সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে ভোরের আজানটা খুব স্পষ্ট শোনা যায় ঠাকুমার ঘর থেকে। আর সেই আজানের সুরই প্রতিদিন ঠাকুমাকে জাগিয়ে দেয় ঠিক সময়ে। ওই আজান মেপেই ঠাকুমা সারাদিনের কাজ গোছায়। মাঝেমাঝে তো এমনও হয় বড়ঘরের ঘড়ির পেন্ডুলাম দুলে উঠলেও ঠাকুমা কান সজাগ করে রাখে আজানের সুরের অপেক্ষায়।
কালরাতেই ঠাকুমা বলে রেখেছিল আজ খুব ভোরে উঠবে। আমি যদি পূজার ফুল তুলতে যেতে চাই, তবে অন্ধকার থাকতেই উঠতে হবে। এ আর এমনকি, আমি প্রতিদিন আলো ফোঁটার আগেই তো উঠে পড়ি। কিন্তু আজ যখন আজান পড়তেই ঠাকুমা বিছানায় বসে শ্রীকৃষ্ণের শতনাম করছিলো, তখন আমি পাশ ফিরে পাতলা কাঁথা জড়িয়ে আরেকটু আয়েশ খুঁজছিলাম।
দিদি, তুমি না হয় ঘুমাও, আমি কলেজের ওদিকে যাবো তো, সে তো অনেক পথ। আমার আয়েশের শখ হুট করে পালায়। ও ঠাকুমা, আজ সাহাপাড়া যাবে না? ঠাকুমা ঘাড় নেড়ে ‘না’ বলে বিছানা ছাড়ে।
আজ মা বাসি উঠোনে গোবরজলের ছড়া ছিটাচ্ছে। কলতলায় কালরাতের বাসন নিয়ে ধুতে বসেছে বড় বৌমা (কাকীমা)। ঠাকুমা আগেরদিন নামিয়ে রাখা কালো পাথরের থালাগুলো বড়ঘর থেকে নিয়ে পেয়ারা গাছের গোড়ায় রাখে।
রান্নাঘরের টিনের বেড়ার সাথে ঝুলতে থাকা অল্প আলোর বাতিটা তখনো জ্বলছে। তবে বড়ই গাছের পাতা উপচিয়ে সাদা হয়ে আসা আকাশের আলো উঠোনে পড়তেই, বাতির আলোটা কেমন হারিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
মনি পিসি ব্রাশ হাতে বড়ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের তালা খোলে। এরপর বারান্দা থেকেই হাত বাড়িয়ে সুইচ বন্ধ করে। আর তা করতেই উঠোনের কোনাকানচিতে গিয়ে অন্ধকার জড়ো হয়। তবে তা ক্ষণিক সময়ের জন্য। দিদি, চলো এবার, দেরি হলে মান্দার ফুল অন্য সবাই নিয়ে যাবে।
ঠাকুমার পেছন পেছন আমি যখন ছুটছি, তখন আকাশের সাদা আলো আস্তে আস্তে দখল করে নিচ্ছে আমাদের সারা উঠোন।
আজ ঠাকুমা চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে দিয়ে জোলাপাড়ায় ঢুকে যায়। জোলাপাড়ার বাড়িগুলোর উঠোনে উঠোনে চরকি। আর সুতো ভরা লাল নীল নলিগুলো বারান্দায় স্তুপ করা। ও ঠাকুমা, আমার পুতুলের জামায় সুতোর ফুল তুলে দেবে বলেছিলে। দেবো দিদি, ঠাকুমা খেজুর চাচার বাড়ি পেরিয়ে যায়। করিম জোলার বাড়ির উঠোনে মুরগীগুলো খোঁপ থেকে বেরিয়ে আসছে। পেছন পেছন ছানাগুলোও। করিম জোলার বাড়ি ছাড়ালেই কলেজের মাঠ। সে মাঠের ওই কোণায় মান্দার গাছ।
গাছের তলায় লাল মান্দার ফুলের ছড়াছড়ি। ঠাকুমা ঠিকই বলেছিলো, সাহা পাড়ার সবাই চলে এসেছে মান্দার ফুল নিতে। আমি ঠাকুমার হাত ছেড়ে দৌড়ে যাই মান্দার গাছের তলায়। লাল কয়েকটা ফুল কুড়িয়ে গলা চড়াই, ও ঠাকুমা তাড়াতাড়ি আসো।
ঠাকুমার ফুলের সাজি আমি মান্দার ফুলে ভরিয়ে দেই সাধ্যমত।
বাড়ি ফিরেই ঠাকুমা মনিকাকুকে দিয়ে বড়ইগাছের নিখুঁত একটি ডাল পেড়ে নেয়। কলাপাতার কচি মাইজ, মান্দার ফুল আর বড়ইয়ের ডাল লাল বারান্দায় এককোণে রেখে ঠাকুমা পেয়ারা তলায় যায়। কালো পাথরের থালাগুলো মাটি দিয়ে মেজে নেয় ঠাকুমা।
আজ সকালের খাবারে গরম ভাতের সাথে ঘি দিয়ে সীম-আলু মাখা আর বেগুন ভাজি।
সবাই খেয়ে নিলো মনিপিসি শুধু খেলো না। ঠাকুমার বানিয়ে দেওয়া তাল মিছরির শরবত খেয়ে বাইরবাড়িতে চলে গেলো।
আজ দুপুরের বাজারে দাদু পাঠিয়েছে নদীর রায়েক মাছ। রূপার মতো চকচকে মাছগুলো উঠোনে রোদ বাঁচিয়ে বরইগাছের ছায়া পোহাচ্ছে।
আজ ছাই মাখিয়ে ঠাকুমাই মাছগুলো কেটে নিলো। উনুনে তখন শেষ শীতের পালং এর সুক্তো।
ঠাকুমা রান্নাঘরে ঢুকতেই মা উনুনপাড় ছেড়ে উঠে এলো। আজ পদের তেমন বাড়াবাড়ি নেই।
পালং সুক্তো আগুন ছাড়লেই উনুনে ওঠে ডাল ছেটানো লাউয়ের ঘন্ট।
এরপরই মরিচ পোড়া ঝোল।
কড়াইয়ের সর্ষের তেল তেতে উঠলেই তাতে গোটা কয়েক শুকনো মরিচ। মরিচ পুড়ে কালো হবার অপেক্ষা করে ঠাকুমা। এরপর তেজপাতা আর রাঁধুনি।তেলে পড়তেই রাঁধুনি ঘ্রাণ ছড়ায়। উঠোনে রোদ পোহানো গেলবারের তিলের গায়ে লেগে যায় সে ঘ্রাণ।
এরপর কড়াইয়ে ছোট করে কেটে রাখা বেগুন দিয়ে অল্পক্ষণ ভাজে ঠাকুমা। তাতে হলুদ, লবণ আর বেটে রাখা শুকনোমরিচ পড়ে। বেগুন আর মশলা থেকে তেল ছেড়ে আসতেই ঘটির থেকে জল ঢালে ঠাকুমা। ফুটে উঠলেই হলুদ লবণ মাখানো রায়েক মাছগুলোর ডুবে যাবার সময় হয়। তবে তা অল্প সময়ের জন্য। একটু পরেই গায়ে অসংখ্য রাঁধুনির দানা মেখে সাঁতরাতে শুরু করে হলুদ রঙ মাখা মাছগুলো।
রাঁধুনি, তেজপাতা আর পোড়া মরিচের ঘ্রাণ উঠোনের বাতাসে দোল খেতে শুরু করেছে।
আর সেই উঠোনেই এঁটেল মাটিতে তিন ধাপের ছোট্ট ভিটে বানাচ্ছে মনিপিসি। পিরামিডের মতো সে ভিটের প্রতি ধাপে ফুল লতা আঁকানো।
ও মনিপিসি, এটা কী ফুল এঁকেছো? পদ্ম ফুল, মনিপিসি শব্দটা বাতাসে ভাসিয়েই ভিটেয় মন দেয়। মনিপিসি মাটির ভিটের সিঁড়ি কাটে, ১৪ ধাপের সিঁড়ি। চারপাশে এঁটেল মাটি দিয়ে লেপে ভিটের মাথায় লাগিয়ে দেয় বরই গাছের ডাল।
মনি স্নান করে নাও, মায়ের ডাকে মনিপিসি আর মাটির ভিটে ছেড়ে কলঘরের দিকে চলে যাই আমি।
আর ওদিকে অল্প ময়দা গোলা পিটুলি দিয়ে ঝোল উনুন থেকে নামায় ঠাকুমা।
আজ লাল বারান্দায় পাত পড়েছে দাদু, আমার আর মনিকাকুর। সবার পাতে পালং এর সুক্তো, ডাল ছেটানো লাউ এর ঘন্ট। এক নিমেষে দাদু আর মনিকাকু তা শেষ করে ফেলে। কিন্তু আমি পারি কই? আমার পাতে লাউ তখনো গড়াগড়ি খায়। ঠাকুমা সবার পাতের কাছে মাছের খাড়া বাটি এগিয়ে দেয়। রাঁধুনির দানা শরীরে লেপ্টে রায়েক মাছগুলো কেমন লাল ঝোলে ভাসছে।
ও ঠাকুমা, আমার মাছ কই?
লাউয়ের ঘন্ট একপাশে সরিয়ে আমি মাছের জন্য পাতে জায়গা করি। পাতে মরিচ পোড়া ঝোলের রঙে ভাতগুলো রঙিন হতেই আমার নাকে ধাক্কা দেয় সেই রাঁধুনির গন্ধ। পাতলা ঝোল গড়িয়ে লেপ্টে যায় সব ভাতের গায়ে।
খাওয়া শেষেও হাত থেকে মুছে যায় না মরিচ পোড়া ঝোলের সেই ঘ্রাণ।
বারবেলা আসতেই মনিপিসি উঠোনে নামিয়ে নেয় মান্দার ফুল আর কালো পাথরের থালাগুলো। সেই থালায় ঠাকুমার বাগানের পাকা পেঁপে, কয়েক টুকরো শশা, কোরানো নারিকেল আর আতপ চালের পাঁচভাগ নৈবদ্য।
মাটির ভিটের চারপাশে পুকুর কেটে তাতে জল ভরে দেয় মনিপিসি। কলাগাছের খোলে মান্দার ফুল আর প্রদীপ ভাসায় সেই পুকুরে। এরপর মনিপিসির পাশ থেকে ঠাকুমা গেয়ে ওঠে,
বট আছেন, পাকুড় আছেন, তুলসী আছেন পাটে । বসুধারা ব্রত করলাম তিন বৃক্ষের মাঝে...
নিভে আসা বেলার আলো তখনো উঠোনে আলতো পড়ে আছে। মনিপিসি মান্দার ফুল পুকুরের জলে ছুঁইয়ে বাড়ির আনাচেকানাচে ছেটায়। কলাপাতার মাইজ দিয়ে ঢাকে পাথরের থালার নৈবেদ্য।
বেলা ডুবে যায়। সন্ধ্যাপ্রদীপ তুলসীতলায় জ্বালিয়ে আমরা সবাই ঘরে উঠি।
উঠোনে মাটির সেই ভিটের চারপাশে তিরতির করে জ্বলতে থাকা প্রদীপগুলো ভাসতে ভাসতে আলো ছড়ায়।
ওদিকে আমার অপেক্ষা বাড়তে থাকে, কখন প্রদীপ নিভে যাবে আর হাতের তালুতে আতপের নৈবেদ্যে আমি পাটালিগুড় খুঁজবো।
বুবুভা তো সম্পাদিত । সেখানে এই সব ভুল "আজ সকালের খাবাড়ে", কিম্বা "তাল মিছড়ির শরবত" থাকা বাঞ্ছনীয় নয়।
আরো আছে:
আলো ফোঁটার আগেই > ফোটার
মুরগীগুলো খোঁপ থেকে > খোপ
পেছোন পেছোন ছানাগুলোও > পেছন
মনিপিসি > মণি পিসি
আতপ চালের পাঁচভাগ নৈবদ্য > নৈবেদ্য বা নৈবিদ্য
মনি স্নান করে নাও, মায়ের ডাকে মনিপিসি আর মাটির ভিটে ছেড়ে কলঘরের দিকে চলে যাই আমি।... আজ লাল বারান্দায় পাত পড়েছে দাদু, আমার আর মনিকাকুর। >>এক বাড়িতে তিন জন মণি? নাকি মেজ সেজ এই হিসেবে মণি? লেখিকা সেই হিসেবে মণি হলে তার ওপরের ভাইবোনেরা কোথায়?
অসম্ভব ভালো একটা লেখার মাঝে এত বানান ভুল বড়োই দৃষ্টিকটু।