তীব্র রোদ বাড়ির উঠোনে খুব বেশী সময় আস্তানা গাড়ে না। কিন্তু তাতে কী? পেয়ারা আর বরই গাছ মিলমিশে যে বানায় হয় তাতে এতটুকু উষ্ণতা কমে না। মাঝেমাঝে তো নিশ্চল ওই বরই গাছটাই বাতাসহীন উঠোনকে যেন আরোও গুমোট করে তোলে।
গুমোট উঠোনে আমি আর ইতু পাঁচগুটি খেলতে খেলতে ঘেমে ভিজে উঠেছি। আখের গুড় ভেজানো জলের গ্লাস হাতে ঠাকুমা। গ্লাসে খোদাই করা অক্ষরগুলো 'স্মৃতিকণা' আমি এর আগেও অনেকবার বানান করে পড়েছি। কিন্তু এখন ওই গ্লাস বা অক্ষরে আমার এতটুকু আগ্রহ নেই। পাঁচগুটিতে আমার দান যে এখন। আমি পাঁচটা গুটি মাটিতে রেখে একটা হাতে নিয়ে অন্যটা হাওয়ায় ভাসাই। আর ছড়া কাটি,
'তেলেটা কামিনী
গুটিকে যামিনী
ও তিনশো টাকা
চারশো দানা
পঞ্চমীটা কানা'
যাহ্, হাওয়ায় ভাসানো শেষ গুটিটা আমার হাতে তো এলো না। ও ঠাকুমা, আমি গুড় ভেজানো জল খাবো না এখন। আমি হেরে যাচ্ছি তুমি দেখছো না? ইতুর দান শুরু হতেই আমি মনে মনে বলতে থাকি, ইতুর গুটিটা হাত ফসকে পড়ে যাক। তা আর হয় কই? দিদি, হারা তে দোষ কোথায়? হেরে গিয়েই তো শিখছো, ঠাকুমা আমাকে প্রায় হাত ধরে টেনে তোলে, গুড়ের জলটুকু শেষ করো, না হলে এই চড়ায় শরীর খারাপ করবে। ঠাকুমার হাতের গ্লাস থেকে ঢকঢক করে মিষ্টি জল খেতে খেতে আমি ইতুকে দেখি। মাথা নিচু করে একমনে হাওয়াই ভাসানো গুটি মুঠোর পুরছে।
ও ঠাকুমা, তুমি ইতুর জন্য আনোনি গুড় ভেজানো জল। আমার কথা শুনে ইতু আরেকটু ঘাড় নুইয়ে গুটি গোছায়। ঠাকুমা আমার কথার উত্তর না দিয়েই চলে যায়। আমি আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমার দানে। দু'দান খেলা না হতেই মনিপিসির ডাক, কলতলা থেকে তোরা দু'জন হাত পা ধুয়ে আয়। ওমা, আমাদের তো খেলা শেষ হয়নি। মনিপিসি তা শুনলে তো, আবার পরে খেলিস; এখন হাত পা ধুয়ে বড়ঘরে আয়। আমি আর ইতু পাঁচগুটি উঠোনে ফেলেই কলতলায় যাই। কিন্তু কলঘরে জলের বালতি আজ ফাঁকা। ইতুর তাতে আনন্দ বেড়ে যায়।
টিউবওয়েলের হ্যান্ডেলে ঝুলে ঝুলে দু'জনের জন্য জল তোলে ও। গুমোট গরমে ঠান্ডা জল পেয়ে আমরা ভুলে যাই মনিপিসির ডাক। দু'জন মিলে জল ছিটিয়ে জামাকাপড় প্রায় ভিজিয়েই ফেলেছি আবার মনিপিসির ডাক, তোরা এখনো আসলি না। এবার বালতি উপুড় করে সব জল কলঘরের ভাসিয়ে আমরা বড়ঘরে আসি। বড়ঘরের লাল মেঝেতে পাটি পেতে বসে আছে মনিপিসি। সিলিং ফ্যানের ঘটাং ঘটাং আওয়াজ কিছুটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে রেডিও থেকে ভেসে আসা গানে,
'আরে ও প্রাণের রাজা,
তুমি যে আমার
কাছে কাছে থেকো
চাই না কিছু আর।'
সুযোগ পেলেই মনিপিসিটা দাদুর রেডিও নিয়ে বসে। ও মনিপিসি, তুমি আবার দাদুর রেডিও ধরেছো? প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মনিপিসি হাতের ইশারায় আমাদের মেঝেয় বিছানো পাটিতে বসতে বলে। আমি ঝট করে বসে পড়লেও ইতু বসে না। বড়ঘরের ঠিক মাঝখানে দাদুর বসার কাঠের চেয়ারের হাতল ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মনিপিসি আমার দিকে একটা কাঁসার বাটি ঠেলে দিয়ে অন্যটা ইতুর দিকে বাড়ায়, যবের ছাতু আর আখের গুড়। ইতু বাটিটা হাতে নিয়ে আমার ঠিক গা ঘেঁষে এসে বসে। আমরা দু'জনে গুড় আর যবের ছাতু জল দিয়ে মেখে খেতে শুরুই করেছি ঠিক তখন ঠাকুমা দু'টো কলা ছুলে তাতে দেয়, চন্দনকবরী কলা ভাল করে মেখে নাও দিদি। আমাদের বাটির ছাতু অর্ধেক না ফুরাতেই আমাদের ক্ষুধা ফুরিয়ে আসে। রেডিও'র পাশে দু'জনের গ্লাস। চোখ পড়তেই দেখি আমার গ্লাসে টলটলে সাদা জল থাকলেও ইতুর গ্লাসে গুড় ভেজানো জল। ঢকঢক করে সেই জল খেয়েই ইতু ছুট লাগায় নিজের বাড়ির দিকে। আর আমি বড়ঘর লাগোয়া বাইরবাড়ির বারান্দা পেরিয়ে ছুটি গোলেনুর দাদীর বাড়ির দিকে।
আজ গোলেনুর দাদীর উঠোনে চড়কায় ববিনগুলো খালি খালি ঝুলছে। দাদীর আজ চড়কি ঘুড়িয়ে সুতায় ববিন ভরার সময় নেই। আজ গোলেনুর দাদীর উঠোনে একটুও আলস্য নেই। সারাবাড়িই আজ খুব ব্যস্তসমস্ত।
আজ সতেরো রোজা। সুমীর দাদাজান পোড়াদহ থেকে কাল রাতেই বাড়ি এসেছেন। হাসনা চাচী উঠোনের এক কোণে ডাল বাটছেন। আর কোহিনুর পিসি তরমুজ এনে বালতির জলে ভিজিয়ে রাখছে। মানুষগুলোর ব্যস্ততায় এ বাড়ির এমন উৎফুল্ল মেজাজ এর আগে কবে দেখেছি মনে করতে পারি না। হাসনা চাচী, সুমী কই? উত্তর আসে রান্নাঘরের ভেতর থেকে, মনি এদিক আয়।
গোলেনুর দাদীর ডাকে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াতেই নাকে ধাক্কা দেয় বেশ অপরিচিত একটি ঘ্রাণ। উনুনের গনগনে আগুনের পাশে গোলেনুর দাদীর ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। কালো লোহাড় কড়াইয়ের বলক আসা জলে ডুমো করা কাটা ওলকচু ফেলেই গোলেনুর দাদী আমার দিকে এগিয়ে আসে। ঠাকুমার জন্য কয়েকটা কাঁচামিঠা আম রাখছি, নিইয়্যা যাস। আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে গোলেনুর দাদীর ঘর লাগোয়া আমগাছটার দিকে তাকাই। আমার চোখ আটকে যায় বারান্দায় জলচৌকিতে বসে থাকা মানুষটার সাথে। লম্বা জোব্বা পড়া মানুষটির দাড়িগুলো কী সুন্দর মেহেদী রঙা। লোকটির পাশে বসে সুমী পোড়াদহের গল্প শুনছে, জানো বু' পোড়াদহে কত্ত বড় মেলা হয়? কত্তরকমের মিষ্টি পাওয়া যায়, জানো? সেসব মিষ্টি কত্ত বড় হয় দেখবা? দু'হাত প্রসারিত করে মানুষটি দেখায় মিষ্টির বিশালতা। দাদাজান, পুতুল পাওয়া যায় না? বড়-কনে পুতুল?
মানুষটি একটু হেসে উত্তর দেয়, পাওয়া যায় তো বু, তোমারে একবার নিইয়্যা যামু মেলায়, তোমার নতুন দাদীও তোমারে দেখতে চায়।
গোলেনুর দাদী হাসনা চাচীরে তাড়া দেয়, বৌ হাঁসের গোশত ধুইয়্যা দাও। উনুন থেকে কড়াই নামিয়ে ওলকচুর জল ঝরায় দাদী। এরপর পরেই খালি কড়াইটি চুলায় বসিয়ে সর্ষের তেল ঢালে। এরপর উনুনের আঁচ বাড়ায়। আগুনের আঁচ উনুনের ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বেরিয়ে কড়াইয়ের চারপাশ ঘিরে ধরে। এরপর কড়াইয়ের তেলে নুন হলুদ দিয়েই আগে থেকে সেদ্ধ করে রাখা ডিমগুলো লালচে করে ভেজে নেয় দাদী। হাসনা চাচী ততক্ষণে গোশত ধুয়ে রান্নাঘরে নিয়ে এসেছে। দাদী একটা মুখ ছড়ানো হাড়িতে গোশতগুলো নিয়ে পেঁয়াজ বাটা, আদা বাটা, অনেকটা রসুন বাটা, জিরাবাটা, ধনিয়া বাটা আর মরিচ বাটা দিয়ে গোশতগুলো হাত দিয়ে খুব কষে কষে মাখায়। এরপর লবণ আর সর্ষের তেল দিয়েও বেশ খানিকক্ষণ মাখায়। হাতের মশল্লাটুকু হাত ধুয়ে গোশতে মিশিয়ে হাঁড়ি উনুনে দেয়। ঢাকনা নামিয়ে কিছুক্ষণ পরপর নেড়েচেড়ে গোশত কষাতে থাকে। মশলা আর তেল আলাদা হয়ে গেলে দাদী সেদ্ধ ওলকচুগুলো গোশতে মেশায়। আবার একটু জল দিয়ে নেড়েচেড়ে কষাতে থাকে। ওলকচু আর হাঁসের গোশতের মিলমিশে অদ্ভুত অচেনা এক সুঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা দিতেই গোলেনুর দাদী ভাজা ডিমগুলো হাঁড়িতে ফেলে দেয়। এরপর দেরী না করেই গরমজল ঢেলে দেয় গোশতে। টগবগ করে ফুটত থাকে হাঁস-ওলকচুর সালুন। নামানোর আগে অনেকটা বাটা গরম মশল্লা মেশায় তাতে দাদী। আর হাঁড়ি নামিয়ে মেশায় ভাজা জিরার গুড়া।
গোশতের হাঁড়ি নামতেই ওঠে আরেকটি হাঁড়ি। ও দাদী, আর কী রান্না করবা? পানখাওয়া লাল ঠোট দুটোয় একটু হাসি ছড়িয়ে পড়ে, সুমীর দাদাজান বুটের ডালের খিচুড়ি পছন্দ করে গোশতের সাথে। দাদী ভেজানো বুটের ডাল হাত দিয়ে কচলিয়ে ধোয়া শুরু করতেই মনিপিসির হাঁক, মনি আয় চান করবি।
আমি গোলেনুর দাদীর দেওয়া কাঁচামিঠা আম নিয়ে বাড়িতে এসেই সোজা ঠাকুমার কাছে চলে যাই। ও ঠাকুমা, সুমীদের বাড়িতে আজ কত ভাল ভাল রান্না হচ্ছে, তুমি বুটের ডালের খিচুড়ি রাঁধতে পারো? কেন গোলজার ভাই আসছে? প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন পেয়ে আমি উৎসাহ হারাই। কে গোলজার, চিনি না তো।
দুপুরের স্নান করে ভাত খেয়ে ভাতঘুম দিয়ে উঠতেই ঠাকুমা একবাটি যবের ছাতু আমার হাতে ধরিয়ে দেয়, গোলেনুর দাদীকে দিয়ে আসো, গোলজার ভাই ইফতারে ছাতুর শরবত খায়।
আমি কাঁসার বাটি ভরা যবের ছাতু নিয়ে যখন গোলেনুর দাদীর উঠোনের ঠিক মাঝখানে, তখন বাজার থেকে সুমী ওর আব্বার সাথে বরফের চাই নিয়ে ফেরে। আমি গোলেনুর দাদীর হাতে ছাতুর বাটি দিয়ে বাড়ির দিকে ফিরি। আমার পেছনের বাতাসে ভাসতে থাকে,
লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহু লা শারীকা লাহু
লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হামদূ...
খুব ভালো লাগছে আপনার লেখা। ছবিটাও কি আপনারই করা?
ছবি লেখিকারই।
হাঁসের মাংস বহুবার খেয়েছি। তবে এমন পদ্ধতিতে রান্না নয়। সাদামাটা মাংস রান্নার পদ্ধতিতেই। আনাজপাতি দিয়ে মাংস রান্নার বিষয়ে অভিজ্ঞতা প্রায় নেই বললেই চলে। বাঙাল হওয়া সত্ত্বেও। একমাত্র পেঁপে দিয়ে ছাড়া। মায়ের কাছে শুনলাম, খুড়তুতো দাদু ও মামারা শিমের বীজ দিয়ে পায়রার মাংস রাঁধতেন। লেখাটা বেশ লাগল।
দেশজ রান্নার পদ্ধতি এক জায়গায় করতে পারলে ভাল লাগবে। নিরামিষ রান্নার বৈচিত্র বিশাল। দুই বাংলা তো বটেই ত্রিপুরা, অসমও ধরতে হবে।
দারুণ রেসিপি। আর তা স্মৃতি দি' লিখেছেনও চমৎকার আয়োজনে। খুব ভালো লাগলো।
খুব ভালো লাগছে এই লেখা .
বেশ ভালো লাগলো।
এগুলো শুধু রান্না নয়, টুকরো টুকরো ছোটবেলা র স্মৃতি চোখের সামনে একদম ছবির মতো তুলে ধরা।
দারুন।
শুধু শৈশবের স্মৃতি না সাথে একটি সুন্দর গল্প আর অসাধারণ রেসিপি । পড়ে অনেক ভালো লাগল ।
এইযে গ্রামে থাকা লোকগুলো সেই সময়ে জাত -পাত হিন্দু মুসলমান , ছোয়া ছুঁয়ি ।..এইসব জানতো না কি জিনিস ।..এই যে মানুষ কি অসম্ভব সরল প্রাণ ছিল।.. সুন্দর , শান্তিপূর্ণ জীবন ।.নেই কোনো বিজ্ঞানের খবরদারি ।..নেই কোনো মানুষের বেপরোয়া গিরি ওনারা প্রকৃতির কোলে নিরীহ শিশুর মতো "খেলিছ , এ বিশ্ব লয়ে ""..কেন ??কোথায়?? কি কারণে শেষ হয়ে গেলো ।.বা কে শেষ করে দিলো ??এই প্রশ্ন মনে আসছে বার বার !!
সুনন্দা শিকদারের দয়াময়ীর কথা প্রথম যখন পড়ি, কি অসম্ভব ভালো লেগেছিলো। ঠিক একই রকম অনুভুতি হচ্ছে আপনার এই লেখা পড়ে। কি নরম মায়াময় লেখা, অসাধারন!
লেখাটার সব কটি পর্ব পড়ছি। আমি নানা রকম রান্না করতে ভালবাসি। হাাঁসের মাংস এবার পেলে এভাবে করে দেখব। আমার এক সহকর্মীর কাছে শুনেছি লাউ দিয়ে গরুর মাংস রাঁধার কথা। সে না কি অপূর্ব হয় খেতে।
এক্কেবারে ঠিক লেখাগুলি থেকে দয়াময়ী , সরলাবালা দেবী, পূণ্যলতা দেবীর সুবাস আসে