(১)
ফ্যাশান ম্যাগাজিনটিতে পুরো ডুবে গিয়েছিলেন, তাই গাড়িটা গেইটের কাছে এসে যখন ধাক্কা খেল, তিনিও গাড়িটার সাথে শরিক হলেন, দু'জনে মিলে কিছুক্ষণ ভীষণ দুলে যখন থামলেন, তখন দু'জনেরই জল গড়িয়ে পড়ছে শরীর থেকে। অচিরেই দালানের ভিতর থেকে আসা একটা কানে তালা দেয়া আওয়াজ সেই জল পড়া থামিয়ে দিল। একই সঙ্গে তার স্বয়ংক্রিয় হৃদপিণ্ডটাও যেন থেমে যাওয়ার উপক্রম হল! ড্রাইভার আবুল একটুখানি ঘুরে এসে তা-ই জানালো যা তিনি আগেই জানতেন। দুইদিন পরপরই বদমাশগুলির মাথায় কী একটা কিরকিরা উঠে আর বেতন বাড়ানোর জিকির তুলে কা কা করতে থাকে সমস্বরে!
“কী মনে করে ওরা! টাকার কোন মা-বাপ নাই! টাকা-পয়সা সব বলদের গুয়া দিয়া বাইর হয়!” আপন মনে বিড়বিড় করতে থাকেন আশফাক সাহেব মানিব্যাগটাতে হাত বুলাতে বুলাতে। অথচ ওখানে মানির কোন ছিটেফোঁটাও নেই! আগে দু’চার পয়সা যাও রাখতেন, এখন তাও উধাও। দেখেছেন পয়সা থাকলেই ভিক্ষুকেরা কেমন করে যেন খবর পেয়ে যায় আর ভিড় করে মনোযোগের বিঘ্ন ঘটায়। মানিব্যাগটি এখন পুরো কার্ডের দখলে। গোল্ড, প্রিমিয়াম, সিগনেচার, ডেবিট, ক্রেডিট সহ আরো কত কার্ড যে ঠেসাঠেসি করে ঘর করছে ওখানে, তার হিসেব আশফাক সাহেবেরও কাছেও নেই পুরো!
হঠাৎ চায়ের তেষ্টা পেল আশফাক সাহেবের। কিন্তু চা নেই এখানে, চিৎকার আছে! চায়ের জন্য ছটফট করতে করতে মুত ধরে গেল তার। ইদানীং এমন হচ্ছে আশফাক সাহেবের; জল যোগের সাথে জল বিয়োগের সংকেত পৌঁছুচ্ছে তার ব্রেইনে আর তার ক্রম-উড্ডীয়মান ভূরিটাকে ঝালমুড়ির পটটার মত ঝাঁকাচ্ছে!
‘বলে দাও, অর্ডার পড়ে গেছে। সময় ভাল না। সামনের সিজনে অর্ডার বাড়লে বিবেচনা করা হবে। ‘ম্যানেজারের প্রতি ফোন অর্ডারটা রেখে আবার ম্যাগাজিনের পাতায় চোখমুখ ধুতে যাচ্ছিলেন, ড্রাইভার আবুলের শীতল কণ্ঠ হঠাৎ কথা কয়ে উঠলো, ‘অহন কই যাইবেন স্যার?’
‘কই যাব মানে? আমার চেম্বারে যাব। গাড়ি ঢোকাও।’ বলেই আবার উঁকি দেন ম্যাগাজিনটার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনটায়। এক উঠতি মডেল কন্যার এক্সক্লুসিভ ফটো রয়েছে অনেকগুলো।
কিন্তু ড্রাইভার হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকে। তার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে গাড়িও নড়ে না, আশফাক সাহেবও শরীরে ইঞ্জিনের ভাপ পান না। আবুলের স্পর্ধা দেখে হতবিহবল হয়ে যান আশফাক সাহেব। সেও তাহলে যোগ দিয়েছে ওদের দলে?
‘যেকোনো কিছু ঘটতে পারে, বাইরে থাকাই ভাল হইব, স্যার’, হঠাৎ করেই নীরবতা ভাঙে আবুল। মনে হয় স্যারের মনের কথা টের পেয়ে গেছে সে।
একটা হুংকার ছাড়তে গিয়েও সামলে নেন আশফাক সাহেব। আসলেও যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। পিস্তল রাখেন গাড়িতে একটা, কিন্তু তাও তো আবুলই চালাবে বলেই, অনেক প্র্যাকটিস করেও আঙ্গুলের কাঁপাকাপি বন্ধ করতে পারেননি তিনি। কখন গুলি বেরিয়ে সোজা তার নাকে ঢুকে, সেই ভয় থেকেই কিনা, কেনার মাস তিনেকের মধ্যেই আবুলের হাতে সোপর্দ করেছেন পিস্তলটাকে।
‘কি করবে? আর কেনই বা করবে? ওদের তো বলা হয়েছেই বাড়ানো হবে, ডিল তো হয়েই গেল, আবার কি!’ কণ্ঠস্বরকে মিহি সুতোর মত তুলতুলে করে ওড়ান আশফাক সাহেব।
“কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত তো ওগো বাঁইচা থাকতে হইব, স্যার; সব কিছুর দাম ডাবল হইয়া গেছে।”
“দাম ডাবল করলে বাসার খরচ অর্ধেক করে দিতে হবে! কম খেলে কি মানুষ বাঁচে না? আমিও তো খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি অনেক দিন ধরে। কই তারপরও তো বডি কমাতে পারছি না এক ইঞ্চিও!” বিড়বিড় করতে করতে থেমে যান আশফাক সাহেব, নিজের ফুলে উঠা শরীরটা দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় তার!
আগেও খেয়াল করেছেন বিষয়টা। বেশি রাগ আর উত্তেজনার সময়, হঠাৎই অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে যায় মাথাটা, আর মারাত্মক সব আইডিয়া পয়দা হতে থাকে সেখানে। আজ যখন তার গার্মেন্টসের বাউন্ডারি ওয়ালের বাইরের থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুতছিলেন, তখন আশেপাশের পথচারীদের দিকে একবারও তাকাচ্ছিলেন না, বরং মন দিয়ে চিন্তা করছিলেন। একটা কাজ করলে হয়, জার্মান ফার্মটার অফিসে ঢুঁ মেরে আসা যায় এই ডামাডোলের বিরতিতে। দু'বছর আগে থেকেই ওদের একটা প্রস্তাব ছিল। পুরো ফার্ম রোবোটাইজড করার। তখন আমল না দেয়াই ভুল হয়েছে। রোবট দিয়ে এই লেবারগুলোকে আগাপাছতলা তুলে ফেলতে হবে। তখন সব কিছু গোছানো আর পরিকল্পিত থাকবে, সারাজীবনই একটি সিস্টেমেটিক সমাজ কামনা করেছেন তিনি। হয়ত ম্যালা টাকার দরকার পড়বে প্রথমদিকে, কিন্তু তারপর তো রিটার্ন আসতে শুরু করবে বন্যার স্রোতের মত! এই অবাধ্য জীবদের পেছনে আর একটা টাকাও খরচ করবেন না তিনি, থাকুক ওরা রাস্তায় পড়ে!
(২)
কয়েক মাস পরের কথা। পুরো ফার্ম স্বয়ংক্রিয় করার কাজ সম্পন্ন হয়েছে; আজ একটা সংবাদ সম্মেলন করে সারা দেশকে জানানো হবে এই কৃতিত্বের কথা। আবুলকে সাতসকালেই বললেন অফিসের পথে গাড়ি ছুটাতে। আবুলকে রেখেছেন এখনো, যদিও উল্লুকটা জানে না, তাকেও রিপ্লেস করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। খুব খুশী খুশি লাগছে আশফাক সাহেবের, অচেনা খুশবু ছুটে বেড়াচ্ছে তার রক্তকণিকায়, আর তার ফিডব্যাক দিতেই যেন গোঁফে তা দিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত বিরতিতে। আজ আর ম্যাগ- মডেলে মনোযোগ দিতে পারছেন না। বরং বারবার ভেসে উঠছে সম্মেলনের দৃশ্যগুলো, সাংবাদিক, ক্যামেরার ফ্ল্যাশব্যাক!
কিন্তু বিধি বাম! অফিসটার কাছে আসতেই আটকে গেলেন। রাস্তা ভর্তি মানুষ, নিঃশব্দে মরার মত পড়ে রয়েছেন। কারো কারো দেহ বিকৃত আকার ধারণ করেছে, ঘা পাঁচড়া, রক্ত, পুঁজ, জীবাণু –গা গুলিয়ে দেয়া দৃশ্য! সমস্যা হল, লোকগুলো এমন করে জুড়ে আছে রাস্তায় যে তাদের ডিঙ্গিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আবুল গাড়ি থামিয়ে ঘুরে এসে খবর দিল, লোকগুলো আর কেউ না, তাদেরই কোম্পানির ছাঁটাই করা কর্মচারী, তবে অনাহারে-অর্ধাহারে তাদের এমন অবস্থা হয়েছে যে চেনা সম্ভব না! কথাটা শুনে আশফাক সাহেব মুখটা এমন বাঁকালেন যে, রাস্তা দখল করে থাকা লোকগুলির থেকেও বেশি বিকৃত দেখাল। বিরক্তিতে তার কপালের রগ, মাথার চুল, হাতের আঙুল সব দাঁড়িয়ে গেছে! উজবুকটাকে কে দায়িত্ব দিয়েছে রাস্তার লোকগুলো কারা, তা চিনে আসতে! আহ্, রিপ্লেস না খুঁজে যদি আবুলটাকেই অটোমেশন করে ফেলা যেত! সেক্ষেত্রে সুইচটা টিপতেন কেবল তিনি, আর ও থেমে যেত, যাকে তাকে চিনতে হত না!
“স্যার একটা উপায় আছে, ওগোরে হাসপাতাল নিয়া যাওন যায়। তাইলে রাস্তা ক্লিয়ার হইয়া যাইব। “প্রায় থাপড়ে উঠেছিলেন আশফাক সাহেব; কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই কিছু সাংবাদিককে দেখতে পেলেন, স্টোরি কাভার করতে এসেছে। নাহ, একদম খারাপ কয় নাই বলদডা। লোকগুলোকে সত্যি সরান দরকার এখান থেকে! নাহলে সাংবাদিকগুলা সরবে না, আর তার অনুষ্ঠানও ফ্লপ মেরে যাবে! নেংটা পেলে সাংবাদিকগুলার মাথা ঠিক থাকে না!
আশফাক সাহেবের আবার পিষু পেয়েছিল, কিন্তু আজও তিনি অফিসের খানদানি টয়লেটে যেতে পারলেন না। রাস্তাটার কোনায় ছিল একটা বড়সড় ডাস্টবিন, তার চিপাতেই কাজটা সারতে সারতে ড্রাইভারের কাজকর্ম লক্ষ্য করছিলেন! নাহ্, আবুলের রিপ্লেসমেন্ট দরকার নেই। সে নিজে থেকেই একটা হাই ডেফিনিশন অটোমটেড প্রডাক্টে রূপান্তরিত হচ্ছে দিন দিন! কী অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ম্যানেজ করে ফেলল অ্যাম্বুলেন্স। যাদের অ্যাম্বুলেন্সে কুলোলো না, তাদের সিএনজি চালিত ক্যাবে; আর যখন ক্যব ফুরিয়ে গেল, তখন বসিয়ে দিল রিকশার গাদায়।
ক্লান্ত-শ্রান্ত আবুল অবশ্য দিন শেষে একটা বিশাল ফর্দ নিয়ে এসে দাঁড়ালো সামনে। ফর্দটার দিকে নজর বোলানোর পর চোখ-মুখ গুড়ের থেকেও শক্ত হয়ে গেল আশফাক সাহেবের, রগগুলি ফুলতে শুরু করল দলবেঁধে। হারামাজাদা এ করেছে কি! রাস্তার লোকগুলোর চিকিৎসার বিল, ওষুধ খরচ, তাদের বহন করা ভাড়াটে যানবাহনের বিল, আর সাথে লেজ হয়ে জুড়ে বসেছে জরুরী সেবার অতিরিক্ত চার্জ। এছাড়া আছে রোগীদের সঙ্গে থাকার জন্য অন্য যে লোকগুলোকে ভাড়া করা হয়েছে, তাদের ক্লেইম। এদিকে যানবাহন আর লোক ভাড়ার দায়িত্ব নিয়েছিল আরো কিছু লোক, তাদেরও দাবী আছে ন্যায্য পারিশ্রমিকের! সব শেষে, এত কিছু তদারকি করার জন্য নিজের জন্যও একটা মোটা অংকের দাও বাগিয়ে ধরেছে শয়তানটা! আশফাক সাহেবের করোটির নীচে লাভা জ্বলছিল দাউ দাউ করে। অনেক কায়দা করে পাকানো ঘুষিটা যখন ছুঁড়তে যাবেন, তখন তার মাথাটা আবার ঠান্ডা হয়ে এলো! আর তো মাত্র কটা দিন, তারপরেই আবুলবিহীন জীবনে প্রবেশ করবেন তিনি, তাই শেষ সময়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে নিজের ভোকাল কর্ড নষ্ট করা বেকুবি হবে!
ভাবতে ভাবতে ফের পকেটে হাত চলে যায় আশফাক সাহেবের। যদিও তার টাকা পকেট আর বাসার ট্রাঙ্কের মায়া ত্যাগ করে অনেক আগেই পাড়ি জমিয়েছে ব্যাংক ভল্টের নিরাপদ পোতাশ্রয়ে, কিন্তু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে তার! রোবট গড়তে গিয়ে কাড়িকাড়ি টাকা খুইয়েছেন তিনি। লাভ উঠে আসতে কমছে কম ৩ বছর - তার চিফ একাউন্টেন্ট হিসেব করে দেখিয়েছিল। কিন্তু তাও তিনি সাইন করে দিয়েছিলেন ক্রয় আদেশটিতে! তার চোখজুড়ে তখন একটাই স্বপ্ন -বেতন বাড়ানোর হাঁকডাক আর শুনতে চান না এই জীবনে! তার সারা শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় শ্লোগানটা!
“স্যার এত করলেন, কিন্তু মানুষ জানল না, তা কেম্নে হয়?” - বিল পরিশোধ বাবদ একটা বড়সড় চেক সই করিয়ে নিতে নিতে বলে আবুল। পুরোটা যদিও সে বলে না, আশফাক সাহেবের বুঝতে কোনই সমস্যা হয় না। আর সুন্দর একটি পরামর্শ দেয়ার জন্য নিমিষেই ক্ষমা যায় আবুল।
পরদিন সব পত্রিকায় তার ছবি আসে, সঙ্গে তার স্বপ্ন - কোথাও ফ্রন্ট পেইজে, কোথাও ব্যাক পেইজে - তার কমিটমেন্ট স্বয়ংক্রিয় একটি সমাজ গড়ার জন্য, যা এনে দেবে স্থিতিশীলতা, উন্নতি হবে নিরবচ্ছিন্ন ও অবাধ! রাতের মধ্যে চলে আসে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার লোকজন, প্রিন্ট মিডিয়ার মত সেখানে অবশ্য ব্যাক বা ফ্রন্ট নেই, প্রাইম বা সাব প্রাইম আছে।
নিজের কথাগুলো বারবার পড়তে ও শুনতে চেয়েছিলেন আশফাক সাহেব, কিন্তু হঠাৎ করেই যেন পেটটা ফুলে উঠতে শুরু করে। কমোডে বসেও হাঁসফাঁস করছিলেন, কিছুতেই ক্লিয়ার হচ্ছিল না। আবুলকে একটা ভাল ডাক্তারের অ্যাপোয়েন্টমেন্টের কথা বলতে হবে। আবুলের নাম মনে আসতেই নিউজ আর ছবিগুলো জাবর কাটতে থাকে তার মস্তিষ্কে, আর এই ফাঁকে পেটের বজ্জাতগুলি হুড়হুড় করে বেরিয়ে পড়ে! সেদিকে তাকিয়ে খুশী হয়ে উঠেন আশফাক সাহেব, সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্তটা পাকা করে ফেলেন, আবুলকে রোবট দিয়ে রিপ্লেস করবেন না। আবুল তার গাড়ি চালায় বটে, কিন্তু কাজগুলি কি নিখুঁত ভাবেই না করেছে, একদম খাপে খাপে, নিয়ম মাফিক, যেমনটা তিনি ভালবাসেন!
পরদিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠেই চোখে পড়ে একটা নতুন ফর্দ, আগেরটির থেকেও চওড়া দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে। বেশি রেগে গেলে তার ভ্রু কুচকে যায়, নাকটা ফুলে খুব বোকা দেখায়, আর ঠোঁট ঠকঠক করতে থাকে! বোকা মূর্তিটা এড়ানোর জন্য তখন নিজের চোখ, নাক আর ঠোঁটের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনে যে প্রাণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হন তিনি, আজও তার ব্যতিক্রম হল না। অসম যুদ্ধটা তার মুখটা এমন কিম্ভূতকিমাকার তুলল যে আবুলের পক্ষে তার পাঠোদ্ধার একেবারেই সম্ভব হল না, এবং তার বাকযন্ত্র স্বয়ংক্রিয় মেশিনের মত ভটভট করে যেতে লাগলো, “স্যার, ওরা তো সবগুলাই ব্যাক পেইজ আর সাব প্রাইমে ফালাইতে চাইছিল। আমি কইলাম, যত লাগে টাকা লাগুক, আমার স্যার ব্যাক বেঞ্চে থাকার লোক না।”
(৩)
কয়েকদিন বাদে একটা গা হিম করা চিৎকার শুনে দৌড়ে এলো স্যারের চেম্বারে আবুল। আশফাক সাহেবে প্রায় গলা টিপে ধরেছিলেন চিফ একাউন্টটেন্টের। তার নিট সম্পদ না কি অবিশ্বাস্য গতিতে জাম্প করছে, তবে উপরে দিকে না গিয়ে সে নীচের দিকে নাবছে আর শীঘ্রই ভূপাতিত হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যখন নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করা ছোকরাটা দশ নাম্বার বিপদ সংকেতের চার্ট হাতে দাঁড়িয়েছিল, সাইক্লোনের বেগে তেড়ে গিয়েছিলেন আশফাক সাহেব তার দিকে, আবুল না থাকলে ঘূর্ণিস্রোতে তলিয়ে যেত এতক্ষণে! ছোকরা চলে যাওয়ার পর আবুল এসে দাঁড়াল তার স্যারের পাশে যিনি একটার পর একটা সিগারেট ধরিয়ে যাচ্ছিলেন আর মুখের সঙ্গে নাক, কান ও চোখ দিয়েও ধোঁয়া বের করছিলেন।
কিছুটা মুহূর্ত কেটে গেলে আবুল কম্পিত কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘আমাগো একটা ব্যাংক লোন করতে হইব স্যার অহন। “আশফাক সাহেব এতটাই নিমজ্জিত ছিলেন যে একবার শুধু তাকালেন, ‘আমাগো’ শব্দটা তাকে কিছুটা কৌতূহলী করে তুললেও মুখ থেকে শব্দ বের করতে ব্যর্থ হল। কিন্তু আবুল থেমে থাকল, তার বাকযন্ত্রটা গমগমে আওয়াজে সিগারেটের ধোঁয়াকে টেনে ধরতে লাগল, ‘ব্যাংক লোন পাওয়া অন্য মাইনসের জন্য কঠিন হইলেও আপনার জন্য বেফার হইব না, স্যার! তয় ব্যাংকারগো ক্রাস করার লাইগা মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণী একটা কাম করলে ভাল হয়, স্যার। যদি একটা ডোনেশান পার্টি করা যায়…”
আশফাক সাহেব হাতের আধখাওয়া সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে এবার ভাল করে তাকান আবুলের দিকে। যতই দেখছেন অবাক হচ্ছেন। একটা আয়ে ফেল করা ছেলে, কিন্তু কথাবার্তা সব ব্রিটিশ ডিপ্লোম্যাটদের মত, সিস্টেমেটিক, প্রিপ্ল্যানড। নাহ্, আবুলকে রেখে দেবেন তিনি, ওর রক্তে মিশে আছে রোবটের গুণাবলী!
বেশিদিন না, মাত্র সপ্তাহখানেকের মধ্যেই স্যারের আস্থার প্রতিদান দেয় আবুল - একটি আড়ম্বরপূর্ণ পার্টির মধ্যমণির আসন অলংকৃত করতে দেখা যায় আশফাক সাহেবকে। সত্যিকারের ডিপ্লোম্যাট, বিভিন্ন দেশের ও আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠীর – গিজগিজ করছিল পার্টি সেন্টারটিতে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে যেসকল মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, তাদের নিয়ে দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে প্রায় শতাধিক এনজিও। তারা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছেন আশফাক সাহেবের মঞ্চের সামনে। চেকের ডালা থেকে যখন একটি একটি করে তুলে দিচ্ছিল আবুল, আশফাক সাহেবের হাতটা প্রায়ই চলে যাচ্ছিল নিজের পাদদেশে! সেখানে ছিল তার মানিব্যাগটা, আর তার পেছনে এক স্পর্শকাতর মাংসপিণ্ড – দুটোতে মিলে এমন এক স্বয়ংক্রিয় পাঁক দিতে শুরু করেছিল যে, এক পর্যায়ে অনুষ্ঠানটা আবুলের হাতে ছেড়ে দিয়ে হলের কোনায় অবস্থিত চৌকো টাইলস ঘরটিতে আশ্রয় নিলেন তিনি!
(৪)
ডোনেশান পার্টি সত্যিই সাড়া ফেলে দেয়। রাতারাতি স্টার বনে যান আশফাক সাহেব। একদিন আবুল হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে তার কক্ষে। ইতোমধ্যে আবুলের পদোন্নতি ঘটেছে, স্বেচ্ছাসেবী থেকে বেতনভুক-সেবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে এখন সে। তার হাতে পোরা থাকে আশফাক সাহেবের সার্বক্ষণিক নির্ঘণ্ট, সে বাহিরের দুনিয়ার সাথে আশফাক সাহেবের লিংক হিসেবে কাজ করে। এই মুহূর্তে সরকারের এক ডাকসাইটে নেতা রয়েছেন আবুলের হাতে ধরা ফোনের অপর প্রান্তে। ফোন ধরার সময় যে মুখখানা ছিল সাদা মেঘের ভেলা, তা-ই নিকষ কালো হয়ে গেল ফোনটা রাখার পর, সঙ্গে হাতটাও স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পতিত হল পকেটে। একটি অটোমেটেড সোসাইটির পথে দেশকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানান লিডার। কিন্তু এই ট্রেন্ড অনুসরণ করে সারা দেশে যে হারে শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে, তাতে নীরব দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে সর্বত্র। ঝুঁকি না নিয়ে এখন থেকেই একটি ফান্ড গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে! আশফাক সাহেবের কাছ থেকে কিছু কন্ট্রিবিউশান আশা করা হচ্ছে সরকারী দল থেকে, সেক্ষেত্রে পরবর্তী নির্বাচনে নিশ্চিত মূল্যায়িত হবেন তিনি।
“এইডাতো খুশীর খবর, স্যার, আমাগো এতদিনের কামের স্বীকৃতি!” আবুলের ডগমগ মুখখানার দিকে যখন প্রশ্নচোখে চাইলেন আশফাক সাহেব, তখন আবার আর্তনাদ করে উঠলো আবুলের হাতে ধরা ফোনটা – বিরোধী দলের নেতা। একটা ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে ভেসে এলো ওপার থেকেঃ “আশফাক সাহেব, একটি স্বয়ংক্রিয় সমাজ গড়ে তোলায় আপনি জাতিকে যে পথ দেখিয়েছেন, তার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসে। কিন্তু যে লোকগুলো পথে বসেছে, তাদের পুনর্বাসনে কিছুই করছে না সরকার। জনতা ফুঁসে উঠেছে! আপনার মত বিত্তবানেরা পাশে থাকলে, এই লোকগুলিকে নিয়েই আমরা দুর্নীতিবাজ সরকারকে গদি থেকে উৎখাত করতে সক্ষম হব। আর একটা সুখবর দিচ্ছি, আগামী নির্বাচনে আপনি প্রার্থী হচ্ছেন আমাদের দল থেকে। ইতিমধ্যেই আমাদের নমিনেশান বোর্ড চূড়ান্ত করেছে বিষয়টি।”
ফোন শেষে ধপাস করে পড়তে যাচ্ছিলেন সোফার ফোমভর্তি গাদাটায়, ধরে ফেলল আবুল, তারপর বিছানাটায় শুইয়ে দিয়ে আশফাক সাহেবের শিয়রে আস্তে আস্তে পাড়তে লাগল “স্যার, উনারে ফেরানো ঠিক হইব না। বলা যায় না, আবহাওয়া কোন দিকে যায়। আর তাছাড়া, সরকারি দল খালি মূল্যায়নের কথা কইছে, অন্যদিকে বিরোধী দল টিকিট হাতে ধরায় দিছে। হাতের মইদ্যে দুইডা কার্ডই রাখা দরকার আমাগো, যদি শেষমেশ সরকারী দল পোল্টি লয়, তয় তুরুপ করবার পারবেন, স্যার!”
আশফাক সাহেব কোন উত্তর দেন না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। আবুলের বাকযন্ত্র এরপর দামামা ছড়াতে থাকে ক্রমশ, “স্যার, টাকা নিয়া ভাইবেন না! ব্যাংকগুলাতে গেলে এখন জামাই আদর করবে আপনেরে। আর সিকিউরিটি চাইলে আপনার এত্ত বড় বাড়িডা তো পইড়াই আছে।” পকেটটায় হাত রাখতে রাখতে প্রমাদ গুনলেন আশফাক সাহেব, ইতোমধ্যে অফিসের জায়গা সম্পত্তি বন্ধক দেয়া আছে ব্যাংকে, রোবট প্রজেক্টের অর্থায়নে। এখন বাড়িটাও বাঁধা পড়বে? কিন্তু আবুল যে সূত্র দিয়েছে, তাতে তো এক বাড়ি দিয়েই বাজিমাৎ হবে, শত শত বাড়ি দৌড়ে আসবে তার কাছে! নির্বাচনের টিকিটটা বাগাতেই পারলে আর কি চাই!!
(৫)
নির্বাচন ঘনিয়ে এলো, কিন্তু তার আগেই ব্যবসায়িক ঋণে দেউলিয়া ঘোষিত হলেন আশফাক সাহেব। আর দেউলিয়া হলে তো নির্বাচন করা যায় না, ফলে টিকিট মিলল না কোন দলেই। নির্বাচন শেষ হওয়ার আগে বাড়িও হারালেন। এরপর আশফাক সাহেব তাকালেন আবুলের দিকে। আবুল নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “চিন্তা নাই স্যার, চলেন আমার লগে, আল্লাহর দুনিয়ায় একটা ব্যবস্থা হইবই আফনের। আল্লাহ কারো ফালায় রাখে দেখছেন কহনো?”
এরপর আবুল একটি বড় ভবনের গেটে প্রবেশ করিয়ে দিল আশফাক সাহেবকে। ঢুকে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আশফাক সাহেবের! একটা বিশাল গার্মেন্টস কারখানা। গিজগিজ করছে শ্রমিক। আশফাক সাহেব বিস্মিত নয়নে তাকালে হাসিমুখে বলল আবুল, “চিন্তা নাই, স্যার, ম্যানেজাররে আগেই কইয়া রাখছি আফনের ব্যাপারে। আফনের ভাগ্য ভাল, আমার কোম্পানির ফোরম্যানের পোস্টটা খালি হইসে কয়দিন হইল!”
প্রবল একটা ঝাঁকুনি খেয়ে পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিলেন আশফাক সাহেব! এরপর কারখানার সদর দরজা লক্ষ্য করে অনেকটা হাঁটার পর হঠাৎ কি মনে করে পিছু ফিরলেন তিনি!
“তোমার কোম্পানিতে সব মানুষ দেখছি, আবুল! কোন স্বয়ংক্রিয় শ্রমিক নিয়োগ কর নাই?” পকেটের মানিব্যাগে স্বয়ংক্রিয় হাতটা বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করেন আশফাক সাহেব, আজ সেটি পুরোই গড়ের মাঠ, এমনকি কোন কার্ডটার্ডও নেই!
“রোবট মানুষের থাইকা বেশি কাম করবার পারে সত্যি, কিন্তু আমি চাইলেই মানুষরে থাবড়াইবার পারি, রোবটরে পারি না, তাই কোন রোবট রাখি নাই, আশফাক সাহেব।” বলে হাসতে হাসতে নিজের বিশাল চেম্বারটাতে ঢুকে পড়ে আবুল।