সিলিং-এর দিকে গত এক ঘন্টা ধরে তাকিয়ে আছি, অ্যালার্মটা বেজে যাচ্ছে। এই নিস্তব্ধ সকালে অ্যালার্মের শব্দটাই একমাত্র সঙ্গী। কেউ কোনোদিন মনে হয় ভেবেও দেখেনি, ক্লাস এর সবচেয়ে বাচাল মেয়েটা ১২ বছর পর এক ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে পড়ে থাকবে, কথা বলা ভুলে যাবে।
শেষে উঠলাম, ঘড়িতে ৫টা বাজে, স্নান করতে করতে সময়ের কথা ভুলে গেলাম, বেরিয়ে দেখি ৬টা বাজে, অস্বাভাবিক কিছু না, আমার প্রায় প্রতিদিনই এত সময় লাগে। গত কালের ডিনার লাঞ্চ বক্সে নিয়ে, বেরিয়ে পড়লাম, চাকরি করতে মোটেও ভালো লাগে না। মানুষ দেখতেও আজকাল ইচ্ছে করে না, করোনার জন্য এখন সবাই দুটো মুখোশ পরে, আগে একটা পরত। শীত কালে এখানে বেশি বরফ সাধারণত পড়ে না, কিন্তু এবার সব কটা স্ট্রিট ধবধবে সাদা, সূর্যের আলোয় চিকচিক করছে। এদেশের লোকজনকে আমার ভালো লাগে না, রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে ফিরেও দেখেনা, কথা বলে না, জাস্ট মাইন্ডিং দেয়ার ওউন বিজনেস।
পাড়ার বাসস্টপ পেরিয়ে একটু গিয়েই মেট্রো স্টেশনটা, প্ল্যাটফর্ম এর পাশের দোকান থেকে প্রতিদিন এক কাপ চা না খেলে দিন শুরু হয় না, ট্রেনে চেপে বসলাম, আমার পাশে একটা মেয়ে বসলো দুই স্টপ পর, প্রতি দিন ৩ ঘন্টা ট্রেনে বসতে ভালো লাগে না, লোক জন কথাও বলে না।মেয়েটার চুল ছোট করে ছাঁটা, মেটে লাল রঙের। মুখ দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু তারপর হঠাৎ ,আমার দিকে তাকিয়ে বললো, "কিছু জিজ্ঞেস করবেন? এতক্ষণ ধরে কারো চোখে কারোর তাকিয়ে থাকা একটু ইমপোলাইট, তাই না?"
কী বলব বুঝে পেলাম না, চোখদুটো তার মিষ্টি মধু রঙের, অথচ এত ঠান্ডা দৃষ্টি। "না, না এমনিতেই, বসে বসে এদিক ওদিক দেখছিলাম আরো দুটো স্টপ বাকি, ভালো লাগছিলো না।" বেশ থতমত খেয়ে বললাম।
মেয়েটা আর উত্তর দিলো না, ৫ মিনিট পরে জিজ্ঞেস করল, "আপনার নাম টা একটু বলবেন? এমনিতেই তেমন কিছু না"।
আমার নাম 'মেঘ' বেশি কথা বলার প্রয়োজন বোধ করলাম না। আর কিচ্ছু বললো না মেয়েটি, পরের স্টেশন এ নেমে গেলো।
আমিও নেমে গেলাম একটু পরে, দিনটা যেমন তেমন চলে গেলো, গত ৩ বছর যেভাবে প্রতি দিন কেটেছে ঠিক তেমনি।
সবাই কে দেখলে মনে হয় কোনো চিন্তা নেই কারোর, হাসছে ঠাট্টা করছে, কী ভালো মিথ্যে বলতে পারে ওদের চোখগুলো। ওই মেয়েটার চোখ কিন্তু মিথ্যে কথা বলেনি, ওকে দেখে মনে হয় কলেজে পড়ে, আবার কোনোদিন দেখা হলে নাম জিজ্ঞেস করতে হবে, মনে মনে ভাবলাম।
ফেরার পথে খাবার কিনে, বাড়ির ট্রেন ধরলাম, তখন রাত ৮টা। 'জীবনের ওপর হতাশ হওয়া' আজকাল নাকি ইন্টারনেট ট্রেন্ড। মনে মনে হাসলাম, ভাবছি নার্সিসিস্টিক হওয়ার একটা সীমা থাকে, সভ্যতা সেটাকে কবে পেরিয়ে গেছে।
বাড়ির রাস্তাগুলো আমার আর ভালো লাগে না, অ্যাপার্টমেন্টে এর দরজা খুলে, মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায়। প্রতিদিন এক গল্প, কিন্তু তবুও কাঁদার ইচ্ছে করে, একটা মানুষ যদি থাকতো যে বলতো "হাত পা ধুয়ে এসে খেতে বস রে, এত দেরি কেনো? কাজ এর চাপটা একটু কমাতে বল, অসুস্থ হয়ে যাবি তো!" ভাবলেই কী আর সব হয়। লাইটটা জ্বালিয়ে খাবারটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, আজ থেকে ৫ বছর আগে হলে, না খেয়ে ঘুমোতাম। কিন্তু এখন আর অত বোকা রইনি, ইটিং ডিসঅর্ডার এর মত ভয়াবহ জিনিস আর দেখিনি! বাসন আর ভরালাম না, ধুয়ে রাখার আলস্য। কাপড় না ছেড়েই ঘুমিয়ে পড়লাম, ২ টার সময় ঠেলে উঠলাম,গত ৬ দিন ধরে টানা দুঃস্বপ্ন দেখছি কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।
মা বাবা বেঁচে আছে চিন্তা নেই, সুস্থও আছে, ব্যস কথা বেশি বলে না এটুকুই। ৩ বোন ২ ভাই আমরা, কেউ এখন পাত্তা রাখে না, মনে হয় একলা এই পৃথিবীতে। আবারো চোখ বুজে শুয়ে রইলাম।
ট্রেনে এখন, হঠাৎ কেউ হাত ধরে টান দিল, চেয়ে দেখি গত দিনের মেয়েটা, অবাক হয়ে রইলাম। ট্রেন থামার মুহূর্তে, আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, "এটা আমার স্টপ না তো।" বললাম আমি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা গাছের নিচে গিয়ে থামলো, বললো "জানি, এটা যে আপনার স্টপ না, কিন্তু একটু ভরসা করুন। আপনার আজকের দিনটা খুব ভালো যাবে" ।
"তুমি, আপনি না, তুমি বলে ডাকবে" অনেকদিন পর কিচ্ছু না বুঝে হাসলাম, ভেবেছিলাম ছোট বেলার হাসিটা হারিয়ে গেছে কিন্তু সেটা যায়নি দেখে অবাক হলাম ।
মেয়েটা মাটির দিকে থেকে মুখ তুলে কিচ্ছু বললো না, প্যারালাল হাসি দিল একটা, 'মেঘ, চলো ' বলে আমার হাত ধরে হাটতে শুরু করল, মেয়েটার চোখ দুটো তবুও বিষণ্ণ, খালি খালি লাগে কিন্তু ও বাকিদের মত মিথ্যে বলল না, অবাক লাগল। একটা ছোট দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে, আমার দিকে তাকাল একবার, ভেতরে গিয়ে দেখি একটা আইসক্রিমের দোকান। আমার হাতে একটা চকোলেট আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে বলল 'খাও', দেখি তোর স্ট্রবেরিটা একবার বলে, একটু খেলাম, ওর মুখটা দেখার মত ছিল। "এটা কিন্তু ঠিক না, আমাকেও একটু দাও তাহলে!"
তারপর আমরা কত জায়গায় গেলাম, লেকের ধারে হাঁসকে পাউরুটি দিলাম, কত কিছু খেয়ে দেখলাম, এই করতে করতে কখন বিকেল হয়ে গেলো লক্ষ্য করিনি। পার্কে একটা বড় নাগরদোলাতে শেষ দুজনে উঠলাম, সারা দিনে ওর হাতের দাগগুলোকে পাত্তা দেইনি, দেখলে কষ্ট হয়। হাওয়াই মিঠাইটার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো "মেঘ, কেমন ছিল দিনটা?" প্রথমবার, মেয়েটার চোখ দেখে জীবন্ত লাগলো, ছলছল করছিল, যেন এক্ষুণি কেঁদে দেবে।
"কেনো করলে এসব, তুমি তো আমাকে চিনো পর্যন্ত না, যারা আমার কিচ্ছু হয় তারা আজ অব্দি কিছু করলো না?"
আমি থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেনো?
কিছু আর বলে না, একটু পরে মুচকি হেসে বলল "জানি না, অনেক দিন পর কিচ্ছু করার ইচ্ছা হলো। মেঘ, তুই এত মন খারাপ করে থাকিস না তো, জানিস হাসলে তোকে খুব ভালো লাগে।" তুমি কখন তুই হয়ে গেলো আমরা লক্ষ্য করলাম না।
রেন্ডম একটা দিন, আমার কাছে এতো চমৎকার একটা স্মৃতি হয়ে উঠবে, ভেবেও দেখিনি।
"তোর নাম টা?"
মেয়েটা কিছু বলে না।
"ফোন নম্বরটা একটু দিলে ভালো হয়?"
সেটা একবারেই বলে দিলো, আমি আর সেটা নিয়ে বেশি ভাবলাম না।
বাড়ি গিয়ে আজকে কাঁদার ইচ্ছে হলো না।
দুঃস্বপ্নও দেখলাম না।
প্রথম বার এতো বছর পর মনটা ভালো ছিল।
হঠাৎ ভোর ৫টার সময় ফোনটা বেজে উঠলো, প্রথম বার কেউ আমাকে অনেক দিন অমন ফোন করেনি, তুলে দেখলাম নম্বর এর নাম নেই, "হ্যালো মেঘ?", আর ভাবা লাগলো না কে।
মনটা কেমন খুশি হয়ে গেছিলো, আজকে অফিসে গিয়ে সারাদিন মনে হলো ওই দিন তার কথা। দেখতে দেখতে একটা বন্ধু বানালাম, মেয়েটার নাম এখনও জানি না, ফোনে ' বান্ধবী' দিয়ে সেভ করা। ট্রেন এ প্রতিদিন আমার পাশে বসে, বেশি কথা না বললেও, আমার কথা মন দিয়ে শোনে। ওর চোখগুলো এখন একটু নরম হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না, 'কেনো ' তার মুখটা দিনে দিনে সাদা হচ্ছে বা 'কেনো ' সে দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে।
ভাবলেও অবাক লাগে, কিছু দিন আগের আমার ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট জীবনটা কীভাবে পাল্টে গেলো টেরই পেলাম না।
আজকে মন শক্ত করলাম, ট্রেন এ চেপে ওকে ডেকে বললাম, "একটা কথা জিজ্ঞেস করলে খারাপ পাবি নাকি?"
বন্ধু বললো "নাহ্ অমন কি আর জিজ্ঞেস করবি।"
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, বললাম "তুই ঠিক আছিস? মানে, মন ভালো আছে? অসুস্থ নাকি? "
একটা কথাও বলল না ট্রেন এর সিলিং -এর দিকে ১৫ মিনিট তাকিয়ে রইল, আমিও আর কিচ্ছু বললাম না কিন্তু এই স্তব্ধতা মোটেও অস্বস্তিকর ছিল না। আমার স্টপ আসলো আমি নেমে গেলাম, বন্ধু আর ওঠে না। তারপর কি হলো ঠিক জানি না, সেই চিন্তা নিয়েই দিন কাটালাম।
আগামী কাল ট্রেন এ উঠলো না, কলও করেনি, একটু চিন্তা হলো ঠিকই এই নাকি হারিয়ে ফেললাম সেই একমাত্র বন্ধু। একটু চিন্তিত বলাটা রীতিমত ভুল, আমার রাতের ঘুম উড়ে গেছিলো, তবুও কোথাও একটা, মনে মনে জানতাম বন্ধু আমাকে ছেড়ে যাবে না, ততটুকু ভরসা ছিল।
আগামী দিন সে এলো, এসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, "জিজ্ঞেস করার জন্য, থ্যাঙ্ক ইউ, মেঘ, আমিও জানিনা। কী করছি? কী করবো? কিন্তু জানিস আমি যেমন আছি ভালো আছি, আর তোকে দেখে সেদিন মনে হয়েছিল তুই ভালো নেই; এর বেশি কিছু না, মানুষকে খুশি রাখলে পৃথিবীটা ভালো লাগে। "
"কথাটার উত্তর দিলি না, তুই কি ভালো আছিস? স্পষ্ট বল" বেশ শক্ত হয়ে বললাম।
আস্তে করে বলল, রীতিমত ফিসফিস করে,
"না রে, যেমন আছি ব্যাস আছি, ভালো মন্দ জানি না; অর্থসংকট, কিন্তু এই কত দিন আর দুঃস্বপ্ন দেখিনি, বলতে গেলে সত্যিতে ভালো আছি মনে হয়।"
"তাই বুঝি, ব্যস আমাকে ছেড়ে চলে যাস না।"
"আমি যদি কোনো দিন চলে যাই, তাহলে আগের মত হাসা ভুলে যাস না, পারলে আর এক জনকে হাসা শেখাস।"
ও বললো।
"ওরকম কথা বলিস না, চিন্তা করিস না ভুলবো না!" একটু হেসে বললাম "তোর নাম টা?"
ও শেষে বলল "তোর ফোনে কি নামে এতদিন সেভ করেছিস?"
'বান্ধবী' বললাম।
"সেটাই আমার নাম ধরে নে, নাম জেনে আর কী করবি"
সেটাই আমার বান্ধবীর সাথে শেষ দেখা। আর সে ট্রেনে উঠেনি, ফোনও ধরেনি।
দু দিন পর রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে, টিভির দোকানে খবরে যা দেখলাম তা কোনোদিনও ভুলবো না,
*ব্রেকিং নিউজ: এঞ্জেল মারাক, ১৯ বছরের এক যুবতীর, ২ বছর আগে নিখোঁজ, ট্রাক দুর্ঘটনায় হঠাৎ মৃত্যু!*
মনটা তখন কেমন ভেঙে গেলো, কিন্তু অবাক লাগলো, এমন উচ্ছৃঙ্খল এক ব্যক্তি আমাকে হাসা শিখিয়ে গেলো।
জীবন ভালোই যাচ্ছে, ভালো মানে আগের মত একঘেঁয়ে আর নিঃশব্দ, মনে হচ্ছিল এঞ্জেল বলে কেউ কী আদৌ ছিল, না ওটাও ছিল স্বপ্ন ? সবটাই এক রাতের ছল। ট্রেন এ চেপে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকি এখন, চাই না আর কোনো সঙ্গী, একটা মেয়ে আমার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে দেখলাম, বললাম, "কিছু জিজ্ঞেস করবেন? এতক্ষণ ধরে কারো চোখে কারোর তাকিয়ে থাকা একটু ইমপোলাইট, তাই না?"
"না, না এমনিতেই, বসে বসে এদিক ওদিক দেখছিলাম আরো দুটো স্টপ বাকি, ভালো লাগছিলো না।" বেশ থতমত খেয়ে বলল।
কী করে জানি আমি জানতাম, ওই মেয়ে টা আমি ছিলাম, আর আমি ছিলাম এঞ্জেল, ঠিক এভাবেই কেটে যায় সময়। মানুষ যায়, মানুষ আসে। সবাই পায় না সেই বান্ধবীকে, কিন্তু যারা পায় তারা আরেকজনের জন্য এঞ্জেল হয়ে উঠে। হঠাৎ মনে হলো, এঞ্জেল বলে কেউ থাকলেও আমি তাকে চিনি না, আমি কোনোদিন কোথাও বলিনি, আমি যাকে চিনি, সে তো আমার একমাত্র বান্ধবী।