অনেককাল আগের কথা। দেশ থেকে চাকরিবাকরি ছেড়ে সব পেয়েছি'র দেশ আমেরিকায় এসে ফের ছাত্র হয়ে পি এইচ ডি করতে ঢুকেছি আটলান্টা শহরে অবস্থিত জর্জিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে, সংক্ষেপে জর্জিয়া টেকে। তাও আবার সস্ত্রীক। একটা এক কামরার এফিশিয়েন্সি অ্যাপার্টমেন্টে থাকি দুজনে। সেখানে আমাদের রুমমেট কয়েক হাজার আরশোলা৷ অ্যাপার্টমেন্টের ছাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে বলে সারাক্ষণ তলায় বসিয়ে রাখতে হয় একটা বালতি। শীতের কামড় থেকে বাঁচতে সেকেন্ড হ্যান্ড দোকান স্যালভেশন আর্মি থেকে কিনে আনি মৃত সাহেব-মেমের কোট। বাস ট্রেন ঠেঙিয়ে বিশ মাইল দূরে অবস্থিত ফার্মার্স মার্কেটে গিয়ে পুঁচকে পুঁচকে পটল আর পাঁঠার মাংসের একই দর দেখে দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। তারপর দুটোই কিনতে গেলে বাজেটে কুলোবে না বলে মাংস ফেলে অধিক দুষ্প্রাপ্য পটল কিনে ঘরে ফিরি।
এমন চরম দারিদ্র্য সত্ত্বেও প্রাণে ফুর্তির অভাব নেই। শিং ভেঙে যে বাছুরের দলে ঢুকেছি সেই দলের ছেলেমেয়েরা সবাই মহা ফুর্তিবাজ। মূলত: গৃহহীন আর ভবঘুরেদের আড্ডা ফোর্টিন্থ স্ট্রিটের চেকার্স নামের ফাস্ট ফুড জয়েন্ট থেকে দু ডলারের "ডিপ সি ডাবল স্যান্ডউইচ", আলুভাজা আর কোকাকোলা তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে আমরা রাজা উজির মারি। আর দলের অবিসংবাদিত নেতা প্রলয় আমাদের চেয়ে বছর দশেকের ছোট হলে হবে কি, অভিজ্ঞতায় এবং মননে আমাদের দাদা, ফ্রেন্ড, গাইড অ্যান্ড ফিলোজফার। আমাদের মধ্যে প্রলয়-ই প্রথম সাহসে ভর করে কিনে ফেলল একখানা গাড়ি। আটশো ডলারে বছর দশেকের পুরনো নীল রঙের নিসান সেন্ট্রা। আমাদের দশ বারোজনের গ্রুপের সেই প্রথম গাড়ি ঘিরে সবারই প্রবল উত্তেজনা ও অধিকার বোধ। সুপারমার্কেট থেকে কেনা চাল আর আলুর বস্তা পিঠে করে বয়ে দু মাইল চড়াই পার হয়ে ঘরে পৌঁছনোর দু:খ আর কোমরের ব্যথা ঘোচাল সেই টু-ডোর গাড়ি, যার পিছনের সীটে বসতে গেলেও সামনের দরজা দিয়ে সামনের সীট ভাঁজ করে ঢুকতে হত।
এরপর একদিন আমরাও ধারদেনা করে কিনে ফেললাম একখানা গাড়ি। ক্রেইগস লিস্টের বিজ্ঞাপন দেখে ইউনিভার্সিটিরই এক বিদায়ী ছাত্রের কাছ থেকে দু হাজার ডলার দিয়ে কেনা সেই নিসান ম্যাক্সিমা হাতে পেয়ে আমাদের খুশি আর ধরে না। না হয় হলামই আমরা সেই গাড়ির সাত নম্বর মালিক, আর না হয় তার মাইলোমিটারে দেখাচ্ছেই একশো তেইশ হাজার মাইল। দেখতে যেন শ্বেতশুভ্র রাজহংসটি। আর স্টার্ট দিলে আলোর মত হাসির মত কুসুমগন্ধরাশির মত ভেসে চলে। গর্বে আমাদের বুক ফুলে ওঠে। এত সুখও কপালে ছিল!
কিন্তু অচিরেই দেখা গেল সে গাড়ি সামনের দিকে মোটামুটি স্বচ্ছন্দে এগোলেও পিছু হটতে তার ঘোর অনীহা। চালক পিছনে যাবার উদ্দেশ্যে গীয়ার বদলে রেয়ার ট্রান্সমিশনে দিলে বেয়াড়া গাড়ি ঘাড় গোঁজ করে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে। তারপর সম্পূর্ণ তার নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পাঁচ বা দশ বা পনেরো মিনিট পর থরথর করে কেঁপে উঠে সে পিছনের দিকে যেতে থাকে।
ব্যাপারটা মোটেও ভাল ঠেকছে না বলে সে গাড়ি নিয়ে মেকানিকের কাছে গেলাম৷ তিনি দেখেটেখে জিগালেন, "কত দিয়ে গাড়ি কিনলে?" দুহাজার বলাতে তিনি কিছুক্ষণ হাঁ করে আমার মুখের পানে চেয়ে থেকে বললেন, "তুমি তো বিরাট বড়লোক হে! যে গাড়ি কেনার জন্য তোমারই দু হাজার ডলার পাওয়া উচিত ছিল, তা তুমি দুহাজারে কিনলে? এর ট্রান্সমিশনের তো দফা শেষ! আজ পিছনে যাচ্ছে না, কাল সামনেও যাবে না।" সারাতে কত লাগবে জিজ্ঞেস করাতে তিনি আঁতকে উঠে বললেন, "অমন ভাবনা মাথায়ও এনো না। এ গাড়ি সারাতে হলে গাড়ির ডবল দাম পড়বে। তিনগুণও পড়তে পারে। তার চেয়ে চালাতে থাকো। গাড়ি নিজের মর্জিমত চলুক৷ যেদিন দেখবে সামনে-পিছনে কোনদিকেই আর চলছে না, বেমালুম রাস্তায় ফেলে রেখে হাওয়া হয়ে যেও। আর হ্যাঁ, এরপর পুরনো গাড়ি কিনতে হলে আগে মেক্যানিক দেখিয়ে নিও।" বাড়ি ফিরে কত্তাগিন্নি মুহ্যমান হয়ে বসে রইলুম। ধার করে কেনা রাজহংস যে আসলে টেরোড্যাকটাইল তা কি করে বুঝব! অতগুলো টাকা ধার করে...
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত একদিন আমি বে-খেয়ালে বা অবদমিত ফ্রাস্ট্রেশনে ব্রেকের বদলে অ্যাকসিলারেটর দাবিয়ে গাড়ি নিয়ে সজোরে ধাক্কা মারলাম আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের পাঁচিলে। দেওয়ালের একাধিক ইট খসিয়ে গাড়ির সামনেটা তুবড়ে চটকানো আলুভাতের মত হয়ে গেল। কিন্তু কি আশ্চর্য - সে তখনও সচল! চেপ্টে যাওয়া ইঞ্জিন থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, কিন্তু চলছে! অতি সহানুভূতিশীল পুলিশের দাক্ষিণ্যে টিকিট খাওয়া আর ছাত্রদরদী ইউনিভার্সিটির সৌজন্যে পাঁচিল ভাঙার ক্ষতিপূরণ দেওয়া থেকে রক্ষা পেলেও সেই চেপ্টে আধা চুরমার হয়ে যাওয়া, ট্রান্সমিশন ফেল করা সার্কাসের গাড়ি নিয়ে কি করব ভাবছি।
প্রলয় বলল, "চলো আয়ূবভাইয়ের কাছে যাই। পাকিস্তানি মেকানিক, আমাদের বাড়ির কাছেই থাকেন, শুনেছি গরীব ছাত্রছাত্রীদের গাড়ি খুব অল্প পয়সায় ম্যাজিকের মত সারিয়ে দেন। অগত্যা এক দিন গেলাম আয়ূবভাইয়ের বাড়ি। প্রলয়দেরই পাড়া হোম পার্ক এলাকায় ছোট ছোট পুরনো একতলা বাড়িগুলোর একটিতে আয়ূবভাই থাকেন। মূলত: ছাত্রছাত্রী ও নিম্নবিত্ত লোকজনের বাস এই অঞ্চলে। বেল বাজাতে শান্ত সৌম্য চেহারার টাকমাথা এক প্রৌঢ় দরজা খুললেন। আলাপ পরিচয় এবং কুশল বিনিময়ের পর আগমনের হেতু জানালাম। গাড়ি দেখে প্রথমে আঁতকে উঠলেন, " অ্যায়সা হালত ক্যায়সে বনা দিয়া ভাই?" অ্যাকসিডেন্টের বিবরণ শুনে গম্ভীরভাবে ঘাড় নেড়ে বললেন, "হোতা হ্যায়, হোতা হ্যায়"। তারপর বললেন "এ যা হাল করেছ, সারাবার গ্যারান্টি আমি দিতে পারব না। আমি একটা জাঙ্ক ইয়ার্ডে কাজ করি। সেখানে ভাঙা গাড়ি থেকে উপযুক্ত পার্টস জোগাড় হলে সারাতে পারব, নাহলে না। নতুন বনেট লাগবে, বাম্পারও। ইনশাল্লাহ ঠিক হো জায়েগা।" কাঁচুমাচু হয়ে জিজ্ঞেস করলাম কত লাগতে পারে। তাতে মৃদু হেসে বললেন, "উসকা ফিকর মত করো শঙ্করভাই। পহলে ঠিক তো হোনে দো।" আমি তখন মানসিকভাবে এতই বিপর্যস্ত যে শঙ্করভাই ডাক শুনেও প্রতিবাদ করার কথা মনে হয়নি। ফলে
আয়ূবভাইয়ের কাছে আমি পার্মানেন্টলি শঙ্করভাই হয়ে গেলাম।
হপ্তাদুয়েক পর আয়ূবভাইয়ের ফোন, "শঙ্করভাই, আপকা গাড়ি ঠিক হো গয়া, আজ শামকো আ যাও!" বিকেলে গিয়ে দেখি সেই গাড়ি বিলকুল ভোল পালটে আয়ূবভাইয়ের বাড়ির সামনে বিরাজ করছে। তার সেই শ্বেতশুভ্র রূপ বিলকুল ভ্যানিশ। সাদা গাড়ির সম্মুখভাগে শোভা পাচ্ছে একটা ছাইরঙা বনেট। সেটা আবার সাইজে একটু ছোট, ফাঁক দিয়ে ইঞ্জিন দেখা যাচ্ছে। ভুঁড়ির ওপর উঠে থাকা আন্ডারসাইজ গেঞ্জির মত। সাদা রঙের তুবড়ে যাওয়া বাম্পার উধাও। তার জায়গায় জায়গায় জায়গায় চটা ওঠা একটা কালো রঙের বাম্পার।
সেই বিচিত্র গাড়ির দিকে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছি, আয়ূবভাই বিজয়ীর হাসি হেসে বললেন, "দেখা শঙ্করভাই? ম্যায়নে কহা ঠিক কর ডালুঙ্গা - কর দিয়া না?" তারপর বললেন কিভাবে উনি ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেছেন জাঙ্কইয়ার্ডে যুতসই পার্টস পাবার জন্য। ছাইরঙের বনেটটা নাকি অল্প তোবড়ানো ছিল, তার ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে তাকে সোজা করেছেন। তারপর তাকে আমার গাড়িতে লাগিয়েছেন। কালো রঙচটা বাম্পারটা অন্য এক দাবিদারকে হটিয়ে সংগ্রহ করেছেন। গাড়ি ঠিক করার এইসব রোমাঞ্চকর গল্প শুনিয়ে আয়ূবভাই শেষে আমার হাতে দু কৌটো সাদা রঙের স্প্রে ক্যান দিয়ে বললেন, "অব ইসকো কালার কর দো, ফির অরিজিনাল জ্যায়সা হো জায়েগী৷ ঔর বাম্পার কো স্যান্ড পেপার সে থোড়া ঘিসনা, ফির উও দাগ-ওয়াগ চলা জায়েগা।" পয়সার কথা বলতে বললেন "এর জন্য আর কি পয়সা নেব! পার্টসের জন্য তো কোনো পয়সা লাগেনি, মজুরি হিসেবে যা তোমার সামর্থ্য - দশ বিশ পঁচিশ - তাই দিও। সেই মুহূর্ত থেকে পাকিস্তানের করাচি শহরের মহম্মদ আয়ূব হয়ে উঠলেন আমাদের মধুসূদনদাদা।
এরপর প্রায় তিন বছর সেই ভাঙা গাড়ি চালিয়েছি। শুধু আয়ূবভাইয়ের ভরসায়। আগের মেকানিকের ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক প্রমাণ করে গাড়ির ট্রান্সমিশন একদিন জবাব দিল। আমি গাড়ি ফেলে পালিয়ে যাবার পরামর্শ অগ্রাহ্য করে আমাদের মধুসূদনদাদাকে ফোন লাগালাম। তিনি সামান্য মূল্যে ট্রান্সমিশন বদলে দিলেন - সৌজন্যে সেই জাঙ্কইয়ার্ড। গাড়ি আবার গড়গড়িয়ে চলতে লাগল। গাড়িতে ভুল করে হেডলাইট জ্বালিয়ে রেখে চলে গেছি। ফিরে এসে স্টার্ট দিতে গিয়ে দেখি ব্যাটারি শেষ। ফোন লাগাবার দশ মিনিটের মধ্যে মধুসূদনদাদা জাম্পস্টার্টার কেবল নিয়ে হাজির। কি করে অন্য গাড়ির সাহায্যে ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়া গাড়ি জাম্প স্টার্ট করতে হয় নিজস্ব অননুকরণীয় ভঙ্গীতে ("পাজিটিব মে পাজিটিব ডালো, নিগটিব মে নিগটিব") শিখিয়ে দেবার পর কেবলগুলো দিয়ে বললেন "অবসে ইয়ে হামেশা ট্রাঙ্ক মে রখনা!"
মহম্মদ আয়ূব করাচী শহরে নিজের ছোট্ট সংসার - বিবি আর ছেলেকে ছেড়ে সুদূর জর্জিয়া প্রদেশের আটলান্টা শহরে পাড়ি দিয়েছিলেন দুটো বাড়তি পয়সার মুখ দেখার আশায়। এক এজেন্টের মাধ্যমে সামিল হয়েছিলেন মসজিদ বানানোর কাজে নিযুক্ত শ্রমিকের দলে। ভেবেছিলেন কিছু ডলার আয় করতে পারলে ছেলেটাকে ভাল করে পড়াশুনা করাবেন। আটলান্টায় এসে দেখেন কাজের নামে চলছে নিরন্তর শোষণ। প্রাপ্য মজুরি না দিয়ে, অতি শোচনীয় অমানবিক পরিবেশে জীবন কাটাতে বাধ্য করে করানো হচ্ছে মসজিদ নির্মাণকার্য। আয়ূবভাই প্রতিবাদ করে কাজ ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে চাইলে এজেন্ট এবং মালিকপক্ষ থেকে তাঁকে সন্দেহভাজন বলে ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (এফ বি আই) কাছে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। নাইন ইলেভেন, অর্থাৎ ট্যুইন টাওয়ার ধ্বংসের অব্যবহিত পরের সেই সময়ে সামান্যতম ইন্ধন পেলেই মুসলমানরা এফ বি আইয়ের ওয়াচলিস্টে চলে আসতেন। আয়ূবভাইয়ের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসাবাদ করার পাশাপাশি তাঁর পাকিস্তানি পাসপোর্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য নিজেদের কাছে গচ্ছিত রাখে এফ বি আই। ফলে আয়ূবভাইয়ের একুল ওকুল দুকুলই যায়। আয়ও নেই, দেশে ফিরে যাবার পথ বন্ধ। আশ্রয় দিতেও পরিচিত লোকজন ভয় পেত। শেষে এক শুভানুধ্যায়ী বন্ধুর কাছে ঠাঁই জোটে। গাড়ি সারাইয়ের অভিজ্ঞতা থাকার কারণে জাঙ্ক ইয়ার্ডে গ্রাসাচ্ছাদন চালিয়ে নেবার মত একটা কাজ জুটিয়ে নিতে সক্ষম হন। তার পাশাপাশি আমাদের মত ইউনিভার্সিটির দু:স্থ ছাত্রছাত্রীদের ভাঙাচোরা গাড়ি সারিয়ে তাদের জীবনধারণে সাহায্য করেন। কিন্তু কবে পাসপোর্ট ফেরত পাবেন, কবে ফিরে যেতে পারবেন পরিবারের কাছে, কিছুই জানেন না।
আমাদের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে এসে সাদা ভাত দেখে আয়ূবভাই সামান্য ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন রান্নায় আশানুরূপ ঝাল না হওয়াতে এবং খাদ্যতালিকায় পোলাও না দেখে। আমরা খুব ঝাল খেতে পছন্দ করি কিন্তু অতিথি এলে একটু রাশ টেনে রান্না করি শুনে এক বোতল আগুন-ঝাল লাতিন আমেরিকান লঙ্কা হ্যাবেনেরোর সস কোয়েলীকে উপহার দিয়েছিলেন। আমার বাবা মা প্রথমবার আমেরিকায় আসার পর আয়ূবভাই আমাদের সকলকে খাওয়াতে নিয়ে গেলেন তাঁর পছন্দের রেস্তোরাঁ হায়দ্রাবাদ হাউসে। বিরিয়ানি, কাবাব, কোর্মার সে এক এলাহি সম্ভার।
আমরাও ঠিক করেছিলাম একদিন আয়ূবভাইকে বাসন্তী পোলাও খাওয়াব। কিন্তু আটলান্টায় পড়াশুনার পাট চুকিয়ে নতুন চাকরি নিয়ে বস্টন রওনা হতে গিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে তা আর হয়ে উঠল না। তারপর ফোন বদল হয়ে কনট্যাক্ট লিস্ট থেকে আয়ূবভাইয়ের নম্বর হারিয়ে গেল। আমি তখন আইভি লীগ স্কুলের জাঁতাকলে পড়ে "চাঁদ তারেঁ তোড়কে লাউঁ" গাইতে গাইতে রাতদিন ছুটছি। টপ জার্নালে পাবলিকেশন, ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের হেঁটে যেতে দেখা, তারপর জীবনে বউয়ের অসুস্থতাজনিত অপ্রত্যাশিত টর্নাডো - এসবের চক্করে মধুসূদন দাদা জীবন থেকে মুছে গেলেন। পরবর্তীকালে যখন আবার তাঁর কথা মনে পড়েছে, তখন যোগাযোগ করার আর কোন রাস্তা নেই। উভয়ের পরিচিত বন্ধুবান্ধবেরাও সব আটলান্টা ছেড়ে চলে গেছে। ভাবলে আজকাল আত্মগ্লানিতে ভুগি। যেভাবে তিনি ছাতা ধরে রেখেছিলেন আমাদের মাথার ওপর তিন তিনটে বছর ধরে, সেই অভূতপূর্ব স্নেহের ঋণ কোনদিনই শোধ হবে না। কিন্তু একটু সাহায্য কি করতে পারতাম না, ঘোর অনিশ্চয়তা থেকে উদ্ধার পেয়ে তাঁর নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যাবার প্রচেষ্টাকে?
বিশ বছর পরে, পৃথিবী যখন উত্তরোত্তর হিংস্র হচ্ছে, মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব আর অবিশ্বাস যখন নিত্যদিন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে, পান থেকে চুন খসলে সোশ্যাল মিডিয়ায় লোকে একে অপরকে ছিঁড়ে খাচ্ছে, তখন আয়ূবভাইয়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে। একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করেছিলাম আম পাকিস্তানি আম ভারতবাসী সম্পর্কে কি ভাবে। আয়ূবভাইয়ের উত্তর আজও কানে বাজে - "শঙ্করভাই, আখির তুমমে ঔর মুঝমে কুছ ফারাক হ্যায় কেয়া? কুছ লোগ আপনে ফায়দে কে লিয়ে তুমহে ঔর হমে এক দুসরে কি দুশমন, মতলব বেওকুফ ঔর উল্লু বনানে কি কোশিশ করতে হ্যায়। দুখ কি বাত ইয়ে হ্যায় কি হম উল্লু বন ভি যাতে হ্যায় - ঔর উও লোগ কামেয়াভ হো জাতে হ্যায়!"
ভাল থাকবেন আয়ূবভাই। আমার মধুসূদন দাদা।