জ্ঞান হওয়া ইস্তক শ্যামাপিসিমা কে দেখে এসেছি।
একমাত্র দাদু তাকে ডাকতেন "কই গ্যালা, শ্যামা?" বলে। আর কারো বোধহয় শুধু নাম ধরে ডাকার অধিকার ছিল না ... হিম্মতও নয়। ঠাকুমা, ছোট ঠাকুমা কোন অদ্ভুত কারণে তাকে বেশ সমীহ করেই ডাকতেনঃ 'স্যাকরা বৌ ' বলে। বাবা-কাকা-পিসিরা ডাকতো 'শ্যামা দি' আর আমরা বলতাম - 'শ্যামা পিসিমা'। উনি ঠাকুমাদের ডাকতেন বড়-মা , ছোট-মা নামে, বাবা-পিসিদের সরাসরি নাম ধরে আর আমাদের তো ধর্তব্যের মধ্যেই আনতেন না। একেবারে নিজের ইচ্ছেমতো নাম দিতেন ... এবং ২০০% বাঙ্গাল অ্যাকসেণ্টে। যে কোন কারণেই হোক সেই নাম গুলিও হতো প্রাক স্বাধীনতা আমলের নেতৃবৃন্দের স্মরণে।
লর্ড লিটনের থেকে 'লিটু' (আমার ভাঁড়ারে), সরোজিনী থেকে 'সরইজ্যা' (এক বোনের কপালে) কিংবা ডালহৌসি থেকে 'ডালই' (ছোট ভাইয়ের শিকেয়) -- জুটতো সেই সব শুভনাম।
রেগে গেলে অবশ্য আমাদের ঠিকঠাক নাম ধরেই ডাকতেন। একদিন নিজেই বলেছিলেনঃ "চেইত্যা গেলে কি আর আদরের নামে ডাকন যায় ... নাকি ডাকা উচিত?"
হক কথা !
আমার বাবা ছিলেন তার বিশেষ স্নেহাস্পদ ... আর আমি -- "আমাগো পুনু-র( বাবার ডাকনাম) পোলা" বলেই হয়ত তাঁর কাছে আসার ... গল্প শোনার ... গল্প শোনানোর সময় ও সুযোগ পেতাম সবচেয়ে বেশি।
কত কথা যে হতো ! তাঁর নাকি জন্ম হয়েছিল কালীপূজোর দিন -- ঘোর অমাবস্যায়। গাত্রবর্ণ ছিল তমিস্রানিন্দিত। কে নাম রেখেছিল মনেও পড়ে না -- তবে ডাকনাম হয়ে গিয়েছিল - শ্যামা। শ্যামাপিসির বাবা ছিলেন আমার ঠাকুর্দা মশাইয়ের সাহেবি আপিসের "পাংখা -পুলার "। খাতায় সে পদটি রাখা হলেও, আসলে মানুষটি বাগানের দেখভাল করতেন।
- "আমার বাপের হাতের পাঞ্জায় নিশ্চিত গাছগাছালির রেখা আসিল। যে চারা-ই বসাইতো, ফনফনাইয়া উইঠ্যা দৈর্ঘ্যে-আড়ে, ফুলে -ফলে, সুবাসে-ছায়ায় এক্কেরে অশোক কানন হইয়া যাইত!"
- "তুমি বাবাকে হেল্প করতে, শ্যামাপিসি ? "
- "করতে লাগে রে, মনা, করতে লাগে। বাগানের গাছ আর পুকইরের মাছ -- এরা হইল অতিথি। সকলের ঘরে এয়ারা আসে না। তোমার ঘরে আসলে পরে তুমি তার পা-ধোয়নের জল গামছা দিবানা? বাতাসা, মুড়ির মোয়া দিবা না? গাছের তেমনই হইল জল। খুড়পি হইল গামছা। মাছের জন্যও তেমনই জলে দিতে হয় খই -মুড়ি -ভাত।"
শ্যামা পিসির বাপের বাড়ি ছিল ঢাকার কাছেই - নবাবগঞ্জ । মেয়েদের ইস্কুলে পড়াশুনো করেছিল ম্যাট্রিক অবধি। পরীক্ষা দেওয়া আর হয়নি। " চৈত্রর শেষে পরীক্ষা। আর বিয়া লাগলো মাঘের শ্যাষম্যাশ। আমি রইলাম নন-মেট্রিক হইয়া । "
নন-ম্যাট্রিক হলে হবে কি, শ্যামা পিসির ছিল দোর্দণ্ড দাপট ! ঠামা ... ছোট ঠামাদের দেখেছি বেশ তটস্থ থাকতে তার সামনে। পূজো-আচ্চা কিছুই করতে দেখিনি কোন দিন, এমনকি সন্ধ্যেবেলায় প্রদীপটদীপ জ্বালাতেও না --- কিন্তু পূজোর 'ডিটেলস' আর 'ফাইন টিউনিং '-এ ওনারই ছিল শেষ কথা।
- "বড় মা(ঠাকুমা), রূপরা য্যান সোনা-সোনা হয় ! তামারঙ ধরলে, তোমার গিরস্থিরই অমঙ্গল। "
- "অ ছোটমা (বাবার কাকিমা), লক্ষ্মী পূজার খিঁচড়ি কিন্তু! মন আর চক্ষু দুইয়োটাই য্যান সোনামুগের ডাইলের দিকে থাকে!"
★
সবুজ রংয়ের মধ্যে গোলাপি ফুল আঁকা একখানা মাঝারি তোরঙ্গ ছিল শ্যামাপিসির।
কয়েকটা পুরোনো বই খাতা আর গালার তৈরি বিতিকিচ্ছিরি দু তিনটে পুতুল ছাড়া বোধহয় বিশেষ কিছু থাকতো না তার মধ্যে -- তালা-চাবি খোলা অবস্থাতেই ঝুলতো তার গায়ে।
- " ওইডারে সাথে নিয়াই তো শ্বশুরবাড়ি ছাইড়া তগো গিরস্থিতে আইসিলাম একদিন ! "
- " কবে এসেছিলে গো, পিসি ? কেন এসেছিলে? "
- " আরে, সেই সব শোননের .. বোঝনের বয়স হয় নাই এখনো। বড় হও, কমু । তাড়া কিসের ? "
- " আমি বড় হয়েছি তো ! রিক্সায় একাই তো স্কুলে যাই।
তুমিও তো একা-একাই এসেছিলে বললে! এখনই তোমার কত্তো বয়েস... আমি বড় হতে হতে তুমি এক্কেবারে বুড়ি হয়ে যাবে। ব...লো না, শ্যামাপিসি । প্লিজ ! "
- " রাখ তগো পিলিজ মিলিজ ! দাঁড়া, আগে পান খাইয়া আসি । "
শ্যামাপিসি পান খেতেন। সারাদিনে অনেকবার পানপাতা -সুপুরি -খয়ের আর পানের বোঁটার মাথায় ছোঁয়ানো একটু চুন -- টিফিনবাক্সের মতো একটা ডিব্বা থেকে বের করতেন আর গালে পুরতেন।
আর হ্যাঁ, মুখে খয়ের-পান থাকলে, পিসি কখোনো ... কক্ষনো জিভ বাইরে আনতেন না।
- "এক্কেরে তেনার মতো লাগবো যে ... যার নামে আমার নাম । মানি, না মানি, পাপের ভয় আছে তো ! "
- " বাপে অনেক দেইখা শুইনা বিয়া দিল সোনার কর্মকারের ঘরে। হক্কলে কইল - ছেমড়ি তর বাপের জামাই ভাইগ্য ভাল। পয়লা নম্বরের কারিগর ! গয়নায় মুইড়্যা রাখবো তরে।
বিয়ার পরে, কে যে কি বুঝাইল তারে, কয় --" লাক্ষার কারিগর হমু। ওইতে অনেক পয়সা। গালার পুতুলের কদর দেশে-বিদেশে। মালিক নিজে কইসে, ম্যানেজার করবো। তুমিও সুখেই থাকবা। চলো, আরেক নবাবাগঞ্জ যাই। চাঁপাই-নবাবগঞ্জ।
কও দেখি মনা, লখিন্দর কে ছিল ? "
গল্পের মাঝে এমন তাল কাটা প্রশ্ন শুনে খুব বিরক্তি আসে।
শিউলি পাতা চিবোনো মুখে বললাম -- " কে আবার ! চাঁদ সদাগরের ছেলে। বেহুলার বর।"
- " এক্কেরে ঠিক ! জানো তো, সেই বেহুলার বাপের বাড়ি ছিল ওই চম্পা নগরে। লখিন্দরের স্বশুরঘর। তার থিকা সেই নবাবগঞ্জ হইল চাঁপাই নবাবগঞ্জ।
তা, যা- মন-নেয় হউক গিয়া, আমারা সেখানেই বাসা করলাম। আরে, যে সোনা-রূপায় ছবি ফুটায়, গালা তার কাছে কি ? তার পুতুল তৈরির কেরামতিই তো আলাদা ! "
আমার স্পষ্ট মনে আছে বলতে বলতে শ্যামাপিসির চোখ দুটো কেমন বড় বড় আর উজ্জ্বল হয়ে উঠত।
"আমার বাক্সে তেনার হাতে গড়া দুইখান পুতুল আসে -- দেইখো তার জেল্লা ... পালিশ ... আর গড়ন ! তোমার বৌ-রে দিয়া যামু একখান। লজ্জা পাও ক্যান, মনা !
ভালই ছিলাম। বাপের জামাইয়ের গুমর ছিল খুব ! নিজে ম্যানেজার , তার উপর পড়ালিখা জানা বৌ ! বিলাতি ডিজাইনের বই আইন্যা দিত ... আমি পইড়া, যতটা সইম্ভব, মানে করতাম -- উনি শুইন্যা মাথায় রাখতেন।
তারপর.... তারপর আমি তো চইল্যা আইলাম ঢাকায়। উনি রইলেন সেইখানে । "
- " কেন, তুমি চলে এলে কেন ! বলছো, এতো ভাল জায়গা ! "
- তুমি আমাগো পুনুর পোলা ... তোমারে আবার লজ্জা ! আরে, পোলামাইয়া হওনের সময় বাপের ঘরেই তো আসে ! পরে বোঝবা সে সব। যাউগ্যা, আমি ঢাকায় রইলাম সাত মাস ... ওইদিকে না জানি কি যে বইয়া গেল তার মনে !
এক মাঝরাতে পোলা বিয়াইলাম আমি আর তিন দিন পরে খবর আইলো .... তিনি গলায় দড়ি দিসেন ।
লোকে কইল মালিক মিথ্যা চুরির দায়ে পুলিশে দিসিলো। ইনি সহ্য কতে পারেন নাই।
এদিকে হক্কল এয়োতি ... বোঝলা হক্কলে ... এমন কি আমার মা-য়ে পর্যন্ত কইল -- মাইয়ার অমবস্যায় কালির ঘরে জন্ম ... সোয়ামী তো খাইবই! পোলাটাও কি কু-ক্ষণেই না জম্মাইলো।"
কতটা বুঝেছিলাম জানিনা কিন্তু এসব শুনে আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। অথচ মনে আছে তাকিয়ে দেখেছিলাম ... পিসির চোখ দুটো যেন রাগে জ্বলছে !
- "চক্ষের জল মুইছ্যা, আমার বাপে পোলার নাম রাখল গোপীনাথ ... গুপী ।
কিছুদিন পর পোলারে লইয়া গেলাম শ্বশুরঘর। ধূলা পায়ে ... বোঝলা ... একটা বাতাসা একখোড়া জল পর্যন্ত না দিয়া ... তেনারা আমায় বাইর কইরা দিল। অবইশ্য বিয়ার যৌতুকের সবুজ তোরঙ্গখান দিসিল।
ব্যস, কাঁখে গুপী আর হাতে খালি তোরঙ্গ ঝুলাইয়া আবার বাপের ঘরে ফিরৎ !"
- " তারপর ? "
- " তারপর ... আবার কি? বাপের সাথে আবার বাগানে। তফাত কেবল, এইবার কোলে পোলা আর এইবার শাদা থান !
সেই বাপ কালের গাছ ই আমায় তার ছায়া দিল শেষ তক।
তোমার দাদু, আমার বাপের বড়বাবু, আমার অবস্থা দেইখা বাপের উপর খুব চোটপাট করল একদিন -- " আজ থিক্যা আমার সাত মাইয়া দুই পোলা। শ্যামা রে, পিচ্চি পোলাডারে লইয়া কই গেলি? যা, বড়মা ছোটমার কাছে যা।"
গাছের ভালোবাসা এমনই রে সোনা। ছিলাম দুই ভাইয়ের এক বইন পারুল ... হইলাম সাত পারুলের একজন আর পাইলাম সোনার টুকরা আরো দুই ভাই! কই লাগে ঠাকুরমার ঝুলির গল্প ! কও!
তারপর? ভাই বোনেদের বিয়া লাগল ...ভাইপো, বোনঝি হইল ... তোমাগো নিয়া আমি আবার ঘোরতর সংসারী হইলাম।"
- " আর গুপীদা ? "
গুপীদাকে চিনতাম সব্বাই। কতবার এসেছে আমাদের এখানে। খুব কালো গায়ের রং আর কি চকচকে শাদা দাঁত ... হাসলে ওপরের গোলাপি মাড়ি বেরিয়ে থাকে। (এ কথা শুনলে অবশ্য আমার মা খুব রাগ করতেন।)
- " গুপী একটু বড় হইলে, তার বড়মামা-মামী তারে নিজেদের কাছে নিয়া পালপোষ করল। তাগো বাচ্চা নাই তো ! সে সোদপুরেই পড়াশুনা করসে। আই. কম. পাশ করসে। এখন তো সোনার কাজকাম করে ... তাদের বানাই গয়না নাকি কমলালয় অব্দি পৌছায়। রক্তে স্যাকরা বিদ্যা আছে যে !
কয় তো, নিজের দোকান দিব ... নতুন ডিজাইন ... হ্যাকা ঢ্যাকা.. কতো কি ! বিদ্যা তো ওই আই.কম. -- কিন্তু কথার তারাবাত্তি ! "
ছোট বোন কিছু না বুঝেই হয়ত ফুট কাটল -- আইকমের পরে বাইকম হয়ে যদি তোমায় নিতে আসে তাড়াতাড়ি ... কি হবে পিসি ? "
- " তুই থাম তো সরইজ্যা। খালি আ-কথা কুকথা ! কই যামু ? নিজের ঘর ছাইড়া কেউ যায়? যত্তসব। "
মুখে বলতেন বটে একথা কিন্তু অন্যকথাও ছিল। মাঝেমধ্যে বিকেল বেলায় ঠাকুমাদের চুলে যশোরের খয়েরি কালো কেমন একটা দু-রঙা চিরুনী চালাতে চালাতে গুণগুণ করে একটা গান গাইতেন। কোল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আমরা গানের কথা শুনেছি -- কিচ্ছু বুঝিনি যদিও।
" কিশোরগঞ্জে মাসির বাড়ি
মামার বাড়ি চিতনপাড়
বাপের বাড়ি বামণবাইড়া
নিজের বাড়ি নাই আমার ..!"
সরোজিনী তো বলেও ছিল একদিন -- " কি যে গাও ! যেমন বিচ্ছিরি গলা তোমার... কথাগুলোও তেমনি অদ্ভুত ! এই গান গেয়ে আর শুনে আবার নিজেরা কাঁদতেও থাকো ! তোমারা যেন কেমন!"
শ্যামাপিসিমা চোখ মুছে বলেছিলেন --- " মনা রে , নিজের ভূমে পরবাসী হইয়া বৌ -মাইয়ারা দেশ ছাড়নের পথে এই গান গাইয়া হাঁটতো আর হাতের উল্টাপিঠে চক্ষু মুইছা শেষবারের মতো পিছনপানে নিজের ঘর নিজের উঠান দেইখা নিত । সেই সব তোমরা বুঝবা না ... বোঝনেরও কাম নাই । "
★
শ্যামাপিসি কিন্তু যথেষ্ঠ স্মার্ট মহিলা ছিলেন। নিজেই হেঁটে তখনকার ছড়ানো ছিটানো গড়িয়াহাট বাজারে চলে যেতেন -- পানের কৌটো 'রিফিল ' করতে। ফেরত রাস্তায় বাঁধা ছিল গোলপার্কে ঠাকুরের দোকানে গিয়ে গম্ভীর মুখে বলা :- "এক খান খোকার খেলা দাও। " অত্যন্ত ঘাবড়ে যাওয়া লোকটিকে তারপর বুঝিয়ে দেওয়া : - আরে আমার মতো রং আর বতলে বুড়বুড়ি ওঠে ... সেই খোকার খেলা ! " ঠাকুর আমার বাবাকে বলেছিল -- " জিন্দেগি মে কিসিকো অয়সা কায়দা সে কোকা কোলা বোলতে হুয়ে সুনে নাহি, ডাংদার সাব,রাম কসম! "
★
শ্যামাপিসি কাছাকাছি থাকলে উনিই ফোন ধরবেন - এই ছিল দস্তুর । বহুবার এই ফোন সংক্রান্ত ঝামেলাতে জড়িয়েও পড়েছেন। বাবা চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরা মাত্র একদিন বলেছিলেন: "পুনু, বর্ধমান থিকা ছোকরা ফোন করছিল। আবার পরে করবো। "
কোন ছোকরা ? বর্ধমানে তো কেউ ই নেই ! এমন সব লছরঘন্টি চিন্তা করতে করতেই আবার ফোন আসে -- আলিপুর বর্ধমান রোডের থেকে মিস্টার চোপড়ার ফোন !
-" ওই একই হইল ! "
★
শ্যামাপিসি দারুণ রান্না করতেন। সব রান্নাতেই কি যেন একটা করতেন ! দাদু তো যে কোন পদ মুখে দিয়েই বলতেন - " শ্যামা রে, তুই এইডা বানাইয়া আমারে খাওয়াইবি তো একদিন।" এ নিয়ে মৃদু অশান্তি যে বাড়িতে হতো আন্দাজ করতাম। শাঁপলা ডাঁটা আর ডালের বড়া-র লাবড়া, মুলো দিয়ে শোল মাছের ঝোল, কচি কচু পাতা আর পাট পাতা ভাজা ... এমন সব কিছু। বাবার বন্ধু রমেন কাকুর একটি দারুণ রেঁস্তোরা ছিল গড়িয়াহাটে -- নিরালা । সেখানে নিত্যনতুন পদ তৈরি করা হতো। 'বাসন্তী পোলাও ' কথাটি সেখানেই প্রথম শুনি। রমেন কাকু শ্যামাপিসির হাতের নানা সুখাদ্য বিলক্ষণ চেখেছিলেন। তাই হয়ত, নতুন পদটি একদিন নিয়ে এসেছিলেন পিশি কে চাখাতে।এক্সপার্ট ওপিনিয়ন নিতেও হয়ত।
পিশি দু-চামচ খেয়েছিলেন।
-- " রমেন, তোমাগো ওঝা-জি... "
-- " দিদি, ওঝা নয়। বাবুর্চি। "
--" ওই একওই হইল। তুমি বাবু -- তোমার রান্না করে। সে যেই হউক। তোমার ওঝা-জি কিন্তু পুলাউয়ে বসন্ত আনোনের আগেই গাজনের বাদ্যি বাজাইয়া দিসে। বাবুর পয়সার মশল্লা! একমুঠ দিসে! অরে কইয়ো, জাফরানের সুতলি য্যান দুধে গোলনের আগে, দুধে আধা চামচ চিনি গুইলা নেয়। একটু মিঠা না হইলে, বসন্তের ফুল ফুটবো ক্যামনে?"
★
কত গল্প যে জানতেন শ্যামাপিসি ! আমাদের একদিন শুনিয়েছিলেন চন্দন, উদয় আর পান্না-মায়ের গল্প। আমার এত্তো মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল গল্পটা শুনে। তারপর থেকে, কেন জানি না, গুপীদাকে চন্দন বলে মনে হতো আমার...আর পিশিকে পান্না-মা। উদয়কে খুঁজে পেতাম না ... খুঁজতে চাইও নি।
★
এর মধ্যেই গুপীদা একদিন এসে মায়ের সাথে দেখা করে কটকে পাড়ি দিল। সেখানে বক্সী বাজারে নাকি অনেক গয়নার দোকান। ভাল চাকরি পেয়েছে। যাবার দিন পিশির জন্য নিজে হাতে বানানো একজোড়া রূপোর দুল এনেছিল। সে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শ্যামাপিসি সেটা আমার মায়ের কানে পরিয়ে দিল। ওনার কাছে আপত্তি টাপত্তি তো কোনদিনই টিঁকতো না -টেঁকেও নি।
★
বেশ ... বেশ কিছুদিন পরে হঠাৎ একদিন গুপীদা নাকি পিশিমাকে কটক থেকে ফোন করে। মা কাছেই ছিল সেদিন। বহুবার শুনেছি সেদিনের কথা।
দেশে তখন সোনা নিয়ন্ত্রণ আইন চলছে। গয়না বানানো প্রায় বন্ধ। স্বর্ণশিল্পীরা মিছিল করছেন... গুলি চলছে তাদের ওপর। গুপীদা তার মাকে নাকি বলেছিল অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করার ইচ্ছের কথা। পিশি বলেছিলঃ- গুপীরে , মরণ বাঁচন তো উপরওলার হাতে। অ্যাসিড খাইয়া মরা নাকি খুব কষ্টের... জানি না। তর বাপেও আত্মহত্যা করছিল। নিশ্চয়ই এ্যাতো কষ্ট পাইয়া যান নাই। সোনা থাউক আর না থাউক, তর তো প্যাটে বিদ্যা আসে। তুই ইস্কুলে চাকরি পাবি না ? সোনা-খাদ-বানি ছাইড়্যা বাইর হও, মনা।
জীবন পাওয়া কি অতো সোজা নাকি ? জানাইবা আমারে কি ঠিক করল্যা। "
নাহ, গুপীদার আর মরা হয়নি।
★
এরও অনেক দিন পরে, আরো অনেকের বিয়েতে শাঁখ বাজিয়ে... উলু দিয়ে... দাদুকে, ঠামাকে প্রণাম করে একদিন শ্যামাপিসি গুপীদার সাথে কয়েকদিনের জন্য কটক-পুরী-সমুদ্দুর-মন্দির দেখতে গেলেন ।
আর ফেরা হয়ে ওঠেনি।
★
অনেকদিন পরে মায়ের পুরোনো অ্যালবামের ভেতর থেকে একটা লাল হয়ে যাওয়া খাম পেয়েছিলাম। আমি তখন প্রায় ডাক্তার।
সঙ্গে একটা ছবি।
চিঠিটা দাদুকে লেখা ।
★
" বাবা,
আমি আপনাগো শ্যামা। আপনারে তো কখনো চিঠি পত্র দেই নাই তাই ভাবতে ভাবতেই দিন সপ্তাহ মাস কাবার হইয়া গেল।
এইখানে আসোনের তো হইয়া গেল ছয় মাস... কুশলেই আছি সবাই।
তারপর খবর এই যে, গুপী এখন নিজের সোনা-রূপার দোকান চালানো ছাড়াও একটা প্রাইমারি ইস্কুলে পড়াইতাসে। আপনার আশীর্বাদে তার মন শান্ত হইসে।
একটা কথা কই। সারাজীবন আমারে মাইয়া কইলেন সকলের কাছে কিন্তু আমারে তো কোনদিন কইলেন না - বাবা কইয়া ডাকতে। বাবু হইয়াই রইলেন।
আজ আমি তাই ইচ্ছা কইর্যাই চিঠির উপরে বাবা লিখসি। দেখসেন ?
ছাড়ান দ্যান এই সব। ভাল খবর দেই। গুপীরে জোর কইর্যা বিয়া দিসি। কটকের মাইয়া। নাম - সত্যভামা। খুবই লক্ষ্মীমন্ত। সাত ক্লাস অব্দি পড়সে। আমি কইসি যে ম্যাট্রিক করতেই হইবো। বউ আবার চমৎকার রানধে। কচুর মুখি দিয়া লাবড়া বানায় -- আমার মন ক্যামন যে করে আপনারে খাওয়াইবার জইন্য।
ইচ্ছা আছে, বাড়ির উঠানে গাছ বসামু ... স্বর্ণচাঁপা, স্বর্ণলতা।
শাশুড়ি-বৌ দুইয়োজনে খাওনের একটা দোকান দিমু। নাম রাখুম -
"হেমাঙ্গিনী সত্যভামা ভোজনালয়। "
সারাজীবন আপনারা তো শ্যামা কইয়াই ডাকাডাকি করলেন, আমার তো একটা ভাল নামও ছিল। হেমাঙ্গিনী। স্কুলে একবার প্রাইজ পাইসিলাম একখান বই - ধাত্রী পান্না ! তাইতে এখনও সেই নাম লিখা আছে।
বাবা, আমার বোধহয় আর বাড়ি ফেরা হইব না। বউডারে পড়াইতে হইবো ... গুপীরেও একটু দ্যাখন লাগে। উড়নচন্ডী হইয়া আছে জীবনভর।
দোকানের ঠিকানা পাঠাইলাম।
শোনেন বাবা, একটা গুরুতর বিষয় কই। ছোট্ট একটাইরা জমি কিনসি। আশে পাশের কিসু লোক এমন ভাব করে য্যান আমরা চোর-চোট্টা। দ্যাশের-গ্রামের-ঠিকানার কাগজ-পর্চা দেখতে চায়। আপনে পুনুরে কইবেন, সে য্যান তার ডাক্তারির ছাপা কাগজে লিখা দ্যায় যে, আমি আপনাগো শ্যামা। এই দ্যাশ আমারও বরাবরের। তাইলেই এইখানে বাঁইচা বইত্যা থাকবার পারি।
পুনু ডাক্তার -- তার সহি করা কাগজের জোরে মানুষের নাম ঠিকানা জন্ম-মৃত্যুর জাবদা খাতায় ওঠে --- এইডা কোন ছার !
আর, সেই কাগজের এক্কেরে উপরে আপনে লাল কালিতে লিখবেন --
'শ্যামা আমাগো মাইয়া '।
তারপর দস্তখত কইরা দিয়েন।
দেখুম কেডা তাড়ায় আমারে !
আমাগো পুনুর বউ গীতা মায়েরে একটু কইবেন আট আর নয় ক্লাসের ইতিহাস আর ভূগলের কয়েকখান বই য্যান পাঠাইয়া দ্যায়।
আরেক কথা কই। রাগ কইরেন না য্যান। যেদিন আসি, না বইল্যা আপনার খানিকটা সোনা নিয়া আইসি। তার থিকা কিছুটা দিলাম গুপীর বৌটারে। সে তো আপনারই নাত বৌ। কি ভাবতাসেন -- চোর না বাটপাড় ?
না, না, নিশ্চিন্ত থাকেন।
সেই সব সোনাদানা নিই নাই।
আমি স্যাকরার ঘরের বৌ -আসল সোনা চিনি। আপনাগো আশীর্বাদ আর ভালোবাসা তো চব্বিশ কারাট সোনা। প্যাঁটরা-বাক্সের মধ্যে যা থাকে সে তো গিলটি করা।
কেমন কইলাম কন? জানি, আপনে মনে মনে কইতাসেন -- ছেমড়ি, বাপের সঙ্গে মস্করা করতাসো ?
বাপ ই তো। আপনে তো আমার অনেক জম্মের বাবা।
গুপীর বৌয়ের ছবি পাঠাইলাম। একটু ঠাকুরের আসনে ছোঁয়াইয়া দিয়েন।
সময়ে ওষুধ খাইয়েন।
প্রণাম নিয়েন। ইতি আপনার মাইয়া - শ্যামা কর্মকার।
★
বড়ো হয়ে ... বুড়ো হয়ে, অনেকবার গেছি কটক মেডিকেল কলেজে। কাছেই সেই বক্সীবাজার। প্রথম বারেই গিয়েছিলাম সেই দোকানের ঠিকানায়। অনেকবার হাত বদল হয়েছে সেটি। গোপীনাথ কর্মকারের হদিশ কেউ দিতেও পারেন নি। অবশেষে এক বয়স্ক মানুষ বলেছিলেনঃ- সোনার কাজ তো কবেই ছেড়েছিলেন তিনি ... মিডল স্কুলে পড়াতেন। খুব ভাল পড়াতেন। তার বৌ ও প্রাইমারী স্কুলে পড়াতেন। তারপর .... " উনি রিটিয়ার হলেন। কে জানে কোথায় আছেন এখন। আছেন ই কিনা কে জানে । "
★
বুঝলাম শ্যামাপিসির নিজের উঠোনে শেষ অব্দি স্বর্ণলতা আর স্বর্ণচাঁপা ফনফনিয়ে উঠেছিল।
আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরেছিলাম সেদিন।