কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি
প্রবুদ্ধ বাগচী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পর্ব ৩
টেক্সট বই বা রেফারেন্স বই কেনার সূত্রে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার গন্ধ মেখে নেওয়ার যে ধারা শুরু হয়েছিল মাধ্যমিক পর্বে তা আরেকটু বিকশিত হল উচ্চমাধ্যমিকে পা রাখার পর। আমাদের সময় প্রায় প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে তাঁদের মা-বাবা ও শিক্ষকরা পদে পদে মনে করিয়ে দিতেন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য। তাই মাধ্যমিকের ফলাফল দিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের হিসেব করলে চলবে না। উচ্চমাধ্যমিকের বিপুল সিলেবাস, প্রতিটি বিষয়ের বিস্তার অনেক, তাছাড়া এখনকার মতন তখন ইলেভেন ও টুয়েলভ আলাদা আলাদা পরীক্ষা হওয়ার চল ছিল না। উচ্চমাধ্যমিক মানে একসঙ্গে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বোঝা মাথায় নিয়ে সাগর পাড়ি দেওয়া। তাছাড়া, পাঠ্যক্রমের এই বিপুল বোঝা ছাড়াও হিসেব করে দেখলে উচ্চমাধ্যমিক-এর প্রস্তুতির জন্য সত্যি সত্যি দুবছর সময় পাওয়া যেত না। ক্যালেন্ডারের হিসেবে তখন মাধ্যমিক পরীক্ষা হত মার্চ মাসের গোড়ায়, ফল বেরোতো জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ নাগাদ। ফলে উচ্চমাধ্যমিকের ক্লাস শুরু হতে হতে জুলাইয়ের শেষ। পরের বছর টুয়েলভে উঠে পড়াশোনার সময় মিলত আট মাসের বেশি নয় । তাছাড়া যারা উচ্চমাধ্যমিকের পাশাপাশি জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবে তাঁদের চাপ আরও বেশি। কারণ, সাধারণভাবে জয়েন্টের সিলেবাস উচ্চমাধ্যমিকের সঙ্গে এক হলেও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বলেই সেখানে কঠিন কঠিন প্রশ্ন হয়, কঠিন কঠিন অঙ্ক করতে হয়। সাধারণভাবে যারা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিত তাঁদের যেসব পাঠ্যবই পড়লে চলে যেত, জয়েন্ট এন্ট্রান্সের জন্য সেগুলো উপযুক্ত ছিল না। অবশ্য এখানে কেবল উচ্চমাধ্যমিক বিজ্ঞান শাখার কথা বলা হলেও কলা ও বাণিজ্য শাখাতেও যে ব্যাপারটা সহজ ছিল এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। হয়তো তাঁদের ক্ষেত্রে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার ব্যাপারটা ছিল না, তবে সব মিলিয়ে ব্যাপারটা ছিল বেশ বেশ দুরূহ। তাছাড়া আজকের মতো এত মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ তখন দুরস্ত, কাজেই সীমিত আসনসংখ্যা থাকায় প্রতিযোগিতার তীব্রতা ছিল অনেক বেশি। অবশ্য আমরা সেই তীব্রতার তুলনামূলক হিসেব করতে রাজি নই। আজ যারা এইসব পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের সামনেও যে পথ ফুলে ফুলে ঢাকা এমন নয়। কারণ মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং-এ আসন সংখ্যা বাড়লেও প্রতিযোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। আর আমাদের সময়ে যা আমরা ভাবতেই পারতাম না, সেই ব্যক্তি বা কর্পোরেট মালিকানার মেডিক্যাল কলেজ বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ চালু হয়েছে এই বিগত তিরিশ বছরে। সেই সঙ্গে ফুলে ফলে বিকশিত হয়েছে নানান কিসিমের ট্রেনিং/ কোচিং সেন্টার, সেখানেও মূলত ব্যক্তি বা কর্পোরেট-গোষ্ঠীর ‘দাদাগিরি’। আমাদের বেড়ে ওঠার দশকে জয়েন্ট এন্ট্রান্সে বসা ও পাশ করার জন্য কোনো কোচিং সেন্টারের নাম ও ঠিকানা আমরা শুনিনি। হ্যাঁ, কিছু বিশেষ শিক্ষক ছিলেন যারা জয়েন্টের ছাত্র-ছাত্রীদের আলাদা করে পড়াতেন। তাঁদের কাছে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, অঙ্ক বা জীববিদ্যার বিশেষ ধরনের নোটস থাকত বা শক্ত শক্ত অঙ্কের সলিউশান থাকত যা তাঁরা ওইসব পড়ুয়াদের দিয়ে তাঁদের তালিম দিতেন। শহর কলকাতার আওতার বাইরে আমাদের জনপদেও এমন কেউ কেউ ছিলেন যারা জয়েন্টের পড়ুয়াদের আলাদা ব্যাচে পড়াতেন, তাঁর জন্য তাঁদের দক্ষিণাও ছিল কিছু বেশি । আবার কলকাতা শহরেও এমন কিছু প্রবাদপ্রতিম ‘জয়েন্ট পাশ-করানো স্যার’ এর গল্প আমরা শুনেছি। সেই সময়ের হিন্দু স্কুলের এক স্বনামধন্য অঙ্ক স্যারের কথা এখনই মনে পড়ছে। যাক, ওসব গল্প ছেড়ে আসুন আবার আমরা ফিরে আসি বইপাড়ায়।
উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে শুধু ইলেভেন ক্লাসের বইগুলোর বিপুল আয়তন দেখে প্রাথমিকভাবে বেশ ভড়কে গিয়েছিলাম একথা আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। আর তখন প্রায় আমাদের বলেই দেওয়া হল ওই বিপুলাকার বইগুলির একটাকে ভর করে পরীক্ষা পাশ করা যাবে না।ইলেভেন ক্লাসে অঙ্কের ছিল তিনটে বই। ত্রিকোণমিতি, স্থানাঙ্ক জ্যামিতি ও বীজগণিত । এগুলো সব বিখ্যাত ‘দাস মুখার্জি’ সিরিজের , যা নাকি সেই সময় একটু উঁচু তারে বাঁধা বলে মনে করা হত, অর্থাৎ একটু ‘ভাল’ ছেলেরাই এইসব বইয়ের অঙ্ক করে — জয়েন্ট এন্ট্রান্সেও এই বই থেকে অঙ্ক দেওয়া হয়। অবশ্য ‘ত্রিকোণমিতি’ বইটির লেখক ছিলেন মুখার্জি ও গঙ্গোপাধ্যায়। অনেকদিন পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর লেখায় পড়েছি, এই ‘গঙ্গোপাধ্যায়’ (সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়) ছিলেন সম্পর্কে তাঁর মাতামহ (সুনীলের মায়ের মেজমামা), সেকালের নামজাদা গণিতবিদ। সেই আমলে তিনি ‘ডি এস সি’ ডিগ্রি পেয়েছিলেন ও দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধান। কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা ‘ইউ এন ধর অ্যান্ড সন্স’ ছিলেন এঁদের প্রকাশক। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইনে-কড়ি তখন তেমন ভাল ছিল না , কিন্তু এই পাঠ্যবই-এর বিক্রি থেকে তিনি প্রচুর আয় করতেন, এই খবর আমরা সুনীলের ওই লেখাতেই পাই। প্রসঙ্গত, আজও কিন্তু এই ‘ইউ এন ধর’ উচ্চতর গণিতের নানা টেক্সট বই প্রকাশ করে চলেছেন। কিন্তু একটা বই থেকে অঙ্ক প্র্যাক্টিস করলে কোনো লাভ নেই, তাই বাবার সঙ্গে কলেজ স্ট্রিটে এসে উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম যে-বইটি কিনেছিলাম তা হল ‘ভঞ্জ গাঙ্গুলি’র ‘উচ্চমাধ্যমিক গণিত’। ‘দাস মুখার্জি’ সিরিজের বইগুলো ছিল আলাদা আলাদা, অর্থাৎ বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি ও জ্যামিতির তিনটে বই — ‘ভঞ্জ গাঙ্গুলি’র একটি বৃহৎ মহাভারত-সদৃশ বইয়ের মধ্যেই তিনটে আলাদা আলাদা বিভাগ। প্রাথমিকভাবে হাতে নিলে শিহরণ জাগা একদম স্বাভাবিক। এবারেও বই কেনার সময় সেই বইয়ের গুমটি ও রিবেটের জন্য দরাদরি পেরিয়ে বই বগলে নিয়ে বাড়ি ফেরা। এর অল্প পরেই আবার যাই পদার্থবিদ্যার রেফারেন্স বই হিসেবে অজয় চক্রবর্তী- র বই কিনতে। সেই সঙ্গে অজয় চক্রবর্তীর একটি বই ছিল যা জয়েন্ট এন্ট্রান্সের পরীক্ষার্থীদের অবশ্যপাঠ্য — এখানে পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন জটিল প্রশ্ন ও অঙ্ক, উত্তর সমেত পাওয়া যেত। পরে বায়োলজির ‘সান্যাল চ্যাটার্জি’ বা রসায়নের রেফারেন্স বইও কেনা হয়েছে একইভাবে।
বই কেনাকে সামনে রেখে বারবার কলেজ স্ট্রিট আসা যাওয়ায় একটা সুবিধা হল জায়গাটা ক্রমশ আমাদের কাছে পরিচিত হয়ে উঠছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের নাম তখন আর আমাদের কাছে অপরিচিত নয়, সেই কলেজ সামনা-সামনি দেখে বিস্ময় লেগেছিল বই কি। তার সুউচ্চ চূড়ায় সেই ঘড়ি যেন মনে হত এক ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হিসেবে কেবল সময় মেপে চলেছে। তার পাশেই হেয়ার স্কুল, বিপরীতে হিন্দু স্কুল। এইসব স্কুলের নাম আমরা পেতাম এ বি টি এ র টেস্ট পেপারে। ‘টেস্ট’ পরীক্ষার পরে আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, কবে টেস্ট পেপার বেরোবে আর তাতে থাকবে নামী দামী স্কুলের প্রশ্নপত্র। পাশাপাশি রেখে তুলনা করলেই বুঝতে পারতাম হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল, সাউথ পয়েন্ট, সেন্ট টমাস ইত্যাদি স্কুলের প্রশ্নের মান গড়পড়তা জেলার পরীক্ষার প্রশ্নের থেকে উঁচু। হিন্দু-হেয়ার ছাড়িয়ে আরেকটু এগিয়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ । কলেজ স্ট্রীট মানে শুধু বই নয় তার সঙ্গে মেধা ও বৌদ্ধিক চর্চার একেকটা গ্রন্থি এই সব প্রতিষ্ঠান। বলা দরকার, এইসব সরকারি স্কুলগুলি আজকের মতো তখন কৌলীন্য হারিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যায়নি মোটেও। আশির দশকে হিন্দু ,হেয়ার, সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল থেকে মাধ্যমিক / উচ্চমাধ্যমিকে ছেলেরা মেধাতালিকায় উঁচুর দিকে নাম তুলত। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অবজেক্টিভ প্রশ্নের কাঠামো তৈরি করে বা ইলেভেন-টুয়েলভ আলাদা আলাদা পরীক্ষা ব্যবস্থা চালু করে প্রচুর প্রচুর নম্বর পাওয়া যেত না মোটেও। আজকের ব্যবস্থা খারাপ কিম্বা আগের ব্যবস্থাটাই ভাল ছিল এই ধরনের কোনো সিদ্ধান্তের কিনারে আসতে চাইব না, বিবৃত করতে চাই সেইদিনকার বাস্তবতাটুকুই। তবে একদম নিরপেক্ষ বিন্দু থেকে এবং শিক্ষাবিজ্ঞানের দৃষ্টি থেকে বিচার করলে, সিলেবাস ও পরীক্ষার বোঝা পড়ুয়াদের জন্য যত কম থাকে ততই ভাল। ভারি ভারি বইয়ের চাপে ন্যুব্জ পড়ুয়া শিখে একেবারে দিগগজ হবে এমন কোনো স্বতঃসিদ্ধ নেই। অনেকদিন আগে থেকেই, কেন্দ্রীয় বোর্ডের স্কুলগুলিতে নাইন-টেন ও ইলেভেন-টুয়েলভ আলাদা করে পরীক্ষা হত। বস্তুত পরীক্ষার সঙ্গে শিক্ষার কতটা নির্দিষ্ট যোগ আছে, সেটা নিয়ে এখনও আমাদের মতো অনেকেই সন্দিহান। আবার অন্য কথায় ফিরি।
তখন অতটা চেনা ছিল না বলে বুঝতে পারিনি আসলে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার আয়তন ঠিক কতখানি। পরে খুঁজে-পেতে পায়ে হেঁটে দেখেছি, দক্ষিণ দিকে ট্রামলাইন বরাবর বৌবাজার ক্রশিং থেকে ( বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট) মোটামুটি বইপাড়ার শুরু, সরকারিভাবে ‘কলেজ স্ট্রিট’ রাস্তাটাও শুরু হয়েছে ওইখান থেকে। সুবিখ্যাত ‘গোপাল পাঁঠার দোকান’ পেরিয়ে কিছু হার্ডওয়ার-এর দোকান, তারপরেই কুখ্যাত ‘হাড়কাটা গলি’ যার সরকারি নাম ‘প্রেমচাঁদ বড়াল লেন’ — মূলত এর পর থেকেই প্রকাশনা সংস্থাগুলির অফিস আরম্ভ হয়ে যায়। এমনকি নিচে হার্ডওয়ারের দোকান বা মেডিক্যাল সরঞ্জামের বিপণি এমন শতবর্ষ পেরোনো বাড়ির দোতলা বা তিনতলায় প্রকাশক সংস্থার অফিস আছে যা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই । উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি ‘প্রগ্রেসিভ পাব্লিশার্স’ এর কথা, যাদের ঠিকানা ৩৭ডি, কলেজ স্ট্রিট —- একটা সময় এই অফিস খুঁজে পেতে আমাকে ঘোল খেয়ে যেতে হয়েছিল —- অনেকটা ঘুরপাক খাওয়ার পরে সেই বাড়ি খুঁজে পেয়ে দেখতে পাই আসলে সেই বাড়িটার সামনে হার্ডওয়ারের দোকান, তারই পাশে একটা সঙ্কীর্ণ দরজা দিয়ে ঢুকে প্রাচীন নড়বড়ে সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠতে হয়। এইভাবে এগিয়ে যেতে যেতে উত্তরদিকে ট্রামলাইন ধরে সোজা বিবেকানন্দ রোডের মোড় অবধি ছড়িয়ে আছে বইপাড়ার ডানার প্রান্ত । খুব নির্দিষ্ট করে বললে বিবেকানন্দ রোড ও বিধান সরণীর সংযোগস্থলে, এখন যেখানে বিবেকানন্দের জন্মভিটেকে সুসজ্জিত করে মিউজিয়াম তৈরি হয়েছে তার উলটো দিকে ‘ডি এম লাইব্রেরি’ ও ‘ সংস্কৃত পুস্তক ভান্ডার’ — পাশাপাশি দুটি প্রাচীন প্রকাশনা সংস্থার অফিস ও দোকান। ওইটাই বইপাড়ার উত্তরদিকের সীমানা বলে ধরা যায়। ওই বাড়িতেই একদা অবস্থান করত ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স’ প্রকাশনার দফতর, যারা একচেটিয়াভাবে রবীন্দ্রনাথের বই প্রকাশ করতেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ অনেকবার ওই দফতরে এসেছেন। কোনো এক কারণে কিছু একটা জরুরি প্রয়োজনে কবির টাকার দরকার হওয়ায় তিনি এই প্রকাশনাকে তার বইয়ের সত্ত্ব আগাম বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ সেই কাজে ব্যয় করেন, এই তথ্য পাওয়া গেছে প্রশান্তকুমার পালের ‘রবিজীবনী’ তে। যদিও সেই প্রকাশনা সংস্থা আজ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ইতিহাস বলছে, কলেজ স্ট্রিটের বুকে প্রথম যে বইয়ের দোকানটি গড়ে উঠেছিল, তার মালিক ছিলেন এই গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। তবে প্রথম দিকে তাঁদের নিজস্ব কোনও দোকান ছিল না। হিন্দু হোস্টেলের সিঁড়িতে মেডিকেল বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসতেন তিনি। এরপর ১৮৮৩ সালে গড়ে ওঠে ‘এস কে লাহিড়ী অ্যান্ড কোম্পানি’ এবং বছর তিনেক বাদে ‘দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি’(১৮৮৬)। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও এখানে একটি বইয়ের দোকান খুলেছিলেন যার নাম ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারি’।
কলকাতায় প্রথম বই-বিক্রেতা হিসেবে যার নাম পাওয়া যায়, তিনি গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। প্রথমে শুধু বই-বিক্রেতা হলেও পরে একাধারে প্রেসের কর্মী, লেখক, প্রকাশক, সাংবাদিক, পুস্তকবিক্রেতা সব ভূমিকাতেই তাঁকে দেখতে পাই। কোনও এক বাবুরাম এদেশীয়দের মধ্যে প্রথম ছাপাখানা স্থাপন করলেও ইউরোপীয় রীতিতে বই প্রকাশের ক্ষেত্রে গঙ্গাকিশোরই পথিকৃৎ। শ্রীরামপুর প্রেসে কম্পোজিটর হিসেবে নিজের জীবন শুরু করে পরে কলকাতায় এসে ১৮১৬ সালে সুসম্পাদিত এবং প্রথম বাংলা সচিত্র গ্রন্থ ‘অন্নদামঙ্গল’ তিনিই প্রকাশ করেন। শুধু ছাপানোই না, বাড়ি বাড়ি ঘুরে প্রচার করে বইটি বিক্রির যে বিপণন-কৌশল তিনি গ্রহণ করেন, ইতিহাসের বিচারে তাতেও গঙ্গাকিশোর অসামান্য। কাগজের বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, উৎসাহী ব্যক্তিরা তাঁর বাড়িতে এসেও বই কিনতে পারতেন। ১৮১৭ সালে স্থাপিত হয় ‘স্কুল বুক সোসাইটি’। হিন্দু কলেজের পাশেই ছাত্রদের জন্য তাঁরা একটা বইয়ের দোকান খোলেন। শুধু ছাত্ররাই নয়, সাধারণ মানুষও সেই দোকানে বই কিনতে আসতেন। প্রায় একই সঙ্গে শোভাবাজার রাজবাড়ির বিশ্বনাথ দেব একেবারে অন্যস্বাদের সস্তা-বই প্রকাশ শুরু করেন—- বটতলার বইয়ের সেই শুরু । আমরা জানি, শোভাবাজার-চিৎপুর এলাকার একটি বিশাল বটগাছকে কেন্দ্র করে এই নামের উৎপত্তি হয়। সেই বটগাছ এবং তার আশেপাশের এলাকায় যে মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প গড়ে উঠেছিল, তা প্রধানত সাধারণ ও অর্ধশিক্ষিত পাঠকের চাহিদা মেটাত। এছাড়াও লল্লুলাল নামের এক প্রকাশকের নামও দেখতে পাই, যদিও তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না। এভাবেই চলত, যদি না ১৮৪৭ সালে স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বই ব্যবসায় নামতেন, যাতে বাংলা প্রকাশনা-জগতের গুণগত সমৃদ্ধি ঘটে। সেই বছর (১৮৪৭) ছশো টাকা দিয়ে আর্মহার্স্ট স্ট্রিটে ‘সংস্কৃত যন্ত্রালয়’ নামে একটা কাঠের প্রেস কিনে বিদ্যাসাগর মশাই কলেজ স্ট্রিট এলাকার আরপুলি লেনে (মেডিক্যাল কলেজের উল্টোদিকের গলিরাস্তা) একটা বইয়ের দোকানও খুলে ফেললেন। নাম রাখলেন ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি’। কার্যত বর্তমান কলেজ স্ট্রিট এলাকায় সিরিয়াস বই-ব্যবসার সেই শুরু। যেহেতু দোকানের নাম ‘ডিপজিটরি’ তাই তাঁর নিজের লেখা বই ছাড়াও অন্যের বইও ছাপা হত এখানে। তাঁর দোকানে নিজের প্রেসের বই ছাড়াও অন্য অনেক লেখক তাঁদের বই বিক্রির জন্য রেখে যেতেন। বই বিক্রি হলে কমিশন কেটে টাকা দেওয়া হত। আজও কলেজ স্ট্রিটে তাঁর দেখানো এই মডেলেই বইয়ের ব্যবসা চলছে। যথাসময়ে প্রাপ্য অর্থ বুঝিয়ে দেওয়া আর যথাযথ হিসেবের জন্য বিখ্যাত হয়েছিল ‘বিদ্যাসাগরের বইয়ের দোকান’। একজন সৎ পুস্তক বিক্রেতা হিসেবেও আদর্শ স্থাপন করেছিলেন বিদ্যাসাগর। যদিও বিদ্যাসাগরের আরও অন্যান্য অনুসরণযোগ্য দৃষ্টান্তের মতো এই ব্যাপারেও আমরা তাঁর দেখানো পথ থেকে সরে এসেছি। কলেজ স্ট্রিটের বেশিরভাগ প্রকাশক আজও লেখককে তাঁর বই বিক্রির প্রকৃত তথ্যের হিসেব দেন না, লেখকের প্রাপ্যও ঠিকমতো মেটান না।
কাছাকাছি ওই সময় কলেজ স্ট্রিটে আর যে কটি বইয়ের দোকানের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হল ‘বি ব্যানার্জি এন্ড কোং’, ‘দাসগুপ্ত এন্ড কোং’ (এর উল্লেখ আগেই করা হয়েছে) আর ‘সোমপ্রকাশ ডিপজিটরি’। আর ছিলেন আশুতোষ দেব যিনি এ.টি.দেব. নামেই খ্যাত, যার ‘অভিধান’ ছিল তুমুল জনপ্রিয় । ১৮৬০ সালে অভিধানের ব্যবসায় তাঁর প্রায় একচেটিয়া প্রভাব ছিল। শেষের দিকে তাঁর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সুবল চন্দ্র মিত্র সংকলিত অভিধান। এই সময় যোগেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ক্যানিং লাইব্রেরী’ গল্প ও উপন্যাস ছাপা শুরু করল। নতুন লেখক তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে বাজি রেখে ‘স্বর্ণলতা’ লিখলেও (১৮৭৩) তা ছাপার জন্য কোনও প্রকাশক এগিয়ে আসছিলেন না—-যোগেশবাবু তখন সেই সাহস দেখান। বইটি ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কলেজ স্ট্রিটের বই-ব্যবসা এইভাবেই জমে উঠতে থাকে।
এই সময়কালে ‘অ্যালবার্ট হল’ ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরি হয় যে বাড়িতে আজকের ‘কফি-হাউস’। নতুন বাড়ির নিচের তলার সব ঘর দেখতে দেখতে ভাড়া নিয়ে নিল প্রকাশকরা। প্রথমেই এল ‘চক্রবর্তী চ্যাটার্জী এন্ড কোম্পানি’। তারপর পাশের ঘরে উঠে এল বিবেকানন্দ স্ট্রিটের ‘কমলা বুক ডিপো’। এল ‘সেন রায় এন্ড কোং’, ‘ইউ.এন.ধর’ আর ‘সেন ব্রাদার্স’। এই ‘সেন ব্রাদার্স’ এর মালিক ভোলানাথ সেন নিজেও সহজ ভাষায় ছোটদের জন্য কিছু কিছু বই লিখতেন । এমনই একটি বইয়ে নবী হজরত মহম্মদের একটি ছবি প্রকাশ হলে একশ্রেণির মুসলমান মৌলবাদী রুষ্ট হন, তার পরিণামে লাহোরের দুই দুষ্কৃতী যুবার হাতে তিনি নিজের দফতরে নিহত হন (১৯৩১)। কলেজ স্ট্রিটের প্রথম ও একমাত্র ‘শহিদ প্রকাশক’ তিনিই। এই বিষয়ে বিস্তৃত বিবরণ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে দেবারতি মুখোপাধ্যায়-লিখিত ‘মৃত্যুমেডেল’ গ্রন্থে। সেখান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যে-ছবি লেখক ভোলানাথ সেন তাঁর বইয়ে ব্যবহার করেছিলেন তা তাঁর নিজের বা কোনো ভারতীয় শিল্পীর আঁকা নয় — এই ছবি এঁকেছিলেন পঞ্চদশ শতকের একজন তুর্কি শিল্পী। ছবিটি আঁকা হয়েছিল হিব্রু বাইবেলে উল্লিখিত দেবদূত গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে নবী মহম্মদের আলাপচারিতা অবলম্বনে, যাতে কোনোভাবেই ইসলাম বিষয়ে কোনো তূষ্ণীভাব চিত্রিত হয়নি। মুসলিম ধর্মগ্রন্থ ‘কোরআন’-এর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সংস্করণেও ব্যবহার করা হয়েছে এই ছবি। অবশ্য অনেক টানা-পোড়েনের পর ভোলানাথ সেনের দুই আততায়ীকে বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যাই হোক এইভাবেই ‘অ্যালবার্ট হল’ ও তার আশেপাশে প্রচুর বইয়ের দোকান গড়ে উঠতে লাগল, আশেপাশের গলিগুলিও ভরে উঠল বইয়ের দোকানে। আর বিংশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে গোটা কলেজ স্ট্রিট ছেয়ে গেল বইয়ের দোকানে, তার নামই হয়ে গেল বইপাড়া ।
পূর্ব- পশ্চিমে বইপাড়ার সীমানা হিসেবে ধরা যায় পুবে মোটামুটি শ্রদ্ধানন্দ পার্ক আর পশ্চিমে মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে সেন্ট্রাল এভিনিউ এর সীমানা অবধি। এমন নয় যে, এই পরিসীমায় সবটাই বইয়ের প্রকাশন জগৎ, অন্য আরও নানা দোকান নিশ্চয়ই আছে —- তবে বইপাড়ার রেশ এসে পড়েছে এই অংশটা জুড়ে। সেন্ট্রাল এভিনিউ পেরিয়ে হাওড়ার দিকে এগোলে আর কোনো প্রকাশন সংস্থা নেই। তবে পুব দিকে শ্রদ্ধানন্দ পার্ক পার হয়ে শিয়ালদহের দিকে এগোলে বৈঠকখানা বাজার বা পটলডাঙ্গা স্ট্রিট এলাকাটা অন্য আরেক রকম ভাবে এই প্রকাশনা জগতের সঙ্গে যুক্ত। তা হল ছাপার নানারকম কাগজের পাইকারি বাজার এখানেই , সেই সঙ্গে আছে কিছু নামী প্রেস যাদের ব্যবসার বেশিটাই আসে ওই বই-প্রকাশকদের কাছ থেকে। আমরা যখন ওইসব এলাকায় যাতায়াত শুরু করি তখন অবশ্য অফসেট-মুদ্রণপ্রযুক্তি ডানা মেলেনি ফলে প্রেস বলতে বোঝাতো তার কালিঝুলি-মাখা কম্পোজ রুম, সিসের ভারি গ্যালি ও মেশিন হিসেবে অল্প ছাপার ক্ষেত্রে ট্র্যাডল মেশিন আর বই ছাপার ক্ষেত্রে ষোলো পাতা ফর্মা ছাপার বড় ফ্ল্যাট মেশিন। এখানেই বলে রাখি, অফসেট বা ডিটিপি প্রযুক্তি এসে মামুলি ছাপাখানাকে উচ্ছেদ করার পরে এই অঞ্চলে তৈরি হয়ে যায় অনেক ডিটিপি সেন্টার। অত্যন্ত অপরিসর এক চিলতে ঘুপচি ঘরে দুটো তিনটে ডেস্কটপ কম্পিউটার বসিয়ে বহু মানুষ নিজের রুটি রুটির সংস্থান করেন, এই এলাকা থেকেই। বই প্রকাশনের সূত্রে এইসব গল্প না এসে উপায় নেই। কারণ এত বড় একটা প্রকাশনার দুনিয়া যে গড়ে উঠল, তার পাশে পাশে এই বাণিজ্যের আনুষঙ্গিক প্রয়োজনগুলো ছিল বলেই। ছাপার কাঁচামাল কাগজ, অক্ষরবিন্যাস কেন্দ্র (কম্পোজিং ইউনিট) ও মুদ্রণযন্ত্রের পাশাপাশি এই আয়তাকার এলাকার মধ্যে মিলেমিশে আছে বাঁধাই-কারিগরদের অসংখ্য দোকান। প্রেস থেকে ছাপা হয়ে সেই ফর্মা চলে যায় বাঁধাইঘরে , সেখান থেকেই জন্ম হয় পূর্ণাঙ্গ একটা ঝকঝকে বইয়ের। বৈঠকখানা এলাকা থেকে সেই ‘ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’র মোড়ের বিপরীত দিকে চাঁপাতলা এলাকা অবধি ছড়িয়ে আছে এই বাঁধাই-এর দোকানগুলি।
এখানে পাঠকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, বইপাড়া নিয়ে লিখতে বসে এগুলোর কথা কি বলা দরকার? আমাদের মতে, কলেজ স্ট্রিট মানে যেমন নানারঙের প্রকাশনের এক বিরাট সাম্রাজ্য বা কলেজ স্ট্রিট-এর ছড়ানো এলাকা মানে যেমন ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান আর বাংলার রেনেসাঁ- র বর্ণময় বিচ্ছুরণের রশ্মিচিহ্ন—-- ঠিক তেমনি এটাও ভাবতে হবে এত বড় একটা বাণিজ্য এলাকা, এত সুবিস্তৃত প্রকাশনার জগৎ কিন্তু আজও তেমন কোনো ঝকমকে প্রযুক্তি-লালিত সংগঠিত বিনিয়োগের গন্তব্য হয়ে ওঠেনি। বিশ্বায়ন-পরবর্তী আমাদের প্রতিটা বাণিজ্যদুনিয়া যেভাবে নিজেদের পাল্টে পাল্টে নিয়েছে, কলেজ স্ট্রিটের এই বিপুল প্রকাশনা- মানচিত্রে তার পায়ের ছাপ কতটুকু পেয়েছি আমরা ? পুরোনো ছাপার প্রযুক্তি অচল হয়ে গিয়ে অফসেট প্রযুক্তি এসেছে ঠিকই, কালিঝুলি-মাখা স্বল্প পাওয়ার বাল্বের আলোয় সিসের অক্ষর নিয়ে কম্পোজরুমের জায়গা নিয়েছে কম্পিউটার নির্ভর ডি টি পি । আজকের মুদ্রণ-প্রযুক্তিতে একটা বই ছাপা হওয়ার আগেই ডিজিটাল মাধ্যমে সিডি বা পেন ড্রাইভে বন্দি হয়ে যায়। ফলে বইয়ের পরের সংস্করণ প্রকাশ করার কাজ নিতান্তই অনায়াসসাধ্য হয়ে গেছে। কিন্তু এ তো মুদ্রণ-প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ। পাশে পাশে প্রকাশনা হাউসগুলির কর্মী , ছাপাখানার কর্মচারীরা, বাঁধাই- কর্মীরা কি সঠিক শ্রমের জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিক পান আজও ? তাঁদের এই কাজের কি সামাজিক নিরাপত্তা আছে আদৌ ? কোভিড-কালীন লকডাউনে যখন প্রায় দেড়-দু বছর কলেজ স্ট্রিটের প্রকাশনা ব্যবসা চরম দুর্বিপাকে, তার ওপর আম্ফান ঝড়ের প্রকোপে প্রচুর বইবিক্রেতা বা প্রকাশকদের বই নষ্ট হয়ে যেতে দেখলাম আমরা, তখনই আরেকবার নতুন করে বোঝা গেল কোন তাসের ঘরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে বাংলার এই কিম্বদন্তী প্রকাশন দুনিয়া। প্রচুর মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছেন, যাদের কাছে এই কলেজ স্ট্রিটই ছিল রুটি-রুজির ভরসা। খেয়াল করে দেখেছি, আজকে যখন পাড়ার মুদির দোকানেও মোবাইল নির্ভর অ্যাপ বা কার্ড দিয়ে কেনাকাটা করা যায় তখন কলেজ স্ট্রিটের অধিকাংশ বই-বিপণি বা প্রকাশকের কাছে সেই ব্যবস্থাটুকুও অমিল। এটা একটা দৃষ্টান্তমাত্র। গড়পড়তা প্রকাশকের অবস্থা একেবারেই বলার মতো নয়। তবে এটা স্বতন্ত্র আলোচনার প্রসঙ্গ।
এই পর্ব শেষ করার আগে একটা সংশয়ের জবাব দিতে হবে। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বই-কেনা দিয়ে যে পর্বের শুরু তাতে বইপাড়ার যে এতসব খুঁটিনাটি কথা এল, পাঠক ভাবতেই পারেন সেই কিশোরবেলাতেই কি এত কিছু আমাদের জেনে ফেলার সুযোগ ঘটেছিল? এর অনিবার্য উত্তর, না। তখন এত কিছুর কোনোটাই আমাদের জানার সুযোগ ঘটেনি। এর সমস্তটাই পরের জীবনের সঞ্চয়। দুটো তথ্য, এখানে জানাই। আশির দশকের গোড়ায় হাওড়া ও শিয়ালদহ রেল স্টেশন থেকে কলেজ স্ট্রিটের মূল সংযোগবাহী রাস্তা মহাত্মা গান্ধী রোড ছিল বাস বা ট্রামযাত্রীদের কাছে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার জায়গা। স্বল্প পরিসর রাস্তায় উভমুখী গাড়ির চলাচল, ট্রামলাইন এবং সেন্ট্রাল আভিনিউ-এর মোড় পেরিয়েই যে মেছুয়াবাজার বা তার পরে রবীন্দ্র সরণী ( চিৎপুর রোড) ও সাবেক বড়বাজার—- সেখানে ঠেলা, টানা-রিকশা সব জড়োসড়ো পাকিয়ে একটা ট্রাফিকপিন্ড হয়ে উঠত। ফলে হাওড়া যাওয়ার জন্য কলেজ স্ট্রিট থেকে বাস/ট্রামে উঠলে তার অব্যর্থ পরিণতি হত সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পেরোনোর অল্প আগে বা পরে সেই ট্রাফিকের পিন্ডে আটকে পড়া। ফলে বহুবার এই দুর্বিপাকের আশঙ্কায় বাস ট্রামের ভরসায় না থেকে পদব্রজে হেঁটে আসতে হয়েছে হাওড়া স্টেশন অবধি।
এই ট্রাফিক জ্যামের সূত্রেই মনে পড়ে গেল অন্য একটা বিপরীত ঘটনা । এই গল্পটা প্রয়াত সঙ্গীত ও লোক-সংস্কৃতি গবেষক সুধীর চক্রবর্তীর কাছে শোনা। গত শতকের চল্লিশের দশকে শিবপুরে (হাওড়া) থাকার সময় সুধীরবাবু মাঝে মাঝে হেঁটে হেঁটে মহাত্মা গান্ধী রোড দিয়ে কলেজ স্ট্রিটের দিকে আসতেন। আজকের ‘রবীন্দ্র সরণী’ তখন ছিল চিৎপুর রোড —- মহাত্মা গান্ধী রোড যেখানে চিৎপুর রোডকে পেরোচ্ছে তার উত্তরপ্রান্ত অর্থাৎ জোড়াসাঁকো-মুখী রাস্তার নাম ছিল ‘আপার চিৎপুর রোড’ আর দক্ষিণপ্রান্ত যা নাখোদা মসজিদের সামনে দিয়ে লালবাজারের দিকে গেছে তার নাম ‘লোয়ার চিৎপুর রোড’। আজকের এই জনবহুল এলাকার দিকে তাকিয়ে বোঝাই যাবে না, সেই চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকে এই রাস্তা ছিল কীরকম ফাঁকা। সেই সূত্রেই এই ‘আপার চিৎপুর রোড’ সুধীরবাবুদের লব্জে হয়ে উঠেছিল ‘অপার’ চিৎপুর রোড — অর্থাৎ যেখান দিয়ে সহজে হেঁটে যাওয়া যায়। এখন আছে কি না জানি না তবে কয়েক বছর আগেও ওই রাস্তার সংযোগস্থলে একটা দেওয়ালে নীল রঙের টিনের প্লেটে সাদা অক্ষরে লেখা একটা বোর্ড আটকানো ছিল যাতে ইংরিজি হরফে লেখা ছিল ‘আপার চিৎপুর রোড’ । অবশ্য বেশ কয়েকবছর আগে (২০০৪-২০০৫) কলকাতা পুলিশ মহাত্মা গান্ধী রোডে ট্রাফিক চলাচল একমুখী করে দেওয়ায় সেই সাবেকি ট্রাফিকজ্যাম এখন বেশ অনেকটাই কমে এসেছে।
যাই হোক এই সনাতনী ট্রাফিক জ্যাম সূত্রেই এলাকাগুলো চিনে নেওয়ার একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে এইভাবেই। আর বৈঠকখানা এলাকার কাগজপট্টি বা বাঁধাইঘরগুলিকে চিনতে হয়েছিল এক অন্যসূত্রে, সেই প্রসঙ্গ যথাসময়ে পরে আসবে। উপসংহার হিসেবে একটা খবর ভাগ করে নিই। পটলডাঙ্গা স্ট্রিট-কে বাংলা সাহিত্যে অমর করে রেখেছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তার টেনিদার কাহিনিতে । পাশাপাশি বাংলার র্যাডিকাল রাজনীতির জগতে পটলডাঙ্গা স্ট্রিটের ‘অমি প্রেস’ একটি উল্লেখ্য প্রতিষ্ঠান। নকশালবাড়ি রাজনীতির অধিকাংশ সমর্থক গোষ্ঠী বা সংগঠনের যাবতীয় বই, পুস্তিকা, ট্যাবলয়েড, হ্যান্ডবিল একটা সময় নিয়মিত ছাপা হয়েছে এই প্রেসে। এই সংস্থার মালিক পৃথ্বীশ সাহা নিজে ছিলেন একজন র্যাডিকাল চিন্তাভাবনার সমর্থক, ফলে প্রশাসনিক ও পুলিশি আক্রমণের ঝুঁকি নিয়েও প্রেস কর্তৃপক্ষ অকুতোভয় সমর্থন জানিয়ে গেছেন এইসব মুদ্রণে, এমনকি অনেক সময় নিজেদের প্রাপ্য অর্থও তাঁরা সময়মত পাননি তবু বিমুখ হননি । বাংলার বৈপ্লবিক রাজনীতির মানচিত্রে এই প্রতিষ্ঠান কিছুটা ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’ । ‘অমি প্রেস’ এর কর্ণধার পৃথ্বীশ একই সঙ্গে ছিলেন সাহিত্যপ্রেমিক, তাঁর বউদির নামে তিনি একটি সাহিত্য পুরস্কারও চালু করেছিলেন যা এখনও প্রতি বছর দেওয়া হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি’র পক্ষ থেকে। এই ভালবাসার সূত্রেই বিভিন্ন তরুণ কবির কবিতার বই ছাপা হত এই প্রেসেই। কবি শঙ্খ ঘোষ নিয়মিত নিজের বইয়ের প্রুফ দেখতে এই প্রেসে আসতেন। একুশ শতকের গোড়ার দিকে (আনুমানিক ২০০৪) প্রেস কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন অফসেট প্রযুক্তির যুগে এই পুরোনো প্রেস আর চালানো সম্ভব নয়। তখন প্রেসের সব সিসার অক্ষর একজায়গায় মিলিয়ে (এই প্রক্রিয়ার টেকনিক্যাল নাম, পাই করা) বিক্রি করে দেওয়া হয়। সেদিন ওই ঘটনার সাক্ষী ছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। কলেজ স্ট্রিট এলাকার একটি ঐতিহাসিক প্রেসের এইভাবেই মৃত্যু ঘটে যায় ।
(ক্রমশঃ)
পরের পর্ব প্রকাশিত হবে ১২ ফেব্রুয়ারি কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি (পর্ব ১) পড়ুন
https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=26440কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি (পর্ব ২) পড়ুন
https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=26535
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।