কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি
প্রবুদ্ধ বাগচী
(পূর্ব-প্রকাশিতের পর)
পর্ব ১২
নব্বইয়ের দশকে একেবারে গোড়ায় দেশের পক্ষে বড় খবর ছিল অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে গোটা দেশের আর্থিক ব্যবস্থার খোল-নলচে পালটে দেওয়া, যার হাত ধরে বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের পথ খুলে যেতে থাকে। এই কাজ সংগত ছিল কি ছিল না সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না, তবে ঘটনাটা ঘটল। উদারনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে রাজ্যের বামপন্থীরা সকলেই যে খুব খুশি ছিলেন এমন নয়। বিশেষত, এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব যেভাবে কমিয়ে দেওয়া হচ্ছিল সেটা বাম-প্রভাবিত ট্রেড ইউনিয়নগুলি মোটেও ভালোভাবে নেননি। এই সময়ের কাছাকাছি সংবাদপত্রে আলোচিত হচ্ছিল আরো কিছু বিষয় —-- ‘গ্যাট চুক্তি’,’ ডাঙ্কেল প্রস্তাব’ এবং শোনা যাচ্ছিল ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা’ (WTO)-র নাম।
আসলে নব্বই দশকের গোড়াতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘পতন’ এবং তথাকথিত ‘সোভিয়েত ব্লক’ ভেঙে যাওয়ার ফলে গোটা দুনিয়া জুড়েই একটা নতুন বাস্তবতার সূচনা হয়। ১৯১৭ সালের ‘রুশ বিপ্লব’, পরপর দুটি মহাযুদ্ধ পেরিয়ে সমাজতন্ত্রের বিজয়রথ যেভাবে আমাদের দেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক মননে একটা স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছিল সোভিয়েতের পতন ছিল সেখানে একটা ‘কালচারাল শক’। যে বামপন্থী-মহল, দুনিয়ার এক তৃতীয়াংশ সমাজতন্ত্রের লাল রঙে রঙিন বলে দেওয়াল লিখতেন, এই বিশ্ব-পরিস্থিতি সেই লেখার ওপর এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন ঝুলিয়ে দেয়। পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি যখন একের পর এক নিজেদের বদলে নিচ্ছে, ভেঙে পড়ছে বার্লিন-প্রাচীর তখন আমাদের দেশে সরকার- পরিচালিত দূরদর্শনে এই বিষয়ে একমাত্র সংবাদ দিতেন সাংবাদিক প্রণয় রায় তার ‘ওয়ার্ল্ড দিজ উইক’ অনুষ্ঠানে —- আমরা হাঁ-করে গিলতাম সেই খবর। পরে এই সময়ের ওপর মৃণাল সেন তাঁর ‘মহাপৃথিবী’ ছবি করেছিলেন। যদিও ১৯৮৭ সালে যখন আমাদের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সোভিয়েত সফরে গিয়েছিলেন, তখন সেখানকার প্রেসিডেন্ট গর্বাচভ তাঁর ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রৈকা’ শুরু করে দিয়েছিলেন —- সফরসঙ্গী কলকাতার দুই সাংবাদিকের প্রতিবেদন পড়ে মনে হয়নি রাশিয়া এক বিরাট টালমাটালের মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
যাই হো্ক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দুনিয়া জুড়ে যে ‘ঠাণ্ডা যুদ্ধ’ পরিস্থিতি চলছিল, এই পরিবর্তনের ফলে তার অবসান হল। সেই সঙ্গে একমেরু পৃথিবীতে প্রবল আকার নিয়ে দেখা দিতে লাগল বিশ্ব পুঁজির আগ্রাসন। মার্কিন দেশের নায়কত্বে দেশে দেশে শুরু হয়ে গেল ‘উদার অর্থনীতির’ জোয়ার। আমাদের দেশে এই সংস্কারের মুখ ছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ, যিনি সুদীর্ঘকাল কাজ করেছেন বিশ্বব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারে (IMF)। স্বাভাবিকভাবেই এই দশকের শুরু থেকেই ডঃ মনমোহন সিংহের প্রকাশ্য সমালোচনা এসে পড়ে পথেঘাটের বিক্ষোভে জমায়েতে। এমনকি বামপন্থীদের কিছু পত্র-পত্রিকায় এমন কথাও লেখা হয় যে, বিশ্বব্যাঙ্কই নাকি কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে মনোমোহন সিংহ-কে অর্থমন্ত্রী নির্বাচন করেছে কারণ তিনি মার্কিন প্রশাসনের বশংবদ । কলেজ স্ট্রিটও এই সরব বিক্ষোভ তরঙ্গের আওতার বাইরে ছিল না। এই সময়টায় আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বছরে, কলেজ স্ট্রিটে নিত্য আসা-যাওয়ার কমতি ছিল না। রাজপথের ওপর কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানো থেকে ঘন ঘন ‘বাংলা বনধ’-এর আহ্বান ছিল সেই সময়ের কলেজ স্ট্রিটের প্রায় প্রতিদিনের চিত্র। নব্বই দশকের দ্বিতীয় বছরের গোড়ায় আমি যখন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বীমা সংস্থার চাকরিতে ঢুকি, তখন প্রায় প্রতিদিন টিফিনের সময় অফিসের গেট-মিটিঙে ‘কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী’- র বাপান্ত করা হত, আয়োজিত হত রাস্তা জুড়ে মিছিল। ব্যাঙ্ক বীমা টেলিকম ইস্পাতশিল্প সর্বত্র তখন একই বিরোধিতা আর প্রতিবাদ আন্দোলন যার আঁচ বারবার লেগেছে কলেজ স্ট্রিটেও।
এরই পাশাপাশি দেশজুড়ে তৈরি হচ্ছিল এক অন্যরকমের ঘটনার ঘনঘটা। ‘রাম মন্দির’ নামক একটা ইস্যু আচমকা উঠে এল রাজনীতির আঙিনায়। অযোধ্যায় পাঁচশো বছরের পুরোনো ‘বাবরি মসজিদ’-এর ভিতরেই নাকি ‘রাম’ নামক পুরাণপুরুষের জন্মস্থান, এই অনৈতিহাসিক একটি তথ্য ঘিরে পথে নামল ভারতীয় জনতা পার্টি নামক একটি দল, যাদের বয়স তখন দশ বছরও পেরোয়নি । দেশজোড়া এই ভয়ংকর দাবিকে সামনে রেখে ঘোষিত হল ‘মন্দির ওহি বানায়ঙ্গে’। রাজ্যের বামপন্থী মহল ঠিকই চিনেছিলেন এইসব আবদার ও হুঙ্কারের পেছনে লুকিয়ে আছে আগ্রাসী সাম্প্রদায়িকতার আস্ফালন যা ধর্মীয় বিভাজনকে উস্কে দেবে। এই প্রেক্ষাপটে কলেজ স্ট্রিট আবার সরগরম হল এই সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে। শাসকদলসহ বিভিন্ন বাম সংগঠন পথে নামলেন, চেষ্টা করলেন রাজ্যের মধ্যে যেন এই সাম্প্রদায়িক অশান্তির প্রভাব না পড়ে। শেষরক্ষা যে হয়েছিল, তা বলা যাবে না।
কারণ পশ্চিমবাংলার বাম রাজনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে একটা বড় সহায়ক শক্তি ছিল ওপার বাংলা থেকে আসা উদবাস্তুরা, যারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিসেবে অনেকেই পুব বাংলায় নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন অথবা তার আশঙ্কায় নিজেদের কয়েক পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে এপারে চলে আসেন। বাস্তুহারা হিসেবে এপারে এসেও তাঁদের বহু ধরনের সংগ্রাম ও তিতিক্ষার পরিচয় দিতে হয়েছে —- এই লড়াইয়ে বামপন্থীরাই ছিলেন তাঁদের সহায়। ফলে মৌলবাদী রাজনীতির সেই সময়ের ধ্বজাধারী ‘জনসঙ্ঘ’, ‘হিন্দু মহাসভা’ বা অন্য সংগঠনগুলি এই মানুষদের সামনে রেখে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত করার সুযোগ পায়নি। কিন্তু ‘রামমন্দির আন্দোলন’-এর এই আবহে নিজেদের চোখেই দেখলাম কীভাবে এলাকার পরিচিত ‘কমরেড’-রা হঠাৎ করে বাম থেকে ‘রাম’ সমর্থক হয়ে ‘রামশিলা’ মাথায় করে অযোধ্যায় ‘করসেবা’ করতে দৌড়ে যেতে লাগলেন। আমাদের ছোট মফসসলে মোটামুটি সবাই সবাইকে চিনতেন। তাই তাঁদের রাজনৈতিক আনুগত্যের এই ‘ভোলবদল’ খুঁজে নিতে আমাদের কোনো অসুবিধে হয়নি। ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান ঠিক ওই সময়েই একটি রাজনৈতিক স্লোগানে পরিবর্তিত হল। তবে, আমাদের মতন তরুণদের দল যারা সেইসময় একটা জোট বেঁধেই থাকবার চেষ্টা করতাম তাঁদের কারোর মধ্যে এই বিষয়ে কোনো ‘আলোড়ন’ ওঠেনি, ‘রাম’কে নিয়ে এই রাজনীতির যে একটি বিশেষ অভিমুখ আছে আমরা তা সহজেই বুঝেছিলাম।
আর এই সবের মধ্যেই ঘটে গেল স্বাধীন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত ঘটনাটা। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২, তথাকথিত ‘করসেবক’ তথা উন্মত্ত দুষ্কৃতীদের হাতে ধ্বংস হয়ে গেল ঐতিহাসিক ‘বাবরি মসজিদ’। ভারতীয় জনতা পার্টির সর্বভারতীয় নেতারা সেখানে দাঁড়িয়ে তার নেতৃত্ব দিলেন, উৎসাহে ফেটে পড়লেন প্রকাশ্যে। এর অল্প আগে ‘রাম-রথ’ এর যাত্রা দেশের নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে ছড়াতে এগোলেও এই রাজ্যে তার তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। কিন্তু ‘বাবরি মসজিদ’ ধবংসের পরেই দেশজোড়া যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি শুরু হল, কলকাতা তার বাইরে থাকতে পারল না। আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতায় সেই প্রথম সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সংঘর্ষের ঘটনা। এই কথা ঠিক যে, সেদিনের দাঙ্গা কলকাতার কিছু পকেট এরিয়া ছাড়া বৃহত্তর বাংলায় ছড়িয়ে পড়েনি, এর জন্য বামপন্থী সরকারের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। মফসসলে বসে আমরা এই হিংসার কোনো প্রত্যক্ষ প্রভাব টের পাইনি। আমাদের পড়শি এলাকায় ‘কাজিপাড়া’ বলে একটা ছোট মুসলিম মহল্লা ছিল । মসজিদ ধ্বংসের পরে আমরা বন্ধুদল একটি পোস্টার-প্ল্যাকার্ড-সজ্জিত সাইকেল মিছিলে করে শান্তির বার্তা নিয়ে এলাকা পরিদর্শন করেছিলাম — কিন্তু তেমন কিছু সত্যিই ঘটেনি।
অথচ রাজধানী কলকাতায় পরপর তিনদিন টানা কার্ফু, আবার অল্প সময় ছেড়ে আরো দুদিন —- আমরা যারা তখন নিয়মিত কলকাতায় আসতাম সেটা তাঁদের পক্ষে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। একদিকে গার্ডেনরিচ এলাকায় থানা আক্রান্ত হল, লালবাজারের সামনে দুষ্কৃতীদের আঘাতে আহত হলেন কলকাতা পুলিশের একজন ডেপুটি কমিশনার। অন্যদিকে ট্যাংরা এলাকায় ‘হিন্দু নাগরিক’-দের ‘নিরাপত্তায়’ বুক বাজিয়ে এগিয়ে এলেন এক কুখ্যাত ‘বাহুবলী’ যাকে তখন সবাই ‘বামফ্রন্টের কাছের লোক’ বলেই চিনতেন। শহর কলকাতা পুরনো ছন্দে ফিরতে এক সপ্তাহ সময় নিল, আবার সব অফিস-কাছারি,দোকান-বাজার চালু হল আর আবার কলেজ স্ট্রিট ফিরে এল তার চেনা ছন্দে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বানে মুখর হল রাজপথ। যেদিন পার্কসার্কাস থেকে শিল্পী-অভিনেতাদের ধিক্কার মিছিল বেরোলো, আমারও সৌভাগ্য হয়েছিল সেই মিছিলে অংশ নেওয়ার। মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন মৃণাল সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ প্রমুখ। মিছিল এসেছিল কলেজ স্ট্রিটে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হয়েছিল সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী কনভেনশন।
এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গ। নব্বই দশকের দ্বিতীয়ার্ধের সূচনাতেই আমরা আমাদের পুরনো শহরতলি ছেড়ে কলকাতার উত্তরপ্রান্তে এসে বাসা নিই। এই সময়ের অল্প আগে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার পরীক্ষার্থী হিসেব কলেজ স্ট্রিটের প্রেসিডেন্সি কলেজের ক্যাম্পাসে পরীক্ষা দিতে আসতে হয় পরপর তিনদিন। ঘটনা হিসেবে এটা এমন কিছুই নয়। কিন্তু এর প্রায় দশ বছর আগে যে শিক্ষাসত্রে ভর্তি হওয়ার বাসনায় নাম লেখাতে এসেছিলাম, এবার এক দশক পেরিয়ে তাকেই একটু ঘনভাবে দেখার সুযোগ ঘটল আমার। প্রেসিডেন্সি মেন বিল্ডিঙয়ের সুবিশাল ঐতিহ্যশালী লেকচার থিয়েটারে পরীক্ষা দেওয়া একটা অন্য অভিজ্ঞতা। যদিও পরের বছর একই সময় আবার একই পরীক্ষা দিতে একই জায়গায় আসতে হয়, এইবারে আর সেই আগের রোমাঞ্চ ছিল না। তবে ততদিনে আমরা কলকাতায় এসে গেছি, যেখান থেকে বাসযোগে মিনিট পঁয়তাল্লিশের মধ্যে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছানো যায়।
ওই সময়টায় পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বাড়িতে ছুটি নিয়ে পড়াশোনা করতে হত। কিন্তু কোনো কোনো শীতের দুপুরে যখন একলা বাড়িতে থাকতে ভাল লাগত না ও পড়ায় মন বসত না —- তখন প্রায় উদ্দেশ্যহীনভাবেই এসে পড়েছি কলেজ স্ট্রিটে। এমাথা-ওমাথা ঘুরে বেড়ানো, বইয়ের দোকানের ওপর দিয়ে এলোমেলো চোখ ফেলে বই দেখা, ‘পাতিরাম বুক স্টল’এর সামনে দাঁড়িয়ে কোনো কোনো লিটল ম্যাগাজিনের পাতা ওলটানো — এইভাবে সময় কেটে যেত। আর হ্যাঁ, এই সময়টার কিছুটা আগে আমার এক বন্ধু সহকর্মী হদিশ দিয়েছিল ‘উমা স্টোর্স’ দোকানটার —- গোলদীঘিতে ঢোকার মুখে ‘বিদ্যাসাগর মূর্তি’ যে গেটের সামনে সেই গেটের পাশেই। এখানে নানা রকম নতুন নতুন মডেলের ডট পেন পাওয়া যেত। এই পেন জমিয়ে রাখার স্বভাবটা আমার অনেকদিনের পুরোনো, বহু বছর ধরে নানা রকম পেন আমার সংগ্রহে ছিল ও আছে। ফলে নতুন মডেলের পেনের সন্ধানে একবার করে ঘুরে যেতাম ‘উমা স্টোর্স’-এ । দোকানে বেশিরভাগ সময়ে থাকতেন একজন যুবক যার একটা চোখ ছিল নষ্ট, মুখে বসন্তের দাগ । তিনি আমায় চিনে গিয়েছিলেন, দুচারটে কথা হত তাঁর সঙ্গে। নতুন কোনো পেন-এর সন্ধান থাকলে সেটি কিনে নিয়ে আবার বাড়ি ফেরা। বহু বছর পরে মাত্র একমাস আগে হঠাৎই গিয়েছিলাম ওই ‘উমা স্টোর্স’-এ —--- অবাক হলাম, দোকানের সেই পুরনো মালিক, আমায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, আজকাল তো আর আপনাকে দেখতেই পাই না ! আজ অনেকদিন পরে এলেন ! উনি আজও আমায় মনে রেখেছেন! এই এক আশ্চর্য বিনিসুতোর সম্পর্ক।
আরও, আশ্চর্য এই যে, পরীক্ষা প্রস্তুতির অবসরে কলেজ স্ট্রিটের এই সংক্ষিপ্ত সফরের পর মনটা হয়ে যেত অনেক শান্ত ও শমিত —- বাড়ি ফিরে আবার পরীক্ষার পড়াশোনায় ডুবে যেতে কোনো অসুবিধে হত না। কলেজ স্ট্রিটের ওই রাজপথ আর বইপাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান — সব মিলিয়ে যেন ছিল একটা মানসিক প্রণোদনার উৎস। এই সূত্রে মনে পড়ছে প্রেসিডেন্সি কলেজের ‘বিতর্কিত’ অধ্যাপক ওটেন সাহেবের কথা, যার সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের ‘সংঘর্ষ ও বিরোধ’ এর প্রেক্ষিতে তরুণ সুভাষকে ওই কলেজ থেকে বহিষ্কৃত করা হয়। অবশ্য, এই বিষয়ে স্কুলের নিচুতলার ইতিহাস বইয়ে যা লেখা হয় তার কিছুটা ‘অতিরঞ্জিত’। সুভাষচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে স্বীকার করেছেন, ওটেন সাহেবের ‘নিগ্রহের’ নেপথ্যে তিনি ছিলেন, কিন্তু নিজে ব্যক্তিগতভাবে কিছু করেননি। আর সুভাষের বিরুদ্ধে যে তদন্ত কমিশন হয়েছিল তাঁর প্রধান ছিলেন স্যার আশুতোষ, তাঁর লিখিত রিপোর্টের ভিত্তিতেই সুভাষচন্দ্র কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। কিন্তু এটাও ঘটনা, পরে সুভাষচন্দ্র বসু যখন ভারতের রাজনীতির নক্ষত্র, তখন ইংল্যান্ডে ফিরে-যাওয়া প্রবীণ ওটেন সাহেব তাঁর প্রাক্তন ছাত্র সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। সত্তর দশকের গোড়ায়, তখন ওটেন সাহেবের বয়স সাতাশি পেরিয়েছে, তিনি থাকেন লন্ডন শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরের এক শহরতলিতে। সেই সময়, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের পরিবারের দুই সদস্য — ডঃ শিশির কুমার বসু ও তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণা বসু—- ইউরোপ সফরে গিয়ে ওটেন সাহেবের ওই বাড়িতে যান। অশীতিপর অধ্যাপক খুব আগ্রহ নিয়ে কৃষ্ণা বসুর থেকে জানতে চেয়েছিলেন কলেজ স্ট্রিটের কথা —-- কলেজ স্ট্রিট কেমন আছে ? এখনো কি গোলদীঘির ধারে তরুণরা আড্ডা দেয় ? ওইসব মূল্যবান বইবিপণিগুলিরই বা কী অবস্থা আজ ? কী আশ্চর্য, ওই অতখানি বয়সেও তিনি নিজের স্মৃতিতে বহন করছিলেন এই কলেজ স্ট্রিটকে !
ঘটনা হিসেবে তুচ্ছ হলেও আমার মনে পড়ে ১৯৯৭ সাল নাগাদ অফিস ক্লাবের লাইব্রেরির জন্য দল বেঁধে ‘দে’জ পাবলিশার্স’-এ বই কিনতে আসার স্মৃতি। প্রচুর বই কিনে নাছোড় ট্যাক্সিকে রাজি করিয়ে নতুন বইয়ের গন্ধ শরীরে মাখতে মাখতে আবার অফিসে ফেরা। ১৯৯৮-এর গোড়ার দিকে (ফেব্রুয়ারিতে) অফিস রিক্রিয়েশন ক্লাবের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ‘ডিরোজিও হল’ বুক করতে আমাকেই আসতে হয়েছিল প্রেসিডেন্সি কলেজে। আর অনুষ্ঠানের দিন দুপুর থেকে সেই হল সাজানো ও আনুষঙ্গিক প্রস্তুতির জন্য একঝাঁক আমাদের মতো তরুণ-তরুণী এসে দখল নিয়েছিলাম সেই প্রেক্ষাগৃহের —- আমাদেরই উৎসাহে সেই অনুষ্ঠানের নাম দেওয়া হয়েছিল —’আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি’ । এর আগে হলের সামনে অনেকবার বাদল সরকারের নাটক দেখেছি কিন্তু ভিতরে ঢুকবার সুযোগ পেলাম এই প্রথম। সেই অনুষ্ঠানে নামমাত্র পারিশ্রমিকে গান গেয়েছিলেন সেই সময়ের ‘অখ্যাত ও অল্পশ্রুত’ রবীন্দ্রগানের শিল্পী শ্রাবণী সেন। ওই বছরের মাঝামাঝি চাকরিসূত্রে আমায় চলে যেতে হয় কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ছেড়ে। তবে তার মানে এই নয় যে, কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে আমার চিরবিচ্ছেদ ঘটে গেল। সময় সুযোগ হলেই দেখা হয়েছে তার সঙ্গে —- ইট কাঠ পাথর নয় জলজ্যান্ত এক প্রাণবন্ত অস্তিত্ব।
কাট টু । আমরা চলে আসি ২ ডিসেম্বর ২০০৬ এর বিকেলে । ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে সেদিন সন্ধ্যে ছটায় একক গান গাইবেন কবীর সুমন। নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম আমি। কিছুটা সময় কফি হাউসে পরিচিত একজনের সঙ্গে কাটিয়ে যখন নীচে নামলাম তখন রাস্তায় শোরগোল। প্রেসিডেন্সি কলেজের পড়ুয়ারা মিছিল করে বেরিয়ে এসেছেন পথে। খবর এসেছে , মেধা পাটেকরকে গ্রেফতার করেছে রাজ্যের পুলিশ —- তারই প্রতিবাদে পথ অবরোধ হয়ে গেল পড়ুয়াদের নেতৃত্বে। মনে করা যেতে পারে এই সময়ের দু-তিনমাস আগে থেকেই সিঙ্গুরে কৃষিজমি দখল করে গাড়ি কারখানা তৈরি করা নিয়ে রাজ্য উত্তাল। কৃষকদের ক্ষোভ প্রতিবাদে মুখর হয়েছে সিঙ্গুর ও তার সংলগ্ন অঞ্চল। স্বতঃস্ফূর্ত গণআন্দোলনের জোয়ার এসে পড়েছে রাজধানীর কেন্দ্রে। ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার বাংলা সংস্করণ ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’ এ জ্বালাময়ী প্রতিবাদী কলম লিখছেন মহাশ্বেতা দেবী। সাধারণ মানুষ উদ্বেলিত হচ্ছেন এই আন্দোলনের তরঙ্গে। রাজ্যের বামপন্থী সরকার কৃষকদের থেকে জোর করে জমি নিয়ে নিচ্ছেন, প্রতিবাদীদের ওপর চলছে পুলিশি নিপীড়ন, এমনকি আড়াই বছরের কোলের শিশুকেও জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মামলায় —-- এই রাজ্যে এগুলো ঘটছে, এমনটা মেনে নিতে পারছেন সাধারণ সাতে-পাঁচে না-থাকা মানুষও। সেইদিন সামনে থেকে দেখা গেল পড়ুয়াদের প্রতিবাদ, পুলিশের আস্ফালন। ততক্ষণে মঞ্চে উঠে পড়েছেন কবীর সুমন। গান নয়, সেদিনের পত্রিকায় প্রকাশিত মহাশ্বেতা দেবীর একটি নিবন্ধ পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হল অনুষ্ঠান। কবীর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সেদিনের অনুষ্ঠান উৎসর্গ করলেন মেধা পাটেকরকে। কিন্তু এইসব ছাপিয়ে মনে পড়ে, সেদিনের ওই প্রতিবাদী সন্ধ্যার অনুষ্ঠান কবীর সুমন শেষ করেছিলেন একটি রবীন্দ্রনাথের গান দিয়ে : ‘ও গান আর গাস নে’ —--- যেন ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা নিয়ে সেই সন্ধ্যায় আমাদের মন ভরে গিয়েছিল ওই নিবেদনে। রাত নটা নাগাদ যখন কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে বাস ধরতে এলাম তখন সব শুনশান, নিঃশব্দ ।
নন্দিগ্রামের গণহত্যা ঘটল ঠিক এর সাড়ে তিনমাস পরে ( ১৪ মার্চ ২০০৭)। আবার উত্তাল হল কলেজ স্ট্রিট। প্রতিবাদী সমাবেশ, মিটিং মিছিলে নতুন করে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠল মহানগর। সুদীর্ঘকাল বাম শাসকদের একাধিপত্যে আমরা যখন ভুলতে বসেছিলাম প্রতিবাদী শহরের ছবি ঠিক তখনই পুলিশের গুলিতে একসঙ্গে চোদ্দজনের অসহায় মৃত্যু মানুষের মধ্যে যেন জাগিয়ে তুলল প্রতিবাদের নাছোড় স্পন্দন। এটা ঠিক যে এইসব ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে মানুষের যে সরকার-বিরোধী স্বর ফুটে বেরোচ্ছিল তাকে নিজেদের পক্ষে সংহত করতে চাইছিলেন তৎকালীন বিরোধী শিবির, রাজ্যের বিরোধী নেত্রী নিজেকে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছিলেন বিকল্প শক্তির কেন্দ্র হিসেবে —- কিন্তু ‘সংসদীয় ব্যবস্থায়’ দলীয় রাজনীতি যাদের ‘পেশা’ তাঁদের পক্ষে এটা কিছু দোষের বলে মনে করার কোনো কারণ নেই —- অন্তত তাতে মানুষের প্রতিবাদী সত্ত্বা মর্যাদা হারিয়ে ফেলে বলে আমাদের মনে হয় না। ওই বছরেরই নভেম্বর মাসে (২০০৭) রাজ্যের শাসকদল নন্দিগ্রামে তাঁদের হারানো জমি পুনরুদ্ধারে নতুন ‘অ্যাকশনে’ নামে ও আবার একপ্রস্থ রাজনৈতিক সংঘর্ষ আর হানাহানিতে শিরোনামে এসে পড়ে নন্দিগ্রাম খেজুরি, সোনাচূড়া, গোকুলনগর । শাসকদের পক্ষে এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নন্দিগ্রামে সূর্যোদয়’, আর রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন ‘দে হ্যাভ বিন পেড ব্যাক বাই দেয়ার ওন কয়েন’। এর প্রতিবাদে দলীয় রাজনীতির সমস্ত পতাকা সরিয়ে রেখে কলকাতা দেখল এক প্রতিবাদী ‘মহামিছিল’ , যার সূত্রপাত হয়েছিল কলেজ স্ট্রিটে। আজ সকলেই জানেন, কবি শঙ্খ ঘোষের নেপথ্য অধিনায়কত্বে দলমত নির্বিশেষে মানুষ সেদিন পথ হেঁটেছিলেন শাসকের ঔদ্ধত্যকে ধিক্কার জানিয়ে। বিগত বহু বছর কলেজ স্ট্রিট মানুষের এমন স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভের আয়নায় নিজের ছায়া দেখেনি। নন্দিগ্রামের গণহত্যার বর্ষপূর্তিতে আবার মিছিল হল কলেজ স্ট্রিটে। সেদিন ধর্মতলা থেকে মিছিল এল গোলদীঘির বিদ্যাসাগর মূর্তির নীচে। পায়ে পায়ে আমাদের সঙ্গে হাঁটলেন প্রবীণ তরুণ সান্যাল, শাঁওলি মিত্র, মহাশ্বেতা দেবী প্রমুখ। সেখানকার সভা শেষে আমরা অনেকেই গেলাম রামমোহন হলে, সেখানেও সেই সন্ধ্যায় আয়োজিত হয়েছে আরেকটি সভা। মঞ্চের পিছনে বিরাট ব্যানার, তাতে বড় বড় অক্ষরে অক্ষরে লেখা রয়েছে : ‘আঘাত হয়ে দেখা দিলে / আগুন হয়ে জ্বলবে’।
এই আগুনেরই আরেক প্রকাশ আমরা দেখলাম এর বছর ছয়েক পরে। জুন ২০১৩। রাজ্যে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ‘পরিবর্তন’ এর সরকার। কামদুনি নামক এক অখ্যাত গ্রাম তখন সংবাদ শিরোনামে। সেখানকার এক কলেজ-ছাত্রীকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত ও নিহত হতে হয়েছে স্থানীয় দুষ্কৃতীদের হাতে। রাজ্যজুড়ে দাবি উঠেছে দোষীদের গ্রেফতার ও উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার। এই দাবি নিয়ে আবারও এক প্রতিবাদী মিছিলের আহ্বান জানালেন কলকাতা তথা বাংলার দুই বিবেকী কন্ঠস্বর —- শ্রদ্ধেয় কবি শঙ্খ ঘোষ ও অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র। শুধু এই ডাকে সাড়া দিয়েই আবার পথে নামলেন মানুষ। সেদিনও তীব্র গ্রীষ্মদুপুরে জমায়েত হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। কত কত মানুষ এসেছিলেন সেইদিন ! হাতে হাত ধরে আমাদের সঙ্গে হাঁটলেন প্রতিবাদী মানুষ যার পুরোভাগে ছিলেন প্রবীণ কবি শঙ্খ ঘোষ, যাকে এর আগেও আমরা দেখেছি সিঙ্গুর নন্দিগ্রামের ঘটনায় প্রতিবাদী ভূমিকা নিতে। মিছিল এগিয়ে চলল ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেলের দিকে। সেখানে তখন অসুস্থ ও অশক্ত শরীরে ম্যাটাডোরের ওপর অপেক্ষা করছেন অশোক মিত্র। মিছিল যত এগোয় দলে দলে মানুষ আমাদের জন্য জানাতে থাকেন সংহতি। বিশেষ করে দেখেছিলাম তরুণীরা কীভাবে হাতে প্রতিবাদের প্ল্যাকার্ড ধরে মিশে যাচ্ছে মিছিলের শরীরে। এও এক অভিজ্ঞতা।
শুধু প্রতিবাদ প্রতিরোধ নয়, এই কথা বারবার বলার চেষ্টা করছি, কলেজ স্ট্রিটের পথে পথে ছড়িয়ে আছে মেধা ও মননচর্চার উজ্জ্বল নুড়িখন্ড। আমাদের অকিঞ্চিৎকর জীবনে তার কতটুকুই বা নাগাল পেয়েছি আমরা? একসময়ের প্রেসিডেন্সি কলেজ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকপাল অধ্যাপকরা তাঁদের কর্মজীবন তো কাটিয়ে গেছেন এখানেই। আমরা আমাদের সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পদার্থবিদ ডঃ অমল কুমার রায়চৌধুরির ক্লাস করার সুযোগ পাইনি, কিন্তু মাঝে মাঝেই তাঁকে দেখেছি এই এলাকায়, তখন তিনি যথেষ্ট প্রবীণ । ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত ছোটখাটো এই মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁর তৈরি করা ‘রায়চৌধুরী ইকুয়েশন’ সহায়ক হয়েছে স্টিফেন হকিং-এর গবেষণায়। সত্যেন বসুর পরে এই মাপের বাঙালি বিজ্ঞানী আমরা আর পাইনি।
কলেজ স্ট্রিটের এই মহতী এলাকায় বিশ্রুত মানুষদের বক্তৃতা শোনার কয়েকটি অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে ফুরিয়ে যাবে এই পর্ব। এর প্রথমজন বিশ্বখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক নোয়াম চমস্কি। ১৯৯৬-এর জানুয়ারিতে তিনি রাজ্য সরকারের আমন্ত্রণে কলকাতায় এসে তার বক্তৃতা দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শতবার্ষিকী হলে। সেই পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থাকার স্মৃতি আজও অমলিন। সবটা যে বুঝেছি, তা বললে অনৃতভাষণ হবে, তবু একজন মেধাবী ব্যক্তিত্বের প্রতিভার ছটা যে তাঁর উপস্থিতির মধ্যেও প্রোথিত থাকে, এটা সেদিনের অভিজ্ঞতা আমায় বুঝিয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘মহাবোধি সোসাইটি হল’ এ ‘উন্নয়ন অর্থনীতি’ নিয়ে কথা বলতে আসেন আরেক বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ ডঃ অমিত ভাদুড়ি । এক শনিবারের সন্ধ্যায় সেই আলোচনা আমাদের মন ভরিয়ে দেয়। প্ল্যানিং কমিশনে ‘একশো দিনের কাজ’ প্রকল্পের জন্য যে কমিটি হয়েছিল, তিনি ছিলেন তার সদস্য। সেখানে প্রকল্পের খুঁটিনাটি তৈরির নানা অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেন ওই বক্তৃতায়। তবে এইসব ছাড়িয়েও তিনি বলেছিলেন, যা আজও আমার স্মৃতিতে সজীব—-- ওই সময়কালে সারা দেশে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে ‘স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ করার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চলছে তা, তাঁর বিচারে মনে হয়েছিল বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের থেকে কোনো অংশে কম নয়। মঞ্চে তখন তাঁর পাশে বসে আছেন অসীম চ্যাটার্জি ও দীপাঞ্জন রায়চৌধুরী। এর অল্প আগেই তাঁর লেখা বই ‘ডেভলেপমেন্ট উইথ ডিগনিটি’ ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছে, আমাদের সবারই সংগ্রহে ছিল সেই চল্লিশ টাকা দামের বইটি, যার প্রকাশক ছিলেন ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট’। দুবছর আগে যখন দিল্লির উপকন্ঠে ‘কৃষক আন্দোলন’ চলছে ডঃ ভাদুড়ির একটি ইংরিজি নিবন্ধ তরজমা করার সূত্রে ওঁর সঙ্গে কিছুটা ব্যক্তিগত সখ্য হয়, তবে সেটা নিছকই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফটোগ্রাফার সুনীল জানা- র স্মরণে একটি আলোচনা-সভা আয়োজিত হয়েছিল কলেজ স্ট্রিট ‘কফি হাউস’-এর তিনতলায় ‘বই-চিত্র’ সভাঘরে, যেখানে বলতে এসেছিলেন অশীতিপর অশোক মিত্র। তখন তাঁর শরীর একেবারে ভেঙে গেছে, তবু ‘কফি হাউস’-এর পুরনো বাড়ির তিনতলায় উঠে তিনি তাঁর স্বল্প বক্তব্যে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সুনীল জানা-র জীবনের মূল প্রতিবাদী ও মানবিক সুর। যাকে কমিউনিস্ট দলের পি সি জোশি নিজে ডেকে নিয়ে এসে কাজে লাগিয়েছিলেন ১৯৪৩ এর মন্বন্তরের ছবি তোলার কাজে, সেইসব ছবি আজ ইতিহাসের অঙ্গ। ১ মে ২০১৮, অশোক মিত্র প্রয়াত হন, এর কিছুদিন পরে (১৮ মে ) তাঁর স্মরণে ‘সমাজচর্চা ট্রাস্ট’ এর আয়োজনে ইউনিভার্সিটি ইন্সটিউটে যে সভা হয়, তাও আমার জীবনের একটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। বামফ্রন্টের সমস্ত প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে সেদিন প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত ছিলেন শঙ্খ ঘোষ, অমিয় দেব, অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মালিনী ভট্টাচার্য প্রমুখ ব্যক্তিত্ব, ছিলেন অশোক মিত্রের কন্যাসমা অধ্যাপিকা জয়তী ঘোষ। শ্রীমিত্রের নিজের নির্বাচন করে যাওয়া একগুচ্ছ রবীন্দ্রগান পরিবেশিত হয়েছিল ওই সভায়।
এই ব্যাপারে শেষ যার কথা উল্লেখ করতে হবে, তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শিশু ও জনস্বাস্থ্য রোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ বিনায়ক সেন, যাকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে কারারুদ্ধ করেছিল ছত্তিসগড়ের সরকার। শুধু দেশজুড়ে নয় সারা পৃথিবীর মানবাধিকার সংগঠনগুলি এই ঘটনাকে ধিক্কার জানান। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ তাঁকে আখ্যা দেন ‘ প্রিজনার অফ কনসায়েন্স’ বলে। ২০০৯ সালের মে মাসে ডঃ সেন মুক্তি পেলে কলকাতায় তাঁর একটি বিশেষ সম্বর্ধনার আয়োজন করা হয় ‘ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট’ হলে। সেখানে মঞ্চে তাঁকে নাগরিক সম্বর্ধনা জানান কবি শঙ্খ ঘোষ। আর বক্তা হিসেবে ছিলেন ‘আর্য সমাজ’ এর স্বামী অগ্নিবেশ ( যিনি সেইসময় ছত্তিশগড় সরকার আর মাওবাদীদের মধ্যে সমন্বয়কারী প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন ) , গান্ধীবাদী হিমাংশু কুমার ( ‘সালওয়া জুড়ুম’-বিরোধী আন্দোলনের সংগঠক) ও স্বয়ং ডঃ সেন। প্রেক্ষাগৃহ উপচে দর্শক সেদিন বসে পড়েছিলেন মেঝেতে। আর আমরা যারা সৌভাগ্যক্রমে চেয়ারে বসার সুযোগ পেয়েছিলাম তারা মুখোমুখি হয়েছিলাম এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার। আর, এই সব কিছুরই আধার ছিল কলেজ স্ট্রিট। বারবার সেদিন মনে হয়েছিল, প্রতিবাদ প্রতিরোধ মেধা স্পর্ধা সবকিছু যেন আজ মিলে-মিশে গেছে এই কলেজ স্ট্রিটের ধুলোয় বাতাসে স্পন্দনে ।
(ক্রমশ)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৮ জুন
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।