কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি
প্রবুদ্ধ বাগচী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পর্ব ১৩
কলেজ স্ট্রিট-কে কেন্দ্র করে এই সুদীর্ঘ আখ্যান অসম্পূর্ণ থাকবে যদি এই এলাকার অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ না করি। কোনো রকম সরকারি সাহায্য বা পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই এই বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই পেরিয়ে এসেছে পঁয়তাল্লিশ বছর, যার নাম ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’ । উইকিপিডিয়ায় লেখা হয়েছে, ১৯৭২ সালের স্কটিশ চার্চ কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র সন্দীপ দত্ত ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সাময়িক পত্র-পত্রিকার সংরক্ষণ নিয়ে চূড়ান্ত অবহেলা দেখে সিদ্ধান্ত নেন তিনি নিজেই একটা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি গড়ে তুলবেন। এই বক্তব্যে কোনো ভুল নেই, সেইটাই ছিল এই লাইব্রেরি নিয়ে ভাবনার গোড়ার কথা । আর, এই অসম্ভব স্বপ্ন সত্যিই তিনি সফল করে তোলেন একদিন। ১৯৭৮ সালের ২৩ জুন তিনি তাঁর নিজের বাড়ির (১৮/এম, টেমার লেন) একতলায় তৈরি করেন ‘বাংলা সাময়িকপত্র পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র’ পরে যার নাম হয় ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’। গত সাড়ে চার দশকে চারাগাছ থেকে এই প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়েছে বটবৃক্ষে । আজ তাঁদের সংগ্রহে প্রায় এক লক্ষ লিটল ম্যাগাজিন যার মধ্যে আছে দুষ্প্রাপ্য নানা পত্রিকার বিভিন্ন কপি। সেই সঙ্গে আছে ৬৫টি নানা বিষয়ের প্রায় পাঁচ হাজার বই। কলকাতার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থাগারগুলির পাশে পাশে এই লাইব্রেরিও আজ সন্ধিৎসু পাঠক ও গবেষকদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য। নিতান্তই অপরিসর ঘরে বিপুল সংগ্রহের ভার বহন করে আজও উৎসাহী পাঠক গবেষকের কাছে তাঁদের চাহিদা মিটিয়ে চলেছে এই প্রতিষ্ঠান। কলকাতার সংস্কৃতির সঙ্গে এই লাইব্রেরি কীভাবে যুক্ত তা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম গত কয়েক বছর আগে তৈরি চিত্র পরিচালক অনীক দত্তের একটা বাংলা ছবিতে (‘মেঘনাদ বধ রহস্য’) যেখানে এই ছবির নায়ক এই লাইব্রেরিতে এসেছিলেন একটি তথ্যের খোঁজে। এছাড়া আজ ইউ টিউব বা অন্য মাধ্যমেও এই লাইব্রেরির পরিচিতি পাওয়া যাবে। কলেজ স্ট্রিট-এর অনুষঙ্গে এই লাইব্রেরির প্রসঙ্গ তাই না এসে উপায় নেই। আশির দশকের গোড়ার দিকে যখন কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে অল্প অল্প পরিচয়ের সূচনা হচ্ছে তখন এই লাইব্রেরির সন্ধান না-জানলেও নব্বই দশকে এসে এই লাইব্রেরি আমাদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে ওঠে। নিজস্ব কিছু লেখালিখির সূত্রে বেশ কয়েকবার এই প্রতিষ্ঠানের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্তের সাহায্য নিতে হয়েছে। হাসিমুখে তিনি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমার দিকে। তাঁর লাইব্রেরি ঘরের টেবিলে বসে কাজ করেছি। মনে আছে, এমনই একদিন ছিল রথযাত্রার বিকেল, পথে পথে বাচ্চাদের রথ বেরিয়েছে — আমরা কাজ করছিলাম ভিতরের ঘরে। চায়ের সঙ্গে পাঁপড়ভাজা আনানো হল সেদিনের উপস্থিত সদস্যদের জন্য। এই ব্যক্তিগত উষ্ণতা কি আর কোনো বড় প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারে পাওয়া সম্ভব ?
ব্যক্তিগত উষ্ণতার প্রসঙ্গ আলাদা করে উল্লেখ করলাম কারণ এক সময় সন্দীপ দত্ত, আমাদের শ্রদ্ধেয় সন্দীপদা, আমাদের মতো স্নেহভাজনদের জন্মদিনের সপ্তাহখানেক আগে থেকে নিজে হাতে জন্মদিনের শুভেচ্ছা- বার্তা ও অলঙ্করণ করা পোস্টকার্ড ডাকে দিতেন, জন্মদিনের আগের দিন বা ওই দিনই সেই সুচিত্রিত পোস্টকার্ড এসে যেত আমাদের হাতে। এই উষ্ণতার কি কোনো বিকল্প হয়। মনে পড়ছে ‘জন্মদিন’ শিরোনামে তিনি একটি সংকলন প্রকাশ করেছিলেন অনেক বছর আগে —- সেই সংকলনে আমায় আমন্ত্রণ করেছিলেন লিখতে। সেই লেখায় লিখেছিলাম, ‘জন্মদিন আমার কাছে মৃত্যুর দিনের আরেকটু কাছে এগিয়ে যাওয়া’ —- এমন ‘নেতিবাচক’ মন্তব্যের জন্য আমায় মৃদু বকে দিয়েছিলেন তিনি। ‘ষাটের দশক’ এর বাংলা কবিতার বিভিন্ন প্রবণতা নিয়ে একটি ছোট গবেষণা মূলক কাজ করার সময় আমার প্রধান সহায় ছিলেন তিনি ও তার লাইব্রেরি। গত মার্চ মাসে (২০২৩) লাইব্রেরির প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্তের আকস্মিক প্রয়াণ তাই আমাদের কাছে এক মস্ত ক্ষতি। এই ‘দুর্ঘটনার’ মাত্র দিন পনেরো আগেই তার লাইব্রেরির অপরিসর ঘরে অনেক কথা হয়েছিল তাঁর সাথে। এত বড় একটা ব্যাতিক্রমী উদ্যোগের পেছনে যে কোনোদিনই কোনও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা মিলল না, এটা ছিল তাঁর মূল আক্ষেপ। রাজ্যের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী একদা ছিলেন এই লাইব্রেরির সদস্য ও পাঠক —- প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি সরকারি ক্ষমতায় এসে ‘কিছু’ করবেন। আদপে হল না কিছুই, এটাই ছিল তাঁর আফসোস। আর ‘কিছুই না করতে পেরে’ রাজ্যের বর্তমান ‘হেরিটেজ কমিটি’ র চেয়ারম্যান ও একদা সন্দীপদার প্রতিবেশী নাকি প্রস্তাব দিয়েছিলেন এই লাইব্রেরিকে তিনি ‘হেরিটেজ’ করে দেবেন — আদপে কিছুই হয়নি। অবশ্য ‘হেরিটেজ’ ঘোষণার কিছু আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন আছে, এই ধরনের প্রতিশ্রুতির কোনো সারবত্তা নেই। যাই হোক, প্রাণপুরুষের মৃত্যুর পরেও লাইব্রেরির কাজ থেমে নেই, এটাই আজকের বড় খবর।
কলেজ স্ট্রিট কেন্দ্রিক আড্ডার জায়গাগুলো নিয়ে আগের একটা পর্বে অল্প কিছু বলেছি। এবারে তার সঙ্গে কিছু সংযোজন করতে চাই। তার আগে আবারও বলে রাখি কলেজ স্ট্রিট-এর অনুষঙ্গে মূলত কফি হাউস ঘিরে যে আড্ডা একেবারে মিথ হয়ে গেছে সেইরকম কোনো আড্ডার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার কোনো সুযোগ আমাদের ক্ষেত্রে ঘটেনি। পড়াশোনা যখন করেছি, তখন তার মূল কেন্দ্র ছিল যাদবপুর ; পরের পর্বে আড্ডা দেওয়ার জন্য যে কয়েকটা ক্ষেত্রে কলেজ স্ট্রিট এসেছি, তার মধ্যে কফি হাউস ছিল একেবারেই কম। বরং নব্বই দশকের গোড়ায় অল্প কয়েকবার একক বান্ধবী নিয়ে স্বল্প সময় কাটিয়েছি কফি হাউসে, তাকে অবশ্যই আড্ডা বলা চলে না। একুশ শতকে এসেও ওই রকমই বিশেষ পরিচিত কারোর কারোর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাবার জন্য বেছে নিতে হয়েছে কফি হাউস। মনে পড়ে যাচ্ছে, ২০১৮ সালে বহু বছর বাদে যাদবপুরের এক চেনা বান্ধবীর সঙ্গে হঠাৎ পরিচয় হয়েছিল ফেসবুকের দৌলতে, সে তখন স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা —- গবেষণার পাশে পাশে চালায় একটি ইংরিজি ব্লগ। এর অল্প কয়েকমাস পরে সে কলকাতায় এলে দুজনের ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও ঘণ্টাখানেক সময় কাটানো গিয়েছিল কফি হাউসেই। তারপর আবার তার সঙ্গে যোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। বরং অন্য একটা আড্ডার সূত্রপাত হয়েছিল কলেজ স্ট্রিটকে ঘিরেই —- সেই কথা বলি। ‘পরিকথা’ পত্রিকার সম্পাদক দেবব্রত চট্টোপাধ্যায় মোটামুটি তিনমাস অন্তর তখন তাঁর পত্রিকা প্রকাশ করতেন। পত্রিকা প্রেস থেকে হাতে এলে তিনি পত্রিকার সঙ্গে নানা সূত্রে যুক্ত নানান ব্যক্তিত্বকে আহ্বান করতেন এক বৈকালিক আড্ডায়। সেই আড্ডার জায়গা ছিল সংস্কৃত কলেজের মেন গেট দিয়ে ঢুকে মূল প্রবেশপথের সামনে যে ধাপ দেওয়া সিঁড়ি, সেইটাই। আমরা একেকটা সিঁড়ির ধাপে ধাপে বসতাম, চা বিস্কুট আসত, হাতে হাতে দেওয়া হত পত্রিকার নতুন কপি, সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে চলত নানা বিষয়ের কথাবার্তা। এই আড্ডায় আসতেন কথাসাহিত্যিক অমলেন্দু চক্রবর্তী, প্রাবন্ধিক- গবেষক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, গল্পকার সাধন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। যেহেতু খোলা জায়গায় জমায়েত, ফলে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নামার মুখেই ভেঙে যেত সেই আড্ডা। সমস্যা হত বর্ষার সময় — জুন-জুলাই মাসের সংখ্যা বেরোলে কখনো সেই আড্ডা স্থগিত রাখতে হয়েছে।
‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকার উদ্যোগে প্রথম থেকেই নানা ধরনের অনুষ্ঠান ও আড্ডার আয়োজন হয়ে আসছিল সেই নব্বই দশকের গোড়া থেকেই। একসময় ‘আলিপুর সেন্ট্রাল জেল’ ক্যাম্পাসের মধ্যে কবি কানাইলাল জানার সুবিশাল কোয়ার্টার্সের ছাদে নিয়মিত অনুষ্ঠান হয়েছে প্রতিমাসে। পরে ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকার দফতর ও প্রকাশনার অফিস পটলডাঙ্গা স্ট্রিটে উঠে এলে সেই বাড়ির চারতলার ছাদে শুরু হল অনুষ্ঠান ও আড্ডা। বেশ কয়েকবার সেখানে যোগ দিয়েছি, আড্ডা ও কবিতাপড়ার বাইরেও সেখানে অন্য আকর্ষণ ছিল গান। উপস্থিত কেউ কেউ খোলা গলায় গান শুনিয়ে নতুন মেজাজ জুড়ে দিতেন আড্ডার। একবার এমনই এক আড্ডায় তাঁর খোলা গলায় ‘তোমায় সোনার থালায় সাজাব আজ’ গেয়ে মাত করে দিয়েছিলেন আমাদের একসময়ের বান্ধবী মৌ ভট্টাচার্য। বিশেষ করে বিজয়া দশমীর পরে ‘কবিতা পাক্ষিক’ যে বিজয়া সম্মিলনী আয়োজন করতেন সেখানে আগত কবি সাহিত্যিকদের পাত পেড়ে লুচি, ছোলার ডাল ও মিষ্টি খাওয়ানো হত। এর উদ্যোক্তা ছিলেন কবিদের পরমসুহৃদ প্রভাত চৌধুরী আর নেপথ্য কারিগর ছিলেন তাঁর স্ত্রী যূথিকা চৌধুরী, আমাদের সকলের বৌদি। আসলে রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দফতরে চাকরি করলেও প্রভাতদা ছিলেন কবিতা ও সাহিত্যের একজন ‘হোলটাইমার’, রাইটার্স বিল্ডিং-এ তাঁর দফতরে যাতায়াত সূত্রে দেখেছি অফিসের দৈনন্দিন কাজের বাইরে তাঁর টেবিল ঘিরে আমাদের মতো তরুণদের অবাধ আড্ডা, নানা পরিকল্পনার খসড়া তৈরি। অবসর নেওয়ার পরে তাঁর সেই সুযোগ আরও প্রসারিত হয় —- নিয়মিত কবিতার কাগজ চালানোর পাশাপাশি নানা প্রকাশনায় তিনি যুক্ত হয়ে পড়েন। জীবনের শেষ দিকে তিনি একটি সাময়িকপত্র প্রকাশ করাও শুরু করেন। স্বপ্নদ্রষ্টা এই মানুষটির অকালমৃত্যু পটলডাঙার সেই আড্ডার অবসান ডেকে এনেছে।
‘ফেভারিট কেবিন’ এর কথা আগে একবার লিখেছি। সেখানে আড্ডা দেওয়ার সূত্রপাত হয়েছিল কথা সাহিত্যিক অমলেন্দু চক্রবর্তীর মধ্যবর্তিতায়। তাঁর প্রয়াণের পরে ওইখানে আড্ডার সঙ্গী হয়েছেন শিক্ষা চিন্তক গবেষক সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাঝে মাঝে থাকতেন ‘জলার্ক’ সম্পাদক তথা ‘ঋতাক্ষর’ প্রকাশনার কর্ণধার মানব চক্রবর্তী, কবি- গল্পকার প্রদীপ রায়গুপ্ত, আসতেন বাংলা সিনেমার গবেষক দেবপ্রসাদ ঘোষ। ওখানেই আলাপ হয়েছিল দৃপ্তা পিপলাই নামক এক কেরলীয় তরুণীর সঙ্গে, তিনি তখন রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কিছু গবেষণার কাজ করছিলেন। মেল ও ফেসবুকে কিছুদিন এই বিষয়ে আমাদের মধ্যে কিছু তথ্য বিনিময় হয়েছিল। বর্তমানে তিনি সম্ভবত বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা, বিবাহ- সন্তান সব কিছু সামলিয়ে বোধহয় শিক্ষকতার কাজ করেন, প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আর নেই।
এর আগের কোনো একটা পর্বে কলেজ স্ট্রিট এলাকার তিনটি ‘বসন্ত কেবিন’ নিয়ে লিখেছি। এদের মধ্যে কলেজ স্ট্রিট বাজারের মধ্যে অবস্থিত ‘বসন্ত কেবিন’-এ আমাদের স্বল্পায়ু আড্ডার কথাও জানিয়েছি। কলেজ স্ট্রিটের প্রাচীন বাজার ভেঙে ‘বর্ণপরিচয়’ মল তৈরি শুরু হতেই সেই ‘বসন্ত কেবিন’ ভাঙা পড়ে যায়, এখনকার অসম্পূর্ণ ‘বর্ণপরিচয়’ এ সেই রেস্টুর্যান্ট চালু আছে কি না আমার জানা নেই। তবে আড্ডার একটা নতুন কেন্দ্র হিসেবে মেডিক্যাল কলেজের বিপরীতের ‘বসন্ত কেবিন’ উঠে আসে মোটামুটি নতুন শতাব্দীর গোড়ার দিকে। প্রতি শনিবার সন্ধ্যে ছটা/সাড়ে ছটা থেকে নটায় দোকান বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত একদল সাহিত্যমনস্ক ব্যক্তিত্ব এখানে জড়ো হতেন, নিজেদের লেখা পড়তেন, নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করতেন একতলার ডানদিকের তিনটি টেবিল জুড়ে নিয়ে। আসতেন নানা ছোট পত্রিকার সম্পাদকরা তাঁদের নতুন সংখ্যার কপি নিয়ে এবং পরের সংখ্যার জন্য লেখা সংগ্রহের অভিপ্রায়ে। বার কয়েক টোস্ট আর চায়ের অর্ডার দেওয়ার পরে দোকানের খাবার বিল সকলে ভাগাভাগি করে মিটিয়ে দিতেন। নিয়মিত না হলেও বেশ কয়েকবার এই জমায়েতে হাজির থেকেছি। এই আড্ডার মূল সংগঠক ছিলেন প্রাক্তন অধ্যাপক, কবি ও প্রাবন্ধিক সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়। নিয়মিত আসতেন কবি সুজিত সরকার, সোমক দাস, অজয় নাগ, কালীকৃষ্ণ গুহ, ‘মাঝি’ পত্রিকার প্রশান্ত রায় প্রমুখ। এখানেই পরিচয় হয় জার্মান ভাষার এক সুপণ্ডিত ও অনুবাদক দেবব্রত চক্রবর্তীর সঙ্গে। আলাপ হয় অনেক মফসসলের কবি ও সম্পাদকদের সঙ্গে যাদের সকলের নাম সত্যিই এখন আর স্মরণে নেই। তবে এখানে বলে রাখা দরকার, সাধারণভাবে লেখক-সাহিত্যিকদের এইসব আড্ডা-জমায়েতকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে একরকম ‘গ্লোরিফাই’ করে দেখানোর একটা প্রবণতা আছে। পাশাপাশি, যারা এইসব আড্ডার সদস্য ছিলেন ও থাকেন তাঁরা নিজেরাও একধরনের গর্বের সঙ্গে এইসব কথা বলে থাকেন। বাংলার সাহিত্য, রাজনীতি বা সমাজনীতির সঙ্গে অনেক গৌরবময় মননশীল আড্ডার ইতিহাস জড়িয়ে আছে এটা সত্যি। কিন্তু অন্যদিকে এটাও সত্যি, সব আড্ডাই যে খুব সৃষ্টিশীল বা মেধাবী এমন সাধারণীকরণ না করাই ভাল। ‘কল্লোল’ বা ‘কৃত্তিবাস’ এর আড্ডাকে পরের সময়কালে আলাদা করে মহিমান্বিত করেছেন সেই গোষ্ঠীর সদস্যরাই, কিন্তু ওইসব গোষ্ঠীর নিজেদের ভিতরেও অনেক দ্বন্দ্ব-প্রতিদ্বন্দ্ব ছিল, সেগুলো তেমন করে উল্লিখিত হয়নি। ‘বসন্ত কেবিন’ এর আড্ডা নিয়ে এই প্রসঙ্গটা উত্থাপন করলাম, কারণ, বেশ কয়েকবার তাঁদের আড্ডার শরিক হয়ে আমার মনে হয়েছে এখানে যারা আড্ডা জমাতে আসেন তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক পিঠ-চুলকানোর একটা ব্যাপার আছে। এমনকি দূর মফসসল থেকে যেসব কবি-যশোপ্রার্থী বা সম্পাদকরা এখানে আসতেন তাঁরা প্রায়ই হাতে গুঁজে দিতেন নিজেদের চটি দু/তিন ফর্মার কবিতার বই এবং তার পরেই অনুরোধ সেই বই নিয়ে কোনো একটা আলোচনা লিখে তাঁকে সময়ান্তরে দেওয়ার। এই ব্যাপারটা আমার বেশ অপছন্দের বলে বরাবরই মনে হয়েছে। কবি-মহলে ও লিটল ম্যাগাজিনের ভুবনে অনেকদিন ধরেই এটা একটা ‘ভাইস’ যে একজন সম্পাদক অন্য সম্পাদকের রচিত কবিতাকে ‘মহান’ বলে লেখা প্রবন্ধ ছাপবেন, বিনিময়ে তিনিও সময়ান্তরে ওই সম্পাদককে কোথাও ‘অসামান্য’ হিসেবে স্তুতিতে ভরিয়ে দেবেন। আমার মনে হয় না, এতে বাংলা কবিতা বা লিটল ম্যাগাজিনের সত্যি করে খুব লাভ হয় বা হচ্ছে।
যাই হোক ‘বসন্ত কেবিন’ এর এই আড্ডা আচমকাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একদিন। সেটা সম্ভবত ২০০৯-১০ সাল। খবর পেলাম, স্থানীয় জোড়াসাঁকো থানার গোয়েন্দা বিভাগ থেকে আধিকারিকরা রেস্টুরেন্টের মালিককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এসেছেন, তাঁদের সন্দেহ এই রেস্টুরেন্টে ‘নাকি’ মাওবাদীদের আনাগোনা আছে এবং এখানে অনেক গোপন মিটিং সংগঠিত হচ্ছে। মালিক বেচারা ভয়ে কিছুদিন দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য হলেন। তার বেশ কিছুদিন পরে পুলিশের অনুমতি নিয়ে ‘বসন্ত কেবিন’ চালু হল কিন্তু তাঁদের নির্দেশ মতন বিভিন্ন জায়গায় বসানো হল সিসি ক্যামেরা। সেইসব দিনগুলোয় সংগত কারণেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আড্ডা কারণ আড্ডাধারীরা কেউই কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, ‘মাওবাদ’ তো দূরস্থান। সেখানে যারা আসতেন তাঁরা অনেকেই কলেজের অধ্যাপক বা সরকারি চাকুরে, ব্যাঙ্ককর্মী ইত্যাদি। অবশ্য সাময়িক বিরতির পরে আবার আড্ডা চালু হয়েছিল। আমার অবশ্য আর তেমন যাওয়া হয়ে ওঠেনি। সম্ভবত কোভিড-এর আগের বছর (২০১৯) অল্প সময়ের জন্য একবার গিয়েছিলাম। তারপর দুবছর কোভিডের প্রকোপে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। আপাতত সেই ‘বসন্ত কেবিন’ এর ওই আড্ডা বন্ধ। এই লেখার সূত্রেই সম্প্রতি দেখা করেছিলাম ‘বসন্ত কেবিন’ এর ম্যানেজারের সঙ্গে, তিনি আমায় দেখে আফশোস করলেন, কেন আর আমরা নিয়মিত আসি না ! নতুন কোনো গোষ্ঠী এখন সেখানে আড্ডা জমান কি না সেই তথ্য আপাতত আমার অধরা।
কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি-র উল্লেখ দিয়ে শুরু হয়েছিল এই পর্বের আখ্যান। এবার একটু সেই প্রসঙ্গে আসি। সত্যি সত্যি ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বলতে কী বুঝব ও কাদের বুঝব, এনিয়ে বিস্তর বিতণ্ডা আছে, যার কোনও সর্বজনগ্রাহ্য সমাধান এখনো আমাদের অধরা । তবে একটা গড়পড়তা হিসেবে আমরা এইটুকু ধরতেই পারি, মূলধারার বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকা যা প্রধানত বড় কোনো সংবাদপত্র বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত হয়, যাদের পিছনে সুনির্দিষ্ট সংগঠিত পুঁজির বিনিয়োগ আছে সেইগুলোর বাইরে গিয়ে ছোট বা মাঝারি মাপের সীমাবদ্ধ পুঁজি নিয়ে যেসব পত্র-পত্রিকা বেরোয় সেগুলোই লিটল ম্যাগাজিন। জানি, এখানে ‘বাণিজ্যিক’ শব্দটি ঘিরে সংশয় তৈরি হবে, কারণ ‘লিটল ম্যাগাজিন’ গুলোও পাঠকের কাছে বিক্রি করার উদ্দেশ্যেই প্রকাশিত হয় আর তারও একটা বিনিময় মূল্য থাকে, তাই সেগুলি বিক্রি হলে নিশ্চয়ই ছোট অর্থে হলেও একটা লাভালাভের ব্যাপার থেকেই যায়। তবে এই বিতর্কিত প্রসঙ্গ নিয়ে আমরা আর কথা বাড়াব না। আমাদের আলোচনার মূল পরিধি কলেজ স্ট্রিট। আর, বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে যেসব উল্লেখযোগ্য ও মর্যাদাবান সাময়িকপত্র বা পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে অন্তত গত এক শতাব্দীর বাংলায় তার অনেকগুলিরই দফতর আমরা খুঁজে পাই এই বইপাড়া ঘিরেই। প্রথমেই যে পত্রিকার কথা আসবে সেটি হল ‘পরিচয়’, যার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত — তখন তাঁদের দফতর ছিল হাতিবাগান এলাকায় (১৯৩১) । পরে তিনি সেই পত্রিকা হস্তান্তরিত করেন ভারতের কমিউনিস্ট দলের ‘মার্কসবাদী সাহিত্য-সংস্কৃতি’ বিষয়ক শাখাকে, সম্পাদনার ভার নেন গোপাল হালদার ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় । বর্তমানে বিরানব্বই বছরে পড়া এই পত্রিকায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন। গত প্রায় এক শতাব্দী ধরে বাংলার প্রগতিশীল সাহিত্যের ধারক-বাহক হয়ে তার উজ্জ্বল দিকচিহ্ন হিসেবে অবস্থান করছে ‘পরিচয়’, যাদের দফতর হল, পুরোনো কলেজ স্ট্রিট মার্কেট সংলগ্ন ৮৯, মহাত্মা গান্ধী রোডের দোতলায়। এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার, কোথাও একটা রাজনৈতিক দর্শনগত পক্ষপাত থাকলেও পত্রিকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বা লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে সেই পক্ষপাত কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি । গুণগত মান-বিচারে সব রকম লেখা ও লেখককে সাদরে স্থান দেওয়া হয়েছে এখানে। সম্প্রতি ‘পরিচয়’-এ প্রকাশিত একটি গল্প ও প্রবন্ধের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, সেটার সূচিপত্র খেয়াল করলে এই উদার মানসিকতার একটা আভাস বোঝা যায় । একসময় ‘পরিচয়’ পত্রিকায় লেখক হিসেবে স্থান পাওয়া ছিল একটা গর্বের ব্যাপার। অবশ্য ‘পরিচয়’ এরও আগে ‘কল্লোল’ পত্রিকার (১৯২৩) দফতর ছিল এই এলাকারই বেনিয়াটোলা লেনের এক অপরিসর ঘরে। সেই ঘর আর তার নিয়মিত বাসিন্দাদের আড্ডা আর দিনযাপনের নানা স্মৃতিখন্ড আমরা পড়েছি অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত-র ‘কল্লোল যুগ’ গ্রন্থে।
এর পাশাপাশি তিরিশের দশক থেকেই ‘অগ্রণী’ পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের ভিতরে অবস্থিত তাঁদের অফিস থেকে। একটা সময় মার্কসবাদী ভাবনা-চিন্তার চর্চাকারী হিসেবে ‘অগ্রণী’ র নাম ছিল সুবিদিত। কবি অরুণ মিত্র প্রমুখ যুক্ত ছিলেন এই পত্রিকায়। আগের কোনো একটি পর্বে লিখেছি, গত শতকের আশির দশকে এই পত্রিকার পুনরুজ্জীবন ঘটে, তখনও তাতে নিয়মিত লেখালিখি করতেন জ্যোতি ভট্টাচার্য, নারায়ণ চৌধুরীর মতো বিশ্রুত মানুষজন। অবশ্য খুব বেশিদিন সেই পত্রিকা চলেনি। এমনই আরেকটি নামী পত্রিকা ‘এক্ষণ’ যার নাম ও অলঙ্করণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। সম্পাদনা করতেন নির্মাল্য আচার্য ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পরে সৌমিত্র চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে বেশি জড়িয়ে পড়ায় একা নির্মাল্য আচার্য-ই আমৃত্যু পত্রিকা সম্পাদনা করে গেছেন। এই পত্রিকার অফিস ছিল এই কলেজ স্ট্রিট পাড়াতেই : ৭৩, মহাত্মা গান্ধী রোড, আসলে যেটা ছিল ‘সুবর্ণরেখা’ প্রকাশনারও অফিস । ‘এক্ষণ’ পত্রিকা যুক্ত ছিল বাঙালির উচ্চমার্গী নানা চিন্তা-চেতনার সঙ্গে, যার বিষয় নির্বাচনের ব্যাপারে সম্পাদক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্যজিতের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতেন। নানা ধরনের বিষয়ের বিন্যাসে ‘এক্ষণ’ ছিল বাঙালির মেধাচর্চার উল্লেখ্য আধার। কার্ল মার্ক্সের দেড়শ বছরের জন্মবার্ষিকীতে (১৯৬৮) ‘এক্ষণ’ তাঁদের ‘কার্ল মার্ক্স সংখ্যা’ প্রকাশ করে সাড়া ফেলে দেয়। গত ২০১৮ সালে মার্ক্স-এর দ্বিশতবার্ষিকীতে সেই সংখ্যা পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল যা পাঠকদের আনুকূল্যে এবারও নিঃশেষিত হয়ে যায়। সম্পাদক নির্মাল্য আচার্যের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এই পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।
সত্তরের দশকের রাজনৈতিক আবর্তের মধ্যে অনেক পত্র-পত্রিকার স্ফূর্ত প্রকাশ ঘটেছিল যার বেশিরভাগই এখন আর প্রকাশ হয় না। কিন্তু সেই সত্তরের দশকের অগ্নিস্রাবী সময়ে প্রকাশিত দুটি পত্রিকা আজও উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। তার একটি ‘অনুষ্টুপ’ অন্যটি ‘অনীক’ —--- এই দুটি পত্রিকারই দফতর কলেজ স্ট্রিট এলাকায়। ‘অনুষ্টুপ’ আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে ২/ই নবীন কুন্ডু লেনের ঠিকানা থেকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে, তৈরি হয়েছে প্রকাশনা। বিভিন্ন বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে খ্যাতি ও প্রচার বেড়েছে পত্রিকার, বেড়েছে বিজ্ঞাপনদাতাদের আনুকূল্য। এই পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অনিল আচার্যের সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রশংসা করার মতো। মূলত তাঁর পরিচিতির সূত্রেই গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক , দীপেশ চক্রবর্তী বা অরিন্দম চক্রবর্তীর মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাঁদের বইপত্র ছাপার ভার এই প্রকাশনাকেই দেন। বিভিন্ন ধরণের স্মারক বক্তৃতা আয়োজিত হয় ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকার অভিভাবকত্বে। এঁদের প্রকাশিত ‘সমর সেন সংখ্যা’, ‘শঙ্খ ঘোষ সংখ্যা’ বা ‘ স্বাধীনতা- উত্তর কালের গণ-আন্দোলন’ , ‘বটতলার সাহিত্য’ বিষয়ক বিশেষ সংখ্যাগুলি সত্যিই ‘কালেক্টর্স আইটেম’। ‘অনীক’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন দীপঙ্কর চক্রবর্তী। যদিও বলে রাখা দরকার এই পত্রিকা আগে ত্রৈমাসিক হিসেবে প্রকাশ হত ‘পুনশ্চ’ নামে (এপ্রিল ১৯৬৪) , পরে (জুলাই ১৯৬৬) তে তাঁদের নাম বদল হয়ে ‘অনীক’ হয়, তখনো সেটা ছিল ত্রৈমাসিক । জুলাই ১৯৭২ থেকে ‘অনীক’ মাসিক পত্রিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আজও নিয়মিত এই পত্রিকা প্রকাশ হয়ে চলেছে। জরুরি অবস্থার সময় (জুন ১৯৭৫) এই পত্রিকা ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণা করা হলে তার সম্পাদক ও সম্পাদকীয় দফতরের এক কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। এঁদের দফতর প্রথমে ছিল সংস্কৃত কলেজের গেটের বিপরীতে ১২সি, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে , কয়েক বছর আগে এরা স্থান পরিবর্তন করে চলে গেছেন ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটের পেছনে রমানাথ মজুমদার স্ট্রিটে ( বর্তমান ঠিকানা : ১০/২বি রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট), যেখানে একই সঙ্গে রয়েছে তাঁদের প্রকাশনা ‘পিপলস বুক সোসাইটি’। এক সময় ‘অনীক’ পত্রিকায় নিয়মিত নানা আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে নানা উজ্জ্বল নিবন্ধ ও সেই সঙ্গে গল্প কবিতা বেরোতো ও পত্রিকাটির একটা অন্যরকম পরিচিতি ছিল। দীপঙ্কর চক্রবর্তী প্রয়াত হওয়ার পরে এর কৌলীন্য কিছুটা কমে যায় ও প্রকাশনা সাময়িকভাবে কিছুটা অনিয়মিত হয়ে পড়ে। যদিও এখন অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবীশ-এর অভিভাবকত্বে পত্রিকা আবার নিয়মিত গুণমান বজায় রেখেই প্রকাশ হচ্ছে । তবে আর্থিক সঙ্কটে পত্রিকার কলেবর কিছুটা কমাতে হলেও প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধগুলি অবশ্যই মেধাবী পাঠকের পক্ষে রোচক । এঁদের পুরোনো সংখ্যাগুলিও এখন আগ্রহী পাঠক ইন্টারনেটেও পড়ে নিতে পারেন।
একসময় খুব সাড়া জাগিয়ে প্রকাশিত হত ‘প্রমা’ পত্রিকা, যাদের দফতর ছিল ৫৭/২ই কলেজ স্ট্রিট। আমরা নব্বই-এর দশকে এই পত্রিকা দেখেছি। পত্রিকার দফতর খুঁজে পাওয়া খুব সহজ ছিল না। পাতিরামের পত্রিকা স্টল থেকে ওই ফুটপাথ ধরে উত্তর মুখে এগিয়ে চললে পাওয়া যায় এক কালী মন্দির, যার পাশের অতি সংকীর্ণ গলিতে ঢুকলে খুঁজে পাওয়া যাবে এই পত্রিকার অফিস। কবিতা ও নানা ধরনের লেখায় উজ্জ্বল থাকত এই পত্রিকায় যার প্রাণপুরুষ ছিলেন সুরজিত ঘোষ । পেশায় প্রযুক্তিবিদ হলেও সাহিত্য ও কবি সাহিত্যিকদের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য ছিল। নিজের প্রকাশনা থেকেও কিন্তু তিনি উল্লেখ্য কবিদের কাব্যগ্রন্থ বা প্রবন্ধের বই বার করতেন। তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে থেকেই পত্রিকা ও প্রকাশনা অনিয়মিত হয়ে পড়ে, তাঁর অনুপস্থিতিতে এখন আর সেই প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব নেই। আরেকটি পত্রিকার কথা এখানে বলতেই হবে, যেটি হল শিবনারায়ণ রায় সম্পাদিত ‘জিজ্ঞাসা’ যাদের স্থায়ী দফতর কফি হাউসের তিনতলায় (১৫, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট) । বাঙালি মননের সূত্রে ভারতের কমিউনিস্ট দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নাথ রায় একটি বর্ণময় চরিত্র, যিনি পরের জীবনে ‘র্যাডিকাল হিউম্যানিজম’ নামক একটি জীবনদর্শনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন —-- তাঁর সাক্ষাৎ শিষ্য ছিলেন মনস্বী শিবনারায়ণ রায়। ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকার মঞ্চে নানা সময় উল্লেখযোগ্য লেখকেরা লিখেছেন, পত্রিকা হিসেবে অনিয়মিত হলেও তার একটা চাহিদা ছিল পাঠক মহলে। শিবনারায়ণ রায়ের মৃত্যুর পরে (২০০৮) এখনও পত্রিকা ওই দফতর থেকেই প্রকাশ হয়। এঁদের প্রকাশনা থেকেও একসময় নানা গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ হয়েছে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পিতৃস্মৃতি’ বইটি এঁরাই প্রকাশ করেছিলেন। খুব সম্প্রতি (জানুয়ারি-২০২৩) এঁরা গৌরকিশোর ঘোষকে নিয়ে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন।
সিরিয়াস পত্রিকার পাশে পাশে অন্য কিছু পত্রিকার নাম এবার উল্লেখ করতে চাইব যাদের দফতর রয়েছে কলেজ স্ট্রিটের এলাকাতেই। যার প্রথমেই আসবে শতাব্দী প্রাচীন ‘দেব সাহিত্য কুটির’ —---- ২১, ঝামাপুকুর লেনে যাদের প্রকাশনা থেকেই আজও বেরিয়ে চলেছে ‘শুকতারা’। ‘শুকতারা’ তে প্রকাশিত ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ বা ‘হাঁদা-ভোঁদা’ র কার্টুন গল্পের স্মৃতি আজও আমাদের শৈশবের চিরন্তন সম্পদ হয়ে আছে। একই সঙ্গে তার জনপ্রিয়তা অমর করে রেখেছে এদের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথ-কে। বস্তুত পক্ষে অ্যানিমেশন বা ছবির মাধ্যমে শিশু ও কিশোরদের গল্প বলার যে ঐতিহ্য তার একটা পৃষ্ঠপোষক এই ‘দেব সাহিত্য কুটির’ । ‘কিশোর জ্ঞান-বিজ্ঞান’ নামে যে পত্রিকাটা আমাদের কিশোর বেলায় প্রকাশিত হত এবং বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তাঁদেরও দফতর ছিল এই পাড়াতেই (৮৬/১ মহাত্মা গান্ধী রোড, দিলখুশা রেস্টুরেন্টের পাশেই) । ‘শৈব্যা প্রকাশন’ থেকে পত্রিকার পাশাপাশি সহজে বিজ্ঞানের নানা বিষয় বোঝবার উপযোগী বইও প্রকাশ হত, এদের কাজকর্মের মূল হোতা ছিলেন রবিন বল। বেশ কিছুকাল আগে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। ‘কিশোর জ্ঞান-বিজ্ঞান’ও অনেকদিন প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেছে, তবে প্রকাশনা আজও আছে। এছাড়াও এমন অনেক ছোট পত্রিকা আছে যা একসময় নিয়মিত কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া থেকে বেরোত কিন্তু এখন আর বেরোয় না। তেমন দুয়েকটা পত্রিকা হল, ‘চতুষ্কোণ’ (দফতর- ৭৭/১, মহাত্মা গান্ধী রোড) বা ‘উৎস মানুষ’ (২, রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট)। এছাড়া ‘কলেজ স্ট্রিট’ নামেও অনেকদিন থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয় এই বইপাড়া থেকেই (১৩, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট)। আর এই যে ‘গুরুচন্ডালী’ তে এই আখ্যান প্রকাশিত হচ্ছে, তাঁদেরও সম্পাদকীয় দফতর (শ্রীগোপাল মল্লিক লেন) কলেজ স্ট্রিট পাড়াতেই । সব মিলিয়ে কলেজ স্ট্রিটের অবস্থান এইভাবে প্রত্যক্ষ যুক্ত হয়ে গেছে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির পরিসরে।
এই পর্ব লিখতে লিখতেই খবর পেলাম মেডিকেল কলেজের বিপরীতে ‘সেসিল হোটেল’ এর । এই হোটেল ছিল গায়ক ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য- র শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি, সেই সূত্রেই সুগায়ক ধনঞ্জয় তাঁর বালি-র আদি বাড়ি ছেড়ে এখানেই দীর্ঘকাল থাকতেন (১৯৪৮ থেকে)। অভিনেতা তথা সঙ্গীতশিল্পী পাহাড়ি সান্যালও তার আগে কলকাতা এলে এখানেই থাকতেন। আমাদের মনে পড়তে পারে, মহাত্মা গান্ধী রোডের ওপর কোনো একটি হোটেলে জীবনানন্দ দাশ- ও কিছুকাল বাস করেছিলেন। বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে তো সংগীতের গভীর সখ্য —- তাই কলেজ স্ট্রিটের আখ্যানে এই তথ্যটুকু থাকলেই বা ক্ষতি কী ?
(ক্রমশ)
পরের পর্ব প্রকাশিত হবে ২ জুলাই
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।