(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পর্ব ৪
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হল একদিন। তারপরে মাস দুয়েকের অখণ্ড অবসর। প্রায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিন কাটানো। এখানে ‘অখণ্ড’ কথাটা আলাদা করে খেয়াল করা দরকার। কারণ, মাধ্যমিক পরীক্ষার পর আমাদের বলে দেওয়া হত উচ্চমাধ্যমিকের দুরূহ সিলেবাসের কথা, ফলে একেবারে মাধ্যমিকের ফল বেরোনোর কাছাকাছি সময়ে উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসের সঙ্গে একটা আলতো পরিচয়ের চেষ্টা যে আমাদের মধ্যে থাকত না, তা নয়। ইদানিংকালে শুনতে পাই, মাধ্যমিক শেষ হওয়ার সপ্তাহখানেক পর থেকেই পড়ুয়ারা তাঁদের প্রাইভেটের কোচিঙয়ে উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাস শুরু করে দেয়। আমাদের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটতে দেখিনি। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি যেমন মাধ্যমিকের পরে মামার বাড়ি বর্ধমানে থাকাকালীন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নামী অধ্যাপকের পুত্রের কাছে উচ্চমাধ্যমিক গণিতের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলাম বীজগণিত বিষয়ে। আমার সেই চার দশক আগের গণিত শিক্ষক ‘দাদা’ সেই বছর নিজে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল, বর্তমানে সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো এক নামী অর্থনীতির অধ্যাপক । এখানে বলা দরকার, মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরের সময়টায় নিজেদের বাড়ি ছেড়ে আমরা কেউ কেউ কিছুকাল নিজেদের মামার বাড়ি বা কারোর ক্ষেত্রে দেশের বাড়ি গিয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসতাম, এখনকার পড়ুয়ারা সেই সুযোগ পান কি না বা তাঁদের অভিভাবকরা এই বিষয়ে তাদের উৎসাহিত করেন কি না সেই বিষয়ে আমার কোনো ধারনা নেই। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলতে পারি, মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে মামার বাড়িতে ছুটি কাটাতে গিয়ে যতটা উপভোগ করেছিলাম, উচ্চমাধ্যমিকের পরে সেই আনন্দ পাইনি। বিশেষ করে মাধ্যমিক-উত্তর অবকাশে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে অবাধ আনাগোনার সুযোগ থাকায় প্রচুর সাহিত্যের বই পড়ার সুযোগ মিলেছিল, যা সচরাচর পাওয়া যায় না। আর উচ্চমাধ্যমিকের পর যে সেই মামাবাড়িতে আমাদের কপালে যে ‘কিল চড়’ জুটেছিল তা আদৌ ভাবার কোনো কারণ নেই। আসলে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে থেকে বাড়িতে একজন মাস্টারমশাইয়ের অধীনে প্রাইভেট পড়ার যে রীতি ছিল, উচ্চমাধ্যমিকে সেই ঘরানা বদল হয়ে যায়। আমাদের সময়কালে যেসব স্যারেরা প্রাইভেট টিউশন করতেন তাঁরা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে আর কারোর বাড়িতে গিয়ে সচরাচর পড়াতেন না। পরিবর্তে তাঁদের নিজেদের বাড়িতে ব্যাচ খুলে পড়ানোটাই ছিল চালু প্রথা। এই ‘গ্রুপে’ পড়ার কারণে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে তৈরি হয়ে গিয়েছিল এক বন্ধুদল। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেও সেই বন্ধুদের নৈকট্য কিছুমাত্র কমেনি, ফলে ওই অবকাশকালে নিজেদের এলাকার বন্ধুদলের সান্নিধ্য ও নরক গুলজার ছেড়ে মামার বাড়িতে থাকাটা ছিল কিছুটা নির্বাসনের মতো। তাই যেটুকু সময় মামার বাড়ি ছিলাম খুব একটা উপভোগ করতে পারিনি, কেবলই মনে হত বিকেলবেলা বন্ধুদের সঙ্গে গুলতানির স্মৃতি। সম্ভবত এই পর্যায়ে বুঝতে পারি, বন্ধুতাও জীবনের একটা অর্জন, অনেক ক্রান্তিকালে বন্ধুতার উষ্ণতা জীবনের শীতলতাকে ঢেকে দিতে পারে। আর সেই অবকাশ যে ‘অখণ্ড’ ছিল, তার কারণ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্টের পরে কে কোথায় কীভাবে নিজেরা ভর্তি হয়ে কোন স্রোতে ভেসে যাব, তার কোনও আগাম ইশারা আমাদের সামনে ছিল না। আর এমন সময়টাই তো বন্ধুদের সঙ্গে অখণ্ড তরজায় দিন কাটানোর ‘অমৃতকাল’।
কিন্তু পরীক্ষা যখন দিয়েছি তার ফল প্রকাশ হবেই এবং সেই সঙ্গে কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি তো নিতেই হবে। প্রায় চল্লিশ বছর আগের সেই সময়কালে ইন্টারনেট দূরাগত মরীচিকা ফলে অনলাইন অ্যাডমিশন কাকে বলে আমরা কেউ স্বপ্নেও জানতাম না। তখন ভর্তি মানে কলেজে কলেজে ঘুরে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স পড়ার অ্যাপলিকেশন ফর্ম তোলা এবং আবার তা সশরীরে গিয়ে জমা দেওয়া। বিভিন্ন বিষয়ের সফল প্রার্থীদের তালিকা কবে বেরোবে তার হদিশ রাখতে হত প্রার্থীদেরই কারণ ল্যান্ড ফোন তখন প্রায় মুষ্টিমেয় অভিজাত বা ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অধীনে, গড়পড়তা মধ্যবিত্তে ঘরে ওই বস্তু থাকত না। মনে আছে আমার ঠাকুরমার প্রয়াণ সংবাদ (১৯৮০) কলকাতায় জ্যাঠামশাইকে জানানোর জন্য আমাদের যেতে হয়েছিল স্থানীয় পুলিশফাঁড়িতে, তাঁরা দয়াপরবশ হয়ে ফোন করেছিলেন জ্যাঠামশায়ের বাড়িওয়ালা-কে। এছাড়া মুঠোফোন বা ই-মেল নামক সংযোগ ব্যবস্থা বোধহয় তখন গোটা দুনিয়াতেই আবিষ্কৃত হয়নি। তাই ঠিক সময়ে গিয়ে কলেজে ভর্তি না হলে তার প্রার্থীপদ বাতিল হয়ে যেত। তখন আবার সেকেন্ড লিস্ট বা থার্ড লিস্ট-এর অপেক্ষা । কলকাতার বেশ কিছু নামী কলেজে অবশ্য সেই সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স পড়ার জন্য অ্যাডমিশন টেস্ট নেওয়া হত এবং সেখানে বসতে গেলে একটা যোগ্যতা-নির্ধারক নম্বরও লাগত। এই ব্যবস্থা এখনও চালু আছে।
পরিবার থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, আমায় কলকাতার কোনো নামী কলেজেই ভর্তির চেষ্টা করা হবে। কিন্তু আজকের মতো ঘরে ল্যাপটপের সামনে বসে বিভিন্ন কলেজের ওয়েবসাইট দেখে সেখান থেকে অনলাইন আবেদন করার তো কোনো উপায় নেই। সুতরাং পথে বেরোনো ছাড়া পথ নেই । কিছুটা বাবার নিজের শারীরিক অক্ষমতা, কিছুটা কর্মক্ষেত্রের চাপ এবং এরই পরিণামে নিজের পুত্রকে কিছুটা স্বাবলম্বী করে তোলার অভিপ্রায়ে এই ভর্তিপর্বের প্রাথমিক স্তরে ঘুরে ঘুরে কলেজ থেকে তথ্য সংগ্রহ বা প্রয়োজনে সেখানকার ফর্ম কিনে আনার দায়িত্ব পড়ল আমার ওপর। শহরতলি থেকে ট্রেনে চেপে মহানগরে এসে নিজে পথ চিনে চিনে , বাসের বা ট্রামের রুট খুঁজে অনেক শিক্ষাসত্রের ঠিকানা বার করা ও অচেনাকে আবিষ্কারের রোমাঞ্চের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। অবশ্য নিজের জীবনের অনেকটাই কলকাতার বাসিন্দা হওয়ায় কলকাতার পথঘাট বেশিটাই পরিচিত ছিল বাবার। ফলে যেদিন যেখানে যেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকত সেদিন প্রাথমিক তালিমটুকু দিয়ে দিত বাবা নিজেই। এমনও হয়েছে আমরা একসঙ্গে ট্রেনে হাওড়া স্টেশনে এসে যে যার নিজের গন্তব্যে চলে গেছি। কিন্তু কারোর থেকে ঠিকানার হাল হকিকত জেনে বুঝে নিলেও সত্যি সত্যি কলকাতার পথে পথে ঘুরে কলেজ খুঁজে বার করে সেখানে সময়মত পৌঁছানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ, শুধু এই পর্বটা নিয়েই একটা বড়সড় অধ্যায় লেখা যায়। যেমন একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ খুঁজে পেতে। ওই কলেজের সামনে দিয়ে কোনো বাস রুট নেই। আমায় বলা হয়েছিল হাওড়া থেকে একুশ নম্বর ট্রাম ধরে ওয়েলিসলি বাটার দোকানের স্টপেজে নামার কথা, সেখান থেকে সামনে হেঁটে পাওয়া যাবে পার্ক স্ট্রিট। পার্ক স্ট্রিট থানার ঠিক বিপরীতেই সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। কিন্তু বাস্তবে এই পথটুকু চিনে যেতে আমায় বেশ ঘোল খেতে হয়েছিল। পরে অবশ্য পায়ে হেঁটেই চিনে গিয়েছিলাম আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের মল্লিকবাজার স্টপেজে নেমে অথবা পার্ক স্ট্রিট-জহরলাল নেহেরু রোডের সংযোগস্থলে নেমে এশিয়াটিক সোসাইটির সামনে দিয়ে হেঁটে সোজা চলে গেলেই মিলবে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ। অবশ্য, কিছুটা প্রসঙ্গের বাইরে হলেও বলতে ইচ্ছে করছে, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে প্রথম দিন ঢুকেই নিজেকে অত্যন্ত আড়ষ্ট ও বেমানান লেগেছিল। কলকাতার ধনী ও অভিজাত ঘরের ছেলেমেয়েদের যে একটা নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, তাদের চলাফেরা, কথাবলা, নিজস্ব আড্ডায় তা এমন স্পষ্টভাবে আগে কখনো টের পাইনি। শহরতলির বাসাবাড়িতে থাকা আমার মতো নিতান্ত মধ্যবিত্ত পড়ুয়া যে ওখানে ঠিক মিশ খাব না, এটা নিয়ে সেইদিন থেকেই মনের মধ্যে পাগলাঘণ্টি বাজছিল। কার্যত পদার্থবিদ্যা ও গণিতের অ্যাডমিশন টেস্টের ফর্ম তোলার যোগ্যতা নির্ধারক নম্বর আমার ঝুলিতে থাকলেও সেই দুটি ফর্ম জমা দিয়েও ওই প্রতিষ্ঠানের অ্যাডমিশন টেস্টে শেষ অবধি আমি আর বসিনি।
কলকাতার খ্যাত কলেজগুলির মধ্যে একেবারে প্রথমেই যার নাম আসে তা হল প্রেসিডেন্সি কলেজ। কলেজ স্ট্রিট এলাকার আশেপাশে মধ্য কলকাতা জুড়ে অনেকগুলি কলেজের অবস্থান। প্রেসিডেন্সি ছাড়া তাদের মধ্যে স্কটিশ চার্চ ও বিদ্যাসাগর কলেজের নাম করা যায় । অন্যদিকে প্রায় একই এলাকার মধ্যে সিটি কলেজ, সেন্ট পলস কলেজ, চিত্তরঞ্জন কলেজ, সুরেন্দ্রনাথ বা বঙ্গবাসী কলেজ পুরোনো প্রতিষ্ঠান হলেও সেই সময়ে পড়াশোনার মানের প্রশ্নে তাদের খুব একটা সুনাম ছিল এমন নয়। ফলে খ্যাত কলেজে ভর্তি হওয়ার অভিপ্রায়ে আবার এসে পড়ল কলেজ স্ট্রিট। সেই প্রথম প্রেসিডেন্সি কলেজের গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলাম, সঙ্গে দুচোখ ভর্তি অপার বিস্ময়। মূল বিল্ডিঙের সেই চওড়া সিঁড়ি যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুভাষচন্দ্র বসু ও ওটেন সাহেবের সংঘর্ষের আখ্যান, প্রশস্ত বারান্দার একপ্রান্তে জগদীশচন্দ্রের গড়া পরীক্ষাগার, তার চওড়া পোর্টিকো, বিরাট বিরাট ক্লাসঘর —- প্রতিটি ধুলোয় বালিতে যেন ইতিহাস কথা বলে ওঠে। পরবর্তী জীবনে প্রেসিডেন্সির অন্যান্য বিল্ডিং বা কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ ঘটেছে —- কিন্তু ‘প্রথম সব কিছু’ মানেই একটা অন্য রকম অনুভূতি।
পদার্থবিদ্যা ও গণিত এই দুটি বিষয়ে স্নাতক পড়তে গেলে যে ন্যূনতম নম্বর সেই বছর (১৯৮৫) প্রেসিডেন্সি কলেজ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করেছিলেন, তার সংস্থান আমার ছিল। সুতরাং নোটিশবোর্ড দেখে দাঁড়িয়ে পড়া গেল লাইনে। এক সময় হাতে এল ফর্ম আর তা জমাও হয়ে গেল যথাসময়ে অন্য একদিন । এখানে একটা পুরোনো কথা না বলে পারছি না। যে সময়ের কথা বলছি, তখন ফটোকপি বা চলিত কথায় ‘জেরক্স’ সেইভাবে ঢালাও চালু হয়নি। ফলে নানা জায়গায় ভর্তির ফর্ম জমা দেওয়ার সময় সঙ্গে দিতে হত পরীক্ষার মার্কশিট বা অ্যাডমিট কার্ডের হাতে লেখা কপি যাকে বলা হত ‘ট্রু কপি’। পাড়ার বইখাতার দোকানে তার ফাঁকা ছাপা ফর্ম কিনতে পাওয়া যেত, সেটা নিজেরা পূরণ করে প্রত্যয়িত করে নিতে হত কোনো পদস্থ আধিকারিক বা স্কুলের হেডমাস্টার মশাইকে দিয়ে। কলেজে ভর্তির আগে এরকম গুচ্ছ গুচ্ছ ‘ট্রু কপি’ সঞ্চয় করে রাখতে হয়েছিল আমাদের —- কখন কোথায় কোনটা কাজে লেগে যায়।
অবশেষে এল প্রেসিডেন্সি কলেজে অ্যাডমিশন টেস্টের দিন। হাতে বেশ সময় নিয়ে পৌছাতে হবে কলেজে। ট্রামের ধীরগতির ওপর সেদিন আর ভরসা করা চলে না। সুতরাং বাস। তখন হাওড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে দুটি বাস ৪৪ ও ৪৪/এ প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর ছাড়ত —- যাদের প্রথমটির গন্তব্য বাগুইহাটি, অন্যটি সল্টলেক। দুটোই যেত মহাত্মা গান্ধী রোড, কলেজ স্ট্রিট হয়ে। বাবা বলে দিয়েছিল, দুটোই কিন্তু পকেটমারের বাস-রুট, যেন সাবধানে যাই। সত্যি বলতে পকেটে তখন মার যাওয়ার মতো তেমন কিছু থাকত না। আর আজকের হিসেবে দেখলে তখন হাওড়া স্টেশন থেকে কলেজ স্ট্রিট অবধি পাবলিক বাসের ভাড়া ছিল পঁয়তাল্লিশ পয়সা। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে গেলে চল্লিশ পয়সা। একটাকায় যাতায়াত হয়ে যায়। মনে আছে আরও একজন বন্ধু আর একজন বান্ধবী এবং তার মা অন্য বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য আমার সহযাত্রী ছিল সেদিন।
পরীক্ষার হল মানে প্রেসিডেন্সির বিরাট ক্লাসরুম, নিচে থেকে ওপর পর্যন্ত গ্যালারি করা। লম্বা রড লাগানো পাখা, চওড়া জানলা। এই দেওয়াল থেকে ওই দেওয়াল জোড়া ব্ল্যাকবোর্ড। এমন ক্লাসরুম আমার ইতিপূর্বে দেখা ছিল না। পরীক্ষা দিতে দিতে বুঝলাম আমি বোধহয় ইতিহাসের সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছি। এর পরের জীবনে আরও বেশ কয়েকবার প্রেসিডেন্সি কলেজের হলে পরীক্ষায় বসতে হয়েছে নানা প্রয়োজনে। কিন্তু সেদিনের সেই উত্তেজনা আসলে শহরতলির মলিন স্কুল থেকে আসা ছাত্র হিসেবে বিস্ময়ের সঙ্গেও যেন জুড়ে একাকার হয়ে গিয়েছিল। এই ঘটনার প্রায় সমকালে বাংলায় হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও- র জীবন নিয়ে উৎপল দত্ত ‘ঝড়’ নামে একটি ছবি করেছিলেন, বাবার সক্রিয় উৎসাহে সিনেমা হলে গিয়ে সেই ছবি দেখার সুযোগ হয়েছিল — সেই ছবিতে যেসব দৃশ্য ছিল তার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে যেন বুঝতে চাইছিলাম সেদিনের প্রেসিডেন্সি কলেজকে।
যেহেতু এই আখ্যানের কেন্দ্রে আছে কলেজ স্ট্রিট তাই এই কলেজে ভর্তির পর্বে আরেকটা ঘটনার কথাও না বললে নয়। সেই বছর বিদ্যাসাগর কলেজে স্নাতক স্তরে ভর্তি হচ্ছিল নম্বরের ভিত্তিতে। সেখানে যেদিন ফর্ম তুলতে যাই, দেখা যায় প্রার্থীদের ফর্ম নেওয়ার লাইন দোতলা থেকে একতলা ছাড়িয়ে রাস্তা অবধি নেমে এসেছে। এমনিতেই বিদ্যাসাগর কলেজের ঢোকার পথ খুব সঙ্কীর্ণ, ফলে ভিড়ে ভিড়ে একটা মাখামাখি অবস্থা। এই লাইন নিয়ন্ত্রণ করছেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা-নেত্রী কর্মীরা। আশির দশকে কলকাতার বেশিরভাগ কলেজের ছাত্র সংসদ এস এফ আই এর দখলে, আর অল্প কিছু জায়গায় ছিল সি পি বা ছাত্র পরিষদ। মফসসল থেকে আগত পড়ুয়াদের সঙ্গে নানাভাবে আলাপ-পরিচয় করছিলেন তাঁরা। আমার স্মরণে আছে যখন গুমোট গরমে লাইনে দাঁড়িয়ে আমি ফর্ম নেওয়ার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছি তখন আমাদের সঙ্গেও পরিচিত হতে এসেছিলেন কিছু তরুণী, সম্ভবত তাঁরা তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। একজনের নাম ছিল দোলন , সম্ভবত তিনি ছিলেন ওই ছাত্রীদলের নেতৃস্থানীয়, আপাতবিচারে একটু ‘ডাকাবুকো’ কিংবা আজকের পরিভাষায় ‘আপরাইট’ । সেই তরুণী আমায় জিজ্ঞাসা করছিলেন আমি কীরকম নম্বর পেয়েছি, কোন কোন বিষয়ে আবেদন করব, কোথায় থাকি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার আশঙ্কা ছিল, আমার ভাঁড়ারে যেটুকু নম্বর তা দিয়ে পদার্থবিদ্যায় ভর্তি হওয়া যাবে তো ! তাদের কথায় যে খুব ভরসার সুর ছিল এমন নয়, কারণ তারাই বা জানবেন কী করে সেই বছরে কেমন রেজাল্ট হয়েছে — ব্যাপারটা আগাম অনুমানের বিষয় নয়। এখানে আরেকটা কথা না বলে পারছি না। সেটা হল, আশির দশকে কলেজপড়ুয়া ছাত্রীরা মূলত শাড়িই পরতেন, কচিৎ কদাচিত কেউ কেউ চুড়িদার। আজ যা প্রায় এক বিরল দৃশ্য। পরিবর্তনের হিসেব নিলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ছাত্রীদের পোশাকে একটা বিরাট ‘বিপ্লব’ ঘটে গেছে গত চার দশকে। চুড়িদার পোশাকটি নিয়ে একদা এই রঙ্গভরা বঙ্গদেশে প্রচুর অনাবশ্যক বিতর্ক হয়েছে। আশুতোষ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ শুভঙ্কর চক্রবর্তী মশাই ( পরে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) এই চুড়িদার পোশাক পরা নিয়ে একসময় তাঁর কলেজে ফরমান চালু করেছিলেন যা নিয়ে প্রভূত জলঘোলা হয়েছিল সংগত কারণেই। রুচি ও শালীনতার প্রশ্নে এবং রাস্তায় ঘাটে চলাফেরার সুবিধের দিক থেকে এই পোশাকের বিকল্প নেই। তাছাড়া সংখ্যালঘু মুসলমান বা শিখ সম্প্রদায়ের মহিলারা খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই পোশাক ব্যবহার করে আসছেন সুদীর্ঘ কাল ধরে। কাজেই কসমোপলিটান শহরে বা একটি সেকুলার রাজ্যে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের পোশাককেই কেন একমাত্র পরিধেয় করা হবে, এই প্রশ্ন ওঠা সংগত । কিছুকাল পরে স্কুল শিক্ষিকারা চুড়িদার পরে স্কুলে যাওয়া নিয়েও নানা অবাঞ্ছিত বিতর্ক তৈরি হয়, কোনো কোনো শুচিবায়ুগ্রস্ত প্রধান শিক্ষিকা এক্ষেত্রে ‘বড়পিসিমা’ সুলভ ভূমিকা নিয়ে বিষয়টিকে আরো জটিল করে তোলেন। আসলে এই পুরো ব্যাপারটাই ‘বোগাস’। কে কী পরে স্কুলে যাবে বা কলেজে যাবে তা একান্তই তাঁর নিজস্ব রুচি ও পছন্দের বিষয়, এই বিষয়ে দ্বিতীয় কারোর নাক বা অন্য কোনো প্রত্যঙ্গ গলানো একেবারেই উচিত নয়। অবশ্য আজকাল তরুণীরা ওইসব বিতর্ক তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে যে যার পছন্দমতো পোশাক পরছেন, এটা খুব আনন্দের কথা । এখন চুড়িদার পোশাকটিও ‘সেকেলে’ হয়ে গিয়ে উঠে এসেছে কুর্তি, জিন্স, লেগিংস, টি শার্ট বা একেবারে ফরমাল ট্রাউজার ও শার্ট। তরুণী-যুবতী এমনকি চল্লিশ পেরোনো মহিলারাও দিব্যি এসব পোশাক পরছেন —-- এতে সমাজ ‘রসাতলে গেছে’ বা শিক্ষার মানের কোনো হেরফের হয়েছে বলে আমি মনে করি না। শুধু এই স্মৃতিযাপনের সূত্রে একটা বিবর্তনের স্মারকচিহ্ন ছুঁয়ে থাকাই আমার উদ্দেশ্য। সেদিনের ঝকঝকে তরুণী দোলনের সেই শাড়ি পরা চেহারাটাই আজও আমার মনে আবছা হয়ে জেগে আছে। আজ এত বছর পরে সেই তরুণী হয়তো সিনিয়র সিটিজেনের চৌকাঠে ঢুকব ঢুকব করছেন! পরবর্তী জীবনে বিদ্যাসাগর কলেজে অনেকবার গিয়েছি। ওই কলেজের ইংরিজি বিভাগের এক অধ্যাপকের সঙ্গে সখ্যের সূত্রে কলেজের টিচার্স রুমে গিয়ে তাঁর সঙ্গে আড্ডা জমিয়েছি অনেকবার। কলেজের বিপরীত দিকে ‘বীণা’ সিনেমা হলের পাশে একটি প্রাচীন মিষ্টির দোকানের নড়বড়ে কাঠের টেবিল চেয়ারে বসে কচুরি জিলিপি বা রসোগোল্লা খাওয়া চলেছে সেই আড্ডারই সূত্রে। তবু ওই কলেজের সামনে দিয়ে আজও যখন যাই সেই প্রথম দিনের স্মৃতি মনে ঘাই দিয়ে ওঠে। যদিও ওই কলেজে আমি কখনো পড়িনি। আর একই সঙ্গে আজকে বন্ধ হয়ে যাওয়া ঐতিহ্যশালী ‘বীণা’ সিনেমার মলিন বাড়িটার দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে এই প্রেক্ষাগৃহেই প্রথম মুক্তি পেয়েছিল ‘পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫) —-- বাঙালির সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সেও তো এক সন্ধিক্ষণ ।
কলেজে ভর্তির প্রসঙ্গে একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। বিগত একদশক তো বটেই, তার কিছু আগেও কলেজে কলেজে ছাত্র সংসদে মূলত শাসকদলের ছাত্র সংগঠন যেভাবে ছাত্রছাত্রী ভর্তির প্রক্রিয়াকে ক্রমশ একধরনের ‘মাতব্বরি’ থেকে পরিণামে একটা লাভজনক ব্যাবসার পর্যায়ে নামিয়ে এনে পুরো বিষয়টার মধ্যে প্রায় একরকম ‘মাফিয়াবাজি’র মডেল খাড়া করেছে, চার দশক আগের কলকাতায় এই পরিস্থিতি আমরা দেখিনি। আজকে যে পরিস্থিতির সামনে কলেজ প্রশাসন কার্যত অসহায়, যার প্রতিরোধে সরকারকে পর্যন্ত বারবার অনলাইন ব্যবস্থা চালু করার কথা ভাবতে হচ্ছে এবং সিদ্ধান্ত নিয়েও আবার পিছিয়ে আসতে হচ্ছে, তা আমাদের সময়ে ছিল দুঃস্বপ্নেরও বাইরে । এখানে একটু ইতিহাসের সূত্র ধরে বলে রাখতে চাই, পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটির শিক্ষাক্ষেত্রে এই ধরনের শাসকদলের ছাত্র যুবদের ‘গা-জোয়ারি’-র ‘শুভ’ সূচনা হয় ১৯৭২ সালের পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের অভিভাবকত্বে। এই বিষয়ে বিদগ্ধ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক অমল কুমার মুখোপাধ্যায় (যিনি রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক হিসেবেই পরিচিত) লিখছেন : ‘সারা রাজ্যে যে সন্ত্রাস আর বিশৃঙ্খলা নিয়ে এসেছিল নকশালপন্থীরা, কংগ্রেসি শাসনকালে তা চলতেই থাকে। পাড়ায় পাড়ায় কংগ্রেস যুব বাহিনীর ঔদ্ধত্যে ও দাপটে সাধারণ মানুষের হয়রানি হতে থাকে আর শিক্ষাক্ষেত্রে নকশালদের ‘মহাজনপন্থা’ অনুসরণ করে আমদানি করা হয় চরম অরাজকতা। বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থায় অবিশ্বাসী নকশালরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পবিত্রতা নষ্ট করেছিল। বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থায় আস্থাশীল হয়েও কিন্তু কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠন নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বার্থে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কর্তৃপক্ষের ওপর অশালীন ভাবে ভয় দেখিয়ে ছড়ি ঘোরাতে থাকে। একই সঙ্গে ছাত্রমহলে সুলভে সমর্থন ও জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য পরীক্ষা ব্যবস্থার সমস্ত পবিত্রতা ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে চালু করা হয় গণ টোকাটুকি। এর ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে কংগ্রেসি ছাত্র সংগঠন দ্রুত দখল নিতে সক্ষম হয় বটে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটাই প্রহসনে পরিণত হয় ( বাঙালি রাজনীতির পঞ্চাশ বছর )।’ সত্যজিৎ রায়ের ‘জন অরণ্য’ ছবির (১৯৭৬) প্রথম দৃশ্যটা দেখলেই অনুমান করা যায় সেই সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থার একটা প্রতিনিধিস্থানীয় চিত্র।
এর পরের পর্বে বামফ্রন্ট শাসনে (১৯৭৭ পরবর্তী সময়ে) এই পরিস্থিতির অবশ্যই উন্নতি দেখতে পাওয়া যায়, কার্যত তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতেই শিক্ষাক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ছিল। ছাত্র সংসদগুলিতে ভোটের মাধ্যমে বাম দলের নিজস্ব ছাত্র সংগঠনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা হলেও বা ‘নিজেদের লোক’ কে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাথায় বসানোর ঘরানা বজায় থাকলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে ওই ধরনের নৈরাজ্য সেইভাবে আর ফিরে আসেনি। আশির দশকের যে সময়ের কথায় আমরা ঘোরাফেরা করছি সেটা দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকারের আমল। এই সময়কালে কলেজে ভর্তি নিয়ে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু সেটা ঘিরে গুরুতর কোনো দুর্নীতি বা দাদাগিরির অভিযোগ ওঠেনি। এই বিচ্যুতিগুলো আসতে থাকে বামফ্রন্টের শেষ দশবছরের শাসনে, আমরা তখন শিক্ষাক্ষেত্র থেকে বিদায় নিয়েছি। আমাদের কলেজ ভর্তির সময়কালে কলকাতার বেশ কিছু কলেজে আমাকেও বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স স্তরে ভর্তির ফর্ম ভরতে হয়েছিল। কোথাও সুযোগ পেয়েছি, কোথাও পাইনি। কিন্তু কোথাও সিট পাইয়ে দেওয়ার নামে কেউ আর্থিক উৎকোচ দাবি করেছে বলে আমার অভিজ্ঞতায় নেই। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে অবশ্য কোনো ছাত্র সংসদ ছিল না। মৌলানা আজাদ কলেজে সংসদ থাকলেও তাদের কোনো বিশেষ মাতব্বরি খেয়াল করিনি। স্কটিশ চার্চ কলেজে ছাত্র পরিষদের দাপট ছিল। বিদ্যাসাগর কলেজে পদার্থবিদ্যার প্রথম লিস্টে আমার নাম ছিল না। সেটা যেদিন দেখতে গিয়ে কিছুটা নিরাশ হয়েছিলাম, সেদিনও আবার দেখা হয়েছিল সেই নেত্রী দোলনের সঙ্গে —- সে বলেছিল, থার্ড লিস্ট অবধি বেরোবে, অপেক্ষা করো। সত্যিই তৃতীয় দফার লিস্টে আমার নাম ছিল। কিন্তু ততদিনে প্রেসিডেন্সি কলেজের অ্যাডমিশন টেস্টের ফল প্রকাশ হয়ে গিয়েছে।
কলেজের একতলায় সেই চওড়া ঐতিহাসিক বারান্দায় নোটিশ বোর্ড। জালের মধ্যে আটকানো টাইপ করা নামের তালিকা। বারান্দায় কৌতুহলী পড়ুয়াদের ভিড়। সেই জমায়েত ঠেলে পৌছানো গেল নোটিশ বোর্ডের সামনে। আসলে এটা কয়েকটি বিষয়ের সেকেন্ড বা থার্ড লিস্ট বেরোনোর দিন। ফার্স্ট লিস্টে যে আমার নাম আসেনি তা দেখে গিয়েছিলাম আগেই। এর পরে সেকেন্ড ও থার্ড লিস্ট বেরোবে তাই আজকেও না এসে উপায় নেই। আসলে এই পরপর লিস্টের ব্যাপারে একটা হিসেব ছিল। কিছু ছাত্র/ছাত্রী যারা সেই সময় জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিত, তাদের ওই পরীক্ষার ফল বেরোনোর আগেই উচ্চ মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়ে যেত, ফলে তারা বিভিন্ন কলেজে পরীক্ষা দিয়ে বা না-দিয়ে (মেধার ভিত্তিতে) সেইসব কলেজে ভর্তি হয়ে যেত। জয়েন্টের ফল বেরোলে তারা অনেকেই চলে যেত মেডিক্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ফলে কলেজের শূন্যস্থানে দ্বিতীয় বা তৃতীয় লিস্টের নাম উঠে আসত। এখন অবশ্য জয়েন্টের রেজাল্ট উচ্চমাধ্যমিকের আগে বেরিয়ে যায় ফলে এই সিট আটকে রাখার বিষয়টা অনেকটাই কমে গেছে। যাই হোক প্রেসিডেন্সির বারান্দায় পরপর আটকানো বিষয়ভিত্তিক সফল প্রার্থীদের নামের তালিকা খুঁজতে খুঁজতে এক সময় খুঁজে পেলাম নিজের নাম। যে দুই বিভাগে পরীক্ষা দিয়েছিলাম তার একটায় আমার নাম উঠেছে। আজকের দিন হলে হয়তো সঙ্গে সঙ্গে আমার মতন কেউ সেলফোন থেকে বাড়িতে খবর দিয়ে দিত বা হয়তো নোটিশ বোর্ডের ছবি তুলে কিংবা নোটিশ বোর্ডে আটকানো নামের তালিকার সামনে ‘সেলফি’ তুলে শেয়ার করে দিত সোশ্যাল মিডিয়ায়, কতগুলো ‘লাইক’ আর বুড়ো আঙুলের ইমোজি পাওয়া যায় তা গুণবার প্রত্যাশায় —-- কিন্তু সেই মান্ধাতার আমলে এসব প্রকাশের কোনও মাধ্যম ছিল না। ফলে নিজের ভাল লাগা আর উত্তেজনা নিজের মধ্যেই আগলে রাখা ছাড়া ভিন্ন কোনো উপায় ছিল না। তাহলে আমিও প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হতে পারব এইবার ? কখন বাড়িতে পৌঁছে এই খবর দিতে পারব আমি বাবা-মা-কে ?
প্রেসিডেন্সির বারান্দা ছেড়ে নামতেই দুজন তরুণী এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমায় জিজ্ঞাসা করলেন আমার নাম কী, কোথায় থাকি, কোন স্কুল থেকে পাশ করেছি। কিছু না-ভেবেই বোকার মতো সব তাদের বলে দিলাম। প্রথমে মনে হয়েছিল, এরা বোধহয় কলেজেরই পড়ুয়া । অবশেষে তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিলেন। দুজনেই ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার সাংবাদিক। কলেজে কলেজে তাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন কলকাতার কলেজগুলির অ্যাডমিশন পরিস্থিতি নিয়ে তাঁরা একটা ফিচার করবেন কাগজে। তাই আমার মতো আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা বুঝতে চাইছেন অবস্থাটা। আজকের পরিভাষায়, তাদের ‘বাইট’ দিলাম আমি — যদিও ঘাড়ে ধরা ক্যামেরা বা মুখের সামনে বাগিয়ে ধরা ‘বুম’ এসব তখন আবিষ্কারই হয়নি। তবে ‘প্রিন্ট মিডিয়া’র সামনে বিশেষত শহরতলি থেকে আসা স্কুলের পড়ুয়ারা যে ভর্তির ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাকফুটে এইটুকু খবর আমি তাদের দিতে পেরেছিলাম। আমার অবস্থান থেকে সেটুকুই ছিল আমার অভিজ্ঞতা-নিংড়ানো উপলব্ধি। এর তিনদিন বাদে ‘টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় প্রকাশ হল সেই প্রতিবেদন। ইংরিজি অক্ষরে নিজের নাম, স্কুলের নাম ও আমার বক্তব্যের চুম্বক ছাপা হয়েছে সেখানে —- এও এক নতুন অভিজ্ঞতা আমার কাছে। আর এই অভিজ্ঞতার শরিক হতে পারলাম কলেজ স্ট্রিটের আবহেই। তাই এই আখ্যানে সেটুকু উল্লেখ না করে আমার উপায় নেই। পুরোনো স্মৃতির মতো সেই খবরের কাগজের কপিটাও আমার সংগ্রহে বহুদিন আগলে রাখা ছিল। এখন সেই ‘হার্ড কপি’ আর খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। প্রায় চল্লিশ বছর তো হতে চলল।
এবারের কলেজ স্ট্রিট পর্ব শেষ করব দুটো খবর দিয়ে। প্রথমত নিয়মিত কলেজ স্ট্রিট তথা প্রেসিডেন্সি কলেজে যাতায়াতের সূত্রে আমার চোখ পড়েছিল প্রেসিডেন্সির বাউন্ডারি বরাবর প্রাচীরে পুরোনো বইয়ের স্টলগুলি । কলেজ স্ট্রিটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এই পুরোনো বইওয়ালারা পুরোমাত্রায় অঙ্গীভূত। সুকুমার সেন, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত (সাঁটুলবাবু), ইন্দ্রনাথ মজুমদার (সুবর্ণরেখা) প্রমুখ কিংবদন্তীরা এই পুরোনো বইয়ের দোকানে ঘুরে ঘুরে মণিমাণিক্য সংগ্রহ করতেন । এই পুরোনো বই-এর দোকান বিষয়ে আমারও কিছু প্রতিক্রিয়া আছে তা জানাব অন্য কোনো পর্বে। আর দ্বিতীয় খবরটা হল, নাম প্রকাশিত ও ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে আর আমার পড়া হয়ে ওঠেনি। তার কারণ এই আখ্যানে প্রাসঙ্গিক নয়।
(ক্রমশঃ)
পরের পর্ব প্রকাশিত হবে ২৭ ফেব্রুয়ারি