কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি
প্রবুদ্ধ বাগচী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পর্ব ৫
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকস্তরে ভর্তি হওয়া আমার মতন মফসসলী ছেলের পক্ষে ছিল ‘চৌবাচ্চার তেলাপিয়ার সাগরে এসে পড়ার মতো’ ঘটনা (ঋণ - নবারুণ ভট্টাচার্য) । অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার বাইরেও বিরাট একটা সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় যেন আমার চোখ খুলে দিতে লাগল দিনে দিনে। পাঠ্য বিষয়ের বাইরে নাটক-কবিতা-ফিল্ম আর রাজনৈতিক দর্শনের চর্চা প্রতিটি পরতে পরতে আমায় সমৃদ্ধ হওয়ায় উপাদান জোগাতে থাকে। কিন্তু যাদবপুর থেকে কলেজ স্ট্রিটের দূরত্ব অনেক হলেও এই পর্বেও কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে আমার যোগ ছিন্ন তো হয়ইনি, বরং আরও নানা বিভঙ্গে তা ধরা দিয়েছে আমার প্রথম যৌবনের দিনগুলিতে।
অ্যাকাডেমিক সূত্রে টেক্সট বুকের দরকার সব সময়েই থাকে, আর, তার হদিশ পেতে গেলে আসতেই হবে কলেজ স্ট্রিটে। সেই যাতায়াতে যে সেই সময় কোনো ভাঁটা পড়েছে এমন নয়। যাদবপুরে কোনও ক্লাস বাতিল হলে বাড়ি ফেরার পথে ছুঁয়ে যেতে হয়েছে কলেজ স্ট্রিটের আনাচ-কানাচ। আর শনিবার ছিল হাফছুটির দিন, বেলা একটা চল্লিশে ক্লাস শেষ, তারপর বিশ্ব জয় করার জন্য হাতে প্রচুর সময় বাড়তি। তাই সেদিন বেশ অনেকটা সময় নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ানো যেত কলেজ স্ট্রিটে। পাঠ্যবইয়ের মধ্যে তখন মূল সমস্যা ছিল কম্পিউটার-বিজ্ঞানের বই নিয়ে। আজ থেকে চার দশক আগে সারা রাজ্যের মধ্যে একমাত্র যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরেই কম্পিউটার-বিজ্ঞান বিষয় হিসেবে পড়ানো হত। মুষ্টিমেয় পড়ুয়া তাদের প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে বিষয় হিসেবে তা বেছে নেওয়ার সুযোগ পেত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীন রিজিওনাল কম্পিউটার সেন্টার ( আর সি সি) তে ছিল সেই যুগের দানবাকৃতি যন্ত্রগণক , যা বসাতে একেকটা বড় ঘরের প্রয়োজন হত। পাঞ্চিং কার্ড ব্যবস্থায় তাতে প্রোগ্রাম চালাতে হত —- আজ সকলের মনে আছে কি না জানি না, তবে এই ব্যবহৃত পাঞ্চিং কার্ড দিয়ে সেই সময়ে তার পেছনে ছাপা হত প্রাইভেট বাসের টিকিট। নব্বই দশকের গোড়ায় জীবনবীমা নিগমের ডাটা প্রসেসিং সেন্টারেও এই পাঞ্চকার্ডের ভাষা পড়বার ‘কার্ড রিডার’ মেশিন আমি দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ যারা রিজিওনাল কম্পিউটার সেন্টারের কম্পিউটার ব্যবহার করবেন তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল একটা কোড। যদি খুব ভুল না- করি, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের জন্য কোড ছিল জে ইউ ম্যাথ সি কে এস —- এই আখ্যান যদি আমাদের যাদবপুরের সহপাঠীদের কারোর চোখে পড়ে, তাদের যদি মনে হয় কোড আমি ভুল বললাম, অনুগ্রহ করে সংশোধন করে দেবেন। মাইক্রোসফট এর ‘উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম’ তখন এইদেশে আগামী ভবিষ্যতের অনেক গভীরে, টেবিলে বসানো ছিমছাম পি সি বা পারসোন্যাল কম্পিউটার-এর কথা তখন কেউ স্বপ্নেও ভেবে উঠতে পারত না, ল্যাপটপের তো কথাই নেই । অবশ্য মার্কিন দেশের বিখ্যাত ‘টাইম’ পত্রিকা প্রতি বছর যে ‘ম্যান অফ দি ইয়ার’ পুরস্কার ঘোষণা করেন তাদের বিচারে ১৯৮২ সালেই সেই পুরস্কার পায় ‘ পারসোন্যাল কম্পিউটার’ —-- প্রকৃতির বিচারে ‘মানুষ’ না হয়েও ‘ম্যান অফ দি ইয়ার’ হিসেবে ‘ পারসোন্যাল কম্পিউটার’ এর এই স্বীকৃতি হয়তো বুঝিয়ে দেয় ‘টাইম’ কর্তৃপক্ষের দূরদর্শিতার কথাই। প্রসঙ্গত বলা ভালো, এরাই কিন্তু ১৯৯৭- সালে ‘ম্যান অফ দি ইয়ার’ হিসেবে নির্বাচিত করেন ‘ইন্টেল কর্পোরেশন’ এর সি ই ও অ্যান্ড্রু গ্রোভ-কে, ২০১০-এ এই পুরস্কার পান ‘ফেসবুক’ এর প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকেরবার্গ। আগামী দিন যে কম্পিউটার ব্যবস্থা আমাদের জীবনযাপনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠবে, এইসব সিদ্ধান্তগুলি আসলে তার সূচক।
যাই হোক, আবার পুরোনো কথায় ফিরি। সেই আমলের কম্পিউটারের ভাষা ছিল বেসিক, কোবোল, পাস্কাল, ফরট্রান ইত্যাদি —- যাদবপুরের ক্লাসে আমাদের এইসবই পড়ানো হত । আমাদের কম্পিউটার বিজ্ঞানের প্রিয় শিক্ষক যিনি ছিলেন তিনি ওই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেক খ্যাত গণিতের অধ্যাপকের অনুজ। যদিও ওই সময়কালে তার অগ্রজ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে মূলত তৎকালীন কেন্দ্রের শাসকদল কংগ্রেসের সঙ্গে কিছুটা রাজনৈতিক যোগাযোগের সুবাদে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে চলে গেছেন। তিনি আজ আর জীবিত নেই, তাই তাঁর নাম উল্লেখ করা সমীচীন নয় —- কিন্তু দুর্ভাগ্যের কথা বিশ্বভারতীর উপাচার্য থাকাকালীন তিনি নানা ধরনের আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং পরে সেই সূত্রেই গ্রেফতার হয়ে দীর্ঘকাল কারাবাস করেন। রাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ( কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হলেও বিশ্বভারতী ঘিরে বাঙালির আবেগ অন্যরকম) উপাচার্যের এই বিপথগামিতা সেদিনের পক্ষে ছিল বড় মাপের ‘শকিং’ । আজ এই মুহূর্তে রাজ্যের এক উপাচার্য যখন দুর্নীতির সূত্রে কারান্তরালে রয়েছেন, তখন এই পুরোন স্মৃতিটুকু উল্লেখ না-করে উপায় নেই। পাশাপাশি এই কথাও বলা দরকার, সুদীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনে শিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কিছু কিছু অভিযোগ উঠলেও কোনো উপাচার্যকে সোজাসুজি আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে কারাবাস করতে হয়েছে এমন কখনো আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখিনি। আবার মূল প্রসঙ্গে ফিরি। ক্লাসে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং -এ যেসব বই অনুসরণ করা হত সেই সবের বই সাধারণভাবে খুব ঢালাওভাবে পাওয়া যেত না। ফলে বই খুঁজতে আসতে হত সেই কলেজ স্ট্রিটেই।
কম্পিউটার বিজ্ঞানের ‘বেসিক’ ল্যাঙ্গুয়েজ এর সবচেয়ে ভাল যে বই তার লেখক হলেন গডফ্রেড। বিদেশি লেখক, বিদেশি প্রকাশন, দামও তুলনায় বেশ বেশি। তবে টাটা গোষ্ঠীর প্রকাশন সংস্থা ‘টাটা - ম্যাকগ্রোহিল’ তখন এদেশে এই বইগুলি বিপণন করতেন। কার্যত তখন কম্পিউটার বিষয়ে ভারতীয় লেখকদের বই বিশেষ পাওয়াই যেত না। এইসব বই খুঁজতে গিয়ে টের পেলাম কলেজ স্ট্রিটের ওই পথের ধারের বইয়ের গুমটিগুলি এই ধরনের বিদেশি প্রকাশনের বই রাখেন না। হয় নামী দোকান থেকে নামমাত্র কমিশনে তা কিনতে হবে না হলে খুঁজে দেখতে হবে অন্যত্র । এই অন্য জায়গা খুঁজে বার করতে করতেই নজরে এল হিন্দু স্কুলের প্রাচীর ঘেঁসে ফুটপাথে যে সব বইয়ের স্টল এগিয়ে এসেছে গোলদিঘীর ধার বরাবর সেই সূর্য সেন স্ট্রিটের মোড় অবধি— সেখানে মূলত মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার বিভিন্ন বিষয়ের বইয়ের পশরা হলেও , কম্পিউটারের বইও সেখানে পাওয়া যায়। অবশেষে কেনা হল সেই ‘বেসিক’ এর বই — এটা দিয়েই শুরু। ‘গডফ্রেড’ বিরচিত ‘বেসিক প্রোগ্রামিং’ এর বইটি হস্তগত হওয়ার পরে কিছুটা অবাক হয়েই ‘আবিষ্কার’ করি, ক্লাসে যে ম্যাডাম আমাদের ‘বেসিক প্রোগ্রামিং’ পড়াতেন তাঁর দেওয়া ‘নোট’ এর সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে এই বইয়ের পাতা ! মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন । পরে নানা সময় অন্য অনেক বইই কিনতে হয়েছে ওইসব দোকান থেকে। কিন্তু একটা ঘটনার কথা না বলে পারছি না। কম্পিউটার বিজ্ঞানে ছিল মূলত দু ধরনের বিষয় —- সফটওয়ার ও হার্ডওয়ার। আজ এই শব্দদুটো প্রাইমারি স্কুলের পড়ুয়ারাও জানে। সফটওয়ারের মধ্যে থাকত ওই কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজগুলি, অর্থাৎ যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী কম্পিউটারকে নানা নির্দেশ দিয়ে প্রোগ্রাম তৈরি করবেন ও চালাবেন । এরই অনুষঙ্গে আসে ‘অ্যালগরিদম’ বা ‘ফ্লো-চার্ট’ ইত্যাদি টেকনিক্যাল শব্দ, যাদের সঙ্গে আমাদের হাতেখড়ি হচ্ছিল এই সূত্রেই। অন্যপক্ষে, হার্ডওয়ার মানে ওই কম্পিউটার যন্ত্রটির বিভিন্ন অংশ কীভাবে কাজ করে তার বিষয়ক চর্চা। আগেই বলেছি, আজকে যেমন টেবিলের ওপর বসানো পি সি র ক্ষেত্রে নিচে একটা সি পি ইউ ( সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট) থাকে, তার ঢাকনা খুললেই দেখা যায় মাদার বোর্ড, প্রসেসর, র্যাম ( র্যান্ডম অ্যাক্সেস মেমরি) বা হার্ড ডিস্ক মেমরি বা ডিভিডি ড্রাইভ —- বিশালাকার কম্পিউটারের এইসব খুটিনাটি ওইভাবে হাতে-কলমে দেখার সুযোগ ছিল না। তাছাড়া আজকে যে প্রযুক্তিতে এগুলি চলে তখন তার প্রযুক্তিও ছিল ভিন্নরকম। আজকে কম্পিউটারে যেমন হার্ড ডিস্ক ড্রাইভ ব্যবহার করা হয় যা আকারে ছোট, কিন্তু সেই সময়ে বিশালাকার ম্যাগনেটিক হার্ড ডিস্ক ব্যবহার হত। ইদানিং সলিড স্টেট প্রযুক্তির হার্ড ডিস্কও বাজারে এসে গেছে, যার পোশাকী নাম এস এস ডি —- সেসবের কোনো প্রশ্ন তখন ছিল না। যিনি ক্লাসে কম্পিউটার-এর হার্ডওয়ার সংক্রান্ত অংশ পড়াতেন হার্ডওয়ার সঙ্ক্রান্ত একটা খুব ভাল বইয়ের কথা তিনি বলেছিলেন টমাস বার্টি-র লেখা ‘ডিজিটাল কম্পিউটার ফান্ডামেন্টাল’। ক্লাসের নোট পড়লেও মূল বইটি পড়ে দেখার ইচ্ছে ছিল। সেই উদ্দেশেই এক শনিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরার পথে কলেজ স্ট্রিটে নেমে শুরু হল সেই বইয়ের খোঁজ। বেশ কয়েকটা স্টল ঘুরে পেয়েও গেলাম সেটা। বেশ দামি ঝকঝকে বই, তখনই তার দাম লেগেছিল দুশো টাকার কাছাকাছি —- প্রায় চার দশক আগে দুশো টাকা বেশ একটা বড় ব্যাপার। আমাদের পরিবার খুব বিত্তশালী ছিল এমন মোটেও নয়, বাড়ির একমাত্র চাকুরে বাবা, বাসাবাড়িতে বসত। কিন্তু পড়াশোনার প্রয়োজনে কোনো খরচের বিষয়ে পরিবার থেকে কোনো আপত্তি কখনো তোলা হয়নি, তাই দাম যাই হোক বই কিনতে কোনো অসুবিধে হয়নি। তবে বাড়ি এসে সেই বই উলটে পাল্টে দেখে বুঝতেই পারছিলাম না এই বই আমার এখনকার সিলেবাসে কীভাবে কতটুকু কাজে লাগতে পারে । পড়ার বিষয়ের সঙ্গে তো অনেক কিছুই মিলছে না ! অগত্যা স্যারের কাছে দেখালাম সেই বই। তখনই বুঝলাম, একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। এই একই নামের ও একই লেখকের অন্য একটা বই আছে, শুধু সিলেবাসের লেভেলটা কিছু আলাদা। এখানে ‘লেভেল’ কথাটা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার। সেই আমলে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কয়েকটি লেভেলের ধারনা এনেছিলেন —- যার শুরু ‘জিরো’ লেভেল, এর পরে ‘ এ’ লেভেল, ‘এ প্লাস’ লেভেল ইত্যাদি । প্রতিটা লেভেলে কী ধরনের বিষয় শেখানো হবে তা ঠিক করা ছিল। লেভেল নিয়ে এই গোলযোগেই ঘটনাটা ঘটে। আসলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস যে ‘লেভেল’-এ পড়ে, সেই না-কেনা বইটার কথাই বলেছিলেন আমার শিক্ষক। অতঃ কিম ? ফিরতি পথে আবার আসতে হল কলেজ স্ট্রিট। সেই স্টলে গিয়ে বললাম সব কিছু, বইটা পাল্টে দিতে অনুরোধ জানালাম। কিন্তু খবর নিয়ে জানা গেল ওই বইটি এখন ছাপা নেই। তাই বলে কেনা বইয়ের দাম ফেরত হবে না, কারণ ভুলটা আমার। সেই ন যযৌ ন তস্থৌ অবস্থা থেকে উদ্ধার করলেন পাশাপাশি একটা স্টলের মালিক। তার প্রস্তাব হল, আমার হাতের ওই নতুন বইটি তিনি কিনে নেবেন, কিন্তু পুরোনো বইয়ের দামে। খুব বেশি হলে তিনি তিরিশ টাকা দাম দিতে পারেন। নতুন ঝকঝকে একটুও ব্যবহার না-করা দুশো টাকা বইয়ের দাম তিরিশ টাকা ? প্রথমে একটু আপত্তি করলেও ক্রমে বুঝতে পারলাম অন্য স্টলের মালিকরাও বুঝে গেছেন আমার ব্যাপারটা। সুতরাং অনেক দরাদরি করেও চল্লিশ টাকার বেশি দাম হল না। অগত্যা রাজি না হয়ে লাভ কী? ওই বই তো আমার কোনো কাজে লাগার নয়। কিন্তু এই ঘটনায় এইটুকু বোঝা গেল যে, নতুন বই শুধু নয়, পুরোনো সেকেন্ডহ্যান্ড বইয়েরও একটা বাজার আছে কলেজ স্ট্রিটে। বলতে গেলে এই ঘটনা থেকেই আমার নজর পড়ল পুরোনো বইয়ের দোকানে।
পুরোনো বইয়ের দোকান ঠিক ঠিক শুরু হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবনের পাশের গলিতে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পোস্ট অফিসের সামনে থেকে, যার সীমানা আরো উত্তরে প্রেসিডেন্সি কলেজের পাশের গলি, ভবানী দত্ত লেনের মুখ অবধি। বেশ কিছুদিন জরিপ করে বুঝলাম, এই দোকানগুলোরও একটা চরিত্রগত রকমফের আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভবনের গেটের আশেপাশে যেসব স্টল সেখানে মূলত পাওয়া যায় বিশ্ববিদ্যালয় এর স্নাতক স্তরের বিভিন্ন বিষয়ের পুরোনো বছরগুলির প্রশ্নপত্র বা গাইড বই। কিছু কিছু প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার পুরোনো প্রশ্নপত্র বা গাইডও মেলে এখানে। তবে সাবেক কলেজ স্ট্রিটের যেসব পুরোনো বইয়ের দোকান মণি-মাণিক্যের ভান্ডার বলে পরের অধ্যায়ে শুনেছি তাদের দেখা মেলে আরেকটু আগে। মোটামুটি হেয়ার স্কুলের প্রাচীর যেখানে আরম্ভ হচ্ছে সেখান থেকে শুরু হয়ে একেবারে প্রেসিডেন্সির গেট ছাড়িয়ে ভবানী দত্ত লেনের মুখ অবধি তার বিস্তার। শুনেছি, প্রেসিডেন্সি কলেজের সব নাম-করা অধ্যাপকরা এককালে নিয়মিত এইসব দোকানে আসা যাওয়া করতেন এবং এখান থেকে বিরল সব বই কিনতেন। সত্যজিৎ রায় থেকে অমর্ত্য সেন সকলেই নাকি এই চত্বরে এলে একবার করে ঘুরে যেতেন এই সব বইয়ের দোকান, প্রখ্যাত প্রশাসক (আই সি এস) ও চিত্রকলা বিষয়ক সুপণ্ডিত অশোক মিত্র তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে পুরোনো বই কেনার কথা, একই কথা পেয়েছি অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের লেখায় । এই সূত্রেই জানতে পারি, এই চত্বরে কিছু কিছু বই-বিক্রেতা আছেন যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই পুরোন বই বিক্রির পেশাতেই থেকে গেছেন। অনেক বিশিষ্ট পড়ুয়া মানুষ বা অ্যাকাডেমিক জগতের অনেক সুখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গেও তাদের নিবিড় সখ্য, যাদের কাছে ‘দামি’ পুরোনো বইয়ের খবর পৌঁছে দেন তারা। আর ওইসব ব্যক্তিরাই তাদের মূল ক্রেতা। প্রসঙ্গের বাইরে হলেও বলি, নিউ মার্কেট এলাকার এমনই এক পুরোনো ইংরিজি বইয়ের বিক্রেতা ‘শর্মা’ র সঙ্গে মাসকাবারি ব্যবস্থা ছিল সত্যজিৎ রায়ের। সেই বই-বিক্রেতা সত্যজিতের বাড়ি গিয়ে তাঁর পছন্দের বইয়ের তালিকা নিয়ে আসতেন, আর বই জোগাড় হলে পৌঁছে দিতেন তাঁর কাছে। এমনকি, সত্যজিৎ ওই পাড়ায় গেলে দোকানের সামনে গাড়ি থামালেও তাঁর গাড়িতে বইয়ের প্যাকেট তুলে দেওয়া হত। গ্র্যান্ড হোটেলের নীচে পুরনো বইয়ের আরেক খ্যাত ক্রেতা ‘চেতনা’ নাট্যদলের নির্দেশক- অভিনেতা অরুণ মুখোপাধ্যায় —-- নিয়মিত তিনি দেশ বিদেশের নাটকের বই সংগ্রহ করতেন ওখান থেকেই। সম্প্রতি তরুণ মজুমদারের একটি সাক্ষাৎকার শুনে জানলাম, একটা সময় হলিউডের নানা ছবির চিত্রনাট্য সাইক্লোস্টাইল করে ছবির সঙ্গে আসত ‘মেট্রো’ সিনেমার কর্তৃপক্ষের কাছে —-- সেগুলি সের দরে বিক্রি হত ‘মেট্রো গলি’ তে। আজকালকার দুনিয়ায় নিছক পাঠ্য বইয়ের বাইরে ইংরিজি পুরোনো বইয়ের পাঠক নিতান্তই কমতি, তার ওপরে কোভিডের প্রকোপে সেই পুস্তক বিক্রেতা ‘শর্মা’ তাঁর এতদিনের দোকান বিক্রি করে দিয়ে নিজের দেশে ফিরে গেছেন। তুলনায় কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের দোকানগুলি এখনো টিকে আছে, যদিও তাদের চরিত্র বদলে গেছে অনেকটাই। কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো বইয়ের দোকান বিষয়ে সম্প্রতি এক নামী কবির কাছে গল্প শুনেছি শক্তি চট্টোপাধ্যায় নাকি তরুণ কবিদের তাঁকে উপহার-দেওয়া বই এখানে বেচে দিতেন, তেমন কিছু কিছু নাম-লেখা বই খুঁজে পেয়েছেন অন্যেরা। এমনকি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর কবিতার বই বন্ধু শক্তিকে নাম লিখে উপহার দিয়েছেন, সেই বইও খুঁজে পাওয়া গেছে এই পুরোনো বইয়ের ‘ঠেকে’। এই সূত্রেই জেনেছিলাম যেসব পুস্তক ব্যবসায়ী প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই পুরোনো বইয়ের ব্যবসাই করেন, তাঁরা খোঁজ রাখেন কোথায় কোন বাড়িতে পুরোনো বইয়ের সংগ্রহ বিক্রি করা হচ্ছে আর সেগুলো কিনে এনে আগ্রহী পাঠকের হাতে পৌঁছে দেন। এই খবর জেনে মনে পড়ে গিয়েছিল শংকর লিখিত ‘জনঅরণ্য’ উপন্যাসের ‘হীরালাল সাহা’ চরিত্রটাকে, যে কলকাতার ‘সাহেবিবাড়ি’ ভাঙার ব্যবসায়ে নিজেকে যুক্ত করেছিল। আর বইপাড়ার সঙ্গে যাদের দীর্ঘ যোগ, তাদের কাছে এই তথ্যও অজানা নয় প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক হিসেবে একমাত্র ‘সুবর্ণরেখা’ই পুরোনো বইয়ের কারবার করত। ব্যবসার থেকেও তার পেছনে ছিল তার কর্ণধার ইন্দ্রনাথ মজুমদারের একরকম ভালবাসা ও প্যাশান। কোথাও কোনো পুরোনো জমিদারবাড়ি বা প্রাচীন কোনো বনেদি বাড়ি ভাঙার খবর পেলেই এই বিচিত্র মানুষ ইন্দ্রনাথ সেখানে যাকে চলিত ভাষায় বলে ‘ বডি ফেলে দিতেন’ —--- যতক্ষণ না তিনি বইয়ের ‘গুপ্তধন’ পেতেন, ততক্ষণ চলত তাঁর অনুসন্ধান। তারপর গাড়িতে করে বই চলে আসত তাঁর দোকানে। ইন্দ্রনাথ মজুমদার চলে গেছেন অনেকদিন, ‘সুবর্ণরেখা’র ঔজ্জ্বল্য কিছুটা ফিকে —- তবু এখনো মহাত্মা গান্ধী রোডের ওপর তাদের দোতলায় অবস্থিত দোকানে পুরোনো বই পাওয়া যায়। তবে এইসব গল্প আশির দশকে আমার জানা ছিল না।
সত্যি বলতে কি, আমাদের সাধ যতই থাক সাধ্য ছিল সীমিত। শহরতলির নিতান্ত একটা ভাড়াবাড়ির সংকীর্ণ আড়াইখানা ঘরে আমাদের বাস। বইপত্র রাখার দামী আলমারি, শোকেস বা পর্যাপ্ত জায়গা তেমন কিছুই ছিল না। ওরই মধ্যে বাবার সংগ্রহের কিছু পুরোনো বইপত্র আর মাঝেসাঝে কেনা দু-চারটি বই। বাবার সংগ্রহের অন্যতম গৌরব ছিল জন্মশতবার্ষিকী-তে প্রকাশিত ষোলো খন্ডের রবীন্দ্র রচনাবলী, আর তিন খন্ডে প্রকাশিত বিদেশি বিখ্যাত চিত্রশিল্পীদের পেইন্টিং-এর বই ‘মেমোরেবল ওয়ার্ল্ড পেইন্টিংস’ —- বিশ্বখ্যাত লিওনার্দো ভিঞ্চি বা রেমব্রান্ট বা বত্তিচেলির ছবির প্রিন্ট এই বইগুলিতেই আমি প্রথম দেখার সুযোগ পাই। পৃথিবীবিখ্যাত ছবি ‘এ সামার নাইট’, ‘লাস্ট সাপার’ বা ‘বার্থ অফ ভেনাস’ এই তিনখন্ডেই ছাপা হয়েছিল। বিদেশি প্রকাশনার রয়্যাল সাইজের বই, মোটা কাগজে ঝকঝকে ছাপা, দারুণ চামড়া বাঁধাই —- এই বইগুলি পুরোনো বইয়ের দোকান থেকেই সংগৃহীত হয়েছিল। আর ছিল এক সময়ের অতি বিখ্যাত দু খণ্ডের ‘ওয়েবস্টার ডিকশনারি’ আর একটা ঢাউস বই— ‘বুক অফ কোটেশন’। এগুলি সবই পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা। ছিল নিজে নিজে ফটোগ্রাফি শেখার বিদেশি সিরিজের গোটা কুড়ি বই, ছিল গ্রীক মিথোলজির ওপর দু খন্ডের সংকলন, সেইসঙ্গে অ্যালবেয়ার কামু-র ‘প্লেগ’, হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দি সি’ - এগুলির পেঙ্গুইন এডিশন। এই প্রতিটি বই আজও আমি উত্তরাধিকার সূত্রে নিজের সংগ্রহে রাখতে পেরেছি। কেবলমাত্র তিনবার বাসাবদলের ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ হিসেবে গত তিনবছর আগে (২০২০) ওই অমূল্য ছবির বইগুলি আমি আর রক্ষা করতে পারিনি— এ নিয়ে মাঝে মাঝেই আমার আত্মগ্লানি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে ক্লাস টেন থেকে যে ছোট ঘরটি আমার পড়াশোনার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছিল তার একদিকের দেওয়ালে ছিল সিমেন্টের র্যাক। সেখানে বা পড়ার টেবিলের একদিকে পড়ার ও পড়ার বাইরের নানা বই কোনোমতে স্থান সঙ্কুলান হত। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলিতে আমায় হাতখরচ হিসেবে বাড়ি থেকে যেটুকু টাকা দেওয়া হত তা শুনলে অনেকেই এখন হেসে ফেলবেন কিংবা একালের পড়ুয়ারাদের চোখ কপালে উঠবে। হাওড়া থেকে যাদবপুর তখন সরকারি বাসে ভাড়া ছিল মাত্র পঞ্চান্ন পয়সা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গান্ধী-ভবন’ সংলগ্ন চিপ ক্যান্টিনে দু টাকার মধ্যে চা- সমেত টিফিন করা যেত। বাড়ি থেকে রোজ হাতে পেতাম পাঁচ টাকা আর একটা দশ টাকার নোট বিপদ-আপদ বলে রেখে দিতে বলা হয়েছিল মানিব্যাগের ভিতরের খাঁজে, ওটা আপতকালীন খরচের জন্য। ফলে বই কেনার জন্য বাড়তি অর্থ সেইভাবে হাতে থাকত না। টিফিনের পয়সায় কিছু কাটছাঁট করে এবং মাঝে মাঝেই বাসের ভাড়া ফাঁকি দিয়ে কিছু পয়সা জমলে তাই দিয়ে পড়ার বইয়ের বাইরে অন্য ধরনের বই কেনার কথা ভাবা যেত। বাসের ভাড়া ‘ফাঁকি’ দেওয়ার পদ্ধতিটা ছিল ‘রোমাঞ্চকর’ — এই ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে বাসে উঠলে হয় সামনের দরজা দিয়ে বাসে উঠে পেছনের দরজা দিয়ে নামতে হয়, অথবা বিপরীতটা। কন্ডাক্টার টিকিটের কথা জিজ্ঞাসা করলে খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে হয় ‘হয়ে গেছে’ —- সাকুল্যে এতে সাশ্রয় হয় ওই পঞ্চান্ন পয়সা। মিনিবাসের ক্ষেত্রে একটি মাত্র দরজা থাকায় সেই ক্ষেত্রে এই ফরমুলা প্রযোজ্য হত না। এখন অবশ্য সব বাসেই একটি মাত্র দরজা, ফলে এখন এই ‘টেকনিক’ আর কাজে লাগার নয়। বয়সের উন্মাদনার কারণে ট্রেনের ভাড়া ফাঁকি দিয়েও সেইসময় একটা আত্মপ্রসাদ লাভ করতাম। পরে বিবেচনা করে দেখেছি, সেইসময় হাওড়া সেকশনে লোকাল ট্রেনের পরিষেবা ছিল অত্যন্ত খারাপ, নিত্যনৈমিত্তিক ট্রেনের গণ্ডগোল লেগেই থাকত আর তার জন্য ভোগান্তি হত আমাদের মতো নিত্যযাত্রীদের। তাছাড়া অভিজ্ঞতা বলছে ভারতীয় রেল কোনোদিনই তার যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধেজনক পরিষেবা দিতে পারেনি — আজও সেই ট্র্যাডিশনের খুব একটা রকমফের হয়নি। বাসের ক্ষেত্রে সরাসরি বাসের কন্ডাক্টার বা চালকের কাছে অভিযোগ জানানো বা চিৎকার করে গালমন্দ করার একটা স্পেস থাকে, ট্রেনের ক্ষেত্রে সেটা থাকে না। ফলে সেই অবদমিত ক্রোধ রূপান্তরিত হত টিকিট ফাঁকি দিয়ে একটা প্রতিশোধমূলক পরিতৃপ্তিতে। এখানে অবশ্যই বলা দরকার, পারিবারিক আর্থিক মাপকাঠি যেমনই হোক, ক্লাসে পড়াশোনার জন্য যেসব বই লাগে তা কিনে দিতে পরিবার থেকে অবশ্যই সহযোগিতা পাওয়া যেত। শুধু কম্পিউটার-বিজ্ঞান তো নয় গণিতের নানা বই, পদার্থবিদ্যার স্নাতক স্তরের বই সব ওই কলেজ স্ট্রিট থেকেই কেনা। আর সেই সূত্রেই শিক্ষাসত্র যাদবপুরে হলেও বই কেনার জন্য কলেজ স্ট্রিটে আসা যাওয়ায় কোনো ভাঁটা পড়েনি।
অন্য ধরনের বই বলতে সেই সময়ে আমাদের মূল আকর্ষণ ছিল কবিতা ও রাজনৈতিক বা সামাজিক সাহিত্য। সেই আগ্রহ থেকেই এক দুপুরে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ে একটি বই যার শিরোনাম ‘নিষিদ্ধ কবিতা’। সম্পাদনা করেছেন বোম্মানা বিশ্বনাথন। এই সম্পাদক ব্যক্তিটির নামের সঙ্গে পরিচয় ছিল অন্যসূত্রে। আমাদের ছেলেবেলায় ‘চাঁদমামা’ নামে একটি ছোটদের পত্রিকা প্রকাশ হত সারা ভারতের অনেকগুলি ভাষায়, বাংলাতেও। ওই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এই দক্ষিণ ভারতীয় ভদ্রলোক। কিন্তু ‘নিষিদ্ধ কবিতা’ মানে কী? হাতে তুলে নিই বইটা। প্রচ্ছদে অফ হোয়াইটের ওপর লাল অক্ষরে খোদিত বইয়ের শিরোনাম, বাঁধাই কিছুটা খুলে গিয়েছে। উলটে পাল্টে দেখি, জরুরি অবস্থার সময় যেসব কবিতা সরকারিভাবে ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষিত হয়েছিল আসলে এটা তারই একটা সংকলন। ততদিনে ‘জরুরি অবস্থা’ বিষয়টি সম্বন্ধে একটা ধারনা পাকা হয়ে গেছে। তাই মনে হয়েছিল, এটা বেশ নতুন ব্যাপার তো ! দরাদরি করে পাঁচ টাকায় কিনে নিলাম সেই বই। পুরনো বইয়ের দোকান থেকে সেই আমার প্রথম সংগ্রহ। এর পরে আর দুয়েকটি বই এইভাবেই প্রায় জলের দরে কেনার সুযোগ ঘটেছে। একটা হল, বামপন্থী ঐতিহাসিক গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের লেখা দেশের ছাত্র আন্দোলনের একটা ছোট ইতিহাস, ‘বন্দিমুক্তি কমিটি’ প্রকাশনার একটি ছোট কবিতা-সংকলন আর কার্ল মার্ক্স এর প্রেমের কবিতা। প্রতিটি বইয়ের দাম কী কত ছিল, আজ তা আর মনে নেই —- সম্ভবত বন্দিমুক্তি কমিটির বইটির দাম ছিল দুটাকা । এই কবিতা-সংকলনটির পেছনের কভারে হলুদ কাগজের ওপর লাল অক্ষরে ছাপা ছিল একটি কবিতা, যার লেখক বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কবিতাটা পড়ে বিমোহিত হয়ে গিয়েছিলাম, এটা স্মরণে আছে আজও —-- এত বছর পরেও দেখছি, পুরো কবিতাটা হুবহু মনে থেকে গেছে। ইংরেজ কবি ডাবলু এইচ ওডেন তাঁর ‘পোয়েটস টাং’ রচনায় লিখেছিলেন কবিতা হচ্ছে আসলে এক ধরনের ‘স্মরণীয় উচ্চারণ’ (মেমোরেবল স্পিচ)----- সেদিনের ওই মন ভরিয়ে দেওয়া কবিতাও কি ছিল ওইরকম কোনো মনে রাখার মতো উচ্চারণ ? তবে এখানে এটাও বলা দরকার সেই সময় পকেটে তো আর বেশি রেস্ত থাকত না তাই দামি বইয়ের দিকে নাগাল বাড়ানোর সুযোগ ছিল সত্যিই সীমিত।
শুধু পুরোনো বই কেন, আস্তে আস্তে নতুন বইয়ের দিকেও নজর পড়ল। সপ্তাহে অন্তত একদিন কলেজ স্ট্রিট যাই। সব দিন যে বই কিনি তা নয়। এদিক ওদিক ঘুরি, বই দেখি। একেকটা বইয়ের খোঁজ করি। এই পর্যটনের সূত্রেই জেনে যাই কলেজ স্ট্রিটে নন-টেক্সট বই কেনাকাটার সব থেকে সুলভ জায়গা হল ‘দে’জ পাব্লিশিং’-এর দোকান। তাঁরা নিজেদের ও অন্য প্রকাশনার বইয়ে কুড়ি পারসেন্ট কমিশন দেন, সঙ্গে পাওয়া যায় তাদের ছাপানো পুস্তক তালিকা। এইভাবেই ঘোরাঘুরি করতে করতে দু-দিনে কিনে ফেলি দুটো প্রিয় কবিতার বই । একটি শঙ্খ ঘোষের ‘কবিতা সংগ্রহ’ ও অন্যটি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ — দুটি বই আজও আমার সংগ্রহে রয়েছে। এই লেখা সাজাতে সাজাতে দেখলাম দুটি বইয়েরই দাম ছিল কুড়ি টাকা, কমিশন বাদ দিয়ে ষোলো টাকা। এই শুরু হয়ে গেল পড়াশোনার পাশাপাশি না- পড়াশোনার বই কেনার অভিযাত্রা। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে, কবিতার বই কেনার ক্ষেত্রে এই দুই কবিকেই বেছে নিলাম কেন ? এর উত্তর দিতে হবে অনেকটা পরিসরে। পরের পর্বে ধরা থাকবে তার কাহিনি।
তার আগে, এই পর্বের ইতি টানি অন্য একটা কথা বলে। আমরা যখন মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিলাম তখন ‘ন্যাশনাল স্কলারশিপ’ বলে একটা ব্যাপার ছিল। পরীক্ষায় পঁচাত্তর শতাংশ নম্বর পেলে ওই স্কলারশিপ দেওয়া হত, তবে পরিবারের আর্থিক আয়ের একটা মাপকাঠি থাকত। এটা সরকারি স্কলারশিপ, কোন সরকার এটা দিতেন বা কত টাকা করে পাওয়া যেত এইসব কিছুই আমাদের জানা ছিল না। মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে স্কুল থেকে আমরা যারা এই স্কলারশিপের যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম তাদের একটা ফর্ম ফিল আপ করতে বলা হয়েছিল সেখানে পারিবারিক আয় উল্লেখ করতে হয়েছিল। ফর্ম ভরার পরে জানা যায়, যাদের পারিবারিক আয় নির্ধারিত সীমার ওপরে তাঁরা স্কলারশিপ পাবে না, কিন্তু তাদের একটা সার্টিফিকেট ও এককালীন সম্ভবত একশো টাকার চেক দেওয়া হবে। দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়ায় সেই সার্টিফিকেট আর আসে না, আসে না চেকও। এমন সময় জানা গেল এই সার্টিফিকেট বা চেক সংক্রান্ত খবর পাওয়া যাবে ৫ নম্বর ভবানী দত্ত লেনে অবস্থিত রাজ্যের শিক্ষা দফতরের অফিসে। তখন আমাদের কলেজ স্ট্রিট আসা যাওয়া আরম্ভ হয়ে গেছে, তাই প্রেসিডেন্সি কলেজের পাশের গলি ভবানী দত্ত লেনের প্রকান্ড ৫ নম্বর বাড়িটি খুঁজে নিতে কোনো অসুবিধা হয়নি। পুরোনো দিনের পাঁচতলা বাড়ি, একেকটা তলা বেশ উঁচু —- বিরাট খাঁচার মতো একটা লিফট আছে বটে, কিন্তু মাঝে মধ্যে তিনি দেহ রাখেন, তখন পা-গাড়ি ছাড়া গতি নেই। সেই বাড়ির পাঁচ তলায় শিক্ষা দফতরের অফিসে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করতে হয়েছে এই সূত্রে। সরকারি অফিসের বিবর্ণ চেহারা ও সরকারি কর্মচারীদের গয়ংগচ্ছ ব্যবহার এই সূত্রে কিছুটা আস্বাদন করার সুযোগ হয়েছিল এই উপলক্ষে। যদিও এই হাঁটাহাঁটির ফলশ্রুতি হিসেবে সেই সার্টিফিকেট ও চেক পাওয়া গিয়েছিল একদিন। আর পরে জেনেছি ওই বাড়িটিতে গোড়ার দিকে একসময় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অফিস ছিল – যা পরে পার্ক স্ট্রিটে এবং তারও পরে সল্ট লেকে চলে যায় । আশির দশকে আমরা যখন ওই বাড়িতে যেতাম তখন সেখানেই ছিল রাজ্য লেখ্যাগার ( স্টেট আরকাইভ)। পরে ‘পশ্চিমবঙ্গ কলেজ সার্ভিস কমিশন’এর অফিসও ছিল ওই বাড়িতেই, স্টেট লেভেল এলিজিবিলিটি টেস্ট (স্লেট)-এর সফল প্রার্থীদের সাক্ষাতকারও নেওয়া হত ওখানেই। নব্বই দশকের মাঝামাঝি ওই বাড়িতেই কলেজ সার্ভিস কমিশনের তৎকালীন সচিবের সঙ্গে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমার একটি প্রকাশ্য, উচ্চকিত ও তীব্র বাদানুবাদ ঘটে, যার জের গড়িয়েছিল ‘আজকাল’ পত্রিকার ‘চিঠিপত্র’ বিভাগ অবধি। তবে এই আখ্যানে সেই প্রসঙ্গ অবান্তর। এখন সম্ভবত ওই বাড়িতে আর কোনো সরকারি অফিসই নেই।
( ক্রমশঃ )
'কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি'র পরের পর্ব প্রকাশিত হবে ১২ মার্চ
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।