কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি
প্রবুদ্ধ বাগচী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পর্ব ২
কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে আবাল্য পরিচয়ের কথা আগের পর্বে উল্লেখ করলেও একটা কথা বলা দরকার, অন্তত ক্লাস এইট/নাইন পর্যন্ত স্কুলের পাঠ্যবইয়ের জন্য আমাদের কলেজ স্ট্রিটে আসতে হত না। তখন জানুয়ারিতে শুরু হত শিক্ষাবর্ষ। স্কুলে নতুন ক্লাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই হাতে পাওয়া যেত বুক লিস্ট। সেই বুক লিস্টের বইগুলো পাওয়া যেত স্থানীয় বইয়ের দোকানেই। আমরা যে জনপদে থাকতাম সেখানে মুলত দুটো স্কুল — প্রতিটারই ছেলে-মেয়ে আলাদা বিভাগ। ফলে আদপে চারটি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের বই সরবরাহ করার জন্য স্থানীয় বইয়ের দোকানগুলিই যথেষ্ট বলে আমাদের অভিভাবকরা মনে করতেন। কমিশন কিছু কম পাওয়া গেলেও এর জন্য কলকাতা আসার কথা কখনো ভাবা হয়েছে বলে মনে পড়ে না।
তবে এখানে একটা কথা বলা দরকার। স্কুলে কোন পাঠ্যবই নির্বাচিত হবে এটা নিয়ে শুনেছি আজকাল বড় বড় প্রকাশকদের সঙ্গে স্কুলের মাস্টারমশাইদের একটা অশুভ যোগাযোগ তৈরি হয়েছে, যাকে পরিভাষায় বলা হয় ‘নেক্সাস’ । পাঠ্যবই যারা নির্বাচন করেন সেইসব মাস্টারমশাইদের হাতে রাখার জন্য প্রকাশকরা নাকি নানা রকম উপঢৌকনের দেদার বন্দোবস্ত রাখেন। কারণটা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। রাজ্যে শিক্ষার বিস্তার ক্রমশ বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে স্কুলে স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যাও বেড়েছে অনেক। এখন প্রায় এগারো/বারো লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। কাজেই নিজের প্রকাশনের এক বা একাধিক টেক্সট বুক বেশ কিছু স্কুলে মনোনীত করানো গেলে প্রকাশকের আশু লক্ষ্মীলাভ। একই সঙ্গে কিছু কিছু স্কুল নাকি বিশেষ একটি বা দুটি বইয়ের দোকান পড়ুয়াদের বলে দেন, কেবল সেই দোকানেই ওই স্কুলের পাঠ্যবই পাওয়া যায়। এইসব ব্যবস্থার মধ্যে একটা স্বচ্ছতার অভাব খুব প্রকট। কলকাতার নামজাদা স্কুলগুলিও অনেকদিন হল এই অস্বচ্ছ ব্যবস্থার মধ্যে নিজেরা ঢুকে পড়েছে। নির্দিষ্ট দোকান থেকে ছাত্রদের বই কিনতে বা ক্ষেত্রবিশেষে স্কুলের পোশাক কিনতে বাধ্য করা বা কলেজ স্ট্রিটে প্রকাশকের ঘর থেকে বেশি কমিশনে পাঠ্যপুস্তক কিনে এনে স্কুল থেকে নিজেরা সেইসব বই পড়ুয়াদের কাছে ছাপা দামে বিক্রি করা — এই মুক্ত বাণিজ্য এখন প্রায় প্রথায় পর্যবসিত। এমনকি খাতা বা জলের বোতল এসবও স্কুল নিজেরা ইদানিং ছাত্রদের কাছে বিক্রি করে মুনাফা করে । আমাদের স্কুল জীবনে এই ধরনের জিনিস আমরা দেখিনি।
স্কুল থেকে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নিজেদের প্রকাশিত অঙ্কের বই বা বাংলা, ইংরিজি টেক্সট বই বিনামূল্যে দেওয়া হত। আর, অভিভাবকদের মুখে শুনেছি, নোটবই বা সহায়ক বই নাকি স্কুল থেকে প্রকাশিত পুস্তক তালিকায় উল্লেখ করা ছিল আইনবিরুদ্ধ। ফলে একেবারে গোড়ার দিকে প্রাথমিক স্তরে ‘ছাত্রবন্ধু’ জাতীয় নোটবই বইয়ের দোকান থেকে গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হত ঠিকই, কিন্তু পুস্তক তালিকায় তার কোনো উল্লেখ থাকত না। কেউ ইচ্ছে করলে ‘ছাত্রবন্ধু’ না কিনলেও কিছু যেতে আসত না। ক্লাস এইট/নাইন বা টেনেও মূলত বাংলা ও ইংরিজির নানা মোটা মোটা নোটবই বাজারে চালু ছিল, দোকানে সিলেবাসের বই কিনতে গেলে বিক্রেতা এইসব বই গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। টেক্সট বইয়ের তুলনায় নোটবইয়ে ‘কমিশন’ ও দেওয়া হত বেশি। এই বেশি কমিশন বা কম কমিশন এর পেছনে একটা অন্য গল্প ছিল। তখন সেটা খুব বিশদে জানতাম, এমন নয়। অবশ্য ক্লাস টেনে উঠে বাবার মুখে শুনেছিলাম এই কাহিনি। আসলে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এ কোনো প্রকাশকের টেক্সট বই অনুমোদন পেতে গেলে কিছু নিয়ম কানুনের বেড়া পেরোতে হত, এখনও হয়। বইয়ের আয়তন কেমন হবে, সর্বাধিক কত পৃষ্ঠা হবে, তাতে কেমন কাগজ দিয়ে ছাপতে হবে, তার সর্বাধিক দাম কত হতে পারে —-এই সবটাই পর্ষদ ঠিক করে দিত। এইসব নিয়ম মেনে বইয়ের নমুনা পর্ষদে জমা দিলে তবে সেগুলো বিবেচনা করে পর্ষদ বইয়ের অনুমোদন দিতেন ও সেই অনুমোদনের একটা ক্রমিক সংখ্যা ও তারিখ থাকত যা বইটির গোড়ায় ছাপা থাকত। পক্ষান্তরে, নোটবইয়ে এমন কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না এবং নোটবই মূলত ছাপা হত নিউজ প্রিন্টে, ফলে খরচ হত কম— তাই ছাপা মূল্যের থেকে কমিশন পাওয়া যেত বেশি। আমাদের সমকালের পড়ুয়ারা নিশ্চয়ই বাংলার সহায়ক বই হিসেবে বহুল প্রচারিত এম সেন (মোহিত সেন) বা বি চৌধুরির (বিভূতি চৌধুরী) নোটবইগুলির বিপুল আয়তনের কথা স্মরণ করতে পারবেন।
এই আখ্যানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলতে ইচ্ছে করছে, গত প্রায় দুই-তিন দশকে স্কুল পর্যায়ে কিছু কিছু নোটবই বা গাইড বুকের প্রকাশকরা তাঁদের ব্যবসা এমন রমরমা পর্যায়ে নিয়ে গেছেন যে নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপনের জন্য তাঁরা বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলকে পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারছেন। হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখেছি বইগুলি আয়তনেও বেশ বড় ও দামেও। পাঠ্যপুস্তকের অনুমোদন কমিটি আজও এই রাজ্যে বহাল আছে কিন্তু মাধ্যমিক স্তরে টেক্সট বই অনুমোদনের নিয়মকানুন একই আছে কি না সেটা আমার জানা নেই। কিন্তু ২০১৪-১৫ অবধি দেখেছি, পাঠ্য পুস্তকের তুলনায় এইসব নোটবইয়ের চাহিদা প্রবল। কলেজ স্ট্রিটে নতুন বছরের বই কিনতে এসে সবাই এইসব একেকটা ব্র্যান্ডের নোট বই খোজ করছেন। ‘রায় অ্যান্ড মার্টিন’ এর বই না পড়লে বা ‘পারুল প্রকাশন’ ‘ছায়া প্রকাশনী’ বা ‘সাঁতরা’ র বই হাতে না পেলে নাকি পড়াশোনাই এগোবে না ! ঘটনাচক্রে কলেজ স্ট্রিট এলাকার এমন এক নামী নোট বই প্রকাশনার গুদামঘরে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল, সেখানে গিয়ে দেখেছি, পাটকলের গুদামে কাঁচা পাটের গাঁটরি যেভাবে রাখা থাকে সেইভাবে রাখা হয়েছে নোট বইয়ের বান্ডিল। ব্যাপারটা চোখকে খুব স্বস্তি দিয়েছিল, এমন নয়। এমনকি গত এক দশক ধরে দৃষ্টিকটুভাবে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ওপরের দিকের স্থান পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের দিয়ে নিজেদের নোটবইয়ের বিজ্ঞাপন পর্যন্ত এইসব প্রকাশকরা অনায়াসে করিয়ে নিতে পারছেন। পরীক্ষায় ভাল ফল করে কোনো নোটবই প্রকাশনার ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ হয়ে ওঠা এটা একটা বড় সামাজিক দুর্লক্ষন বলেই আমাদের মনে হয়। তবে সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
ক্লাস নাইন পর্যন্ত সেইভাবে দরকার না হলেও ক্লাস টেনে উঠে অনেকেই বলতে লাগলেন, মাধ্যমিকের উত্তরপত্রে ভাল নম্বর পেতে গেলে স্কুল নির্দিষ্ট একটি পাঠ্য পুস্তকের ওপর নির্ভর না করে রেফারেন্স বই দেখা দরকার। দু-তিনটে বই দেখে প্রশ্নপত্রের উত্তর তৈরি করলে তার মান অনেক ভাল হয় আর পরীক্ষকরাও খুশি হয়ে তাতে বেশি নম্বর দেন। বলতে গেলে, এই রেফারেন্স বই কেনার সূত্রেই কলেজ স্ট্রিটে আসা যাওয়ার সূত্রপাত হল। উল্লেখ করা দরকার, আমাদের স্থানীয় বইয়ের দোকানগুলো যেহেতু এলাকার স্কুলের পুস্তকতালিকা অনুযায়ীই নিজেরা বই নিয়ে আসত তাই তালিকার বাইরের কোনো বই সচরাচর তাঁদের সংগ্রহে থাকত না। বড় জোর অর্ডার দিলে তাঁরা কলকাতা থেকে আনিয়ে দিতেন। কিন্তু আমাদের বাড়িতে যেহেতু বাবা নিত্যযাত্রী হিসেবে রোজই চাকরি করতে কলকাতা যেতেন ফলে আমাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। বলতে গেলে, বাবার হাত ধরেই কলেজ স্ট্রীট বইপাড়ায় আমার পা রাখার সূত্রপাত। সেটা আশির দশকের শুরুর দিক, ৮১-৮২ সাল হবে।
কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে বাস থেকে নেমে প্রেসিডেন্সি কলেজের উল্টোদিকের ফুটপাথ ধরে সার বাঁধা বইয়ের গুমটি আর বিক্রেতাদের বইয়ের জন্য উৎসুক জিজ্ঞাসা ‘কী বই বলুন’ ও মাঝে মাঝে হাত টেনে ধরা। এই অভিজ্ঞতার স্বাদ সেই প্রথম পেলাম আমি। তফাতটা হচ্ছে কলেজ স্ট্রীটে বই কিনতে এলে ওই গুমটির বই বিক্রেতাদের কাছে একাধিক বইয়ের নাম মুখে বলে দিলে বা চিরকুটে লিখে দিলে তাঁরা একটা বা দুটো নিচু টুলে আমাদের বসিয়ে রেখে চলে যেতেন বই আনতে। এই অভিজ্ঞতা পাড়ার বইয়ের দোকানের মতো নয়। আসলে পরে বুঝেছি, এঁরা ঠিক প্রকাশক নন, মূলত বইয়ের বিক্রেতা। ক্রেতার কাছ থেকে বইয়ের নাম জেনে এঁরা চলে যেতেন বিভিন্ন প্রকাশকের দোকানে যাদের প্রায় সকলেরই অফিস তথা গুদামঘর বা দোকান ( আজকের ভাষায় শো রুম) ছিল ওই কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার চৌহদ্দির মধ্যেই। আর সুবিধা হল, তাঁরা যখন আমাদের বসিয়ে রেখে একসঙ্গে তিনটে চারটে বই হাতে করে ফিরে আসতেন, ওই স্বল্প পরিসর গুমটিতেই দাঁড়িয়ে বা বসে প্রতিটি বই হাতে নিয়ে তার ভালমন্দ বিচার করে নেওয়ার এক সীমাহীন সুযোগ এসে যেত ক্রেতার সামনে। মাধ্যমিক পদার্থবিদ্যার চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত বা অলোক চক্রবর্তী, বা জীবনবিজ্ঞানের সান্যাল-চ্যাটার্জি না অমূল্যভূষণ চক্রবর্তী—-- কোন বইতে বেশি ছবি দিয়ে বোঝানো আছে বা কোনটায় বেশি অঙ্ক করতে দেওয়া আছে বা করে দেওয়া আছে তার একটা তুলনামূলক চেহারা বই হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই বোঝা যেত। এবং চারটে বই আনিয়ে তার থেকে একটা কিনতে চাইলেও বিক্রেতা অসন্তুষ্ট হতেন এমন নয়। ওই একটা বইয়ের কমিশন নিয়ে একটু দর কষাকষি চলত ঠিকই, তারপর একটা রফাও হয়ে যেত। ছাপা মূল্যের থেকে কুড়ি বা পঁচিশ শতাংশ ছাড় তো অনায়াসেই মিলত। অবশেষে খরিদ করা বইটি পুরনো খবরের কাগজে মুড়ে ( তখন প্লাস্টিক ব্যাগ এমন সর্বভূতেষু হয়ে ওঠেনি) আমাদের হাতে তুলে দিয়ে মিষ্টি হেসে তাঁরা বলতেন ‘কাকু, আবার আসবেন কিন্তু’ । অবিক্রীত বই আবার ফেরত চলে যেত প্রকাশকের দফতরে।
এই পর্যন্ত এসে একটা অন্য কথা বলতেই হচ্ছে। বই বিপণনের ক্ষেত্রে এই যে ক্রেতা নিজের প্রাথমিক পছন্দের চার/পাঁচটির মধ্যে একটাকে বা দুটোকে নিজে হাতে নেড়েচেড়ে দেখে তারপর নির্দিষ্ট বইটাকে কেনার সুযোগ পাচ্ছেন, এটা একটা বড় অ্যাডভান্টেজ, যা পাড়ার দোকানে মেলে না। নব্বই দশকের পর নয়া উদারনৈতিক অর্থনীতি চালু হওয়ার পরে যখন আমাদের চোখের সামনে খুলে গেল নতুন নতুন শপিং মল, সেখানেও কিন্তু যাবতীয় ভোগ্যবস্তুকে এইভাবেই প্রদর্শিত করা হয় এবং ক্রেতা নিজেই ঘুরে ঘুরে নিজের পছন্দের জিনিসটি নির্বাচন করে নেন। কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় আজও টেক্সট বইয়ের ক্ষেত্রে এই প্রথা পুরোদমে চালু আছে যার সূত্রপাত ঘটেছে অনেক অনেক দিন আগে। যদিও নন-টেক্সট বই বলে যাদের চিহ্নিত করা হয় অর্থাৎ গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নাটক কবিতা ইত্যাদির বই, সেই রকম বাংলা বইয়ের শতকরা একশোভাগই একসময় প্রকাশিত হত কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া থেকে, কিন্তু বহুদিন পর্যন্ত সেইরকম বই নিজে হাতে নেড়েচেড়ে দেখে পছন্দ করে কেনার সুযোগ কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় ছিল নিতান্তই হাতে গোনা একটা দুটো বিপণিতে। আশির দশকে মনীষা গ্রন্থালয়ে, ন্যাশনাল বুক এজেন্সিতে এই ব্যবস্থা চালু থাকতে দেখেছি। তৎকালীন ‘প্রগতিশীল’ সাহিত্যের বিপুল সম্ভার হাতে তুলে দেখে, কিছুটা পাতা উলটে পাল্টে দেখে কেনার সুযোগ ছিল। পরে বেনিয়াটোলা লেনের মুখে আনন্দ পাব্লিশার্স তাঁদের বিপণিতে এই ব্যবস্থা চালু করে, ‘সিগনেট প্রেস’ প্রকাশনা ‘আনন্দ পাব্লিশার্স’ অধিগ্রহণ করার পরে সংস্কৃত কলেজের গেটের বিপরীতে তাঁদের যে নতুন দোকান চালু হয় সেখানেও এই সুযোগ আছে। তবে সেটা মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। ইদানিং আরও কিছু নতুন দোকানে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। অবশ্য ইংরিজি বইয়ের ক্ষেত্রে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের তিনতলায় অবস্থিত ‘রূপা অ্যান্ড কোম্পানি’ বা ‘চক্রবর্তী চ্যাটার্জি’ র শোরুমে বরাবরই এই ব্যবস্থা ছিল, পার্ক স্ট্রিটের অক্সফোর্ড বুক স্টোরেও আছে একই ব্যবস্থা। বই বিপণন নিয়ে কেউ যদি সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা করেন তিনি ভেবে দেখতে পারেন এই যে নিজে হাতে বই ঘেঁটে তার ভাল মন্দ বিচার করে নেওয়ার সুযোগ এই ব্যবস্থাটাই পরে ‘কলকাতা বইমেলা’ কে জনপ্রিয় করার একটা অন্যতম কারণ কি না। কারণ কলেজ স্ট্রিটের ছোট বড় সব প্রকাশকই যখন বইমেলায় নিজেদের দোকান সাজান তাঁদের এই ব্যবস্থাটাই চালু করতে হয় মেলায়, সারা বছর পাঠক যে সুযোগ কলেজ স্ট্রিটে পান না।
তবে সেই আশির দশকের গোড়ায় যখন মূলত বাবার সঙ্গে কলেজ স্ট্রিটে আসা যাওয়া শুরু হয় তখন আমাদের মূল লক্ষ্য থাকত টেক্সট বই কেনা তাই অন্য প্রকাশনার দিকে সেইভাবে তাকিয়েছি এমন কথা স্মরণে আসে না। এমনকি প্রেসিডেন্সি কলেজের উল্টোদিকে ওই বিখ্যাত বই গুমটিগুলির আড়ালে যে অনেকগুলি শতাব্দী প্রাচীন বইয়ের দোকান ছিল তা আমাদের চোখেই পড়েনি। ‘দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি’র কথা পরে অনেক জায়গায় শুনেছি বা পড়েছি। ছাত্রবেলায় অমর্ত্য সেন এই বইয়ের দোকান থেকে নিয়মিত বই কিনতেন বলে জেনেছি। আমরা অবশ্য ‘হিন্দুস্থান লাইব্রেরি’ নামক বইয়ের দোকানটার কথা তখন শুনেছি যার অবস্থান ছিল একেবারে কলেজ স্ট্রিট চৌমাথায় কৃষ্ণদাস পাল মশায়ের ঢেকে যাওয়া মূর্তিটার ঠিক পেছনে। সেই দোকান আজও আছে তবে সম্ভবত তার হাত বদল হয়েছে।
এই জানা বা না-জানার পেছনে আসলে একটা কারণ ছিল। দাশগুপ্ত বা ওই সারির অন্য দোকানগুলি মূলত টেক্সট বইয়ের ব্যবসায়ে নিযুক্ত থাকলেও তাঁরা প্রকাশ ও বিক্রি করতেন উঁচু ক্লাস —- অন্তত গ্র্যাজুয়েশন বা পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন স্তরের বই ও রেফারেন্স বই। ফলে ক্লাস নাইন / টেনের বইয়ের জন্য ওইসব দোকানে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না , যা মিটিয়ে দিতেন ওই গুমটি দোকানের অনুজ্জ্বল বিক্রেতারাই। ‘হিন্দুস্থান লাইব্রেরি’ তুলনায় নিচু ক্লাসের টেক্সট বই কিছু বিক্রি করতেন ঠিকই, কিন্তু ওদের কাউন্টার থেকে সেই বই কিনলে বাঁধা ধরা দশ বা পনেরো শ্তাংশের বেশি ছাড় মিলত না —- যার থেকে বেশি ছাড় দিতেন ফুটপাথের বই গুমটি। আসলে তখন কলেজ স্ট্রিটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরশ আমাদের গায়ে সেভাবে যে লেগেছে এমন বলা একটু ভুল উচ্চারণ। বরং হরেক বইয়ের মেলা, হাতে নিয়ে বই দেখার সুযোগ এবং তুলনায় বেশি ছাড় —- এইসব উপাদানগুলিই যেন আমাদের টানত বেশি। বইপাড়ার সাবেক ঐতিহ্য ও পরম্পরা , সেই সঙ্গে নিজেদের সাংস্কৃতিক জীবনের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে নেওয়া এসব ঘটনা আরও পরের। যখন নিজে পায়ে হেঁটে ঘুরে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে চিনতে পেরেছি বাংলার এই সাংস্কৃতিক মুক্তাঞ্চলকে , সেই কাহিনির কথা আসবে যথাসময়ে।
(ক্রমশঃ)
কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি (পর্ব ১) পড়ুন এই লিঙ্কে :
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।