কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি
প্রবুদ্ধ বাগচী
(পূর্ব-প্রকাশিতের পর)
পর্ব ৯
গত শতকের নয়ের দশকের গোড়ার দিকে যে-বছর উগ্রপন্থী হিন্দু মৌলবাদীরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করেন (৬ ডিসেম্বর ১৯৯২) সেই বছরের জানুয়ারি মাসে আমি প্রথম জীবিকাসূত্রে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় যোগ দিই। তাঁদের অফিস ছিল একেবারে মধ্য কলকাতায় চাঁদনি চক এলাকায়। খুব কাছেই, প্রায় বলতে গেলে বিপরীত দিকেই, ছিল আনন্দবাজার পত্রিকার অফিস। সাতের দশকের পরিচিত কবি প্রমোদ বসু তখন আনন্দবাজার সংস্থায় তাঁদের ‘রবিবাসরীয়’ বিভাগে কাজ করতেন, সংবাদপত্রের অফিসে তাঁর ‘বস’ ছিলেন সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিত । প্রমোদ বসুর সঙ্গে আমার একটা খুব গভীর সখ্য হয়ে গিয়েছিল। তার সূত্রটা ছিল, আমাদের মফসসল থেকে প্রকাশিত অন্য একটি ছোট কবিতাপত্র ‘ক্যাকটাস’ । আমাদের সেই সাংস্কৃতিক সংগঠনের মুখপত্র যা বিক্রি করতে গিয়ে প্রেসিডেন্সির সামনে হ্যাটা খেয়েছিলাম তখন সেটি বিলুপ্ত, আর আমি নিজেও নানা কারণে ততদিনে সেই প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিচ্যুত। কিন্তু এলাকার দুই তরুণ যখন কবিতাপত্র প্রকাশে এগিয়ে এল, তখন আমিও তাঁদের সঙ্গে হাত মেলালাম, মেলালেন অনেকেই। তাঁদের সূত্রেই পরিচয় হয়েছিল কবিতা বিষয়ক নিবন্ধ ও আলোচনার খ্যাত লেখক বিদ্যাসাগর কলেজের ইংরিজির অধ্যাপক সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে, যে পরিচয় আজও জীবন্ত ও নিবিড় হয়ে আছে। এইভাবেই পরিচয় বেড়ে বেড়ে এগোলো হাওড়ার খ্যাত কবি সুজিত সরকার, প্রমোদ বসু, ব্রত চক্রবর্তীর সঙ্গে। এসব যোগাযোগের হোতা মূলত সুব্রতদা, যার কাছে নবীন লেখকদের দ্বার আক্ষরিক অর্থেই ছিল অবারিত। আর এই সূত্রে ওইসব অগ্রজ কবিদের বাড়ি যাতায়াতও শুরু হল। আসলে তখন নিয়মিত কবিতা লেখার অভ্যাস ছিল, তার কিছু কিছু প্রকাশও হত এখানে ওখানে। বছর দুয়েক এমন চলার পরে কবি প্রমোদ বসুই প্রস্তাব দিলেন, এবার একটা কবিতার বই প্রকাশ করো। ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল নিতান্তই চমকে ওঠার মতো। আমার লেখা কবিতা বিষয়ে আমার খুব যে আত্মবিশ্বাস ছিল, এমন নয়। তাই আমার মতো অভাজনের বই কে প্রকাশ করবেন, কারাই বা সেগুলো কিনবেন এগুলোর সবটাকেই মনে হয়েছিল শীতের কুয়াশায় ঢাকা রেলপথ। কিন্তু অগ্রজ প্রমোদ বসু বললেন, তিনি সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবেন আমার সঙ্গে। শুরু হল একটা নতুন পর্ব যার কেন্দ্রে আবার ফিরে এল কলেজ স্ট্রিট। সময়টা ১৯৯৪।
একটা কথা স্পষ্ট জানতাম খুব নামী দু-একজন কবি ছাড়া কবিতার বই কোনো প্রকাশনই নিজে থেকে বিনিয়োগ করে প্রকাশ করেন না। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও গোড়ার দিকে নিজের কাব্যগ্রন্থ নিজের অর্থেই ছাপাতে হয়েছিল। কাজেই মোদ্দা কথাটা হল, নিজের কবিতার বই প্রকাশ করার জন্য আসলে নিজেকেই অর্থ খরচের প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে একটা প্রকাশনের নাম ও লোগোতো চাই নইলে বইটা প্রকাশ হবে কোথা থেকে ? সুমহান ঐতিহ্যযুক্ত এই কলেজ স্ট্রিট বইপাড়া নিয়ে আমাদের তুমুল গর্ব ও উত্তেজনা থাকলেও নতুন লেখকদের ক্ষেত্রে প্রকাশকরা যে তাঁদের মাথায় কাঁঠাল ভাঙেন, এই তেতো সত্যটার নাগাল ততদিনে পেয়ে গেছি। বিশেষ করে, বাংলাভাষায় কবি ও কবি-যশোপ্রার্থীর সংখ্যা এত বেশি যে কবিতার বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকদের একটা, পরিভাষায় যাকে বলে ‘স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর’ ছিল ও আজও আছে। সেটা হল, কবির থেকে টাকা নিয়ে তাঁকে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক বই ছাপার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। তারপর সেই প্রতিশ্রুত সংখ্যার কম বই ছাপানো ও এই বিষয়ে কোনো হিসেব দিতে অস্বীকার করা। অতঃপর ছাপানো বইগুলো বাঁধিয়ে কবির ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া, তিনি পারলে সেগুলো বিক্রি করে তার টাকা তুলে নিতে পারেন অথবা বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে সেগুলো বিলি করে আত্মতৃপ্ত হতে পারেন। প্রকাশকদের কথায় ‘চয়েস ইজ ইয়োরস’। কলেজ স্ট্রিট নিয়ে লিখতে বসে তার ইতিবাচক দিকগুলোর পাশে এইসব নেতিবাচক দিকগুলোও উল্লেখ করা দরকার। অবশ্য প্রকাশকদের দিক থেকে ভাবলে, কবিতার বইয়ের পাঠক এমনিতেই খুব কম, তার ওপর নতুন অপরিচিত কবিদের ক্ষেত্রে তা আরও কম —- তাই প্রকাশক নিজে থেকে বিনিয়োগ করে কবিতার বই ছাপলে তার সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। সেই ঝুঁকি কে স্বেচ্ছায় নিতে চাইবেন ? এই প্রশ্নটাও যে একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো তা নয়।
যাই হোক এবার আবার ফিরি মূল প্রসঙ্গে। ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট এর পেছন দিকের রাস্তা দিয়ে ঢুকলে রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট —- ওই রাস্তার ১০/২বি নম্বর বাড়িতে ছিল সুপরিচিত ‘রক্তকরবী’ পত্রিকার অফিস (পত্রিকার রেজিস্টার্ড নাম অবশ্য ‘একালের রক্তকরবী’) । ত্রৈমাসিক এই পত্রিকাটির খ্যাতি ও পরিচিতি ছিল ভালই। পত্রিকার সঙ্গে তাঁরা একটা প্রকাশনাও চালাতেন, বেশ কিছু ভাল বই তাঁরা প্রকাশ করেছিলেন সেই সময়। ওই পত্রিকা-সম্পাদক তথা প্রকাশনার মালিকের কাছে আমায় চিঠি লিখে পাঠালেন কবি প্রমোদ বসু। নতুন লেখকদের নিজের পত্রিকায় জায়গা দেওয়ার বিষয়ে ওই সম্পাদক ছিলেন উদ্যমী। অত্যন্ত স্নেহভরে তিনি আমায় অনুরোধ করলেন তার পত্রিকায় লিখতে। মূলত তাঁর উৎসাহেই বাংলা ভাষার কিছু ‘মহিলা কবি’-দের (এই শব্দবন্ধ নিয়ে বিরোধ আছে জেনেও প্রয়োগ করলাম) লেখালিখি নিয়ে আমি কিছু চর্চা করতে থাকি। কবিতা সিংহ, নবনীতা দেবসেন, কেতকী কুশারী ডাইসন, দেবারতি মিত্র, গীতা চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের লেখার সংস্পর্শে আসি। তাঁদের কেন্দ্র করে আমার লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন ‘রক্তকরবী’ পত্রিকার সম্পাদক। প্রমোদ বসুর চিঠির সূত্রে কথায় কথায় বই প্রকাশের প্রসঙ্গ উঠতে তাতেও তিনি অসম্মতি জানাননি। মোটামুটি কত সংখ্যক কপি ছাপাব, কী সাইজ হবে বইয়ের, কী ধরনের কাগজে ছাপা হবে, প্রচ্ছদ কেমন হবে, কে সেটা আঁকবেন ইত্যাদি ইত্যাদি বিবেচনা করে তিনি একটা আনুমানিক খরচের হিসেব আমায় দিলেন । পান্ডুলিপি জমা দেওয়ার সময় ওই পরিমাণ অর্থের একটা অংশ দিতে হবে তাঁকে, তারপরে কাজ এগোতে থাকবে, প্রয়োজনে আবার কিছু নগদ দরকার হলে তা দিতে হবে।
যত অনায়াসে এই বাক্যগুলি লিখে ফেলা গেল আসলে কাজগুলো যে অত সহজ ছিল না তা টের পেতে লাগলাম ক্রমশ। আগের কোনো পর্বে পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে পড়ার কথা ভাগ করে নিয়েছি, তার থেকে সহজেই অনুমান করা যায় প্রেস, ছাপা-হওয়া এইসব বিষয়গুলির সঙ্গে আমাদের প্রাথমিক যোগাযোগ ঘটে গিয়েছিল এর আগেই। প্রুফ কেমনভাবে দেখতে হয় তাও শিখে নিয়েছিলাম এর আগের সেই পর্বে। ফলে পেশাদার ‘প্রুফ রিডার’ নিয়োগ করলে যখন আরও বাড়তি খরচের ধাক্কা সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে নিজেই প্রুফ দেখব এই কথা জানিয়ে দিয়েছিলাম প্রকাশককে । এই সূত্রেই প্রায় নিয়মিত দুপুরবেলায় অফিসের টিফিনের প্রহরটিকে একটু বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হত প্রকাশকের দফতরে। ‘রক্তকরবী’ পত্রিকার সম্পাদক (তিনি প্রয়াত হওয়ায় তাঁর নাম এখানে অনুল্লিখিতই থাকবে) নিজে চাকরি করতেন বিবাদী বাগ এলাকায় এক বেসরকারি সংস্থার উঁচুপদে, তার অফিস ছিল গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ঠিক বিপরীত দিকে। বহু রোদঝরা দুপুরে শুধু তার সাহাচর্য পাওয়ার জন্য তাঁর অফিসে গেছি, তাঁর টিফিন ভাগ করে খেয়েছি আমরা দুই অসমবয়সী বন্ধু । এমনকি এটাও বলা দরকার দৈনিক সংবাদপত্রে আমায় প্রথম লেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনিই। তখন ‘সংবাদ প্রতিদিন’ দৈনিক প্রকাশ হত ট্যাংরা এলাকার রাধানাথ চৌধুরী লেনের অফিস থেকে। সেই নতুন দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগের দুই কর্মী কবি অমিতেশ মাইতি ও কথাসাহিত্যিক রবিশংকর বলের সঙ্গে আমার যোগাযোগের মাধ্যম ছিলেন ‘রক্তকরবী’ পত্রিকার সম্পাদক। ওই দুই অগ্রজের প্রশ্রয়ে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর বুক রিভিউ বিভাগে ও রবিবারের পাতায় অনেকদিন লিখেছি, যতদিন না এঁরা দুজনেই অকালে ঝরে না যান। এখন এই সম্পাদক-মশাই সারা দিনে তাঁর পত্রিকা দফতরের কাজ চালানো, প্রেসে যাওয়া, কাগজ কেনা, বাঁধাই ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ইত্যাদির জন্য একজনকে নিয়োগ করেছিলেন। স্বভাবতই তাঁর বেতনের তুলনায় কাজের পরিধি ছিল অনেক বেশি, সেটা নিয়ে তাঁর বেশ ক্ষোভ ছিল যা প্রকাশ্যেই তিনি উগরে দিতেন মাঝে মাঝে। অনেক ক্লান্ত দুপুরে তাঁর সঙ্গে দেখা হত আমার। কথা হত। প্রুফের তাড়া তাঁর থেকে সংগ্রহ করে আবার তাঁকেই ফেরত দিয়ে আসতাম। মেদিনীপুর-নিবাসী এই মানুষটির নাম এখন আর মনে নেই, তবে সেই সময়ে তিনি এই পত্রিকা দফতরের কাজের পাশাপাশি ডাক বিভাগে ক্যাজুয়াল হিসেবে কাজ করতেন বলে শুনেছিলাম। এই ঘটনার অনেকদিন পর, কলেজ স্ট্রিট এলাকাতেই দেখা হয় তাঁর সঙ্গে — জানতে পারি, ডাক বিভাগে স্থায়ী কর্মী হিসেবে তিনি নিয়োগ পেয়েছেন। মাত্র কয়েকমাস আগে, হাওড়া - নিমতা মিনিবাসে আমি তাঁকে দেখে ঠিক চিনে ফেলি —- ইতিমধ্যে তাঁর চেহারায় বয়সের ছাপ পড়লেও —- কিন্তু তিনি আমায় চিনতে পারেননি। টিকিট কাটার ধরণ ও সহযাত্রীদের সঙ্গে কথাবার্তা শুনে মনে হল এখন তিনি নিমতা এলাকাতেই থাকেন। কলেজ স্ট্রিট নিয়ে লিখতে বসলে এমন কত চরিত্রই না উঁকি মেরে যায় মনের পর্দায়।
কিন্তু বই প্রকাশের এই পর্ব অবধি এসে সমস্যার সূত্রপাত হল অন্য জায়গায়। আমার বইয়ের প্রচ্ছদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রমোদ বসু। চাকরির কাজের চাপে সেটা করে উঠতে না-পারায় বারবার আমায় ফিরে আসতে হচ্ছিল আনন্দবাজার দফতর থেকে। অথচ বিকল্প যে কাউকে অনুরোধ করব, সেই রাস্তাও আমার জানা ছিল না। তাছাড়া প্রমোদদা যেহেতু প্রথম থেকে নিজেই উদ্যোগ নিয়েছেন তাই তাঁকে নিরস্ত করা আমার পক্ষে উচিত কাজ বলে মনে হয়নি। কিন্তু জানুয়ারি ১৯৯৫-এর বইমেলায় নিজের বই প্রকাশ করতে গেলে সময়ের এই নিয়ম না মানলে মুশকিল, কারণ বইমেলার আগের ছ/সাত মাস কলেজ স্ট্রিটের প্রেস, বাঁধাই ঘর সহ প্রত্যেকের ওপর ভীষণ চাপ থাকে —- তাঁদের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে না-চললে পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যেতে পারে। এই সময়েই আরেকটা জিনিস দেখলাম, ‘রক্তকরবী’ প্রকাশনা নিজেরাও আসন্ন বইমেলার জন্য বেশ কিছু বই প্রকাশের আয়োজন করছেন — তাই তাঁদের নিজেদের মনোনীত বইগুলি যাতে সঠিক সময়ে বেরোয় সেই বিষয়ে তাঁদের নজর ছিল অনেক বেশি। ফলে নাম - না-জানা লেখক হিসেবে আমি তাঁদের হিসেবের বাইরে চলে যেতে লাগলাম ক্রমশ। বলতে গেলে আমার পক্ষে সে এক অকূল পাথার। এর মধ্যেই বইয়ের প্রচ্ছদ হাতে এসে গেল একদিন।
কিন্তু সে প্রচ্ছদ কোথায় কেমনভাবে ছাপা হবে ? এই সংশয় আর দুশ্চিন্তায় যখন দিশাহারা অবস্থা সেই সংকট থেকে আমায় উদ্ধার করলেন ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকার সম্পাদক তথা প্রাণপুরুষ প্রভাত চৌধুরী। প্রাথমিকভাবে তাঁর একটু হাল্কা অভিমান ছিল, কেন আমি বইটা তাঁদের প্রকাশন থেকে প্রকাশ করছি না। কারণ, ওই সময় ‘কবিতা পাক্ষিক’ পত্রিকা নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করে সাড়া ফেলে দিয়েছে ও স্বল্প দামে বিভিন্ন কবিদের কবিতার বই প্রকাশ করতে শুরু করেছে, যেগুলির প্রচ্ছদ ও সার্বিক প্রকাশনার গুণমান ছিল চমৎকার। আজকের খ্যাত লেখিকা যশোধরা রায়চৌধুরীর প্রথম বই ‘পণ্য সংহিতা’ প্রকাশ হয়েছিল ওই ‘কবিতা পাক্ষিক’ এর ঘর থেকেই । যাই হোক, ওই প্রাণবন্ত প্রিয় মানুষটি ওসব মান-অভিমান বেশিক্ষণ মনে রাখতেন না। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সব সমস্যার সমাধান করে দিলেন। তাঁদের প্রকাশনার বইয়ের কভার যেখানে তৈরি ও ছাপা হচ্ছিল সেখানেই তিনি বলে-কয়ে ব্যবস্থা করে দিলেন আমার জন্য। কলেজ স্ট্রিট এলাকার প্রধান প্রধান রাস্তাগুলোর পেছনে যে-সব পাড়া, গলি ও তস্য গলি আছে তা এতদিন আমার পায়ে হেঁটে চেনার সুযোগ ঘটেনি। প্রধানত বড় রাস্তার আশেপাশের দোকান, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এগুলোতেই ঘোরাফেরা করেছি। এবার নতুন ভাবে আবার চিনলাম কলেজ স্ট্রিট আর তার বইপাড়া। এখানে বলে রাখা দরকার, নিজের বই প্রকাশনার এই পর্বে অফিস থেকে কলেজ স্ট্রিট এলাকায় আসা ও ফেরত যাওয়া পুরোটাই ছিল পদব্রজে, এর পেছনে যে কোনো ব্রত ছিল এমন নয় —-- আসলে অফিসের অবস্থান থেকে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছানো ও ফেরত আসার জন্য উপযুক্ত বাস পাওয়া যেত না। তার কারণ ওই অঞ্চলের বিভিন্ন রাস্তায় একমুখী যানচলাচল ব্যবস্থা। তাই ‘কানাই ধর লেন’ নামক যে রাস্তায় প্রচ্ছদ সংক্রান্ত কাজে আমায় যেতে হত তাতে পৌঁছানোর শর্টকাট রাস্তা যে কুখ্যাত ‘হাড়কাটা গলি’ যার সরকারি নাম প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট এটা আমায় হোঁচট খেতে খেতেই চিনে নিতে হয়েছিল। দুপুরবেলায় হাড়কাটা গলি যে সাধারণ পথচারীদের পক্ষে খুব বিপদের তা মনে হয়নি। এইসময় লালবাতি পাড়ার বাসিন্দারা মূলত গলির পুরোটা জুড়ে স্নান, কাচাকুচি বা নিছক রোদ-পোয়ানো ও নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি ঠাট্টা-ইয়ারকি করেন, যার সবটাই খুব ‘নিরামিষ’ নয় , এটা আমার অভিজ্ঞতা। নিশ্চয়ই গলির পরিবেশ খুব স্বাস্থ্যকর নয়, দিনে-দুপুরেও সেখানে মাতালদের উপদ্রব চোখে পড়েছে, কোথাও উঁচু গলায় গালিগালাজ, ঝগড়া এসবও যে দেখিনি তা নয় — তবে এগুলো ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের নিজস্ব ব্যাপার। পথচারী মানুষের প্রতি তাঁদের কোনো বেচাল কিছু করতে দেখিনি। মাননীয় পাঠকদের একটু মনে করিয়ে দিই, এই হাড়কাটা গলিতে যেসব বাড়ি যৌনকর্মীদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার হয় সেই বাড়িগুলির মালিক কলকাতার অনেক বিত্তবান মানুষ, যাদের কাছে এগুলি এক ধরনের বিনিয়োগ। বাড়িভাড়া ও এই আদিম ব্যবসার লাভের একটা অংশ তাঁদের কাছেই যায়। ঠাকুরবাড়ির প্রথম কৃতী পুরুষ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরও একসময় এখানে কিছু বাড়ি কিনে তা বিনিয়োগ হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। যারা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসটি পড়েছেন তাঁদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, ওই আখ্যানের ‘ভূমিসুতো’ নামক তরুণী চরিত্রটিও এই এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন।
আমার একদিনের কথা মনে আছে, যেদিন ওই আঁকাবাঁকা গলি দিয়ে কানাই ধর লেনে ঢুকে পড়ার গলিটা আমি কেমন করে যেন ভুল করে ফেলি, ফলে পথ হারিয়ে এসে পড়ি লালবাতি পাড়ার একদম কেন্দ্রে যেখানে প্রতিটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একদল রূপোপজীবিনি — ভরদুপুরে তাঁদের অনেকেরই পোশাক শিথিল ও বিস্রস্ত। সেই মুহূর্তে আমার ঠিক কী করা উচিত, এই ভেবে স্নায়ু টানটান হয়ে যেতে থাকে। আমি কি তাহলে যে পথে এসেছি সেই পথেই ফিরে যাব ? কিন্তু আমায় বেশি কিছু ভাবার সুযোগ না দিয়েই কয়েকজন মহিলা ( পেশায় যৌনকর্মী হলেও তাঁদের কি মহিলা বলে উল্লেখ করা আভিধানিক নয়? ) আমার দিকে এগিয়ে এসে আমায় অত্যন্ত সুভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করেন, আমি কাউকে খুঁজছি কি না। আমি বিনীতভাবে জানাই, কানাই ধর লেনে যেতে চাই রাস্তাটা একটু ভুল হয়ে গেছে। তাঁদের মধ্যে একজন আমার সঙ্গে কিছুটা এসে সঠিক গলিটা আমায় চিনিয়ে দিয়ে ফিরে চলে যান। কলকাতার লালবাতি পাড়ার যারা খবর রাখেন তাঁরা জানেন, ‘হাড়কাটা গলি’ হল কলকাতার লালবাতি এলাকার মধ্যে সি-গ্রেড, এখানকার বাসিন্দারা তুলনায় নিচুশ্রেণির, তাঁদের স্ট্যাটাস ও রেট তুলনায় অনেক কম। কিন্তু এইসব তো রাতের গল্প আর হিসেবনিকেশ —- দিনের বেলায় তাঁদের আচারে-ব্যবহারে অবশ্য এই শ্রেণিগত বৈষম্য আমার সেদিন চোখে পড়েনি। এই ঘটনার পরে আরও অনেকদিন আমি পথিক হিসেবে ওই পাড়া অতিক্রম করে গেছি। দেহজীবী মহিলাদের ‘অসভ্য’ জটলা দেখে নিজের মধ্যে অনুভব করেছি এক অপরাধবোধ, একটা কবিতার বই ছাপিয়ে সেই মানবিকতার অবমাননাকে কতদূর প্রতিহত করা যায় ?
যাই হোক , প্রচ্ছদের প্রাথমিক কাজ শেষ হয় একদিন। রঙের ব্যবহার কেমন হবে সেই বিষয়ে প্রচ্ছদশিল্পী হিসেবে প্রমোদদার একটা অনুমোদন দরকার ছিল, তাও পেয়ে যাই যথাসময়ে। এর পরের গন্তব্য ‘চাঁপাতলা ফার্স্ট বাই লেনে’র ছাপাখানা যেখানে ছাপা হবে এই প্রচ্ছদ। কিন্তু প্রচ্ছদের কাগজ কী হবে, জিজ্ঞাসা করলেন প্রভাত চৌধুরী। জানতে চাইলেন, পুস্তানির কাগজ কীরকম মানের দিতে চাও? বলা দরকার, তিন ফর্মার কবিতার বইয়ের প্রুফ দেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পর পরই ‘রক্তকরবী’ প্রকাশন আমার বই নিয়ে তাঁদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তাঁরা তখন আসন্ন বইমেলায় নিজেদের অন্য বই নিয়েই বেশি বেশি যুক্ত । সত্যি বলতে কি, বইয়ের এসব টেকনিক্যাল বিষয় তখন আমি জানতাম না। সবটাই শিখলাম প্রভাত চৌধুরীর স্নেহচ্ছায়ায়। বৈঠকখানা রোডের কাগজপট্টিতে তিনিই প্রায় হাত ধরে নিয়ে গেলেন আমায়। যখন কম্পিউটার ও প্রিন্টারের ব্যবহার প্রায় অপরিহার্য হয়ে গেল তখন প্রিন্টারের কাগজের গুণমানের সঙ্গে জি এস এম ( গ্রাম/ স্কোয়ার মিটার) এর সম্পর্কের কথা পরে জেনেছি। কিন্তু কাগজপট্টিতে এর হিসেব ছিল অন্যরকম। প্রিন্টার- প্রযুক্তির আগে ‘কত কেজি’-র কাগজ তার ওপর নির্ভর করত কাগজের গুণ। এছাড়া ম্যাপলিথো বা বন্ড পেপার কিংবা একজিকিউটিভ বন্ড পেপারের তফাত কীরকম তাও ঘুরে ঘুরে তখন চিনেছি। চিনেছি পুস্তানিতে কেমন কাগজ দিতে হয়, প্রচ্ছদ ছাপার বোর্ড-কাগজ হয় কত রকমের, বইয়ের ‘স্পাইন’ থাকলে একরকম প্রচ্ছদ, না-হলে আরেক রকম। এইসব খুঁটিনাটি দিনের পর দিন পথে ঘুরেই শেখা। এই কাগজের গুণমান চেনা বিষয়ে অন্য একটা প্রক্ষিপ্ত প্রসঙ্গ টেনে আনার লোভ সামলাতে পারছি না। নিজের বইয়ের কাগজ কিনতে নিয়মিত বৈঠকখানা এলাকার কাগজপট্টিতে ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ত কিছু কিছু দোকানে বর্গাকার আকারের নিউজপ্রিন্টের লালচে কাগজ বান্ডিল বেঁধে বিক্রি হচ্ছে। তখন আজকের মতো লিগ্যাল, এ-ফোর, লেটার, এ-ফাইভ এইসব কাগজের মাপজোক কিছুই জানা ছিল না। একদিন দর করে দেখলাম, একেকটা বান্ডিলে প্রায় পাঁচশো করে শিট আছে, বিক্রি হয় একশোর বান্ডিলের হিসেবে। দুশোর বান্ডিল কিনলেও দামে প্রচুর সস্তা পড়ে, অন্ততপক্ষে সেই সময় যেসব ফুলস্কেপ কাগজ আমরা নিয়মিত লেখার জন্য ব্যবহার করতাম তার তুলনায় । একবার কিনেই ফেললাম। লিখতে গিয়ে দেখলাম কালি বা জেল পেনে ওই কাগজে লেখা চলে না, তাতে কালি শুষে নেয় —- কিন্তু বল পেনে লিখতে কোনো অসুবিধেই নেই। লেখার কাঁচামালে সাশ্রয় করব বলে ব্যবহার করতে শুরু করলাম ওই নিউজপ্রিন্ট। যে কোনো লেখার পান্ডুলিপি ওই কাগজেই করি, পত্রিকা দফতরে জমা দিই। ধাক্কা খেলাম একদিন। কবি মঞ্জুষ দাশগুপ্ত একবার কী একটা বিষয়ে লেখা চেয়েছিলেন, তাঁকে ওই লাল কাগজে লেখা পান্ডুলিপি দিতেই উনি আমায় স্নেহভরে খুব ভর্ৎসনা করলেন কেন এরকম সস্তা কাগজে আমি পান্ডুলিপি তৈরি করেছি? একটু কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, আনন্দবাজার অফিসে সাংবাদিকদের দেখেছি, এইরকম নিউজপ্রিন্টে লেখার কপি তৈরি করে। শ্রদ্ধাভাজন কবি বললেন, খবরের কাগজের ‘কপি’ আর তোমার লেখা কি এক হল ? কোনোদিন যেন আর না দেখি, এইরকম কাগজে পান্ডুলিপি না-করতে। আদেশ শিরোধার্য করে তারপর থেকে আমি কিনতে থাকি দামি বন্ড পেপার যাতে দেওয়া থাকে হাতির জলছাপ আর তাতেই তৈরি হতে থাকে আমার পরবর্তী লেখালিখির পান্ডুলিপি — যতদিন না পর্যন্ত ল্যাপটপ ও বাংলা লেখার সফটওয়ার ‘জীবনসঙ্গী’ হয়ে ওঠে। এই ঘটনার অল্প পরেই চোখে পড়ে বুদ্ধদেব বসুর লেখা —- যেখানে তিনি লিখবেন লেখার কাগজে বিষয়ে তাঁর অসম্ভব শৌখিনতার বৃত্তান্ত। রিপন কলেজের চাকরি তখন তিনি হারিয়েছেন — তবু নিজের লেখার জন্য তিনি খুঁজে পেতে কিনে আনেন দামি লেখার কাগজ আর ঝর্ণা কলমের নিবের সঙ্গে সেই কাগজের সখ্যে নির্মিত হতে থাকে তাঁর একেকটি আশ্চর্য কবিতা ও গদ্য।
যাই হোক, আবার মূল কথায় ফিরি । বই-প্রকাশের ওই শেষ একটা পর্যায়ে বৈঠক খানার কাগজ-পট্টি থেকে কাগজ-কেনা, তারপর সেই কাগজ মুটের মাথায় চাপিয়ে প্রেসে পৌঁছে দেওয়া সব কিছুরই দায় এসে পড়ল আমার ওপর। যাই হোক, একদিন ওই চাঁপাতলা ফার্স্ট বাই লেনের অপরিসর গলির এক প্রিন্টিং প্রেসে ছাপা হল বইয়ের প্রচ্ছদ। এবার বাঁধাইখানা। তারও মুশকিল আসান হলেন অভিভাবক ও তরুণদের ভরসা ওই প্রভাতদা। ততদিনে ‘রক্তকরবী’ প্রকাশনা নিজেরা আমার বইয়ের ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলেছেন, এমনকি বইমেলা ১৯৯৫-এ তাঁদের প্রকাশিতব্য বইয়ের ছাপানো তালিকাতেও আমার বইয়ের নাম তাঁরা ছাপেননি। কেবল আমারই উদ্যোগে ছাপানো ফর্মা এনে জমা করেছেন নিজেদের অফিসে। সেই দড়ি দিয়ে বাঁধা ফর্মা আর প্রচ্ছদ ও পুস্তানির কাগজ হাতে-টানা রিকশায় চাপিয়ে আমিই পৌঁছে দিয়েছি কানাই ধর লেনেরই এক বাঁধাইখানায়। সেই বাঁধাইখানার ব্যবস্থা ও দাম-দর সবই ঠিক করেছেন প্রভাত চৌধুরী । গত বছর (২০২২) কবিতা জগতে সকলের প্রিয় প্রভাতদা আমাদের ছেড়ে গেছেন তবু আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের এক কবিযশোপ্রার্থী তরুণের একান্ত সহায় হয়েছিলেন তিনিই। প্রমোদ বসুও আর আমাদের মধ্যে নেই। রয়ে গেছে শুধু এইসব রামধনু স্মৃতিকথন।
জানুয়ারি-৯৫ এর কলকাতা বইমেলায় আমার সেই ক্ষীণতনু কবিতার বই ‘তৃষ্ণার দ্বিতীয় প্রচ্ছদ’ প্রকাশিত হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু মেলায় অবস্থিত ‘রক্তকরবী’ প্রকাশনার স্টলে তাঁরা আমার বই রাখেননি। বরং নিজেদের প্রকাশিত বইয়ের সারির পাশে আমার বইটিকে সাদরে জায়গা করে দিয়েছিল ‘কবিতা পাক্ষিক’ তাঁদের অপরিসর স্টলে। এটা সাধারণভাবে ‘কলকাতা বইমেলা’-র রীতির মধ্যে পড়ে না —- তবু প্রভাত চৌধুরী দেখেছিলেন একটি প্রকাশনা সংস্থার কথার খেলাপে আমি নিজেই বইয়ের বান্ডিল নিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে মেলার মাঠে ঢুকছি আর বই কোথাও রাখার জায়গা না-পেয়ে অপমানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া একই সঙ্গে নির্মম ও সদাশয় —-- আলো-অন্ধকারের এই বিপরীত খেলা দেখার অভিজ্ঞতা জুড়ে গেছে আমার জীবনের সঙ্গে।
(ক্রমশ)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৭ মে
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।