এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  স্মৃতিচারণ  স্মৃতিকথা

  • কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি 

    প্রবুদ্ধ বাগচী লেখকের গ্রাহক হোন
    স্মৃতিচারণ | স্মৃতিকথা | ২১ মে ২০২৩ | ৮০১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি 
    প্রবুদ্ধ বাগচী 

    (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

    পর্ব ১১

    ইতিহাসের পাতা ওলটালে দেখা যাচ্ছে ১৮১৭ সালে ‘হিন্দু কলেজ’  প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কলেজ স্ট্রিট এলাকার শিক্ষাগত ঐতিহ্যের সূত্রপাত। তখন অবশ্য ‘হিন্দু কলেজ’ যা পরবর্তী সময়ে ‘হিন্দু স্কুল’ ও ‘প্রেসিডেন্সি কলেজ’ আজকের জায়গায় অবস্থিত ছিল না। বর্তমান বাড়িতে ‘প্রেসিডেন্সি কলেজ’ সম্পূর্ণ সরকার শাসিত একটি শিক্ষাসত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৫৫ সালে, এর পরে ১৮৫৭ সালে ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা হলে ‘প্রেসিডেন্সি কলেজ’ কে তার অন্তর্ভুক্ত একটা কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর প্রায় দুশো বছর পরে ২০১০ সালে ‘প্রেসিডেন্সি কলেজ’ স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।   ১৮১৮ সালেই গড়ে ওঠে ‘হেয়ার স্কুল’ আর ‘সংস্কৃত কলেজ’ তৈরি হয় ১৮২৪ সালে। ‘কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৩৫ সালে। তবে কলেজ স্ট্রিট নামের এই রাস্তাটি সরকারিভাবে নির্মাণ করা আরম্ভ হয় ১৮২১ সালে, শেষ হয় ১৮২২- এ —-- বউবাজার এর ওয়েলিংটন মোড়ে গণেশ চন্দ্র এভিনিউএর সংযোগস্থল থেকে শুরু হয়ে মহাত্মা গান্ধী রোড পর্যন্ত বিস্তৃত এই প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তাটি তারপর থেকে দুশো বছর ধরে ধারণ করে আছে শিক্ষা সংস্কৃতি রাজনীতি ও বাঙ্গালির মেধাচর্চার কেন্দ্র হিসেবে। এই মুহূর্তে মাত্র আড়াইশো মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে তিনটি শতাব্দী প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত ভারতের আর কোথাও নেই। তবে এইসব খবর আজ সবাই জানেন, প্রাসঙ্গিকভাবে সেগুলো নতুন করে শুধু উল্লেখ করলাম মাত্র। 

              বরং অন্য একটা কথা এর আগের কোনো পর্বে বলেছিলাম যে বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলন বা রাজনীতি চর্চার একটা পরিচিত কেন্দ্র হিসেবে কলেজ স্ট্রিট এলাকার পরিচিতি যথেষ্ট। ইতিপূর্বে বইপাড়ার বৃহত্তর এলাকার মধ্যে কানাই ধর লেন ও চাঁপাতলা ফার্স্ট  লেনের দুটি প্রেস ও বাঁধাইখানার কথা বলেছি। স্বদেশী যুগের গোড়ার দিকে যে বিখ্যাত  ‘যুগান্তর’ পত্রিকা প্রকাশ হয়েছিল (১৮ মার্চ, ১৯০৬)  তাদের দফতর ছিল ২৭, কানাই ধর লেনের একটি তিনতলা বাড়িতে, বাড়িটির ভাড়া ছিল মাসে ২৮টাকা । পরে ওই পত্রিকার অফিস স্থানান্তরিত হয় কাছেই ৪১, চাঁপাতলা ফার্স্ট লেনে। তবে অনেকেরই এই তথ্য অজানা নয় যে ‘যুগান্তর’ সাপ্তাহিক পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে কারোর নাম প্রকাশিত না হলেও আসলে এই পত্রিকার মূল কান্ডারী ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের অনুজ দত্ত, প্রকাশক ছিলেন অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন্দ্র কুমার ঘোষ। এই ভূপেন্দ্রনাথ মানুষটিকে নিয়ে আমাদের বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে চর্চা হয়েছে অত্যন্ত কম । অথচ স্বদেশী যুগের বিপ্লবী আন্দোলন তো বটেই পরবর্তী সময়ে ভারতে সাম্যবাদী আদর্শকে যে সব ব্যক্তিত্ব দেশীয় রাজনীতির মঞ্চে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে এই শ্রদ্ধেয় মেধাবী মনীষীর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর অগ্নিস্রাবী লেখনীর জোরেই ‘যুগান্তর’ পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ১৭/১৮ থেকে একসময় (১৯০৭) পঁচিশ হাজারে পৌঁছায়। এই আগুয়ান বিপ্লবী সেই বিরল নেতাদের একজন যিনি গ্রেফতার হওয়ার পরেও ব্রিটিশ-শাসিত আদালতে নিজের আত্মপক্ষে সওয়াল করে জামিন নিতে অস্বীকার করেন। আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, ‘দুঃখিনী জন্মভূমির জন্য যা কর্তব্য বুঝেছি, তা করেছি — আপনারা যা ইচ্ছা করুন’ । সচরাচর বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত ‘রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন’ কর্তৃপক্ষ স্বদেশী বিপ্লবীদের বিষয়টিকে একটু এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করেন —- কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের জন্মভিটেতে তাঁরা কয়েকবছর আগে যে সুন্দর একটি মিউজিয়াম তৈরি করেছেন সেখানে স্বামীজীর অনুজ ভূপেন্দ্রনাথের একটি মূর্তি তাঁরা রেখেছেন। 

     স্বাভাবিক এইটাই যে তৎকালীন আরো পত্র-পত্রিকার মতোই ‘যুগান্তর’ রাজরোষে পড়েছে বারবার এবং তাই নিজেদের ঠিকানা বারবার বদল করতে হয়েছে তাঁদের। এই পত্রিকার পরের ঠিকানাগুলোও কলেজ স্ট্রিটের এলাকার বাইরে নয় —-- প্রথমে ২৯/১, মির্জাপুর স্ট্রিট ও সবশেষে ৭৫, কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিট ( আজকের বিধান সরণী)।   এমনকি এই পত্রিকা ছাপানোর জন্য কাগজ সরবরাহ করতেন বিখ্যাত বাঙালি কাগজ ব্যবসায়ী ‘ভোলানাথ দত্ত অ্যান্ড সন্স’ — আজও এই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের দোকান আছে ক্যানিং স্ট্রিটের চিনেবাজার এলাকায়। এর আগে বৈঠকখানা এলাকার কাগজপট্টিতে ঘুরে বেড়াবার সময় এই নামটির সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়। এখানে একটা অন্য কথা বলে রাখা দরকার। একসময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত দুটি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকের অন্যতম ছিল ‘যুগান্তর’ পত্রিকা যা ১৯৯১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। সেই ‘যুগান্তর’ বাংলা দৈনিক  পত্রিকার সঙ্গে আমাদের এই ‘যুগান্তর’ পত্রিকার কিন্তু কোনো প্রত্যক্ষ যোগ নেই। তবে পরোক্ষ যোগ আছে। কাহিনিটা হল, ভূপেন্দ্রনাথ সম্পাদিত এই পত্রিকা ধারাবাহিক রাজরোষে পড়তে পড়তে একসময় বন্ধ হয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে ইংরিজি  ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র কর্তৃপক্ষ, যার সূত্রপাত হয়েছিল শিশিরকুমার ঘোষের হাতে পূর্ব বাংলার যশোরে —- তাঁরা ‘যুগান্তর’ নামে একটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ওই নামটি ইতিমধ্যেই নথিভূক্ত হয়ে যাওয়ায় তাঁর স্বত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধে দেখা দেয়। এই সময় জানা যায়, পুরোনো ‘যুগান্তর’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর সাহিত্যিক শিবরাম চক্রবর্তী ১৯২৩ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময়কালে ওই নামের স্বত্ব কিনে নিয়ে সেই মতো সরকারের কাছ থেকে ডিক্লারেশন  নেন এবং কিছুদিন ‘যুগান্তর’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশও করেন। যদিও সেই পত্রিকাও বেশিদিন চলেনি, কিন্তু তাঁর নামের স্বত্ব তখনও শিবরামের হাতে। এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ র মালিক তুষারকান্তি ঘোষ তাঁর বাগবাজারের অফিসে শিবরাম চক্রবর্তীকে ডেকে তাঁর থেকে মাত্র পাঁচশো টাকার ওই নামের স্বত্ব কিনে নেন এবং নতুন করে দৈনিক ‘যুগান্তর’ প্রকাশ হতে থাকে।

     কলেজ স্ট্রিট এলাকা থেকে প্রকাশিত আরেকটি উল্লেখ্য পত্রিকা হল কাজি নজরুল ইসলাম সম্পাদিত অর্ধ - সাপ্তাহিক পত্রিকা (সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হত) ‘ধূমকেতু’ —- যার প্রথম সংখ্যার জন্য শুভেচ্ছা কবিতা লিখে দিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। গোড়ার দিকে ৩২, কলেজ স্ট্রিট থেকে প্রকাশ হতে থাকে ‘ধূমকেতু’, কিছু পরে তা চলে যায় ৭, প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনে ( মেডিক্যাল কলেজের বিপরীতে)। মনে করে নেওয়া যেতে পারে এই প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনেই জীবনের শেষ পর্বে থাকতেন বঙ্কিমচন্দ্র, এখানেই তাঁর প্রয়াণ ঘটে (১৮৯৪)। ঠিক কলেজ স্ট্রিটের মধ্যে না হলেও ৯৩/১, বৌবাজার স্ট্রিট এই এলাকা থেকে খুব একটা দূরে এমনও নয়। এই ঠিকানাতেই একসময় প্রতিষ্ঠিত ছিল ‘চেরী প্রেস’ যার মালিক ছিলেন পাইকপাড়া রাজ পরিবারের কুমার অরুণচন্দ্র সিংহ। এই প্রেসের ঠিকানাতেই দফতর ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস সম্পাদিত ‘নারায়ণ’ ও ‘বিজলি’ পত্রিকার অফিস। দেশবন্ধুর রাজনৈতিক শিষ্য সুভাষচন্দ্র বসু এক সময় নিয়মিত এই প্রেসে আসতেন, তখন তিনি কলকাতা পুরসভার মেয়র। সুভাষচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী  ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ (১৯২৮)  দলের আলাপ আলোচনা ও মিলনকেন্দ্র ছিল ‘বেণু’ পত্রিকার অফিস, যার অবস্থান ছিল ৯৩/১/এফ, বৈঠকখানা রোড। সকলেই স্মরণ করতে পারেন, এই ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’এর সদস্য ছিলেন রাইটার্স বিল্ডিং-এর অলিন্দ অভিযানের তিন নায়ক বিনয়-বাদল-দীনেশ। ‘বেণু’ পত্রিকার অফিসে দীনেশ গুপ্তর নিয়মিত যাতায়াত ছিল। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের পরে (১৯৩০) সেই অভ্যুত্থানের অন্যতম সেনানী বিপ্লবী গণেশ ঘোষ একসময় কিছুদিন পুলিশের নজর এড়াতে এই ‘বেণু’ পত্রিকার দফতরে আত্মগোপন করে ছিলেন। ১১০ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের বাড়িটিও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন —-- এই বাড়িতে নিয়মিত রাজনৈতিক বৈঠকে আসতেন বাঘা যতীন, আসতেন বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা।  আজকের  ‘কফি হাউস’ তৈরি হওয়ার আগে ওই বাড়িটি পরিচিত ছিল ‘অ্যালবার্ট হল’ হিসেবে — এই সভাঘর ছিল বাঙালির জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এক উল্লেখ্য কেন্দ্র। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রায় সব পরিচিত নেতাই এই সভা গৃহে কোনো না কোনো ইসুতে বক্তৃতা দিয়েছেন, সভা করেছেন। এছাড়া প্রাক স্বাধীনতা আমলে কলেজ স্ট্রিটের অন্যান্য রেস্টুর‍্যান্ট ঘিরেও যে রাজনৈতিক কাজকর্ম হত, সে কথা আগের একটি পর্বে বলা হয়েছে।

    স্বাধীনতা আসার একেবারে শেষ দশকে অর্থাৎ ১৯৪৫- সন থেকে কলকাতা ছিল রাজনৈতিক মিটিং মিছিল গণ-আন্দোলন সব কিছুর একেবারে কেন্দ্রে। ওই বছর (১৯৪৫) আজাদ হিন্দ বাহিনীর গ্রেফতার হওয়া সদস্যদের লালকেল্লায় বিচারের  প্রহসনের বিরুদ্ধে কলকাতার ছাত্র-যুবরা পথে নামে। তারপর থেকে স্বাধীনতা পেরিয়ে উত্তর স্বাধীনতা যুগের যেসব আন্দোলন বিক্ষোভে বাংলা উত্তাল হয়েছে তার উল্লেখ্য কেন্দ্র হিসেবে উঠে আসে দুটি এলাকা । একটা কলেজ স্ট্রিট, অন্যটা ধর্মতলা চত্বর। পরে এসপ্ল্যানেড ইস্ট বলে চিহ্নিত এলাকার নাম হয়েছে ‘সিধহু কানহু ডহর’, অন্যদিকের অংশ নাম পেয়েছে ‘রাণী রাসমণি রোড’, তারও পরে মেট্রো সিনেমার বিপরীতে জমায়েতের জায়গার নাম জুটেছে ‘মেট্রো চ্যানেল’, অন্যপ্রান্তে ‘ওয়াই চ্যানেল’ । কিন্তু একটা সময় এসপ্ল্যানেড বলতে ধর্মতলা এলাকার সবটাই বোঝাতো। আর কলেজ স্ট্রিট ছিল ছাত্রদের প্রতিবাদ আন্দোলন জমায়েতের স্বাভাবিক পছন্দ। পাঁচের দশকে বা ছয়ের দশকে যেসব রাজনৈতিক আন্দোলন কলকাতার বুকে বারবার আছড়ে পড়েছে তার মূল ভরকেন্দ্র ধর্মতলা এলাকা হলেও এগুলোর প্রত্যক্ষ অভিঘাত এসে পড়েছে কলেজ স্ট্রিট এলাকায়। ষাটের দশকের শেষ দিকে তৎকালীন বিশ্বব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান তথা ভিয়েতনামের যুদ্ধে মার্কিন দেশের প্রধান পরামর্শদাতা রবার্ট ম্যাকনামারার কলকাতা আসা রুখতে শহরের বাম ছাত্রযুবরা যে নজির রাখা  আন্দোলন করেন তারও কেন্দ্র ছিল কলেজ স্ট্রিট। এর সমকালে এবং তার পরে প্রায় এক দশক অবধি কলেজ স্ট্রিট বাংলার রাজনৈতিক সংগ্রামের শিরোনামে থেকেছে মূলত নকশালবাড়ি আন্দোলনের সমর্থক ছাত্রদের সূত্রে। এর একটা কারণ এটাই যে প্রেসিডেন্সি কলেজের একদল মেধাবী ছাত্র তখন এই আন্দোলনে নিজেদের সহমর্মিতা জানিয়ে এতে যুক্ত হন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে শোনা, একটা সময় ভবানী দত্ত লেনে (প্রেসিডেন্সি কলেজের পাশের গলি) নকশালপন্থীদের এতদূর প্রভাব ছিল যে দিনের বেলাও পুলিশ সেখানে ঢুকতে সাহস পেত না। পরে অবশ্য তাদেরই কারোর বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগ নিয়ে পুলিশ সেখানে ঢুকে বেশ কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে, যাদের স্মরণে নির্মিত  শহিদ বেদি আজও দেখা যাবে ওই রাস্তার মুখে। সম্প্রতি কথাসাহিত্যিক সুপ্রিয় চৌধুরীর উদ্যোগে ভবানী দত্ত লেনের ওই শহিদ বেদির সংস্কার করা হয়েছে —-- সারা রাজ্যেই এই ধরনের ‘নকশালপন্থী শহিদ-স্মারক’ গুলি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এই বিষয়ে তাঁর লেখা ‘স্মৃতি বিস্মৃতির শহিদ বেদি’ বইটি আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।   অন্যদিকে একটা সময় নকশালপন্থীদের মধ্যে যেসব ভুল বা রাজনৈতিক অর্থে ‘বিচ্যুতি’  দেখা দিতে থাকে তার পরিণামে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীত দিকে বিদ্যাসাগর মূর্তির মাথা কাটা যেতে থাকে নিয়মিত। এই দুর্ভাগ্যজনক ‘কুকীর্তি’ র সঙ্গেও জড়িয়ে থাকে কলেজ স্ট্রিট। 

           আশির দশকের গোড়ায় যখন আমাদের কলেজ স্ট্রিট চত্বরে আসা যাওয়া শুরু হয় তখন রাজ্যে বামফ্রন্টের শাসন। বেশিরভাগ কলেজের ছাত্র-সংসদ তাদের ছাত্র সংগঠন এস এফ আই এর দখলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও মোটামুটিভাবে দলের ‘ইয়েসম্যান’ হিসেবেই নির্বাচিত হতেন, তবে তা সরকারি রীতিনীতি মেনেই। দলীয় ‘আনুগত্য’ থাকলেও তাঁদের কাউকে অবশ্য আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা ইদানিংকার মতো আর্থিক-দুর্নীতি বা নিয়োগ-দুর্নীতিতে জড়িয়ে কারাবাস করতে দেখিনি । উপাচার্য নির্বাচনের  এই  রীতি-রেওয়াজে আকস্মিক ছন্দপতন ঘটে যখন তৎকালীন রাজ্যপাল অনন্তপ্রসাদ শর্মা রাজ্য সরকারের পাঠানো প্যানেল থেকে ডঃ সন্তোষ ভট্টাচার্য-র নাম বেছে নিয়ে তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করেন। বামপন্থী শিক্ষামহলে সন্তোষ ভট্টাচার্য অপরিচিত নাম ছিলেন এমন নন, তিনি এক সময় সি পি আই দলের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, কমিউনেও থাকতেন। কিন্তু যাকে তখন বলা হত ‘আলিমুদ্দিনের লোক’ তিনি ঠিক সেইরকম ছিলেন না। ফলে এই ঘটনা রাজ্যের শাসকদলের পক্ষে ছিল এক বিরাট ‘বেইজ্জতি’ যা তারা মেনে নিতে এতটুকু প্রস্তুত ছিল না। তৎকালীন রাজ্যপালমশাইও যে খুব নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন এমন নয়। প্রথম জীবনে রাজ্যপাল অনন্তপ্রসাদ শর্মা পূর্ব রেলের টিকিট পরীক্ষক হিসেবে হাওড়ায় পোস্টিং ছিলেন। রেল-দফতরের কংগ্রেস-সমর্থিত শ্রমিক সংগঠন করার সূত্রে দিল্লিতে তার যোগাযোগ বাড়ে এবং কংগ্রেস হাইকমান্ড এর কৃপাধন্য হয়ে তিনি রাজ্যের রাজ্যপাল পদটি ‘উপহার’ পান। রেল শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা হিসেবে রাজ্যের আই এন টি ইউ সি সংগঠক ও হেভিওয়েট কংগ্রেস নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সখ্য ছিল, শোনা যেত সুব্রতবাবু নাকি প্রায়ই সন্ধ্যের দিকে রাজভবনে পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে আসতেন।
     
    উপাচার্য নির্বাচন বিষয়ে ‘প্রকৃত ঘটনা’  কী ছিল তা নিয়ে সেই সময় নানা সংবাদপত্রে নানান রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল । সব প্রতিবেদনই যে খুব বস্তুনিষ্ঠ ছিল, তেমন নাও হতে পারে। কারণ, ওই সময়টায় কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রায় সব বাংলা সংবাদপত্রই ছিল ‘সরকার-বিরোধী’ তথা বামফ্রন্টের সমালোচক। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবু প্রায়ই বলতেন, বেশ কিছু বাংলা সংবাদপত্র তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও অপপ্রচার করছে। তবে এই বিষয়ে একটা ভাষ্য পাওয়া যায়, তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ তথা পরিচিত শিক্ষাবিদ অমল কুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখায়। তিনি লিখেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে বামফ্রন্ট তথা সি পি আই এম- সমর্থিত উপাচার্য প্রার্থী রমেন্দ্রকুমার পোদ্দার সদস্যদের ভোটে প্রথম পছন্দের প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হন। এই পরাজয়ের পেছনে আসলে ছিল, শরিক দলগুলির সমর্থিত সিনেট সদস্যদের ক্ষোভ —- তাঁরা ‘সিপিআইএম এর একতরফা দাদাগিরির’ বিরোধিতা করে রমেন্দ্র বাবুর বিরুদ্ধে ভোট দেন, ফলে দ্বিতীয় পছন্দের প্রার্থী সন্তোষ ভট্টাচার্য প্রথম তালিকায় উঠে আসেন। সেদিক দিয়ে  ‘আচার্য’  হয়তো অনৈতিক কিছু করেননি। তবে অমল কুমার মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য মেনে নিলেও এই উপাচার্য বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ‘আচার্য’ হিসেবে সম্ভবত একটা ‘কাস্টিং ভোট’ এর বিষয় ছিল — সেইখানে  তিনি এমন একটা কাজ করেছিলেন যাতে সরকারের প্রথম পছন্দের মানুষটি নির্বাচিত না হতে পারেন। অন্তত রাজ্যের শাসকদল এই নিয়ে রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ‘অগণতান্ত্রিকতা’র অভিযোগ তুলেছিল।   মনে রাখতে হবে, ১৯৮২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার তখন আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, অন্যদিকে রাজ্যের বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেস কিছুটা হতোদ্যম। এই অবস্থায় সরকারকে চটিয়ে দেওয়ার মতো কিছু কাজ করে  রাজভবনের বাসিন্দা তার পুরোনো দলকে একটু উজ্জীবিত করার ব্রত নিয়েছিলেন কি না, সেটা ভেবে দেখার বিষয়। তবে জলে যে ঢিল পড়ল তা বোঝা গেল অচিরেই।

    গোটা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে শুরু হল বিক্ষোভ আন্দোলন যার কেন্দ্র কলেজ স্ট্রিটের ক্যাম্পাস কারণ উপাচার্য-র অফিস সেখানেই। উপাচার্য- র পদত্যাগ ও অপসারণ চেয়ে যে বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল অকুতোভয়  উপাচার্য প্রথমে তা গ্রাহ্য করলেন না। ফলে বিরোধ বেড়েই চলল। একদিকে শাসকদলের তোল্লাই পেয়ে এস এফ আই এর তুমুল আন্দোলন, অন্যদিকে উপাচার্যের ‘একরোখা’ মনোভাব পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল করে তুলল। অবশেষে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে গিয়ে ছাত্রদের থেকে তিনি শারীরিক বাধা পেলেন, তিনি ফিরে গেলেন নিজের বাড়ি এবং ঘোষণা করলেন, বাড়ি থেকেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন। আমাদের স্মরণে আছে কলেজ স্ট্রিট ঘিরে এইসব কাজকর্মের স্মৃতি। এটাকে ‘ছাত্র আন্দোলন’ বলা যাবে কি না সেই সময়ে এটা নিয়েও কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের প্রতিষ্ঠান ও পঠন-পাঠন-পরীক্ষা-সিলেবাস এসব সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে আন্দোলন বিক্ষোভ করতেই পারে, কিন্তু কে উপাচার্য হবেন, কোন পদ্ধতিতে হবেন, সেখানে কী ত্রুটি ছিল এগুলো কি তাদের বিবেচনার আওতায় পড়ে? প্রশ্নগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার নয়, কারণ সিনেট সিন্ডিকেটে তখন ছাত্র প্রতিনিধিও থাকতেন —- ন্যায্য বা অন্যায্য বিষয়ে তাঁদের মত রাখার সুযোগ তো ওই প্রতিষ্ঠানের ভিতরেই ছিল । তাছাড়া ‘গণতন্ত্রের প্রশ্ন’ তুললে আশির দশকে বা তার পরের সময় বিভিন্ন কলেজের ছাত্রসংসদগুলিতে কেমনভাবে ‘গণতান্ত্রিক প্রথায়’  নির্বাচন পরিচালিত হয়েছিল তার প্রতিতুলনা এসেই যায়। অবশ্য ‘গণতান্ত্রিক প্রথা’ মেনে চলে হচ্ছে না এই কারণে গত একদশক রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ব্যবস্থাটাই স্থগিত করে রাখা হয়েছে —- প্রথমে ‘লিংডো কমিশন’ এর গাইডলাইন মেনে চলার কথা বলা হলেও এখন সবটাই বিশ বাঁও জলে। এ নিয়ে আর বাড়তি মন্তব্য করে লাভ নেই। 

          কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ডামাডোলে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম নষ্ট হচ্ছিল। ঠিক সময় পরীক্ষা, ফলপ্রকাশ কোনোটাই সুষ্ঠুভাবে হতে পারছিল না, ক্ষতি হচ্ছিল পড়ুয়াদের। আসলে উপাচার্য ও ছাত্র সংগঠন ( বকলমে শাসক দল) দুজনেই ছিলেন অনড়, ফলে ব্যাপারটা ছিল ‘পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন’ । ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৭, এই চার বছর চলেছিল এই গোলমাল যতদিন না চিকিৎসক অধ্যাপক ডঃ ভাস্কর রায়চৌধুরী পরের উপাচার্য হিসেবে দায়ভার না নেন। ডঃ রায়চৌধুরী ছিলেন নামজাদা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ, তবে শাসকদলের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল সুবিদিত। তবে তাঁর পদানসীন হওয়ার পরে শাসক দলের ‘রাজনৈতিক ইগো’ পরিতৃপ্ত হয়, এর অল্প পরে ‘বিতর্কিত’ আচার্য এপি শর্মাও রাজ্য ছাড়েন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক হতে থাকে।   আশির দশকের প্রথমার্ধে, কলেজ স্ট্রিট এলাকা উদ্বেল হয়েছিল আরেকটি যে আন্দোলনে তা হল জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন  (১৯৮২) যার নেতৃত্বের একটা বড় অংশ ছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। রাজ্যের সমস্ত মেডিক্যাল কলেজে এর প্রভাব পড়লেও স্বাভাবিকভাবে তার কেন্দ্রে ছিল কলেজ স্ট্রিট ও কলকাতা। আশির দশকের রাজনৈতিক আঙিনায় এটা ছিল স্বতঃসিদ্ধ যে, সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন সরকার ভালো চোখে দেখতেন না। তাই জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের ক্ষেত্রেও প্রথম দিকে সরকার ‘সহনশীল ভূমিকা’ দেখালেও পরে সরকার ও শাসকদলের ‘ক্যাডার-বাহিনী’ মেডিক্যাল কলেজগুলিতে হানা দিয়ে আন্দোলনকারীদের হেনস্থা করতে শুরু করেন। অবশ্য সেই আন্দোলনের দাবিগুলি ছিল সম্পূর্ণ জনস্বার্থের অনুকূল, যার নেতৃত্বে ছিলেন মূলত নকশালপন্থী প্রভাবিত চিকিৎসকদের সংগঠন যাদের নেতৃত্বের অ্যাকাডেমিক কেরিয়ার ছিল উজ্জ্বল। সরকারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ন্যায্য আন্দোলনের ডাক দিলে আজও অবশ্য সরকার একইভাবে তার ‘উত্তর’ দিয়ে থাকেন, তবে কালের নিয়মে ও রুচির বিকারে তার চরিত্র আজ আরও অধোগামী ও হিংস্রতর।
      
    আশির দশকেই রাজ্যের তৎকালীন সরকার রাজ্যে দুটি শিল্প কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তখন প্রাক- বিশ্বায়ন যুগের ‘লাইসেন্স রাজ’ পুরোদমে কার্যকরী, কেন্দ্রের সরকারের সুনজরে না থাকলে রাজ্যের পক্ষে শিল্প তৈরির অনুমোদন পাওয়া ছিল মুশকিল। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কেন্দ্রে আশির দশকের শুরু থেকেই ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকার, তার পরেই রাজীব গান্ধীর সরকার। সংগত কারণেই রাজনীতির পার্থক্য থাকায় রাজ্য-কেন্দ্র বিরোধ ছিল তখনকার একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার। ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’ ছিল তখনকার সংবাদপত্রের একটা বড় ইসু, এটা নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ বিদ্রূপ কার্টুন করা হত সংবাদপত্রে। অনেক পরে, ব্যক্তিগতভাবে নানান তথ্য ঘেঁটে ও শ্রদ্ধেয় অশোক মিত্রের নানা প্রামাণ্য রচনা পড়ে  আমার মনে হয়েছে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে কেন্দ্রের সরকার অনেক ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকারকে প্রকৃতই বঞ্চনা করেছেন, তাঁদের ন্যায্য পাওনা দিতে অস্বীকার করেছেন। আজকেও এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখছি। তবে রাজ্যের শাসকদল একটা সময় অবধি এটা নিয়ে ‘রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড’ পেতে চেষ্টা করে গেছে এবং হঠাৎ করেই নব্বই দশক থেকে প্রসঙ্গটা নিজেরাই চাপা দিয়ে দিয়েছে, কারণ আমাদের কারোরই জানা নেই। কিন্তু যে সময়ের কথা বলছি, তখন রাজ্যের প্রস্তাবিত দুই কারখানা ‘হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যাল’ ও ‘বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র’ নিয়ে রাজ্যের শাসক দল ঠিক করেছিলেন তাঁদের ছাত্র ও যুব শাখার মাধ্যমে রক্তদানের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করে ও মানুষের থেকে অনুদান সংগ্রহ করে একটি মোটা তহবিল গড়ে তা ওই শিল্প কারখানার জন্য দান করবেন। এটা মূলত একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি যার ধাক্কা এসেছিল কলেজ স্ট্রিটেও। বড় মাপের রক্তদান শিবির, মানুষের থেকে অনুদান সংগ্রহ কর্মসূচি ( আজ যাকে বলে ক্রাউড ফান্ডিং) এইসব কান্ড কারখানা ঘটেছে কলেজ স্ট্রিটেও। এগুলোকে সাবেকি ছাত্র আন্দোলনের পর্যায়ে ফেলা যাবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকবে, কেবলমাত্র তথ্যের খাতিরে এগুলোর উল্লেখ জরুরি। 

        আসলে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও ঘোরাফেরা থেকে বুঝেছিলাম, রাজ্যে বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেসের তখন এতটাই ছন্নছাড়া অবস্থা, এবং তৃতীয় কোনো শক্তিও দৃশ্যমান নয় , এমন একটা স্থিতাবস্থার খোলা মাঠে আন্দোলন করার মতো বিষয় তো ছাত্র-যুবদের সামনে ছিল না। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও বেনিয়ম নিয়ে কথা বললে তার তির ঘুরে যায় শাসক দল ও সরকারের দিকে —- সুতরাং ওই পথে যাওয়ার ভাবনা নৈব নৈব চ। তাহলে ছাত্র সমাজ করবেটা কী? শিল্প স্থাপনের জন্য রক্তদান? অনুদান জোগাড় করে কারখানা তৈরি ? হ্যাঁ, যেহেতু এখানে মূল আলোচ্য কলেজ স্ট্রিট চত্বর তাই আরেকটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেই ফুরিয়ে যাবে আমাদের এবারের পর্ব। সেটা এই, যে, কলেজ স্ট্রিটকে কেন্দ্র করে যেসব কলেজ তার আশেপাশে আছে তার মধ্যে কিছু কিছু কলেজে ( যেমন, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, বঙ্গবাসী কলেজ, চিত্তরঞ্জন কলেজ, সিটি কলেজ ) এগুলিতে সেই সময়েও ছাত্র পরিষদের প্রভাব ছিল। মধ্য কলকাতা এলাকার কিছু ‘বাহুবলী’ স্বনামধন্য কংগ্রেস নেতা এইসব কলেজগুলি তখনও নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফলে ছাত্র সংসদের নির্বাচন ঘিরে এখানে প্রায়শ লেগে থাকত গোলমাল —- যুযুধান দুই পক্ষ এস এফ আই ও ছাত্র পরিষদ। সেইসব গণ্ডগোল ঘিরে বোম পড়া, রাস্তায় পাথর ছোঁড়া,  আগ্নেয়াস্ত্র  নিয়ে দাপাদাপি এসবও বাদ ছিল না। আশির দশকের কলেজ স্ট্রিট এইসব কুরুক্ষেত্র যুদ্ধেরও প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আজ অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এলেও এই বাস্তব অবস্থার অনুল্লেখ উচিত হবে না বলেই বিধেয়। 
    ( ক্রমশ ) 
     
    পরের পর্ব প্রকাশিত হবে  ৪ জুন 

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • স্মৃতিচারণ | ২১ মে ২০২৩ | ৮০১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন