এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  স্মৃতিচারণ  স্মৃতিকথা

  • কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি - ৬

    প্রবুদ্ধ বাগচী লেখকের গ্রাহক হোন
    স্মৃতিচারণ | স্মৃতিকথা | ১২ মার্চ ২০২৩ | ১০৩৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি
    প্রবুদ্ধ বাগচী

    (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

    পর্ব ৬

    উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাঠ্যক্রমে আমাদের যে সব কবিতা পড়তে হত তাদের মধ্যে সব থেকে আধুনিক কবি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও জীবনানন্দ দাশ। বুদ্ধদেব বসুর  ‘শীতের প্রার্থনা, বসন্তের উত্তর’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ’আমি কবি যত কামারের’  জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা আমাদের পাঠ্যবইয়ে ছিল, যদিও আমরা যে বছর পরীক্ষার্থী ছিলাম সেই বছর ওই কবিতাগুলি সিলেবাসে ছিল না। তখন নিয়ম ছিল, একেক বছর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কবিতা নির্বাচন করে দেবে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ ।  ফলে সিলেবাসের কবিদের বাইরে আর কারোর কবিতা পড়ার কোনো অভিজ্ঞতা আমাদের হয়নি। আমাদের বাংলা মাস্টারমশাইরাও কোনোদিন বাংলা ভাষার অন্য কবিদের বিষয়ে আমাদের কিছু বলেননি। এটাও এখানে খেয়াল করে দেখবার বিষয়, জীবনানন্দ দাশ বা প্রেমেন্দ্র মিত্র কিংবা বুদ্ধদেব বসু কিন্তু মূলত গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের কবি বলেই পরিচিত —-- অথচ পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আশির দশকের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বাংলা কবিতার পাঠ্যক্রমে এদেরকেই ধরে নেওয়া হচ্ছে ‘আধুনিকতম কবি’ যেন এঁদের পরে আর কেউ বাংলা কবিতা লেখেননি।এর থেকে বোঝা যায়, সাহিত্যর জগতে সমকালীন লেখক-কবিরা কেমনভাবে ব্রাত্য হয়ে থাকেন, আমাদের রাজ্যে। অথচ, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কিন্তু এমন হয় না। আশির দশকেও পদার্থবিদ্যার পাঠ্যক্রমে ‘মডার্ন ফিজিক্স’ এর আওতায় আমরা খুব বুনিয়াদি স্তরের কিছু ‘সলিড স্টেট ফিজিক্স’ পড়েছি, মাধ্যমিকের ঐচ্ছিক গণিতের সিলেবাসে ‘মডার্ন অ্যালজেব্রা’ হিসেবে ‘সেট থিওরি’ র সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে গিয়েছিল।  সাহিত্যের অ্যাকাডেমিক সিলেবাসে সমকালীন সাহিত্যিকদের বাদ রাখার পেছনে শিক্ষাবিদ বা সিলেবাস-প্রণেতাদের কী দর্শন কাজ করে তার নাগাল পাওয়া আমার- আপনার কম্ম নয়। অথচ আদপে কিন্তু আশির দশকে মধ্যভাগে বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য কবিরা সকলেই সক্রিয়ভাবে লেখালিখির মধ্যে ছিলেন। বাড়িতে ‘দেশ’ পত্রিকা রাখার সুবাদে সেইসব কবিদের কিছু কিছু নাম যে জানতাম না, তা নয়। তবে আলাদা করে কবিতা পড়ার কোনো তাগিদ অনুভব করেছি, এমনটাও  নয়। 

    যাদবপুরে ভর্তি হওয়ার পরে কবিতার প্রতি আলাদা সম্ভ্রম ও আগ্রহ যে তৈরি হতে লাগল তার প্রধান কারণ সেখানকার সাংস্কৃতিক পরিবেশ। পোস্টারে, দেওয়াল লেখায়,  হ্যান্ডবিলে তথা ছাত্র সংগঠনগুলির প্রকাশিত পত্রিকায় বহু জায়গায় সরাসরি কবিতার উদ্ধৃতি চোখে পড়তে লাগল। মায়াকোভস্কির কবিতার লাইন ‘আজকে তুমি তোমার কথাই বলো/ কাল ভোরে সেটাই হবে জনগণের ভাষা’ বিরাট একটা পোস্টারে আটকানো থাকত বেঙ্গল ল্যাম্প গেটের সামনে আর্টস ফ্যাকাল্টির ছাত্র সংসদের সামনে । ‘নিভন্ত এই চুল্লিতে মা একটু আগুন দে’ ছাপা হয়েছিল এক পোস্টারে। ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না’ উচ্চকন্ঠে ক্লাসের মধ্যে আবৃত্তি করত আমাদেরই এক সহপাঠী। আর ‘রাজা আসে যায় / নীল জামা গায়/ লাল জামা গায়/ শুধু পোশাকের রং বদলায়/ শুধু মুখোশের ঢং বদলায়/ দিন বদলায় না’ — এই কবিতা আমাদের তরুণ মেজাজে একেবারে যেন সাইক্লোন তুলে দিয়েছিল। আসলে  তরুণ বয়সে সব কিছু অস্বীকার করা, প্রচলিত নিয়ম-নীতি-প্রতিষ্ঠান- রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা সব কিছু ভেঙে তছনছ করার একটা প্রবৃত্তি জেগে ওঠে, ইচ্ছে হয় সব কিছুর তুমুল প্রতিবাদে নিজেদের ডানা মেলে দিই। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় এই উপাদানগুলি সবই ছিল। এর আগের পর্বে ‘বন্দিমুক্তি কমিটির’ একটি ছোট কবিতা সংকলনের চতুর্থ প্রচ্ছদে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অসম্ভব ভাল একটা কবিতার কথা বলেছি । তবে একটু বড় আয়তনে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সেই আমাদের নিবিড় পরিচয়, কিন্তু প্রথম নয়। প্রথম নয়, কারণ, আমাদের বাড়িতে ছিল সুবিখ্যাত সেই কবিতা সংকলন ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ যার সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু । তথ্য হিসেবে জানিয়ে রাখা দরকার সত্তর বছর আগে প্রকাশিত (১৯৫৩) এই সংকলনে বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের তিনটি গানকে এখানে কবিতা হিসেবে স্থান দিয়েছিলেন, কবিতার মূল্যেই গ্রহণ করেছিলেন সুকুমার রায়ের লেখা পাঁচটি ছড়া।  চমৎকার বাঁধাই, হাল্কা শেওলা রঙের প্রচ্ছদে সোনার জলে বইয়ের নাম লেখা সেই বইয়ে সংগৃহীত হয়েছিল বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা — ‘মুখোস’---- সেই কবিতার শেষ দুটি পঙক্তি ছিল : ‘হে যুবক, হে যুবতী পৃথিবীতে তোমাদের কতটুকু দান ?/ কান্নাকে শরীরে নিয়ে কার ঘরে কয় ফোঁটা দিয়ে গেলে আলো ?’ । নিঃসন্দেহে এই ধরনের উচ্চারণ আমাদের কাছে বেশ নতুন বলে মনে হয়েছিল।    তথ্য হিসেবে এটাও বলা দরকার ওই বছরেই (১৯৮৫)  কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হন। ফলে সেই সময়ে তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন মহলে নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছে। অনেক পত্র-পত্রিকা তাঁকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা বা স্মরণ-সংখ্যা প্রকাশ করছে। কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে অচ্ছেদ্য যে নাম ‘পাতিরাম বুক স্টল’ ততদিনে তার হদিশ পেয়ে গেছি আমরা। সব পত্রিকা কিনতে না পারি, হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখতে পাচ্ছি নিয়ত।

    শঙ্খ ঘোষ ও বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার বই কেনা ও পড়ে উদ্দীপ্ত হওয়ার পরে আমাদের দু-তিনজন বন্ধুর মনে হয়েছিল, সদ্য প্রয়াত কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে আমরাও কি কিছু করতে পারি না ? এই জিজ্ঞাসার জবাব পাওয়া খুব সহজ ছিল এমন নয়। প্রকাশনা করতে গেলে লেখা লাগবে, তা ছাপতে অর্থ লাগবে —- কে জোগাবে সেই সব? এই প্রাথমিক প্রশ্নের সমাধান নিয়ে আমরা কয়েকদিন খুব বিচলিত হয়ে রইলাম যদিও ইচ্ছেটাকে জিইয়ে রেখেছিলাম পুরোদমে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এই মূল সমস্যার নিষ্পত্তি হয়ে গেল সহজেই। শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদ- সাপ্তাহিক সম্পাদনা করতেন আমাদের স্কুলের এক বাংলার মাস্টারমশাই, তিনি নিজে যে খুব একটা কবিতা-ভক্ত ছিলেন এমন নয়, কিন্তু সেই পত্রিকায় আমরা কেউ কেউ হাত পাকানোর জন্য মাঝে মাঝে লিখতাম। কার্যত আমাদের সাহিত্যর মাস্টারমশাইরা কেউই নিয়মিত কবিতা পড়তেন বলে মনে হয় না। একবার আমার সাইকেলের কেরিয়ারে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইটি দেখে আমাদের ইংরিজি সাহিত্যের একজন শিক্ষক সেটি হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে মন্তব্য করেছিলেন, এই কবিকে তিনি চেনেন না ! যদিও দশকওয়ারী হিসেব করলে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মূলত চল্লিশ দশকের কবি বলেই পরিচিত যার সমকালীন কবি হিসেবে রয়েছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ । যাই হোক ওই বাংলার মাস্টারমশাই-কাম-সম্পাদকের কাছে আমাদের প্রস্তাব ফেলামাত্র তিনি তাঁর এইসব তরুণ প্রাক্তন ছাত্রদের দাবি মেনে নিলেন। তাঁর প্রস্তাব হল, তোরা লেখা জোগাড় কর, ছাপার দায়িত্ব আমার। এখানে বলা দরকার ওই শিক্ষকের নিজের একটি প্রেস ছিল, সেখান থেকেই তিনি তাঁর নিজের পত্রিকা ছাপাতেন।  

    কিন্তু বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-কে নিয়ে লেখা জোগাড় হবে কেমন করে? কলকাতার নামী লেখক-কবিদের তো আমরা কেউই  তেমন চিনি না, তাঁরাও চেনেন না, আমাদের মতো অনামী তরুণদের। তাহলে কীভাবে তাঁদের কাছে পৌঁছে যাব আমরা ? কীভাবে,  কোন পরিচয়ে লেখা চাইব তাঁদের কাছ থেকে ? যে সংবাদ-সাপ্তাহিকের পক্ষে এই উদ্যোগ তা নিতান্তই মফসসল এলাকায় পরিচিত পত্রিকা, মহানগরের আঙিনায় তো ওই পত্রিকার কোনো পরিচিতিই নেই, তাহলে ? এই সমস্যারও সমাধান হয়ে গেল অচিরেই।  
    আমাদের এক ঘনিষ্ঠ বৃত্তের বন্ধু সেবার জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার মেডিক্যাল শিক্ষার  সুযোগ পেয়ে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিল। ডাক্তারির মেধাবী ছাত্র হয়েও কবিতা বা সাহিত্য বিষয়ে তার আগ্রহ কম ছিল না। ওই বন্ধুটির নিজের জামাইবাবু, যিনি ব্যাঙ্কে কাজ করতেন, তাঁর ছিল নাটক-কবিতা-গান-সাহিত্য-চলচ্চিত্রের  প্রতি সবিশেষ আগ্রহ। কলকাতায় চাকরি করার সূত্রে তাঁর অনেক যোগাযোগও ছিল। নিজের কনিষ্ঠ শ্যালকের এই আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে তিনি নিজেও এগিয়ে এলেন আমাদের সঙ্গে —- তিনি আমাদের সকলের প্রিয় ভাস্করদা (ভাস্কর চৌধুরী)। কার্যত তিনি না থাকলে আমাদের এই বেপরোয়া স্বপ্ন দিনের আলো দেখত না। সেই ভাস্করদারই  সূত্রে তাঁর পরিচিত ও বন্ধুস্থানীয় ব্যাঙ্ককর্মী আরেক খ্যাত কবি শ্যামল সেন এগিয়ে এলেন আমাদের উৎসাহ জোগাতে। আমাদের প্রস্তাবিত  স্মরণ-গ্রন্থের নাম ও প্রচ্ছদ সবই ছিল এদের দুজনের সানন্দ সহযোগিতার ফসল। আর ওই সংকলনের লেখা জোগাড় করার সূত্রেই নতুন করে আবার ফিরে এল কলেজ স্ট্রিট। 

    এখন যেখানে অসমাপ্ত ‘বর্ণপরিচয়’, আগে সেটাই ছিল সাবেকি কলেজ স্ট্রিট মার্কেট। তার অন্দরমহলে বিচিত্র সব শাড়ি, গয়না, কসমেটিক্স ,  বাসন, জুতোর দোকানের আড়ালে দুয়েকটা প্রকাশনা সংস্থার অফিসও ছিল। এক সময়ের প্রগতি শিবিরের নামী পত্রিকা ‘অগ্রণী’ তখন নতুন পর্যায়ে আবার প্রকাশ হতে আরম্ভ করেছে —- তাদের অফিস ও প্রকাশনা সংস্থা ‘অগ্রণী বুক ক্লাব’ ছিল এখানেই, ছিল ‘হরফ’ প্রকাশনা সংস্থা, যাদের মালিক ইসলামধর্মী হলেও ইসলামী বইয়ের পাশে পাশে বাংলায় ‘বেদ’, ‘উপনিষদ’ প্রকাশ করতেন। আর, এই বাজারেরই পশ্চিম প্রান্তে ছিল ‘বসন্ত কেবিন’ নামের এক রেস্টুরেন্ট। শনিবার সন্ধ্যেবেলা সেখানে নরক গুলজার করতেন একদল কবি, লেখক —- চেতনাগতভাবে যারা সকলেই ছিলেন বামমনস্ক এবং সকলেই প্রায় একটা সময় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে চিনতেন। সম্ভবত ‘ক্রান্তি প্রকাশন’-এর অফিস ছিল এই বাজারের মধ্যেই, সেই সূত্রে কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এখানে নিয়মিত আসতেন। এই আড্ডার হদিশ দিয়েছিলেন ভাস্করদা ও কবি শ্যামল সেন। সুতরাং নতুন উদ্যমে শুরু হল নিয়মিত কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় ঘোরাফেরা। ‘বসন্ত কেবিন’ এর আড্ডায় আমাদের মতো নবাগতদের আশ্রয় পেতে কোনো অসুবিধে হয়নি। হয়তো কবি শ্যামল সেনের সূত্র এখানে কাজ করে থাকতে পারে। 

     আর আমাদের প্রস্তাবিত সংকলনের কথা শুনে অনেকেই আমাদের উদ্যোগে সামিল হয়ে লেখা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।  শুধু তাই বা বলি কেন, অনেকে আবার আরো নতুন নতুন যোগাযোগের সন্ধান দিলেন আমাদের। এই সূত্রে চিনলাম,  ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকার নবীন কুন্ডু লেনের অফিস। ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকা তখন বীরেন্দ্র-সমগ্র প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে স্বল্প আলাপ হয়েছিল, তবে অত নামী পত্রিকার খ্যাত সম্পাদক-মশাই আমাদের এই ‘সীমাবদ্ধ’  বীরেন্দ্র- স্মরণে খুব একটা পাত্তা দেননি। তোমরা আবার এসব করার কে হে ? মুখে না বললেও তাঁর এমন একটা ভঙ্গিমা আমাদের তরুণ চোখে অব্যর্থভাবে ধরা পড়েছিল। তুলনায় সহ-সম্পাদক রঞ্জিত সাহা (নিজের নামের এই বানানই তিনি লিখতেন, ‘রণজিৎ’  নয়)  ছিলেন অনেক অমায়িক, যিনি লেখা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমাদের। দমদম রোডের সি আই টি আবাসনে থাকা সাদাসিধে গণিতের মাস্টারমশায় ছিলেন রঞ্জিত —-- অনেক পরে জানতে পারি রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহের কথা, সেই সঙ্গে গণিতচর্চার সূত্রে তিনি যে একটি বিশেষ স্কলারশিপ নিয়ে কিছুদিন বিলেতে কাটিয়ে আসেন তা-ও জানি । বরানগর এলাকার প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও প্রশিক্ষক শংকর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সখ্যের সূত্রে নজরুল মঞ্চ (কামারহাটি)-র একটি গানের অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় বহু বছর পরে।    ‘সত্তর দশক’ পত্রিকার সম্পাদক চন্দন ঘোষ নিজে শুধু লেখা দেননি, পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন কবি সমীর রায় ও সৃজন সেনের সঙ্গে। সমীর রায়ের সন্ধান পেতে গেলে যেতে হত ‘বুকমার্ক’ প্রকাশনার  দফতরে, ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট এর পাশে। কবি হিসেবে সমীর রায়ের বেশ নাম ছিল, রাজনীতির সূত্রে তিনি জরুরি অবস্থার সময় কিছুকাল কারাবাসও করেন — কিন্তু মানুষ হিসেবে তাঁর তুলনা ছিল না। আমাদের মতো তরুণদের যেভাবে তিনি প্রশ্রয় দিয়েছিলেন তা আমাদের কাছে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। সমীর রায়ের কবিতার বই ‘রণপায়ে হেঁটে যাব’ ছিল সুপরিচিত, তার বিখ্যাত কবিতা ‘হাসেমচাচা’ তখন আবৃত্তি-শিল্পীদের কাছে ছিল অবশ্য-পাঠ্য। তুলনায় সৃজন সেন ঠিক অতটা যে আমাদের সঙ্গে মিশেছিলেন এমন নয় —- ‘অনুষ্টুপ’ প্রকাশন থেকে বেরোনো তাঁর কবিতার বই ‘থানা গারদ থেকে মা-কে’ তখন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখা তিনি দিয়েছিলেন। লেখার সূত্রেই যোগাযোগ হয়েছিল কবি ও অনুবাদক কমলেশ সেনের সঙ্গে, সে ওই কলেজ স্ট্রিটেই — ইনিও ছিলেন  অহংহীন এক চমৎকার মানুষ। আশুতোষ কলেজের ইংরিজির অধ্যাপক সৌম্যদর্শন কবি অমল চক্রবর্তী আসতেন ‘বসন্ত কেবিন’ এর শনিবার সন্ধ্যের আড্ডায় —-- নৈহাটির বাসিন্দা এই কবি আড্ডা শেষে শেয়ালদহ থেকে ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতেন। খুব একটা প্রচারের আলোয় তিনি ছিলেন না, কিন্তু কবিতা লিখতেন বেশ ভাল। আমাদের সংকলনে তিনিও তাঁর লেখা দিয়েছিলেন। ওইখানেই আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল কবি অমিত চক্রবর্তীর সঙ্গেও। কবি একলব্য চট্টোপাধ্যায়ও আসতেন ওই ‘বসন্ত কেবিন’ এর আড্ডায় —- ইনি পরে ‘মা লো ভী’ নামক একটি কবিতা আন্দোলনের প্রবক্তা হয়ে উঠেছিলেন।  'কথাশিল্প' প্রকাশনার কর্ণধার অবনী রায়ের সঙ্গেও এই সূত্রে আলাপ হয় আমাদের। শ্যামাচরণ দে স্ট্রীটের এই বিখ্যাত প্রকাশনা দফতর একসময় মাতিয়ে রাখতেন বিশিষ্ট সব মানুষরা। শুনেছি, রণেন রায়চৌধুরীর মতো লোক সঙ্গীত গায়করা সন্ধেবেলা এখানে গান শোনাতে আসতেন। অবনী রায় ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। তিনি সেই সময় বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মণিভূষণ ভট্টাচার্যের একটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ ‘একটি ঐতিহাসিক পদযাত্রা’ প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর সহযোগিতায় কবি মণিভূষণের লেখা জোগাড় করা আমাদের পক্ষে সহজ হয়।  আসলে সংকলন প্রকাশের জন্য লেখা জোগাড় করাতাগিদে  এইসব আনাচ-কানাচ সেই কয়েক মাস আমরা চষে ফেলেছিলাম আর এরই সূত্রে শুধু ‘কলেজ স্ট্রিট’ নামের এক প্রাচীন রাস্তা নয় আসলে আমাদের মনের মুকুরে ধরা পড়ছিল একটা সাংস্কৃতিক জনপদ। এর পরে আরো নানা প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে কলেজ স্ট্রিট এলাকার আরো অলিগলি চিনেছি ও ঘুরেছি অজস্রবার। তবে শুরুটা বোধহয় হয়েছিল কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক সঙ্কলনের সূত্রে। 

    এখানে একটা কথা বলে রাখি। ওই সময়টায় না হলেও, পরে জেনেছি, কলেজ স্ট্রিট এলাকায় ‘বসন্ত কেবিন’ রেস্টুরেন্ট আসলে তিনটে। একটা হেদুয়ার মোড়ে, বিডন স্ট্রিট ও বিধান সরণীর সংযোগস্থলে। দ্বিতীয়টা হল পুরোনো কলেজ স্ট্রিট বাজারের ভিতর, যার কথা একটু আগেই বলেছি। তৃতীয় ‘বসন্ত কেবিন’ এর অবস্থান কলুটোলা স্ট্রিট ও কলেজ স্ট্রিটের সংযোগস্থলে মেডিক্যাল কলেজের বিপরীতে। ‘বর্ণপরিচয়’ তৈরি হওয়ার পরে দ্বিতীয় ‘বসন্ত কেবিন’ এর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে, প্রথম ‘বসন্ত কেবিন’ টিমটিম করে টিকে থাকলেও তার হাতবদল ও কৌলীন্যবদল ঘটেছে। তিন নম্বর ‘বসন্ত কেবিন’ অবশ্য এখনো টিকে আছে। সেখানে একটা সময় পর্যন্ত শনিবার সন্ধ্যে ৬টা থেকে ৯টা নিয়মিত কবি-লেখক-শিল্পীদের আড্ডা জমত, তাতে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা অন্যপর্বে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে। তবে কোভিড-পর্বে সুদীর্ঘ লকডাউন ও রেস্টুরেন্টে মেলামেশা করার তথাকথিত ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স’ আপাতত সেই সান্ধ্য আড্ডার যতি টেনে দিয়েছে বলেই শুনতে পাই।
     
    লেখা জোগাড় করার পাশাপাশি প্রেসে তা ছাপার কাজও এগিয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে। সমস্যা হল প্রচ্ছদ ছাপায়। আগেই বলেছি, সেই সময়ের মুদ্রণ-প্রযুক্তি ছিল আজকের তুলনায় মান্ধাতার আমলের। আর, ওই সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ছাপা হত ট্র্যাডল মেশিনে। ফলে প্রচ্ছদ ছাপতে গেলে আগে দরকার প্রচ্ছদের ছবির ব্লক বানানোর। এই ব্লক তৈরির কাজটা একচ্ছত্রভাবে হত কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে।  শ্রীরামপুর শহর বাংলা ছাপাখানার আঁতুড়ঘর হিসেবে চিহ্নিত —-- এই শহরের পঞ্চানন কর্মকারই প্রথম ধাতু গলিয়ে সিসার অক্ষর তৈরি করেছিলেন বলে ইতিহাসে লেখা আছে। কিন্তু প্রচ্ছদের ব্লক তৈরির জন্য সেই শহরের মানুষদেরও আসতে হত কলেজ স্ট্রিটে। আবার নতুন করে চিনলাম কলেজ স্ট্রিট। মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে এগোলে আমহার্স্ট স্ট্রিট ( অধুনা রাজা রামমোহন সরণী)-এর ক্রশিং পেরিয়ে বাঁ-ফুটপাথ বরাবর সারিসারি সব ব্লক তৈরির কারিগরদের দোকান। ওই এলাকায় ঘুরে টের পেলাম শুধু শ্রীরামপুর নয়, লোকাল ট্রেনের সূত্রে হাওড়া বা শিয়ালদহ লাইনে কলকাতার শহরতলির বহু জায়গা থেকেই ছাপার ব্লক তৈরির জন্য এখানেই আসতে হয়। আজ এত বছর পরে মুদ্রণ- প্রযুক্তি যেখানে গিয়ে পৌঁছেছে সেখানে প্রচ্ছদ বা রঙিন ছবি ছাপার জন্য এই হাফটোন জিঙ্ক ব্লক- এর প্রয়োজন একদম একটা বড় শূন্যে এসে পৌঁছেছে —-- সেদিনের সেই ব্লক তৈরির কারিগররা আজ কী করছেন, তাঁদের খবর আর কে রাখে ? আর এই সূত্রেই একটু ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখে নেওয়া দরকার উনিশ শতকে এই হাফটোন ব্লক তৈরি ও তা ছাপার প্রযুক্তি যে বাড়িটিতে আবিষ্কৃত হয়েছিল তার ঠিকানা এই কলেজ স্ট্রিটের এলাকা থেকে মোটেও বেশি দূরে নয়। আশা করি, সকলেই চিনতে পেরেছেন,  ১০০ নম্বর গড়পার রোডের সেই বাড়িটি, যেখানে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নামের এক ‘মজার মানুষ’ নিজের খেয়ালে মেতেছিলেন মুদ্রণ-প্রযুক্তি নিয়ে নিত্যনতুন খেলায়, আর সেই উদ্দেশ্যেই  তিনি পুত্র সুকুমারকে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন মুদ্রণ- প্রযুক্তি নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার জন্যে। বাংলার ছাপাখানায় রঙিন ছবি ছাপানোর প্রথম গৌরব সেই ‘ইউ এন রায় অ্যান্ড সন্স’ এর একতলার ছাপাখানার। 
       
    যাই হোক, সেই ব্লক তৈরির পাড়ায়  পৌঁছে দেওয়া হল প্রচ্ছদের ছবি ও ডিজাইন — আগেই বলেছি এই প্রচ্ছদের ডিজাইন করে দিয়েছিলেন কবি শ্যামল সেন ও আমাদের ‘মেন্টর’ ভাস্করদা। সংকলনটির নাম রাখা হয়েছিল ‘স্মৃতির তরবারি’ —- প্রচ্ছদে হালকা নীল রঙে আঁকা ছিল কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি স্কেচ আর পটভূমি হিসেবে রাখা হয়েছিল কবির নিজের হাতের লেখা একটি কবিতার পাণ্ডুলিপি। এই পাণ্ডুলিপি হাতে পাওয়ার জন্য আমাদের যোগাযোগ করতে হয়েছিল কবির কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীবুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অশিক্ষক কর্মচারী হিসেবে তখন পোস্টিং ছিলেন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ ক্যাম্পাসে। কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকটি কবিতা পুনর্মুদ্রণের অনুমতির জন্য যেতে হয়েছিল ঢাকুরিয়া স্টেশন রোডে কবির বাড়িতে —- কবিপত্নী শ্রীমতী রাণী চট্টোপাধ্যায় সানন্দে তাঁর লিখিত অনুমতি দিয়েছিলেন কবির এই তরুণ ভক্তদের । অবশেষে নির্দিষ্ট দিনে হাতে পাওয়া গেল সেই হাফটোন জিঙ্ক ব্লক, বেশ সুন্দর করে খবরের কাগজে মুড়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে তা তুলে দেওয়া হল আমাদের হাতে। তখনকার নিয়ম অনুযায়ী , এই ধরনের ব্লক ছাপার মেশিনের ‘গ্যালি’-তে আটকে তা ছাপা হত প্রচ্ছদের মোটা  কাগজে। ‘গ্যালি’ ব্যাপারটা এখনকার পাঠকরা মনে হয় জানেন না। ছাপার জন্য  পুরোনো ধরনের ‘ট্র্যাডল’ মেশিনে যে সাইজের পাতা ছাপা হবে সেই মাপের একটা কাঠের কাঠামো তৈরি করে তার মধ্যে সিসের অক্ষরে কম্পোজ করা অংশগুলি রেখে টাইট করে বেঁধে দেওয়া হত, ছবি ছাপার জন্য ব্লক আটকে দেওয়া হত সেখানেই। একেই বলা হত গ্যালি। একটা গোল রং লাগানো চাকতির মধ্যে দেওয়া থাকত ছাপার কালি, যান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটা রোলার ওই রং দেওয়া চাকতির ওপর থেকে রং নিয়ে ওই গ্যালির ওপর সেই রং ছড়িয়ে দিত, তারপরে কাগজ রাখা ট্রে-র ওপর চাপ পরে গ্যালির লেখা ছাপা হয়ে ফুটে উঠত কাগজের গায়ে। বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, এই ব্যবস্থায় দুই বা তার বেশি রঙের প্রচ্ছদ ছাপা হওয়া খুব সহজ বিষয় ছিল না। একটি করে রঙের অংশ ছেপে তা শুকিয়ে গেলে, চাকতিতে দ্বিতীয় রং চাপিয়ে আবার মেশিনে চাপাতে হত আগের ছাপা হওয়া কাগজ। একে প্রেসের পরিভাষায় বলা হত ‘সেকেন্ড ইম্প্রেসন’ ।   কিন্তু এখানেও ছিল একটা সংশয়। যে মেশিনে সংবাদ-সাপ্তাহিকটি ছাপা হত অর্থাৎ ওই ‘ট্র্যাডল মেশিন’ —-- তাতে এই দুই রঙের প্রচ্ছদ কতটা নিখুঁতভাবে ছাপা হবে বোঝা যাচ্ছিল না। এই নিয়ে আমাদের মাস্টারমশাই কিছুটা চিন্তাতেও ছিলেন। যাই হোক,  যে কোনো উপায়ের মধ্যবর্তিতায় অবশেষে একদিন হইহই করে ছাপা হয়ে গেল সেই প্রচ্ছদ —--  সীমিত প্রযুক্তির সহায়তায় ব্যাপারটা যে খুব খারাপ হয়েছিল এমন নয়। পুরো বইটাই এবার চলে গেল বাঁধাইখানায় । আমরা তখন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছি।
     
     নিজেদের সুদীর্ঘ  শ্রম আর উদ্যোগে তৈরি হওয়া একটা স্মারক-সঙ্কলন প্রকাশ যেন বা একটা যুদ্ধজয়। বলে রাখা দরকার, নতুন লেখা না দিতে পারলেও আমাদের সেই সংকলন  ‘স্মৃতির তরবারি’- তে নিজের একটি  বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিষয়ক নিবন্ধ পুনর্মুদ্রণের সানন্দ অনুমতি দিয়েছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। তাঁর কাছে পৌঁছে গিয়ে লেখা চাওয়ার কাজটা আমাকেই করতে হয়েছিল, প্রাথমিক সঙ্কোচ কাটিয়ে অমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন কবির কাছে ( তখন তিনি যাদবপুরে অধ্যাপকও বটে) যাওয়া একটা বিরল অভিজ্ঞতা। অবশ্য তরুণদের প্রতি তাঁর অনাবিল প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত সেই সময়েই পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। একইভাবে চল্লিশ দশকের আরেক প্রখ্যাত কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সহযাত্রী কবি বীরেন্দ্র-র স্মরণে লেখা দিয়েছিলেন আমাদের, লেখা দিয়েছিলেন প্রখ্যাত ভারততত্ববিদ ও অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অতীন্দ্র মজুমদার। কিন্তু আজ এত বছর পরে এই কথা লিখতে বেশ খারাপই লাগছে, আমরা তাঁর বাড়িতে গিয়ে লেখা চাওয়া সত্ত্বেও আমাদের সম্পূর্ণ নিরাশ করেছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় —- এটাও এক ধরনের অভিজ্ঞতা ! কলেজ স্ট্রিটের সূত্রেই এইসব অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার ভরে উঠেছে আমাদের।
     
    কবি বীরেন্দ্রর জন্মদিনে ( ২ সেপ্টেম্বর) ‘বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি’ কলকাতার বাংলা আকাদেমি সভাঘরে তার নামাঙ্কিত পুরস্কার ও স্মারক-বক্তৃতা আয়োজন করতেন। সেই বছর ওই অনুষ্ঠানে আমরা কয়েকজন পৌঁছে গিয়েছিলাম আমাদের এই সীমিত সামর্থ্যে প্রকাশিত সংকলন  নিয়ে। কেউ কেউ আগ্রহ দেখিয়ে কিনেছিলেন, কেউ বা মুখ ফিরিয়ে চলে গিয়েছিলেন। এই প্রতিক্রিয়ার ধরন-ধারন আলাদা করে উল্লেখ করলাম এই কারণে যে ছোট পত্র-পত্রিকা নিয়ে সার্বিকভাবে যে একটা গৌরববোধ আমাদের মধ্যে কাজ করে আসলে তার মধ্যেও আছে একটা শ্রেণিবিভাজন। বাণিজ্যিক পত্রিকার বাইরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে নানান ধরনের পত্রিকা প্রকাশ হয় সারা রাজ্য জুড়ে সেই চল্লিশ বছর আগেও তাদের মধ্যে ছিল একটা কুলীন বা অকুলীন ভেদাভেদ। শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত সংবাদ-সাপ্তাহিকের নাম কলকাতার সাংস্কৃতিক বৃত্তে বহুল প্রচারিত ছিল এমন নয়। তাই এমন একটি অচেনা প্রকাশন থেকে সংকলন প্রকাশ পেলে তা কলকাতার বিদ্বজ্জন-মহলে জাতে ওঠা প্রাথমিকভাবে খুব মুস্কিল। এই কটু সত্যি আমরা টের পেয়েছিলাম সেই অত বছর আগেই। আর এই ছোটখাটো  মফসসলের পত্রিকাকে উপেক্ষার মানসিকতা প্রত্যক্ষভাবে টের পেয়েছি এর পরে। সেই কাহিনিরও পটভূমি ছিল কলেজ স্ট্রিট,  যার বিশদ বৃত্তান্ত বলা হবে এর পরের পর্বে। তবে এত কিছুর মধ্যেও এইটুকু আলোর ঠিকানা এই যে,  ‘বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণ কমিটি’র সেই অনুষ্ঠানের খবর বা যাকে পত্রিকার ভাষায় বলে প্রোগ্রাম রিভিউ, ছাপা হয়েছিল তার দুই সপ্তাহ পরের ‘দেশ’ পত্রিকায় —- সেখানে প্রতিবেদক উল্লেখ করেছিলেন ‘শ্রীরামপুরের তরুণদের উদ্যোগে প্রকাশিত’  এই সংকলনের  প্রকাশবার্তা। তখন সেইভাবে  চিনতাম না, এই ঘটনার অনেক পরে আলাপ হয়েছিল সেই প্রতিবেদকের সঙ্গে —-- তিনি কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। সরস মনের  আড্ডাবাজ ও রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাঙ্ঘাতিক ভক্ত  এই কবির কাছেই শুনেছিলাম কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত সাক্ষাতকারের কথা।  বাঙালির প্রিয় ‘মোহর’ কীভাবে অনুষ্ঠানের আগে সেজেগুজে তার প্রস্তুতি নিতেন, কীভাবে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে জনে জনে জিজ্ঞাসা করতেন ‘আমায় দেখতে সুন্দর লাগছে তো?’ , কেউ ‘বিরূপ মন্তব্য’  করলে কেমনভাবে তিনি হারিয়ে ফেলতেন গানের মুড —- এইসব কিছুই আমাদের একদিন  গল্প করেছিলেন কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়। ব্যক্তিগত জীবনে  তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ —  দুর্ঘটনায় হারিয়ে ছিলেন তাঁর অল্পবয়সী একমাত্র কন্যাকে, তারপর স্ত্রী-কে। লকডাউনের মধ্যে (২০২০)  নিঃশব্দে কবি নিজেও প্রয়াত হয়েছেন।   তারও বেশ কিছুকাল আগে (২০১৩) আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন প্রিয় মানুষ ভাস্করদা। আমাদের পৃথিবী ক্রমাগত নিঃস্ব হয়ে আসছে।  
    (ক্রমশঃ)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • স্মৃতিচারণ | ১২ মার্চ ২০২৩ | ১০৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন