কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি
প্রবুদ্ধ বাগচী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পর্ব ৭
শ্রীরামপুর শহরের সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকলেও তার লাগোয়া যে মফসসল জনপদে আমাদের ছেলেবেলা ও কিশোরকাল কেটেছে সেখানে সেই অর্থে কোনও বিস্তৃত সাংস্কৃতিক কাজকর্মের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেনি। রবীন্দ্র- সান্নিধ্যধন্য এক সঙ্গীত শিক্ষক তাঁর বাড়িতে একটা রবীন্দ্রগানের স্কুল চালাতেন। সেখানে অনেকে গান শিখতে আসতেন, তবে তাঁদের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে তেমন কোনও প্রকাশ্য অনুষ্ঠান, যাতে অনেকে যোগ দিতে পারেন, এমন কখনো চোখে পড়েনি। অন্য দুয়েকটা একটা গান/ নাচের স্কুল ছিল অন্য পাড়ায়। নিতান্তই ঘরোয়া সীমায়িত উদ্যোগ।তারা কেউ কেউ ‘বছরে তিরিশবার’ না হলেও এক আধবার ‘শ্যামা শাপমোচনের অশ্রুমোচন’ করতেন। কোনো ভদ্রমানের ও মাপের প্রেক্ষাগৃহ সেখানে ছিল না, ফলে এইসব অনুষ্ঠান হত নেহাতই ছোট কোনও ঘরোয়া জায়গায় বা অল্প একটু জমিতে মাচা বেঁধে। আর ছিল একটা ছোট সংগঠন ‘নাট্যম’ —-- যারা মূলত বছরে একবার নিজেরা এলাকা থেকে চাঁদা তুলে প্যান্ডেল বেঁধে নাটক অভিনয় করতেন। তবে সেই নাটক অভিনয়ের সঙ্গে কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের ‘নাট্য আন্দোলন’ এর বিন্দুমাত্র সংযোগ ছিল না। এদের প্রযোজনা মানে ‘রামের সুমতি’ বা ‘চোখে আঙুল দাদা’ এইসব প্রযোজনা। তবে এর পাশাপাশি, তাঁরা ব্রতচারী ও ড্রিল এইসব শেখাতেন। তখনকার অভিভাবকরাও আজকের মতো নিজেদের সন্তান সন্ততিদের গান- নাচ- ছবি আঁকা এইসব কোনো একটা শিল্পমাধ্যমে জুড়ে দেওয়ার কথা ভাবতেন কিনা সন্দেহ, কিন্তু এদের ব্রতচারী শিবিরে বেশ অনেকে আসত, আমরাও কিছুকাল ওই ব্রতচারী শিবির ও ব্যান্ড বাজানো শেখা, ড্রিল করা এইসব কাজে যুক্ত হয়েছিলাম। সেই সূত্রেই ‘কেটল ড্রাম’ বা ‘বিগ ড্রাম’ কিংবা ‘বিউগিল’ অথবা ‘ঝাঁঝর’ যন্ত্রগুলিকে কিছুটা নেড়েচেড়ে দেখবার সুযোগ হয়েছিল —-- হাতে কলমে শেখার চেষ্টা করেছিলাম বাঁশি, কিন্তু আধখানা ‘গৎ’ এর বেশি শিখতে পারিনি। তবে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে ওই জনপদের বেশিটাই ছিল পিছিয়ে পড়া, মূলত উদবাস্তু মানুষ, ফলে জীবিকার সংগ্রামে যুক্ত থাকার পরে তাঁদের হাতে কতটা বাড়তি সময় ও অর্থ ছিল, সেটা একটা গভীর অর্থনৈতিক ভাবনার বিষয়।
আর ছিল একটা অ্যামেচার যাত্রাদল, যারা বছরে একবার স্কুলের মাঠে বিরাট তাঁবু ফেলে নিজেদের পালা মঞ্চস্থ করত।প্রধানত সেটা অনুষ্ঠিত হত শিবরাত্রির রাতে। সারারাত অনুষ্ঠান করার বিষয়ে তখন কোনো পরিবেশ বিধির বালাই ছিল না, আর, শিবঠাকুরের উপোসী ভক্তদের সারারাত জাগিয়ে রাখার প্রশ্নে এই বিনোদন ছিল অবিকল্প । গত চল্লিশ বছরে রাজ্যের সর্বত্র দুর্গাপুজো-কে এক বড় মাপের সামাজিক ইভেন্ট হয়ে উঠতে দেখছি আমরা, আমাদের সেই পুরোনো মফসসলে সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ছিল স্থানীয় একটি কালীপুজো । স্কুলের বিশাল মাঠে চারদিক ঘিরে একেক বছর একেক ধরনের আকর্ষণীয় প্যান্ডেল বানিয়ে তাক লাগিয়ে দেওয়া হত দর্শকদের —- আধুনিক পরিভাষায় ‘থিম পুজো’ গড়ে উঠেছিল ওই কালীপুজো ঘিরেই । কোনোবার হয়তো তৈরি হল ‘তাজমহল’, কোনোবার ‘ তারাপীঠের মহাশ্মশান’ নিখুঁত ভাবে গড়ে উঠল ওই মাঠের ভিতর। লোকে লোকারণ্য, ভিড় —- একদিনের কালীপুজো গড়িয়ে যেত চার-পাঁচদিনে। তবে ‘তাজমহল’ এর আদলে গড়া প্যান্ডেলে কালী প্রতিমার অধিষ্ঠান ঘিরে কোনো বিরুদ্ধতা বা গোঁড়া সমালোচনার ভ্রুকূটি কখনো ঘটেছে বলে টের পাইনি। আসলে এই পুজোর অধিনায়ক ছিলেন এলাকার দুই স্বনামধন্য বাহুবলী যুবা, যারা প্রথম যৌবনে ‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে’ পরিণত করার স্বপ্নে মশগুল ছিলেন, পরে তাঁরা শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’-র ‘স্বর্গীয় বিভা’ খুঁজে পেয়ে শ্রীরামপুরের এক ‘নামী’ কংগ্রেসি ট্রেড ইউনিয়ন নেতার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেন। পরে শুনেছি, এদের বলা হত ‘কংশাল’ — আশির দশকে বামপন্থীদের শাসনে তাঁরা রাজনৈতিকভাবে কিছুটা ফিকে হয়ে গিয়েছিলেন —- ফলে পুজোআচ্চা নিয়ে লোক মাতানো ছাড়া তাঁদের তেমন কোনো কাজ ছিল না। তবে একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না, হালের শাসকদলের নানা ‘বাহুবলী’-দের ‘বল’-এর পাশাপাশি বিত্তের যে বৈভব আমরা নিয়ত দেখি, চার দশক আগের সেই সময়ে এই ‘বাহুবলী’-দের তেমন কিছু চোখ টাটানো বিত্ত- বৈভব, বাড়ি, গাড়ি কিছুই কিন্তু আমরা দেখিনি। এইসব বিনোদন ও সংস্কৃতির বাইরে এলাকার বেশির ভাগ মানুষকেই দেখতাম, তাঁরা তাদের অবসর কাটাতেন তাস খেলে। হাওড়াগামী লোকাল ট্রেনেও তাদের দাপট ছিল প্রচুর। দলবদ্ধভাবে তাঁরা একজায়গায় বসতেন, অন্যদের জোর করে উঠিয়ে দিয়ে আর ট্রেনযাত্রার মিনিট চল্লিশেকও তাঁরা বুঁদ হয়ে থাকতেন তাসের নেশায়।
আশির দশকের গোড়ার দিকে কিছু তরুণ এই স্থিতাবস্থায় কিছুটা বদল আনার চেষ্টা করেন। নিজেরা একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি করে নানান রকম সাংস্কৃতিক কাজেকর্মে নিজেদের নিয়োজিত করার চেষ্টা করেন তাঁরা। এই একই সময়কালে স্থানীয়ভাবে তৈরি হয় একটি গ্রুপ থিয়েটারের দল, একটা সিনে ক্লাব ও আরও দু-একটা সাংস্কৃতিক উদ্যোগ। এইসব উদ্যোগগুলির পেছনে তৎকালীন শাসকদলের বিভিন্ন শাখার কর্মীরা কম-বেশি যুক্ত ছিলেন বলে স্বাভাবিকভাবেই যাকে পরিভাষায় বলে ‘প্যাট্রনেজ’ তার সুবিধে ছিল তাদের পক্ষে । অবশ্য এতে কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছিল বলে মনে করার কারণ নেই। তবে সব কটি সংগঠনই যে এমন ছিল তা নয়। আমাদের সঙ্গে কেমন করে যেন যোগ ঘটেছিল এমন একটি সংগঠনের যারা সেই অর্থে শাসক দলের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে ছিল না। নিজেদের মতো নানা কাজ করার তাঁরা চেষ্টা করতেন। সেমিনার, নাটক, বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ছোট ছোট পাঠচক্র আয়োজন —-- এগুলোর সমান্তরালে তারা নিজেদের একটি মুখপত্র সেই সময় প্রকাশ করা শুরু করেন। স্থানীয়ভাবে কিছু উৎসাহী মানুষ এই পত্রিকা কিনতে ও সমর্থন করতে এগিয়ে আসেন। একেবারেই আট/দশ পাতার ট্যাবলয়েড সাইজের কাগজ, নিউজপ্রিন্টে ছাপা —- প্রতি পাতায় দুটি কলাম করে ছাপা হত। ছাপার বিষয় মূলত নিবন্ধ, সম্পাদকীয় প্রতিবেদন, দু/চারটে কবিতা এইসব।
আশির দশকের মাঝামাঝি যখন ওই বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক সংকলন ইত্যাদি প্রকাশ করে আমাদের একটু হাত পেকেছে, ঠিক তখনই ওই পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গেও যুক্ত হয়ে পড়লাম আমরা। পত্রিকা প্রকাশের এই পর্যায়ে আমাদের সিদ্ধান্ত হল, শুধু স্থানীয়ভাবে নয়, আমাদের পত্রিকা আমরা বিক্রি করব কলকাতাতেও। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? পরিকল্পনা করা হল, পত্রিকা ব্যাগে করে নিয়ে আমরা পৌঁছে যাব কলকাতার কিছু নামী কলেজে — সেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে তাদের কাছে বিক্রি করা হবে পত্রিকা। যাকে বলা হয় পুশ সেল । এই নতুন কার্যক্রমের সূত্রেই আবার জড়িয়ে গেল কলেজ স্ট্রিট । ঠিক হল, প্রেসিডেন্সি কলেজ দিয়েই শুরু হবে আমাদের কর্মসূচি।
নির্দিষ্ট দিনে কাঁধের ব্যাগে পত্রিকার কপি ভর্তি করে আমরা কয়েকজন এসে দাঁড়ালাম প্রেসিডেন্সির গেটের সামনে। কলেজের গেট পেরিয়ে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া আজকের মত দুরূহ ছিল না ঠিকই কিন্তু কলেজ ক্যাম্পাসের ভিতরে পত্রিকা বিক্রি করা সমীচীন হবে কি না এই বিবেচনায় আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রইলাম গেটের সামনে। সেখান দিয়েই ছাত্র-ছাত্রীদের ঢোকা-বেরনো ও বিক্ষিপ্ত চলাচল। আমরা পত্রিকা হাতে নিয়ে আবেদন করতে লাগলাম আগত পড়ুয়াদের কাছে। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কাউকে এগিয়ে আসতে দেখলেই আমরা তাঁর মুখোমুখি দাঁড়াই, বিনীতভাবে জানাই আমাদের সংগঠনের পরিচয়, তারপর তাঁর দিকে এগিয়ে দিই আমাদের পত্রিকা । মাত্র পঞ্চাশ পয়সার বিনিময়ে সেটি কিনতে অনুরোধ জানাই। আমাদের বিপণন কৌশল বলতে এইটুকুই। গেটের সামনে ছড়িয়ে থাকে আমাদের চার-পাঁচজন তরুণ বন্ধু, তাঁদের প্রত্যেকের হাতে একগোছা পত্রিকা। যে যেমনভাবে পারেন ‘অ্যাপ্রোচ’ করেন ছাত্র-ছাত্রীদের। কেউ কেউ দু-দন্ড দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনলেও বাকিরা বেশিরভাগই আমাদের উপেক্ষা করে ঢুকে যাচ্ছিলেন কলেজের ভিতরে। মরিয়া আমরা অধ্যাপকদের গাড়িও ভদ্রভাবে থামিয়ে জানলা দিয়ে কথা বলে আমাদের পত্রিকা বিক্রির চেষ্টা করে গেছি। তাতে কোনো কোনো অধ্যাপক রুষ্ট হচ্ছিলেন টের পাই। আবার দুয়েকজন যে আমাদের কথায় আগ্রহী হয়ে নিজেরা গাড়ির ভিতরে বসেও পত্রিকা কেনেননি, তা নয়। কোনও কোনও পড়ুয়া নিজেরাও গাড়িতে কলেজে আসতেন, তাদের ক্ষেত্রেও আমাদের প্রয়াসের ঘাটতি ছিল না। কিন্তু বরফ গলেছে খুব কম ক্ষেত্রেই। ঘণ্টা দু-আড়াই এইভাবে ‘হকিং’ করার পর আস্তে আস্তে বেলা গড়ায় মধ্যাহ্নের দিকে, তখন আর কলেজ আগত ছাত্র-ছাত্রীদের স্রোত থাকে না গেটের সামনে। একটু ঝিমিয়ে পড়ে বইপাড়া। আমাদের তরুণ বন্ধুরাও তখন কিছুটা হা-ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত । আসলে এখানে ওই পুরোনো কথাটা আবার না বলে উপায় নেই। নিতান্ত মফসসলের নাম-না-জানা কোন এক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর পত্রিকা বিষয়ে শহরের নামজাদা শিক্ষাসত্রের কারোর তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। মহানগর কলকাতা বরাবরই যেন এমন উদাসীন ও নিষ্ঠুর।
এখানে দুটো বিচিত্র প্রতিক্রিয়ার উল্লেখ না করে পারছি না। এই প্রেসিডেন্সির গেটেই একজন পড়ুয়ার কাছে পত্রিকা বিক্রির জন্য অনুরোধ করতেই তিনি দুহাত কপালে তুলে নিজের অপারগতা জানান, সাধারণত যা আমরা রাস্তার ভিক্ষুকদের ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করে থাকি। সম্ভবত তিনি আমাদের ওই ভিক্ষুকদের সমান পর্যায়েই ভেবে নিয়েছিলেন। অন্য একটা ঘটনা আরও অবমাননার । আমাদের আট পৃষ্ঠার পত্রিকার বিনিময়মূল্য ছিল পঞ্চাশ পয়সা। পত্রিকা কিনতে আপাতভাবে রাজি হয়ে একজন ছাত্রী আমাদের একশো টাকার নোট এগিয়ে দিয়েছিল। বলা বাহুল্য, পঞ্চাশ পয়সার পত্রিকার বিনিময়ে আমাদের পক্ষে একশো টাকার ভাঙানি দেওয়া ছিল অসম্ভব। যিনি এটা দিয়েছিলেন তিনি নিজেও এটা জানতেন বলেই আমাদের মনে হয়। তিনি মনে হয় এটাও জানতেন না, ওই সময়টায় আমরা যারা প্রেসিডেন্সির গেটে পত্রিকা বিক্রি করতে নেমেছিলাম, তাঁদের কারোর পকেটেই গোটা একটা একশো টাকার নোট থাকত না। আজ আরো বেশি করে মনে হয় এটা বোধহয় অভিজাত শ্রেণির সদস্যদের পথে-কাগজ-বিক্রি-করা ছেলেদের প্রতি একরকম ইচ্ছাকৃত অপমান , যার একটা সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করার অবকাশ আছে।
আরও দুটো প্রতিক্রিয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। কলেজ স্ট্রিটে পত্রিকা বিক্রি ( ইংরিজিতে এটাকে অনায়াসেই হকিং বলা চলে) করার সময় অনেকেই প্রশ্ন করতেন, আমরা কোন পার্টির লোক ? সিপিএম ? কংগ্রেস ? নকশাল ? এস ইউ সি ? কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের ত্রিসীমানায় বি জে পি নামক কোনো দলের নাম তখন কেউ শোনেনি। এই প্রশ্নে আমাদের উত্তর ছিল নেতিবাচক, অর্থাৎ আমরা কোনো রাজনৈতিক দলেরই কর্মী নই। অনেকেরই এই জবাব খুব একটা পছন্দ হত না বা বিশ্বাস্য বলে মনে হত না। মনে রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজনীতির উঠোনে প্রধান দল সি পি আই এম, প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। আর প্রান্তীয় পরিসীমায় রয়েছে কিছু নকশালপন্থীগোষ্ঠী যাদের সব থেকে বড় অংশ তখন ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট ( আই পি এফ) নামে কাজ করেন, এঁরাই পরে সি পি আই এম এল (লিবারেশন) নামে আত্মপ্রকাশ করেন। আর ছিল এস ইউ সি আই —- দুটিমাত্র বিধায়ক থাকলেও তাঁদের ছাত্র সংগঠন ছিল বেশ জোরালো । আসলে সেই সময়ের রাজনৈতিক অবস্থাটা এমনই ছিল যে একেবারে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ার বাইরেও যে কেউ কিছু করতে পারে এটা মানুষ বিশ্বাস করতেন না। সেটা খেয়াল করেছিলাম বিদ্যাসাগর কলেজে পত্রিকা বিক্রি করতে গিয়ে। সেখানে তৎকালীন শাসকফ্রন্টের ছাত্র সংগঠনের প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল অনেক বেশি। তাদেরই কেউ কেউ আমাদের একটা দুটো কাগজ কিনে বুঝতে পারলেন আমরা ঠিক ‘তাদের লোক’ নই। ছাত্র সংসদ থেকে নির্দেশ এল আমরা যেন কলেজের বাইরে আর পত্রিকা বিক্রি না করি— অবশ্য মানতেই হবে তাঁদের সেই নির্দেশে আপাতভাবে কোনো হুমকির সুর ছিল না — নির্দেশ না মানলে কী হত সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। অগত্যা তাঁদের ‘নির্দেশ’ মেনে আমরা চলে গেলাম আরও উত্তরে। স্কটিশ চার্চ কলেজে তখন ছাত্র পরিষদের সংসদ। সেখানে গেটের সামনে দাঁড়াতেই তাঁদের পক্ষ থেকে বাধা এল —- এঁদের কোনো কোনো মাতব্বর আমাদের কাগজ হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলেন ও সরাসরি বলে দিলেন এই পত্রিকা এই কলেজের সামনে তাঁরা বিক্রি করতে দেবেন না। আসলে তাঁরাও নিজেদের হিসেব নিকেশে বুঝতে পারলেন আমরা ঠিক তাঁদের প্রজাতির নই। কারণ, আমাদের পত্রিকায় সেই সময় বেরিয়েছে অটোমেশন-বিরোধী নিবন্ধ। আর তাঁদের আরাধ্য তৎকালীন যুবা প্রধানমন্ত্রী তখন সারা দেশে বাজিয়ে দিয়েছেন অটোমেশনের বাজনা।
আবার এর বিপরীতে এমন ঘটনাও ঘটেছে । প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র সংসদের কোনো প্রতিনিধি গেট থেকে আমাদের পত্রিকা সংগ্রহ করে দেখা করতে বলেছেন তাঁদের সংসদের অফিসে। আমরা গেছি, তাঁদের সঙ্গে চা খেয়েছি, আলাপ পরিচয় হয়েছে। অবশ্য সেই সময় প্রেসিডেন্সির ছাত্র সংসদ তৎকালীন শাসক দলের ছাত্রশাখা এস এফ আইয়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। আই সি ( ইন্ডিপেন্ডেন্ট কন্সোলিডেশন) নামক একটা সংগঠন ও পি সি এস এ(প্রেসিডেন্সি কলেজ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন) ছিল তার নিয়ামক — কোনো দলীয় ব্যানার না ব্যবহার করলেও মূলত এতে যুক্ত ছিলেন নানা নকশালপন্থী গোষ্ঠীর মানুষজন। খুব নির্দিষ্ট ভাবে বলতে পারি না তবে সম্ভবত এই আই সি বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট কন্সোলিডেশন-ই থেকেই পরে আইসা ( অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন তৈরি হয়েছে —- যারা এস এফ আই-এর মতোই আজও প্রেসিডেন্সি কলেজ ও দিল্লির জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান ছাত্র সংগঠন হিসেবে টিকে আছেন। তবে এটা বলা দরকার, সেই সময়টায় প্রেসিডেন্সি কলেজকে ঘিরে এইরকম একটা বৃত্ত তৈরি হয়েছিল, যাতে কলেজের প্রাক্তন ও বর্তমান র্যাডিকাল ভাবনাচিন্তার মানুষজন যুক্ত ছিলেন, ছিলেন কিছু অধ্যাপক-গবেষক। প্রসঙ্গত, আজকে রাজ্যের শাসকদলের একজন মন্ত্রী ও একজন সাংসদ তখন ওই বৃত্তে জড়িত ছিলেন—- তাঁরা আজ আর আমাদের চিনতে পারবেন কি না, এই প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়।
প্রতি মাসে বেরোনোর কথা থাকলেও কার্যত পত্রিকা প্রকাশের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার সেই মজবুত সাংগঠনিক শক্তি আমাদের ছিল না। ফলে দু-তিনমাস পরে পরে হলেও কলেজ স্ট্রিট-কেন্দ্রিক আমাদের এই পত্রিকা বিক্রির প্রকল্প পরিত্যক্ত হয়নি। ব্যাগ বোঝাই করে পত্রিকা বহন করে নিয়ে গিয়ে ঘণ্টা দু-তিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে পত্রিকা বিক্রি করে আমাদের খুব যে কিছু লাভ হত এমন নয়। দুশো কপি পত্রিকা নিয়ে গেলে সাকুল্যে হয়তো পঞ্চাশ কপি বিক্রি হত। তুলনায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিক্রি হত বেশি, তবে তা কোনোদিনই একশোর ঘর পেরোয়নি। সকলের পক্ষে নিজেদের সব কাজ মুলতুবি রেখে এই ‘হকিং’ করা খুব সহজ কাজ ছিল না। কলেজ স্ট্রিট এলাকার অন্য কলেজগুলিতে ছাত্র-সংসদগুলি হয় ভারতের ছাত্র ফেডারেশন কিম্বা ছাত্র পরিষদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত । আগের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা স্পষ্ট বুঝেছিলাম এঁদের আমাদের পত্রিকার প্রতি অঘোষিত ‘নিষেধাজ্ঞা’ রয়েছে আর তাঁদের নিজস্ব এলাকায় এর বিরুদ্ধে কিছু করা আমাদের কম্মো নয়। তাছাড়া একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের পত্রিকা প্রকাশ ও তা বিক্রি করার জন্য আমরা এসব বিরোধ বিসম্বাদে যাবই বা কেন ? এরকম কোনো গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়ার বিন্দুমাত্র বাসনা আমাদের কারোর মধ্যেই ছিল না। এইসব বিবেচনা করে পরের দিকে আমরা মূলত প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুরেই কাগজ নিয়ে যেতাম। কারণ এই দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারাই ছাত্র রাজনীতির নিয়ামক থাকুন না কেন, কেউ আমাদের কাজে কোনো বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। প্রেসিডেন্সির মতোই যাদবপুরের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল —-- তাঁরা এমনকি একসঙ্গে দশ/পনেরো কপি কাগজ নিজেরা কিনে নিয়ে তাঁদের সদস্যদের মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন।
শেষবার যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের গেটে আমরা পত্রিকা বিক্রি করতে যাই, সেদিন এক অল্পবয়স্ক যুবক আমার কাছে এসে আমাদের কাগজ হাতে নিয়ে দেখতে চান। হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখে তা আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে তিনি আমায় খুব অথরিটিটিভ গলায় বলেন, আপনারা এই পত্রিকা এখানে বিক্রি করবেন না, চলে যান। কারণ জানতে চাইলে তিনি কলেজ স্ট্রিট-বউবাজার অঞ্চলের একজন প্রতাপশালী কংগ্রেস নেতার নাম করেন ও নিজেকে ‘তার লোক’ বলে পরিচয় দেন। সেই নেতার নাম এখানে উল্লেখ করতে চাই না, কারণ ওই যুবকের সেদিনের ওই দাবির সপক্ষে আমরা কোনো তথ্যপ্রমাণ পাইনি, সবটাই মুখের কথা। কিন্তু উল্লিখিত ওই নেতা বর্তমানে রাজ্যের শাসকদলের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও খুব পরিচিত মুখ, যাকে আমরা টিভি চ্যানেলের বিতর্কে প্রায়শ অংশ নিতে দেখি —- যদিও এটা যে সময়ের কথা তখন তিনি তাঁর ডাকনামে বেশি পরিচিত ও ‘খ্যাত’ ছিলেন, এখন সেই ডাকনামে তিনি আর নিজের পরিচয় দেন না। তবে এটা সত্যি কথা, আজ থেকে চার দশক আগে রাজ্যে বামপন্থী শাসকদলের প্রবল প্রতাপ থাকলেও খোদ কলকাতায় তাঁদের প্রভাব তেমন ছিল না। কলকাতার বেশিরভাগ বিধায়ক ছিলেন তৎকালীন বিরোধী কংগ্রেস দলের। বিশেষ করে মধ্য কলকাতার শিয়ালদহ, কলেজ স্ট্রিট, বউবাজার এইসব এলাকায় সত্যিই কিছু কিছু ক্ষমতাশালী কংগ্রেস নেতা ছিলেন, পরে তাঁরা অনেকেই বর্তমান শাসক দলে ভিড়ে গেছেন । এই ঘটনার পরে অবশ্য আমাদের পত্রিকা প্রকাশ চূড়ান্ত অনিয়মিত হয়ে পড়ে ও এই কলেজে কলেজে কাগজ বিক্রির উদ্যোগে ভাঁটা পড়ে। তার সঙ্গে অবশ্য ওই নেতাবাবুর ‘চেলা’র ‘হুমকি’র কোনো যোগ নেই —- সেটা অন্য গল্প।
সারাদিন কলেজ স্ট্রিট এলাকায় এই শ্রমসাধ্য কাজ করে আমাদের খিদে পাওয়া খুব অন্যায় ছিল এমন নয়। অথচ প্রত্যেকেরই পকেট তখন এমন নয় যে এই কর্মযজ্ঞ শেষ করে কোথাও বসে খাওয়াদাওয়া করা যায়। কলেজ স্ট্রিট মানেই সবাই জানে তার কফি হাউসের কথা। কিন্তু আজ এটা শুনতে খুব অবাকই লাগবে যে আমরা অনেক দিন পর্যন্ত এই কফি হাউসের ধার মাড়াইনি কেবলমাত্র আমাদের পকেটের সীমাবদ্ধতার কারণেই। একটা সময় পর্যন্ত কফি হাউসের খাবারের দাম বেশ কম ছিল এটা ঠিক। কিন্তু এই তুলনাটা আসলে করা হয় সমপর্যায়ের কোনো রেস্টুরেন্টের সঙ্গে। কলেজ স্ট্রিট এলাকার খাওয়া-দাওয়া এই আখ্যানের একটা পর্বের বিষয় হয়ে উঠতেই পারে। কিন্তু সে পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই বলতে চাইব এটাই যে পত্রিকা বিক্রির সামান্য টাকায় হাত না-দিয়ে সকলের পকেটের রেস্ত জড়ো করে আমাদের সামান্য ক্ষুন্নিবৃত্তি ঘটত ফুটপাথের দোকানেই। সংস্কৃত কলেজের প্রাচীর বরাবর যে সার দেওয়া বইয়ের দোকান ওরই আড়ালে ছিল একটা ফুটপাথের দোকান। তার পাশেই ছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ’ এর বই বিক্রির কাউন্টার ( ঠিকানা : ১ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট) । হদিশ না-জানলে ওই দোকান খুঁজে পাওয়াই ছিল মুস্কিল। অথচ রাজ্য সরকারের আর্থিক আনুকূল্যে ‘ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ’ বাংলা ভাষায় বিভিন্ন বিষয়ের বই প্রকাশ করত সুলভে। দর্শন-ইতিহাস-পদার্থবিজ্ঞান-গণিত সবই ছিল তার মধ্যে। পদার্থবিদ্যার ‘পদার্থের ধর্ম’ ( প্রপারটিজ অফ ম্যাটার), গণিতের ‘উচ্চতর কলনবিদ্যা’ (হায়ার ক্যালকুলাস) বা অর্থনীতির ‘চাহিদাতত্ত্ব’ (ডিমান্ড থিওরি), ইতিহাসে ‘প্রাচীন ভারতের ইতিহাস’ এইসব বই ছিল খুবই ভাল মানের। সেই বই-বিপণির পাশেই ছিল আমাদের দ্বিপ্রাহরিক পেট ভরানোর দোকান—- যার উপাদান ছিল কোয়ার্টার পাউন্ড সেঁকা পাউরুটি, সঙ্গে ঘুগনি বা আলুর দম। কলেজ স্ট্রিট এলাকায় সেইটাই তখন সবচেয়ে কম দামের পেট ভরানো খাবার। অবশ্যই কফি হাউসের থেকে সস্তা। ইউনিভারসিটি ইন্সটিটিউটের পাশেও অবশ্য এরকম দুয়েকটা ফুটপাথের স্টল ছিল, আজও আছে। সেখানেও যে মাঝে মধ্যে যেতাম না এমন নয়। তবে পত্রিকা বিক্রির শ্রমজনিত যে খিদে তখন পেটের ভিতর আগুন জ্বেলে দিত তার নিরসন হত ওই ‘ব্রাত্য’ ফুটপাথের দোকানেই । কলেজ স্ট্রিট মানে ওইসব দোকানগুলোও, যেখানে যুবক বয়সের ‘আগ্রাসী’ খিদে মিটিয়েও কোনোদিন তার জন্য অসুখ করেছে বলে মনে পড়ে না।
(ক্রমশঃ)
পরের পর্ব প্রকাশ হবে ৯ এপ্রিল
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।