কলেজ স্ট্রিটের পাঁচালি
প্রবুদ্ধ বাগচী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পর্ব ১০
যাদবপুরে ভর্তি হওয়ার প্রথম বছরের শেষে একটা ছাত্র-সংগঠনের বার্ষিক অনুষ্ঠান হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গান্ধী ভবন’ প্রেক্ষাগৃহে। সেই অনুষ্ঠানে একটি নাট্যদল পরিবেশন করেছিল হিন্দি কথাসাহিত্যিক কিষান চন্দরের ‘জামগাছ’ গল্প অবলম্বনে নাটক ‘চাপা পড়া মানুষ’ । নাটক দেখার চোখ যে তখন খুব পাকা ছিল এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। তবু বাবাদের অফিসের ক্লাবের বার্ষিক উৎসব উপলক্ষ্যে দুবার দুটি প্রযোজনা দেখেছিলাম — একটি ম্যাক্সিম গোর্কির ‘লোয়ার ডেপথ’ অবলম্বনে ‘নিচের মহল’ এবং পরেরটি উৎপল দত্তের ‘ফেরারি ফৌজ’। এই নাটক পরিবেশনা ও পরিচালনা করেছিলেন অফিস ক্লাবের সদস্য-সদস্যারাই। বয়স যথেষ্ট কম থাকায় দুটি বিখ্যাত নাটকের মর্মবস্তু যে মাথায় ঢুকেছিল, তা নয়। কিন্তু একবার ‘মহাজাতি সদন’ ও অন্যবার ‘কলামন্দির’ প্রেক্ষাগৃহের বিরাট স্টেজ, মঞ্চসজ্জা, আলো প্রক্ষেপন এগুলো মনে বেশ দাগ কেটে গিয়েছিল। কারণ, আমাদের বাসভূমি যে পোড়া মফসসল সেখানে যে দুয়েকটা নাটক দেখিনি তা নয় —- তবে সেই জনপদে কোনো প্রেক্ষাগৃহ ছিল না। পুজোর পর একটা ক্লাব রাস্তা জুড়ে মঞ্চ বেঁধে বার্ষিক একটা নাটক করত। স্বাভাবিকভাবেই রাস্তার বাঁধা মঞ্চে ওই মাপের পরিকাঠামো থাকা সম্ভব ছিল না। তাই কলকাতার প্রেক্ষাগৃহ ছিল আমাদের কাছে বিস্ময়।
এখানে একটা ভিন্ন কথা বলি। নাটকের চর্চা বাংলাদেশে খুব নতুন কিছু নয় । অবিভক্ত বাংলাতেও পুজোর সময় নাটক যাত্রাপালা এইসব যে প্রচুর পরিমাণে হত তার নানা উল্লেখ দেখতে পাই সেই সময়ের নানা বিশিষ্ট মানুষদের স্মৃতিকথায়। কিন্তু নাটকের একটা রকমফের শুরু হয়েছে গত শতকের চল্লিশের দশকে যখন থেকে গণনাট্য আন্দোলনের সূচনা। সত্তর বা আশির দশকে গণনাট্য আন্দোলন ছিল না কিন্তু ছিল ‘অন্যরকম’ গ্রুপ থিয়েটারের নাটক যার মর্মকথা ছিল বেশ খানিকটা প্রগতিশীল , নিছক পৌরাণিক ঠাকুর-দেবতার নাটক বা সামাজিক নাটকে দর্শকদের তখন আর মন ভরার নয় । অফিস ক্লাবের নেতৃত্বে যেহেতু তখন বাম মনোভাবাপন্ন কর্মীরাই ছিলেন তাই তাঁদের পছন্দের প্রযোজনা হিসেবে উঠে এসেছিল ম্যাক্সিম গোর্কি বা উৎপল দত্ত। আর আশির দশকে যেহেতু রাজ্যে বাম সরকারের আমল, তাই পাড়ার ক্লাবের কেষ্টবিষ্টুরাও কিছুটা ‘প্রগতিশীল’ ছাঁচের নাটকই পছন্দ করতেন বলে মনে হয়। এই ঘরানা মেনেই গোটা রাজ্যে তখন চালু হয়ে গিয়েছিল ‘রবীন্দ্র নজরুল সুকান্ত জয়ন্তী’ যাকে আড়ালে সমালোচকরা ‘র.সু.ন’ জয়ন্তী বলে বিদ্রুপ করতেন। কোনো কবিকে ছোট করা কাম্য নয় ঠিকই, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি একই পঙক্তিতে নজরুল ও সুকান্ত সেইভাবে বসতে পারেন না খুব সংগত কারণেই। তাঁরা নিজেরা জীবিত থাকলেও এই ব্যবস্থা মেনে নিতেন বলে মনে হয় না। তাঁর সমকালীন বা অনুজ কবিদের নিয়ে যিনি সত্যি সত্যি মূল্যায়ন করতে পেরেছেন, সেই বুদ্ধদেব বসু নজরুল বিষয়ে পরম শ্রদ্ধাশীল হয়েও লিখেছিলেন, বয়স ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবিদের যে ভাবনা ও উচ্চারণের পরিবর্তন হয় কাজি নজরুলের ক্ষেত্রে তা ছিল অনুপস্থিত —- বয়সের পাশে পাশে তাঁর কবিত্বের বিবর্তন ঘটেনি। কবি সুকান্তের মধ্যে অসম্ভব সম্ভাবনা দেখলেও বুদ্ধদেবের মনে হয়েছিল দলীয় সংসর্গ ও কিছুটা প্রোপাগান্ডাধর্মী লেখা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই সুকান্তের লেখায় তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ ঘটবে। যাই হোক এসব আলোচনা এখানে না করলেও চলে। মোটকথা হল, শাসকের রুচি ও মতাদর্শ কে কিছুটা মান্যতা দেওয়ার অঘোষিত দায় স্থানীয় ক্লাবের ছিল। যদিও সেই আমলে পুজোর ঢালাও আয়োজন করার জন্য ক্লাবগুলিকে সরকারি অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল না, ফলে শাসক দলের ‘অনুগ্রহ’ পাওয়ার লক্ষ্যে যে ক্লাবগুলি এই পথ বেছে নিতেন এমন অভিযোগ না-করাই ভাল —-- হয়তো শাসকের রাজনৈতিক ভাবনার কিছুটা সমর্থক হিসেবে নিজেদের পরিচিত করার উদ্দেশ্য থাকলেও থাকতে পারে। তবে তার কারণে যদি ভাল নাটকের প্রযোজনা হয় তাতে কারোরই কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
কিন্তু যাদবপুরের আঙিনায় ‘চাপা পড়া মানুষ’-এর পরিবেশনা আমায় আমূল নাড়া দিয়েছিল মূলত তার আঙ্গিকের কারণে। রঙিন আলো, মেকআপের পোশাক, মঞ্চের সাজসজ্জা ও উপকরণ সব কিছুকে উপেক্ষা করে এমনভাবে যে নাটক করা যায় এবং দর্শকের মন জয় করে নেওয়া যায়, এটা সত্যিই আমার জানা ছিল না। এই ঘটনার বেশ অনেক পরে বাদল সরকারের ‘থার্ড থিয়েটার’ বা ‘অঙ্গনমঞ্চ’ নাটকের কথা জেনেছি, আরো অনেক পরে বাদল সরকারের লেখায় ও সাক্ষাৎকারে শুনেছি পিটার গ্রোটস্কি-র ‘পুওর থিয়েটার’-এর নাট্যভাবনা কীভাবে তাঁকে ঘুরিয়ে দেয় এই ‘তৃতীয় থিয়েটার’ এর দিকে। কিন্তু কলেজ স্ট্রিট নিয়ে এই আখ্যানে থিয়েটারের কথা কেন ? তার কারণ, কলেজ স্ট্রিট যে সমস্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমার এই ক্ষুদ্র ও অকিঞ্চিৎকর জীবনকে আলোকিত করেছে তার মধ্যে নাটক অন্যতম। আর সেই আলোক প্রক্ষেপণের পটভূমি কলেজ স্ট্রিটের এই সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক এলাকা। আশির দশকে এই এলাকায় কয়েকটি পুরোনো সভাঘরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হত। খুব পরিচিত ছিল ‘স্টুডেন্টস হল’ আর ‘মহাবোধি সোসাইটি হল’ । তুলনায় কম অনুষ্ঠান হত ‘ত্রিপুরা হিতসাধিনী মঞ্চ’ বা ‘থিওজফিক্যাল সোসাইটি’ তে। এছাড়া বড় অনুষ্ঠানের জন্য ছিল ‘ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট’ ও ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শতবার্ষিকী হল’ বা প্রেসিডেন্সি কলেজের ‘ডিরোজিও হল’ । তবে নাটক বা অন্য কোনো বড় অনুষ্ঠানের জন্য মূলত শেষের তিনটে প্রেক্ষাগৃহই ব্যবহার করা হত।
সম্ভবত ১৯৮৭ সালে উৎপল দত্তের ‘পি এল টি’ নাট্যদল নতুন করে ‘কল্লোল’ নাটক মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই নাটক ঘিরে যে ইতিহাস সেগুলো তখন একটু একটু আমাদেরও কানে এসেছে। তাই যখন খবর পাওয়া গেল ‘ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট’-এ এই প্রযোজনা মঞ্চস্থ হবে তখন একটুও সময় নষ্ট না করে কয়েকজন বন্ধু এক হয়ে নিজেদের টিকিট কিনে ফেলেছিলাম। আর যথাসময়ে সেই নাটক দেখতে হাজির হয়েছিলাম প্রেক্ষাগৃহে। সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যেন বা ইতিহাসকে নতুন করে ছুঁয়ে থাকা। যতদূর মনে আছে তখন ‘শার্দূল সিং’-এর ভূমিকায় শেখর চট্টোপাধ্যায় বোধহয় অভিনয় করতেন না, তার জায়গা নিয়েছিলেন মৃণাল ঘোষ । কিন্তু মঞ্চে উৎপল দত্ত , শোভা সেনের দাপুটে অভিনয় সেই আমাদের সরাসরি দেখবার রোমাঞ্চ। আর সব মিলিয়ে ওই জমজমাট নাটক আমাদের অভিজ্ঞতায় একটা স্থায়ী ছাপ ফেলে গিয়েছিল। আরো কিছুটা পরে ‘কল্লোল’ নাটকের ইতিহাস পড়ে দেখার সুযোগ হয়েছে। ‘ইতিহাস বিকৃতি’-র অভিযোগ তুলে কীভাবে এই নাটককে আটকানোর চেষ্টা হয়েছিল সরকারি প্রশাসনের তরফে, কীভাবে কলকাতার সব বাংলা সংবাদপত্র ‘কল্লোল’ নাটকের বিজ্ঞাপন ছাপতে অস্বীকার করেন , কীভাবে ‘স্টার থিয়েটার’-এ এই নাটকের শো-এর দিন সন্ধ্যায় রাস্তার ওপর কংগ্রেস দলের দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হন উৎপল দত্ত ও শোভা সেন —--- আর এই প্রবল প্রতিরোধের মধ্যেই নাটকের আলোকশিল্পী স্লোগান দেন ‘কল্লোল চলছে, চলবে’ —- এই স্লোগানই মানুষের মুখে মুখে হয়ে ওঠে নাটকের বিজ্ঞাপন —- একের পর এক শো ‘হাউসফুল’ হতে থাকে । সবটাই এক গৌরবের দৃপ্ত ইতিহাস। আমাদের দেখা ‘কল্লোল’ প্রযোজনা আসলে এইসব ইতিহাসেরই এক সম্প্রসারণ।
পরের সময়কালে ‘পি এল টি’ র আরো অনেকগুলি প্রযোজনা দেখেছি, অবশ্য সেগুলি সবই ‘অ্যাকাডেমি’ বা ‘রবীন্দ্রসদন’ প্রেক্ষাগৃহে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে অ্যাকাডেমিতে তখন টিকিটের মূল্য ছিল সব থেকে কম পাঁচ টাকা, আমরা মূলত এই দামের টিকিটেই অশোক মুখোপাধ্যায়ের ‘ থিয়েটার ওয়ার্কশপ’, বিভাস চক্রবর্তীর ‘অন্য থিয়েটার’, অসিত মুখোপাধ্যায়ের ‘গান্ধার’, সীমা মুখোপাধ্যায়ের ‘রংরূপ’ বা শাঁওলি মিত্রের ‘পঞ্চম বৈদিক’ এর নাট্য প্রযোজনা দেখেছি। বাগবাজারের গিরিশ মঞ্চ তখন সবে চালু হয়েছে (১ জুলাই ১৯৮৬) কিন্তু নিয়মিত নাটকের অভিনয় সেখানে হত না। বাংলা নাটকের দুই কিম্বদন্তীর অন্যতম শম্ভু মিত্র আমাদের এই নতুন পৃথিবী চেনার আগেই অভিনয় জীবন থেকে অবসৃত ফলে বাংলার সাংস্কৃতিক রাজধানীর এই অলিন্দে উৎপল দত্তের নাটক দেখেই আমাদের নাট্য পরিক্রমার সূত্রপাত ।
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে আবার ফিরি কলেজ স্ট্রিটে। আশির দশকে কলেজ স্ট্রিটের ‘স্টুডেন্টস হল’ বা ‘থিওজফিকাল সোসাইটি’-র দোতলার হলঘরে বাদল সরকারের ‘শতাব্দী’ নাট্যদল তাদের ‘অঙ্গনমঞ্চ নাট্যোৎসব’ আয়োজন করতেন। আর শনিবার কার্জন পার্কে হত তাদের শো। সাধারণভাবে ‘শো’ বলতে যে ঝলমলে ব্যাপার বোঝায় আদপে ব্যাপারটা যে তেমন নয় সেটা বুঝতে পারলাম যেদিন প্রথম তাদের নাটক দেখতে যাই ‘থিওজফিকাল সোসাইটি’-তে । যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ‘চাপা পড়া মানুষ’ দেখি তখন তো তাও একটা মঞ্চ ছিল কিন্তু একটা ঘরের মেঝেকে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে তার চারদিকে শতরঞ্চি পেতে দর্শক বসিয়ে শারীরিক নানা কসরতে একেকটি নাট্যমুহূর্ত তৈরি করে তাক লাগিয়ে দেওয়া আর দর্শককে অভিভূত করার এই প্রয়াস আমাদের নবীন চোখে মনে হয়েছিল অবিস্মরণীয়। ‘নবীন চোখ’ কথাটা এই কারণে বললাম যে, নাটক নিয়ে এই তৃতীয় ধারার চর্চা আসলে বাদল সরকার শুরু করেছিলেন এর আরও আগে। আর পরে জেনেছি ‘অঙ্গনমঞ্চ’ নাট্যের এইটাই থিওরি যে অভিনেতা আর দর্শক একই সমতলে অবস্থান করবেন, সেই নীতি মেনেই এইভাবে অভিনয় করা হয়। তাঁদের নাট্য আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে তাঁরা প্রকাশ করতেন “অঙ্গন” নামক একটি পত্রিকা। বর্তমানে সেই পত্রিকা লুপ্ত হলেও তাঁদের প্রকাশিত আঠাশটি সংখ্যার একটি সুসম্পাদিত সংকলন তাঁরা কয়েকবছর আগে প্রকাশ করেছেন।
এর আগে পথনাটকের নিয়মিত আয়োজন এর আগে হত কার্জন পার্কে— ১৯৭৪ সালে এরকমই এক শনিবারে (সম্ভবত ২০ জুলাই) কার্জন পার্কে পথনাটকের আয়োজনে পুলিশি হামলা হয় যার পরিণামে নিহত হন নাট্যপ্রেমী প্রবীর দত্ত। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে পরে শুনেছি, পুলিশের সন্দেহ হয়েছিল ওই দিনের সাংস্কৃতিক আয়োজনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নকশালপন্থী-গোষ্ঠীর নেতারা ওখানে সমবেত হবেন। তাই সাদা পোশাকের পুলিশের নজর ছিল সেখানে। কিন্তু সেদিনের শহিদ প্রবীর দত্ত নিজে সেইভাবে কোনো রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, যাদবপুরের দিকের এক উদবাস্তু পরিবারের সন্তান প্রবীর নিছক নাট্যমোদী হিসেবেই নিয়মিত ওখানে নাটক দেখতে আসতেন। গোলমালের সুযোগে পুলিশ সেদিন তাঁকে পিটিয়ে মেরে ফেলে, মেডিক্যাল কলেজে হাসপাতালে তার দেহ পরিজনদেরও দেখতে দেওয়া হয়নি। সত্তর দশকের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অগুনতি আক্রমণের এই এক কলঙ্ক চিহ্নের সঙ্গে জুড়ে ছিল নাটক। প্রবীরের হত্যার পাশাপাশি সেদিনের জমায়েত থেকে বেশ কিছু কবি, নাট্যকর্মী, গণসংগীত দলের গায়ককে পুলিশ সেদিন গ্রেফতার করে লালবাজার সেন্ট্রাল লকআপে নিয়ে যায়। এদেরই একজন আমায় পরে বলেছিলেন তিনি সেদিন সেন্ট্রাল লকআপের মাটিতে বসে ‘সখী ভাবনা কাহারে বলে যাতনা কাহারে বলে’ গানটি উচ্চস্বরে গেয়েছিলেন–পুলিশ আপত্তি করেনি !
‘থিওজফিক্যাল সোসাইটি হল’-এ সেই দিনের প্রযোজনা ছিল গৌরকিশোর ঘোষের কাহিনি অবলম্বনে ‘সাগিনা মাহাতো’। বাদল সরকারকে সেই প্রথম সামনে থেকে অভিনয়ে দেখা। নাটক শেষে নাট্যকর্মীরা চাদর পেতে দর্শকদের থেকে সাধ্যমতো অর্থ সংগ্রহ করতেন, নাটকে দর্শক ও নাট্যদলের যোগসূত্র স্থাপনের এই প্রয়াসও ছিল আমাদের চোখে অভিনব। এর পাশাপাশি আগত দর্শকদের নাম-ঠিকানা তাঁরা একটা কাগজে লিখে রাখতেন। এই লিখে রাখার অর্থ বুঝলাম কিছু পরে। ‘শতাব্দী’ নাট্যদল তাঁদের সহমর্মী আরও কিছু নাট্যদলের সঙ্গে মিলে বছরের একটা সময় ‘অঙ্গনমঞ্চ’ নাট্যোৎসব আয়োজন করতেন। কিন্তু তার জন্য কোনো গণমাধ্যমে তাঁরা কোনও প্রচার করতেন না। আগত দর্শকদের ঠিকানায় তাঁদের উৎসবের নাট্যসূচি ও মঞ্চায়নের জায়গা উল্লেখ করে একটি করে পোস্টকার্ড পাঠাতেন। এইভাবেই তাঁদের সমর্থক নাট্যমোদীরা হাজির হয়ে যেতেন তাঁদের উৎসবে। আমার ঠিকানাতেও অনেকবার এইরকম পোস্টকার্ড এসেছে। নাটকগুলি মঞ্চস্থ হত লিন্ডসে স্ট্রিটের ‘সিন্ধুভবন’ হলে , লোরেটো স্কুলের শিয়ালদহ ব্রাঞ্চের খোলা চত্বরে বা ‘ডিরোজিও হল’ এর ঢোকবার মুখে সামনের খোলা জায়গায়। বাদল সরকারের নিজের লেখা নাটক ‘খাট মাট ক্রিং’, ‘ভোমা’, ‘ত্রিংশ শতাব্দী’, ‘আন্ড্রোক্লিস ও সিংহ’ ইত্যাদি বেশিটাই দেখেছিলাম ‘থিওজফিক্যাল সোসাইটি’ ও ‘ডিরোজিও হল’ চত্বরে। আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’ যখন তাঁরা ‘থার্ড থিয়েটার’ ফর্মে মঞ্চস্থ করেন, সেই প্রযোজনায় বাদল সরকার নিজেও ছিলেন। আরও পরে নব্বই দশকের দ্বিতীয় পর্বে বাদল সরকার ‘রক্তকরবী’-কে থার্ড থিয়েটারের ফর্মে রূপান্তরিত করেন, তবে তাঁর নিজের নাট্যদল ‘শতাব্দী’ র পরিবর্তে তা মঞ্চায়ন করেন কাঁচড়াপাড়ার ‘পথসেনা’ —- সেও ছিল এক অবাক-করা আয়োজন। কম করেও অন্তত পাঁচবার সেই প্রযোজনা দেখেছি বিভিন্ন জায়গায়। তার মধ্যে একবার দেখেছি, রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ‘ওরিয়েন্টাল সেমিনারি’র নিজেদের স্কুল-সংলগ্ন ছোট মাঠে।
আর একটি ঘটনা উল্লেখ করে এই প্রসঙ্গের যতি টানব। গত শতকের নব্বই দশকের সব থেকে উল্লেখ্য ঘটনা ছিল সোভিয়েতের পতন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার অবসান। বাঙালির রাজনৈতিক জীবন, তার স্বপ্ন ও সংগ্রামের সঙ্গে যোগ ছিল এই স্বপ্নপ্রয়াণের। খুব সম্প্রতি একটা লেখায় পড়লাম অরবিন্দ ঘোষও তাঁর ১৯০৬ সালের একটা লেখায় ‘প্রোলেতারিয়েত’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন, সেই শব্দের অর্থ ও ব্যবহার বোধহয় তখন সারা ভারতের কেউ জানতেন না। এই নব্বই দশকের গোড়ার দিকে ‘শতাব্দী’ নাট্যদল ‘ডিরোজিও হল’ চত্বরে তাঁদের যে নাট্যোৎসবের আয়োজন করেছিলেন তাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল বাদল সরকারের সুবিখ্যাত নাটক ‘মিছিল’, যে নাটক স্পষ্টত ‘দিনবদলের’ সুরের মূর্ছনায় একসময় উদ্বেল করেছিল স্বপ্ন-দেখা বাঙালি মনকে। অগ্রজদের থেকে গল্প শুনেছি একটা সময় এই নাটক পরিবেশনার শেষে অভিনেতা আর দর্শকরা মিলে মিশে তৈরি হত সত্যিই এক মিছিল, সেখানেই নাটকের শেষ আর স্বপ্নের শুরু। কী নিদারুণ ট্র্যাজেডি, নব্বই দশকের ওই সময়টাতেই সোভিয়েত পতনের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে কলেজ স্ট্রিটে সোভিয়েতের প্রগতিশীল বইপত্রের একমাত্র দোকান ‘মনীষা পাবলিশিং’ তখন বিপন্ন হয়ে তাঁদের সংগ্রহে থাকা সোভিয়েত বইপত্র প্রায় জলের দরে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। আমরাও তখন ব্যাগ ভর্তি করে কিনে নিচ্ছি গোর্কি, মায়াকভস্কি, টলস্টয়, গোগোল, চেকভ বা অস্ত্রভস্কির সুমুদ্রিত সাহিত্য, পাশাপাশি অত্যন্ত ঝকঝকে প্রোডাকশনের পেরেলম্যানের ‘ ফিজিক্স ফর এন্টারটেনমেন্ট’ ‘ম্যাথমেটিক্স ক্যান বি ফান’ বা আসিমভ ও অন্যান্যদের লেখা বিজ্ঞান-বিষয়ক ছোট ছোট বইগুলো। আরেকটু খুঁজে পেতে দেখলে মিলে যাচ্ছে উচ্চতর গণিতের ‘টপোলজি’ বা ‘ডিফারেন্সিয়াল জিওমেট্রি’। আর ঠিক এই কালপর্বেই ‘ডিরোজিও হল’-এর নাট্য উৎসবে ঢুকে পড়ছে ‘মিছিল’এর মতো নাটক। অবশ্য তথ্যের খাতিরে এখানে উল্লেখ করা দরকার সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার তথাকথিত ‘পতন’ কে সামনে রেখে ঠিক তার প্রতিস্পর্ধী একটি নাট্য প্রযোজনা করেছিলেন উৎপল দত্ত — সে নাটকের নাম ছিল ‘লালদুর্গ’। একই সময়ে বিশ্বব্যাপী এই পরিবর্তন নিয়ে উৎপল দত্ত অনেক পরিশ্রম করে একটি বই লেখেন যার নাম ‘প্রতিবিপ্লব’। এই সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহপাঠী তরুণীর সঙ্গে আমার গভীর সখ্যের উত্থান ও বিকাশ। ঠিক হল, আমরা দুজনেই দেখতে যাব নাট্যোৎসব।
অবশ্য বাদল সরকার মানুষটিকে এর অল্প আগেই আমরা নিয়মিত দেখতাম যাদবপুরের ক্যাম্পাসে। চৌষট্টি বছর বয়সে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘তুলনামূলক সাহিত্য’ বিভাগে। বিকেলে ক্লাসের পর আমরা বন্ধু-বান্ধবীরা বেঙ্গল ল্যাম্প গেটের উল্টোদিকে যে চায়ের দোকানে নরক গুলজার করতাম, সেখানে তিনিও চা খেতে আসতেন। আমাদের সঙ্গে তাঁর কোনও সাক্ষাৎ পরিচয় হয়নি ঠিকই, কিন্তু একটা খ্যাত মানুষকে একেবারে অন্য পরিবেশে দেখতে পাওয়া আমাদের বিচারে একটা ভিন্ন অভিজ্ঞতা। মনে রাখা দরকার, সেই সময়ে বাদল সরকারের খ্যাতি ও পরিচয় সারা ভারতজুড়ে —- তাঁর লিখিত নাটক অভিনীত হচ্ছে বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায়। যাই হোক, ‘মিছিল’ নাটক দেখতে যাওয়ার দিনটা আলাদাভাবেই উল্লেখ করতে চাই। নাটক শুরু হত সন্ধ্যে সাড়ে ছটায়। আমরা দুজনে তার আগেই পৌঁছেছিলাম কলেজ স্ট্রিটে। সংস্কৃত কলেজের গেটের সামনে হঠাৎ সেদিন দেখা হয়ে গেল অমলেন্দু চক্রবর্তীর সঙ্গে। তাঁর সেই অমল হাসি দিয়ে তিনি অভ্যর্থনা করলেন আমাদের। একথা ওকথা হওয়ার পরে উনি বললেন, চলো কোথাও বসে একটু গল্প করি। বাধ্য হয়ে বলতে হল আমাদের নাটক দেখার পূর্ব-নির্ধারিত প্ল্যানের কথা। জিজ্ঞাসা করলেন, কোন নাটক ? ‘মিছিল’ এর নাম শুনে প্রৌঢ় মানুষটির চোখেমুখে যেন আলো ছড়িয়ে পড়ল। খুব শান্ত স্বরে বললেন, তোমাদের আটকাবো না। অবশ্যই তোমরা দেখতে চলে যাও। আমার আজ অন্য একটা কাজ আছে, নাহলে আমিও আবার একবার তোমাদের সঙ্গে দেখতে যেতাম। প্রেসিডেন্সির গেট অবধি এসে স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে আমাদের বিদায় জানালেন। আমরা এগিয়ে চললাম ‘ডিরোজিও হল’ এর দিকে। ‘এখন যৌবন যার / মিছিলে যাওয়ার তার এই তো সময়’ – বাংলাদেশের এক কবির এই কবিতার লাইন কি মনে মনে উচ্চারণ করছিলেন তিনি ?
রাজনৈতিক মিছিলের প্রাণকেন্দ্র কলেজ স্ট্রিটে সেই সন্ধ্যেয় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল নাটকের ‘মিছিল’ । ‘ডিরোজিও হল’ এর সামনের চত্বরে ‘শতাব্দী’ নাট্যগোষ্ঠীর অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তৈরি করছিলেন একেক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। ছিলেন স্বয়ং বাদল সরকার। নাটকের শেষ হয়েছিল দর্শক অভিনেতাদের মিলিত এক স্ফূর্ত মিছিলে। পরে অনেকবার এই অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে নিতে চেয়েছি সলিল চৌধুরীর লেখা ‘শপথ’ কবিতার সঙ্গে। সেই কাহিনি বলা যাবে পরের পর্বে। তবে আশ্চর্য এক সমাপতন হল নতুন ধারার নাট্য আন্দোলনের এই প্রাণপুরুষ এবং শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র হিসেবে তৎকালীন কমিউনিস্ট দলের সক্রিয় কর্মী বাদল সরকার প্রয়াত হন ২০১১ সালের ১৩ মে, ঠিক যেদিন সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনের অবসানের পর ‘নতুন’ সরকারের মন্ত্রীসভা শপথ নিচ্ছিলেন রাজভবনে।
(ক্রমশ)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২১ মে
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।