এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  প্রবন্ধ

  • কোলকাতার পথের কথা  

    Sukdeb Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    প্রবন্ধ | ০১ জুলাই ২০২৪ | ২৯০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কোলকাতার পথের কথা

    ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এদেশে আসার বহু আগে থেকেই যে কোলকাতা নামে একটি জনপদ ছিল তা ‘মনসামঙ্গল’, ‘চণ্ডীমঙ্গল’ এবং ‘আইন-ই-আকবরি’তে অঞ্চলটির উল্লেখ থেকেই অনুমান করা যায়। তখন চারিদিকে জল আর জঙ্গলে ঘেরা ছিল আমাদের আজকের মহানগর। ওই শ্বাপদসঙ্কুল পরিবেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাস করত কিছু কিরাত, ধীবর এবং শবরের মত লোকজন। ধীরে ধীরে ভাগ্যের সন্ধানে এখানে আসে শেঠ, বসাক, আর্মানী, ও ইংরেজদের মত আরো অনেকে। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলে বসবাস এবং ব্যবসা করার অনুমতি পাওয়ার পর থেকে ধীর লয়ে পালটাতে থাকে এখানকার পরিবেশ এবং পরিমন্ডল। বাড়তে থাকে ঘর বাড়ি আর কমতে থাকে বনানী।

    যে কোন অঞ্চলের বিকাশের জন্য প্রাথমিক শর্তগুলির অন্যতম হল, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। সেই সময় কোলকাতায় (গোবিন্দপুর, কলকাতা,সুতানুটি) যারাই এসেছে, নদীপথে এসেছে। অরণ্যবেষ্টিত ঐ প্রত্যন্ত প্রান্তরে যোগাযোগের জন্য প্রয়োজন ভিত্তিক ছোট ছোট মেঠো পথ ছিল, আর ছিল ডিঙি নৌকো।

    তথ্য মতে চিৎপুর রোড বা অধুনা রবীন্দ্র সরণি কোলকাতার সব থেকে পুরনো রাস্তা। এই রাস্তা নির্মাণের সময়ের ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। রাস্তাটি চিৎপুর থেকে আরম্ভ হয়ে চৌরঙ্গীর জঙ্গল পার করে শেষ হত কালীঘাটে গিয়ে। কালীঘাটের তীর্থ যাত্রীরা এককালে এই পথ দিয়েই ডাকাত আর জন্তু জানোয়ারের ভয়ে দল বেঁধে যাতায়াত করত। সাহেবরা রাস্তাটির নাম দিয়েছিল ‘রোড টু পিলগ্রিম’। পরে এসপ্ল্যানেড থেকে দক্ষিণ অংশের নাম হয় চৌরঙ্গী রোড, আর উত্তরাংশের নাম হয় চিৎপুর রোড।আরও পরে সে নামও পালটে গিয়ে হল জওহরলাল নেহেরু রোড আর রবীন্দ্র সরণি। চিত্রেশ্বরী বা চিত্তেশ্বরী দেবীর নাম থেকে জায়গার নাম হয় চিৎপুর। লোকে বলে চিতে নামে এক ডাকাত এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। ভিন্ন মতে জায়গাটির নাম ছিল চিত্রপুরী। ১৬১০ সালে মনোহর ঘোষ এখানে সর্বমঙ্গলা এবং চিত্রেশ্বরীর মন্দির নির্মাণ এবং প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর এটি ডাকাতদের দখলে চলে যায়। (কলিকাতার রাজপথ - অজিতকুমার বসু)। মন্দিরের মূর্তিটি দুর্গার। সুধীর নিত্র তাঁর ‘হুগলী জেলার ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন — ‘এখন বাংলা দেশের সর্বত্র ডাকাতে কালী দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু ডাকাতে দুর্গা একমাত্র কাশীপুর চিৎপুর ছাড়া আর কোথাও আমার নয়নগোচর হয়নি।’ পুরো এলাকা তখন ছিল ঘন জঙ্গল। চিৎপুর রোডের ধারে এককালে পেরিন সাহেবের মনোরম প্রমোদ উদ্যান ছিল।

    ১৭০৬ থেকে ১৭৫৬ পর্যন্ত কোলকাতার তিনটি গ্রামের মোট চারবার জরিপ করা হয়। ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দের প্রথম জরিপে জানা যায় যে তখন কোলকাতায় ২টি স্ট্রিট ও ২টি লেন ছিল। শহরের মোট জমির পরিমান ছিল ১৬৯২ একর। ১৭২৬ সালে দ্বিতীয় জরিপে দেখা যায় স্ট্রিট ৪টি এবং লেন ৮টি। এই ২০ বছরে জমির পরিমান বেড়ে ২৩৫০ একর হয়েছে, কিন্তু রাস্তা বেড়েছে মাত্র ২টি এবং গলি বেড়েছে ৬টি। ১৭৪২ সালে তৃতীয় জরিপে পাওয়া যায় জমির পরিমান ৩২২৯ একর, স্ট্রিট ১৬টি, লেন ৪৬টি এবং বাই লেন ৭৪টি। এই সময়ে চৌরঙ্গী অঞ্চল ব্রিটিশদের অধিকারে আসে, এবং রাস্তার সংখ্যাও অনেক বাড়ে। বর্তমানের গড়ের মাঠ বা ময়দান অঞ্চলটি তখন ছিল জঙ্গল। ১৭৫৬তে শহরে জমির পরিমান বাড়ে নি, কিন্তু জনবসতি দ্রুত বেড়েছে। ওই সময় পাকা বাড়ির সংখ্যা ছিল ৪৯৮টি এবং কাঁচা বাড়ি ছিল ১৪৪৫০টি। সেই অনুপাতে রাস্তা তেমন একটা বাড়েনি। স্ট্রিট ছিল ২৭টি, লেন ৫২টি এবং বাই লেন ৭৪টি।

    প্রকৃত অর্থে বড় রাস্তা তখনও পর্যন্ত একটিও ছিল না। স্ট্রিট, লেন, বাই লেন, সব রাস্তাই ছিল সরু ও কাঁচা। কাঁচা রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি চলতে পারে না। এদিক ওদিক যেতে হলে তিনটি উপায় ছিল — হেঁটে, গরুর গাড়িতে, অথবা পালকিতে। কোলকাতার প্রথম বড় পাকা রাস্তা হল সার্কুলার রোড। তৈরি হয় ১৭৯৯ সালে। পাকা রাস্তা বলতে পাথরের টুকরো দিয়ে নয়, ইটের খোয়া দিয়ে বাঁধান। এই রাস্তা তৈরি হয়েছিল বর্গিদের আক্রমণের ভয়ে খনন করা মারাঠা ডিচকে ভরাট করে। এই কাহিনী অন্য অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।

    প্রথম দিকের মানচিত্রে রাস্তার নাম থাকত না। ১৭৯২ সালে কর্নেল মার্ক উডের প্রকাশিত মানচিত্রে ২৬টি রাস্তা ব্যক্তির নামে পাওয়া যায়। সিংহভাগ ইংরেজদের নামে হলেও ৬টি রাস্তা বাঙালিদের নামে ছিল। সেগুলি হল - মদন দত্ত, প্রাণকৃষ্ণ বাবু, নিলু দালাল, প্রাণকৃষ্ণ চ্যাটার্জী, মুক্তরাম বাবু এবং বলরাম ঘোষ।

    ছিল এলাকার নামে কিছু রাস্তা। যথা, বিউরিয়াল গ্রাউন্ড রোড(পরে পার্ক স্ট্রিট, আরও পরে মাদার টেরিজা সরণি), ডুম টোলি(এজরা স্ট্রিট), পুরানা নাচঘর কা পুরব রাস্তা (লর্ড সিনহা রোড), হোগলকুড়িয়া গলি (সাহিত্য পরিষদ স্ট্রিট) প্রভৃতি।

    সিরাজদৌলার কোলকাতা আক্রমণের পরের কয়েক বছরে তৈরি হল শ্যামবাজার রোড, মাণিকচরণ রোড (মাণিকতলা স্ট্রিট), গোপালনগর রোড, দমদম রোড (বেলগাছিয়া রোড), বারাসাত রোড, বেলিয়াঘাটা রোড।

    পলাশীর যুদ্ধের পরে কোলকাতার গভর্নর হলওয়েল সাহেবের বাসনা হল শহরে পেশাভিত্তিক বসতি গড়ে তোলার। কিছুটা তাঁর প্রচেষ্টায় আর অনেকটাই পেশাগত কারণে কোলকাতায় এইরকম বেশ কিছু অঞ্চল গড়ে উঠল। এই পেশাভিত্তিক বসতিগুলোও আবার আকারে প্রকারে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের ছিল।

    ঝুপড়ী, তাঁবু, কুঁড়ে ইত্যাদি অস্থায়ী আবাসকে বলা হত টোলা। শ্যামবাজারে ছিল কম্বুলে টোলা। এখন এটি রাস্তার নাম। এখানে একসময় কম্বুলেরা ভেড়ার লোম কেটে কম্বল তৈরি করত। বেনেটোলায় ছিল মশলা বিক্রেতাদের আস্তানা, পটুয়াটোলায় পোটো বা চিত্রকরদের আস্তানা, কলুটোলায় কলুদের আস্তানা, আর কুমোরটুলি তো এখনও প্রতিমা তথা মাটির জিনিসপত্র তৈরির অতি পরিচিত স্থান। এমনই কাঁসারি টোলা, আহিরিটোলা, জেলেটোলা, কসাইটোলা, কপালিটোলার মত আরও অনেক টোলা বা টুলি ছিল যার, কিছু এখনও আছে, কিছু হারিয়ে গেছে, আর কিছু রাস্তার নামে রূপান্তরিত হয়েছে।

    নিবাস স্থায়ী হলে তাকে বলা হত পাড়া। যথা মালিপাড়া(লেনিন সরণির গায়ে), মুসলমান পাড়া(সূর্য সেন স্ট্রিটের পূর্ব দিকে), চাষা ধোপা পাড়া (সিমলা স্ট্রিটের পাশে), কাঁসারি পাড়া, ছুতোর পাড়া, গোয়াল পাড়া, তেলি পাড়া ইত্যাদি। এগুলিরও বর্তমানে কিছু আছে কিছু নেই, আর তেলি পাড়া, গোয়াল পাড়ার মত কিছু অঞ্চল রাস্তা রূপে অবস্থান্তরিত হয়ে অতীতকে বহন করে চলেছে।

    প্রথমদিকে কোলকাতায় অনেক ফাঁকা জায়গা ছিল। সেইসব স্থানে যখন বসতি গড়ে উঠল তখন গাছ, দেবতা বা সেখানকার পরিচিত কিছুর সাথে ‘তলা’ যোগ করে এলাকার নাম দেওয়া হত। যেমন, বটতলা, লেবুতলা, আমড়াতলা, তালতলা, ধর্মতলা, চাঁপাতলা ইত্যাদি। আবার তলা কিছু ক্ষেত্রে ‘তলাও’ থেকে এসেছে। বির্জিতলা যেমন বীরজী তলাও থেকে এসেছে। এখানে পুকুরের ধারে হনুমানজীর পুজো হত।

    কাছাকাছি বড় জলাশয় থাকলে স্থানের নামের সাথে পুকুর যোগ হত। যেমন, শ্যামপুকুর, ফড়েপুকুর, কাঁটাপুকুর, মনোহর পুকুর, ঝামাপুকুর, বেনেপুকুর, পদ্মপুকুর। অধিকাংশ পুকুরেরই এখন দেখা পাওয়া না গেলেও ওই নামে অনেকগুলি রাস্তার সন্ধান পাওয়া যাবে।

    গ্রাম থেকে রূপান্তরের পর্বে এ শহরে অনেক হাট ছিল। নগরায়নের সাথে সাথে তা বাজারের মাঝে লীন হয়ে গেল। গরানহাটা, গরুহাটা, দরমাহাটা, মুরগিহাটা, স্বব্যাখ্যাত এইসব হাটা বা হাটগুলি অতীতকে আমাদের সামনে মেলে ধরে।

    সেকালের ধনী ব্যক্তিরা শহরে অনেক জমি জায়গা নিয়ে বড় বড় বাগান বাড়ি বানাতেন। বাঙালি বাবুরা ছাড়াও ইংরেজ, পার্সি, ইহুদী, ফিরিঙ্গী, অনেকেরই বিলাসবহুল অট্টালিকা ছিল। ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রের পাশাপাশি দুটি বাগানবাড়ি ছিল। তার এখন নাম জোড়াবাগান। রাজা রাজবল্লভের বাগানবাড়ি ছিল রাজাবাগানে। যে জায়গার নামে বিখ্যাত মোহনবাগান ক্লাব সেখানে ছিল গোপীমোহন দেবের বাগানবাড়ি। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে ক্যাপ্টেন স্ট্যাফোর্ড ‘ফেলকন’ জাহাজে করে এলেন কোলকাতার ঘাটে। তিনি স্থানীয় ভাষা কিছুই জানেন না। কিংবদন্তি আছে, তিনি বাবুদের কাছে খোঁজ করলেন একজন দোভাষীর। সেই বাবুরাও ছিল ইংরাজিতে পণ্ডিত। সাহেবের কথা শুনে তাঁদের মনে হল তিনি বোধহয় ধোপা চাইছেন। সত্ত্বর ঘরে গিয়ে পাঠিয়ে দিলেন রতু ধোপাকে। চালাক রতু প্রাথমিক ভয় ভীতি কাটিয়ে সাহেবদের সাথে রয়ে গেল। সাহেবদের ফাই-ফরমাশ, খিদমৎ খেটে অচিরেই সে হয়ে গেল একজন বিত্তবান মানুষ। তারও হল বাগান বাড়ি। রতন সরকারের নামে কোলকাতায় দুটি রাস্তা রয়েছে। প্রথমটি হল জোড়াসাঁকো অঞ্চলের ‘রতন সরকার গার্ডেন’ স্ট্রিট এবং দ্বিতীয়টি কলুটোলার ‘রতু সরকার লেন’। বাড়িগুলির অধিকাংশই লুপ্ত হয়ে সেখানে গড়ে উঠেছে বসতি। তবে সেইসব বাগানে হওয়া বসতির নামের শেষে ঝুলে আছে একটুকরো বাগান। যেমন, বাদুড়বাগান, চালতাবাগান, হর্তকিবাগান, গোয়াবাগান, পার্সিবাগান, রায়বাগান, অ্যান্টনি বাগান, ফুলবাগান। অবশ্য সব বাগানই বাগানবাড়ি ছিল না। যেমন, চোরবাগান, কলাবাগান।
    এই টোলা, পাড়া, হাটা, তলা, বাগান, সম্বলিত এলাকা অথবা রাস্তাগুলি আগলে রেখেছে কোলকাতার গত কালকে।

    পলাশীর যুদ্ধের পরে ইংরেজদের অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হলেও পরের কয়েক দশক রাস্তাঘাট সহ শহরের সামগ্রিক উন্নয়নে তেমন একটা প্রয়াস ছিল না। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পাদে হেস্টিংস এবং কর্নওয়ালিসের আমলে উন্নয়ন মূলক কাজকর্ম শুরু হয়, যা পূর্ণতা পায় লর্ড ওয়েলেসলির জমানায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ১৮০৫ এবং ১৮০৯ সালে কয়েক বছরের ব্যবধানে তৈরি হয় দু দুটি শহর উন্নয়ন কমিটি। এই সময় বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য লটারির মাধ্যমে টাকা তোলার প্রবনতা দেখা যায়। ১৭৮৪ তে তৈরি হয়েছিল লটারি কমিশন। ১৮১৭ তে হয় লটারি কমিটি, যা বহাল ছিল ১৮৩৬ সাল পর্যন্ত।

    এই লটারির সৌজন্যে অন্যান্য উন্নয়ন মূলক কাজের সাথে সাথে শহরের রাস্তার মানচিত্রেও আসে ব্যাপক পরিবর্তন। ১৮০৫ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে তৈরি হয়েছিল—ইলিয়ট রোড, স্ট্র্যান্ড রোড, উড স্ট্রিট, ওয়েলেসলি স্ট্রিট, ওয়েলিংটন স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, কর্নওয়ালিস স্ট্রিট, হেস্টিংস স্ট্রিট, ময়রা স্ট্রিট, লাউডন স্ট্রিট, আমহারস্ট স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিট, কলুটোলা স্ট্রিট, মির্জাপুর স্ট্রিট, ক্যানাল স্ট্রিট, রডন স্ট্রিট, হাঙ্গারফোরড স্ট্রিট। এছাড়াও ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, ম্যাঙ্গো লেন এবং বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটকে চওড়া ও সোজা করা হয়। এই সময়ে গড়ের মাঠের মধ্যে দিয়ে গাড়ি চলার এবং পায়ে হাঁটার অনেকগুলি রাস্তা তৈরি হয়। রাস্তাগুলিকে পাকা করার জন্য প্রতি বছর ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হত।

    লটারি কমিটি উঠে যাওয়ার পরে বেশ কিছুদিন কাজকর্মে শৈথিল্য আসে। ওই কয়েক দশকে উল্লেখ করার মত তেমন কিছুই হয়নি।

    ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে আবার কাজকর্মে কিছুটা গতি আসে। ১৮৬৪ সালে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটকে বর্ধিত করে ধর্মতলা স্ট্রিটের সাথে যুক্ত করা হয়। ১৮৬৫তে তৈরি হয় ক্যানিং স্ট্রিট, ১৮৬৮তে বিডন স্ট্রিট, ১৮৭৩রে গ্রে স্ট্রিট। হ্যারিসন রোড (মহাত্মা গান্ধী রোড) তৈরি হয় ১৮৮৯ সালে। এই রাস্তাটির প্রথমে নাম ছিল সেন্ট্রাল রোড।

    তখন কোলকাতা বলতে মারাঠা ডিচ বা তার উপরে তৈরি সার্কুলার রোডের অন্দরের অংশকে বোঝাত। ১৮৮৮ সালে এই সীমারেখার বাইরের কিছু শহরতলিকে কোলকাতার সাথে যুক্ত করা হয়। সেগুলি হল - এন্টালি, বেনিয়াপুকুর, ট্যাংরা, তপসিয়া, বালিগঞ্জ, ভবানীপুর, কালীঘাট, চেতলা, আলিপুর, খিদিরপুর প্রভৃতি। এই অঞ্চলগুলি কোলকাতার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে তৈরি হল- ল্যান্সডাউন রোড, হরিশ মুখার্জী রোড, হাজরা রোড, চেতলা সেন্ট্রাল রোড, স্টার্নডেল রোড, জজেস কোর্ট রোড, গোপাল নগর রোড, সবজিবাগান রোড, কালী মন্দির রোড, হেস্টিংস পার্ক রোড, উডবার্ন পার্ক রোড, জগন্নাথ দত্ত স্ট্রিট এবং গ্যাস স্ট্রিট।

    কোলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট গঠিত হয় ১৯১২ সালের ২ জানুয়ারি। এই ট্রাস্ট কোলকাতায় ছোট বড় অনেক রাস্তা তৈরি করে এবং একই সাথে প্রচুর সরু রাস্তাকে চওড়া এবং উন্নত করে।

    ১৮৫৬ সালে হ্যালিডে স্ট্রিট নামে ১/৩ মাইল লম্বা এবং আনুমানিক ৭০ থেকে ৮০ ফুট চওড়া একটি রাস্তা তৈরি হয়েছিল। রাস্তাটি আয়তনে ছোট হওয়ায় যান চলাচলের ক্ষেত্রে তেমন একটা উপযোগী ছিল না। ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বেশ কিছু জমি অধিগ্রহণ করে রাস্তাটিকে উত্তরে এসপ্ল্যানেড থেকে দক্ষিণে গ্যালিফ স্ট্রিট এবং কাশীপুর রোডের জংশন পর্যন্ত প্রসারিত করে তৈরি করে কোলকাতার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজপথ। ১০০ফুট চওড়া সেই রাজপথের বিভিন্ন অংশের আজকের নাম হল, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ অ্যাভিনিউ, গিরীশ অ্যাভিনিউ, যতীন্দ্র মোহন অ্যাভিনিউ এবং চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ। ওই অঞ্চলেই যতীন্দ্র মোহন অ্যাভিনিউ থেকে শুরু হয়ে কর্নওয়ালিস স্ট্রিট পার করে শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় পর্যন্ত আর একটি চওড়া রাস্তা তৈরি হয়। বিখ্যাত মানুষ ভূপেন্দ্রনাথ বসুর নামে নাম রাখা হয় ভূপেন্দ্র বসু অ্যাভিনিউ।

    বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও এখনকার দক্ষিণ কোলকাতার অনেকটাই ছিল জলাভূমি এবং জঙ্গল। ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ওই সব অঞ্চলে প্রচুর জমি অধিগ্রহণ করে এলাকাগুলির উন্নয়নে সচেষ্ট হয়। তৈরি করা হয়, গড়িয়াহাট রোড থেকে রসা রোড পর্যন্ত বিস্তৃত, দুটি সমান্তরাল গুরুত্বপূর্ণ রাজপথ। একটি রাস্তার নাম রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। রাস্তাটি ১২০ ফুট চওড়া, মাঝে রয়েছে ট্রামের লাইন। রাস্তার নিচে রয়েছে ৯ ফুট ব্যাসের পয়ঃপ্রণালী। প্রথমে রাস্তার নাম ছিল Main Sewer Road। এই নামে জনগণের আপত্তি আসতে থাকায়, ১৯২৯ সালে নতুন নাম রাখা হয় বালিগঞ্জ অ্যাভিনিউ। ১৯৩১ সালে পুরসভার আদেশে বালিগঞ্জ অ্যাভিনিউ হয়ে গেল রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। দ্বিতীয় রাস্তাটি তিনবারে তৈরি হয়েছে। প্রথম অংশ তৈরি হয় ১৯৩৩ সালে, দ্বিতীয় অংশ ১৯৩৯ সালে এবং তৃতীয় অংশ ১৯৪২ সালে। নাম রাখা হয় ‘সাদার্ন অ্যাভিনিউ’। রাস্তাখানি ১৫০ ফুট চওড়া এবং ২৫৬৭গজ লম্বা। রাস্তার মাঝে রয়েছে ঘাসে ঢাকা ৫৮ ফুট চওড়া Boulevard বা বীথিকা। রাস্তাটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ১১,১৯,১৩৩ টাকা। গত শতকের ষাটের দশকে রাস্তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হল ‘ডঃ মেঘনাদ সাহা সরণি’।

    পার্ক সার্কাস অঞ্চলে ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট পাঁচটি নতুন রাস্তা তৈরি করে। রাস্তাগুলি হল - নিউ পার্ক স্ট্রিট, নিউ থিয়েটার রোড, সার্কাস অ্যাভিনিউ, সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউ এবং সুরাবর্দি অ্যাভিনিউ। এই গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলি তৈরি হওয়ার ফলে কড়েয়া বাজার অঞ্চলের চিত্রটাই পালটে গিয়েছিল।

    শহরের পূর্বদিকে, কাঁকুড়গাছি ফুলবাগান অঞ্চলে, কোন বড় রাস্তা ছিল না। এমনকি জনবসতি যথেষ্ট থাকলেও, ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালীর কোন ব্যবস্থা ছিল না। ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ১৯৪৮ সালে এই অঞ্চলের সার্বিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা করে তা রুপায়নে সচেষ্ট হয়। উল্টডাঙ্গা থেকে বেলেঘাটা পর্যন্ত একটি প্রশস্ত রাস্তা(১০০ থেকে ১২০ফুট) তৈরি করা হয়। রাস্তার নিচে বানান হয় ১০ ফুট ব্যসের ইঁটের পয়ঃপ্রণালী। তৈরি করা হয় আরও কিছু মাঝারি ও ছোট রাস্তা। আচার্য সত্যেন বসু সরণি এবং হেমচন্দ্র নস্কর রোড ছাড়া বাকি সব রাস্তাই লোকে সি আই টি রোড নামে জানে। রাস্তা, পয়ঃপ্রণালী, উদ্যান (সুভাষ সরোবর) ইত্যাদি নির্মাণের পর মানিকতলা, কাঁকুড়গাছি, নারকেলডাঙা প্রভৃতি অঞ্চলের পরিবেশ ও পরিস্থিতির লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে।

    ডালহৌসি থেকে হাওড়া ব্রিজের মুখ পর্যন্ত ১০০ ফুট চওড়া এবং ১০৫০ গজ লম্বা একটি রাস্তা বানান হয়। খরচ হয় আনুমানিক ২ কোটি টাকা। ১৯৫০ সালে এই রাজপথে যান চলাচল শুরু হয়। রাজপথটিকে ব্র্যাবোর্ন রোড হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে নাম বদল করে বিপ্লবী ত্রৈলোক্য মহারাজ সরণি রাখা হয়।

    বড়বাজারের মত ঘিঞ্জি অঞ্চলে শতেক সমস্যার মধ্যেও কিছু রাস্তা প্রশস্ত করা হয় যার মধ্যে ময়দাপট্টি অঞ্চল বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে।

    উপরে উল্লিখিত পথগুলি ছাড়াও ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বা সি আই টি, রসা রোড, বটকৃষ্ট পাল অ্যাভিনিউ, সুন্দরী মোহন অ্যাভিনিউ, সান ইয়াৎ সেন স্ট্রিট, বিবেকানন্দ রোড(মানিকতলা স্পার), বালমুকুন্দ মক্কর রোড(চিৎপুর স্পার) এর মত আরো বেশ কিছু রাস্তা শহরের মানচিত্র যোগ করে।

    এবার একটু জানা যাক, কেমন ছিল সে যুগের রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ এবং তাকে সুসজ্জিত করার প্রয়াস। ইংরেজরা কোলকাতায় আসার পর থেকে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে একটি দুটি করে রাস্তা তৈরি করতে শুরু করে। প্রথম দিকে সব রাস্তাই ছিল কাঁচা। ১৮২০ সাল থেকে রাস্তা পাকা করার প্রবণতা দেখা যায়। সেই সময় পাকা রাস্তা খোয়া এবং পাথরকুচি দিয়ে বানান হত। তখন পাথরকুচি বিদেশ থেকে আমদানি করা হত, ফলে রাস্তা সংস্কারের জন্য অনেক খরচ পড়ে যেত। ১৮৬৩ সালে খরচ হয় ১৮৫০০০ টাকা, ১৮৭৫ সালে হয় ৩৮৪০০০ টাকা এবং ১৯১৪ সালে তা বেড়ে হয় ৪৬৫০০০ টাকা। ভারি গাড়ি চলাচলের উপযুক্ত রাস্তা নির্মাণের জন্য তখন নানারকমের পরীক্ষা শুরু হয়। ১৯০৭ থেকে ১৯১০ সালের মধ্যে অ্যাসফল্ট ম্যাকাডাম দিয়ে ডালহৌসি স্কয়ারের পূর্ব দিক এবং কলেজ স্ট্রিট পাকা করা হয়। প্রাথমিকভাবে রাস্তা মসৃণ এবং সুন্দর মনে হলেও অল্পদিনেই তা নষ্ট হয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই ওই প্রচেষ্টা বাতিল হয়ে যায়। ১৯১০ সালে বার্ড কোম্পানি হাজির হয় তাদের ধূলিশূন্য রাস্তা নির্মাণের প্রকল্প নিয়ে। এই পদ্ধতিতে রাস্তার ওপরের স্তর ৩ ইঞ্চি তুলে ফেলে সেখানে বার্ড কোম্পানি ঢেলে দেবে তাদের তৈরি মিশ্রণ। তারপর স্টিম রোলার চালিয়ে রাস্তা সমান এবং মসৃণ করে দেওয়া হবে। ১৯১০ সালের ১৫ জানুয়ারি এই প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। ওই মিশ্রণ দিয়ে ক্লাইভ স্ট্রিটের কিছুটা এবং লায়ন্স রেঞ্জ তৈরি হয়। মিশ্রনটির নাম ছিল গ্লাডওয়েল সিস্টেম। ঐ একই বছরে বার্ড কোম্পানি আর একটি প্রস্তাবে জানায় যে তারা মেসার্স লিমর অ্যাসফল্ট পেভিং কোম্পানির লিথোফল্ট ব্লক দিয়ে ১০০০ গজ রাস্তা বানিয়ে দেবে। এই প্রস্তাবও পুরসভার ১৯১০ সালের ১২ মার্চের সভায় অনুমোদিত হয়। রাইটার্স বিল্ডিং এর সামনের রাস্তা লিথোফল্ট ব্লক দিয়ে তৈরি হয়। বার্ড কোম্পানিও সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এরপর পুরসভার ইঞ্জিনিয়ার মিঃ ম্যাক্কাবে উদ্ভাবন করলেন উন্নততর মিশ্রণ, ম্যাক্কাবে সিস্টেম। লায়ন্স রেঞ্জ, এসপ্ল্যানেড রো ইস্ট এবং চৌরঙ্গী রোডের কিছুটা এই পদ্ধতিতে তৈরি হয়। আগের থেকে খরচ কিছুটা বেশি হলেও এই মিশ্রণের পরমায়ু বেশি ছিল। পাথরের রাস্তার আওয়াজে দফতরের কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটছে, কিছু অফিস থেকে এমন অভিযোগ আসে। অনুরোধ করা হয় অফিসের সামনের রাস্তা কাঠের করে দেওয়ার জন্য। বিদেশের কিছু রাস্তার অনুকরণে কাঠের রাস্তা তৈরির নানা প্রস্তাব বিভিন্ন সময় এসেছে। কিন্তু কাঠের রাস্তার নানা সমস্যার কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। পিচ অ্যাসফল্ট ইত্যাদি দিয়ে আধুনিক রাস্তা করা শুরু হয় ১৯২৪/২৫ সালে।

    কোলকাতা শহরে রাস্তা ধোয়া শুরু হয় ১৮১৮ সালে। প্রথমদিকে পুকুর, ডোবা ইত্যাদি থেকে মশকে করে জল নিয়ে ভিস্তিরা রাস্তা ধুত। এরপর বেশ কয়েকটি রাস্তার পাশে aquaducts বানান হয়। চাঁদপাল ঘাট এবং নিমতলা ঘাটের পাম্পিং স্টেশন থেকে এগুলিতে জল সরবরাহ করা হত। রাস্তা ধোয়ার খরচ সেই সময় রাস্তার ধারের বাসিন্দাদের জোগাতে হত।

    রাস্তাগুলির সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দুই পাশে গাছ লাগান হত। ১৮৬৯ সালে প্রথম এই প্রচেষ্টা শুরু হলেও, এই খাতে ব্যয় করার আইনগত অনুমোদন না থাকায়, কিছুদিনের মধ্যে তা বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে আইনবলে পুরসভা বৃক্ষ রোপণের খাতে খরচ করার অধিকার পায়। এরপর অনেক রাস্তার ধারে গাছ লাগান হয়। বোটানিক্যাল গার্ডেনের মিঃ লেনের সুপারিশ মত এই উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে বেশ কিছু চারা গাছ আনা হয়। গাছ পোঁতা এবং সেগুলির দেখভালের জন্য কিছু কর্মীকে বহাল করা হয়। সেই সময় লাউডন স্ট্রিট ছিল সবথেকে সুন্দর সুসজ্জিত রাস্তা।

    সেকালে পল্লী জীবন সচল থাকত সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত, তারপরেই সব সুনসান। কিন্তু শহর কোলকাতার জীবন যাপন তো তেমন নয়। সেখানে রাতেও রাস্তা সচল থাকে। এই রাতের রাস্তাকে সচল রাখতে প্রয়োজন আলোর। প্রথমদিকে জ্বলত তেলের বাতি। তখন শহরে বড় বড় রাস্তার ধারে মোট ৩১৩টি তেলের বাতি জ্বলত। আলো জ্বালানো, বাতি পরিস্কার, তেল আর পলতের জোগান, সমস্ত কাজ ঠিকাদারেরা করত। এইসব কাজের জন্য বাতিদান পিছু পুরসভার মাসিক বরাদ্দ ছিল ১টাকা ২য়ানা ৬পাই। সেই সময় রাস্তার ধারের বাড়ির মালিকদের নিজের খরচে সদর দরজায় আলো লাগান বাধ্যতামূলক ছিল। ১৮৫৬ সালে নতুন আইন করে ঠিক হয় যে, বাড়ির বার্ষিক মূল্যায়ন ১২০টাকা বা তার ঊর্ধ্বে হলে শতকরা ২ টাকা করে আলো কর দিতে হবে। বাতিদানের সংখ্যা বেড়ে ৪১৭হয়। তেলের বাতিতে আলো তেমন একটা হত না। ১৮৫৭ সালের ৯ জুলাইয়ের সন্ধ্যায় কোলকাতার চৌরঙ্গী রোডে প্রথম গ্যাসের আলো জ্বলল। ওরিয়েন্টাল গ্যাস কোম্পানি এর পর শহরে ৬০০টি গ্যাসের বাতিদান লাগাল। ১৮৫৭ সালের ১৪ মের চুক্তি অনুসারে রাতে ১০ ঘন্টা ওই গ্যাসবাতি জ্বলবে এবং প্রতিটি বাতিদানের জন্য পুরসভা গ্যাস কোম্পানিকে বছরে ৯০ টাকা করে দেবে। গ্যাস বাতি ছাড়াও ওই সময় রাস্তায় ১০০০টি তেলের বাতিও ছিল। আলো কম হওয়ায় গ্যাসের বাতির বিরুদ্ধে করদাতাদের বিস্তর অভিযোগ ছিল। যদিও তেলের বাতির তুলনায় তা অনেকটাই বেশি ছিল। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনমত ব্যবস্থা নেওয়া হত। কোলকাতার রাস্তায় প্রথম বৈদ্যুতিক আলো বসে হ্যারিসন রোডে, ১৮৯১ সালে। এই আলো দেওয়ার জন্য হ্যালিডে স্ট্রিট পাম্পিং স্টেশনে ডায়নামো বসান হয়। ১৮৯৫ সালে প্রথম রাস্তার আলোর বিদ্যুৎ সরবরাহ করার অনুমতি পেল ‘The Calcutta Electric Lighting Corporation Ltd.’. এরপর ১৮৯৭ সালে আত্মপ্রকাশ করে ‘Indian Electric Company Ltd’. মাসখানেক বাদে কোম্পানিটির নতুন নাম রাখা হল, ‘The Calcutta Electric Supply Corporation Ltd’. বৈদ্যুতিক বাতি এসে গেলেও গ্যাস এবং তেলের বাতিও কোলকাতায় অনেকদিন ছিল। ১৯৪০-৪১ সালে শহরের রাস্তায় মোট আলো ছিল ২৮৩০১টি। তার মধ্যে বৈদ্যুতিক বাতি ছিল ৮৮৪০টি, গ্যাসের বাতি-১৯১০৯টি এবং তেলের বাতি- ৩৫২টি। ১৯৫০ এর দশকে তেল এবং গ্যাসের বাতি শহর থেকে বিদায় নেয়।

    ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধ থেকে ব্যক্তির নামে রাস্তার নামকরনের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তার আগে কোথা থেকে শুরু হয়ে কোন দিকে গেছে- এটাই ছিল অধিকাংশ রাস্তার পরিচয়। তখন অনেক রাস্তারই কোনো ছিরি ছাঁচ ছিল না, গ্রামের রাস্তার মত এঁকে বেঁকে খানিকটা গিয়ে বড় রাস্তায় মিশত। ক্রুকেড লেন, সার্পেন্টাইল লেন, জিগজ্যাগ লেনের মত কিছু গলি এখনও সেদিনের কথা স্মরণ করায়।

    বিশিষ্ট লোকজনের নামে অনেক রাস্তার নাম হয়েছে। অক্রুর দত্ত লেন, রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটের মত কিছু রাস্তা বিত্তবান মানুষেরা নিজেরা খরচ করে বানিয়ে নিজেদের নামে নামাঙ্কিত করেছিলেন। কিন্তু কোলকাতায় এমন অনেক এলাকা ছিল যেখানে তেমন গণ্যমান্য লোকজন থাকতেন না। ওস্তাগর, খানসামা, দর্জি, মিস্ত্রির মত প্রান্তিক মানুষেরা সেখানকার বাসিন্দা ছিল। ঐ সব অঞ্চলের রাস্তার নামকরণ হয়েছিল অঞ্চলেরই পরিচিত কোন মানুষ বা স্থানীয় কিছুর নামে। যথা—ছিদাম মুদি লেন, শ্যামাবাই গলি, অখিল মিস্ত্রি লেন, পাচি ধোপানির গলি, গাঁজা ওয়ালা গলি, হুঁকা ওয়ালা গলি, খইরু মেথর লেন, ধাঙড় পাড়া লেন, ছকু খানসামা লেন, শরিফ দফতরি লেন, রফিক সারেঙ লেন, করিমবক্স খানসামা লেন ইত্যাদি। করিমবক্স ছিল রাজভবনের খানসামা।

    ১৮৭৭ সালের পর বেশ কিছু রাস্তার নাম পালটান হয়। গাঁজা ওয়ালা গলি হয় মোহনলাল মিত্র লেন, রমজান ওস্তাগর লেন হয় মদন দত্ত লেন, ফক্স লেন হয় প্রতাপ চ্যাটার্জী স্ট্রিট, নানকু জমাদার লেন হয় বেন্টিঙ্ক ফার্স্ট লেন, ধোপাপাড়া লেন হয় পণ্ডিত লেন, চুনাম গলির নাম হয় ফিয়ার্স লেন, পটুয়াটোলা বাই লেন হয় চিন্তামণি দাস লেন, রতন মিস্ত্রি লেন হয় শ্যামাচরণ দে লেন। অধিকাংশ নাম পালটে গেলেও গুলু ওস্তাগর লেন, দর্জি পাড়ার মত কিছু আদি নাম রয়ে গিয়েছিল।

    শহরের রাস্তাঘাটের নামের মধ্যে নিহিত আছে নগর জীবনের বিবর্তনের নানান কাহিনী। একসময় ইংরেজ রাজপুরুষদের নামে তো রাস্তা ছিলই, এমনকি তাদের গৌরবগাথাও স্থান পেয়েছে পথনামে। ওয়াটারলু যুদ্ধের বিজয়ের স্মারক, ওয়াটারলু স্ট্রিট এবং প্রিটোরিয়ায় ব্রিটিশ পতাকা উত্তোলনের দিনকে স্মরণ করে প্রিটোরিয়া স্ট্রিট।

    স্থানীয় বেশ কিছু ঘটনাও জায়গা করে নিয়েছে পথনামে। আলিপুরের ডুয়েল অ্যাভিনিউ। আগে ইংরেজ রাজপুরুষদের মধ্যে কোন বিতর্কের মৌখিক সমাধান না হলে অনেক ক্ষেত্রে বন্দুক বা তরোয়াল নিয়ে আনুষ্ঠানিক লড়াই করে তার মীমাংসা করা হত। একে বলা হত ডুয়েল। ১৭৮০ সালের ১৭ অগাস্ট এখানে পিস্তল নিয়ে লড়াই করেছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস এবং কাউন্সিলের সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মতবিরোধ ছাড়াও এই ডুয়েলের নেপথ্যে ছিল এক সুন্দরী নারী।

    রাজভবনের উল্টো দিকে একটা রাস্তা ঢুকে গেছে। বড় বাহারি নাম ছিল তার, ফ্যান্সি লেন। ছিল বলছি কারণ, এখন তার নাম হয়েছে পান্নালাল ব্যানার্জী স্ট্রিট। রাস্তাটি ওয়েলেসলী প্লেস থেকে কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট পর্যন্ত বিস্তৃত। ফ্যান্সি শুনে শৌখিন বা মনোরম কিছু ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। এখানে দিবালোকে সর্বসমক্ষে ফাঁসি দেওয়া হত। ফাঁসি শব্দটা সাহেবদের মুখে উচ্চারণে বিকৃতি ঘটে হয়ে গিয়েছিল ফ্যান্সি। বীভৎস এই ঘটনার সাক্ষী থেকেছে শহর কলকাতা। তখন হুগলী নদী থেকে একটা খাল কলভিন ঘাট বা কাঁচাগুড়ি ঘাট থেকে বেরিয়ে হেস্টিংস স্ট্রিটের পুরান সমাধিক্ষেত্রের পাশ দিয়ে বেন্টিঙ্ক অতিক্রম করে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের গা ঘেঁসে গিয়ে বেলেঘাটা হয়ে লবণহ্রদে পড়ত(কারো মতে বিদ্যাধরী নদিতে)। খালটির নাম ছিল ক্রিক খাল। ‘কলিকাতা’ সেটলমেন্ট প্রস্তাবে খালটির নক্সা আছে। ১৭৩৭ সালের ৩০ সেপটেম্বর, এক চরম দুর্যোগের দিনে এই খালে নৌকাডুবি হয়ে অনেক মানুষ মারা যায়। সেই থেকে নাম হয় ডিঙ্গা ভাঙা খাল। পরবর্তীকালে এটিকে বুজিয়েই হয় হেস্টিংস স্ট্রিট(এখনকার কিরণ শঙ্কর রায় রোড) এবং ক্রিক রো। এই খালের ধারে একটি গাছ ছিল ফাঁসির মঞ্চ। সামান্য অপরাধে, কখনও বা বিনা অপরাধে, ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে লোক জড় করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হত গরিব নেটিভদের। ১৮০০ সালে জনৈক ব্রজকিশোরের ফাঁসি হয়েছিল ২৫টাকা দামের একটা ঘড়ি চুরি করার অপরাধে। সেই সময় এমন কত যে ব্রজকিশোরের এখানে বলি হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই।

    ছোট একটা গলি। অধিকাংশ দোকান বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রের। দিনের বেলা লোকজনের ভিড়ে সরগরম। রাতের নির্জনতা স্মরণ করিয়ে দেয় যে গলিটার নাম গুমঘর লেন। যদিও অতীতে এখানে গুম হওয়ার কোন রেকর্ড নেই। চাঁদনি চক থেকে বেরিয়ে প্রায় ৩০০মিটার কোনাকুনি গিয়ে মিশেছে টেম্পল স্ট্রিটে। আগে গলিতে অনেক ছাগল থাকত বলে কেউ কেউ একে বকরি লেনও বলে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় কর্মীদের চিকিৎসার জন্য নেটিভ হাসপাতাল খোলা হয়। ১৭৯৬ সালে চাঁদনি চকে বর্তমান হসপিটাল স্ট্রিটে হাসপাতালটি উঠে আসে। দুরারোগ্য এবং ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্তদের এই রাস্তার একটি বাড়িতে আলাদা করে রাখা হত। সেই থেকেই নাম হয়ে যায় গুমঘর লেন।

    একটি রাস্তা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোড থেকে শুরু হয়ে মারকুইস স্ট্রিট এবং রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড পার হয়ে মজফ্ফর আহমেদ স্ট্রিটে গিয়ে মিশেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জেমস হিকি, বিচারক লা মেস্টারের মত অনেক নামী দামী সাহেব এই অঞ্চলে বাস করতেন। রাস্তাটির নাম ‘কলিন স্ট্রিট’। সাহেবরা থাকত, তাই স্বাভাবিক ভাবেই রাস্তার নামও সাহেবি। আসল ঘটনা কিন্তু তেমনটা নয়। এই রাস্তার আগের নাম ছিল ‘কলিঙ্গবাজার স্ট্রিট’। লোকে বলত ভিস্তিপাড়া। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে স্থানীয় অধিবাসীরা রাস্তাটির নাম পরিবর্তনের জন্য পুরসভাকে অনুরোধ করেন। কারণ, রাস্তার এ হেন নামের জন্যই নাকি তাঁরা জমি বাড়ির উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছেন না। ১৭ জুলাই ১৯১২ সালে পুরসভার অধিবেশনে কমিশনার ডঃ ব্যাঙ্ক রাস্তাটির নতুন নামকরণের প্রস্তাব দেন। কমিশনার মিঃ শেলটন একটি অভিনব প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন যে Collinga থেকে শেষ দুটি অক্ষর g এবং a বাদ দেওয়া হোক। সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়ে গেল এই অভিনব প্রস্তাব। হবে নাই বা কেন, একটু ছাঁটকাটের পরে নামটা যে বেশ সাহেবি হয়ে গেছে। সেই থেকে কলিঙ্গ হয়ে গেল কলিন।

    কোলকাতার বহু পুরনো একটি রাস্তা হল ‘হাড় কাটা গলি’। বেশ গা ছমছম করা নাম। পুরসভার ১৯৫৬ সালের জুন মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল—‘That name Harkata Lane has no historical reference attached to it except that the area was inhabited by bonecutters and women of ill repute and was notorious for murder and robbery.’ প্রতিবেদনের ‘inhabited by bonecutters’ অংশের কোন তথ্যের সমর্থন পাওয়া যায় না। তুলনায় সমাজবিজ্ঞানী বিনয় ঘোষের এই মতটি অনেক বেশি যুক্তিগ্রাহ্য – “হীরাকাটা থেকে হাড়কাটা হয়েছে। বউবাজার বহুকাল থেকে স্বর্ণকারদের ব্যবসাকেন্দ্র। স্বর্ণকারদের পাশে হীরাকাটা (Diamond Cutters) শিল্পীদের বসতি স্বাভাবিক।’

    বড়বাজারের শোভারাম বসাক স্ট্রিট আর রতন সরকার গার্ডেন স্ট্রিটের মাঝে আছে মাথাঘষা গলি। তখনো শ্যাম্পুর ব্যবহার কেউ জানত না। মহিলাদের কেশচর্চার উপকরণ ছিল নানারকমের সুগন্ধি মাথাঘষা। একসময় এখানে অনেক মাথাঘষার দোকান ছিল বলে পথের এমন নাম। এই অঞ্চলে বাস ছিল বলে তখনকার বিখ্যাত গাঙ্গুলি পরিবারকে ‘মাথাঘষা গলির গাঙ্গুলি’ বলা হত।

    অষ্টাদশ শতাব্দীতে বেশ কিছু চিনা অধিবাসী বিভিন্ন কারণে কোলকাতায় আসেন। এঁদের একটা বড় অংশ এখানে পাকাপাকিভাবে থেকে যায়। বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের আশেপাশে গড়ে ওঠে চিনা বসতি। ওই এলাকাতে ছিল একটি বহুমুখী গলি। চিনারা ছাতা মাথায় দিয়ে ওই গলিপথে যাতায়াত করতেন। গলিটি সব সময় ছাতাময় হয়ে থাকার কারণে লোকমুখে এর নাম হয়ে গেল ‘ছাতাওয়ালা গলি’।

    বর্গিদের ঠেকাতে ১৭৪২ সালে কাটা হল ‘মারাঠা ডিচ’। অর্ধ সমাপ্ত এই ডিচ অর্ধ শতকের কিছু বেশি সময় ধরে হয়ে উঠেছিল শহরের জঞ্জাল ফেলার জায়গা। ১৭৯৯ সালে এটিকে ভরাট করে তৈরি হল সারকুলার রোড। তার পরেও বাগবাজার অঞ্চলে ডিচের ছোট একটি অংশ ভরাট না হওয়া অবস্থায় থেকে গিয়েছিল। ক্যালকাটা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রাস্ট ১৯১৭ সালে এটি ভরাটের পর ইতিহাসকে স্মরণ করে নাম রাখে ‘মারাঠা ডিচ লেন’।

    এবার একবার দেখে নেওয়া যাক কোলকাতার রাস্তার ‘রোড’, ‘স্ট্রিট’, ‘লেন’, ইত্যাদি বিভিন্ন রূপের কিছু প্রথমকে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে কোলকাতার প্রথম ‘রোড’ হল চিৎপুর রোড। প্রথম ‘রো’ হল ভ্যান্সিটার্ট রো, তৈরি হয় ১৭৮৪ সালে। প্রথম ‘গলি’ হল, রানী মুদিনীর গলি। গিরিশচন্দ্রের প্রফুল্ল নাটকের একটা গানে রানী মুদিনীর কথা আছে।

    ‘রানী-মুদিনী গলি
    সরাপের দোকান খালি
    যত চাও তত পাবে
    পয়সা নেবে না
    ঠোঙা করে শালপাতাতে
    চাট দেবে হাতে হাতে
    তেল মাখা বাদাম ভাজা
    মোলাম বেদানা’

    এক সময় গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের ঠিকানা ছিল রানী মুদিনীর গলি। ১৮৫১ সালে নাম হল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিট। এখন নাম হয়েছে আবদুল হামিদ সরণি।

    প্রথম ‘অ্যাপ্রোচ’- চিৎপুর অ্যাপ্রোচ(১৯২৪), প্রথম ‘অ্যাভিনিউ’- ‘অ্যাভিনিউ টু দি ইষ্টওয়ার্ড’(১৭৫৬), পরে নাম হয় বৌবাজার স্ট্রিট। কর্পোরেশনের খাতায় অবশ্য ১৯২৪ সালে প্রথমবার অ্যাভিনিউ শব্দটি ব্যবহার করা হয় সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এর ক্ষেত্রে। কোলকাতায় একটাই ‘ওয়ে’ আছে, কুইনস ওয়ে। ‘সার্কেল’ও একটিই আছে, সুরেশ দত্তের নামে। হরিশ শিকদারের নামে আছে কোলকাতার একটিমাত্র ‘পথ’। প্রথম ‘টেরেস’, কুইন ভিক্টোরিয়া টেরেস। ১৮৭৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় শহরের রাস্তার তালিকা।

    কোলকাতার রাস্তার নামে কেবল ব্রিটিশ রাজপুরুষ এবং স্থানীয়রাই যে জায়গা পেয়েছেন তা কিন্তু নয়। স্বদেশের গান্ধী, নেহেরু, গোখেল, মতিলালের সাথে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ফুটে রয়েছেন মার্ক্স, লেনিন, হো-চি-মিনরাও।

    কোলকাতা সংস্কৃতি মনস্ক শহর, পথনামেও তা প্রতিফলিত হয়েছে। বাল্মীকি, কৃত্তিবাস, শেক্সপিয়ার, পিকাসো, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, ইকবাল, গালিব, হেম, নবীন, সুকান্ত, ভোলা ময়রা, শিশির ভাদুড়ি, প্রমথেশ বড়ুয়া, গিরীশ ঘোষ, সকলেই কোন না কোন পথে চিহ্নিত হয়ে আছেন। আছে লাইব্রেরী রোড, সাহিত্য পরিষদ স্ট্রীট, ন্যাশনাল লাইব্রেরি রোড এবং বয়েস ওন লাইব্রেরি রো। কোলকাতার বিখ্যাত রঙ্গমঞ্চের নামে রয়েছে স্টার লেন।

    সেকালের বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা ‘ইন্ডিয়ন মিরর’ এর নামে রয়েছে ইন্ডিয়ন মিরর স্ট্রিট। ১৯৩৭ সালে পুরসভার ক্ষমতাশালী একটি গোষ্ঠী রাস্তাটির নাম পালটে সমাজসেবী পূরণচাঁদ নাহারের নামে নামাঙ্কিত করার উদ্যোগ নেয়। ওই উদ্যোগের বিরোধিতা করে অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হয় —

    ‘We are surprised to hear that there is a proposal before the Corporation of Calcutta for renaming the Indian Mirror Street as Puran Chand Nahar Street. The Indian Mirror might be a mere name to the present generation but as a contemporary we know what part it played in the last century in the Indian newspaper world. It was one of the most fearless journals and under the distinguished editorship of the Late Narendra Nath Sen it achieved an all India reputation. The proposal, it seems, aims at obliterating the memory of great journal, and as an institution it always entitled to greater respect than an individual, we consider the attempt to be extremely unfortunate and hope that the City Father’s will sternly set their face against the proposal.’

    সংবাদপত্র এবং নাগরিকদের সম্মিলিত প্রতিবাদের ফলে ওই প্রস্তাব বাতিল হয়।

    আছে বিশ্বকোষ লেন, স্বর্ণলতা স্ট্রিটের মত বইপত্রের নামে রাস্তা। এমনটি দেশের অন্য কোন শহরে আছে কিনা জানিনা। বিশ্বকোষ লেন থেকে প্রকাশিত হত নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত বাংলা এনসাইক্লোপেডিয়া এবং স্বর্ণলতা একটি বিখ্যাত উপন্যাস।

    রাস্তাঘাটের নাম পালটান বহুদিন ধরেই আমাদের শহরের একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নতুনকে স্বীকৃতি জানাতে গিয়ে মুছে ফেলা হচ্ছে অতীতকে। পথনামের সাথে জুড়ে আছে সেই সময়ের সমাজচিত্র ও বিন্যাস, নাম পরিবর্তনের সাথে সাথে যা হারিয়ে যাচ্ছে কালের গর্ভে। অনেক ইতিহাসবিদ নাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন। তবু প্রতিনিয়তই পরিবর্তন হয়ে চলেছে। কারণ, নতুন রাস্তা তৈরি করে কোন বরেণ্যকে স্মরণ করার থেকে পুরনো নাম পালটে দেওয়া অনেক সহজ কাজ।

    তথ্যসূত্রঃ-
    কলিকাতা দর্পণ - রাধারমণ মিত্র
    কোলকাতা - শ্রীপান্থ
    কলিকাতার রাজপথ - সমাজে ও সংস্কৃতিতে — অজিত কুমার বসু
    নগর কলকাতার রাস্তার ইতিহাস - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
    শব্দবিদ্যার আঁচড়ে কলকাতার স্কেলিটন - সুকুমার সেন
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • প্রবন্ধ | ০১ জুলাই ২০২৪ | ২৯০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যোষিতা | ০১ জুলাই ২০২৪ ২১:১৯534034
  • "হোগলকুড়িয়া গলি (সাহিত্য পরিষদ স্ট্রিট) " — এটি সাহিত্য পরিষদ স্ট্রীটের বিপরীতের এলাকা। মূল কোলকাতার বর্ডার যদি সার্কুলার রোড হয়, তবে এ ছিল সার্কুলার রোডের পূবদিকে। ওটা ছিল হোগলার বন। হোগলাবনের গলি নামেও চেনা যেত। সিরাজদৌল্লার টাইমে ওখানে হাবসি (খোজা) সৈন্যরা থাকত। তখন জায়গাটার নাম হাবসিবাগানও বলা হতো। হাবসির অপভ্রংশ হালসী হয়ে, পুরো এলাকাটার নাম হয় হালসীবাগান। পরে বদ্রীদাস মারোয়াড়ি ওখানে মন্দির বানিয়ে দেন শ্রমন পার্শ্বনাথের নামে। তবে বদ্রীদাসদের আসল এলাকা ছিল আরও একটু দক্ষিণ পূর্বে, খালের পূবদিকে বাঘমারি অঞ্চলে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন