এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  বাকিসব  মোচ্ছব

  • বুড়ো ঝিনঝিনতলা

    সায়ন্তন চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    বাকিসব | মোচ্ছব | ০১ জানুয়ারি ২০২০ | ২০৫৯ বার পঠিত
  • অনেক অনেক বছর আগে কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে যখন ইস্পাতরঙা ইঞ্জিনটা থেকে নেমে প্রিয় চুরুটখানা দাঁতের ফাঁকে কামড়ে ধরে ম্যাকফার্লঙ সাহেব পা রেখেছিলেন বুড়ো ঝিনঝিনতলার মাটিতে, চওড়া কিনারাওয়ালা ধূলিধূসরিত ফেল্টের টুপিটা মাথা থেকে খুলে তিনি এইরকম একটা তুঁতফলের মত আঁটোসাঁটো সূর্যকেই প্রথম লক্ষ্য করেছিলেন পশ্চিমের স্থির প্রেক্ষাপটে, যে চিত্ররেখাটি এক্ষুনি এইমুহূর্তে রেলের হাইভোল্টেজ তারের ওপরে বসা একটি সমীচীন মাছরাঙার ডানার ঝাপটায় কেঁপে উঠবে, আর তারপর পাখিটা যখন মসৃণ বাতাস বেয়ে নিখুঁতভাবে রেলের কোয়ার্টারগুলোর পিছনে নেমে এসে পুকুরের জল ছুঁয়ে মুখে মাছ নিয়ে উড়ে যাবে, ততক্ষণে তুঁতফল ধ্যাবড়া হয়ে আকাশময় গড়িয়ে পড়েছে আলোর প্রগাঢ় রঙ। আরেকটু অপেক্ষা করতে করতে ক্রমশ বোঝা গেল জলের উপরিতল আলো আর বইতে পারছে না; পৃথিবীর ঘুরন্ত গায়ে জল, জলের অন্ধকার স্থির হয়ে আছে — এই দৃশ্য দেখে মানুষের মনে হল জল ছিঁড়ে একটু পরেই ডুবে যাবে আলো, যদিও মানুষ এখানে কেউ নেই।

    পুকুরের পাড়ে সাপখোপ সচরাচর, অন্ধকার জমতে জমতে ধোঁয়া উঠেছে অনেক; তবুও একটার পর একটা শুকনো ডাল মুচড়ে — তার পায়ের চাপে পাতাগুলো অঝোরে ভাঙছে — হাঁটতে হাঁটতে সে উপস্থিত হল এইখানে। মশাগুলো দুহাতে সরাতে সরাতে সে হঠাৎ যেখানে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, ঠিক ওই জায়গায় উবু হয়ে বসে অনেকবছর আগে বুড়ো হারাধন ডোম প্রাতঃকৃত্য সেরে ভোরের মেঘলা আলোয় কান পেতে বিস্ময়ে হিম হয়ে গিয়েছিলেন, আর তাঁর মনে পড়ে গেছিল আরও পুরোনো দিনের প্রায় ভুলে যাওয়া এক মৃত্যুর ঘটনা — বাকি জীবনটা যে কাহিনী বুড়ো ঝিনঝিনতলার রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো তিনি বলে বেড়াবেন আলোর পৃথিবী ছেড়ে কমলালেবুর ভেতর অপ্রতিরোধ্য ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে পর্যন্ত। তখনও অবশ্য বুড়ো ঝিনঝিনতলার নাম বুড়ো ঝিনঝিনতলা হয়নি; পুবে বকুলপুর আর পশ্চিমে গড়ানডাঙার মাঝামাঝি চারানো খাপছাড়া বনজঙ্গলে-ভর্তি জায়গাটা চিরকালই আশ্চর্যরকম অপ্রয়োজনীয় ছিল, যদিও মাঝখানে অনেকগুলো জলের বছর এখানকার মাটি ভিজিয়ে ভিজিয়ে দিয়ে যাবার পর এখন রেলের প্ল্যাটফর্মগুলোতে হলুদের ওপর মোটা মোটা কালো অক্ষরে বুড়ো ঝিনঝিনতলা নামটাই লেখা, আর সেই প্ল্যাটফর্মগুলোর অদূরে পুকুরের পাড়ে জংলা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে সুপষ্ট অবিকলভাবে তার চোখে পড়ল, দেখতে পেল সে খানিকটা লোভাতুর হয়ে, স্টেশনমাস্টারের কোয়ার্টার ঘরের জানলাটা, জানলার পাল্লাদুটো কিংবা হয়তো একটাই পাল্লা — হাট করে খোলা। জানলার পাশেই মেঝেতে লোহার ট্রাঙ্কের ওপর টিনের ট্রাঙ্ক থাক দিয়ে সাজানো, অসাবধানে কম্বলটা তার ওপরেই মিশকালো হয়ে, যেন নিয়ে নিলেই হল।

    নিয়ে নিলেই হয়, ভাবল সে এরকম; কার একটা গলা কানে আসছে যেন, চটাস করে সে একটা মশা মারল পায়ে, স্টেশনমাস্টারের মেয়েই হবে বোধহয়, থ্যাপ করে খানিকটা আঁশটে রক্ত হাতে চিটিয়ে গেল, হারমোনিয়াম বাজিয়ে রেওয়াজ করছে পাশের ঘরে; এরা কেন জানলায় জাল লাগায়নি, কম্বলটার গায়ের স্টিকারটা অব্দি খোলা হয়নি এখনো, মশার ধূপ পোড়ায় বোধহয়, একদম নতুন। সে মাটির ওপর পা-টা দুবার ঘষল। কানের কাছে মশা বিনবিন করছে সমানে। নীচের ঠোঁটটা দাঁত দিয়ে কামড়ালো একটু। এত মশা। জানলার শিকের ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে সুরসুর করে টানতে লাগল কম্বলটা। পুরোটাই বের করে এনেছে প্রায়, এরকম সময়ে মানুষের হৃৎপিণ্ডকে নাড়িয়ে দিয়ে হঠাৎ, কম্বলের নীচে বোধহয় একটা মোটা বই বা ওরকম কিছু ছিল, ধপ করে পড়ল মেঝেতে। আর — কে? কে? — বলতে বলতে স্টেশনমাস্টারের মেয়ে এসে ঢুকল ঘরে। সে শুনতে পেল গান এখনো চলছে। হয়তো লোকটার বউ গান গেয়ে থাকে, বিশিষ্ট রীতি ও রেওয়াজ-প্রবণ সেই গলা — ওসব ভাববার মত নিঃসাড় অবসর এখন আর নয়। কম্বলটা জোরে টেনে নিয়ে তাতে মুখ ঢেকে সনির্বদ্ধভাবে সে দৌড় লাগালো; মেয়েটা দ্যাখেনি তো? দেখেছে? দ্যাখেনি? দ্যাখেনি। বুকটা ধকধক করছিল তার, বুকের ভেতরটা, এমনকি যখন সে মদনের অনেকদিনের বন্ধ চায়ের দোকানটা অব্দি চলে এল, তখনও — সে একটা স্পষ্টতায় পৌঁছতে চাইল।

    কোনো একদিন ভোরে দোকান খোলবার সময় যখন মদন খেয়াল করেছিল রাস্তার উল্টোদিকের শ্যাওলা-ধরা পাঁচিলটার গায়ে, যেখানে ঝোপঝাড়, লতাপাতা গজিয়েছে প্রচুর, তার ওপরে নতুন একটা সিনেমার পোষ্টারগুলো কেউ সেঁটে দিয়ে গেছে, সে মাথা নেড়েছিল পোষ্টারে হিরোর ছবিটা দেখতে দেখতে, কেননা সে জানত কি ঘটবে এরপর আর তাই সে অবাক হলোনা বিশেষ যখন বেলা বাড়লে দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে চা খেতে খেতে হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল রতন। চা-ভর্তি খুড়ির ভেতরে লেড়ো না সুজির বিস্কুট কি একটা ডুবিয়ে অপেক্ষা করছিল সে, জানে অপেক্ষা না করলে ভালো করে ভেজে না, আবার একটু বেশী অপেক্ষা করলেই, লেড়ো না সুজির বিস্কুট — সেটার ডোবানো অংশটা ভেঙে তলিয়ে যাবে চায়ে; চট করে তুলে মুখে দিতে যাবে, তখনই সামনে তাকিয়ে দেখেছিল রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে একটা লোক পাঁচিলটার গায়ে পথচলতি হ্যাঁচকাধরনের পেচ্ছাপ করতে শুরু করেছে সবে। রতন গিয়ে জোরে একটা ধাক্কা মারল লোকটাকে — হট শালা!

    লোকটা এরকম অপ্রত্যাশিত আক্রমণে হকচকিয়ে গেল প্রথমে, তারপর চোখ রাঙিয়ে তেড়ে এল — ধাক্কা মারলি কেন বে? বলতে বলতেই রতনকে একটা ধাক্কা মেরেছিল ঘুরিয়ে আর রতন ছিটকে গেছিল খানিকটা দূরে। তা দেখে রাস্তার ওদিকের চায়ের দোকান থেকে মদন চা ছাঁকতে ছাঁকতে হাঁক দিয়েছিল — ও দাদা! শুনছেন? নতুন এদিকে? ও ছোকরা মাথা পাগলা, বাদ দিন, এদিকে আসুন, চা খেয়ে যান। লোকটা রতনের চোদ্দো-পনেরো বছরের শরীরটা একবার দেখে নিয়ে বাচ্চা বলেই বোধহয় আর মারামারিতে জড়ায়নি, পাগল শালা! — মাথা ঘুরিয়ে থুক করে একদলা থুতু ফেলে কোন্‌দিকে চলে গেছিল। রতন ফের রাস্তার এদিকে এসে ফেলে যাওয়া চা-টুকু নিয়ে বসতেই মদন দাঁত বের করে বলেছিল — খাবি একদিন, অচেনা লোককে, গাঁয়ের লোক নয় এরা, রগচটা লোকের পাল্লায় পড়বি যেদিন, রেলের কাজে নতুন লোকের এদিকে আনাগোনা শুরু হয়েছে, পেচ্ছাপ করার সময় ধাক্কা মারা, ঠাঁটিয়ে সিধে করে দেবে তোকে! আর ঐ যে — পোষ্টারগুলোর দিকে আঙুল দেখিয়ে — ঐ হিরো তোকে বাঁচাতে আসবে না, সে তুই যতই লোকের পেচ্ছাপ থেকে তোর হিরোর পোষ্টার বাঁচাস না কেন! এইসব কথায় রতন কোনো পাত্তা না দিয়ে চা-টুকু শেষ করেছিল একমনে, তারপর চোখের সামনে ও দূরে রাস্তার ওপর পৃথিবীর গায়ে লেগে থাকা বুড়ো ঝিনঝিনতলার সমস্তটায় উপুড় হয়ে শোওয়া সকালের ঝিমকিনি রোদ্দুরটুকুর দিকে চেয়ে টাকরায় জিভ দিয়ে টকটক করে আঘাত করতে করতে কি একটা সিনেমার গান ভাঁজতে লেগেছিল।

    আজকের সূর্য ও অন্যান্য নক্ষত্রের আলো অনেক বাদামি মিহি ধুলো-ধুলো হয়ে একদিন ছিল পুরোনো পৃথিবীর গায়ে, যখন এই এলাকায় কয়লার একটা খনি বেরিয়ে পড়ে, আর সেকারণেই গুরুত্বপূর্ণ যেদুটো মূল রেললাইন তার মাত্র কয়েকবছর আগেই পাতা হয়েছিল পুবে বকুলপুর আর পশ্চিমে গড়ানডাঙা দিয়ে, ব্রিটিশ সাহেবরা তাদেরকে জুড়ে দেয় একটা মিটারগেজ লাইনের সাহায্যে এবং ঝিনঝিনতলার উত্তরদিকে নদীর তীরে একটা বাংলোও বানানো হয় তখন। কিন্তু এখানকার কয়লা এত নিম্নমানের যে কিছুদিনের মধ্যেই সেই হুজুগ একদম ফুরিয়ে যায়, পরে স্মরণযোগ্য কালের ভেতর আর মাত্র একবারই ঐ মিটারগেজ লাইনটা ব্যবহার করা হয়েছিল যখন একটা ৪-৬-০ ইঞ্জিনে চড়ে ম্যাকফার্লঙ সাহেব এসে পৌঁছান এই বুড়ো ঝিনঝিনতলায়; অবশ্য তখনও বুড়ো ঝিনঝিনতলার নাম ঝিনঝিনতলা হয়নি, সে বুড়োও হয়নি। কোনো একদিন যখন বিকেলের হাওয়া খেতে বুড়ো ঝিনঝিনতলার কানাসাদা মেঘগুলো নদীর ওপর গিয়ে জমা হয়েছিল দলে দলে, সেরকম সময়ে সাহেব এসে পৌঁছেছিলেন এই অক্ষাংশে, দ্রাঘিমার পাড়ে, যেন এইসব পথে, পথের বাতাসে উত্তরসাগরের লবণাক্ত স্বাদ নিয়ে এলেন তিনি, আর নদীর ধারের বাংলোটা তখন জায়গায় জায়গায় একটু জীর্ণ হয়ে গেলেও দিব্যি বাসযোগ্য, সেইখানের নির্জনতা ম্যাকফার্লঙ সাহেবকে মুগ্ধ করল। প্রথম প্রথম সাহেবকে দেখে গ্রামের লোকেরা অবাক হত, ক্রমশ বোঝা গেল গাছপালার প্রতি, বিবিধ লতা ও গুল্মের প্রতি তাঁর দারুণ আগ্রহ; বাংলার এই দূরতর প্রদেশের বিভিন্ন উদ্ভিদের জীবনচর্যা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতেই যে সাহেব এতদূর এসেছেন, ভেবে ঝিনঝিনতলার কোবরেজমশাই বেশ খুশি হলেন, গ্রামের ভিতর পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতেন ছোটখাট মানুষটি। ম্যাকফার্লঙ সাহেবের সাথে প্রাথমিক ম্লেচ্ছতাজনিত অনাগ্রহ কাটিয়ে ক্রমশ তাঁর সখ্যতা গাঢ় হল হয়তো এই কারণে যে কেবল রোগের চিকিৎসা তাঁকে যথেষ্ট সন্তুষ্ট করতে পারছিল না, সাহেবের সঙ্গে কবিরাজীচর্চার প্রগাঢ় তত্ত্বসমূহ নিয়ে, নানান প্রাচীন ঔষধি সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা করতে করতে তিনি নিজের ভেতর আলোর একরকম অনির্বচনীয় প্রতিফলন ক্ষমতা টের পেলেন নতুন করে।

    নানারকম গাছ চিনতে উদ্ভিদবিদ সাহেবের দারুণ উৎসাহ, সেইসঙ্গে ভাঙা ভাঙা বাংলায় গ্রামের লোকেদের কাছ থেকে জেনে নিতেন নানা তথ্য; কয়েকমাসের মধ্যেই এই উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের গাছেদের কিছু কিছু তালিকা সাহেব প্রস্তুত করে ফেললেন নদীর পাড়ে নির্লোক ঘরটিতে বসে। বাইরে যখন কালবৈশাখীর মেঘ নদীর ওপর ঝুঁকে পড়েছে বেশ, চরাচরব্যাপী ঝড়ের আলোড়ন, তখন নিজস্ব মেধার গভীরে মনোসংযোগ করে ঘৃতকুমারী ও আমলকীর বিভিন্ন ভেষজ গুণাগুণ, কালমেঘ ও মেষশৃঙ্গের শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য, কয়েকটা সপুষ্পক ও অপুষ্পক বিরুৎ জাতীয় উদ্ভিদের বর্ণনা ইত্যাদি তিনি জমিয়ে তুলতেন সঙ্গে করে আনা খাতার পাতায়। আলাপ গড়ানোর পর অনেকসময় কোবরেজমশাইয়ের সঙ্গেও গ্রামের আনাচেকানাচে ঘুরে ঘুরে গাছপালা দেখে বেড়াতেন সাহেব, সংগ্রহ করতেন প্রয়োজনমাফিক; বর্ষার শুরুতে একদিন অবেলায় কোবরেজমশাই ম্যাকফার্লঙ সাহেবকে নিয়ে গেলেন একটা বিশেষ উদ্ভিদ দেখাতে। নদীর পাড় থেকে গ্রামের ভেতর যে রাস্তাটা ঢুকে গেছে তার পাশে ছিল একটা ঘোড়ানিম গাছ, তার থেকে ঘাস ভেঙে হাতদশেক এগিয়ে যখন মাথার উপর দিয়ে কান্নিক মেরে একঝাঁক গাঙশালিখ সূর্যের আলো এঁটো করে ঈশানকোণে নদীর দিকে উড়ে চলে গেল, মাটিতে আড়াআড়ি পড়ে থাকা শ্যাওলা-মাখা একটা গাছের গুঁড়ি টপকে কোবরেজমশাই আঙুল তুলে দেখালেন বাবলা গাছের ঝোপটাকে — এর নাম স্বর্ণলতা।

    ঝোপটার ওপর একটা পাতাহীন হলদে রঙের উজ্জ্বল মসৃণ পরজীবী উদ্ভিদ জড়িয়ে-মড়িয়ে রয়েছে ম্যাকফার্লঙ সাহেবের সামনে, আশ্রয়দাতার কাছ থেকে সে প্রাণরস শুষে নেয় নিঃশব্দে এবং আশ্রয়দাতাকে মেরে ফেলে একটু একটু করে; আরেকটু ঝুঁকে ভালো করে দেখতে যাবেন তিনি, নীচু হলেন দু-পা এগিয়ে, হঠাৎ কোবরেজমশাই তাঁর কনুই ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিলেন, টেনে সরিয়ে আনতে চাইলেন সাহেবকে — সাপ! সাপ! সাহেব বিস্ফারিত চোখে দেখলেন ভেজা ভেজা ঘাসের ভেতর তাঁর খাঁকিরঙের বুটজুতোপরা পাদুটো যেখানে ডুবে আছে, সেখান থেকে হাতখানেক দূরে ঝোপটার গায়ে মাটিতে শুয়ে দুটো ছোপছোপ চন্দ্রবোড়া পরস্পরকে জাপটে ধরেছে যেন, পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে মুহূর্তের মধ্যে চালিয়ে দিলেন তিনি, ছিটকে আলাদা হয়ে গেল সাপদুটো, একটা সরসর করে ঢুকে গেল ঝোপের আড়ালে, অন্যটা নিথর হয়ে পড়ে রইল। ম্যাকফার্লঙ সাহেব কোবরেজমশাইয়ের দিকে ফিরলেন, আতঙ্কে তাঁর কপালেও বিন্দু-বিন্দু ঘাম, এবং শঙ্খ লাগা সাপদুটোর একটা মরে পড়ে আছে দেখে পিছু হটে কোবরেজমশাই রক্তশূন্য মুখে ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন মুহূর্তে; যেন তাঁর শরীরের মাংসল টুকরোগুলো খসে খসে অলঙ্ঘ্যনীয় কঙ্কাল হয়ে যাচ্ছে পলকে পলকে, এইভাবে পাঁজরের হাড়গুলো শক্ত করে শিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি ঘোড়ানিম গাছটার তলায়। অনেক-অনেক বছর পরে অঝোর বৃষ্টির দিনে সেখান দিয়ে চলে যাবে একটা ঝকঝকে গাঢ় নীলরঙা গাড়ি আর তারও কিছুদিন পরে সেইসব স্বর্ণলতার বিনুনিতে একজন মানুষের রক্তের বাসি ছিটেগুলো কালীপুজোর হুল্লোড়ের রাতে ব্যাঞ্জোর আওয়াজে মুখর আর আতসবাজির আলোয় আলোকিন্নী হয়ে যাওয়া বুড়ো ঝিনঝিনতলার আকাশ দেখতে দেখতে খয়েরি, খয়েরিতর হয়ে আসবে।

    মেঘেদের শিষ ঝেড়ে ছেঁটে নেওয়া বৃষ্টির জল শিকড়ে বাজের মত আছড়ে পড়ছে গাড়ির কাঁচের ওপর, সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে — প্রশান্ত, কেউ কি আসবে, এই বৃষ্টিতে, আমায় দেখতে? তোমার মনে হয়? — কালো চশমাটা খুললেন তিনি, খানিকটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল চারদিক, সেটাকে ভাঁজ করে বুকপকেটে রাখতে রাখতে সামনে ড্রাইভারের পাশে বসা লোকটির উদ্দেশ্যে — তাহলে, ব্যাপারটা তো, এখন গিয়ে কী লাভ ওখানে, একটা লোকদেখানো ফর্ম্যালিটি স্রেফ —

    প্রশান্ত ব্যাকভিউ মিররে চোখ রেখে — ঠিকই বলেছেন, বৃষ্টি থামুক, তারপরই না হয় কোবরেজমশাইয়ের ভিটেতে — কথাটা শেষ না করেই মাথা ঘুরিয়ে একটু ইতস্তত করে — আচ্ছা, সত্যিই আপনার, কোবরেজমশাই, কেউ হতেন?

    একটা নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি, কালো চশমাটা পকেট থেকে বের করতে করতে — আমি জানতাম না, ইন ফ্যাক্ট, এখনো জানি না — চশমাটার বাঁদিকের ডাঁটিটা একটু বেঁকে গেছে কি, সেটা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে — এখান থেকে ভোটে দাঁড়ানোর সময়, পার্টিরই কেউ একটা, দাঁড়াচ্ছি এখান থেকে ঠিক হওয়ার পর, খুঁড়ে বের করেছিল, শুনেছিলাম, এখানকার কোবরেজ আর আমার দাদুর, সত্যি-মিথ্যে ফ্র্যাঙ্কলি জানি না, কী একটা লতায়-পাতায় সম্পর্ক, এসব ব্যাপারে হোয়াট ক্যান ইউ ডু?

    সামনে উইন্ডস্ক্রিনের দিকে মুখ ফেরাতে ফেরাতে প্রশান্ত — খুব অদ্ভুত এইখানকার সমস্যাটা —

    — সেইটেই বল, মান্ধ্যাত্যা আমলের একটা ইঞ্জিন, আমায় আসতে হল, সরানো গেল না? কী যেন নাম, ঐ সাহেবটার, ঐ যে কী, ভুলে গেলাম, বল তো গল্পটা —

    — ম্যাকফার্লঙ? ম্যাকফার্লঙ এসেছিল ঐ ইঞ্জিনটায় চড়ে, তারপর ওটা এইখানেই, এমনিভাবে বছরের পর বছর, ঝোপঝাড় গজিয়ে গেছে ওটার গায়ে, পড়ে আছে, লতাপাতায় ঢেকে ফেলেছে একেবারে; শুনেছি ঐ বুড়ো ইঞ্জিন থেকেই, কানফেরতা হতে হতে ঝিনঝিনতলা —

    কালো চশমাটার কাঁচগুলোয় ফুঁ দিয়ে বাস্প জমাতে জমাতে তিনি — এখানে থাকে এখনো, ঝামেলাটা পাকিয়েছিল যে লোকটা প্রথম, ওর বংশের লোক ?

    — হ্যাঁ, হারাধন ডোম; ওর নাতির ছেলে বোধহয়, নাকি নাতির নাতি, কে জানে, সে হচ্ছে পরাণ, কাঠগোঁয়ার টাইপের লোক —

    — গোঁয়ার হোক আর যাই হোক, দেখা করতে বোলো একবার — চশমার কাঁচদুটো মুছে নিতে নিতে — এই লাইনটা ফের ব্যবহার করবে রেল, রেলের জমিতে পড়ে থাকা একটা ইঞ্জিন, রেল সরাতে পারবে না, আশ্চর্য!

    হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় যেন, প্রশান্ত ফের পিছনদিকে ঘুরে — এই পরাণ ডোমের ছেলেটাও খুব অদ্ভুত, বুঝলেন? শুনেছি শ্মশানে চিতায় তোলা মড়াকে দেখে, ওরা তো মড়া পোড়ায়, বলে দিতে পারে পুড়তে কত সময় লাগবে, মিলিয়ে দিতে পারে নাকি, একদম একজ্যাক্ট — প্রশান্ত একগাল হাসল — জানেন ছেলেটা আবার আপনার, মানে আপনার সিনেমার, দারুণ ভক্ত!

    বৃষ্টিটা ধরে এসেছে দেখে কালো চশমাটা আবার পরে নিয়ে জানলার কাঁচটা নামিয়ে দিতে দিতে রাস্তার পাশে ঘোড়ানিম গাছটার ওদিকে বৃষ্টিধোয়া স্বর্ণলতার দিকে তাকিয়ে তিনি আনমনে বললেন — ভাবাই যায়না, এখনো এদেশের কিছু লোক, দেশটা স্বাধীন হয়েছে বছর ষাটেকের ওপর হতে চলল, এখানকার লোক এখনও এক সাহেবের কথামত চলে!

    দুপুরের দিকে তড়বড় করে প্রবল বৃষ্টি নামল, নদীর বুকের ওপর বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে নিমেষে — এই দৃশ্যের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন ম্যাকফার্লঙ সাহেব, তাঁর মুখে ক্লান্তির ছাপ, চোখের তলায় কালি, ঠোঁটের ফাঁকে চুরুটটা একা একাই যেন পুড়ে যাচ্ছিল আর ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে বাইরের জলছবি প্রকৃতিকে আরো বেশী অস্বচ্ছ দেখাচ্ছিল। পরপর কয়েকটা রাত তাঁর ভালো করে ঘুম হয়নি, ঠান্ডা জোলো হাওয়ায় তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন, যেন তাঁর হাত ঠেকে যাচ্ছিল কোনো মৃত মানুষের গায়ে। কোবরেজমশাইয়ের সঙ্গে তাঁর বেশ কিছুদিন কথা হয়নি তেমন, বোধহয় সেই সাপটাকে মারবার পর থেকেই কোবরেজমশাই এড়িয়ে যাচ্ছিলেন তাঁকে, তাছাড়া তিনি ঠিক করেছিলেন বিভিন্ন গাছপালার কথা, কোবরেজমশাইয়ের কাছ থেকে জেনে নেওয়া সংস্কৃত শাস্ত্রে লেখা তাদের গুণাগুণ এইসব নিয়ে ইংরেজীতে একটা বই লিখে ফেলবেন তিনি, লিখতে তিনি শুরু করে দিয়েছিলেন ইতিমধ্যে। এই ব্যাপারটাও কোবরেজমশাইকে খুশি করেনি, বহুযুগের সঞ্চিত জ্ঞানকে বিদেশী ভাষায় বাইরের লোকেদের হাতে তুলে দিতে তাঁর আগ্রহ নেই, বিশেষত তিনি বুঝে গেছেন এই গাছপালা সংক্রান্ত গবেষণা লিপিবদ্ধ করার প্রক্রিয়া সাহেবের কাছে নিতান্তই পার্থিব জড় ব্যাপার, যেসমস্ত উদ্ভিদের প্রাণরস গ্রহণ করে মানবেরা বেঁচে আছে পৃথিবীর কোলে, তাদের আত্মার ভিতরের ঈশ্বরকে, অলৌকিককে অনুভব এবং আত্মস্থ করবার মত সুস্নাত মনোভঙ্গি সাহেবের নয়।

    শেষবার যখন কোবরেজমশাইয়ের সাথে ম্যাকফার্লঙ সাহেবের দেখা হয়েছিল দু-তিন সপ্তাহ আগে, তাঁর বাড়ী গিয়ে সাহেব শুনেছিলেন তাঁর মেয়ের প্রচন্ড জ্বর সাতদিন ধরে, একথা শুনে সাহেব বলেছিলেন — আরে আমার কাছে ওষুধ আছে, বলে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি, কোবরেজমশাই তাঁকে নিরস্ত করবার হাজার চেষ্টা করলেও উপকার করবার অত্যুৎসাহে জোর করে সাহেব ঢুকে পড়েছিলেন মেয়েটির ঘরে। আলো-আঁধারি মাটির ঘরটায় ঢুকে তিনি দেখেছিলেন মেয়েটি শুয়ে আছে বিছানায়, ঘুমোচ্ছে অসাড়ে, ছেঁড়াখোঁড়া কাঁথা-কম্বলের ভাঁজের ভেতর লেপটে রয়েছে যেন, তার শিয়রে একটি প্রদীপ জ্বলছে। কাছে গিয়ে মেয়েটির নাড়ী দেখবার জন্যে কবজিটা ধরতেই তিনি বুঝে ফেলেছিলেন খুব গোপন কিছু একটা তিনি দেখে ফেলেছেন, ছিটকে সরে এসেছিলেন তিনি বিছানার কিনার থেকে, মরে কাঠ হয়ে গেছে মেয়েটির দেহ, কোনো স্পন্দন নেই আর তার শরীরে। এখন নদীর দিক থেকে একঝলক ঠান্ডা হাওয়া ভেসে গায়ে লাগতেই তিনি যেন আঙুলের ডগায় মৃত মেয়েটির স্পর্শ টের পেলেন আরেকবার, আর তার চোখ-বোজা শীতল মুখটা ভেসে উঠল মনের ভেতর, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মন যেন আরেকবার আশ্বস্ত করল তাঁকে যে কোনো ভুল তাঁর হয়নি যখন তিনদিন আগে কোবরেজমশাইয়ের বাড়ীর সামনে দিয়ে আসার সময় স্পষ্ট দেখেছিলেন মেয়েটি দুয়ারে বসে একমনে খেলনাবাটি খেলছে, পিঠের ওপর খোলা চুলগুলো ছড়ানো, আর খেলতে খেলতে পলকের জন্যে চোখ তুলে তাকিয়েছিল তাঁর দিকে।

    ভারতবর্ষে চলে আসবার অনেক অনেক দিন পর আবার নিজের পরিবারের কথা ভীষণ মনে পড়ছিল ম্যাকফার্লঙ সাহেবের, একটা নিঃশ্বাস ফেলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, টুপিটা চাপালেন মাথায়। জানতেই হবে তাঁকে কী করে একজন পিতা তাঁর মৃত সন্তানকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন, কৌতুহল তাঁকে হিংস্র করে দিচ্ছিল, বৃষ্টির ভেতরেই তিনি ভিজতে ভিজতে বেরিয়ে পড়লেন কোবরেজমশাইয়ের বাড়ীর দিকে। কোবরেজমশাই অত্যন্ত বিরক্ত হলেন সাহেবকে দেখে; সাহেবকে তিনি কিছুই বলতে চাননা, অথচ সাহেবও নাছোড়বান্দা। অনেকক্ষণ গভীর বিতৃষ্ণার সঙ্গে সাহেবকে প্রত্যাখ্যান করার পরে কোবরেজমশাই যখন কেবল উদাসীনভাবে স্বীকার করলেন — আছে কিছু প্রাচীন চিকিৎসাবিদ্যা, কিন্তু এর বেশী আর একটা শব্দও বলতে চাইলেন না, ধৈর্য হারিয়ে কী ভেবে পকেটে করে আনা পিস্তলটা বের করে সোজাসুজি তাক করে বসলেন সাহেব কোবরেজমশাইয়ের দিকে। হাতটা কাঁপছিল সাহেবের থিরথির করে, তিনি টের পাচ্ছিলেন কপাল থেকে বাঁদিকের ভুরুর ওপর একটা ঘামের রেখা একটু একটু করে চুঁইয়ে পড়ছে আর বৃষ্টির একঘেয়ে শব্দটা যেন খুব খুব দূর থেকে ভেসে আসছিল অযথা। যখন ঘামের রেখাটা নেমে এসে তাঁর বাঁ চোখের পাতাটা ছুঁলো, চোখটা বোজবার আগের মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারলেন আঙুলের চাপটা একটু বেশী পড়ে গেছে, নিমেষের মধ্যে বিশ্রী শব্দ করে গুলিটা সমস্ত মগ্নতা ভেঙে দিল এবং কোবরেজমশাইয়ের শরীরটা ঘাড় গুঁজে আছড়ে পড়ল দুয়ারের ওপর। বৃষ্টির ভেতর দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে নদীর পাড়ের ঘরটায় যখন ফিরে আসছিলেন সাহেব, তখন মাটির দুয়ারটা বেয়ে একটু একটু করে মরা মানুষের রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছিল উঠোনের দিকে আকাশের জল খাবে বলে।

    জীবনে অনেক মৃত্যু দেখেছিলেন হারাধন, শুধু মানুষের নয়, পাখপাখালির, কুকুরের, বেড়ালের, ভোঁদড় ও ভাম ইত্যাদির; তবুও বুড়ো হয়েও মৃত্যু দেখার টান তাঁর কোনোদিন কমেনি। কার্তিকের ধুলাটিয়া মাঠে ঘুঙুর আলোর ভেতর সার দিয়ে পড়ে ছিল সাতটা শেয়ালের পাটকিলে দেহ, দেখেছিলেন তিনি, স্বপ্নের ভেতর কোনো কোনো নদীর নক্ষত্রবাসরের দিনে অরণ্যে গিয়েছেন, দেখেছেন আলো কাঁধে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা খরগোশ, কাঁচফুল, বিভিন্ন পতঙ্গের দল ও মরে যাবার পর তাদের উড়ন্ত আত্মারা — পতঙ্গেরই মতো; এইসব দেখে দেখে তিনি বিস্মিত হতেন, হয়েছিলেন। বাড়ীর সামনের আমগাছ থেকে ঝরে পড়া লাল পিঁপড়ের পল্টন ডেঁয়ো পিঁপড়ের মৃতদেহ বয়ে সুশৃঙ্খলভাবে হেঁটে আসত দাওয়া অব্দি, চোখ কুঁচকে দেখতেন তিনি মন দিয়ে, তাঁকে ঘিরে আকাশের উড়ন্ত আলোয় বিপর্যস্ত পাখিদের দেহ খসে খসে পড়ত, নষ্ট পালক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত মাটির উঠোনে; কুয়াশার আবডালে মরে যাওয়া কাকের দেহ ঘিরে ভিড় করা জ্যান্ত কাকেদের কোলাহল দেখতে দেখতে তাঁর মনে হত মানুষের সৎকার করবার মত আশ্চর্য কাজ পৃথিবীতে আর কিছু নেই, এই যে জীবনের ভেতরে থেকে মৃত্যুর গা ঘেঁষে চলা, তাঁর চেতনায় এরকম ভাবনার নীচে জলে-ডোবা পাথরের মতন বোধগম্যতা অবনত হয়ে আসত। অথচ সামাজিক সম্মান, সফলতা তত নেই, যদিও প্রকৃতির ভেতর মৃত মানুষের সংখ্যা সর্বদাই বেশি; জীবনে কখনো কোনো গুরুত্ব পাননি তিনি কারোর কাছে, এইসব দু-একটা ব্যাপার তাঁকে দুঃখ দিত মাঝে মাঝে।

    ম্যাকফার্লঙ সাহেবকে নামিয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় যান্ত্রিক গোলযোগে বিকল হয়ে পড়ে ইঞ্জিনটা, দেখা গেছিল সেফটি ভালভে কিছু সমস্যা হচ্ছে, পাছে ঝুঁকি নিলে বয়লার ফেটে যাওয়ার মতো বড়োসড়ো কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাই সেটাকে ঝিনঝিনতলাতেই সাময়িকভাবে রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তখন। কথা ছিল একদিন ফিরে এসে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার, কিন্তু তারপর কাদের যেন অবহেলায় ইঞ্জিনটা এখানেই পড়ে ছিল বছরের পর বছর, সেই ভুলে যাওয়া ইঞ্জিনটাই হারাধনের জীবনের প্রান্তিক একটা ভোরে তাঁর সবকিছু পালটে দিল। রেললাইনের ধারে মাঠে পুকুরের পাড়ে প্রাতঃকৃত্য সারতে যেত গ্রামের মানুষেরা, ভোরের ম্লান আলোয় প্রাতঃকৃত্য সেরে নানারকম ভাবনা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন যেসমস্ত কথা তিনি ভাবছেন, তা আসলে তিনি ভাবছেন না। একটা আশ্চর্য ফিসফিসানি কোথাও থেকে অবচেতনের ভেতর ভেসে এসে তাঁর মনকে কিছু পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। যেন তিনি কেবল অনুভব করতে পারছেন সেই অদৃশ্য সত্তাকে, বাতাসের ভেতর কান পেতে আস্তে আস্তে তিনি এগিয়ে চললেন সেই ফিসফিসানির উৎসের দিকে আর সেই স্বর ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠতে লাগল। অবশেষে তিনি বুঝতে পারলেন ঐ সবুজ শিয়ালকাঁটার ঝোপের ওপারে বুনো আগাছায় আর কচু ও কলাপাতার জঙ্গলে আপাদমস্তক ঢেকে যাওয়া একটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো, যেন প্রকৃতিরই নিজের হাতে তৈরী ওটা আর ওখানেই ছিল চিরকাল, সামনে দুজোড়া চাকা, মাঝখানে তিনটে অ্যাক্সেল দিয়ে যুক্ত ছ'টা চাকা আর পিছনে কোনো চাকা না থাকা ইঞ্জিনটার কাছাকাছি এগোলেই মাথার ভেতর ওরকম ফিসফিস শোনা যায়, মনে হয় নিজেরই মনের কথা যেন।

    অনেকদিন পর্যন্ত তাঁর কথা কেউ বিশ্বাস করেনি; অথচ তিনি পাগলের মত বলে বেড়াতেন সেই ভোরের অভিজ্ঞতা বুড়ো ঝিনঝিনতলার রাস্তায় রাস্তায়, বলতেন ম্যাকফার্লঙ সাহেবের কাহিনী। এমনকি মিথুন রাশির সৌভাগ্যের কোনো কোনো রাতে হলুদ জ্যোৎস্না যখন মেঘের গায়ে বাস্তুসাপের মতো চিকচিক করছে, তিনি একা একা হেঁটে গিয়েছেন সেই ভাঙাচোরা ইঞ্জিনটার কাছে। এমন অপরিমেয় জ্যোৎস্নার রাত যে চাঁদ নিজে মরে গেছে চাঁদের আলোতে, তবু ঐখানে মানুষ ও নক্ষত্রের মাঝে ঘাসের নরম দেশে শিশির ও শিশিরের চিঠি এসে পড়ে আছে; এ সমস্ত অন্ধকারে কতিপয় কাক বুঝি উড়ে গেছে দিগন্তের অদ্ভুত ওপারে, যেখানে ক্লান্ত মানুষেরা অঢেল ঘুমের ঘোরে ডুবে গেছে, তাদের অনতিদূরে ছায়ারঙা জলের পাশে কান পেতে অনন্ত পংক্তিমালা শুনেছেন তিনি, তারা ঝিকিয়ে উঠেছে তাঁর চেতনার মেঘরঙা দেয়ালে। ক্রমে ক্রমে দু-একজন কৌতুহলী হল, কেউ কেউ বিশ্বাসও করল হয়তো; একদিন সমস্ত মানুষেরা যখন অনুভব করল অনুতপ্ত ম্যাকফার্লঙ সাহেব সত্যিই ফিরে এসেছেন বুড়ো ঝিনঝিনতলায় এবং তাঁর পরামর্শ তাদের বিপদআপদ থেকে বারবার রক্ষা করে, সেদিন হারাধনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর সম্মানীয় মানুষ বুড়ো ঝিনঝিনতলায় আর কেউ ছিল না। অবশেষে কোনো এক রাতের অন্তিম প্রহরে ছ'জোড়া শঙ্খচিল ডানা মুড়ে নেমে এল হারাধনের বাড়ীতে, উঠোনের বিভিন্ন প্রান্তে ও কোণে তারা মাথা ঝুঁকিয়ে চুপ করে বসল। শেষবার স্ত্রী ও সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে হারাধন রওনা দিলেন নক্ষত্রের সেই ভোজসভার উদ্দেশ্যে, যেখানে আদরের প্রয়োজন থেমে এলে কর্কটক্রান্তির নদীগুলো নাকছাবি খুলে রেখে পাশ ফেরে স্বপ্নেতে আর এইসব শঙ্খচিলেরা মরে মরে নিঃশেষ হয়নি কখনও।

    মানুষ খুন করবার পর যেরকম ক্লান্ত ক্লান্ত হয়ে যায় মানুষের মন, আর কোনো কাজ পড়ে থাকেনা তো তার, যেন জানলার কাঠে আটকে পড়া ডানা-ছেঁড়া ছাইরঙা ফড়িঙ, ফড়িঙের মতো ঘষটাতে ঘষটাতে চেটে নেওয়া ধুলো ও বালির স্বাদ, গায়ে লেগে থাকা দগদগে ঘা-গুলো তাকে শয়তানের রূপ দেয়; বৃষ্টির অবিরাম অন্ধকারে ঘরের ভেতর মাথা নীচু করে বসে থাকতে থাকতে অন্ধকার ভয় এসে ঘিরে ধরে। চমকে চমকে উঠছেন ম্যাকফার্লঙ সাহেব, যেন নাকে মাঝে মাঝে ধোঁয়ার গন্ধ পাচ্ছেন তিনি, কোথাও নিশ্চয় গ্রামের লোকেরা আগুন সাজাচ্ছে, আগুনের মতো তাড়াতাড়ি এসে পড়বে হঠাৎ, আগুন ধরিয়ে দেবে, পুড়িয়ে মারবে তাঁকে এইঘরে। এইঘরে, এইঘরে, অথবা টেনে বের করে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে মারবে সাপের মতন, হলুদ স্বর্ণলতার গায়ে চলকে ওঠা রক্তের দাগ যেন; তুড়ুক তুড়ুক করে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে বাদলিপোকাগুলো, অতর্কিতে গায়ে এসে পড়ছে ঝুপঝাপ করে, ভয় পেতে পেতে একসময় অসহ্য হয়ে উঠল তাঁর মন। উঠে দাঁড়িয়ে পিস্তলটা হাতে নিয়ে তিনি বাংলো থেকে বেরিয়ে এলেন নদীর পাড়ে; সন্ধ্যে হয়ে গেছে, বৃষ্টির তোড় কমেছে, তবে টিপটিপ করে জল পড়ছে সমানে, ব্যাঙ ডাকছে নিরবিচ্ছিন্নভাবে। আসুক যে আসবে, গুলি করে মারবেন তাকে এইখানে, যেরকম কোবরেজমশাইকে মেরেছেন। সামান্যতম শব্দ পেলেই ম্যাকফার্লঙ সাহেব সেদিকে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন সতর্কভাবে, ভিজতে ভিজতে রাত কত বাড়ল কে জানে, সাহেবের চোখদুটো গরম হয়ে এল, শরীরটাও অবসন্ন, জ্বর আসছে হয়তো, অপেক্ষা করতে করতে কেউ এলোনা দেখে টলতে টলতে একসময় তিনি ঘরে এসে ঢুকলেন।

    একটা চুরুট ধরিয়ে তেলের বাতিটা জ্বেলে তিনি লিখতে লাগলেন একটা চিঠি; বহুসমুদ্রের ওপারে তাঁর স্ত্রী এমিলিকে রেখে তিনি চলে এসেছিলেন এইদেশে, এমিলি আসতে চাননি, সাহেবকেও নিরস্ত করেছিলেন অনেক। অথচ কোনো কথা শোনেননি সাহেব, উঠোনের চেরিগাছটার নীচে দাঁড়িয়ে যেদিন তিনি সুসজ্জিত আর্মি অফিসারের কাছ থেকে ছেলের মৃত্যুসংবাদটা গ্রহণ করেছিলেন সেদিন থেকেই পালটে গেছিলেন বুয়র যুদ্ধে মৃত সৈনিকের হতভাগ্য পিতা ম্যাকফার্লঙ সাহেব। তারপর থেকেই সাহেব যেন পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলেন ভেতরে ভেতরে, আশ্চর্য এক অবসাদ তাঁর হৃদয় ও চেতনাকে আচ্ছন্ন করেছিল, একসময় মৃত্যুর অমোঘতা তাঁকে সম্পূর্ণ ক্লান্ত করে ফেলে, মৃত্যুপরবর্তী জীবন নিয়ে চর্চায় তাঁর আগ্রহ বাড়ছিল, আগ্রহ বাড়ছিল মৃত্যুকে অতিক্রম করে যাবার জাদুতন্ত্র ও গুপ্তবিদ্যার প্রতি, যদিও কোনো দিশা পাচ্ছিলেন না উত্তরসাগরের দ্বীপে বসে; তাঁর বন্ধুস্থানীয় কিছু মানুষ তখন তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিল ভারতবর্ষে যেতে। বটানিক্যাল সার্ভের সাথে যোগাযোগ করে প্রাচ্যের উদ্দেশ্যে একসময় তিনি রওনা দিলেন স্ত্রী-পরিবারকে পিছনে ফেলে, আজ তাঁর সেইসব কথা মনে পড়ছে, স্ত্রী-কে চিঠিতে লিখছিলেন কিভাবে তিনি মাদ্রাজ পৌঁছলেন, কয়েকবছর চষে বেড়ালেন ভারতের বিভিন্ন জেলা ও গ্রাম, তারপর ক্রমে ক্রমে রোদেপোড়া চামড়া নিয়ে বাংলার এই মুলুকে এলেন তিনি। লিখতে লিখতে নিজের কাছেই যেন যুক্তি সাজাচ্ছিলেন কেন তিনি এতদূরে এসে কোনো ভুল করেননি, কেন অন্যায় করেননি কোবরেজমশাইকে খুন করে; এইসব মানুষেরা, এরা কোনোদিন জানেনি জীবনের মহার্ঘ্যতা, বোঝেনি বাঁচবার কাতরতা, অবিন্যস্তভাবে মরে যায় এরা নিজেদের স্বার্থপর জেদে, সংস্কারে। যদি না নিজেদের সংস্কার ত্যাগ করে এরা বেঁচে উঠতে পারে, হয়তো একশ বছর পরে এইসব জনপদ নিশ্চিহ্ন যাবে, এরা মরে যাবে একা একা মারী ও মড়কে।

    শ্রান্ত হয়ে একসময় লেখা থামালেন সাহেব, প্রেমের কিছু বহুব্যবহৃত ভাষা ও বাগধারা প্রয়োগ করে স্ত্রী-র উদ্দেশ্যে লেখা চিঠির শেষে তিনি নামসই করলেন, তারিখ দিলেন যথারীতি। জ্বরটা বেশ গাঢ়ভাবে এসেছে তাঁর, সঙ্গে আনা ওষুধ খেলেন একটা, তারপর নিভন্ত তেলের আলোয় বিছানায় শুয়ে পড়লেন, এই ঘরখানা তাঁর বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছে, বাইরে এখনো অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে, জ্বরের ঘোরে দেখতে লাগলেন ঘরের মেঝে, আলো-আবছায়া দেয়াল, সারারাতই বৃষ্টি পড়বে হয়তো। দু-একটা মাছি ওড়াউড়ি করছিল, কয়েকটা অন্যরকম পোকা, একটা ধূসর মথ নিঃশব্দে উড়ে উড়ে বসছিল আলোর কাছে, আস্তে আস্তে বিছানার পাশ দিয়ে একটা কালো মাথা মুখ বাড়ালো, তারপর মৃদু আলোয় দেখা গেল ছোপছোপ শরীরটা, হাতে ও গলায় কয়েকবার ছোবল মারার পর সাপটা যখন ধীরে ধীরে ঘরের ওপাশে সরে যাচ্ছে, সাহেব বুঝতে পারলেন চোখের পাতাদুটো বুজে আসছে, ঘুম পাচ্ছে, প্রচুর প্রচুর ঘুম, আর ক্ষতস্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে জমা হচ্ছে বিছানায়; দূরে, দূরে, আরও দূরে কোনো যুবকের মৃতদেহ হিম হয়ে আছে যেন, রোদ আর কখনও উঠবে না, বন্দুকে মাটি জমে জমে উইপোকা খেয়ে নেবে, আয়নায় বিছেরা ঘুরতে ঘুরতে একদিন কালো ঘুমে ডুবে যাবে, তাদের জীবন কোনো বীতশোক পিতার অবসরের গান, অবসাদের শূন্য রূপ-রুগণতার মতো। বাইরে বৃষ্টি থামবে না আর, আর তাঁর দেখা হবেনা এই বৃষ্টির শেষ, জলের ওপর ক্লান্তির ছায়া আর কোনোদিন পড়বে না।

    তিনি স্লিপার থেকে পা-টা বের করে ঘাসের উপর রাখলেন, ভালো লাগছিল তাঁর অল্প ভেজা ভেজা ঘাসের নরম, ঘাসের ভেতর ছিট-ছিট হলদে, বেগুনি রঙের ফোঁটা ফোঁটা ফুলগুলো, একজন অপ্রতিম ঘাসফড়িঙ লাফিয়ে লাফিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে ঘাসেদের দেশ-মহাদেশ; ওপাশে নয়নতারার সারি, দোপাটি খানিকদূরে, লেবুফুলের গাছটার গা বেয়ে চুঁইয়ে পড়া পাড়া-গাঁর সন্ধ্যা ভালো লাগছিল তাঁর, কালো চশমার ভেতর দিয়ে দেখছিলেন তিনি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কালো কৃশকায় ছেলেটির ব্রণ-বসন্তের দাগওলা কদাকার মুখটার ঘোরলাগা ভাব। তাকে বসতে বলা হয়েছিল অনেকক্ষণ আগে, তার জন্যে আনা মোড়া অযত্নে পড়ে আছে পাশে, বয়ঃসন্ধির ছেলেটি ও বেতের মোড়াটা তাঁর সঙ্গে একটা সমকোণী ত্রিভুজ তৈরী করেছে। ছেলেটার মা নেই, বাবার সঙ্গেই থাকে, ছেলেটার লজ্জাসমন্বিত মুগ্ধতা গ্রহণ করতে ভালো লাগছিল তাঁর; অথচ এর বাপ কত গোঁয়ার। পরাণ ডোমকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তিনি, একজন নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে স্থানীয় মাস্টার হাজির ছিল, সে বকুলপুর হাইস্কুলের প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের শিক্ষক। তিনি জানিয়েছিলেন রেল এই লাইনটা সংস্কার করে ফের ব্যবহার করতে চায়, কেননা বকুলপুর আর গড়ানডাঙার গুরুত্ব বেড়েছে অনেক; তাদের মধ্যে রেল যোগাযোগ থাকা দরকার। ব্রডগেজ করা হবে এই লাইনটাকে, ইলেক্ট্রিফিকেশন হবে, আর এসবের সাথে সাথে ঝিনঝিনতলার উন্নতিই হবে; শুধু ইঞ্জিনটাকে সরানো প্রয়োজন।

    কালো চশমাটা খুলতে খুলতে তিনি পরাণের মুখের ভাব লক্ষ্য করে বুঝেছিলেন এত সহজে হবে না; আরো অনেকক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে তিনি বললেন — ম্যাকফার্লঙ সাহেবকে চেনো তো? আমার কথা না মানো, তাঁর কথা মানবে কি? বলে তিনি মাস্টারের হাতে দিলেন গড়ানডাঙা থানার পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে খুঁজে পাওয়া চিঠিটা। সাহেবের স্ত্রী এমিলিকে লেখা চিঠি, শেষ পাতা জুড়ে শুধু কিভাবে আর একশ বছর পরে এই অঞ্চল মারী আর মড়কে ধ্বংস হয়ে যাবে সেই বর্ণনা দেওয়া। — শেষের তারিখটার সঙ্গে একশ বছর যোগ করে দ্যাখো, আর ম্যাকফার্লঙ এসেছিলেন বিলেত থেকে, তা আজকের বিলেত হচ্ছে আমেরিকা — পরাণের দিকে তাকিয়ে কথাটা জানানো দরকার মনে হয়েছিল তাঁর; দেশ মানে বোঝে না এরা ঠিকমত, ভাবে হয়তো একটা কমলালেবু, তার দু-একটা কোয়া, নিদেনপক্ষে একটা-দুটো বীজের স্বাদ পেতে চায় কখনো কখনো, ঠেস দিয়ে বলেছিলেন তিনি — তোমরা তো আবার সাহেবদের কথা শোনো। ইংরেজী খবরের কাগজটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি, মাস্টার পড়েছিল কিভাবে বিলেত-আমেরিকার লোকে অব্দি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে যে, কোনো ধুমকেতু বা গ্রহাণু বা কিছু একটা এসে ধাক্কা মারতে চলেছে পৃথিবীকে। শান্তভাবে তিনি কেটে কেটে ঘোষণা করেছিলেন — খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে, আর সেজন্যেই যে ঝিনঝিনতলায় ডাক্তার, হেলথসেন্টার, রেল যোগাযোগ দ্রুত প্রয়োজন, তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

    তিনি ভেবেছিলেন পরাণ এরপর মেনে নেবে, আর সে গ্রামের লোককে গিয়ে বললে ইঞ্জিন সরানোর কাজটা সহজ হয়ে যাবে। ফলে দুদিন পর যখন ফিরে এসে সে ইতস্তত করে জানিয়েছিল যে, সে রাজী নয় আর মাস্টার তাকে বলেছে যে এইধরনের খারাপ ঘটনার ভবিষ্যৎবাণী অনেকসময় ভুল হয়ে থাকে, তখন তাঁর প্রচন্ড রাগ হল মাস্টারের বিশ্বাসঘাতকতায়। লোকটার দিকে তিনি হিম চোখে তাকিয়ে ছিলেন; একজন গোঁয়ার লোক যখন একজন যুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের সঙ্গে জোট বাঁধে, তখন তাকে বোঝানো কার্যতঃ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। ওরা চলে যাওয়ার পরে বেশ হতাশ হয়ে তিনি প্রশান্তকে ডেকে বলেছিলেন সামনের কালীপুজোয় যেন টাকা খরচ করে এই এলাকায় ধুমধাম করে যাত্রাপালা, আতসবাজি ইত্যাদির আয়োজন করা হয়, পরাণের ওপর ভরসা না রেখে স্থানীয় লোকেদের সরাসরি হাত করা দরকার। তারপর কি ভেবে তিনি পরাণের ছেলে রতনের সঙ্গে একবার দেখা করতে চেয়েছিলেন। এখন ছেলেটাকে দেখে, কথা বলে ভালো লাগল তাঁর, যদিও তিনি জানেননা সে বাপকে রাজী করাতে পারবে কিনা। তিনি চোখ থেকে চশমাটা খুললেন, রতনের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল একটু, বাড়িয়ে দিলেন চশমাটা — নাও।

    কয়েকদিন পরে ইস্কুল শেষে সন্ধ্যেবেলা সাইকেল চালিয়ে মাস্টার বাড়ি ফিরছিল, তার একহাতে টর্চ, অন্যহাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল সাইকেলের গতিপথ। নদীর ধার থেকে গ্রামে ঢোকার রাস্তাটার পাশে ঘোড়ানিম গাছটা অব্দি এসেছে, এইসময় পথের ধারে অপেক্ষারত কয়েকজন ছায়ামানুষ ক্ষিপ্রবেগে একটা বাঁশ ঢুকিয়ে দিল সামনের চাকাটায় স্পোকগুলোর ফাঁকে, হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে রাস্তার পাশে, হাত-পা ছড়ে জ্বালা করতে লাগল, হাতের ছিটকে পড়া টর্চটা থেকে শেষ কয়েকটা আলোকরশ্মি লাফিয়ে বেরিয়ে এদিক-ওদিক দৌড়ে গেল, তারপর সবদিক অন্ধকার হয়ে গেল নিমেষে। মুখে কাপড়-বাঁধা লোকগুলো প্রথমে তার মাথায় মারল একটা মোটা বাঁশ দিয়ে, ফেটে গিয়ে দরদর করে রক্ত পড়তে লাগল, তারপর স্বর্ণলতার ঝোপটার দিকে টেনে এনে এলোপাথাড়িভাবে যেখানে খুশি মারতে শুরু করল। সাইকেলের বেঁকে যাওয়া ভাঙা স্পোকগুলো খুলে এনে তার প্রায় অচৈতন্য শরীরটা গেঁথে দিল মাটিতে, তারপর কাজ শেষ হয়েছে বুঝে আস্তে আস্তে চলে গেল। মাস্টার রক্তে মাখামাখি হয়ে শুয়ে প্রথমে ভাবল সে মারা যাচ্ছে, তারপর ভাবল এইভাবে বেঁচে থেকেছে মানুষ একদিন, যখন সে বিশ্বাস করতে পেরেছে মৃত্যু তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার, বিশ্বাস করতে হবে প্রকৃত মানবমনের অন্তর্গত হয়ে, এইকথা ঝেড়েমুছে সে চেষ্টা করল যুক্তি ও উপপাদ্যগুলোকে ভুলে যেতে; নিউটনের তত্ত্বগুলো, চার্লস ও বয়েলের গ্যাসের সূত্রগুলো, তরলের প্রবাহ সংক্রান্ত বার্নোলির নীতি ইত্যাদি বেশ সুস্থিতভাবে পেরিয়ে যেতে যেতে একসময় সে এসে দাঁড়াল সংখ্যা ও স্বতঃসিদ্ধের ছায়াপথপ্রবণ জগতে। এখানে তার কোনো উষ্ণতা বা শীতলতার বোধ নেই, নেই কোনো আনন্দ বা ব্যথার অনুভূতি, অথবা সমস্তই রয়েছে তার, যা সে চাইবে। তার পায়ের নীচে ও চারপাশে অসংখ্য ঝিনুক পড়ে, অবেলায় চানের মতো পৃথিবীর এইসব ঝিনুকের ভেতর ধরা থাকে মানুষের আর্ত শঙ্খিনী হৃদয়ের নোনা বিষাদকান্না।

    তার সামনে যে পাহাড় দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার গায়ের ধূসর সিঁড়িগুলোকে মাস্টার দেখল কিংবা শুনল কিংবা অনুভব করল অথবা কিছুই করল না অথবা সবকিছুই করল, শুধু বুঝল অন্তহীন পেরিয়ে যেতে হবে এইসব প্রকৃত অস্তিত্বের আকাশে পৌঁছতে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় — এইভাবে সিঁড়িগুলো পেরিয়ে পেরিয়ে চলল সে, চলল, একসময় বুঝল সামনে আশ্চর্য অসীম শূন্যতা অথবা সংখ্যার এক আশ্চর্য পূর্ণতা, যার চূড়ায় আছে শীতল শুভ্র জলের একটি হ্রদ; সেই হ্রদে অপেক্ষা করে থাকেন গণিতপ্রজ্ঞায় সমারূঢ় প্রবৃদ্ধা পানকৌড়ি, যিনি নেকড়ে ও শেয়ালের পাটকিলে ধূসরতা, আলো-আলো যুবতী ও যুবকের ঘাসফুল পোশাকের নীচে রক্তের অভিরাম, উত্তরফাল্গুনীর ছায়াচ্ছন্নতা থেকে আগন্তুককে নিয়ে যান অনন্তের জগতে, যেখানে ছায়াপথ চেঁচে চেঁচে আলো আসে, প্রত্নতাত্ত্বিকের মতন নক্ষত্ররা কৌতুহলী হয়ে নিরীক্ষণ করে পৃথিবীর নুড়ি-তুষার-সরসতা-যা কিছু বাঙময়, শীত-শীত হাড়ের গভীরে ছেঁকে ছেনে নেয় স্নায়ুর দিকনির্দেশক সংকেত ও যতিচিহ্নগুলোকে, কেননা মানুষেরও সুখ আছে — এবং দুঃখ — বস্তুতপক্ষে শুধু মানুষেরই, আর এভাবেই পাথর, আগুন, নৈঃশব্দ্য উড়ে উড়ে কড়া নাড়ে, তারপর ঘরের অতল থেকে সাড়া না পেয়ে পেয়ে শেষে এসে দীর্ঘায়ু গাঙচিলে পরিণত হয়। পরিশ্রান্তভাবে একটু ফ্যাকাশে হেসে সে যেন বলল নিজেকেই কাছাকাছি পেয়ে — এইসব গাণিতিক প্রমাণ ও প্রস্তাবনাগুলোকে অতিক্রম করে উড়ে যাবে, ততখানি অপরিমেয় ডানা মানুষের নয়। অনুভূতিশূন্য জগতের ভেতর সে যখন মারা গেল ভোরের শিয়রে এসে, পুবের আকাশ তখন ঝুঝকো হয়ে উঠেছে সামান্য।

    প্রাতরাশ খাওয়া হয়ে গেছে তাঁর, বেলাও প্রায় দশটা বাজছিল, ছুরির ডগায় একটুখানি ডিমের কুসুম লেগেছিল, চেটে নিয়ে কাঠের টেবিলের গায়ে মন দিয়ে নিজের নামের আদ্যক্ষর খোদাই করছিলেন তিনি। পরাণ এল, এসেই একেবারে বিপর্যয়ের মতো ফেটে পড়ল টেবিলের ওপর একটা প্রাণপণ ঘুঁষি বসিয়ে, তাঁর একহাতে ধরে থাকা ছুরিটা নড়ে গিয়ে টেবিলের ওপর পেতে রাখা অন্য হাতটায় সামান্য খোঁচা মারল। চামড়া কেটে গড়িয়ে আসা রক্তটুকু ঠোঁট দিয়ে চুষে নিতে নিতে তিনি তাকালেন কঠিন মুখে, পরাণ মেঝেতে আছড়ে ফেলল কালো চশমাটা, বাঁদিকের ডাঁটিটা ভেঙে ছিটকে গেল, হিসহিসিয়ে উঠল সে — জ্যান্ত বেরোতে পারবেন না, পারবেন না জ্যান্ত পালাতে আর, মাস্টারকে খুন করেছেন আপনি, আপনি — পিছন থেকে তাঁর লোকেরা টানতে টানতে পরাণকে বের করে নিয়ে যেতে চাইল, তাদের কাছে গায়ের জোরে হেরে যাবার আগে পরাণ একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল টেবিলের পেয়ালা-পিরিচগুলোর ওপর। যখন তাকে নিয়ে চলে যাওয়া হল তাঁর সামনে থেকে, তিনি দেখলেন তাঁর গায়েও লেগেছে খানিকটা থুতু ছিটকে, সাদা ফেনা-ফেনা থুতু যত বর্ণহীন জল হয়ে যেতে লাগল, তাঁর চোয়াল তত কঠিন হয়ে উঠল।

    এই ঘটনার পরে তিনি চলে গিয়েছিলেন বুড়ো ঝিনঝিনতলা ছেড়ে, ক্রমে ক্রমে এগিয়ে এল কালীপুজোর রাত। সেদিন বিকেল থেকেই হুল্লোড় চারদিকে, আতসবাজি আছে, যাত্রাপালা হবে। যাত্রার মঞ্চের চারদিকে বসার ভালো জায়গা ধরবার জন্যে বিকেল থেকে গ্রামের লোকের হুড়োহুড়ি। পরাণ ঘরেই ছিল, তার সম্ভবত শরীরটা ভালো ছিল না তেমন, রতনকেও সে বারণ করেছিল যেতে। কিন্তু রতন গেছিল যাত্রা দেখতে, সেই কালো চশমাটার জন্যে বাপের মারটা সে ভোলেনি এখনও। সন্ধ্যের পর প্রথমে আতসবাজির খেলা শুরু হল, সে কি অপূর্ব দৃশ্য! অন্ধকার আকাশের গায়ে ফুটে ওঠা আলোর বিভিন্ন নকশা দেখে মোহিত হয়ে গেল বুড়ো ঝিনঝিনতলার মানুষ। ক্রমে ক্রমে যাত্রাপালা শুরু হল, শোনা গেল যাত্রার বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে ছোঁড়া হবে আতসবাজি। দারুণ উত্তেজনার মুহূর্ত তৈরী হয়েছে মঞ্চে, মঞ্চ ঘিরে বসে থাকা মানুষেরা শিহরিত হয়ে উঠছে নায়ক-নায়িকার সংলাপে। এমনসময় রতনের অখন্ড মনোযোগ ভেঙে কে তার কানে কানে বলল — শিগগির বাড়ি যা, হাউই পড়ে খড়ের চালে আগুন ধরে গেছে তোদের ঘরে। প্রথমে সে গা করল না, তারপর কি যেন ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়তে দৌড়তে এল তাদের বাড়ির কাছে। খড়ের চাল তখন দাউদাউ করে জ্বলছে, কয়েকজন লোক ভিড় করে দাঁড়িয়েছে, কেউ কেউ দু-এক বালতি জল ঢালার চেষ্টা করছে, কিন্তু আগুনের তাতে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। রতন ধোঁয়া ও আগুনের ভেতর দিয়ে দেখতে পেল পরাণ ঘর থেকে বেরোনোর চেষ্টা করছে, সে বোধহয় ঘুমোচ্ছিল, আগুন ধরে গেছে তার গায়ের কাপড়ে। রতন দৌড়ে পরাণের কাছে গেল, পরাণ তাকে এক ধাক্কায় ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে, যাতে তার গায়েও না আগুন ধরে যায়।

    মাটিতে পড়ে রতন আস্তে আস্তে উঠে বসল, তারপর হাঁটুদুটোর ওপর থুতনিটা রেখে চুপ করে চেয়ে রইল সামনের দিকে; আর কেউ চেষ্টাও করছে না জল ঢালতে, আগুন লকলক করে ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত মাটির বাড়িটা জুড়ে, আর তার সামনে একজন মানুষ ছটফট করতে করতে পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রাতের আকাশ ভরে যাচ্ছে ধূসর ধোঁয়ায়, উঁচুতে উঠতে উঠতে সেই ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে আতসবাজির গন্ধকের উগ্র ধোঁয়ার সাথে; জ্বলন্ত ঘরবাড়ির পিছনে দিগন্তের কাছে আলোর উদ্ভাস, ওইখানে যাত্রা হচ্ছে, ওইখান থেকে ভেসে আসছে ব্যাঞ্জোর আওয়াজ, মাঝেমাঝে দু-একটা সংলাপের টুকরো। অথচ মানুষ এখানে পুড়ছে কোনো শব্দ না করে। রতনের চোখদুটো যেন আঠা দিয়ে আটকানো পরাণের দিকে, পরাণ আগুনে পুড়তে পুড়তে একবার এদিকে দৌড়োচ্ছিল, একবার ওদিকে, কখনো কখনো মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছিল নিঃশব্দে। রতন ঠোঁট বিড়বিড় করে কি যেন গুনছিল, পিছনে কিছু মানুষ ও গাছেরা নির্বাক এবং নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কে জানে কতক্ষণ পরে, ক্রমশ পরাণ নিস্তেজ হয়ে গেছিল, পড়ে গেছিল মাটিতে, আর উঠছিল না, শুধুই পুড়ে যাচ্ছিল, হয়তো মরেও গেছিল এতক্ষণে। রতনও গুনতে গুনতে থেমে গেছিল একসময়, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে জন্তুর মত একটা চিৎকার করে সজোরে একটা লাথি কষাল বাপের পেটে। সে টেরই পায়নি জামার নীচে শালার শরীরটা কত চিমড়ে হয়ে গেছে আর তাই বুঝতেই পারেনি পুড়তে কতক্ষণ লাগবে। তার চোখ ফেটে জল পড়ছিল, ঘুরে দাঁড়িয়ে বুনো ষাঁড়ের মত মানুষের ভিড়টা ভেদ করে সে দৌড়তে থাকল, যতক্ষণ না মদনের চায়ের দোকানটা অব্দি পৌঁছল। আর তারপর প্যান্ট খুলে ছরছর করে সে পেচ্ছাপ করে দিল সেই পাঁচিলটার গায়ে সিনেমার পোষ্টারগুলোর ওপর।

    ক্রমশ বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসে, শুষ্ক আবহাওয়া, ধুলো-ধুলো পথঘাট — শীতের শুরুর দিকে কোনো এক বিকেলে ঝিনঝিনতলার মাঠে ব্যাটবল নিয়ে ছেলেরা সব হাজির হবে, একটা এল-বি-ডব্লিউ নিয়ে ঝগড়া বাঁধবে তাদের, দুপক্ষই আন্তরিকভাবে হাঁটুর কাছে বলটা যেখানে লেগেছে সেখান থেকে ধরে ধরে উইকেট পর্যন্ত হাওয়ায় একটা কাল্পনিক গতিপথ এঁকে দেখাবে, কিন্তু কী আশ্চর্য, দেখা যাবে, একপক্ষের রেখাটি উইকেট ভেঙে দিচ্ছে আর অন্যদলের মতে বলটা বেরিয়ে যাচ্ছে উইকেটের ওপর দিয়ে; তাদের পিছনে পড়ন্ত সূর্যের আলোর রেণুগুলো বিন্দু বিন্দু করে জমা হবে, আর কে-একটা হাঁসগুলোকে ডেকে নেবে ঘরে — আ-চৈ-চৈ, আ-চৈ-চৈ। দূরে বিকেলের ট্রেনটা যখন হুইসল বাজিয়ে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে একটু একটু করে বেরিয়ে যাবে, তার অনেক আগেই পালটে গেছে বুড়ো ঝিনঝিনতলা; পরপর দু-দুটো অপঘাতে মৃত্যু ঘটায় হুল্লোড়ের রেশ ঝেড়ে গ্রামের মানুষেরা সব ভোরের নীল আলোয় দৌড়ে গিয়েছিল ইঞ্জিনটার কাছে, ইঞ্জিনটার সামনে পুকুরের পাড়ে ঝোপঝাড়-ঘাসমাটির ভেতর ইতস্ততভাবে মানুষগুলো স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়েছিল সমাধিফলকের মতন, কান পেতে তারা শুনতে চেষ্টা করছিল সেই ফিসফিসানি, যা তাদের এতগুলো বছর ঝড়েঝঞ্ঝায় বিস্মৃত পথরেখার সন্ধান দিয়ে এসেছিল। অথচ অবাক হয়ে গেছিল তারা, একেবারে নীরব হয়ে গেছিল ইঞ্জিনটা, কোনো স্বর আর ভেসে ওঠেনি তাদের কানে; প্রথমে তাদের মনে হয়েছিল তারা কালা হয়ে গেছে, কানে আঙুল ঢুকিয়ে বারবার কান পরিস্কার করেও তারা আর কোনো শব্দ শুনতে পায়নি, আর কোনোদিন ম্যাকফার্লঙ সাহেবের গলা ভেসে আসেনি বুড়ো ঝিনঝিনতলায়, ফলে ইঞ্জিনটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে তাদের জীবনে এবং যথারীতি রেল কর্তৃপক্ষ সেটাকে সরিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

    রতনদের পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি নতুন করে গড়ে ওঠে, খড়ের চাল ও মাটির বাড়ি নয়, অ্যাজবেস্টসের ঢেউখেলানো ছাউনি দেওয়া পাকা ঘর; তিনি নিজে এসে দাঁড়িয়েছিলেন রতনের কাঁধে হাত রেখে, অ্যাজবেস্টস থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে এসে তাঁর কালো চশমা পরা চোখদুটোতে পড়ছিল। ধীরে ধীরে এখানে দোকানপাট বসবে, হেলথসেন্টার হবে, রেলের কোয়ার্টারগুলো গড়ে উঠবে, নতুন স্টেশনমাস্টার আসবেন পরিবার নিয়ে — সেসব বেশ ক'টা বছরের কাজ। একদিন একজন ফ্রক পরা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে এসে দাঁড়াবে অ্যাজবেস্টসের চাল-ওলা বাড়ীটার সামনে, ঢুকে ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে সে রতনের বউকে ডেকে বলবে — মালতী মাসী, মায়ের খুব জ্বর এসেছে, গা ম্যাজম্যাজ করছে, তুমি তিনদিন কাজে যাওনি, মা আমাকে পাঠাল, অন্ততঃ বাসনগুলো মেজে দিয়ে এসো। অনুরোধ করে বেরিয়ে আসবার পথে হঠাৎ তার চোখে পড়ে যাবে স্টিকার-না ছেঁড়া মিশকালো কম্বলটা, একমুহূর্ত থমকে গিয়েই কোনো কথা না বলে নিজেকে সামলে নিয়ে যেন কিছুই দেখতে পায়নি এরকমভাবে সে বেরিয়ে আসবে বাড়ীটা থেকে; রাস্তায় এসে বিকেলের মন-খারাপ-করা আলোর ভেতর দাঁড়িয়ে তার মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে যাবে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • বাকিসব | ০১ জানুয়ারি ২০২০ | ২০৫৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ***:*** | ০২ জানুয়ারি ২০২০ ০২:৩৯80135
  • শুভ নববর্ষ , লেখা র জন্য অনেক ধন্যবাদ, চমৎকার লেখা।
  • b | ***:*** | ০২ জানুয়ারি ২০২০ ০৪:৪৮80136
  • এক্ষেলেন্ট।
  • | ***:*** | ০২ জানুয়ারি ২০২০ ১০:৫৬80137
  • ভীষণ ভাল
  • সায়ন্তন চৌধুরী | ***:*** | ০৪ জানুয়ারি ২০২০ ০৫:৩৯80138
  • @খ, শুভ নববর্ষ।

    একটু ভুল আছে। '...বিস্ময়ে হিম হয়ে গিয়েছিলেো জলের বছর...' এইখানটা প্রকৃতপক্ষে হবেঃ '...বিস্ময়ে হিম হয়ে গিয়েছিলেন, আর তাঁর মনে পড়ে গেছিল আরও পুরোনো দিনের প্রায় ভুলে যাওয়া এক মৃত্যুর ঘটনা — বাকি জীবনটা যে কাহিনী বুড়ো ঝিনঝিনতলার রাস্তায় রাস্তায় পাগলের মতো তিনি বলে বেড়াবেন আলোর পৃথিবী ছেড়ে কমলালেবুর ভেতর অপ্রতিরোধ্য ঘুমে তলিয়ে যাবার আগে পর্যন্ত। তখনও অবশ্য বুড়ো ঝিনঝিনতলার নাম বুড়ো ঝিনঝিনতলা হয়নি; পুবে বকুলপুর আর পশ্চিমে গড়ানডাঙার মাঝামাঝি চারানো খাপছাড়া বনজঙ্গলে-ভর্তি জায়গাটা চিরকালই আশ্চর্যরকম অপ্রয়োজনীয় ছিল, যদিও মাঝখানে অনেকগুলো জলের বছর...'
  • গুরুচণ্ডা৯ | ***:*** | ০৮ জানুয়ারি ২০২০ ০১:১২80139
  • এই অংশটা বাদ পড়ে যাওয়ার জন্যে দুঃখিত, ঠিক করে দেওয়া হলো।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন