তৃতীয় মঙ্গরসের অনবদ্য সুপশাস্ত্র মতে এর পরের হুগ্গিটি আরও চমকপ্রদ, যেমন স্বাদে তেমনি তার নামে—
অম্বুবিরহিত হুগ্গি
১। চাল সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে নরম হয়ে এলে তাতে হলুদ মেশান।
২। বিবিধপ্রকারের ডাল ৩/৪ ভাগ সিদ্ধ করে নিন।
৩। একটা খুব বড়ো মুখের মাটির হাঁড়িতে জল ভরতি করে তার মুখে একটা কাপড় বাঁধুন। চাল ও ডাল মিশিয়ে সেই কাপড়ের ওপর রাখুন এবং আর-একটা মাটির হাঁড়ি উলটো করে মুখোমুখি তার ওপর বসিয়ে দিন
৪। চাল সিদ্ধ হয়ে গেলে নুন ও মেথিগুঁড়ো মেশান। ওপরে এক পরত নারকোল কোরা দিন। ফের হাঁড়ি ঢাকা দিয়ে মৃদু আঁচে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখুন।
৫। আগুন থেকে সরিয়ে নিন। ঢাকা খুলে নারকোল কোরা সরিয়ে ফেলে দিন।
৬। ধূমায়িত অবস্থায় মেথি সুরভিত, নারকোল সুবাসিত হুগ্গি পরিবেশন করুন।
অসামান্য, এই আমরা পেলাম বে-আব খিচড়ির গভীর দক্ষিণি ভার্শন। এবং বলতে দ্বিধা নেই ফারসি-উর্দু-বাংলা মিলিয়ে যতগুলি জলহীন খিচুড়ির পাকপ্রণালী পেয়েছি, তার মধ্যে এই কন্নড় পদ্ধতিটিকেই আমার পক্ষে বাস্তবে রেঁধে দেখা সম্ভব হয়েছে। সময় লাগল অবশ্য পাক্কা দু’ ঘণ্টা। তার একটা কারণ খুব ভয় ছিল গ্যাসের ফ্লেম বাড়ালেই হাঁড়িটি ফেটে কেলেঙ্কারি হবে আর ওই যে আগেই বলেছি— অম্বুবিরহিত, আহা, জটায়ু শরণে বলতেই হয়—নামের জোরেই তো এ খিচড়ির প্রথম এডিশন কেটে যাবে মশাই! আর একটা কথা, খিচুড়ি বলতে সাধারণত যে একটা চালে-ডালে মাখামাখি বোঝায়, এ তার একেবারে উল্টো। আমার ধারণা এটিই একমাত্র খিচুড়ি যেখানে প্রতিটা চাল আলাদা করে তুলে খাওয়া যেতে পারে — যেমনটা হওয়া উচিত উৎকৃষ্ট পোলাও বা বিরিয়ানির ক্ষেত্রে!
তৃতীয়টি অবশ্য বেশ সাদামাঠা—
সাবুত মুগ হুগ্গি
১। কাঁচা সবুজ মুগ নিন। তার দ্বিগুণ পরিমাণে জল দিন
২। মুগ ৩/৪ ভাগ সিদ্ধ করুন।
৩। মুগের সমপরিমাণ চাল দিন, নুন দিন, সিদ্ধ করুন।
৪। এটি সরল, প্রশান্ত, পুষ্টিকর হুগ্গি।
মঙ্গরস আমাদের যে খিচুড়ি ওরফে হুগ্গি দিলেন, তা সুবাসিত, উপাদেয়, সর্ম্পূণ তেল ও ঘি-হীন, মাংসবিহীন। পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যকর। সময়কালের বিচারে দেখলে দেখা যাবে এই রান্না হচ্ছিল সুলতানি আমলের একেবারে শেষে, ১৫২৬ সালে বাবর মুঘল জমানা শুরু করার ঠিক আগে। কাজেই ১৬১৭ সালে জাহাঙ্গির বাদশার যে সফর দিয়ে আমরা এ অভিযান শুরু করেছিলাম মঙ্গরসের রসিক রসনা আমাদের নিয়ে এসে হাজির করল তার মোটামুটি এক শতক আগে। এর মধ্যে আমরা ঘুরে এসেছি খিচুড়ির অন্দর ও বহির্মহলের অনেক কামরা-অলিন্দ। অনেক রহস্যের সমাধান হয়নি, কিছু হয়েছে, অনেক রোমহর্ষক কিসসার সন্ধান মিলেছে, খিচুড়ি-অভিযান হয়ে উঠেছে এক মহাভারত পরিক্রমা, তার অজস্র বৈচিত্র্য নিয়ে। কিন্তু আমি বলব, যদি খিচুড়ির তারাবাজি দেখতে হয় তাহলে আমাদের ফিরে যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে খিচড়ির মুঘল গার্ডেন্স-এ।
ফিরে না গেলে যে রহস্য-সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ অধ্যায় শুরু তা পূর্ণ হওয়া নামুমকিন। খিচুড়িতে কবে পড়ল গুশ্ত—মাংস? আমি যেটুকু সাক্ষী-সাবুদ পেয়েছি, তাতে আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই যে এ কাণ্ড শুরু হয় শাহজাহান বাদশাহের আমলে। এটা কেন কীভাবে হল সে রহস্যের কুল-কিনারা আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি। যেমনটা আমরা আগেই দেখেছি, বিষয়টা ধর্মের নয় যে, ব্রাহ্মণ্যবাদী, মনুবাদী বিধিনিষেধ ভেঙে মুসলমান হেঁসেলে এসে খিচুড়ি নিজের শরীরে গুশ্ত নিল। তাহলে মুসলমান ঘিয়াৎশাহি হেঁশেলে মাংসের এত বিপুল পদের মধ্যে খিচুড়ি ঢুকে পড়ত। যদি ধরি শোলা বা শোলে ইরান-আফগানিস্তান হয়েই ভারতে এসেছিল, তাহলে তো আরও তাজ্জব হতে হয় যে কেন ঘিয়াসউদ্দিন শাহের ডাকসাইটে রকাবদারেরা তা থেকে মাংস ছেঁকে ফেলে দিলেন। হুমায়ুন এতকাল পারস্যে কাটিয়ে পারসিক রসনার যে বিচিত্র সব স্বাদ নিয়ে দেশে ফিরলেন, খিচুড়িতে গুশ্ত তার মধ্যে নেই। তবেই তো মহামতি আকবর এবং তস্যপুত্র জাহাঙ্গির, এই দুই দাপুটে বাদশার দুই পসন্দিদা খিচড়িই খাঁটি নিরামিষ। বিষয়টা শ্রেণিরও নয় যে গরিব আম আদমির খিচুড়িতে এতকাল মাংস পড়েনি তা স্রেফ আম আদমির খানা বলে। আকবর বা জাহাঙ্গির বাদশাকে তো ঠিক গরিব বলা যায় না! তাহলে? তাহলে খিচড়িতে গুশ্ত্ যখন পড়ল—মানে আমার হিসেবে শাহজাহান বাদশার হেঁশেলে— ঠিক তখনও কেন পড়ল, তার আগে কেন নয়, এ মহারহস্যের সমাধানের ভার আমি ছাড়লুম ভবিষ্যতে খানা-সত্যান্বেষীদের হাতেই।
আপাতত, এরপর আমরা একটা ছোট্টো লাফে ঠিক একশতক এগিয়ে গিয়ে ঢুকব সোজা শাহজাহানি হেঁশেলে। তাঁর রাজত্বকাল ১৬২৮ থেকে ১৬৫৮। তারপরে তস্যপুত্র আলমগির বাদশার হেঁশেলে। এরপর মুঘল সাম্রাজ্যের ঝাড়বাতি নিভু নিভু হলে চলে যাব অবধ, মানে লখনও-ফৈজ়াবাদের খানা-বরফট্টাইয়ের দুনিয়ায়। সেখান থেকে সুখাদ্যের ঊনবিংশ শতকীয় বাগ-বাগিচা দক্ষিণের হায়দরাবাদী নিজ়ামি হেঁশেলে এক চক্কর কেটে সাঁ করে চলে যাব পূবে। সেখানে দেখব বঙ্গীয় নবজাগরণের আশ্চর্য বিচ্ছুরণ কীভাবে রং দিচ্ছে সুপ্রাচীন খিচুড়িকে। আর সেই রেনেসঁসের জেরেই ঢুকে পড়ব ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকদের খিচুড়ির দুনিয়ায়, যেখানে বাঁড়ুজ্জের ‘ব্যানার্জি’, চাটুজ্জের ‘চ্যাটার্জি’ হওয়ার মতোই এই খাস ভারতীয় প্রাচীন খানা হল ‘কেজরি’। তারপর ফুটন্ত কেজরির ঢেউয়ের মাথায় চড়ে কালাপানি পার করে সোজা সাম্রাজ্যবাদের আঁতুড়ঘর বাকিংহ্যাম ও ব্রিটিশ রাজন্যের অন্যান্য প্রাসাদের হেঁশেলেও হবে কেজরির খোঁজ। সেখান থেকে সাম্রাজ্যবাদের ফলিত জোয়ারেই হাজির হব ব্রিটিশরাজের ‘আধা-উপনিবেশ’ মিশরের ‘জাতীয়খানা’ কোশারি-র পাতে।
এই প্রদক্ষিণ সাঙ্গ হলে, একেবারে শেষ পাতে আমরা প্রবেশ করব সেই জগতে যেখানে মনুষ্য নয়, এ সুপ্রাচীন খানা সর্বাগ্রে দেবভোগ্য—আমরা যাকে বলি ভোগের খিচুড়ি। বিস্তৃত সে তীর্থে আমরা যাব একটি ক্ষেত্রেই, পুরীর প্রভু জগন্নাথ মন্দির পাকশালে। সেইখানটিতেই শুধু যাব এই প্রাচীন প্রবচন মনে রেখে যে—দেবাদিদেব বিষ্ণু বিরাজ করেন ও নিদ্রা যান দ্বারকায়, স্নানসিক্ত হন রামেশ্বরমে, ধ্যানমগ্ন হন বদ্রীনাথে, এবং আহার করেন পুরীতে। আর আমরা সকলেই জানি সে আহারে খিচুড়ির সবিশেষ উপস্থিতির কথা। সত্যি বলতে কী পুরীর মহাপ্রসাদ রহস্যের অপার দুনিয়ার খিচুড়ির খোঁজে আমার অভিযান নিজেই এক আশ্চর্য রোমহর্ষক কাহিনি। সে নৈবেদ্যকথা দিয়েই শেষ হবে এই খিচুড়ি-আখ্যান।
(ক্রমশ…)
বাপ্রে! খিচুড়ির এতো সলুক সন্ধান, এতো রেসিপি! খুবই পুষ্টিকর ও উপাদেয়। :))
এই সুতোয় শৈশবের লোকগানের খিচুড়ির কথাও না হয় থাক!
"ডেগের ও ভিতরে
ডাইলে-চাইলে উতরাইলি গো সই
সেই উতরানি মোরে উতরাইলি...
শ্যাম, পিরিতি আমার অন্তরে,
হায়রে শ্যাম, পিরিতি আমার অন্তরে..."