খিচুড়ি খানাটা মোটামুটি কতটা প্রাচীন বলে প্রামাণ্য ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তরে বেরিয়েই আমরা জড়িয়ে পড়েছি এক জটিল রহস্যে। তার জট খুলতে খুলতে আমরা ‘খিচ্চ’, ‘খিচ্চা’, ‘খিচ্চি’ এই তিন শব্দ পার করে পৌঁছেছি অন্য দুটি শব্দে—কৃসর আর কৃসরা। এবার খতিয়ে দেখা দরকার কী এই কৃসর-কৃসরা খানা, এবং তা কত প্রচীন? আর তা দেখতে গিয়েই আমরা ঢুকে পড়লাম হাজার বছরেরও আগের বিস্তীর্ণ আলো-আঁধারি দুনিয়ায়। যে দুনিয়া বিস্তৃত কাশ্মীর থেকে ভারতীয় মূল ভূখণ্ডের অন্তিম দক্ষিণ উপদ্বীপ পর্যন্ত। উচ্চকিত প্রাচীন নাট্যমঞ্চ থেকে যৌনকর্মীর ‘কর্তব্যের’ বিশদ বিবরণ দেওয়া শাস্ত্রে। কঠিন ব্যাধির উপশমের কঠিনতর লড়াইয়ে লিপ্ত মহাবৈদ্য থেকে উচ্ছৃঙ্খলতায় সমাজ বুঝি গেল-গেল রব তোলা পণ্ডিতপ্রবরদের জারি করা কঠোর বিধি-নিষেধে। পরবের ভূরিভোজ থেকে আরাধনার নৈবেদ্যতে—মঠে, মন্দিরে।
‘‘ভরত মুনির বচন শুনিয়া মুনিগণ পুনরায় কহিলেন১, ‘এক্ষণে আমরা রঙ্গমঞ্চ বিষয়ক পূজানুষ্ঠানাদির বিষয়ে শুনিতে চাহি। অথবা কী পদ্ধতিতেই বা ভবিষ্যকালে ওই রঙ্গপীঠে মনুষ্যক্রিয়া কার্যাদি করিবে, সেবিষয়ে। ইহার লক্ষণাদি, আকার, পরিমাপ, তথা অধিকারী দেবতাগণের পূজা-বিধান কী হইবে সেসবের বিষয়েও আমাদিগকে অবহিত করুন।
‘যেহেতু নট্যশাস্ত্রের প্রারম্ভিক তত্ত্বই রঙ্গমঞ্চ সংক্রান্ত সেই হেতু আপনি কৃপা করিয়া সর্বাগ্রে নাট্যগৃহের লক্ষণাদি (আকার, পরিমাপ, স্বরূপাদি) আমাদিগকে বলুন।”
‘‘মুনিগণের বচন শুনিয়া ভরত মুনি কহিলেন, ‘প্রথমে আপনারা নাট্যগৃহের লক্ষণ (আকারাদি) ও পূজা-বিধান শ্রবণ করুন —
… ধীমান বিশ্বকর্মা নাট্যগৃহের বিষয়ে বহু বিচার করিয়া বলিয়াছেন তাহা তিন প্রকারের: বিকৃষ্ট, চতুরস্র ও ত্রয়স্র—আয়তাকার, চতুষ্ক ও ত্রিভুজাকার। ইহাদের পরিমাপ তিন প্রকার—বৃহৎ, মধ্য ও ক্ষুদ্র।’ ’’
এইভাবে ভরতমুনি একে একে জানান প্রত্যেক ধরনের নাট্যগৃহের সুনির্দিষ্ট পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিমাপ, সেগুলি তৈরি করার জমি নির্ধারণের পদ্ধতি ও আচার। এবং তারপরে শুরু হয় নাট্যগৃহের ভিত্তিস্থাপনের বর্ণনা—‘এইরূপে পূর্বকথিত বিধি অনুসারে নাট্যগৃহ নির্মাণের জন্য নির্ধারিত ভূমি বিভাজিত করিয়া শুভ নক্ষত্র যোগে ভিত্তি স্থাপন করিতে হইবে। এবং তাহা স্থাপনকালে শঙ্খ, দুন্ধুভি, মৃদঙ্গ, পণব২ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের বৃন্দবাদন করিতে হইবে।
‘এবং এই মঙ্গলময় উৎসবকালে অনিষ্টকারী সর্ব কিছু এবং অবিশ্বাসী পাষণ্ড, জৈন শ্রমণ, কাষায় বস্ত্রধারী বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বিকলাঙ্গ সহ সকল অযাচিতকে ওই স্থান হইতে সরাইয়া ফেলিতে হইবে।
‘রাত্রি হইলে দশদিশায় বিবিধপ্রকার আহারাদি, সুগন্ধী পুষ্প ও ফলাদি সহযোগে নৈবেদ্য প্রদান করিতে হইবে। পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর এই চতুর্দিকে যথাক্রমে শ্বেত-অন্ন, নীলাভ অন্ন, পীতবর্ণের অন্ন এবং লোহিত বর্ণের অন্ন নৈবেদ্য প্রদান করিতে হইবে। এই ভিত্তি স্থাপনকালে ব্রাহ্মণদিগকে ঘৃত-সমৃদ্ধ পায়েস, রাজাদিগকে দধি, ঘৃত, জল, মধু ও শ্বেত চিনির মিশ্রণে সৃষ্ট মধুপর্ক এবং অভিনয়কারীদের গুড় ও চাউলের মিশ্রণে সৃষ্ট গুড়োদন প্রদান করিতে হইবে।
‘বুদ্ধিমানগণ এই ভিত্তি স্থাপন করিবে মূল নক্ষত্র ও অনুকূল মুহূর্ত-যোগে।
‘এইরূপে ভিত্তি স্থাপন সম্পন্ন হইলে, ভিত্তি প্রস্তুতের কাজ সম্পন্ন হইলে স্তম্ভনির্মাণের কাজ আরম্ভ করিতে হইবে।…
‘নাট্যাচার্য তিনদিন ধরিয়া উপবাসের পর সূর্যোদয়ের শুভমুহূর্তে স্তম্ভনির্মাণের কার্য আরম্ভ করিবেন। ব্রাহ্মণস্তম্ভ হইবে চন্দন নির্মিত, ক্ষত্রিয়স্তম্ভ খয়ের৩ বৃক্ষের, বৈশ্যস্তম্ভ ঘব৪ বৃক্ষের এবং শূদ্রস্তম্ভ যে কোনও প্রকার বৃক্ষের কাষ্ঠে নির্মিত হইতে পারে।
‘সর্বাগ্রে স্থাপিত ব্রাহ্মণস্তম্ভ পরিশুদ্ধ করিতে হইবে ঘি ও সরিষা দ্বারা। ইহা স্থাপনকালে পূজার যাবতীয় সামগ্রী শ্বেত হইবে। এবং ব্রাহ্মণদিগকে ভোজনে পায়েস প্রদান করিতে হইবে।
‘ক্ষত্রিয়স্তম্ভ স্থাপনকালে ব্যবহৃত বস্ত্র, পুষ্প ও চন্দন সকলই রক্তবর্ণ হইবে। এবং ব্রাহ্মণদিগকে ভোজনে গুড়োদন প্রদান করিতে হইবে।
‘বৈশ্যস্তম্ভ স্থাপিত হইবে নাট্যমণ্ডপের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে। ইহার পূজা-উপচারে ব্যবহৃত সকল সামগ্রী পীতবর্ণের হইবে। এবং ব্রাহ্মণদিগকে ঘৃত ও চাউলের আহার প্রদান করিতে হইবে।
‘শূদ্রস্তম্ভ হইবে উত্তরপূর্ব কোণে স্থাপিত এবং ইহার পূজায় ব্যবহৃত সকল সামগ্রী নীলবর্ণ হইবে। এবং ব্রাহ্মণদিগকে আহারে কৃসর প্রদান করিতে হইবে।’’’
নাট্যমণ্ডপ নির্মাণের দীর্ঘ বর্ণনার ছোট্টো একাংশ। কথিত বর্ণনাকারী ভরতমুনি। শাস্ত্রের নাম নাট্যশাস্ত্র। নাটক, নাচ, সংগীত, সব মিলিয়ে যাকে বলা হয় ‘পারফর্মিং আর্ট্স’—পরিবেশিত কলা—তার প্রতিটি ক্ষেত্র, সে সবের রস ও ভাব, নিয়ে এমন একটি পরমাশ্চর্য প্রাচীন পুস্তক আর কোনো দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। এর সময়কাল? সঠিক সময়কাল অনির্ধারিত। তবে সাধারণ ভাবে ধরা হয়ে থাকে নাট্যশাস্ত্রের যে রূপটি এখন পাওয়া যায় তা ৫০০ সাধারণাব্দের৫। যদিও নাট্যশাস্ত্রের বিশিষ্ট গবেষক নাটালিয়া লিডোভা-র মতে এই শাস্ত্রের বর্তমান রূপটি তৈরি হয়ে গিয়েছিল ২০০ পূর্বসাধারণাব্দ থেকে ২০০ সাধারণাব্দের মাঝামাঝি কোনো এককালে৬। অর্থাৎ অন্তত দেড় হাজার বছর আগে বা তারও তিনশো চারশো বছর আগে।
নাট্যশাস্ত্রে বর্ণিত ‘বিকৃষ্ট মধ্য’ নাট্যমণ্ডপের প্ল্যান। সূত্র — Kuttambalam and its Links with Bharata's Stage। গোবর্ধন পাঞ্চাল
কিন্তু এই বর্ণনা একটি নাট্যমণ্ডপ তৈরির নির্দেশাবলিই শুধু নয়, এর পরতে পরতে সেসময়ের মধ্য-উত্তর ভারতের সমাজের রঙিন ছবি। পেয়ে গেলাম স্টেজ তৈরির বিজ্ঞানের আশ্চর্য নিখুঁত নিদর্শন, যার সামন্যই রয়েছে আমার এই বাংলা তরজমায়, লক্ষ করলাম পারফর্মিং আর্ট্স-এর ওপর কঠোর হিন্দু অনুশাসন, যেখানে বিকলাঙ্গদের পাশাপাশি অবিশ্বাসী, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের উপস্থিতিও কাম্য নয়। দেখলাম রঙ্গমঞ্চে জাত-ভেদ। ব্রাহ্মণদের অগ্রাধিকার ও তাঁদের তুষ্ট রাখার উপদেশ। জাতভেদের বর্ণভেদ। যেমন মদনমোহন ঘোষ—যাঁর তরজমাটি আন্তর্জাতিক গবেষক মহলে সমাদৃত আজও—শূদ্রস্তম্ভের রঙের বর্ণনা করেছেন ইংরেজিতে ‘blue’ বলে, এবং ফুটনোট দিয়েছেন—blue—symbol of non-Aryan origin associated with the Śūdras এবং পেলাম উৎসবে ব্রাহ্মণভোজনের আহারের তারতম্য ও তালিকা।
আর সেই তালিকাতেই শূদ্রস্তম্ভের নির্মাণের নির্দেশাবলিতে পেয়ে গেলাম—‘ব্রাহ্মণদিগকে আহারে কৃসর প্রদান করিতে হইবে! কৃসর খাদ্যটির এই বিশেষ তালিকায় অবস্থান কি আমাদের কোনো ইঙ্গিত দেয়? এ আন্দাজ করা কি খুব অযৌক্তিক এটি এমনই খাদ্য যা শুদ্রের পক্ষেও জোগান দেওয়া সম্ভব? সেই যে জাহাঙ্গির বাদশাহ লিখেছিলেন, ‘সব থেকে সস্তা’, সেই ট্র্যাডিশন কি তবে সুপ্রাচীন? তাই তো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই কারণেই যে, এরপরেও একাধিকবার পাচ্ছি কৃসর-র নির্দেশ—‘পবিত্র ব্রাহ্মণস্তম্ভ নির্মাণকালে ব্রাহ্মণকে দিতে হইবে গো-দক্ষিণা এবং অন্য স্তম্ভসকল নির্মাণকালে নির্মাণকারী সকলের জন্য মহাভোজের আয়োজন করিতে হইবে। উক্ত ভোজের আহার মন্ত্র দ্বারা পরিশুদ্ধ করিবেন নাট্যাচার্য। পুরোহিত ও রাজাদিগকে প্রদান করিতে হইবে মধু ও পায়েস, নির্মাণকারীদের দিতে হইবে লবণ ও কৃসর।’ আবার এরপরে ভরত বলছেন, ‘মত্তবারণী৭ নির্মাণকালে ভূতকুলকে তাহাদের ইষ্টদ্রব্য যথা মালিকা, ধূপ, সুগন্ধী দ্রব্যাদি, বিবিধ রঙের বস্ত্র নৈবেদ্য রূপে দিতে হইবে। এবং মত্তবারণীর স্তম্ভ সুদৃঢ় করিতে ব্রাহ্মণদিগকে পায়েস এবং কৃসরা দিতে হইবে।’
তাহলে নাট্যশাস্ত্র আমাদের বেশ সুনিশ্চিত ভাবেই জানিয়ে দিচ্ছে আজ থেকে অন্তত হাজার দেড়েক বছর আগেও ভারতের মূল ভূখণ্ডের মধ্যভাগের মানুষ দিব্যি কৃসর বা কৃসরা সাবড়াচ্ছিলেন। তবে তো চাউল-দালি সংমিশ্রণে তৈয়ার খিছুড়ির প্রাচীনতার রহস্য বহুলাংশে সমাধান হয়েই গেল। হল কি? মুশকিল এই যে, মনমোহন ঘোষ এবং বাবুলাল শুক্ল শাস্ত্রী উভয়েই কৃসরা-তে ফুটনোট দিয়ে বলে দিচ্ছেন, ‘দুধ, তিল ও চালের মিশ্রণে’ এ খানা তৈয়ার! সর্বনাশ, খিচুড়ি বা খিচড়ি নামে যে খানা চলে তা বহু কিছু দিয়েই তৈয়ার হয়, কিন্তু ঠিক এই রেসিপিটি তো কস্মিনকালে শুনিনি!
নাট্যশাস্ত্রই শুধু নয় মোটেই, কৃসর বা কৃসরা খানাটির উল্লেখ অভিধান ছাড়াও বিবিধ ধরনের শাস্ত্রে রয়েছে। যেমন ধর্মশাস্ত্রে। মনুস্মৃতি বা মনুর ধর্মশাস্ত্রে। খানা-ডিটেকটিভদের কাছে মনুস্মৃতি এক রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার। একাধিক কারণে। সে অ্যাডভেঞ্চার শুরু হবে পরের কিস্তি থেকে।
(ক্রমশ… পরের কিস্তি পড়ুন পরের বৃহস্পতিবার)
অসাধারণ। পুরো থ্রিলার ভাইবস পাচ্ছি। পরের কিস্তিটা আর একটু বড়ো করুন। লাস্ট দুটো পড়তে না পড়তেই ফুরিয়ে গেল।
রেফ #১ Manomohan Ghosh হবে।
কিস্তিগুলো আরো বড় করুন প্লিজ।
এইবারে এইটুকুনিতে যে পেট ভরল নাঃ(
এ পর্বের পাত জুড়ে তো কেবল নাট্যশাস্ত্রের তরজমা, তার মধ্যেও খিচুড়ির হলেও হতে পারে পূর্বপুরুষ ( নাকি নারী ! ) আছেন কেবল একচিমটি ! আগের পর্বে ar এর মন্তব্য মনসামঙ্গল নিয়েও আরেক ক্লু দিয়ে গেল, সে রহস্যেও আলো পড়বে তো ?
শুদ্র, প্রচীন, নট্য, খিছুড়ি এই টাইপোগুলি ঠিক করে দিলে ভাল হয়।
রেফ #৪, মনে হয়, "ঘব" স্থলে "ধব" হবে। [ধবঃ- Anogeissus latifolia (কবিরাজ উমেশচন্দ্র); Grislea tomentosa (মনিয়ের উইলিয়ামস)]
ভাল লাগল। অনুসন্ধান দারুণ।শুধু একটাই জিজ্ঞাসা খিচুড়ির আদি কৃসর বানানটি কৃশর নয় তো কোনও ভাবে?