[এই ফাঁকে প্রাচীন ভারতের দৈনিক কাল-বিভাগ নিয়ে একটু সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে নেওয়া যাক। এই লেখায় সে প্রসঙ্গ বারবারই আসবে। আমাদের তিথি মতে যদিও দিনের হিসেবে কিঞ্চিৎ হেরফের হয়, তবে গড় হিসেব ২৪ ঘন্টাই ধরেছি।
১ দিন = ৮ প্রহর = ২৪ ঘন্টা = ১৪৪০ মিনিট = ৬০ দণ্ড।
১ দণ্ড = ৬০ পল = ২৪ মিনিট = ১৪৪০ সেকেণ্ড।
১ পল = ২৪ সেকেণ্ড।
দিন ও রাত্রির প্রহরের হিসাব কিছুটা এরকম –
দিনঃ-
প্রথম প্রহর – প্রভাত – ৬ AM থেকে ৯ AM; দ্বিতীয় প্রহর – পূর্বাহ্ন – ৯ AM থেকে ১২ PM
তৃতীয় প্রহর – মধ্যাহ্ন – ১২ PM থেকে ৩ PM; চতুর্থ প্রহর - অপরাহ্ন – ৩ PM থেকে ৬ PM
রাতঃ-
প্রথম প্রহর – সায়াহ্ন – ৬ PM থেকে ৯ PM; দ্বিতীয় প্রহর – প্রদোষ – ৯ PM থেকে ১২ AM
তৃতীয় প্রহর– নিশীথ (মধ্যরাত্রি) – ১২ AM থেকে ৩ AM; চতুর্থ প্রহর – প্রত্যূষ - ৩ AM থেকে ৬ AM]
এখন এই বেলা আড়াই প্রহরে রাজপথে পথচারীর সংখ্যা বেশ কম। কয়েকজন রাজপুরুষ ঘোড়ার পিঠে দুলকি চালে নগর পরিদর্শন করছে। সকালের প্রথম প্রহরান্ত থেকেই বিপণিতে ক্রেতাদের ভিড় জমতে থাকে। এখন পথের দুধারের বিপণিগুলিও প্রায় ক্রেতাহীন। সূর্যের তেজ যত বাড়তে থাকে নাগরিক ক্রেতারা গৃহাভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। এই সময় বরং আশপাশের গ্রাম থেকে আসে গ্রাম্য লোকজন - ঘোড়া কিংবা গোশকটে। তাদের আশাতেই বণিকরা শূণ্য বিপণিতে ধৈর্য ধরে বসে থাকে। পড়শি বণিকদের সঙ্গে গল্পসল্প করে সময় কাটায়।
সাধারণতঃ এই গ্রাম্য ক্রেতারা সরল হয়। কথার তুবড়িতে তাদের ভুলিয়ে ফেলা যায় সহজেই। তাদের সঙ্গে কিছুটা তঞ্চকতা করে, নাগরিক ক্রেতাদের তুলনায় বেশ দুকড়ি উপরিলাভ করে নিতে পারে বণিকেরা। তবে আজকাল গ্রাম্য ক্রেতারাও শহরমুখো হচ্ছে কম। আজকাল কিছুকিছু বণিক, গাধার পিঠে, বলদের গাড়িতে পসরা সাজিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ঘরের মেয়েরা সরাসরি তাদের পছন্দ মতো বাসন-কোসন, রান্নার সরঞ্জাম, মশলাপাতি, কাপড়চোপড়, প্রসাধনী সামগ্রী হাতে নিয়ে, নেড়েচেড়ে, দেখেশুনে কিনতে পারে। কারণ শহরে আসে পুরুষরা। বাবা হোক, স্বামী হোক, ছেলে হোক, ভাই হোক – পুরুষরা পুরুষই। তারা মেয়েদের পছন্দের ব্যাপারটা তেমন বোঝে না। উপরন্তু তাদের মনে হয়, শহুরে বণিকদের বাকচাতুর্যে পুরুষরা বড্ডো বেশি ভেবলে যায়। তারা প্রায়ই ঠকে, রদ্দি জিনিষ কিনে আনে, বেশি দামে।
অতএব আজকাল মধ্যাহ্ন আহারে গৃহে যাওয়ার সময় পর্যন্ত শহরের বণিকদের সময় কাটে একঘেয়ে আলস্যে।
কিন্তু আজ তেমনটা হল না। বানজারা মেয়েদের একটি দল, গান গেয়ে আর নেচে নেচে রাজপথের একপাশ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। তাদের চলায় যেন গন্তব্যে পৌঁছনোর কোন তাড়াই নেই! নাচ ও গানের আনন্দেই তারা যেন মত্ত। তারা কোথা থেকে আসছে কেউ জানে না। কোথায় যাবে তাও কেউ জানে না। তাদের ভাষা দুর্বোধ্য। আশ্চর্য তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ। ঝলমলে রঙদার – পরনে পা পর্যন্ত লুটোন ঘাগরা, বক্ষে চোলি। ওদের দলে আছে চারজন যুবক পুরুষ। বলিষ্ঠ চেহারা সকলের। তাদের পরনে রঙিন পাজামা আর কুর্তা। চারজনের মধ্যে তিনজন পুরুষ বাঁশি, ঝাঁঝর আর ব্যাঞ্জো বাজিয়ে নাচ গানের সঙ্গত করছে। তবে একজন – সেই মনে হয় সর্দার – দলের সবাইকে সামাল দিয়ে চলেছে। রাজপথের পথিকদের যেন কোন অসুবিধে না হয়, তাদের চলাফেরায় যেন কোন বিঘ্ন না আসে।
বিপণি থেকে মানুষজন পথের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। উপভোগ করছে বানজারা দলটির নাচগান আর ওদের উজ্জ্বল বর্ণময় উপস্থিতি। এবং তার থেকেও তারা বেশি উপভোগ করছে, মেয়েদের অপরূপ রূপ আর যৌবন। তরুণ ও যুবক বণিকরা উচ্ছ্বসিত, আঃ মেয়ে তো নয় – যেন একঝাঁক প্রজাপতি উড়ে চলেছে। তাদের সকলের মনেও এখন উড়ছে ওই প্রজাপতির দল। অন্যদিকে বয়স্ক-বিজ্ঞ বণিকদের আড় চোখেও দর্শকামের আবেশ, কিন্তু মুখে বিরক্তি – কোথা থেকে জোটে এই নচ্ছার মেয়েছেলেগুলো, আমাদের ছেলেগুলোর মাথা খাওয়ার জন্যে? কোটালরা করছে কি, দূর করে দিক শহরের সীমানার বাইরে।
ভিয়েনের রসের কড়াইতে আটকে থাকা মক্ষির মতো দলটির দিকে সকলের মন যখন আবিষ্ট, সেই সময়েই রাজপথে এসে পৌঁছল দুই ঘোড়ায় টানা সুসজ্জিত একটি রথ। রথের গতিতে ধীর লয়। রথের আরোহী চান না, রথের ঝাঁকুনিতে তাঁর পানপাত্রের পানীয় উছলে পড়ুক। অথবা রথের দ্রুত গতির ঝাঁকুনিতে ছিন্ন হয়ে যাক তাঁর মদিরার আবেশ। রথের আরোহী রাজ শ্যালক রতিকান্ত। তাঁর রথের দুপাশে সামনে পিছনে সমগতিতে চলেছে ছজন সশস্ত্র অশ্বারোহী রক্ষী। অনতিদূরের প্রমোদকানন থেকে, এই সময়েই, রতিকান্ত তাঁর বাস ভবনে ফেরেন।
অহংকারী রতিকান্ত পথের দুধারের পথচারীদের কিংবা বিপণির বণিকদের মানুষের মধ্যেই গণ্য করেন না। পথের পাথরখণ্ড, অথবা পথের দুধারের গাছপালার দিকে তিনি যেমন নির্বিকার চোখে তাকিয়ে থাকেন, খেটে খাওয়া মানুষদের প্রতিও তিনি একই রকম উদাসীন। তবে পথচারীদের মধ্যে দৈবাৎ কোন সুন্দরী রমণীর দর্শন পেলে, তিনি মৎস্যলোভী শিকারী বিড়াল হয়ে ওঠেন। আজ পথের পাশে নাচ-গান গাওয়া বানজারা মেয়েগুলিকে দেখে তাঁর চক্ষুস্থির হয়ে গেল। সুন্দরী, যুবতী এবং নৃত্যগীত পটিয়সী এতগুলি রমণীর একত্র দর্শন পাওয়া – এ যে অভাবনীয় সৌভাগ্য। তিনি সারথিকে রথ থামানোর নির্দেশ দিলেন।
রথ থামলে তাঁর পাশে পাশে চলতে থাকা অশ্বারোহী রক্ষীকে তিনি বললেন, “অ্যাই, যা তো, মেয়েছেলেগুলোকে আজ সন্ধেবেলা আমার প্রমোদ ভবনে আসার জন্যে নেমন্তন্ন করে আয়। আমি কে পরিচয় দিবি। আর বলবি প্রত্যেকের দুহাত ভরে সোনার মুদ্রা উপহার দেব। ভাল করে বুঝিয়ে বলবি, হতভাগা তোরা যা হোঁৎকা আর মাথামোটা...”।
রক্ষীপুরুষ দলটির কাছে গিয়ে রতিকান্তর বার্তা দিতেই, মেয়েগুলি নাচ-গান থামিয়ে দিল। একটি মেয়ে গলা চড়িয়ে উত্তর দিল, “আমরা নাচগান করি মনের আনন্দে। আমরা বারনারী নয় হে, যে কেউ ডাকলেই তার নাট মহলে গিয়ে ধেই ধেই নেত্য করে বেড়াব। কথাটা আপনার ছোটরাজাকে স্পষ্ট করে বলে দিন, হ্যাঁ”।
রতিকান্ত রথে বসে মেয়েটিকে মন দিয়ে দেখলেন, তার কথাও শুনলেন। মুগ্ধ চোখে মেয়েটিকে দেখতে দেখতে তিনি ভাবলেন, এমন জিনিষের স্বাদ তিনি বহুদিন পাননি। আহা, কী ঝাঁজ, কী তেজ, যেমন বুক তেমনে তার বুকের পাটা। নিজের বুকে ওই বুকের স্পর্শই যদি না লাগল – তা হলে তিনি কিসের রাজশ্যালক? রতিকান্ত অন্য রক্ষীকে বললেন, “অ্যাই যে, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি? ওই মেয়েটাকে তুলে নিয়ে বন্দী কর। বেশী ট্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করলে সবকটাকেই ধরে কয়েদ কর – তারপর আমি দেখছি”।
রক্ষীদের কর্তব্য রতিকান্তকে রক্ষা করা। তাঁকে কেউ আক্রমণ বা আঘাত করতে এলে, তাকে বন্দী করা কিংবা প্রয়োজনে হত্যা করা। কিন্তু এই নির্বিবাদী বানজারা দলটি কাউকেই আঘাত বা আক্রমণ করেনি। এক্ষেত্রে ওদের বন্দী করার কোন অধিকার তো তাদের নেই। রতিকান্তর আদেশ পেয়েও রক্ষীরা যখন ইতস্তত করছে, ঠিক তখনই অকুস্থলে উপস্থিত হল জনা ছয়েক অশ্বারোহী নগররক্ষী। তারা রক্ষীদের কথা শুনেই দ্রুত সক্রিয় হয়ে উঠল এবং ঘোড়া ছুটিয়ে ঘিরে ফেলল বানজারাদের দলটিকে। বাতাসে চাবুক চালাতে লাগল সপাসপ। চেঁচিয়ে উঠল “ছোটরাজাকে তোরা চিনিস না? তাঁর আদেশ অমান্য করার সাহস হয় কী করে? মানে মানে আমাদের সঙ্গে চল, নয়তো চাবকে পিঠের ছাল তুলে দেব”।
দলের যে যুবকটিকে মনে হয়েছিল দলের সর্দার, সে মাটিতে পড়ে থাকা একটা ঝোলা থেকে ছোট্ট একটা বল্লম বের করে হাতে তুলে নিল। সেই বল্লমের ফলা দুপুরের রোদে ঝলসে উঠল আক্রোশে এবং মুহূর্তের মধ্যে সেটি উড়ে গিয়ে গিঁথে গেল রতিকান্তর গলার ঠিক পাশে আসনের পিঠে। এক চুলের জন্যে বেঁচে গেল রতিকান্ত।
আচমকা এই ঘটনায়, মেয়েগুলিকে ছেড়ে নগররক্ষীরা ঝাঁপিয়ে পড়ল যুবকটির ওপর। প্রহার করতে করতে মোটা রজ্জুতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল তাকে। তারপর তুলে দিল একটি ঘোড়ার পিঠে। বন্দী যুবককে নিয়ে নগররক্ষীরা চলে যাওয়ার আগে, তারা এসে দাঁড়াল রতিকান্তর রথের পাশে।
একজন নগররক্ষী মাথা নত করে বলল, “আমাদের অপরাধ মার্জনা করবেন, প্রভু। এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আপনি সুস্থ আছেন তো?”
আতঙ্কে বিবর্ণ মুখ, রতিকান্তর জিভও শুকিয়ে গিয়েছিল। তিনি কোনমতে বললেন, “না, কই? তেমন কিছু তো হয়নি। ঠিকই আছি”।
সেই নগররক্ষী আসনের পিঠে গিঁথে থাকা বল্লমটি খুলে নিয়ে বলল, “দুশ্চিন্তা করবেন না, প্রভু। আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। আজ রাত্রে হতভাগাকে অন্ধকার কারাগারে নির্জলা উপবাসে রেখে দেব। আগামীকাল প্রথম প্রহরেই ওকে রাজপথের চৌরাস্তার স্তম্ভের পাশে শূলে চড়িয়ে দেব। সকল নাগরিক দেখুক, বুঝুক - এ রাজ্যে দুর্বৃত্তের কী পরিণতি হয়”।
কিছুটা ধাতস্থ হওয়া রতিকান্ত হতাশ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “কিন্তু ওই মেয়েগুলো? তারা তো পালিয়ে গেল!”
“ও নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না, প্রভু। ওই দলের প্রত্যেককে আমরা অচিরেই খুঁজে বের করব। তারপর বন্দী করে আপনার সামনে এনে দাঁড় করাব। অনর্থক আপনার অনেক বিলম্ব হল প্রভু, এবার আপনি রওনা হোন। আপনার যাত্রা নির্বিঘ্ন হোক”।
নগররক্ষী ইশারা করতে সারথি রথ চালনা শুরু করল, এবং আগের মতোই ছজন অশ্বারোহী দেহরক্ষী চলল সঙ্গে। বন্দী যুবককে নিয়ে নগররক্ষীরাও দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে দিল উলটো দিকে। ওদিকেই নগর কোটালের কার্যালয়, বন্দীশালা ও কারাগার।
এই গোলমালের শুরুতেই বিপণির ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছিল বণিকরা। আড়াল থেকে নজর রাখছিল পরিস্থিতির ওপর। এ ধরনের ঘটনায় তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কারণ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানে, এই ধরনের বিশৃঙ্খলা হলেই, সাধারণ জনতা, নগররক্ষী সকলেই বিপণিগুলি এবং বণিকদের উপর চড়াও হয় - অকারণ মারধোর করে এবং লুঠ করে নেয় বিপণির মূল্যবান সামগ্রী।
এখন রাজপথ জনশূণ্য। পথে একজনও পথচারী নেই। আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বণিকেরা তাদের সকল বিপণিগুলির দরজা দ্রুত বন্ধ করে ফেলল। তারপর একত্রে ঘরের দিকে যেতে যেতে আলোচনা করল, আজ সন্ধ্যায় আর বিপণি খুলে কাজ নেই। আগামী কাল সকালে পরিস্থিতি বুঝে যা হোক একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
ক্রমশ...