এক। ইনকিলাব পথের মেয়েরা
ইরানের ইশকুলের পড়ুয়া বালিকারা তাদের খোলা চুলের ছবিতে ছেয়ে দিয়েছে সোস্যাল মিডিয়া।
এক মাস ধরে ইরান আক্ষরিক অর্থে জ্বলছে। একটি দৃশ্য ইতিমধ্যেই আমাদের মাথার ভেতরে বসে গেছে। উন্মুক্তবেণীধরা এক নারী কেটে ফেলছেন তাঁর চুল। এই নারী এখন দিকে দিকে প্রতীকের মত। ইরানের এই মেয়েটি প্রতিবাদিনী।
তেহেরান সহ ইরানের আশিটি শহরে ইনকিলাবের আগুন জ্বলছে। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে অনেক মানুষের, সংখ্যাটা প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে । আন্দোলনকারীদের হাতে মারা গেছেন পাঁচ নিরাপত্তারক্ষীও। রাস্তা থেকে বেমালুম লোপাট হয়ে যাচ্ছে মানুষ। খড়্গহস্ত, কঠোর হাত শাসকের, তার লোহার মুঠি স্পষ্ট করে তুলছে নির্বিচার গ্রেপ্তার আর গুলি বর্ষণ। ইরান সরকারের বয়ানে এই আন্দোলন নাকি বহিরাগত, বিদেশি শক্তির উশকানি থেকে এই আগুন জ্বলেছে। স্বীয় সংস্কৃতিকে বজায় রাখতে হবেই, ইস্লামিক বিপ্লবের পরবর্তী ইরানের সরকার শুধু আয়নায় দেখতে পান নি নিজের মুখটি। মানুষ আসলে রাজনৈতিক সামাজিক সবরকমের বদল চাইছেন। চাইছেন অবক্ষয়ী ও দুর্নীতিবাজ সরকারকে ছুঁড়ে ফেলতে। স্বতঃস্ফূর্ত রাগের পেছনে আছে অনেক দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ।
সঠিকভাবে হিজাব পরেন নি, সঠিকভাবে মাথা ঢাকেন নি, সঠিকভাবে কেশ আবৃত করেন নি। এই কারণে মৃত্যু ঘটেছিল মাহসা আমিনির। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২। সরকারের পোষা নীতিপুলিসের ঘেরাওয়ে থাকাকালীন আহত মাহসাকে মাথায় আঘাত করা হয়েছিল। এখনো ইরানের সরকার এ কথা স্বীকার করেনি যে মাহসাকে মেরেছে রাষ্ট্র। কিন্তু মাথায় আঘাত ও রক্তক্ষরণ নিয়ে, কোমায় দুদিন থাকার পর যখন মাহসার মৃত্যু হল, দ্রুত উত্তাল হয়ে উঠল দেশ। বাইশ বছর বয়সিনী এই ইরানি মেয়েটি যেন সারা দেশের নারীর এ তাবত কালের অবরুদ্ধতার প্রতীক।
এখনকার সময়ে অন্তর্জালযোগে দ্রুত ছড়িয়ে যায় ছবি ও ছায়াছবিরা। বিশ্বের নজরে আসে শুধু মেয়েরা নয়। আগুন ঘিরে মেয়েদের নৃত্যরত মূর্তি, কালো হিজাব বা বোর্খা টেনে আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য তো ভাইরাল হচ্ছেই। পাশেই চোখে পড়ে তরুণদেরও। ইরানের তরুণীদের ভাইয়েরা বা প্রেমিকেরা তাদের ঘিরে রয়েছে । এক দুর্বার সরকার বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে মাহসার মৃত্যুর স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ।
ইরানের সরকার এ আন্দোলন থামাতে গুলি টিয়ারগ্যাস জলকামান পেলেট সবই ব্যবহার করেছেন। ইনস্টাগ্রাম ওয়াটস্যাপ বন্ধ করেছেন। তথাপি গোটা পৃথিবী কেঁপে উঠেছে, তাকিয়ে দেখছে ইরানের দিকে। ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাল ওই ভিডিওগুলি যাতে বোরখা পোড়ানোর দৃশ্য দেখে বুকের মধ্যে দামামা বেজেছে নানা দেশের মেয়েদের। যারা নানা কারণে অবরোধে ও আড়ালে থাকে, যারা নানা রকমের বাধ্যবাধকতায় জীবন কাটায়। যে বাধ্যবাধকতা আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মেয়েদের চাল চলন আর পোশাকের ওপরেই লাগু হয়। নারীর পোশাক, তা হবে এমন যা পুরুষের মনোবৈকল্য ঘটাবে না। স্বতঃই সোনার আঙটি পুরুষের পৌরুষ বলে কথা। চুল বা হাত বা কটিদেশ, নারীর যে কোন উন্মুক্ত অংশ দেখলেই বিচলিত হয় এমন ইন্দ্রিয়পরায়ণ প্রাণীকে তো সাবধানে এড়িয়ে চলতে হবে নারীশরীর দেখা, তাই দায় মেয়ের । মূল্যবান ধাতুকে ধারণ করে রাখতে নারীকে আপাদমস্তক ঢেকে ফেলতেই হবে । কেবল পোশাক যথেষ্ট নয়। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ অব্দি ঢাকতে হবে।
ইসলামের এই বিধান আছে। ত্রিশ বছর আগে, তথাকথিত বিপ্লবের আগে, যখন ইরান ছিল পহলভি রাজবংশের করায়ত্ত , তখন কিন্তু এত বিধিবিধান, আইন করে মেয়েদের হিজাব পরতে বাধ্য করা দেখা যেত না। বোরখাহীন চাদরহীন, মুক্তকেশী মেয়েদের দেখা যেত। চুলে বব কাট দেওয়া মেয়েদের দেখা যেত তেহেরানের পথে, নানা পেশায় পাশ্চাত্যের মেয়েদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। যেভাবে আফগানিস্তানের কাবুলে স্বল্পবেশা, মুক্তকেশী মেয়েদের ছবিও দেখা যায়। ইতিহাসের পথ আসলে সরলরৈখিক নয়, এক রেখায় চলে না প্রগতির পথে সমস্ত সভ্যতা। সমস্ত সভ্যতার ভেতরে বার বার বৃত্তাকার ছন্দে ফিরে আসতে দেখা যায় পুরনো অভ্যাস ও বিশ্বাসেদের। উচ্চাবচভাবে বার বার ঘুরে আসে ভাবনার সেইসব বদ্ধতা, যাদের আমরা পুজো করি ঐতিহ্য , সংস্কৃতি, ধর্মের নিদান অথবা জাতীয় অভ্যাসের নাম দিয়ে। ১৯৭৯ সালে ইরানের "বিপ্লব"-এর পর মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল হিজাব বা বোরখা। এখানে মনে রাখতে হবে ইরানে আইনবলে হেড স্কার্ফ, মাথা ঢাকা চাদর বা হিজাব যেহেতু মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক, বিদেশিনীরাও সেখানে গিয়ে সেটাই মেনে চলতে বাধ্য ছিলেন। তেহেরানগামী প্লেনে হর হামেশাই দেখা মিলবে, সম্পূর্ণ বাহু ঢাকা পোশাক ও ম্যাচিং হিজাব পরিহিতা নানা ভিন্দেশি মহিলা ব্যুরোক্র্যাট বা ডিপ্লোম্যাটের। ২০১৮ সালে চিন থেকে সাঙ্গীতিক সফরে যাওয়া এক শিল্পীকে জোর করে হিজাব পরতে বাধ্য করা হয়েছিল তাঁর কনসার্টের মাঝখানে।
আজকের তালিবানের পুনঃ করায়ত্ত আফগানিস্তানে পুনরায় মেয়েদের ওপর চেপে বসতে চলেছে নতুন করে বিধিবিধান। আমরা ছবিতে দেখেছি বিউটি পার্লারগুলো তালা মেরে বন্ধ করে মেয়েদের মুখের ছবিতে আলকাতরা লেপে দিয়েছে নারীবিরোধী তালিবান। ইসলামপ্রধান নয়, এমন অনেক রাষ্ট্র শিউরে উঠেছে এ দৃশ্যে । কিন্তু বিপরীতে যে সব সমাজ পোশাকের ব্যাপারে উদার, তাদের মানসিকতাতেও এই ভাবনার অবশিষ্টাংশ এখনো গেড়ে বসে আছে, যে নারীর ওপরে হওয়া যে কোন আক্রমণ, যৌন হিংসার জন্যই সে নিজেই দায়ী। নিশ্চয়ই মেয়েটি যথেষ্ট শীলসম্পন্ন ছিল না, নিশ্চিতই তার আচরণে বা পোশাকে অশিষ্ট অশ্লীল কিছু ছিল নতুবা পুরুষের যৌনবাসনা উদ্রেক হয় কীভাবে? স্লাট শেমিং বা যে কোন ধর্ষিতাকে অশালীন পোশাকের বা অসভ্য চলাফেরার ভাবার ঐতিহ্য সর্বত্র রয়েছে। যেসব দেশে বোরখা পরাকে আইনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বা নারীকে লাজহীনতার জন্য চাবুক মারার বা পাথর ছুঁড়ে শাস্তিদানের মধ্যযুগীয় প্রথা এখনো পুরোপুরি বহাল, কেবল ধর্মের নামেই, সেসব দেশ যদি এক প্রান্তে, তো অন্য প্রান্তে আছে মেয়েদের কী করা উচিত কী করা উচিত নয় সে নিয়ে তত্ত্ব কথা কপচানো, আদি অকৃত্রিম পুণ্য সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে অসূর্যম্পশ্যা করে রাখার চেষ্টা, আর এসব যারা মানেন না তাঁদের প্রতি একপেশে ও জাজমেন্টাল দৃষ্টি। মার্গারেট অ্যাটউড তাই তাঁর হ্যান্ডেমেইডস টেলে এক কাল্পনিক দেশের কথা বলেছিলেন, যে দেশে মেয়েদের ক্রেডিট কার্ড রাখার অধিকার নেই, টাকাপয়সা লেনদেনের অধিকার নেই । যে দেশে মেয়েরা যৌনদাসী। কাহিনির শেষের ফুটনোটে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, যত অবিশ্বাস্যই মনে হোক না কেন, আসলে মেয়েদের সঙ্গে এইসব ঘটেই চলেছে পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তে। দেশ কাল ভেদে মনে হয় ব্যাপারটা কতই না অদ্ভুত!
ইরানের দন্ডবিধিতে হিজাব না পরার শাস্তি ৭৪ চাবুকের ঘা। ২০১৮ সালে হিজাব না পরে সামাজিক মাধ্যমে বক্তব্য রাখেন সাবা কর্দ আফসারি। এবং গ্রেফতার হন, বৎসরাধিক কাল জেলবাস করেন। মুক্তি পাবার পর আবার মাথা না ঢাকার অপরাধে জেলে যান, এবার সাজা হয় পনেরো বছরের কারাবাসের । তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আছে, বলা হয়েছে মাথা না ঢেকে তিনি ভ্রষ্টাচার আর বেশ্যাবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। একইভাবে জেলে গেছেন ইয়াসামান আর্মানি বা মারিয়াম আকবরি মনফারেদ।
২০১৭ থেকে ২০১৯ ইরানের মেয়েরা লাগাতার আন্দোলন করে চলেছেন হিজাবের বিরুদ্ধে। ভিদা মোভাহেদকে ডাকা হয় "গার্ল অফ ইনকিলাব স্ট্রিট" নামে। ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭ তে ভিদা সাদা হিজাব লাঠির ডগায় বেঁধে পতাকার মত উড়িয়েছেন। ভিদাকে অনুকরণ করে বার বার সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের চিত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন আরো অনেক মেয়েরা পরের বছরগুলোতে। ইনকিলাব স্ট্রিটের মেয়েরা বার বার জেলে গেছেন, গ্রেফতার হয়ে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন, সহ্য করেছেন পুলিসের লাঠি। এই মেয়েদের সঙ্গে থেকেছেন মানবাধিকার গোষ্ঠীরা, উদারপন্থী মিডিয়ার একাংশ, সাংবাদিকের দল।
পুলিস ও নীতিপুলিস, দুই স্তম্ভ ইরান রাষ্ট্রের। আজকের তেহেরানের পথ উত্তাল। মেয়েদের আন্দোলন চূড়ান্তে পৌঁছচ্ছে। একটা বারুদের স্তূপে অগ্নিসংযোগ করেছে মাহসা আমিনির মৃত্যু। বিশ্বের নানা দেশে ইরানের মেয়েদের পক্ষ নিয়ে মানুষ লিখছেন, কথা বলছেন। ক্রিশ্চিয়ান আমানপুর, সি এন এন ইন্টারন্যাশনালের সাহসিনী ও তুমুল জনপ্রিয় সাংবাদিক, তাঁর চ্যানেলে ডেকেছিলেন জাতিসংঘের সভায় হাজির ইরানের রাষ্ট্রপতিকে সাক্ষাৎকার নিতে । নির্ধারিত সময় আসবার কিছুক্ষণ আগে, আমানপুরকে রাষ্ট্রপতির সচিবেরা জানালেন আমানপুরকে মাথা ঢাকতে হবে, হেডস্কার্ফ না পরলে রাষ্ট্রপ্রতি সাক্ষাৎকার দেবেন না। নিউ ইয়র্কের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমানপুর অস্বীকার করলেন এই প্রস্তাব। কারণ সে দেশের মাটিতে ইরানের আইন চলে না। শুধু তাই নয়, কোন রাষ্ট্রপ্রধানের এই ধরনের দাবিই তাঁর কাছে অযৌক্তিক। অপ্রত্যাশিত এবং আচমকা এই দাবি মেনে নেবার প্রশ্নই নেই, আমানপুর বলে পাঠালেন। সাক্ষাৎকার বানচাল হলেও সারা পৃথিবীতে একটা অনুরণন ঘটে গেল। ইরান নিজের মাটিতে মেয়েদের আক্রমণ করছে , অত্যাচার করছে হিজাবের আইন দেখিয়ে। আমানপুরের শিকড় ইরানে। অস্বস্তির সীমা রইল না ইরান সরকারের ।
আমাদের মাটিতে দাঁড়িয়ে আজ কেউ কেউ অন্যভাবে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন। হিজাব নিয়ে ভারতে যে আন্দোলন চলছে তা মুসলিম মেয়েদের নিজেদের আন্দোলন নয়। তা "অপরায়িত" বলেই হিজাবকে দেখায়। অ-মুসলিম সেন্টিমেন্টের জোয়ারে, অন্য ধর্মের মেয়েদের হিজাব পরিধান মানব না, মুসলিমবিদ্বেষের আবহ নিয়ে আসছে। ভারতে হিজাববিরোধিতা ও হিজাব সমর্থন তাই অত্যন্ত জটিল একটা বিষয়। এক ধরনের ক্ষমতাতন্ত্রের বয়ান । যে মেয়েরা নিজেরা হিজাব ত্যাগ করতে চাইছেন ইরানে , তাঁরা তা করছেন নিজের দেশের সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েই শুধু নয়, নিজের ধর্মকে ত্যাগ না করে। পর্দানশিন থাকাটা মেয়েদের নিজেদের সিদ্ধান্ত কতখানি এই কূট প্রশ্ন এখানে আসে।
নারী কী চাইছেন , কীভাবে চাইছেন, তাই দেখার। তাঁদের চাওয়াকে ভুল বা ঠিক বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়না। সমাজের ভয়ে অথবা পরিবারের চাপে বাংলার মুসলিম মেয়েরা যাঁরা ত্রিশ বছর আগে হিজাব নিয়ে ভাবতেন না, এখন ভাবছেন, এ কথা অনেকাংশে সত্যি। তবু, এক পরিণতমনস্ক সমাজে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে মান্যতা দেওয়াটাই শেষ কথা। , শেষাবধি মেয়েরাই বলুক মেয়েদের নিজের কথা। তাঁরা কী চান, কী পোশাক পরবেন , তাঁরাই ঠিক করুন।
যাঁরা ধর্মের থেকে লাইন টেনে আইন করেন, নীতিপুলিস লেলিয়ে দেন মেয়েদের ওপর, তাঁরা, আর যাঁরা ধর্ম আর সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে মেয়েদের অন্দরমহল সামলানোর কথা জোর গলায় বলেন, পোশাক নাজি খাদ্য নাজি লেলিয়ে দেন নিজের ধর্মের অন্যদের ওপরে, তাঁদের মধ্যে তফাৎ হয়তো আছে তবে তফাৎটা কমবেশির। মূল জায়গায় দুজনেই সমান মৌলবাদী।
এনগেলাব , এক পারসি শব্দ। ইনকিলাব , উর্দুতে এসেছে। অর্থ বিপ্লব। যে বিপ্লব আমরা আজ দেখছি ইরানের পথে ।
দুই। ধর্মপরিচয়ের রাজনীতি, ও এক সাঁতারপোশাকের গপ্পো
যখন ইরান জ্বলছে মেয়েদের রোষে, তখন পাশাপাশি বিশ্বের আরেক তথাকথিত উদারবাদী ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কী ঘটছে? সমুদ্রতীরে বসা এক মহিলা নিজের মাথা ঢেকে ছিলেন বলে পুলিশ এসে তাঁর কন্যার সামনে জোর জবরদস্তি করে তাকে সমস্ত গা ঢেকে পরা হিজাব সরাতে বাধ্য করছে। ফরাসি নানা সমুদ্রতীরবর্তী শহরের তট জুড়ে পুলিস কোন মহিলার জোর করে পোশাক খোলাচ্ছে, এই দৃশ্য, আর স্বেচ্ছায় স্বাধীনতাকামী ইরানের মেয়েরা হিজাব পোড়াচ্ছেন, এ কি একই মুদ্রার দুই পিঠ? উদারবাদী দেশগুলোর ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম ভীতি বাড়ছে ক্রমাগতই, আর মুসলিম মেয়েদের "অপরায়ণ" দেখছি আমরা। ক্রমাগতই দ্রুতগতিতে পিছিয়ে যাচ্ছি বিশ্ববাসী, ক্রমাগতই আমাদের গোটা বিশ্বের মানুষকে এক ও অপরের দুই অসেতুসম্ভব দূরত্বে ঠেলে দিচ্ছে হিজাব বিতর্ক।
ফ্রান্স জার্মানি প্রমুখ অগ্রগামী ইউরোপিয় দেশের ক্ষেত্রে উলটো ব্যাপার ঘটছে। সেখানে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে বোরখা ( সমস্ত শরীর এবং মুখ অব্দি ঢাকা পোশাক, যা মেয়েরা পরেন)। মুখ ঢাকা পোশাককে বলা হয়েছে উগ্রবাদীদের পক্ষে সহজ আবরণ। অর্থাৎ বকলমে যে কোন মুসলিম বোরখা পরিহিতা মেয়েকে সম্ভাব্য উগ্রবাদী হিসেবে দাগিয়ে দেবার একটা প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। ২০১১ থেকে আইন করে মেয়েদের মুখ উন্মুক্ত করতে বাধ্য করা হচ্ছে এয়ারপোর্টে, পাবলিক যেকোন পরিসরে। গণ পরিসরে মেয়েদের মুখ ঢাকার প্রাচীন রীতি আছে ইসলামে। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রান্স এই রীতিপ্রসূত বোরখাকেই শুধু নিষিদ্ধ করেনি, সমস্ত শরীর ঢাকা সাঁতার পোশাক বুরকিনিকেও নিষিদ্ধ করেছে। আর বিতর্কের সূত্রপাত এই বুরকিনি ব্যান নিয়েই। কারণ মুখ ঢাকা বোরখা নিষিদ্ধকরণের একটা অর্থ বোঝা গেলেও, গা ঢাকা সাঁতার পোশাককে ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে বিপজ্জনক আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করা? কেন?
কী এই বুরকিনি? বুরখা + বিকিনি = বুরকিনি। এর আবিষ্কারক আহেদা জানেত্তি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি নিজের ধর্মীয় অনুশাসনের ফলে কোনদিনই বিকিনি পরে সাঁতার কাটতে যেতে পারেন নি স্থানীয় সুইমিং পুলে। অনেক মুসলিম মেয়েই যেতে পারেন না, হয়ত ধনীরা নিজস্ব পুলে সাঁতার কাঁটেন গোপনীয়তায়। কিন্তু সাঁতার কাটার আনন্দ মুসলিম মেয়েদের দিতে চেয়েছিলেন তিনি, তাই মাথা ঢাকা, শরীর ঢাকা এক নতুন ধরনের সাঁতার পোশাক সৃষ্টি করেছেন তিনি। অন্তর্জাল ঢুঁড়ে তিনি তাঁর বোনঝির জন্য ফুটবল খেলার উপযোগী মুসলিম মেয়েদের স্পোর্টসওয়্যার পান নি, এই ধরনের অনেক গুলো অভাববোধ থেকেই ২০০৪ সালে বুরকিনির উদ্ভব। বুরকিনি নামকরণ তাঁরই করা, কিন্তু তিনি কোনমতেই একে বোরখার সমতুল্য বলে প্রচার করতে চাননি। বোরখা শব্দটি কুর-আনে নেই, এ কথাও তাঁর জানা। বিকিনি শব্দের সঙ্গে মিলিয়ে একটা চটজলদি আকর্ষক নাম দেন এই অস্ট্রেলিয়া উদ্ভুত , স্বেচ্ছায় ইসলামকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা মেয়ে। জানেত্তি বলেন, বুরকিনি আসলে মেয়েদের মুক্তি দিয়েছে। অনেক মেয়েকে পথ দেখিয়েছে সাঁতারের পুলে বা সমুদ্রে নেমে পড়ার। স্বাধীন করেছে মুসলিম মেয়েদের। ফ্রান্সে বুরকিনি নিষিদ্ধ করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্কের শেষ নেই, তা তাঁর একেবারেই অনভিপ্রেত বলে মনে হয়েছে, কেননা, মেয়েদের পোশাক বেছে নেওয়ার স্বাধীনতাকে তিনি মেয়েদের নিজেদের শরীর সংক্রান্ত স্বাধীনতারই অংশ মনে করেন। আর এই বুরকিনি নিষিদ্ধ করার সঙ্গে তিনি যোগ পান সর্ব ধর্ম সহিষ্ণুতার নয়, বরঞ্চ জাতিবিদ্বেষ বা রেসিজম-এর।
মূল সমস্যা হল ইউরোপের দেশগুলোতে আগত ভিনদেশি পরিযায়ীদের নিয়ে। বহু বছর ধরে ব্রিটেনে ভারতীয় ও বাংলাদেশিরা , জার্মানিতে তুর্কিরা এবং ফ্রান্সে উত্তর আফ্রিকার ফরাসিভাষী ইসলাম দেশগুলির নাগরিকেরা এসে বসতি করেছেন। গত বছর কুড়ি ধরে এই বহু সংস্কৃতির মিলনস্থলগুলোতে চোখে পড়ার মত বেড়েছে এক দিকে ইসলামোফোবিয়া অন্যদিকে কাজে পোশাকে আচার ব্যবহারে বেশি বেশি করে ইসলামধর্মের প্রদর্শনের হিড়িক। দুটোর কে আগে কে পরে তা প্রায় পাখি আর ডিমের প্রশ্নের মতই কূট প্রশ্ন। আইডেন্টিটি পলিটিক্স এখন চূড়ায় বিহার করছে সমস্ত পৃথিবীতে। আর সেইখানে খুব জরুরি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াচ্ছে মেয়েদের নিজেদের সিদ্ধান্ত, তাঁরা কি স্বেচ্ছায় বেছে নিচ্ছেন নিজেদের পোশাক? বুরকিনির মত নতুন সাঁতার পোশাক কি মেয়েদের "নিজের শরীর নিজের অধিকার" স্লোগানের পক্ষে না বিপক্ষে? নাহলে গ্রেনোবল নামের ফরাসি শহরের মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে মেয়েরা বুরকিনি পরে ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতেই বা ছড়াবেন কেন? কেনই বা চ্যালেঞ্জ করবেন ফরাসি সরকারের বুরকিনি নিষিদ্ধকরণের সিদ্ধান্তকে?
ভারতে যেখানে কর্ণাটকে স্কুল কলেজে ধর্মীয় পোশাক পরাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, স্বয়ং বিচারপতি বোরখা নিষিদ্ধ করণের পর নিজের জন্য সুরক্ষা চেয়েছেন রাজ্য সরকারের কাছে, যে বিষয় নিয়ে দু ভাগ হয়ে আছে ভারত... হিন্দু ছাত্রছাত্রীদের এক বগগা মানসিকতা আর অপরায়িত মুসলিম ছাত্রীরা যতটা দূরে দূরে সরে গেছেন যতটা আর কখনো ছিল না, তখন বিদেশের সাংবাদিকেরা সজোরে বলছেন বোরখা বা বুরকিনি নিষিদ্ধকরণ আদৌ সাহায্য করেনা ফ্রান্সের উদারবাদী ধর্মনিরপেক্ষ চিত্রায়ণকে, আদতে সে ইমেজের উল্টোদিকেই যাচ্ছে এই বিপরীত নীতিপুলিসি... প্রশ্নগুলো জটিল, আর উত্তরও আমাদের জানা নেই।