

নরমানডির তটে- পর্ব দুই
সমুখে শান্তি পারাবার
বেহালার সুর যেন হেমন্তের দীর্ঘশ্বাস ১ জুন ১৯৪৪
তার ক্লান্তিকর সুর আমার হৃদয় বিদ্ধ করে ৫ জুন ১৯৪৪
জনের গোঁফ লম্বা ৬ জুন, ১৯৪৪ সকাল সাড়ে নটা
পেগাসাস ব্রিজ: ওপারে মুক্তি
মিত্র শক্তির সম্ভাব্য অভিযানের আশঙ্কায় জার্মান ভেরমাখট ইংল্যান্ড থেকে বেতার তরঙ্গে পাঠানো প্রতিটি মেসেজ পড়ে ফেলছে চার বছর যাবত। তখন ফরাসি প্রতিরোধের বা রেজিসতঁসের সঙ্গে সাঙ্কেতিক যোগাযোগ রাখতে বিবিসির স্বতন্ত্র সম্প্রচার কেন্দ্র রাদিও লন্দ্র (Radio Londres) ফরাসি কবি পল ভেরলেইনের শরণাপন্ন হয়। রেজিসতঁসকে বলা হয় প্রতি রাত এগারোটায় তাঁরা যেন রাদিও লন্দ্র শোনেন, সেখানে অনেক আপাত অর্থহীন বার্তার পরে বিভিন্ন দিনে ভেরলেইনের হেমন্তের সঙ্গীত কবিতার প্রথম দুটি পংক্তি পাঠ করা হবে। প্রথমটি মিত্র শক্তির আসন্ন ল্যান্ডিঙের ইঙ্গিত; সেটি শুনলেই তাঁরা শুরু করবেন সাবোতাজ– রেল লাইন উপড়ে দেওয়া, ফোন লাইন কাটা, ব্রিজ ওড়ানো।
পয়লা জুন ‘বেহালার সুর যেন হেমন্তের দীর্ঘশ্বাস ‘ রেজিসতঁসকে দিলো প্রস্তুতির সঙ্কেত।৫ই জুন রাত সোয়া এগারোটায় শোনা গেল ‘ তার ক্লান্তিকর সুর আমার হৃদয়কে বিদ্ধ করে ‘ - আক্রমণ শুরু হবে আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতরে।
ছয়ই জুন সকাল সাড়ে নটায় এলো সবশেষের মেসেজ ; জনের গোঁফ লম্বা ( Jean a de longues moustache): আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে।
পোর্টসমাউথ, সাউদামপটনের বিশাল ফ্লোটিলা সবে মাত্র যাত্রা শুরু করেছে, তখন; পাঁচই জুনের রাত সাড়ে বারোটায় একশো একাশি জন ব্রিটিশ সৈন্য ছটি গ্লাইডারের ভরসায় নামলেন অরন নদী এবং কঁ কানাল ব্রিজের চল্লিশ গজের ভেতরে; উদ্দেশ্য সেতু দুটি দখল করে নিকটবর্তী কঁ শহর থেকে নরম্যানডি বিচের সাপ্লাই রুট বন্ধ করা।সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত জার্মান রক্ষী বাহিনীকে মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে নাস্তা নাবুদ করে চার বছরের নাৎসি অধিকৃত ফরাসি ভূখণ্ডে মিত্রশক্তির প্রথম পতাকা উত্তোলন। সরাসরি আক্রমণ- নরম্যানডি ল্যান্ডিং ঘটবে চার ঘণ্টা বাদে ; পেগাসুস গ্লাইডারে তাঁরা নেমেছিলেন বলে বেনোভিলের সেই সেতুর নাম আজ পেগাসুস ব্রিজ।


খুব সকালের আবছা আলোয় পেগাসুস ব্রিজের ফলকটির সামনে দাঁড়িয়ে ভাববার চেষ্টা করলাম, গভীর রাতের অন্ধকারে এঁরা নামলেন গ্লাইডারে চড়ে, ঠিক এই ব্রিজের কাছে, কিসের ভরসায়? আকাশ থেকে নামাটা ছিল এতো নিখুঁত? দূর দূর পর্যন্ত শত্রু এলাকা, জার্মান ট্যাঙ্ক, এস এস ; মাথার ওপরে নেই রয়্যাল এয়ার ফোরসের ছত্রছায়া। ব্রিজ যদিও বা দখল করা গেল,, কতক্ষণ সেই বুঁদির কেল্লা রক্ষা করা যাবে? সমুদ্র তীর হতে আসবে এক বিশাল ফোর্স কিন্তু তারা পৌঁছুবে কখন? আসবেই যে তার নিশ্চয়তা কোথায়? এই কজন কুম্ভ ঠেকিয়ে রাখলেন জার্মান আক্রমণ? ছোট্ট একটি ব্রিজ দখলের লড়াইয়ে প্রাণ দিলেন তিন নম্বর গ্লাইডারের লিডার অক্সফোরড লাইট ইনফ্যান্ট্রির ডেন ব্রাদারিজ, নরমানডি যুদ্ধের প্রথম শহীদ। এখানে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্যটি ভাবতে গিয়ে, তাঁদের অপরিসীম সাহসের কথা ভাবলে বাক্য হারিয়ে যায়।
কানালের ওপারে একটি কাফে ‘পেগাসাস ব্রিজ কাফে – গনডাই’, তার গায়ে লেখা ‘অধিকৃত ফ্রান্সের প্রথম মুক্ত বাসভবন’। আগস্ট মাসের সকালে একটা আবছা আলোয় সবটাই যেন এক সুররিয়ালিস্টিক ছবির মতন মনে হল।

লন্ডনে ওয়ার অফিসের ড্রইং টেবিলে ছড়ানো ম্যাপে মিলিটারি স্ট্রাটেজিস্টরা লাল নীল পেন্সিল দিয়ে হয়তো চিহ্নিত করেছিলেন এই ছোট্ট সেতু দুটি; এদের দখল পেলে পরবর্তী লক্ষ্য হবে কালভাদোস অঞ্চলের সদর, মাত্র পনেরো কিলোমিটার পূর্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর কঁ। (আমার গাড়িতে লাগলো দশ মিনিট) সেখান থেকে স্বস্তিকার ঝাণ্ডা নির্মূল করতে পারলেই দুশো কিলোমিটার দূরের প্যারিসের পথ উন্মুক্ত।
এল আলামেনের বিজয়ী যোদ্ধা, ব্রিটিশ কমান্ডার বার্নার্ড মণ্টগোমেরি বলেছিলেন, দিন দুয়েকের লড়াই। তারপর বড়জোর মাস খানেকে প্যারিস।
কঁ: শান্তির জন্য শহীদ
প্যারিস নাতসিমুক্ত হয় ২৫শে আগস্ট।




নরমানডি বিচকে শত্রুমুক্ত করে দেশের অভ্যন্তরে ঢোকার লড়াই চলেছিল আড়াই মাস। হতাহত অগুণতি। তিক্ত সত্য এই যে নরমানডি তট থেকে মাত্র পনেরো কিলো মিটার দূরের কঁ শহর কবজা করতেই মিত্র শক্তির লেগেছিল এক মাস। মিত্র পক্ষে চার হাজার, জার্মান পক্ষে অন্তত পাঁচ হাজার মৃত। হিটলারের একান্ত অনুগত এস এস ট্রুপ, হিটলার ইউগেনড (যুববাহিনী) শহরে থাবা গেড়ে বসেছিল প্রতিটি বাড়ির, গিরজের দেওয়ালের আনাচে কানাচে; রক্ষা করছিল প্রতি ইঞ্চি জমি। শহরের দখল নিতে গেলে গলি থেকে গলি, বাড়ির পর বাড়ির জন্য লড়াইয়ে অজস্র লোকক্ষয়, গুলি বারুদের অপচয়। কঁ-কে পাশ কাটিয়েও যাওয়া যায় না, শত্রু তাহলে থাকে আগে এবং পিছে! শহর দখল করা যায় কি ভাবে? তখন কিছু এরিয়াল সার্ভে দ্বারা স্থির হল এস এস বাহিনীর সম্ভাব্য অবস্থানের ওপরে বোমা ফেলে ইঁদুরের গর্ত হতে তাদের টেনে বের করা হবে। সোর্ড এবং জুনো বিচ থেকে আসা কানাডিয়ান এবং ব্রিটিশ বিমান পুরনো শহরের কেন্দ্রে সেই হাওয়াই অভিযান শুরু করে – প্রথম দশ দিনে সাত হাজার টন বোমা এবং আড়াই লক্ষ শেল বর্ষিত হয় শহর কলকাতার দশ ভাগের এক ভাগ, মাত্র পঁচিশ বর্গ কিলো মিটারের এই জনপদের ওপরে। ফলে আশি শতাংশ বাড়ি ঘর বিধ্বস্ত - সে বোমা বা শেল খুঁজে পেতে কেবল যে হিটলার ইউগেনডের মাথায় পড়েছে তা নয়, ঘনবসতিপূর্ণ শহরে বেশির ভাগ আহত ও নিহত হয়েছেন নিরীহ নাগরিক। ষাট হাজার শহরবাসীর মধ্যে তিন হাজার এই বন্ধুশক্তির বোমা আক্রমণে (আজকাল এর নতুন নাম ফ্রেন্ডলি ফায়ার) প্রাণ হারান, হাজার দশেক আহত, পঁয়ত্রিশ হাজার গৃহহারা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দু’বছর ব্রিটিশ বা জার্মান হাওয়াই জাহাজ কেবল সামরিক লক্ষ বস্তুর ওপরে আক্রমণ সীমিত রেখেছিল – লুফতওয়াফের কভেনট্রি বম্বিঙ্গের পরে সে রকম কোন লজিক আর রইল না (বার্লিনের কাইজার ভিলহেলম গেদেখটনিস গিরজের মতন কভেন্ট্রি ক্যাথিড্রাল আজও অস্ত্রলেখার সাক্ষ্য বহন করে)। সামরিক বেসামরিক বাছ বিচার না করে যে কোন শত্রু শহরে আকাশি অভিযান দ্বারা ত্রাস সঞ্চার হয়ে দাঁড়াল একটি ট্র্যাডিশনাল যুদ্ধরীতি- যেমন ১৯৪৩ সালের জুলাইয়ের তিনটি রাতে হামবুর্গে অগ্নিঝঞ্ঝায় (ফয়ার স্টুরম); পঁয়তাল্লিশ হাজার নাগরিক প্রাণ হারান। কিন্তু বিদেশি প্লেন নয়, কঁ শহরের আকাশে বোমা ফেললেন মিত্রশক্তি যারা ফ্রান্সকে মুক্ত করতে এসেছিলেন, সাধারণ ফরাসি নাগরিককে জীবন থেকে মুক্তি দিতে নয়। ভাগ্যের পরিহাসে স্বাধীনতাকামী অজস্র নিরীহ ফরাসি প্রাণ দিলেন মুক্তিদাতারই হাতে।
পথের পাশে এখানে ওখানে গতকালের ও আজকের সাদা কালো ছবি পাশাপাশি টাঙ্গানো আছে, মিলিয়ে দেখে নিতে পারেন। ঠিক যেমনটা দেখেছি একদিন নুরেমবের্গে। ইসাবেলার কন্যা সোফিয়া, আমাদের মায়া গ্রীষ্মের এই প্রসন্ন দিনে ছুটোছুটি করে, কঁ কাসলের পাকদণ্ডি বেয়ে দৌড়ে নেমে আসে, ঐ তো সঁ পিয়ের গিরজের উন্নত শির যা মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল একদিন।



আজ নতুন দিন।
একদিন হয়তো তারা জানবে আরেক দিনের কথা।
২১শে জুলাই কঁ শহর সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত, জানলায় জানলায় ত্রি কলরে ফরাসি পতাকা উড়ছে, জার্মান বাহিনী পিছিয়ে গেছে পুব দিকে। বিজয়ী ব্রিটিশ কানাডিয়ান সৈন্য শহরে ঢুকলেন, তাঁদের প্রথম কাজ – মিত্রশক্তির বিমানের বোমায় বিধ্বস্ত কঁ শহরের ইট পাথর সরিয়ে রাস্তা খুঁজে নেওয়া।
এক ব্রিটিশ সংবাদদাতা লিখেছিলেন
প্রত্যেক দিন কঁ শহরের মধ্য দিয়ে জিপে চড়ে অরন ফ্রন্ট যাওয়ার সময় লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায়। এই শহরের মানুষ কি কখনো বুঝতে, মানতে পারবে কেন আমরা এমন বর্বরতা তাদের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছিলাম? প্রত্যেক দিন দেখি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে আরও একজনের মৃতদেহ টেনে বের করা হচ্ছে।
(ডেলি মেল, ২২ শে জুলাই, ১৯৪৪ )
কঁ মুক্ত। এবার জীবন যাত্রা সচল করার কাজ শুরু। ব্রিটিশ রয়্যাল এঞ্জিনিয়ারসের টম স্প্রিঙ্গেট একটি গিরজের পাশে শহরের পয়ঃপ্রণালী মেরামত করতে গিয়ে পরের পর একাশি জন সন্ন্যাসিনীর মৃতদেহ টেনে তুলেছিলেন ড্রেনের ভেতর থেকে।। তাঁর পুত্র টোনি লিখেছেন বাড়িতে কেউ কখনো কঁ নামটি উচ্চারণ করলে তাঁর বাবা চুপ করে যেতেন।
ফ্রান্সের মুক্তির ছ মাস বাদে কঁ থেকে অন্দ্রে আইন্তস এডিনবরা আসেন ফ্রেঞ্চ পড়াতে। তিনি লক্ষ করলেন একজন যুবক তাঁর ক্লাসে কিছুতেই মুখ তুলে কথা বলে না; একদিন অন্দ্রে এর কারণ জানতে চাইলেন। সেই যুবক বললেন, নরমানডি লড়াইয়ের সময়ে তার দায়িত্ব ছিল কঁ শহরের এরিয়াল ম্যাপ দেখে স্থির করা কোথায় কোথায় জার্মানরা নতুন রাস্তা বানাচ্ছে, সেই মত বোমা ফেলা হবে। অজস্র বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর জন্য সে নিজেকেই দায়ী মনে করে। অন্দ্রে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন তবু আপনারা আরও অনেক কঠিন নিপীড়ন থেকে আমাদের মুক্ত করেছিলেন।

কানাডিয়ান সৈন্যবাহিনী
কানাডিয়ান কুইনস ওন রাইফেলসের জন বাস কারো কাছে কখনো বিশ্বযুদ্ধের গল্প করতেন না। তাঁর পুত্র লিখেছেন, প্রসঙ্গ উঠলে কেবল বলতেন আমি কঁ-তে ছিলাম। এর পর নিশ্চুপ। দু বছরের গোটা লড়াই নিয়ে কেবল একটি বাক্য।
মঠের মাথায় ও হাসপাতালের ছাতে অনেকগুলি বিছানার সাদা চাদর জুড়ে তার ওপরে মানুষের রক্ত দিয়ে রেড ক্রস এঁকে পতাকা টাঙ্গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই প্রাণে বাঁচেন, হয়তো ঐশ্বরিক করুণায়। কিছু মানুষ ভেবেছিলেন সেই অ্যাবিতে সমাহিত ১০৬৬ সালে ইংল্যান্ড বিজয়ী রাজা উইলিয়ামের সমাধির ওপরে ব্রিটিশ নিশ্চয় বোমা ফেলবে না! প্রচলিত লোকশ্রুতি অনুযায়ী উইলিয়ামের শেষ শয্যা বিঘ্নিত হলে রাজার মাথা থেকে ব্রিটিশ মুকুট খসে পড়বে।
মারি লুইসের ডায়েরি
৯ জুলাই ছত্রিশ ঘণ্টা একটানা বোমা বৃষ্টি চলল।
১১ জুলাই হয়তো গোটা কঁ শহর এবং তার মানুষজন সবাই মারা গেছেন।
১২ জুলাই রাস্তায় ভাঙ্গা রাইফেল, মেশিন গান, কানাডিয়ান ব্রিটিশ সৈন্যদের
খাদ্য রেশনের টিন দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। ফুটপাথের ধারে গোর দেবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে কে বা কারা, মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে কারো বুট পরা পা, হেলমেট। সবুজ ইউনিফর্ম পরা জার্মান সৈন্যের মৃতদেহের চার পাশে উড়ছে মাছি।
২১শে জুলাই কঁ শহর মুক্ত আজ। কোন মূল্যে?
যে কোন যুদ্ধেরই দুটো দিক, তিনটে গল্প থাকে।
কঁ শহর আপন শান্তির জন্য নিজেই শহীদ হয়েছিল।
ও কানাডা
দুনিয়ার সকল প্রকার অপ্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণে আমার আগ্রহ দুর্বার। কিন্তু এই নরমানডি যাত্রা সবার থেকে আলাদা; অনেকবার মনে করেছি ইউরোপের মুক্তির জন্য বহু দূর থেকে আসা অগণ্য মানুষের আত্মদানের এই চিত্রপটের সম্মানে যাব একদিন। এবার তার সঙ্গে যোগ হয়েছে একটি বিশেষ মাত্রা। রোদিকার বন্ধু ইসাবেলার বাস ভ্যাঙ্কুভার আইল্যান্ডের ছোট শহর ভিক্টোরিয়াতে। আই টি তার কাজের বিষয়, অবসরে কানাডিয়ান ইতিহাস চর্চা করে। ইউরোপে কানাডিয়ান যোদ্ধাদের পদচিহ্ন সন্ধানে তার নরমানডি আসা। পতিদেব কেন বা কেনেথের এতে কোন আগ্রহ নেই। সে সিয়াটল আর ভিক্টোরিয়ার মাঝের সমুদ্রে মেরিন বাইওলজি চর্চা করছে।
উটায় প্রথম সৈন্য জাহাজ পৌঁছুনোর এক ঘণ্টা বাদে কানাডিয়ান মেরিন নামে কুরসল -সুর -ম্যের বিচে। নরমানডি অভিযানে কানাডিয়ান সৈন্যসংখ্যা ছিল মাত্র বিশ হাজার, ব্রিটিশ আমেরিকান বহরের তুলনায় কনিষ্ঠতম কিন্তু দিনের শেষে সেই বাহিনী অন্যদের অনেক পিছনে ফেলে ঢুকে গেছে ফ্রান্সের বিশ কিলোমিটার অভ্যন্তরে, তাঁদের প্রথম পতাকা উড়েছে বেরনিয়ে-সুর- ম্যেরের যে বাড়িটির মাথায় তার নাম আজ ল্য মেজোঁ দে কানাদিয়াঁ, বা কানাডা হাউস। এ বিজয় এসেছিল বিপুল রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে। আনুপাতিক হিসেবে অন্য দেশের তুলনায় পাঁচ সপ্তাহব্যাপী নরমানডি লড়াইয়ে কানাডিয়ান মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ; জার্মানদের দ্বারা অসম্ভব সুরক্ষিত জুনো বিচে ল্যান্ডিং ক্রাফট থেকে নেমে হাঁটুজল পেরিয়ে বালুকাবেলা অবধি পৌঁছুতে কামানের গোলা ও সৈন্যের গুলিতে প্রথম হাজার জনের মধ্যে প্রাণ দেন চারশো কানাডিয়ান। আপন দেশের শান্ত নিরিবিলি অন্তহীন প্রেয়ারির প্রান্তর হতে ইউরোপের মুক্তির সংগ্রামের লড়াইয়ের শেষে কানাডা ফিরলেন না পাঁচ হাজার মানুষ, আরও তেরো হাজার আহত।
দুর্ভেদ্য কঁ শহর দখলের লড়াইতে তাঁদের অবদান বিরাট।


জুনো বিচে কানাডিয়ান স্মারক প্যাভিলিয়নের দেওয়ালে আছে ল্যান্ডিঙের ছবি, তাঁদের অসীম বীরত্বের গাথা। ওয়াশিংটনের ভিয়েতনাম মেমোরিয়াল দেওয়ালের মতন এখানে বাইরের কয়েকটি স্তম্ভে লেখা আছে আঠারো হাজার নাম।
অনতিদূরে বেনি-সুর- ম্যেরে কানাডিয়ান সমাধি ক্ষেত্র, সেখানে অনন্ত শয়নে শায়িত দু হাজার কানাডিয়ান সৈন্য, নয়টি সমাধিতে দুই ভাই পাশাপাশি। নির্মমতার কোন শেষ নেই, এই যুদ্ধে প্রথম চার দিনের মধ্যে নিহত হন টরোনটোর তিন ভাই; ইসাবেলা খুঁজে নিয়ে গেল তাঁদের সমাধিতে।

বেনি-সুর- ম্যেরে কানাডিয়ান সমাধি ক্ষেত্র
টরোনটোর ইয়র্ক টাউনশিপের ওয়েস্টলেক পরিবারের তিন ভাই, টমাস, আলবার্ট, জর্জ কানাডিয়ান সৈন্য বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ছয়ই জুন ল্যান্ডিং ক্রাফট থেকে নেমে বিচ পেরিয়ে আউথি গ্রাম দখলের লড়াইতে জার্মান স্নাইপারের গুলিতে মারা গেলেন ছোট ভাই জর্জ, বয়েস ২৩। কুইনস ওন রাইফেলসের টমাস ও আলবার্ট বিশ কিলোমিটার এগিয়ে গেছেন ফ্রান্সের ভেতরে, মেসনিল পাত্রিতে। আকস্মিক জার্মান আক্রমণে দু জনে মারা গেলেন একই দিনে, ১১ই জুন ১৯৪৪, টমাসের বয়েস ২৯, আলবার্ট ২৫। সেদিনের শেষে মেসনিল থেকে শেষ জার্মান সৈন্য বিতাড়িত হয়েছিল; জুনো বিচ থেকে মেসনিলের রাস্তাটির নাম রু দে লা দেলিভ্রান্দ ( আজাদি সড়ক )। বেনি -সুর - মেরে পাশাপাশি সমাহিত আছেন দু ভাই রাইফেল ম্যান টমাস লি ওয়েস্টলেক ( তৃতীয় প্লট সারি ডি ৭ ) এবং রাইফেল ম্যান আলবার্ট নরমান ওয়েস্টলেক ( তৃতীয় প্লট সারি ডি ৮ )।

টমাস, আলবার্ট, জর্জ ওয়েস্টলেক



একটু দূরে আট নম্বর প্লটের এফ সারির বারো নম্বর সমাধির ফলকে লেখা আছে ওয়েস্টলেক পরিবারের তরুণতম সদস্যের নাম:
বি /৬৩০১৮
জি. ওয়েস্টলেক
নর্থ নোভাস্কোশিয়া হাইল্যানডারস
৭ জুন ১৯৪৪
ইয়র্ক টাউনশিপের বাড়িতে প্রথম টেলিগ্রাম আসে জুনের মাঝামাঝি –টমাস, আলবার্ট ও জর্জ ওয়েস্টলেক নিখোঁজ। উনিশে জুলাই তিনটি বিভিন্ন টেলিগ্রামে আসে তিন ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ।
পরিবারের একমাত্র সান্ত্বনা – তিনজনের মরদেহের সন্ধান মেলে এবং বেনি-সুর-মেরে সমাধিস্থ করা হয়। রাজার আদেশে কোন লুণ্ঠনের উল্লাসে বা রাজ্য বিস্তার করতে নয়, এঁরা প্রাণ দিলেন ইউরোপের স্বাধীনতার জন্য। আত্মীয় অনাত্মীয় নির্বিশেষে আসেন সারা ইউরোপের মানুষ, দূর ভ্যাঙ্কুভার দ্বীপের ইসাবেলা ঘিউরিয়া, বা আমাদের মতন আরও দূর দেশের মানুষ এই সমাধিবেদীর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের স্মরণে ফেলেন দু ফোঁটা চোখের জল।
আমরা মৃত এখন
কদিন আগেও ছিলাম বেঁচে,
ভোরের আলোর ছোঁয়া পেয়েছি,
দেখেছি সূর্যাস্ত ;
ভালবেসেছি, ভালোবাসা পেয়েছি
আজ শুয়ে আছি এই ফ্ল্যানডারসের মাঠে।
জন ম্যাকরে
Chanson d’automne
Les sanglots longs
Des violons
De l’automne
Blessent mon coeur
D’une languer
Monotone
Paul Verlaine 1844-1896
dc | 2402:e280:2141:1e8:9dad:41d3:84df:***:*** | ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ২০:৩০735279
হীরেন সিংহরায় | ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১৭:৪৭735318
dc | 2402:3a80:411:2770:c5f2:7c46:caef:***:*** | ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১৮:২৬735322
হীরেন সিংহরায় | ২৮ অক্টোবর ২০২৫ ১৯:৪০735324