কেল্লায় দেখা অভয়ের সাথে
সূরজনগর শহর থেকে দুরে একান্তে তার অবস্থান। প্রচারের অভাব। এসব কারণেই হয়তো দু পাশে নদী বেষ্টিত অনুচ্চ লম্বাটে টিলার ওপর দ্বাদশ শতাব্দীর এই পেল্লায় কেল্লায় পর্যটক সমাগম খুব কম। জানুয়ারির এক আমুদে শীতের সকালে গিয়ে সেখানে ঘন্টা পাঁচেক কাটিয়েছিলাম। সেদিন কোনো দূরাগত পর্যটক দেখিনি। কয়েকটি অল্পবয়সী স্থানীয় ছেলে এসেছিল। আমার মতো ধীর লয়ে কেল্লার সবদিকে হেঁটে, সৌধের ভেতরে ঢুকে, আনাচে কানাচে ঘুরে, ছাদে উঠে চারদিক দেখে, কোথাও খানিক চুপ করে বসে, কিছুক্ষণ একজায়গায় প্লাস্টিক বিছিয়ে শুয়ে - সর্বতোভাবে এই প্রাচীন নির্জন কেল্লার ঝিমঝিমে মৌতাত সত্তায় শুষে নিতে তারা আসেনি। হয়তো আগেও এসেছে তারা। তাই কলবল করে দ্রুত পায়ে এদিক ওদিক খানিক ঘুরে জনা ছয়েকের সেই দলটি চলে যেতেই সেই বিশাল কেল্লা আবার ডুবে গেল নিঝুম স্তব্ধতায়।
চুপ করে একটি পাথরের বেঞ্চে বসে তাকিয়ে ছিলাম দুরে, নীচে নদীর দিকে। এমন শান্ত দৃশ্যে মন শান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। মগ্নতা ক্ষুন্ন হয় পিছন থেকে আসা প্রশ্নে:
- বাবুজী, ওদিকে আর কিছু দেখার আছে?
একটি স্থানীয় লোক। ভুবন সোম সিনেমায় শেখর চ্যাটার্জী রাজস্থানী স্টাইলে সাদা কুর্তা, পাজামা, পাগড়ি পরা এক গাড়োয়ানের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এ লোকটিরও প্রায় তেমনই পোষাক। ক্ষীণকায় চেহারা। বয়স পঞ্চাশের নীচেই হবে হয়তো। সাথে একটি বছর সতেরোর ছেলে।
- হ্যাঁ আছে তো, বড়া বুরুজ - ওটা দেখার মতো জায়গা।
- আপনি দেখে এসেছেন?
- না, একটু বাদে যাবো। ওটাই কেল্লার শেষ প্রান্ত। এই যে নদীটা দেখছেন - কেল্লার বাঁদিক থেকে এসে নদীটা ওখানে কেল্লাকে বেড় দিয়ে চলে গেছে ডানদিকে। খুব সুন্দর দৃশ্য - দেখে আসুন, ভালো লাগবে।
- আপনি তো এখনো ওদিকে যান নি বললেন, কী করে জানলেন?
মৃদু হেসে বলি - দুর থেকে বেড়াতে আসি এসব জায়গায়, তাই আসার আগে ম্যাপে একটু দেখে নি।
- আপনি কোথা থেকে আসছেন?
- কলকাতা।
- ক ল কা ত্তা! শুনা হ্যায় বহুত দুর - বংগাল মূলক মে - অতো দুর থেকে এসেছেন এই কেল্লা দেখতে!
- হ্যাঁ, আর আপনি? সঙ্গের ছেলেটি কে?
- আমি তো থাকি সূরজনগরেই। এ আমার ছেলে, চন্দ্রপুর গাঁও থেকে কদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে আমার কাছে। ওকে এই কেল্লা দেখাতেই এসেছি এখানে। আচ্ছা, বাবুজী, সুক্রিয়া, চল নির্মল, চলতে হ্যয় উধর - বলে লোকটি চলে যায়।
আমি তাকিয়ে থাকি ওদের যাওয়ার দিকে। লোকটির মুখের ফিচার একটু অন্যরকম - লম্বাটে মুখে চোখে পড়ার মতো দীর্ঘ চিবুক - চোখ দুটি সবাক। অল্পবয়সী ছেলেটি বয়স অনুপাতে অত্যন্ত গম্ভীর। গাঁও থেকে বাবার কাছে বেড়াতে এসেছে। তার মানে হয়তো তার বাবা সূরজনগরেই কোথাও কাজ করে - তাই চন্দ্রপুর গাঁয়ের বাড়ি, পরিবার ছেড়ে এখানে থাকে।
মুক্ত বন্দীশালাসেবার একাকী ভ্রমণপথে রাজস্থানের রতনপুর গিয়ে কদিন ছিলাম। সূরজনগর থেকে আরো দশ কিমি দুরে রতনপুর। সেদিন কেল্লা দেখে সন্ধ্যায় ফিরে গেছিলাম রতনপুর। পরদিন আবার গেছি সূরজনগর। এদিন শহরের মধ্যে একটি প্রাচীন প্যালেস, তার মধ্যে সংগ্ৰহালয় এই সব দেখার ইচ্ছা। সূরজনগর বাসস্ট্যান্ডে নেমে এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে প্রাচীন শহরের পথ ধরে যাচ্ছি।
- বাবুজী! আপ ইধর?
একটি হলুদ দোতলা বাড়ি। দেওয়ালে চার জায়গায় ছাদ থেকে বৃষ্টির জল নামার কালচে ছোপ। সামনে বড় টানা উঠোন। পাঁচিলে লোহার মেন গেটে তালা। পাশে লোক চলাচলের ছোট অর্ধবৃত্তাকার গেট খোলা। ওখানে দাঁড়িয়েই হাঁক দিয়েছে গতকাল কেল্লায় দেখা লোকটি। বাড়ির দেওয়ালে ও পাঁচিলে একটি আয়তক্ষেত্র লাল/নীল ত্রিভুজে বিভক্ত। পুলিশের চিহ্ন। তাতে সাদা অক্ষরে লেখা “
মুক্ত বন্দীশালা - সূরজনগর”। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ছবিতে দুটি জায়গাতেই লাল মাস্কিং করে দিয়েছি।
- আরে! আপনি? এখানে?
- আমি তো চার বছর ধরে এখানেই আছি।
- এই মুক্ত বন্দীশালায়! তার মানে? আপনি কি মুক্ত না বন্দী? গতকাল কেল্লায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন যে!
আমি রাস্তায় দাঁড়িয়েই কথা বলছিলাম। লোকটি বলে,
- বাবুজী আপনার তাড়া না থাকলে, আসুন না ভিতরে, একটু গপসপ করা যাক।
আমার তো এমন কিছু অভিজ্ঞতা সেবনের জন্য মন প্রাণ উন্মুখ হয়েই থাকে। পত্রপাঠ চলে যাই ভিতরে। তারপর যে বাস্তব জীবননাট্যর মুখবন্ধ দেখলাম, প্রাচীন সংগ্ৰহালয় দেখার তুলনায় তাও কম আকর্ষণীয় নয়।
জানলুম তার নাম - অভয় রাজ গুর্জর। ওটি বাস্তবিক একটি মুক্ত বন্দীশালা বা Open Prison. অভয়ের সাথে কথা বলে জানলাম ওটা রেগুলার প্রিজন নয়। ওখানে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বন্দীই আছেন। তাদের সবার ক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যাপার প্রায় একই রকম:
১. তারা সকলেই নরহত্যার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত।
২. কেউই টাকাপয়সার জন্য, পরিকল্পনা করে, নৃশংসভাবে বা বহু খুন করেনি। অর্থাৎ তারা কেউই পেশাদার খুনি নয়। একটাই খুন করে ফেলেছে দীর্ঘদিনের ছাইচাপা বঞ্চনা, রাগ বা হতাশার তাড়নায় আকস্মিক উত্তেজনার বশে। তাদের মধ্যে কেউ খুন করে পালিয়ে যায়নি। হয় থানায় আত্মসমর্পণ করেছে বা ধরা পড়ে আদালতে অপরাধ স্বীকার করেছে। তার ফলে অবশ্য তাদের অপরাধ মাফ হয়নি। দফা ৩০২ মাফ করার মতো গুনাহ নয়। কিন্তু তাদের অপরাধ Rarest of the rare crime বলেও গণ্য হয়নি। তাই তাদের মৃত্যুদণ্ডের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা হয়েছে।
৩. তাদের সবার কারাবাসকালে আচরণ ছিল শান্ত, ভদ্র। সশ্রম কারাদণ্ড বলে, যা কাজ করতে বলা হয়েছে মন দিয়ে করেছে। জেলের মধ্যে কখনো কোনো উটকো ঝামেলায় জড়ায় নি। ক্ষণিকের উত্তেজনায় নরহত্যার মতো মারাত্মক অপরাধ করে ফেলে তাদের অনেকের মধ্যে পরে দেখা গেছে অনুশোচনা।
৪. ১০ বছর জেলে কাটানোর পর এদের সবাই সরকারের কাছে ক্ষমাভিক্ষার আবেদন করেছে। আবেদন করলেই মঞ্জুর হবে তার কোনো মানে নেই। তবে এদের ক্ষেত্রে মঞ্জুর হওয়াতেই পুরোদস্তুর জেল থেকে এরা এই মুক্ত বন্দীশালায় স্থানান্তরিত হয়েছে। পুরোপুরি মুক্তি পাওয়ার আগে এখানেও তাদের চার পাঁচ বছর থাকতে হবে। দেখা হবে তাদের সাজা মাফ করে দেওয়া যায় কিনা। এসব সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
আদর্শ কারাগার
নীতিগতভাবে বিচারব্যবস্থার উদ্দেশ্য শাস্তি যেন অপরাধের সমানুপাতিক হয়। তেমনি কারাগারের উদ্দেশ্যও হওয়া উচিত অপরাধীর চিত্তশুদ্ধি করে তাকে পরিবার ও সমাজের মূল স্রোতে ফেরৎ পাঠানো। কিছু ব্যতিক্রমী পরিস্থিতি ছাড়া তাকে আমৃত্যু বন্দী করে রাখাটা সরকারের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত নয়। রাষ্ট্র কর্তৃক অপরাধীর স্বাধীনতা হরণই যথেষ্ট শাস্তি। তার ওপর নানা উপায়ে কারাগার যেন শাস্তিপ্রদাণের উপায় না হয়ে দাঁড়ায়। বরং সেটি হওয়া উচিত সংশোধনাগার। মেয়াদ অন্তে মুক্তি পেয়ে সে তার অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে ভাগ করলে তারা হয়তো উপলব্ধি করতে পারে যে প্রিয়জনের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার হারিয়ে দীর্ঘ বন্দীজীবন কাটানোর যন্ত্রণা। হয়তো তার অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অন্যেরা এমন অপরাধ করার আগে দুবার ভাববে, সংযত হতে পারে।
তবে এমন আশাবাদী ভাবনা বাস্তবায়িত নাও হতে পারে। কারণ কিছু মানুষ অন্যের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সংযত আচরণ করে। কেউ ঠেকে শেখে। তবে অধিকাংশ মানুষ পরিচিতজনের বা নিজের - কারুর ভুল থেকেই শেখে না। তাই সমাজে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হয়ে চলে। সাধারণ মানুষের নরহত্যার মতো অপরাধ করে ফেলার ক্ষেত্রে বড় কারণ দীর্ঘদিনের অবরুদ্ধ আবেগের তাৎক্ষণিক উত্তেজনা। তা ভেবে চিন্তে হয় না। তাই ক্ষণিকের গুরুতর অপরাধেও তাকে আমৃত্যু জেলে আটকে রাখা উচিত নয়। মাঝে প্যারোলে কদিন ছাড়া পেয়ে পালিয়ে না গেলে বা ছাড়া পেয়ে আবার অপরাধ না করলে বেশ কিছু বছর বন্দীজীবন কাটানোর পর তাদের মুক্তি দেওয়া যেতেই পারে।
পৃথিবীর কিছু দেশে কারাবন্দীদের দাম্পত্য সাক্ষাৎকারের (conjugal visit) ব্যবস্থা আছে। দীর্ঘ কারাবাসে দণ্ডিত অপরাধীরা নির্দিষ্ট সময় অন্তর তাদের আইনত স্ত্রী বা স্বামীর সাথে দুই থেকে তিন দিনের জন্য (কোথাও আবার এক সপ্তাহ অবধি) একান্তে মিলিত হতে পারে। তার জন্য জেলের মধ্যে বা বাইরে আছে নির্ধারিত ঘর। দুজনের জন্য সেখানে থাকবে ছোট কিচেন ও রেশন যাতে তারা নিজেরাই কিছু বানিয়ে খেতে পারে। ফলে ঐ কদিন খাবার দেওয়ার কর্মচারীও তাদের প্রাইভেসি ডিসটার্ব করবে না। ঘরে থাকবে পরিপাটি বিছানা, চাদর, তোয়ালে, সাবান, লুব্রিকেন্ট এবং অবশ্যই কনডোম। শেষোক্ত বস্তু দুটি মিলিত হতে আসা সঙ্গী বা সঙ্গিনীও তাদের পছন্দ মতো আনতে পারে।
মেক্সিকো, কানাডা, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্কের মতো দেশ - যেখানে মানুষের কিছু মৌলিক মানবাধিকার স্বীকার ও সম্মান করা হয় - সেখানে বিবাহিত বন্দীর এটি মৌলিক অধিকার। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায় সমগ্ৰ দেশে না হলেও কিছু প্রদেশে তা অনুমোদিত। আবার ইউকে, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, জাপানের মতো দেশে বন্দীদের দাম্পত্য সাক্ষাৎকার অনুমোদিত নয়। তাদের ধারণা যখন কেউ অপরাধ করে জেলে আসে সে বাকি নাগরিকদের মতো মৌলিক অধিকার হারায়।
বিপজ্জনক অপরাধীর কথা আলাদা
তবে অপরাধী মানসিকতার (Criminal mindset), স্বভাব অপরাধী (Habitual offender) বা অপরিণামদর্শী প্রতিক্রিয়াপ্রবণ অপরাধীরা (Highly impulsive, psychotic mentality) এবং যাদের মনে অনুশোচনার (Remorseful) কোনো ভাবনাই আসে না তারা সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। এমন অপরাধীদের ক্ষেত্রে আজীবন কারাবাসই প্রযোজ্য।
তিনটি উদাহরণ নেওয়া যাক।
(ক্রমশ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।