- তিনি কী আমাকে ভুলে গেছেন? এখান থেকে যাবার পর আর কোন সংবাদ পাঠালেন না ৷
ঋষি গৌতম খুব অন্যমনষ্ক থাকেন ৷ কোন কাজে মনসংযোগ করতে পারেন না৷ কেন এমন হয়েছে তা তিনি বুঝতেই পারছিলেন না৷ আশ্রমের চারিদিকে বসন্তের রঙ লেগে যায় ৷ গাছে গাছে পাখিরা কলরব করে৷ হাওয়ার রঙ বদলায়৷ ঋষি গৌতম তাঁর আশ্রমের মাথার চাল মেরামত করছিলেন। তাঁর দিন কাটে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে। তাঁর পক্ষে পিছনের ছায়া দেখা সম্ভবপর নয়৷ এমন সময় ঋষি নারদের আগমন ঘটে। ঋষি গৌতম একটুও আশ্চর্য্য হলেন না নারদকে দেখে। তাঁরা একসাথে কাজ করেছেন ধর্মসূত্র নিয়ে এবং গৌতম জানেন ঋষির আগমনের সম্ভাব্যতা৷ নারদের চরিত্র ভীষণই অকল্পনীয়! সঠিক সময়ে সঠিক স্থানে উপস্থিত হন তিনি৷
-ওহ সাংবাদিক! কী সংবাদ এনেছেন আজ? নতুন কিছু ঘটেছে নাকি?
মিচকি হেসে তাকিয়ে থাকেন নারদ৷ তিনি চিরযুবক,মাথার কেশের রঙ হালকা কালো,মুখ সর্বদাই ভয়ার্ত৷ তিনি খুব সহজে চলাফেরা করতে পারেন এবং তাঁর মুখ দেখে চিন্তায় পড়ে যান ঋষি গৌতম৷ ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা যায় নারদের মুখে।
-সুতরাং আপনি সম্মত হলেন আমি সাংবাদিক!
- অবশ্যই! আপনাকে সবাই স্বর্গীয় বার্তাবাহক বলে চেনেন৷ আপনি গুজবের থেকে সঠিক সংবাদ আহরণ করে পরিবেশন করেন৷
গৌতম কথাগুলো বলার সময় উচ্চকণ্ঠে হেসে ফেলেন৷ পুরনো বন্ধুকে দেখে তাঁর ভালোই লাগে৷
জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নারদ গৌতমের দিকে তাকান এবং বড় কিছুর উত্তর আশা করেন৷
-আমি একজন সাংবাদিক। আগে আমি পর্যবেক্ষণ করি,তারপর লিখি এবং তারপর জানাই। কোথায় কী ঘটছে তা আমি দেখে রাখি। আর ইহা সত্যই বলেছেন আমি সঠিক সংবাদ প্রেরণ করি আমার বন্ধুদের।
-অবশ্যই৷ তবে শুধুমাত্র তথ্যই নয় আরো অনেক কিছু প্রেরণ করেন আপনি।
-আপনি বলুন আজ কি ঘটেছে? আপনার আগমনের হেতু কী!
-সবথেকে বড় সংবাদ হল অহল্যার স্বয়ম্বর।
উচ্ছ্বসের সাথে নারদ জানান। এ সংবাদ শোনামাত্রই গৌতম স্তব্ধ হয়ে যান এবং তাঁর হাসি মিলিয়ে যায়৷ হাতের কাজ বন্ধ করে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন গৌতম৷ আর উত্তর দিতে পারেন না। তিনি আশ্রমের ছাদ থেকে লাফিয়ে নিচে নামেন এবং তাঁর বন্ধুর পাশে আসেন৷ নারদ কিছুটা অবাক হন গৌতমের অবস্থা দেখে৷ তিনি লক্ষ্য করেন গত সাক্ষাতের পর থেকে এই সাক্ষাৎ সময়ে তাঁকে যেন বেশী ধূসর লাগে৷ তাঁকে আরও নমনীয় লাগে।
নারদ ঋষি গৌতমকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন৷
-আপনার মনে পড়ে অহল্যার কথা? নাকি ভুলে গেছেন?
নারদ প্রশ্ন করেন তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে৷
-যিনি এখানে বিদ্যালাভ করেছেন আমি তাঁর কথা বলছি ঋষি গৌতম৷ আপনি বুঝতে পারছেন না? আপনি তাঁর গুরু ছিলেন তাই না?
নারদ প্রশ্ন করেন গৌতমকে৷
-না তিনি এখানে আমার আশ্রয়ে ছিলেন৷ আমি তাঁর গুরু ছিলাম না৷
গৌতম তাঁর ভুল ধরিয়ে দেন৷
-তিনি আমার ছাত্রী নন৷
-যতই আপনি তাঁর গুরু নন বলেন, একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই গৌতম।ইহা সত্য আপনি তাঁর গুরু৷ যখন আপনাকে তাঁর প্রয়োজন ছিল তখনই আপনি তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলেন! কেন? কেন এমন করলেন?
নারদ এ কথা বলাতে ঋষির মুখ আরো ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং তিনি মন্দিরের দিকে তাকিয়ে থাকেন৷ অস্থির হয়ে পড়েন ৷ একটা কালো ছায়া বিস্তৃত হয় অর্ধেক মুখে তাঁর৷
সুতরাং অহল্যার শীঘ্র বিবাহ হতে চলেছে৷ নারদ আরও বলেন
-এই বিবাহ শতাব্দীর সেরা বিবাহ হতে চলেছে৷ আর হবে নাই বা কেন-তিনি এই দেশের সবথেকে সুন্দরী রাজকন্যা।
নারদ দেখেন তাঁর বন্ধুর মাথা ক্রমশ হেঁট হয়ে যায় কিন্তু মুখের কোনো পরিবর্তন হয় না। গৌতমের মনে পড়ে যায় সেই সব দিনগুলোর কথা৷ যখন জলের শিৎকার তাঁর শরীরকে স্পর্শ করত ৷ তিনি বনফুলের মৌমাছির ন্যায় বিচরণ করতেন এ দিক ওদিক। চারিদিকে গুঞ্জন করত কীট পতঙ্গের দল তাঁর পদস্পর্শে৷ তাঁর কথা বলা, হেঁটে যাওয়া , গুরুকে অনুসরণ করা সব মনে পড়ে যায়৷ তখন বলেন নারদ
-অতীতে ভগবান ব্রহ্মা কিছু সুন্দরী নারী সৃষ্টি করেছেন তাঁর মধ্যে অহল্যা অন্যতম। তিনি ব্রহ্মার আশীর্বাদধন্যা। তাঁকে নিয়ে অপ্সরা উর্বসীর খুবই হিংসা৷ তিনি তাঁর রূপের কদর করেন মনে মনে কিন্তু প্রকাশ করেন না৷
নারদের গলায় শ্লেষ ধরা পড়ে৷ ফিসফিস করে তিনি বলেন
-সত্যিই কী তিনি সুন্দরী গৌতম? আমি তাঁকে দেখিনি কখনও...
নারদর গলার স্বর পরিবর্তিত হয়৷ নারদ গৌতমের কাছে অনেক কিছু জানতে চান তা বুঝতে পারেন তিনি৷
-সত্যিই কী তিনি অপরূপা! সবাই একথা কেন বলেন গৌতম? আপনার কী সত্যই তা মনে হয়
-হ্যাঁ, সঠিক বলেন সবাই৷
গৌতম বলেন কিছুটা রুষ্ঠ ভাবে।
-এবং তিনি সত্যই মেধাবী, আপনি সে কথা আগেই বলেছেন।
গৌতম পায়ে একটি ছোট কাষ্ঠখণ্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং নারদকে দেখতে থাকেন চোখ বড় বড় করে৷
-আমার মনে হয় আপনি এখানে এসেছেন ধর্মসূত্র নিয়ে কাজের ব্যপারে৷ আমরা সেই বিষয় নিয়েই কথা বলি?
তিনি একথা বলেন যাতে নারদ আর অন্য কথোপকথন শুরু করতে না পারেন৷
-শেষবার সাক্ষাতের সময় আমরা পর্যালোচনা করেছিলাম তথ্যসূত্র নিয়ে৷ আমরা আলোচনা করেছিলাম সামাজিক আইন এবং অপরাধিদের আইন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে৷
-ইহা আপনার বিষয়।
নারদ বলেনন ঋষি গৌতমকে তাঁর হাত থেকে বীনা নিচে নামিয়ে৷
-আমি বেশি আগ্রহী এই সূত্রগুলোকে বাস্তবে রূপদান করার ক্ষেত্রে৷ এই আইনগুলি কতটা কার্যকরী হবে তা দেখার জন্য৷
-কিন্তু এই শব্দগুলো পড়ার ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধা হতে পারে৷ কারণ সেখানে বিস্তারিত ভাবে তেমন বলা নেই৷
গৌতম ধীরে ধীরে বলেন৷
-প্রিয় বন্ধু আমাদের এই কার্যবিবরণী যাঁরা পড়বেন তাঁরা প্রত্যেকেই মেধাবী৷
নারদ বলেন হাত জোড় করে খরতাল বাজাতে বাজাতে৷
-আমি অসম্মত হলাম।
গৌতম বলেন।
-অস্পষ্টতা অর্থ জ্ঞানী হওয়া নয়৷ পাঠক এবং লেখকের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা জরুরী৷ এই নিয়ে কোনো তর্ক থাকা উচিত নয়৷
-আমার মনে হয় আপনি এখনও জানেন না আমি কি কাজ করেছি৷
নারদ বলেন৷
-আমি একটি প্রশ্ন আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই৷ এই সূত্রগুলো কিভাবে মানুষ জীবনে প্রয়োগ করবে এবং সমাজ উপকৃত হবে৷ এই সম্পর্কে আপনার কোন মতামত আছে? ভালবাসা আর বিবাহ নিয়ে কোন আইন আছে?
নারদ বিদ্রুপ করেন। তাঁর চোখে রসিকতা ধরা পড়ে।
-কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন এর বৃত্তান্ত... আপনি কোনদিন ভালোবেসেছেন কাউকে কিংবা প্রেমে পড়েছেন কখনও?
-সতর্ক হন৷ আপনাকে খুব সুবিধার মনে হচ্ছে না আমার ৷
গৌতম জানান৷
-আমি খুবই সতর্ক।
নারদ বলেন গৌতমের কথার প্রত্যুওরে৷
-আমি আপনাকে বড় এক সংবাদ জানালাম! সবাই তা নিয়ে বলাবলি করছেন... অহল্যার বিবাহের স্বয়ম্বর এবং ইন্দ্র সেই স্বয়ম্বরে অবশ্যম্ভাবীরূপে জয়ী হতে চলেছেন। ইন্দ্র তাঁর ভ্রাতার নিকটতম বন্ধু।
তাতে?
গৌতম অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন৷
-যদিও ইন্দ্র আমার খুব প্রিয় ধনুর্বিদ৷
নারদ বলেন৷
-আমি শুনেছি রানী নল্যানী অর্থাৎ অহল্যা'র মাতা তাঁকে খুবই ভালোবাসেন। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে সব রাজা এবং ঋষিগণ তাঁর বিরুদ্ধে বলে চলেছেন৷
গৌতম স্তব্ধ হন৷ তাঁর মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ উতাল পাতাল করে৷
- এই স্বয়ম্বর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে চলেছে। সারা দেশ অপেক্ষা করছে এই স্বয়ম্বরকে দেখার জন্য।
-তাদের এই প্রার্থনা কি ভাবে আমাদের কাজে সাহায্য করবে বলবেন?
গৌতম নারদের কথায় বিরতি টানেন৷
-আপনি কেন এত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন গৌতম?
প্রশ্ন করেন নারদ।
-আমি আপনার কাছে জানতে চেয়েছি কৌতূহলবশত কারণ অহল্যা এই আশ্রমে শিক্ষা লাভ করতে এসেছিলেন এবং আমি শুনেছি তিনি আপনার খুব প্রিয় ছিলেন এবং আপনার উপর নির্ভরশীল ছিলেন৷ এই আশ্রমকে তিনি খুব ভালবাসতেন বলেই শুনেছি৷
নারদ রোদ এড়িয়ে দেখতে চান গৌতমের মুখ৷ সে মুখে ঘোর অন্ধকার৷
-আপনি তখন থেকে মূর্খের মত কথা বলে চলেছেন। আপনাকে আমি তখন বলেছি তিনি এখানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন,ছাত্রীরুপে নয়৷
ঋষিকে খুবই বিব্রত লাগে৷
-আপনি কাকে এত মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন?
নারদ মাথা নাড়িয়ে প্রশ্ন করেন৷ গৌতম স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন এবং কোন কথা বলার প্রয়োজন মনে করেন না৷
নারদ আবারও প্রশ্ন করেন
কি হয়েছে গৌতম?"
"শুনতে পাচ্ছেন কিছু? এই কান্না এক নবজাতক বাছুরের৷
গৌতম উত্তেজিতভাবে বলেন এবং তাঁর মুখে প্রশান্তি দেখা যায়৷ নারদ তাঁর বন্ধুর পিছন পিছন দেখতে যান সদ্যজাত বাছুরকে৷ ভোরের আলোর মত পবিত্র সে৷ গুরু তখন তাঁর সন্তান প্রসবের পর খুবই পরিশ্রান্ত৷ গৌতম মা এবং সন্তান উভয়কেই দেখেন৷ সুরভী এবং সন্তান দুজনই তাঁর আশ্রয়ে সুস্থ থাকে।
নারদ পা দুটি ভাঁজ করে হাত জোড় করে প্রার্থনা করেন তাঁদের দিকে তাকিয়ে৷ তারপর তিনি শিব মন্দিরের দিকে এগিয়ে যান৷ গৌতম শিবের উপাসক৷ আশ্রমে খুব সুন্দর মন্দির আছে৷ অহল্যা যখন এখানে থাকতেন প্রায়সই যেতেন সেখানে৷ হরেক রকম ফুল ফোটে চারিধারে৷
নারদ তাঁর বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দেখেন এবং হঠাৎ করে মাথায় এক মতলব এসে উপস্থিত হয়
-আপনি ভগবানের আশীর্বাদ পেলেন গৌতম।
তিনি বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলেন কথাগুলি৷
গৌতম লক্ষ্য করেন নারদের গলার স্বর হঠাৎই পরিবর্তিত হয়।
-আপনি জানেন আপনি কি করেছেন?
নারদ প্রশ্ন করেন গৌতমকে এবং তাঁর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে৷ গৌতম একথা শুনে উৎভ্রান্ত হন৷ তিনি কী করেছেন বুঝতেই পারেন না৷
-আপনি গরুর সন্তান প্রসব এবং শিবের উপাসনার দ্বারা ত্রিভুবন জয় করেছেন গৌতম।
-আমি এই কথা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে মনে করি৷
গৌতম নরম ভঙ্গিমায় বলেন এবং মা ও বাছুরের দিকে আবারও ফিরে তাকান।
- ইহা কম কথা নয় ...
-গৌতম, গৌতম!
উপলব্ধি করুন আপনি কি করেছেন।
নারদ আবারও বলেন। তাঁর গলায় উত্তেজনা দেখা যায়৷
-আপনি অনিচ্ছাকৃত ভাবেই অহল্যার স্বয়ম্বরে অংশগ্রহণ করেছেন গৌতম!
গৌতম মাথা তুলে তাঁর দিকে তাকান এবং এই প্রথমবার নারদকে বুদ্ধিভ্রষ্ট মত লাগে তাঁর৷
-আপনি ত্রিভুবন জয় করলেন গৌতম৷
নারদ আনন্দের সাথে জানান তাঁকে৷
- আপনি এক বাছুরের জন্ম প্রক্রিয়ায় থেকে ব্রহ্মা এবং রাজা মুদগলের প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করেছেন খুব স্বর্তস্ফূর্ত ভাবে। আপনি জানেন বেদমতে গরুর প্রসবের সময় উপস্থিত থাকলে তাঁকে ত্রিভুবন জয়ের সমান ধরা হয়৷ আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি এবং শ্রদ্ধার সাথে জানাচ্ছি আপনি স্বয়ম্বরের সমস্ত শর্ত পূরণ করেছেন অনিচ্ছাকৃতভাবে অথবা ইচ্ছাকৃত ভাবে৷
নারদ বলেন৷
তিনি আরও বলেন
-আমি জানি আপনি সর্বদা ভগবান ব্রহ্মার আশীর্বাদধন্য৷ তিনি আপনাকে খুব পছন্দ করেন এবং আপনার মধ্যে সর্বদা বুদ্ধিমত্তা দেখতে পান। আমার ধারণা তিনি অহল্যার জন্য হয়তো আপনাকেই নির্বাচন করে রেখেছেন৷ কে জানে! সময় বলবে সব৷
এক কালো ছায়া দেখা যায় গৌতমের মুখে৷ তাঁকে ক্ষুব্ধ দেখায় এবং তিনি গোয়ালঘরের থেকে বেরিয়ে আসেন। নারদ তাঁর পিছন পিছন
আসেন। তাঁর মুখে সর্বদাই থাকে এক গাল হাসি৷
-এত রেগে যাওয়ার কারণ কি ঋষি? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
আমি যা পর্যবেক্ষণ করেছি তাই জানালাম। আপনার একথা ভালো না লাগলে আমার কিছু করার নেই৷
- ইহা সম্পূর্ণ বন্যবিতর্ক।আপনি কি তা দেখেননি?
গর্জে ওঠেন গৌতম৷
-একজন মানুষ তাঁর কণ্ঠ আমার সাথে মেলাচ্ছেন না।তাঁর ভাবনাগুলো আলাদা বলেছেন।
নারদ নরম সুরে বোঝানোর চেষ্টা করেন নারদ৷
-আপনি কি পাগল হয়েছেন? এই রূপ কথোপকথন বন্ধ হোক৷
গৌতমের গলায় একরাশ বিরক্তি প্রকাশ পায়৷ নারদ বোঝেন তিনি তাঁর অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করতে চলেছেন।
নারদ স্থির করেন তিনি আর কিছুই বলবেন না৷
-শুধু আমি না!আপনিও পাগল হয়ে গেছেন৷
সাহসের সাথে বলেন নারদ।
-অহল্যা আশ্রম ছেড়ে দেওয়ার পর আপনি অত্যন্ত দুঃখী এবং উদাসী হয়ে পড়েছিলেন। আপনি কেন তা মানতে রাজি নন? আপনি অহল্যাকে ভালোবাসেন৷ আমি জানি৷ শুধু স্বীকার করছেন না ৷ কেন?
উদারচিত্তে নারদ বলে চলেন৷
-মূর্খের মত একে ভালোবাসা বলবেন না!
গৌতম কর্কশ গলায় শোনান৷
নারদ স্তব্ধ হয়ে যান। কি বলবেন বুঝতেই পারছিলেন না। তিনি মানতে চান না তিনি কিছু ভুল বলেছেন৷
গৌতম আর কোন কথাই শুনতে চান না৷ কিন্তু তিনি স্তব্ধ থাকতেও পারেন না। তাঁর হৃদয় দোলাচল ওঠে। তিনি নিজের অনুভূতি থেকে অহল্যাকে আলাদা করতে পারেন না৷
গৌতম নারদের করা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না৷ তিনি মনে মনে ভাবেন যদি সত্যিই তিনি অহল্যাকে ভালোবাসতেন তবে তাঁকে নিয়ে তাঁর মধ্যে কোন অনুভূতি থাকত৷ তাঁর সর্বদা ভয় ছিল অহল্যাকে নিয়ে। তাই হয়তো তিনি কোন অনুভুতিকে মনে আসতে দেননি।
অহল্যার মত সুন্দরীকে ভালো লাগবে না তা কখনও হতেই পারে না। তিনি সর্বদা অহল্যার সাথে জুড়ে থাকতেন৷ এই কথাগুলো জানলার ধারে বসে ভাবতে থাকেন গৌতমI নিজের সাথে কথা বলেন তিনি৷ হৃদয়ের কথা শুনতে চান৷ নিজের দিকে তাকান। হৃদয়ের কাছে প্রবেশ করেন।
অহল্যা তাঁকে বিদ্ধ করেছে৷ অহল্যা তাঁর মতই একজন মানুষ৷ তিনি এর আগে কোন নারীর সংস্পর্শে আসেননিI কাউকে ভালোবাসেননি ৷ কোন নারীর সাথে থাকেনি। কিন্তু তাঁর হৃদয় সংকুচিত হয়৷ মনে মনে প্রশ্ন করেন অহল্যা কী তাঁকে ভালোবাসেন?
আরেকটি প্রশ্ন তাঁর মনে আসে তিনি কি অহল্যার যোগ্য?
-আপনি একথা কেন মানতে অরাজি গৌতম?
নারদ বলেন৷
-কেন আপনি আপনার ভাগ্য মানতে চাইছেন না? ইন্দ্র নিজেকে সেরা ধনুর্বিদ মানতে পারেন এবং আপনি একমাত্র তাঁর যোগ্য প্রতিপক্ষ হবেন৷ আমার বিশ্বাস আপনি তাঁকে জয় করতে পারবেন৷ আপনি অহল্যাকে ভালোবাসেন।গৌতম যান তাঁকে বিবাহ করুন৷
গৌতম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে তাকিয়ে থাকেন শূন্যের দিকে৷ চারিদিকে বাতাস বয়ে যায়৷
-কিন্তু অহল্যা কি আমায় ভালবাসেন?
গৌতম প্রশ্ন করেন নিজেকে। নিজের ভাবসাগরে টিল ছোঁড়েন। তিনি একমাত্র যে তাঁর লম্বা কেশ, সরু কোমড়,উন্মুক্ত স্তন দেখেছেন৷ তাঁর জীবনে অহল্যার মত করে কেউই কাছে আসেননি৷ তাঁর মধ্যে দৃঢ়তা জাগে অহল্যাকে নিয়ে।
-এটা খুবই খারাপ বিষয় যে তিনি একজন রাজকন্যাকে ভালোবেসেছেন।
তিনি মনে মনে হাসেন৷
-তাছাড়া অহল্যা নিশ্চই ইন্দ্রের প্রতি অনুরক্ত। এক রাজকন্যা কেন এক ঋষিকে ভালবাসতে যাবেন! আপনি বলুন নারদ৷
-কেন আপনি ভেবে নিয়েছেন অহল্যা ইন্দ্রকে ভালবাসেন?
নারদ জানান
-অহল্যা খুবই বুদ্ধিমতি। তিনি বুদ্ধিমত্তাকেই অগ্রাধিকার দেবেন সৌন্দর্য্যের থেকে ইহা আমি নিশ্চিত৷
গৌতম নিজেকে যেন আয়নার মতো দেখতে পান৷ তিনি যতক্ষণ না অহল্যার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছেন না। অহল্যার সৌন্দর্য্য হল স্বর্গীয়৷ তাঁর কোন ব্যাখ্যা হয় না৷ অহল্যার বুদ্ধিমত্তা যেমনই প্রখর আর সৌন্দর্য্য অতুলনীয়। গৌতম নিজের কথা ভাবেন৷ কেন অহল্যা তাঁকে ভালবাসবেন সেই প্রশ্ন তাঁর গলায় কাঁটার মত বিঁধতে থাকে৷ চোখ বন্ধ করে দেখেন।তাঁর গড়ন অতিব অসাধারণ৷ অহল্যার সৌন্দর্য্যের পাশে যা একদমই বেমানান।কিন্তু তবুও তাঁর মনে আশা জাগে,তিনি ভাবেন যা স্বাভাবিক তাঁকে সহজভাবে মেনে নেওয়া শ্রেয়৷ নারদ তাঁর বন্ধুর মুখের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন৷ তিনি বুঝতে পারেন তাঁর মনে দ্বিধা,দ্বন্দ্ব কাজ করে চলছে৷ তিনি গৌতমকে পাঁচ বছরের অধিক চেনেন যখন থেকে তিনি আশ্রম তৈরি করেন৷ গৌতম তাঁকে নিয়োগ করেছিলেন আশ্রম গঠন করার ক্ষেত্রে৷ তাঁর বিশ্বাস,একাগ্রতা খুবই ছোঁয়াচে।তিনি নিজে যা বিশ্বাস করেন তা অন্যকে বিশ্বাস করিয়েই ছাড়েন। তারপর থেকেই তিনি তাঁর বন্ধু হয়ে ওঠেন৷ নারদ জানেন গৌতম যা করেন তাতেই সাফল্য পান৷ তাঁর মত কঠোর পরিশ্রম কেউ করতে পারবেন না বলে মনে করেন। নারদ জানেন গৌতম যতই দূরে থাকেন না কেন তিনি যদি কোন কাজে প্রবেশ করবেন মনে করেন সাফল্য পেয়েই থাকেন৷ নারদ দেখেছেন অতীতে কি ভাবে গৌতম আহার,নিদ্রা ত্যাগ করে কাজ করে গেছেন৷ নারদ জানেন গৌতমের ক্ষমতা৷ তাঁর আশাবাদী স্বভাব পরিচিত নারদের কাছে৷ তিনি গৌতমকে বলেন
-আপনার রাজা মুদগলের স্বয়ম্বরে অবশ্যই যাওয়া উচিত৷
-অনেক দেরি হয়ে গেছে৷আর সম্ভব নয়৷
গৌতম জানান।
-তিনি কোন পুরস্কার নয়,তিনি একজন নারী।
-আপনার এই কথাগুলো কাব্যিক মনে হয়!
নারদ বলেন
-দার্শনিক বলুন! এখন কোন যুক্তি খুঁজবেন না দয়া করে৷ হৃদয়ের কথা শুনুন। মনে কোন দ্বিধা রাখবেন না ঋষি৷
-আমি কী করে তাঁর সমস্ত ইচ্ছা পূরণ করব? আর কেনই বা অহল্যা আমাকে বিবাহ করার জন্য নির্বাচন করবেন? ইন্দ্রের মত সুদর্শন পুরুষকে ছেড়ে তিনি কেন আমায় বিবাহ করবেন?তিনি ভগবানের রাজা, আমি গরীব বৃদ্ধ৷
নারদ আবারও হাসেন তাঁর কথায়৷
-আপনি নিজেকে সুন্দর ভাবতে পারেন না কেন? আপনাকে সবাই চেনেন আপনার চিন্তা, ভাবনার জন্য৷ নারদ তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করেন।
-আমি দেখেছি ভালোবাসাকে দুর্বল হতে ইচ্ছার কাছে৷ এখানে আপনার ইচ্ছাকে দুর্বল লাগছে৷ আপনি কেন এমন ভাবছেন? আপনি কী ইন্দ্রকে হারানোর জন্য যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না?আপনার মনে হয় না আপনি থাকলে ইন্দ্র কোনভাবেই জিততে পারবেন না? নারদের দাবি না মানার ক্ষমতা তাঁর থাকে না৷ তিনি বন্ধুর কথা ফেলবেন কী ভাবে।
গৌতম কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাঁর মনে পড়ে যায় প্রথমদিন অহল্যাকে দেখার অনুভূতির কথা। কাজ করার সময় অহল্যার কথা মনে পড়ে৷ অহল্যা প্রতি মুহূর্তে কাজ করার সময় উতঙ্ককে অনুসরণ করতেন৷ অহল্যর শীর্ণ শরীরের কথা মনে পড়ে৷ অহল্যার কথা বলা, হেঁটে চলা,রান্না করার মুহূর্তের কথা মনে পড়ে তাঁর৷ তিনি চলে যাবার পর আশ্রম যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে৷ কোন শব্দ পাওয়া যায় না৷
অহল্যার সাথে সাক্ষাতের মুহূর্ত কেমন হবে মনে মনে ভাবেন তিনিI ওই বালিকার মধ্যে এমন কিছু আছে যা অন্যকে মুগ্ধ করতে পারে। তিনি যেন দেখতে পান অহল্যাকে৷ গৌতম নিজেকে সম্মানীত মনে করে তাঁর আশ্রমে অহল্যাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য৷ ওই নারী সর্বদা তাঁকে আকর্ষণ করেই গেছেন৷ তাঁর মত করে ভালবাসতে কেউ শেখাননি তাঁকে। তিনি সর্বদা চেষ্টা করে যাচ্ছেন অহল্যাকে কিভাবে রক্ষা করা যায়৷
-ঠিক আছে, আপনার কথায় সম্মত হলাম৷
গৌতমের জীবনের প্রথম ভালোবাসা অহল্যা৷ তিনি কখনই চাননি তাঁর দ্বারা কেউ আঘাত পাক৷ তাই তিনি দূরে রেখেছেন নিজেকে৷ গৌতম পূর্বে নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করেছেন৷ কিন্ত এখন তাঁর অনুভূতি সামনে চলে এসেছে। তিনি আর কোনো রকম জটিলতা চান না। অহল্যা চলে যাবার পর তাঁর মন খুবই শান্ত হয়ে যায়৷ তা অগ্রাহ্য করতে পারন না তিনি৷ গৌতম তাঁর ভাগ্যকে দেখতে পান৷ তিনি বোঝেন তাঁর ভাগ্যের সাথে অহল্যার ভাগ্য একসাথে বাধা। তিনি বোঝেন তাঁর পক্ষে ফেরা সম্ভব নয়।গৌতমের মনে আনন্দ হয় এমন সময় তাঁর বন্ধু তাঁর কাছে উপস্থিত হওয়ার জন্য৷ তিনি নারদের পাশে গিয়ে তাঁর হাত ধরেন৷
-আসলে ভয়, উৎকন্ঠার জন্য আমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি নারদ৷
২)
-কোন প্রতিযোগী কী ফিরে এসেছেন?অহল্যা প্রশ্ন করেন৷ তিনি কোন ভাবেই ইন্দ্রের নাম সহ্য করতে পারেন না। তিনি জানেন এই স্বয়ম্বরে ইন্দ্রই জয়ী হবেন। কথাগুলো ভেবেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন৷
কি হয়েছে ভেবে অহল্যা দীভদাস অর্থাৎ অহল্যার ভ্রাতাকে খুঁজতে থাকেন৷ মনে মনে ভাবেন এই মুহূর্তে সবথেকে খুশি থাকবেন দীভদাস। তাঁর মুখ সূর্যের মত জ্বলজ্বল করে৷ইন্দ্র ফিরে আসেননি।
দীভদাস জানায়৷
-তুমি ভেবেছিলে যে তিনি জয়ী হবেন৷
-হ্যাঁ।
অহল্যা আর কোন কথা বলেন না৷
-ইন্দ্র হলেন সর্বশেষ্ঠ।
দীভদাস দাবী করেন।
-অন্য যে কোন নারী তাঁকে স্বামীরূপে পেলে খুশি হবেন অহল্যা৷
দীভদাস মৃদুস্বরে কথাগুলি বোঝানোর চেষ্টা করেন অহল্যাকেI
-তুমি কেন অসুখী হবে ভাবছ তাঁকে বিবাহ করে?
অহল্যা ক্রদ্ধ হন।
-আমি কী তোমাকে এ কথা বললাম তাঁকে ভালোবাসা যায় না? এর মধ্যে অন্য কিছু আছে ...
অহল্যা বলেই তাঁর ভ্রাতার দিকে তাকান।
দীভদাস এক মুহূর্তে জন্য স্তব্ধ হয়ে যান। তাঁর ভ্রু কুঁচকে থাকে৷
-তুমি কি অন্য কাউকে ভালোবাসো?তাহলে তা বলছ না কেন?
দীভদাসের গলার স্বর বেড়ে যায়৷ অহল্যার ঠোঁট কেঁপে ওঠে৷
-আমি কি বলব?আমি তাঁকে ভালোবাসি কিনা জানি না...
কে তিনি? ভ্রাতা প্রশ্ন করেনl
-এখন এ কথার কোন মূল্য নেই।
দীভদাস তাঁর ভগিনীর জন্য ভীত হন। তিনি তাঁর পাশে বসে দেখেন তাঁর ভগিনীর মুখের অবস্থা। অহল্যার চোখে জল দেখতে পেয়ে দীভদাসের হৃদয় দুলে ওঠে৷ ভগিনীর কান্নায় তিনি ব্যথীত ৷জানলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন চুপ করে দীভদাসl প্রাসাদের বাইরে ইন্দ্রের রথ দেখতে পাওয়া যায় কিনা দেখতে থাকেন৷ কিন্তু তিনি জেনে গেছেন তাঁর ভগিনী ইন্দ্রকে ভালোবাসেন না ৷সেই ভাবনা দীভদাসকে আরও বিদীর্ণ করে৷
-তুমি কখনও অসুখী হবে না। তোমার বিবাহিত জীবন সুখের হবে৷ অহল্যাকে বোঝান দীভদাস কিন্তু অহল্যার মুখের দিকে তাকান না৷ তিনি বোঝেন তাঁর কি অবস্থা হতে পারে।
-সেই ব্যক্তি কী অংশগ্রহণ করেছেন স্বয়ম্বরে?
দীভদাস অহল্যার কাছে জানতে চান৷
-তিনি আমাকে ভালোবাসেন না দীভদাস৷কেন তিনি এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন?
-কে তিনি?কোন অতিমানব যিনি তোমাকে ভালোবাসেন না!তোমাকে সবাই বিবাহ করতে চায়...
অহল্যা চুপ করে যান। কী বলবেন বুঝতে পারেন না৷
দীভদাস অনীহা নিয়ে জানলা ছেড়ে চলে যান৷
-এই রহস্যজনক মানুষটি তোমার থেকেও বড় মনস্তত্ত্ববিদ! আমি তাঁকে দেখতে চাই৷
দীভদাসের মনে ভয় হয়, আবার আশঙ্কার জন্ম নেয়৷ মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ভগিনীর উপর। কে সেই মানব যে তাঁর ভগিনীকে কষ্ট দিয়ে চলেছেন৷ তাঁর ভগিনীর হৃদয় ভেঙেছেন৷ অহল্যা তাঁকে সঠিক মত চেনেন কী? তিনি তো প্রাসাদের মধ্যে থাকেন তাহলে তাঁর সাথে আলাপ হল কী ভাবে৷ এই প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে এসে ভিড় করে দীভদাসের৷ প্রাসাদের পর অহল্যা ঋষি গৌতমের আশ্রমে গিয়েছিলেন৷ অহল্যার সাথে সেই মানুষটির সাক্ষাৎ কী আশ্রমে হয়েছিল? ঋষিদের কিছু নিয়মশৃঙ্খলা থাকে। তবে কি সেই ব্যক্তি ঋষি গৌতম নিজে? দীভদাসের হৃদয় ভয়ে শঙ্কিত হয়৷
-তিনি কী ঋষি?
দীভদাস অহল্যাকে প্রশ্ন করেন৷ তিনি দেখেন ভগিনীর মুখের অবস্থা। অহল্যা দীভদাসের মুখে এই প্রশ্ন শুনে আরও শক্ত হয়ে যান।
দীভদাস আবারও প্রশ্ন করেন এবং দেখেন অহল্যা কোন উত্তর দিচ্ছেন না৷ একথা শোনামাত্র অহল্যার চোখ,মুখের অবস্থা পরিবর্তিত হয়।
-একজন ঋষি বিবাহ করতেই পারেন যদি তিনি চান৷ দীভদাসের মনে হয় এই সত্যটা তাঁর জানা দরকার৷
-এই স্বয়ম্বরে অনেক ঋষি অংশগ্রহণ করেছেন৷ তিনিও অংশগ্রহণ করতে পারেন...
অহল্যা তাঁর ভ্রাতার মুখের দিকে তাকান।
-তুমি কেন তবে সময় নষ্ট করছ এবং নিজেকে এত যন্ত্রণা দিচ্ছ অহল্যা?দীভদাস প্রশ্ন করেন৷
-তুমি যখন জানো তিনি তোমাকে চান না তবে কেন?
অহল্যা নিশ্চুপ থাকেন৷
-নিজেকে সংযত করো।
দীভদাস বলেন৷
-তুমি বাস্তবকে সামনে রেখে চিন্তা করো। তবে কি তুমি নিশ্চিত যে তুমি তাঁকেই ভালোবাসো?
হঠাৎ জানতে চান দীভদাসI
-আমি একথা জানতে চাইছি কারণ তুমি বলছ তিনি ঋষি৷ তবে তুমি কি তাঁর প্রতি আকৃষ্ট নাকি সত্যিই ভালোবাসো তাঁকে?
-না আমি ভাবিনি৷ আমি খুবই চিন্তিত। তবে এটুকু বলতে পারি আমি তাঁকে ভালোবাসি এবং ইন্দ্রকে আমি ভালোবাসি না কখনই৷
দীভদাসের মাথা ঘুরে যায় একথা শোনা মাত্রই৷
-যে মানুষটি তোমার জন্য অপেক্ষারত,তুমি তাঁর দিকে ফিরেও তাকাও না। আর এমন একজনকে ভালোবাসো যিনি তোমাকে ভালবাসে কিনা তা জানো না...তবে এত কিছুর পর তুমি কেন ইন্দ্রকে বিবাহ করার জন্য ভাবছ না অহল্যা? তিনি তোমায় ভালোবাসেন৷ তিনি তোমাকে সারা জীবন ভালো রাখবেন৷ তোমার পছন্দের অতিমানবের থেকে ইন্দ্র অনেক ভালো নয় কি?
অহল্যা উঠে দাঁড়ান৷ কোন উত্তর করেন না৷
-দয়া করে চুপ করো দীভদাস৷
অহল্যা বিড়বিড় করেন৷
-না অহল্যা চলে যেয়ো না।এই পরিস্থিতি তুমি তৈরি করেছো।
দীভদাস ক্রদ্ধ হন৷অহল্যা দীভদাসের দিকে ফিরে তাকান এবং তাঁর স্বরের তারতম্য লক্ষ্য করেন৷
-তুমি কেন এই কথাগুলো আগে জানাওনি?
দীভদাস বলেন৷
-আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু...
-হ্যাঁ তোমার অবশ্যই বলা উচিত ছিল কারণ এই পরিস্থিতি আমি আর মেনে নিতে পারছি না অহল্যা৷
-এই বিবাহ হচ্ছে তোমার সুখের,শান্তির কথা ভেবে অহল্যা। তোমার সিদ্ধান্তের এদিক ওদিক হলে অনেক কিছু তোমার জীবনে আসতে পারে৷ এখন অবশ্যই আর স্বয়ম্বরকে বন্ধ করা যাবে না। তোমাকে এই প্রতিযোগিতায় যিনি জয়ী হবেন তাঁকেই বিবাহ করতে হবেI
দীভদাস ভগিনীর কাঁধে হাত রাখেন৷এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হবেন ইন্দ্রই। তা তোমায় মানতেই হবে অহল্যা৷ দীভদাস অহল্যাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন ৷ অহল্যাকে দেখে মনে হয় ভেঙ্গে যাওয়া পুতুল৷
-যখন তোমার কথা বলা দরকার ছিল তখন কেন চুপ ছিলে?
দীভদাস প্রশ্ন করেন৷
-যদি তুমি আগে জানাতে তবে তোমার জন্য কিছু করতে পারতাম৷এখন স্বয়ম্বরের ঘোষণা হয়ে গেছে৷ কিছু করার নেই...
-আমি যাকে বিবাহ করতে চাই তাঁর নাম আমি মুখে আনতে পারছি না৷ কেন তুমি আমাকে জোর করছ?
-তোমার সত্য বলা উচিত ছিল তা তুমি করোনি। এই প্রথা তোমার অভ্যাসের মধ্যে ছিল না। -
দীভদাস অহল্যাকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করেন৷
-নীরবতা কখন জটিলতাকে সমাধান করতে পারে না৷ তুমি সত্যকে সামনে আনতে পারনি এটা তোমার দুর্বলতা,স্বাধীনতা নয়।
-আমি যা ভাবব তাই করব৷
চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেন। তাঁকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেন দীভদাস৷ তিনি তাঁর কাঁধে হাত দিয়ে আবারও বলেন
-কান্না থামাও৷নিজেকে সংযত করো৷কিন্তু আমি একা তোমার জন্য কি করতে পারি এখন...
দীভদাসের চোখ ছলছল করে৷
-তুমি এখনও স্তব্ধ আছো? তুমি যদি আগে সব জানাতে তাহলে আমাদের এখানে উপনীত হতে হত না। পিতা'র কথা চিন্তা কর! এই স্বয়ম্বরের জন্য তিনি সকলকে আমন্ত্রণ করেছেনl পৃথিবীর সকল রাজারা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে চলেছেন। তিনি কি করবেন যখন জানবেন তাঁর কন্যা অন্য কাউকে বিবাহ করছেন আর ভালোবেসেছেন অন্যকে৷
অহল্যা দেখেন তাঁর করা ভুলগুলির মধ্যে জড়িয়ে গেছেন ভীষণ ভাবে৷ এই ঘটনা থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো পথ নেই৷
-এদিকে এসো৷উঠে দাঁড়াও৷
অহল্যার চোখ ছলছল করে৷
-দয়া করে আমাকে যেতে দাও৷ আমি আর দাঁড়াতে পারছি না।
অহল্যা বোঝেন তাঁর একটি দায়িত্ব আছে সাম্রাজ্যের প্রতি,পিতার প্রতি।
তিনি বোঝেন অনেক দেরি হয়ে গেছে৷
-আমি তা মানি না৷
দীভদাস বলেন
-হ্যাঁ দেরি হয়েছে৷ তোমার আর এখন চোখের জল ফেলার সময় নেই৷
রেগে গিয়ে উত্তর দেন৷
অহল্যা তাঁর ভ্রাতার কাছে সরে গিয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেন
-আমি দুঃখিত৷ হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ আমাকে এই স্বয়ম্ববরে থাকতেই হবে...
-তোমার মধ্যে যাই থাক না কেন তোমাকে সুখী দেখাতে হবে সবাইকে৷
দীভদাস জানেন তিনি তাঁর ভগিনীকে যা বলবেন তা তিনি অমান্য করবেন না। কিন্তু তিনি এ ও জানেন তিনি যা মনে করেন তাই করেন৷ এই বলে তিনি ঘর থেকে চলে যান৷
কারো পদধ্বনি শোনা যায়৷এটা তাঁর মাতার হতে পারে৷ তাঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় এবং নিঃশ্বাস আটকে যায়৷ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছেন। তারপর তিনি বলেন
-বিজয়ী কে তা পূর্বঘোষিত৷
সেই মুহূর্তে নারদ প্রবেশ করেন রাজা মুদগল অর্থাৎ অহল্যার পিতার রাজসভায়৷ ঋষি নারদ সর্বদা সঠিক সময়ে প্রবেশ করেন যাতে কোন কিছুই অদেখা না থাকে তাঁর। রাজা কি ভাবছেন তা জানা দরকার তাঁর। তিনি রাজার কাছে এসে প্রনাম জানান৷
- আমি কয়েক মুহূর্ত আগে ভগবান ব্রহ্মার সাথে সাক্ষাৎ করে এলাম।
নারদ রাজা মুদগলের সাথে কথাবলা শুরু করেন৷
-তিনি কি আমার জন্য কোন বার্তা পাঠিয়েছেন?
রাজা মুদগল বিনয়ের সাথে জিজ্ঞাসা করেন৷
-তিনি স্বয়ম্বর নিয়ে কথা বলছিলেন৷ অন্য কোন বিষয় নিয়ে কথা হয়নি।
-কিন্ত এমন কেউ আছে যিনি ত্রিভুবন জয় করেছেন অর্থাৎ ত্রিলোক-স্বর্গ, মর্ত, পাতাল জয় করেছেন। এমন একজন আছেন যিনি এই তিন জগতকে জয় করেছেন ৷
নারদ বলেন৷
সবাই অবাক হয়ে শোনে নারদের কথা৷
-কে?কখন?
মুদগল অবাক হয়ে যান৷
-এবং তিনি কেন এই স্বয়ম্বরে উপস্থিত হননি?
-আমি আপনাকে বলছি সব৷ আমি ঠিক কি বলেছি ভগবান ব্রহ্মাকে তাও জানাচ্ছি৷
নারদ রহস্যময়তা সৃষ্টি করেন৷
-এমন একজন আছেন যিনি অসাধ্য সাধন করতে পারেন৷
-কিন্তু ইন্দ্র আসলেন না এখনও...
রানী নল্যানী প্রশ্ন করেন৷
নারদ রানীকে কিছু বলবেন স্থির করেন৷ তিনি তাঁর সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছেন। রানীর মুখে হাসি উধাও হয় নারদকে দেখে। তিনি তাঁকে স্বাগত জানালেন না উল্টে গম্ভীর হয়ে যান৷ নারদকে কেউই তেমন পছন্দ করেন না।
-কে বলল আমি যার কথা বলছি তিনি ইন্দ্র?
নারদ রানীকে প্রত্যুত্তরে শোনান৷
-তিনি এই জয়ের জন্য নানা প্রকার ঐশ্বরিক শক্তির সাহায্য নেবেন৷ কিন্তু এই মুহূর্তে তিনি আর তা পারবেন না৷
নারদের কণ্ঠে বেশ গোপনীয়তা দেখা যায়৷ নারদ এবং ইন্দ্রের এই সংঘাত ঐতিহাসিক,মুদগল তা জানেন৷ তাঁরা দুজনেই খুব অহংকারী। দুজনই চেষ্টা করেন নিজেদের সঠিক প্রমাণ করতে৷
-কে গুপ্তভাবে জয়ী হতে চলেছে নারদ?এখনই আপনি কৌশল করে কথা ঘুরিয়ে দেবেন তা কিন্তু হবে না৷
রাজা মুদগল বলেন নারদকে৷
-আপনি কি জানতে চান কে জয়ী হতে চলেছেন?
নারদ প্রশ্ন করেন৷
-আমি জানি কে তিনি?
রানী নারদকে জানান৷ এ ক্ষেত্রে ভগবান ব্রহ্মা এই স্বয়ম্বরকে গুরুত্ব গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন৷ একথা আমি বুঝতে পারি আমি যখন তাঁর কাছে যাই এবং এই প্রতিযোগিতায় কে জয়ী হতে চলেছে তা তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন৷
নারদের এই কথায় সবার মধ্যে খুব চাপা ভয় কাজ করে৷ ভগবান ব্রহ্মা ঠিক করবেন কে এই স্বয়ম্বরে জয়ী হবেন এবং তাঁর সাথে বিবাহ হবে অহল্যার।
তিনি জানান৷
নারদ হলেন অত্যন্ত ধুরন্ধর ব্যক্তি৷ তিনি সর্বদা চেষ্টা করেন আকর্ষণের মূল কেন্দ্র হতে৷ তিনি খুবই সুখী এই মুহূর্তের সাক্ষী হতে পেরে৷
-ভগবান ব্রহ্মা ঘোষণা করলেন যে ব্যক্তি তিনটি পৃথিবী অর্থাৎ স্বর্গ,মর্ত পাতালে যেতে পারবেন তাঁর সাথেই বিবাহ হবে কন্যা অহল্যার৷
নারদ নাটকীয় ভাবে বলেন কথাগুলি৷
সভাস্থল নিস্তব্ধ হয়ে যায়৷ শুধুমাত্র নারদের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়৷ তাঁর প্রতি শব্দ রানী নল্যানীকে আরও আশঙ্কিত করে তোলে৷
-রাজা এবং রাজপুত্র,ভগবান,ঋষি, দৈত্য, দেবতা সবাই উপস্থিত এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার জন্য। প্রত্যেকেই চান এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে রাজকন্যাকে বিবাহ করতে৷ অবশ্যই রাজা ইন্দ্র তাঁর সর্বতম চেষ্টা করবেন এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হবার৷ কিন্তু এমন একজনই আছেন যিনি এই সব শর্তগুলোকে পূরণ করতে পারবেন৷
-কে তিনি?
নল্যানী প্রশ্ন করেন৷
-কী ভাবে তিনি জয়ী হবেন?
রাজা মুদগল আর উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারেন না৷
নারদ স্মিত হাসেন৷
এই ব্যক্তি ত্রিভুবন প্রদক্ষিণ করেছেন সুরভী নামক এক গরুর জন্ম দিয়ে৷ তিনি ত্রিভুবনকে পর্যবেক্ষণ করেছেন৷ তিনি মাতা এবং প্রকৃতির মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করেছেন৷ প্রদক্ষিণ হল তপস্যার একটি ধাপ৷ নিজেকে উৎসর্গ করেন এর মধ্য দিয়ে৷ তাঁকে ঈশ্বরের এক প্রতিনিধি বলা যায় ভগবান এবং প্রকৃতির মধ্যে সমন্বয় সাধনের৷ বেদমতে গরুকে প্রদক্ষিণ করা ত্রিভুবনে প্রদক্ষিণ করার সমান৷
নারদ বলেই চলে যান৷
-সুতরাং বেদ ঐতিহাসিক জ্ঞানের ভান্ডার৷সেখানে এমন কথা লেখা আছে...
নল্যানীকে কিছুটা অস্বস্তিতে ফেলার চেষ্টা করেন নারদকে৷
-বেদে তপস্যা করার বিভিন্ন পর্যায়ের উল্লেখ আছে। এখানে শ্রুতি আকারে সব লিখিত আছে৷ ইহা কোন স্মৃতি নয়৷ প্রতিটি শব্দ স্তবগান আকারে লিপিবদ্ধ৷ যা ঋষিদের অনুপ্রাণিত করে৷
মুদগল লক্ষ্য করেন নারদের গলার স্বর পরিবর্তিত হয় যা তাঁর স্ত্রীকে প্রশমিত করেl
-হ্যাঁ আমি জানি এবং আমি সম্মত৷
রাজা জানান৷
-যিনি এই স্বয়ম্বরের সকল শর্ত পূরণ করেছেন বলে বলবেন ভগবান ব্রহ্মা তাঁর সাথেই বিবাহ দেবেন?তিনি কি উপস্থিত এই স্বয়ম্বরে?রাজা প্রশ্ন করেন নারদকে৷
-হ্যাঁ, ব্রহ্মা সব স্থির করেছেন এবং তিনি তাঁর সাথে অহল্যার বিবাহ দেবেন৷
-কে তিনি?
রানী প্রশ্ন করেন।
নারদ স্থির করেন তিনি এই রহস্যময়তাকে আর বাঁচিয়ে রাখবেন না৷ তিনি লম্বা এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন
-গৌতম!
সভার সমস্ত স্তব্ধতা ভেঙ্গে যায় এই নাম শুনে।রানীর হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায়৷
- না৷ এ হতে পারে না৷
তিনি গুনগুন করে বলেন৷
কিন্তু তাঁর কথা কেউ শুনতে পায় না।
রাজা মুদগলের মুখের হাসি উধাও হয়ে যায়। তিনি বলেন
-ঋষি গৌতম!
-হ্যাঁ প্রিয় রাজা। তিনি এখানে আসবেন স্বাভাবিকভাবে আপনার কন্যাকে বিবাহ করার প্রস্তাব নিয়ে৷
নারদ জানান।
নারদ দেখেন চারিদিকে যেন হুল্লোড় পড়ে যায়৷ যাঁর চোখ এতদিন ধরে দেখার অপেক্ষায় ছিল সেই ঋষি গৌতম প্রবেশ করেন৷ রানী ভয় পান৷ এই ঋষি কিভাবে তাঁর কন্যাকে ভালো রাখতে পারবেন৷ তাঁর কন্যাকে ইনি বিবাহ করবেন?এই প্রশ্ন কুঁড়ে খায় নল্যানীকে।
তাঁর হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায়৷ গৌতম প্রবেশ করেন প্রাসাদে। প্রতিটি স্তম্ভের দিকে তিনি তাকিয়ে দেখেন৷ সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখেন। তাঁর মনে পড়ে ছোটবেলার কথা৷ তাঁর পিতা এমন এক বড় প্রাসাদে থাকতেন৷ সেখানে তাঁর কষ্ট ছিল না৷ সেখানে ছিল ক্ষমতা,রাজনীতি, যুদ্ধ,অহিংস ইত্যাদি। তিনি এসব থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু এখন তিনি আরও বিখ্যাত হতে চলেছেন৷ রাজা মুদগলের কন্যাকে বিবাহ করতে চলেছেন৷
গৌতম চারিদিকে তাকান৷ তাঁর মনে হয় সবাই কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছেন৷ কারণ তিনি স্বয়ম্বরের সর্বস্বত্ব অনুযায়ী জয়ীএবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মহিলাকে বিবাহ করতে চলেছেন৷
চারিদিকে আবহাওয়া উওপ্ত হয়ে ওঠে। উৎসব মুখর হয় প্রাঙ্গণ৷ রানী অবাক হয়ে রাজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কোন কথা বলার ক্ষমতা থাকে না। ভ্রু কুঞ্চিত করে রানী গৌতমকে দেখেন৷ গৌতমের কিছু আসে না তাতে। তিনি দেখেন অহল্যার মাতা মুখ ফ্যাকাশে করে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি গৌতমের দিকে তাকান আর অহল্যার কথা ভাবেন৷ গৌতম দেখেন মাতা এবং অহল্যার মধ্যে কত পার্থক্য। মাতার থেকে অহল্যা আরো সুন্দরী। অহল্যা মাতার থেকে অনেক জ্ঞানী৷ গৌতম রাজা এবং রানী উভয়ের সাথে সাক্ষাৎ করে কুশল বিনিময় করেন৷
রাজা মুদগল গৌতমকে জড়িয়ে ধরেন৷ তাঁর সৌম্যকান্তি চেহারাকে দেখেন রাজা৷
-আমি আপনার কাছে ঋণী।
মুদগল বলেন।
-আপনি আমার কন্যাকে রক্ষা করেছেন৷
রাজার গলায় আবেগ ধরা পড়ে৷
-আমি কিছুই করিনি।
ঋষি বলেন।
-আপনার মহানুভবতা গুরুদেব ৷
গৌতমের মাথা ঘুরে যায়৷ তিনি তাকান৷
-আমি আপনার কাছে এসেছি কিছু জিজ্ঞাসা করার জন্য রাজা৷
নল্যানী বিদ্রুপ করে বলেন
-অহল্যা আমার গরিব মেয়ে। তাই সে এনাকে বিবাহ করতে চলেছে৷
মুদগল মাথা নাড়িয়ে বলেন
-আমি ধন্য তাঁর কাছে। এমন মানুষের কাছে আমার কন্যাকে তুলে দিতে পেরে৷
-আপনি উপহার পেতে চলেছেন এমন এক জামাতাকে৷
নারদ বলেন৷
-আমি গৌরবান্বিত৷
রাজা মুদগল পিছন ফিরে নল্যানীকে দেখেন।তাঁর মুখ রূপার মত হয়ে যায়৷
-আমি এখনই আমার কন্যাকে এই সংবাদ দিতে চাই গুরুদেব৷
রানী বলেন এবং পিছন ফিরে তাকান রাজার দিকে।
-তিনিও অরাজি হবেন না৷
নারদ ধীরে বলেন৷
-এটি তাঁর স্বয়ম্বরের শর্তে বলা ছিল।
সেই শর্ত অনুযায়ী গৌতম জয়ী। তিনি বিবাহ করবেন রাজকন্যাকে৷গৌতম নারদের কথাকে পাত্তা দেন না৷
-হ্যাঁ আমি শ্রদ্ধা করি তাঁর সিদ্ধান্তকে৷ তিনি এই সিদ্ধান্তে রাজি কিনা আমার জানা জরুরি৷ গৌতম বলেন৷
নল্যানী মানতে পারছিলেন না ঋষি গৌতমকে জামাতা রূপে। তিনি তাঁর কন্যার জন্য অন্য কিছু ভেবে রেখেছিলেন৷
-আমি অহল্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর ঘোষণা করব৷
নল্যানী বলেন।
৩)
যিনি জয়ী নির্বাচিত হয়েছেন তিনি সভাস্থলে উপস্থিত৷
নল্যানী জানান অহল্যাকে৷
অহল্যা এ কথা শোনামাত্রই ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকান৷ তিনি তাঁর মাতার অবস্থান দেখার চেষ্টা করেন৷ মাতা তাকিয়ে থাকেন অহল্যার দিকে৷নল্যানী দেখেন অহল্যা ভূতের মত তাকিয়ে থাকেন তাঁর দিকে৷ অহল্যার এই রূপ মাতা কখনই দেখেননি।
-ইন্দ্র তাহলে ফিরে এলেন?
দীভদাস প্রশ্ন করেন।
-ইন্দ্র না।
মাতা জানান।
অহল্যার বুক থেকে পাথর নেমে যায়৷
-ঋষি গৌতম!
মাতা জানান।
অহল্যা মাটিতে বসে পড়েন। যেন তাঁর সমস্ত শরীরে নিঃশেষিত হয়ে যায়।তাঁর সমস্ত রক্ত চলাচল যেন স্তব্ধ হয়ে যায়৷ তিনি কথা বলার মত অবস্থায় থাকে না।
অহল্যার চোখ জ্বলজ্বল করেএবং মাতার দিকে তাকান।নল্যানী অহল্যার এই শারীরিক অবস্থা চোখে দেখতে পারছিলেন না৷ অহল্যার মুখে হাসি ফিরে আসে৷ এই সংবাদ যেন তাঁকে দ্বিগুণ খুশি করে তোলে৷ তাঁর মধ্যে আনন্দ হতে থাকে৷ নল্যানীর শ্বাস বন্ধ হয়ে যায় কন্যার এরূপ অবস্থা দেখে৷ তিনি দ্বন্দ্বে পড়েন৷ তাকিয়ে দেখেন কন্যাকে৷ দীভদাস কি বলবে বুঝতেই পারছিলেন না৷ এই সত্য শোনার পর স্তব্ধ হয়ে যান তিনি। ভগিনীর উজ্জ্বল মুখ দেখে তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয় না গোটা ঘটনা।
-তিনি কী সেই মহামানব অহল্যা?
দীভদাস প্রশ্ন করেন৷
অহল্যা সম্মতি জানায়৷
-ইহা কি ভাবে সম্ভব আমার জানা নেই৷
নল্যানী প্রশ্ন করেন৷
-অহল্যা ইন্দ্রর সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারবেন না মাতা৷ আমরা কেউই জানতাম না অহল্যা ঋষি গৌতমকে ভালোবাসে এবং তিনি ও অহল্যাকে৷ তা না হলে তিনি এখানে থাকতেন না৷ আপনি ওদের আর বাধা দিতে পারবেন না মাতা।
দীভদাস মাতাকে বলেন।
-আপনাকে মেনে নিতে হবে ওদের বিবাহ৷ আপনি ওদের আশীর্বাদ করুন ওরা যাতে সুখী হয় মাতা৷
-না সম্ভব নয়৷
নল্যানী'র অবসন্নতা চোখে মুখে ধরা দেয়৷ তাঁর মধ্যে সেই ক্ষমতা নেই যে তাঁর সন্তানকে আটকাবে৷ তাঁর দুঃখ এটাই তাঁর কন্যা কোন ভবিষ্যৎ দেখতে পারছে না৷ অহল্যার ইন্দ্রলোকের রানী হবার কথা ছিল।তা না হয়ে তাঁকে থাকতে হবে জঙ্গলে। রাজার পরিবর্তে তাঁর বিবাহ হতে চলেছে ঋষির সাথে৷ অহল্যা পাগল হয়ে গেছেন৷ তিনি নিজের ভালো বুঝতে পারছেন না।
দীভদাস জানেন পরবর্তীতে কি হতে চলেছে তাই তিনি জানলার ধারে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকেন৷
অহল্যার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়৷ তিনি গৌতমের সাথে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে ওঠেন৷ তিনি চান তাঁর বিবাহের সম্মতির কথা জনসম্মুখে জানাতে৷ যখনই তাঁর এ কথা মনে হয় ইন্দ্রের মুখ ভেসে ওঠে৷ তিনি চান মাতা'র কথা অমান্য না করতে কিন্তু তিনি অপারগI প্রতিটা পদক্ষেপ ভেবে চিন্তে ফেলেন তিনি৷ অহল্যার জীবনে প্রথম পুরুষ গৌতম৷ তিনি বিদ্যালাভ করার সময় গৌতমের সব কিছু লক্ষ্য করতেন৷ গৌতমের কালো ঘন কেশ তাঁর অধিক মুখ ঢেকে রাখত৷ তাঁর সরু চেহারা, অপূর্ব চিবুক সারা মুখে অপূর্ব সৌন্দর্য্য বহন করে৷ তাঁর উজ্জ্বল চোখ৷সবমিলিয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র গৌতম৷
যখক অহল্যা তাঁকে দেখতেন প্রতি মুহূর্ত বদলে যেত। তাঁর মুখের হাসির কথা মনে পড়ে অহল্যা। তিনি দৌড়ে যেতে চান তাঁর বুকে নিবিষ্টভাবেI বলতে চান তিনি তাঁকে ভালবাসেন৷ তাঁর কাছে যেন মাতা, পিতা,নারদ কেউ নন৷সবাই তুচ্ছ৷ তাকিয়ে থাকতে চান গৌতমের চোখের দিকে৷ অহল্যা স্বয়ম্বর কক্ষে প্রবেশ করেন।
জানলা দিয়ে হালকা গোলাপি রঙের আভা দেখা যায়। অহল্যা'র চোখ উজ্জ্বল দেখায়।অহল্যাকে যেন আরো সুন্দর দেখায়৷
-কি ভাবে ইহা সম্ভবপর হল?
ইন্দ্র চিৎকার করেন৷
-কীভাবে একজন ঋষি এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হলেন?তিনি শুধুমাত্র আমার!
একথা শোনামাত্র হৃদয়ে ক্রোধ জ্বলে ওঠে অহল্যা৷ তিনি কিছুই বলতে পারেন না৷ ইন্দ্রর রাগার্ত,দুঃখজনক মুখ দেখে অহল্যা আরও স্তব্ধ হয়ে যান৷ অহল্যা ভাবেন ভগবান তাঁর সহায়৷ সুতরাং এখানে কারোর কিছু করার নেই৷ তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়৷
ছয় অশ্ববিশিষ্ট রথ অপেক্ষা করে সাদা প্রাসাদের সামনে৷ স্বয়ম্বর কক্ষ চাঁদের আলোর মত দেখায়৷ সারথীকে রথ চালু করতে বলেন গৌতম৷
-এবার যাবার সময় হল।
গৌতম গুনগুন করে বলেন৷ অহল্যা রথের পিছনের দিকে বসেন। তিনি মাথা নিচু করে থাকেন৷ একবার পিছন ফিরে তাকান ভ্রাতা- মাতা-পিতাকে এবং তাঁদের প্রাসাদকে দেখার জন্য৷ খুব বেশীক্ষণ তাকাতে পারেন না তিনি৷ এক ঝলকে অহল্যা পরিবারের সবাইকে দেখে নেনI আশ্রম থেকে একদিন চলে এসেছিলেন অহল্যা৷ সেখানেই তিনি আবার ফিরে যাচ্ছেন৷ তাঁদের জীবনে নতুন দিন আসতে চলেছে৷ তাঁরা আসার আগে সমস্ত পথ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷ আসার পথের গ্রামগুলো সব নিস্তব্ধ।