ভিড় থিকথিক করছে চারিদিক। যেখানেই তাকাও সেখানেই শুধু লোকে ঠাসা। তিল ধারণের জায়গায়ও নেই। পার্কিং-এর দিকেও একই অবস্হা। শুধুই গাড়ি। দু চাকা, তিন চাকা, চার চাকা, এমনকী বাসও আছে প্রচুর। কোনো হোটেলেই ঘর নেই। খুব প্রয়োজনে পড়লে তৃতীয় ব্যক্তির সাহায্য ছাড়া ঘর পাওয়া খুবই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ডরমেটরিগুলোতেও একই রকম ভিড়।মার্চ মাস ২০২০ সাল পর্যন্ত হাজারদুয়ারিসহ সমগ্র মুর্শিদাবাদের একই অবস্থা থাকতো।
করোনা মহামারীর ভয়াবহতার জন্য হাজারদুয়ারি সহ বহু স্থান তালা বন্দী অবস্থায় ছিল।শুধু যে পর্যটকরা ভিতরে যেতে পারেননি তা নয়,যারা পরিচর্যা করেন তরাও ভিতরে যাওয়ার অনুমতি পাননি। তাই খোলা জায়গাগুলো ছোট ছোট আগাছায় ভরে উঠেছিল। আর যারা এই পর্যটন শিল্পকে কেন্দ্র করে রুজি রোজকার করেন তাদের অবস্থা হয়েছিল আরও কষ্টকর।
যেকোনো পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে অনেকেই অনেক রকম জীবিকার সাথে যুক্ত হয়ে থাকে। মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আবার বিভিন্ন ছোট-বড়ো ব্যবসায়ীরাও এটার ওপর অনেকটাই নির্ভর করে। যে সকল জীবিকা এই পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে - টাঙ্গাওয়ালা, গাইড, টোটোওয়ালা, মালি, ছোট ছোট ফেরিওয়ালা, ঝালমুড়ির মতো অনেক খাবারের দোকানদার, পার্কিংএর ব্যবসায়ী, খাবারের হোটেল, থাকার হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সিল্ক ব্যাবসায়ী, নৌকা চালক, বাবুর্চি কোভিড পরিস্থিতিতে মৃত্যুই শুধুমাত্র পরিবারকে কঠিন সময়ের দিকে ধাবিত করেনি, লকডাউনও মানুষের কঠিন সময়ের পরীক্ষা নিয়েছে। একদিকে মৃত্যুভয় অন্যদিকে জীবিকাহীন গৃহবন্দী জীবন। চারিদিকে শুধুই নেই আর নেই।
সেই পরিস্থিতিতে কেমন ছিল এই সব ব্যবসায়ীরা ? প্রথমেই দেখি টাঙাওলারা কেমন ছিল। মুর্শিদাবাদ বেড়াতে এসেছে আর ঘোড়ায় টানা টাঙ্গাগাড়িতে চড়েনি, এটা ভাবাই যায় না। এটা যেন নবাবি আমলের কিছুটা হলেও আমেজ বহন করে। নবাবরাও ঘোড়ার গাড়িতে চড়তেন,একথা মনে করেই যেন টাঙ্গাগাড়ি পর্যটকদের বেশি করে আকর্ষণ করে।একদা বাংলা,বিহার,ও উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ শহরে আজও অতীতের অনেক স্মৃতি চিহ্নই রয়েছে যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। সারা বছরই এখনে কম বেশি ভিড় থাকেই, তবে উৎসবের মরশুমে বিশেষ করে দুই ঈদ,মহরম,বেরা ও দুর্গা পূজাতে মুর্শিদাবাদ শহরে ভিড় হয় চৌখে পড়ার মতো। তবে শীতের সময় মুর্শিদাবাদে পর্যটকদের ভিড় সবথেকে বেশি হয়। বিশেষ করে ২৫ সে ডিসেম্বর থেকে ১লা জানুয়ারি পর্যন্ত হাজারদুয়ারি কাটরা মসজিদ,কাঠগোলা বাগান, জগৎ শেঠের বাড়ি, নশিপুর রাজবাড়ী,খোসবাগ,রোশনীবাগ,জাফরাগঞ্জ,মোতিঝিল প্রভৃতি স্থানগুলি লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে। তাই টাঙাওলারাও মরশুমের রোজগার করার একটুও সুযোগ হাতছাড়া করেন না। একটা গ্রুপকে ঘুরিয়ে এনে আর একটা গ্রুপকে নিয়ে যাবার দরদাম করে নেন। খাবার ফুরসৎ থাকেনা তাদের। তারা খুব ভালো করেই জানেন কোন জায়গা ঘুরতে কতটা সময় লাগবে। সেই অনুযায়ী ঘোড়াদের খাবার ও জল খাইয়ে দেন। নিজেরাও কিছুটা টিফিন সেই ফাঁকেই খেয়ে নেন। এখন বাড়ি গিয়ে খাবার খাওয়া মানেই রোজকারের সময় কমে যাওয়া, এটা তারা ভালোভাবেই জানেন। তাই একটু বেশি উপার্জন তারা এই মরশুমেই করে থাকেন। সারা বছর অল্প-অল্প পর্যটক আসে। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতি সব কিছুই শূন্য করে দেয়। নিজেদের খাই খরচ,পাশাপাশি ঘোড়াদেরও খাবার যোগান দেওয়া, তাদের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা। তারাই তো আবার রোজগার করতে সাহায্য করবে। রাজু শেখ নামে কেল্লার এক টাঙ্গা চালককে তাঁর ব্যবসার কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি একরাশ আক্ষেপ নিয়ে বলে উঠলেন “দিদি আমাদের ব্যবসা এখন আগের মতো চলেনা, এমনই পর্যটকরা আজকাল নিজেরাই গাড়ি ভাড়া করে আসে,তারপর শহরে এতো টোটোওয়ালা হয়েছে যে আমরা আর পর্যটক পাচ্ছিনা”।
কঠিন পরীক্ষা,ধৈর্য,আর অভাব এই নিয়ে সময় অতিবাহিত করার পর অবশেষে ২০২১সের ৬ই অক্টোবর বিভিন্ন স্থাপত্য-এর কুলুপ খোলা হলে পর্যটকদের আগমন শুরু হয়। সাথে সাথেই লক্ষ্মীর আগমনও হয়।
গাইডের যারা কাজ করেন তারা একটা নির্দিষ্ট স্থানেই থাকেন।অর্থাৎ একটা গাইড অন্য আর একজায়গায় যায় না। তাই শীতের মরসুমে তাদের রোজগার কিছুটা হলেও ভালো হয়। সব পর্যটক গাইড ব্যবহারও করেন না। তাই তাদের উপার্জন খুবই কম। কোভিড পরিস্থিতিতে তাহলে তাদের অবস্থা কেমন হয়েছিল তা আমরা সবটা নাহলেও, কিছুটা অনুমান করতে পারি। এই মুহূর্তে অল্প পর্যটকদের আগমন কিছুটা হলেও তাদের স্বস্তি দিয়েছে।
টাঙাওয়ালাদের মতো টোটোওয়ালাদের একই অবস্থা। তবে টোটো গোটা শহরেই ঘুরতে পারে, তাই কিছুটা হলেও তাদের রোজগার ছিল। লকডাউনের সময় সবার পরিস্থিতি একই ছিল। সেই পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল হওয়ার পর তাদের রোজকার আবার অল্প বিস্তর শুরু হয়।
বিভিন্ন স্থাপত্যর চারপাশে সেই জায়গার অনেক ছোট ছোট উপহারের সামগ্রী ফেরি করে অনেকেই। এটাই তাদের প্রধান জীবিকা। কিন্তু স্থাপত্যই যেখানে বন্ধ, পর্যটকহীন যে স্থান সেখানে এই জিনিস কে কিনবে? তাই কোভিড থেকে মুক্তি পেলেও বেকার বেকার সমস্যা থেকে তারা মুক্তি পায়নি।পর্যটকদের আনাগোনা আবার কিছুটা হলেও তাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।
কোভিড পরিস্থিতিতে পর্যটন কেন্দ্র যখন বন্ধ তখন তা পরিচর্যা করারও প্রয়োজন ছিল না। তাই সেইসব মানুষেরাও ছিল কর্মহীন। এই অর্থাভাব তাদের মজবুর করে অন্য কোনো কাজ করে অর্থ উপার্জন করার জন্য। এই মুহূর্তে তাদের পরিস্থিতি অনেকটাই ঠিক হয়েছে,পুরোনো জীবিকাতেই তারা আবার ফিরে এসে খুশি।
বেড়াতে গিয়ে ঝালমুড়ি, বাদামভাজা, বারোভাজা, আইসক্রিম কত কিছু খাওয়া হয় তার কোনো তালিকা বা হিসাব মনে হয় কেউই রাখে না। তাই আই সব খাবার বিক্রেতার মুখেও হাসি থাকে সর্বদা। কিন্তু জনশূনধ স্থানে এই খাবার কে খাবে? কোভিড তো মানুষ কে গৃহবন্দী করে দিয়েছে। তাই এই ব্যবসায়ীরাও বাধ্য গৃহবন্দী থাকতে। কিন্তু খিদে তো আর বন্দী থাকে না, সময় হলে তার খাবার চাই। সে বুঝবে না কিভাবে তা পাওয়া যাবে। এইসব ব্যবসায়ীদের অবস্থা সত্যিই কোনোভাবেই বর্ণনা করা যায় না। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর তারাও মূলস্রোতে ফিরছে।
সারাদিন ঘোরাঘুরির পর সবারই খিদে পায়। তাই অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে দিবা-রাত্রি । যার যেখানে খাবার ইচ্ছা হয় সেখানেই খাওয়া দাওয়া করতে পারে। অনন্যা ব্যবসার মতো এখানেও কোভিড পরিস্থিতি থাবা বসিয়েছিল। খাবারের হোটেলের পাশাপাশি থাকার হোটেলগুলিও একই অবস্থা। যেখানে কোনো হোটেলে একটা ঘর পেতে দালালের সাহায্য নিতে হয়, সেই জায়গায় সব ঘরই ফাঁকা অবস্থায় পর্যটকদের জন্য দিন গুণছে। এইরকম পরিস্থিতি দালালদেরও।
মুর্শিদাবাদ বেড়ানোর জায়গার পাশাপাশি সিল্কের জন্যও বিখ্যাত। তাই অনেক পর্যটকই ফিরতিপথে সিল্কের শাড়ী বা অন্য কোনো জিনিস কিনে নিয়ে যায় নিজের এবং অন্যদের উপহার দেওয়ার জন্য।
নিজামত ইমাবাড়ায় প্রতি বছর প্রচুর ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।এই সব অনুষ্ঠানে প্রচুর মানুষের দাওয়াতের আয়োজন করা হত।যদিও নবাবী আমল না থাকায় পূর্বের সেই সামর্থ্য হারিয়েছে, ফলে খাবারের আয়োজনে অনেক ভাটা পড়লেও পুরানো ঐতিহ্য মেনে তা কখনও বন্ধ হয়নি এতদিন, কিন্তু কোভিডের ধাক্কায় গত বছর থেকে তা একেবারেই বন্ধ হয়ে আছে। তাদের সাথে কথা বলে জানা যায় এর ফলে বাবুর্চিরা তাদের কাজ ও পেশার দক্ষতা হারাচ্ছে।
যতই বলবো ততই হয়তো কম বলা হবে। কেউই কোভিড পরিস্থিতির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। জীবিকার টানাটানি সব জায়গাতেই লক্ষিত হয়। কেউ কেউ তাদের পুরোনো জীবিকা ফিরে পেয়েছে, আবার অনেকে তা পায়ও নি। তারা খুঁজে নিয়েছে বিকল্প কোনো জীবিকা। এই মহামারী প্রত্যেকের জীবনেই কোনো না কোনো প্রভাব বিস্তার করেছে। নৌকার মাঝি, চপ-শিল্প, এমনকি বড়ো ব্যবসায়ীরাও এর প্রভাব থেকে রক্ষা পায়নি।
কিন্তু আশার আলো দ্বিতীয় লকডাউনের পরে মুর্শিদাবাদ শহরের পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে শহরের সমস্ত ঐতিহাসিক স্থানগুলি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। কোভিডের ভয় জয় করে দেশ বিদেশের বহু পর্যটকদেরও আনাগুনা শুরু হয়েছে নতুন করে, আবার শহরের ছোট বড় ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি ফিরেছে। প্রতি বছরের মতো এই বছরও শারদ উৎসবে সেজে উঠেছে শহর।এই শহরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ঐতিহ্য প্রায় কয়েকশো বছরের।নাজাফি বংশের নবাবরাও শারদ উৎসবে সামিল হতেন।সেই ঐতিহ্য মেনে আজও কেল্লার দক্ষিণ দরজারার সামনে এবং চক মসজিদের সামনে আজও দুর্গা পূজা পালিত হয়। সেই দুই পূজা কমিটির প্রেসিডেন্টও নবাব পরিবারের প্রবীণ সদস্য, নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জার নাতি রেজা আলি মির্জা। যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম নিদর্শন হিসেবে আজও আমরা দেখতে পাচ্ছি।