এখন রাত্রি। এখন ঘন তমসা মধুকলসে পতিত ভোমরার ন্যায় তুরীয় মৌতাতে সংবদ্ধ। জোছনাক্লিষ্ট চন্দ্রমা গত হয়েছে বলে এই ভগ্নকায় কদাকার অতিকায় হর্ম্যখানি বঙ্গদেশের কোনো এক দূর প্রান্তে যেন মৃত ঘটোৎকচ। নিঃশঙ্ক জোনাকিরা গুটি গুটি ডানায় কার্নিসে আলসেতে লুসিফেরিন নিঃসরণ করে স্বপ্রভ বিন্দুসকল। চরাচরে এই বাটিস্থিত কোনো সজীব বস্তুর জাগরণ-সাড়া নেই বলে, ক্ষিতি মরুৎ তস্করের মতন ভগ্ন ইমারতের দশদিকে ক্রীড়াময়। মদীয় অবলোকনে আইশ ইয়ারগণ।
সত্যবতী ঘুমিয়ে রয়েছে বালিশের পাশে খুলে রাখা তার ব্লাউজের ভেতর। সত্যবতী জেগে আছে তার রাতপোশাকের বন্দরে। মাথার মধ্যে অজস্র রীডের পিন গেঁথে আছে।
"লাথি মেরে সব ভেঙে দেব।"
ঝনঝন করে ওঠে প্রাচীন পায়রাঘর। পায়রাঘর অবশ্য নিচে গৃহে ঢোকার দরোজার বাঁদিকে। বহুকাল আগে পায়রাকুল থাকার জন্য বরাদ্দ ঘরটি।
"লাথি মারব দেখবি? এ আমার ঘর। আমার পাখি সব। আমার রোজকার মরা পালক। তেরোশ কড়ি বর্গা। সত্তর জোড়া ঝরোকা। সদর দালানে কস্তুরী হরিণের জোড়া শিং থেকে একটা গতকাল খসে পড়েছে। হরিণ মস্করা করেছে।"
সত্যবতী চাঁপাডাল ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে এক টুকরো জিরো ডিগ্রি পাড়বে ভেবেছিল সন্ধের মুখে। তখন আকাশ পিঙ্গল বর্ণ। সত্যবতীর তলপেটে রজঃকালীন ব্যথা মাঝে মাঝে চাগাড় দিচ্ছিল। চাঁপা ডালে-ডালে আঁধার এলে চম্পকনগরে নৈশকালীন আয়োজন। পাতায় দালানে খোলাছাদে পরাগধানীতে প্রাত্যহিক নিজ হস্তাক্ষরের উৎসব শুরু হয়। রোজ রোজ উৎসব। রোজ রোজ নির্বাক কার্নিভাল। দিনমান গেলে একশরীর সহস্রারে সহস্রধারে ফেটেফুটে শালুকে ক্রিসান্থিমামে কুচি কুচি শরীরে ভেঙে ভেঙে উতল ফ্লেমিংগো। খোলাছাদে ঝুঁকে পড়া ডাল থেকে টুপ টুপ চাঁপা ঝরে আর-- আর মাংসখেকো হায়নার মতো ক্ষুধিত শরীরেরা এক শরীরকে উদ্দেশ করে খিস্তি মারে, শিঁষ দেয়, কোমরে পাক মারে বলে সে এক নকটার্নাল বৈকি!
এখন রাতের তৃতীয় প্রহর। ঘুমন্ত সাদা থানকাপড়ের ওপর নোটন ঝোটন পায়রাগুলি নখের পশমে আঁচড়ালে চল্লিশবর্ষীয়া সত্যবতীর অক্ষিপটলে ঘাম জন্মায়। চরণোপান্তে ব্রাশরীডগুলি হাত ধরে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করে। তি-লা-সো-ফা-মি-রে-ডো। বুড়ো আঙুলে ফা চুমু খেলে, কনিষ্ঠায় সো গা ঘষে দিলে বিচলিত বিহ্বল অনন্যোপায় সত্যবতীর নিদ্রাকাল।
"লাথি মেরে ঘুচিয়ে দেব ইতালিয়ান ট্রেমেলো।"
চামচিকে কিচ কিচ করে বৈকি ঘুলঘুলিতে! এই ঘর থেকে দূর ভিতরমহলে কোনো এক ঘরে শশীবালার শরীরে কেবল শ্বাসটুকু বহাল বলে এখনও যুগ্ম জীবনযাপন চিহ্নিত। সত্যবতীর নবতিপর ঠাম্মি সত্যবতীকে এখনও ত্যাগ করেননি, তাই দুটি মানুষের অট্টালিকাখানি স্মৃতিভারজর্জর জরদ্গব, তবু জিয়ন্ত নিকেতন বটে।
সত্যবতীর লাথির টানে রীড ছিটকে ততদূর যাবে না।
বিকেল নিভতে নিভতে একেবারে মরে এলে শশীবালা হাঁক দেন, ঠাকুরঘরে আলো দিস সত্য।
সত্যবতী সিঁড়ি বেয়ে ছাদের নড়বড়ে সেগুনদরজা, জানালার খড়খড়ি বন্ধ করতে খোলাছাদে আসে। চাঁপাফুলের ঘন গন্ধ। বারোমাসের চাঁপাফুল। ছাদের মেঝে থেকে একটা ফুল তুলে দুহাতে চটকে নাসা ভরে শোঁকে। নির্গতগন্ধ মুখ হাঁ করে উর্ধমুখ হলে, সেই সময় একটি আগুনহীন অকালজোনাই চাঁপাডাল থেকে পিছলে সত্যবতীর বুকের ফাঁকে পড়ে পথ হারিয়ে ফেলে।
সত্যবতীর বুকে অস্পষ্ট মাংসসকল আজন্ম অচঞ্চল। কোমল কি মরুবৎ, সে কথা একমাত্র সত্যবতীই জানে। কীট সে খবরে অজ্ঞাতকুলশীল পতিত হয় এবং সত্যবতী তৎক্ষণাৎ হিংস্র হয়ে ওঠে। নিজের বুকদুটো সজোরে যতটা চটকালে নিজের কাছে অপ্রিয় লাগে না, ততটা এবং ঝটিতি আঁচল খুলে খাঁজে সুগন্ধি হাত ঢোকালে জোনাকির অতিরিক্ত নিঃসৃত লুসিফেরিন মাংসে মাংসে আগুন ধরিয়ে দেয়।
'মাগো মাগো' যন্ত্রণার রবে সত্যবতী ছাদসংলগ্ন ঘরের মধ্যে দৌড়ে এসে হুক ছিঁড়ে ব্লাউস খোলে এবং তখন নিঝ্ঝুম বুকে লালচে লালচে ছোপ রেখে গেছে মৃত দলিত কীট। জোনাকিটাকে টুসকি মেরে ফেলে দিতে সেটি গিয়ে পড়ল মৃত পিয়ানোর ওপর। সত্যবতী তখন অগ্নিভ এবং তেজস্ক্রিয়। মুমূর্ষু পিয়ানোর কিছু কিছু রীড উধাও। ডালার ওপর মাকড়সার মিহি জালের অলংকরণ।
অগ্নিভতা কি উদ্গত জল ডেকে আনতে পারে? লুসিফেরিনের স্পর্শে নগ্নবক্ষ সত্যবতী পিয়ানোর ধুলোর ওপর আছড়ে পিছড়ে আঃ মাগো আঃ মাগো কাঁদে এবং জলহীন। পিয়ানো আর্তনাদ করলে, শৈশবের সত্যবতী বৃষ্টির জমা জল লাফিয়ে লাফিয়ে স্কুল থেকে ফেরার মতন, উধাও রীড বাঁচিয়ে লুপ্তপ্রায় ট্যাংগোর বিকৃত ঝড় তোলে। যেন বহুকাল আগে পিয়ানো টিচারের বকা খেয়ে ক্ষুব্ধ হোমওয়ার্ক। সত্যবতীর ব্লাউসহীন মুক্ত জোড়াস্তন একমাত্র নব নব রূপে প্রতিষ্ঠপ্রাণ সাক্ষী সেই অক্রন্দিত বাদনের।
এবং সবুজ রঙের চোখ নাকি কারুর? বেড়াল কার্নিস থেকে লাফিয়ে মিঁয়াও করে ঘরে ঢুকে।
সত্যবতী অতএব পূর্ণ ন্যাংটো হয় বেলজিয়ান মিররের সামনে। পিছনে আকস্মিক ট্যাংগোর টুইরল্ জার্কে উন্মাদ প্রৌঢ় পিয়ানো অপলক। সত্যবতীর চোখ উপচে শরীর গলে গলে নুন ছিটকে ওঠে। পূর্ণ নগ্ন একটি শরীর তেজস্ক্রিয় এবং বাহুল্যে, হিংস্র প্রজাপতির মতো মিররের সামনে পিয়ানো ঘিরে ঘিরে নাচে। মৃত কীটের লুসিফেরিন কি তখন ভৌত এবং রাসায়নিক যৌথরূপে?
"সত্যবতী, মেঘ চাই না?"
সত্যবতী কোলবালিশে মিশে গোঁ গোঁ শব্দ করে। সে শব্দ জার্মান ট্রেমেলো। মাথায় গেঁথে থাকা অজস্র রীডের পিন কেন্নোর পদসহস্রে কিলবিল করে ওঠে। তীব্র লালরঙের কেন্নো। গায়ে তার কালো কালো সোহাগের ওষ্ঠপিষ্ট দাগ।
"সত্যবতী, ভিজতে চাও?"
সত্যবতী প্রায় অস্ফুটে শরীর ভাঙে। "হ্যাঁ। হ্যাঁ ভিজতে চাই। ডেভিলস্ নোটেশনস্। লাথি মেরে দূর করে দিতে হয়।"
"কে তোমাকে বন্দী করে রেখেছে?"
সত্যবতী নিঃসাড়ে ঘুম।
"আমি? ভেজা ডো? ভিনদেশি শয়তান?"
"ন্ ন্ না। জানি না।" সত্যবতী শুকনো পাতা চিবোনোর শব্দ করে।
"লাথি মেরে ভেঙে সব দূর করে দেব।"
পায়রাঘরে ছড়িয়ে রয়েছে মৃত পাখিদের হাড় চঞ্চু সঙ্গম ডিমের খোসা। সত্যবতীর মাথায় গেঁথে থাকা হাজার ব্রাশপিন ছিটকে ছিটকে পড়ে মেঝেয়। পাখিরা কথা বলে। মি রে ডো। ফা সো লা। ডো...টি ডো...টি। এক পাঁজর থেকে দূর পাঁজরে অনতিক্রম্য। সত্যবতী জাগবে না এ জীবনে। তাহার বুকের নিচে একটি জন্মগত কালো জড়ুল ছিল বলে সে আজন্ম লুকোতে শিখেছে। পাখিরা রকের যুবকবৃন্দের মতো হা হা খা খা করে হেসেছিল বসন্তে বর্ষায়। জড়ুলের ওপর অনাহত চঞ্চুরা ঠুকরোবে বলে বায়না করে যেন। বুক দেখাবে? বুক দেখাতে পারবে চম্পকনগরের নষ্টসপ্তকী?
সত্যবতীকে ভেজাতে সে সময় আকাশে এসেছে শেষ রাতের জলজ মেঘ। সত্যবতী ঘুমের ভেতর শরীর গুটিয়ে আরো দ করে। যেন মীরাবাঈয়ের ঘুঙুরে বিষ মাখানো। একটি পদতলমুর্ছনায় সহসা ক্ষিপ্ত শঙ্খচূড় উন্মোচিত দাঁত বিঁধিয়ে দেবে মাংসে নরমে উহ্যে নীলে।
আকাশে মীরাবাঈ মেঘ তখন। নিচে পায়রাঘরের মেঝেয় আধার উল্টে টলমল পারদের ঝিলমিল ইতালিয়ান ট্রেমেলো। ছাদের পাশে জার্মান রীডের ষড়সপ্তযন্ত্র।
ও মীরাবাঈ ও মীরাবাঈ...
বৃষ্টি শুরু হল।