দশমীর দিনে সবারই একটু মন খারাপ থাকত বইকি! বিশেষ করে বাড়ির পুজো যখন। এই চারদিন তো আর কেবল ঠাকুরের পুজো ছিল তা নয়—আরও অনেক পরিবারের মতো এই পুজোর সময়টা ছিল আমাদের পারিবারিক মিলনের সময়ও। বৃহৎ পরিবার হবার জন্য এবং ক্রমে ক্রমে মানুষ চারিদিকে কর্মসূত্রে ছড়িয়ে পড়ার জন্য, বছরের এই একটা সময়েই ছিল যখন আমরা সবাই মিলতাম। যে যেখানেই থাকুক, বছরের এই ক-টা দিন সবাই চেষ্টা করত বাড়িতে ফেরার জন্য। আমি বিদেশ থেকেও বছরের এই একটা সময়েই আসার চেষ্টা করতাম। তবে বাঙালির এই ঘরে ফেরার গল্প খুব চেনা—এই সময় ফ্লাইটের টিকিট পাওয়া চাপের হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
দশমীর সকাল মনেই শেষ পুজো করে ঘট বিসর্জন—এবং সেই বিসর্জনের আগে সিঁদুরখেলা। তবে আমাদের বাড়িতে মেয়েদের সিঁদুরখেলা নিতান্তই আটপৌরে এবং আমাদের নিজেদের মতো করে ছিল—গালে এবং কপালে সিঁদুর লাগিয়েই কাজ চলত। এই এয়োস্ত্রীদের সিঁদুরখেলার উৎপত্তি, বিবর্তন এবং ক্রমশ বাণিজ্যিক বিবর্তন নিয়ে প্রবন্ধের ফাঁদের মধ্যেই আমরা ব্যস্ত ছিলাম নিজেদের মতো সিঁদুরখেলা অ্যাডাপ্ট করে নিতে। হালকা মজা হত ছেলেদের গালে/কপালে সিঁদুর লাগিয়ে, যদিও ছেলেদের গালে মাখানোকে মনে হয় সিঁদুরখেলা ঠিক বলা যায় না!
দশমীর দিনে সকালের দিকে আমরা ছেলেরা চান-টান করে ঘট ফেলতে যাবার জন্য প্রস্তুত হতাম—মেয়েরা চান-টান করে সাজতে বসত, বাকি সবার মতো অমৃতাও। তারপর একে একে জনতা ঠাকুরদালানে এসে বেলপাতায় ‘শ্রী শ্রী দুর্গা সহায়’ লেখা শুরু করত লাল চন্দন দিয়ে। সেই বেলপাতা ঠাকুরের পায়ে সমপর্ণ করে প্রণাম। জানি না কী কারণে অপরাজিত ফুলের ডাল দিয়ে গোল গোল রিঙের মতো বানিয়ে সেইসব রিং দুর্গা সহ তার সব ছেলেপুলে মায় অসুর-সিংহ-কে পর্যন্ত পরানো হত। বামুন ঠাকুর সেই রিংগুলো খুলে দিলে তা নিয়ে আমাদের ছেলে-মেয়ে-বউদের কাড়াকাড়ি। বলাই বাহুল্য দুর্গার হাতের রিং-এর ডিম্যান্ড খুব প্রবল ছিল।
বাঙালির দ্বারা কেন বিজনেস ঠিকঠাক হয় না তা আমাদের আচরণেই বোঝা যেত! লক্ষ্মীর হাতের মালা নিতে কাউকে তত বেশি উৎসাহী দেখতাম না যত বেশি ডিম্যান্ড দেখতাম সরস্বতীর হাতের সেই রিংগুলির। ফলত ছেলেপুলে পড়াশোনায় ভালো হল—কিন্তু লক্ষ্মীলাভ আর করে উঠতে পারত না! এর মাঝেই কোনো এক সময় দুধে-আলতা গুলে থালায় ঢেলে তাতে মা-দুর্গার মুখের এবং পায়ের প্রতিফলন দেখা, আঁচলে পুষ্পদান, যারা নিতে চাইত আর কি! ঘটনা জটিল। গোটা ব্যাপারটি ‘ঘট বিসর্জন’ নামেই প্রচলিত ছিল।
তো যাই হোক ইত্যাদি ফুল ফুল খেলা শেষ হলে—চারদিনের ফুল-মালা-পুষ্প সাফ করে ঝুড়িতে করে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন। যে পুকুরে সপ্তমীর পুজো শুরু হয়েছিল, সেখানেই আবার দশমীর দিন সকালে যাওয়া ঘট বিসর্জন দিতে। এবং পরে রাতের দিকে আবার যাওয়া ঠাকুর বিসর্জন করতে।
তো দল বেঁধেই যেতাম ঘট বিসর্জন করতে। আমাদের ছেলেছোকরাদের একটু তাড়া থাকত, কারণ ঘাট থেকে ফিরে আমাদের বাজি কিনতে যাবার জন্য বাইরে যেতে হত। ঘট বিসর্জন ছাড়াও এই দশমীর সকালে আরও একটা কাজ আমি খুব নিষ্ঠার সাথে করে এসেছি বহুদিন বা এখনও করি অনেক সময়। সেটা হল দধিকর্মা প্রস্তুত করা। খাবারদাবারের ব্যাপারে একটু বিশেষ টান থাকায় দধিকর্মা জিনিসটা আমি স্বেচ্ছায় নিজের আন্ডারে নিয়ে নিয়েছিলাম। কতটা চিঁড়ে লাগবে, কতটা মুড়কি, দুধ, চিনি, মাখা সন্দেশ, গুড়, নানাবিধ ফলমূল সেসবই জোগাড় হয়ে যেত। অন্যরা এই জিনিস প্রসাদস্বরূপ ভক্ষণ করলেও, আমি এত বেশি খেয়ে ফেলতাম যে দুপুরের খাওয়ার আর দরকার হত না!
ঘাট থেকে ফিরে, মুখে লেগে থাকা সিঁদুর তোলার জন্য আবার স্নান করে আমরা রওনা দিতাম বাজি কেনার উদ্দেশ্যে। বাজির ব্যাপারটা একটু লিখে ফেলা যাক, আগে এটাও মনে হয় সংক্ষেপে লিখেছিলাম নিমোর গল্প লেখার সময়।
আরও অনেক কিছুর সাথে দুর্গা পুজো মনে করিয়ে দেয় আমার রিসার্চ বিষয়ক প্রথম ব্যর্থতার কথা। বাড়িতে বাজি বানাতে গিয়ে—না, বাজি বানাতে ব্যর্থ হইনি, ব্যর্থ হয়েছিলাম হাতে বানানো রংমশাল আর তুবড়ির ধোঁয়া কমাতে। বানাতাম সেসব মাল জবরদস্ত, কিন্তু বড়ো বেশি ধোঁয়া হত। সে অনেক দিন আগেকার কথা।
একসময় আমাদের দাদারা লায়েক বয়েসে পৌঁছে ঠিক করল বাড়িতেই বোম-বাজি ইত্যাদি বানাতে হবে। আমরা তখন খুবই ছোটো। কানেকশন এল নেপালদার বন্ধু অদয়দার চেনা সূত্র ধরে—সেই মাস্টার-এর সাথে। মাস্টার নাকি কংগ্রেস জামানায় পেটো বানাত দুরদার—সিপিএম আমলেও বানাত, তবে খুব খাতির থাকলে তবেই। আমাদের পুরানো বাড়ির ছাদেই সেই বোম-বাজি বানানোর শুরু। তুবড়ির খোল কেনা আসত কুমোর বাড়ির থেকে—বাকি বোম বানানোর মালমশলা মেমারি বাজারের এদিক ওদিক হতে। সোরা, গন্ধক, অ্যালুমিনিয়াম/লোহাচুর, স্পাইরো পাউডার ইত্যাদি। তখন অত রেগুলেশন ছিল না সোরা (পটাশিয়াম নাইট্রেট) বিক্রি নিয়ে। পরে খুব কড়াকড়ি শুরু হয়, লাইসেন্স ছাড়া বিক্রি করা যাবে না এবং বিক্রি করলেও কতটা পরিমাণে ইত্যাদি। তবে সত্যি কথা বলতে কী সবই চেনাশোনা সার্কেলের জন্য জিনিস মার্কেটে থাকলে এবং বেআইনি না হলে মালমশালা পেতে কোনোদিন আসুবিধা হয়নি। তবে জমাটি কেস ছিল কাঠকয়লার বেলায়। সঠিক কাঠকয়লা বাজি বানানোর ক্ষেত্রে খুবই জরুরি যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা জানবেন। আর কোন্ পাগলা নাকি বলেছিল সবচেয়ে ভালো কাঠকয়লা হয় আকন্দ গাছের গুঁড়ি পুড়িয়ে!
এবার খোঁজ আকন্দ গাছ! তখনকার দিনে সবচেয়ে বেশি আকন্দ গাছ ছিল রেললাইনের গা বরাবর—নিমো রেললাইনের গা ঘেঁষে রসুলপুরের দিকে এগিয়ে গেলে অনেক আকন্দ গাছ। এবার যাও হাতে শাবল এবং কাঁধে বস্তা নিয়ে সেই আকন্দ গাছের গোড়া খুঁড়তে! বস্তা করে আকন্দ গাছের গোড়া এনে তা ঢালা হত খামারে গর্ত করে তার ভিতর—এরপর আগুন জ্বালিয়ে মাল দাও চাপা দিয়ে। ওই যে অন্তর্ধূম পাতন না কী বলে না! এক সময় আকন্দ গাছ কমে আসতে লাগল—তখন শিফট করা গেল কুল গাছের ডালে! সেই ডাল পুড়িয়ে নাকি ভালো কাঠকয়লা হয়। কুল ডাল পুড়িয়েও কাঠকয়লা বানিয়েছি দেদার।
আমাদের গ্রামে তখনও বিজলি আসেনি—মিক্সার তো দূরের কথা। সোরা বেটে দিত দিদিরা শিলনোড়ায়। রংমশলার ঠোঙা বানাতাম তখন কাগজ কেটে আমরা। মাস্টার মশালার ভাগ ইত্যাদি শিখিয়ে দিয়ে গেল গদা-কাকুকে। আমি ছিলাম গদা-কাকুর এক নম্বর সহকারী—গদা কাকু কয়েক বছর সেই দায়িত্ব নেবার পরেই ব্যাবসায় শিফট করে গেল। আর পুজোর সময় ব্যাবসা ছেড়ে আসা যায় না—ফলে সেই নাবালক বয়েসে আমার ঘাড়ে এসে পড়ল বোম-বাজি তৈরির গুরু দায়িত্ব! সেই হিসাবে দেখলে আমি যেই বয়স থেকে বাজি বানাচ্ছি, অনেকে সেই বয়সে বাজিতে হাত দিতে ভয় পায়!
একটা খাতা ছিল আমার—চুপিচুপি অনেক কিছু লেখা, সেই খাতাতেই ফর্মুলা লিখে রাখলাম—বোম-বাজির মশালার ভাগ। যত্ন করে চাবি দেওয়া থাকত সেই খাতা আলমারিতে—ইনফ্যাক্ট আমার পর, মানে আমি দেশ ছাড়ার পর ব্যাটন তুলে দেবার জন্য তেমন নির্ভরযোগ্য কাউকে পাইনি—ভায়েরা চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। আমার আন্ডারে কাজ করত তারা পুজোর সময় ঠিক আছে, কিন্তু নিজেরা আগ বাড়িয়ে পুজোর অনেক আগে থেকে সব কিছু ঠিক করে রাখা—এই সব পারত না। আমি বিদেশ চলে গেলাম-পুজোর অনেক আগে বাড়ি ফেরা আর সম্ভব হত না। ক্রমশ পুজোর খুব গায়ে গায়ে বাড়ি ফিরতে শুরু করলাম—অত দেরিতে গিয়ে আর বাজি বানানো সম্ভব নয়। একসময় বাজি বানানো বন্ধ হয়ে গেল বাড়িতে—আমরা দশমীর দিন বাজি কিনতে যেতে শুরু করলাম আমাদের গ্রাম থেকে কিছু দূরে গৌরীপুরে—চাচার কাছে। এবারেও যাব পুজোর সময় বাজি আনতে। এর কিছু বছর পর চাচার বাজি কারখানায় আগুন লেগে মেয়ে, চাচা নিজে অনেক পুড়ে যায়—তবে সে গল্প অন্য কোনো সময়ে।
বাজি কেনার টাকাপয়সা আসত কোথা থেকে? সেটাও একটা মজার ব্যাপার—বাড়ির ভিতরেই চাঁদা তোলা হয়। সবাই কনট্রিবিউট করে--বেশি চাঁদা দিতে হয় স্বাভাবিক ভাবেই বাড়ির জামাইদের। আর-একটা জিনিস বুঝতেই পারছেন, আমি চাকুরিতে ঢোকার পর বেশির ভাগ বাজির বাজেটই আমার পকেট থেকে যেত! মানে ছেলেপুলে সব ইচ্ছে করে ওভার বাজেট করত—এবং আমাকে সেই ভর্তুকি মেটাতে হত। সবটাই আনন্দের সাথে বলাই বাহুল্য। তো এই হল খুব ছোটো করে বাজি বানানোর গল্প।
ঠাকুর বিসর্জন করতে করতে প্রায় রাত বারোটার বেশিই হয়ে যেত। বিসর্জন করে আবার ঠাকুরবাড়িতে এসে পুরোহিতের কাছে শান্তিজল নেবার প্রথা ছিল। অত রাতে আর খাবার ইচ্ছে থাকত না—আর খেলেও একটু বিসর্জনের খিচুড়ি খেয়ে দুর্গাপুজোর পরিসমাপ্তি হত।
শুরু হত অপেক্ষা নতুন করে আরও এক বছরের!
কথায় বলে ঠাকুর জলে না পড়লে বিজয়া দশমী জানাতে নেই। আজ একাদশী - কাল রাতে ঠাকুর বিসর্জন করে এলাম।
সবাইকে জানাই বিজয়া দশমীর প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
জীবনে একটা সময় ছিল, যখন এইসব মুহূর্তগুলো সামনে থেকে কাটিয়েছি। সেই দিনগুলো ভেসে এলো। খুব ভালো লগল। বিজয়া দশমীর প্রীতি-শুভেচ্ছা-ভালোবাসা জেনো।