একদিন বিকেলের দিকে সলিলের বাড়িতে এসে হাজির ঋত্বিক দুজনে মিলে গ্র্যান্ড হোটেলে যাবে বলে। সলিল এমনিতে একটু লাজুক প্রকৃতির এই সব বড় জায়গায় গিয়ে বড় সড় লোকেদের সাথে দেখা করার ব্যাপারে। কিন্তু ঋত্বিক নাছোড়াবান্দা। দুজনে হাজির হলেন গ্র্যান্ড হোটেলের গেটে – কিন্তু তখনকার দিনের স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে দেশীয় ক্যাজুয়াল ড্রেস এবং হাওয়াই চপ্পল পরা সলিল-দের হোটেলের ভিতরে ঢুকতে বাধা দিল গেটের পাহারাদার।
- কোথায় যাচ্ছেন আপনারা?
- (ঋত্বিক আগ বাড়িয়ে ফট করে বললেন) তাতে তোমার বাপের কি?
সলিল দেখলেন কেস গড়বড় – নিজে ব্যাপারটা হাতে নিলেন ঋত্বিক-কে শান্ত করে।
- মানে পাহারাদার বাবু, আমরা পুদভকিন স্যারের সাথে দেখা করতে যাব।
- কি ভোকিন?
- পুদভোকিন
ঋত্বিক আর চুপ থাকতে না পেরে মাঝখান থেকে বলে উঠলেন,
- চেরকাশভ স্যার ও চলবে
পুদভোকিন আর চেরকাশভ দুই নামই দারোয়ানের কাছে জটিল ঠেকল –
- ঔর কৈ নাম হ্যায় কেয়া?
এমন সময় চেরকাশভ সুইমিং পুল থেকে উঠে বাথরোব লাগিয়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিলেন। সামনের ফিতেটা ভালো করে বাঁধা নেই। তাঁর চোখে পড়ে গেল সলিলের দিকে – দেখেই তিনি ছুটে এলেন
“আর রোকতো নই নই! আর ধ্বোংসো নই নই” গাইতে গাইতে। চেরকাশভ ছুটে আসছেন, খোলা গাউন উড়ছে দুইদিকে, সামনে ফাঁকা – অনেকে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, ঋত্বিক বলছেন ‘কি দেখিলাম গ্র্যান্ডে এসে’। প্রায় সাত ফুট সেই মানুষটা কাছে এসে ‘সালিল, সালিল’ বলে প্রায় কোলে তুলে নিজের রুমের দিকে নিয়ে গেলেন।
বেশ খানিক গল্পের পর চেরকাশভ আর পুদভোকিন বের করলেন ওঁদের সাথে করে আনা টিনের ক্যানের রাশিয়ান পিবা বা বিয়ার। আপনারা বললে বিশ্বাস করবেন না, সেই প্রথম সলিল এবং ঋত্বিক দুজনারই বিয়ার তথা মদ্যপান। আর সেদিন এক ক্যান বিয়ার খেয়েই ঋত্বিক পুরো আউট। চেরকাশভ আর পুদভোকিন খানিক পরে এক সভায় যোগদান করার জন্য বেরিয়ে গেলেন, কিন্তু এদিকে ঋত্বিকের নড়ার ক্ষমতা নেই! গ্র্যান্ড হোটেলের এক রুমের বারান্দায় সোফায় বসে প্রথম বারের মত মাতাল হওয়া ঋত্বিক নীচের কলকাতা দেখতে লাগলেন। কিন্তু কতক্ষণ আর বসে থাকবেন বারান্দায় চুপচাপ – তাই খানিক পরেই বিরক্ত হয়ে সলিল-কে বললেন, “এখানে বসে থাকার চেয়ে বরং চল গঙ্গার হাওয়া খেয়ে আসি”। এই বলে দুজনা হোটেল থেকে বেরিয়ে ইডেন গার্ডেন এর পাশ দিয়ে গঙ্গার ধারে এসে বসলেন। ঋত্বিক বলতে লাগলেন, “এ জিনিস কেন মানুষ খায়! আমি এই প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনে আর এই জিনিস ছোঁব না!”
বলাই বাহুল্য, আরো অনেক কিছুর মত এই বিষয়েও ঋত্বিক নিজের প্রতিজ্ঞা রাখতে পারেন নি। আচ্ছা, এবার প্রশ্ন উঠতে পারে খামোকা সেদিন সলিল আর ঋত্বিক গ্র্যান্ড হোটেলে গিয়েছিলেন কেন! সেটা পুরোপুরি বুঝতে হলে ব্যাকগ্রাউন্ডের কথা কিছু বলে নিতে হয়।
চল্লিশের দশকের শেষের দিক থেকেই গণনাট্য, গণসংগীত বা বামপন্থী ভাবধারা নিয়ে সলিল চৌধুরীর টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। এর মূলে ছিল পার্টির সাথে মতান্তর ইত্যাদি – এগুলো সবই খুব ভালো ভাবে ডকুমেন্টেড, মানে আমার নতুন করে কিছু লেখার নেই এই নিয়ে। হালকা টেনশনে হাওয়া দিয়ে দিয়েছিল ততকালীন পার্টি সম্পাদক অজয় ঘোষের ডায়লগ, “সংস্কৃতি ফংস্কৃতি নিয়ে এখন ভাবার সময় নেই, নেতৃত্ব রদবদলেরও প্রয়োজন নেই। যা চলছে চলুক!”
এমনিতে তখন সলিল, ঋত্বিক আর মৃণাল প্রায় একসাথেই ঘোরাফেরা করতেন – বন্ধু সব। এর মধ্যে মৃণাল তখন যতদূর সম্ভব মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ এর কাজ করতেন, সলিল আর ঋত্বিক প্রায় কাঠ বেকার। একদিন সন্ধ্যের দিকে সলিল গেছেন ৪৬নং ধর্মতলা স্ট্রীটে – মৃণাল অন্য কাজে ব্যস্ত তাই আস্তে পারে নি, সাথে শুধু ঋত্বিক। তখন বাজারে বেশ সাড়া ফেলেছে এইচ এম ভি থেকে বেরুনো সন্ধ্যা মুখার্জির গলায় সলিলের গান – “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দেব মেপে”। এমনিতে তখন গণনাট্যের লোকে মুখে ফেরা যত গান প্রায় সবকটাতেই সলিলের অবদান আছে – তা সে সুকান্তের লেখায় সুর করাই হোক, বা নিজের লেখা এবং সুর দেওয়া। তাই এমনিতে পার্টির সাধারণ কর্মীরা গান বাজনার ব্যাপারে সলিলের মুখের উপর কিছু বলত না।
কিন্তু ওই যে অজয় ঘোষ একদিন বলে দিলেন “সংস্কৃতি ফংস্কৃতি নিয়ে এখন ভাবার সময় নেই – যা চলছে চলুক”। ব্যাস এই বাক্য পার্টি কর্মীদের অনেকেই নিজের মত ইন্টারপ্রেট করে নিলেন – ‘যা চলছে চলুক’ এর বদলে হয়ে গেল ‘যার যা মনে হয় করুক’। এর ফলে সলিলের গান নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু হয়ে গেল। “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে” গানটায় একটা লাইন ছিল “হায়, বিধি বড়ই দারুণ”। কিছু পাবলিক আপত্তি শুরু করল যে কমিউনিষ্ট শিল্পীদের গানে ‘হায় বিধি’ বলে ভগবানের নাম নেওয়া হবে কেন? সলিল বললেন, “তাহলে, ‘আল্লা মেঘ দে, পানি দে” কি করে গাইছেন?” – তাঁকে বলা হল ওই গান প্রচলিত, তাই চলবে। কিন্তু সলিল এখন গান লিখছেন, তাই বিধি চলবে না।
সেদিন ৪৬নং ধর্মতলা স্ট্রীটের মিটিং রুমে বসে সলিল এই সব অভিযোগ শুনে মনে মনে ফুঁসছেন, মুখে বিশাল কিছু বলছেন না। ঋত্বিক তখনো মদ খাওয়া শুরু করেন নি – শুধু বিড়ি খেতেন। একটা বিড়ি ধরিয়ে সলিলের কানের কাছের মুখ নিয়ে গিয়ে বললেন, “বুঝলি সলে, এই গাধাগুলোর সাথে বেশীদিন থাকা যাবে না আর”। সলিল মুখ খুলে উত্তর দিতে যাবেন, এমন সময় এক পার্টির সদস্য এগিয়ে এসে বললেন –
- বলছিলাম কি, ‘বিধি’ ইত্যাদি তো পরের কথা। আপনার গানের সুরের স্ট্রাকচারটাই ঠিক নেই!
সলিল বাবু শুনে হাঁ – তবু শান্ত ভাবে জানতে চাইলেন –
- কেমন শুনি একটু
- আপনার এই গানটার স্কেল ঠিক নেই। ডি শার্পে ভালো যেত, ফালতু আপনি স্কেল চেঞ্জ করে ঝুলিয়েছেন!
এবার ঋত্বিক বিড়ি মুখে আরো বড় হাঁ! বিড়ি ঠোঁট থেকে নামাতে ভুলে গিয়ে প্রায় ঠোঁট পুড়িয়ে ফেললেন। যদিও পরে সলিল বাবু লিখেছেন পার্টি থেকে পুরোপুরি সরে আসার কারণ ১৯৫১ সালে তাঁর বাবা মৃত্যু এবং বিধবা মা সহ চার ভাই বোনের ভার নিতে টাকা পয়সা ইনকামে মন দেওয়া। কিন্তু আসল ব্যাপার হল সেইদিন সন্ধ্যের ডি-শার্প বিষয়ক অ্যাডভাইস। সেটাই ছিল কফিনের শেষ পেরেক।
আর সলিল চৌধুরীর বাবা মারা যাওয়া ছাড়াও ১৯৫১ সাল বাঙালীর আরো একটা কারণে মনে রাখা উচিত – এই বছর থেকেই ঋত্বিক ঘটক মদ খেতে শুরু করেন। এই বছরেই কলকাতায় এলেন পৃথিবী বিখ্যাত চিত্র পরিচালক পুদভকিন আর ততোধিক বিখ্যাত অভিনেতা চেরকেশভ। এঁদের বেশ কিছু সম্বর্ধনায় সলিল এবং ঋত্বিক দুজনাই গিয়েছিলেন এবং সলিল নিজের লেখা ও সুর করা গান শুনিয়েছিলেন। সেই গান খুব ভালো লেগে গিয়েছিল চেরকেশভ এর। উনারা উঠেছিলেন ধর্মতলায় গ্র্যান্ড হোটেলে - সলিল আর ঋত্বিক-কে হোটেলে আমন্ত্রণ জানালেন, “চলে আসুন একদিন - গল্প-সল্প হবে”।
তো এই হল সেদিন সলিল-ঋত্বিকের গ্র্যান্ড হোটেল যাবার কারণ। আবার ফিরে আসা যাক, সেদিনের গ্র্যান্ড হোটেলের ঘটনায়। দুজনা তো হোটেল থেকে বেরিয়ে গঙ্গার দিকে এগিয়ে গেলেন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে – গঙ্গার ওপারে সূর্য অনেক ক্ষণ ডুবে গ্যাছে। আলো জ্বলে উঠে কলকাতা হয়ে উঠেছে আরো মোহময়। দুই বন্ধু গঙ্গার ধারে পা ঝুলিয়ে গল্প করতে লাগলেন। এক সময় ঋত্বিক বলে উঠলেন –
- হ্যাঁরে, ঢ্যাঙার সাথে রিসেন্টলি দেখা হয়েছে তোর? চিদু-র সাথে ফিল্ম সোসাইটি তো ফাঁদলো, কিন্তু তার পর করছেটা কি?
- শুনলাম সিগনেট প্রেসে কাজ করছে। খুব ভালো নামও করেছে শুনলাম
- আরে সে তো আমিও শুনেছি। ভিতরের খবর জানতে চাইছি
- ভিতরের খবর আমি কি করে জানবো! আশ্চর্য তো!
- তোরই তো জানার কথা! তোর কি সব শান্তিনিকেতনের কানেকশন আছে না? ঢ্যাঙা তো ওখান থেকে পড়াশুনা করে এসেছে শুনেছিলাম
- ভাই, আমার শান্তিনিকেতনে কোন কানেকশন নেই তেমন
- কেন, এই তো তুই কিছু দিন আগে সুচি-কে (সুচিত্রা মিত্র) দিয়ে কি একটা গান গাওয়ালি। কি গান যেন?
- “আমাদের নানান মতে নানান দলে দলাদলি” আর “ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে”
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই দুটোই। তাহলে বলছিস কেন যে তোর কানেকশন নেই ওখানে?
- তুই কি জানিস না যে সুচি শান্তিনিকেতনে থাকে না?
- তাহলে মোহর-দি? তুই তো উনাকে দিয়ে গান গাওয়াবি বলে উঠে পরে লেগেছিলি
- তা লেগেছিলাম, কিন্তু কিছুদিন আগে মোহর দি চিঠি দিয়ে জানালেন, “ভাই সলিল কিছু মনে কোরো না – আমি যদি তোমার গান গাই, তাহলে শান্তিনিকেতনে আমার থাকার অসুবিধা হয়ে যাবে। কর্তৃপক্ষ তেমনি হিন্টস দিয়েছে সেদিন”। আমরা কমুউনিষ্ট বলে এই ফ্যাসাদ হয়েছে বুঝলি না?
- হুম, তা ভালোই করেছিস মোহর-দিকে এর মধ্যে আর টেনে না এনে।
- কিন্তু ঢ্যাঙার উপর যদি তোর এতই ইন্টারেষ্ট, তাহলে নিজে খোঁজ নিচ্ছিস না কেন? আর কি ব্যাপারে তোর খোঁজ চাই বলতো ঠিক?
- সত্যি বলতে কি ঢ্যাঙার সাথে ঠিক পোষায় না। কিছুদিন আগে কমল-দা বলল একটা হাতচিঠি ওর বাড়িতে দিয়ে আসতে। কি একটা সিনেমা নিয়ে ভাবছে, তার জন্য কিছু তথ্য জানতে চেয়েছিল কমল-দার কাছে। তা, আমি ঢ্যাঙার বাড়িতে গিয়ে দেখলাম ব্যাটা পাজামা পরে আছে
- তাতে কি হল?
- তেমন কিছু নয়, তবে আমি নিজে সেই বাঙালি-কে ঠিক ভরসা করে উঠতে পারি না যে বাড়িতে লুঙ্গি না পরে পাজামা পরে থাকে!
- এটা কোন যুক্তি হল?
- আহা, তার পরের ঘটনাটা শোন। আমি আর সেদিন বাড়িতে ঢুকলাম না। দরজার কাছে চিঠি-টা ঢ্যাঙার হাতে দিয়ে একটা বিড়ি ধরাতে পকেটে হাত দিয়ে দেখি বিড়ি শেষ। ঢ্যাঙা-কে বললাম “একটা বিড়ি হবে তোমার কাছে”? বলে কি, “আমি তো বিড়ি খাই না! সিগারেট চলবে?”। সলে, আমি এই লিখে দিচ্ছি তোকে, ঢ্যাঙা কদিন পর থেকেই চুরুট ধরলো বলে!
- কিন্তু তুই ঢ্যাঙা-কে নিয়ে এত অবসেসড টাইপের হয়ে যাচ্ছিস কেন?
- অবসেসড নয় রে। যাই বলিস, কলকাতার বুকে যে দু-তিনজন সিনেমাটা বোঝে ঢ্যাঙা তার মধ্যে একজন। তাই যবে থেকে শুনলাম যে সে ছেলে সিনেমা করবে বলে উঠেপড়ে লেগেছে, তবে থেকে আমারও ইন্টারেষ্ট বেড়েছে।
গল্প করতে করতে বেশ রাত হয়ে এসেছে। এক ক্যান বিয়ারের নেশা প্রায় কেটে আসছে ঋত্বিকের। উঠবো উঠবো করছেন দুজনে, এমন সময় এক ঠ্যালাওয়ালা রিক্সাচালক এসে পাশে ঠ্যালা রিক্সাটা রেখে একটা বিড়ি হবে কিনা জানতে চাইলো। কেউ বিড়ি চাইলে নিজেদেরও বিড়ির তেষ্টা বেড়ে যায় – এ এক ইউনিভার্সাল সত্য। তখন সলিল, ঋত্বিকও ভাবলেন বাড়ি ফেরার আগে আর একটা করে বিড়ি টেনে নেওয়া যাক। বিড়ি খেতে খেতে তিনজনে গল্প জুড়লেন। রিক্সাচালকের সাথে কথা বার্তা শুনে তাঁরা জানতে পারলেন যে আসলে সেই রিক্সা চালক কিছু দিন আগেও বিহারের দিকের এক গ্রামে ক্ষুদ্র কৃষক টাইপের ছিল – নিজের ছিল খুব কম জমি, তাই নিজের জমি ছাড়াও অন্যের জমিতে কাজ করে তার দিন চলত। কিন্তু কিছুদিন বাদে জাত-পাত নিয়ে কি ঝামেলাতে গ্রামের মুখিয়ারা তাকে গ্রাম ছাড়া করে। তাই কোথায় আর যাবে – এই কলকাতায় ভাগ্যের সন্ধ্যানে এসে রিক্সা চালাতে শুরু করে।
সেদিনকার মত হালকা নেশা কেটে গেলেও, রিক্সা চালকের গল্প মনে রাখার মত অবস্থায় ঋত্বিক ছিলেন না। কিন্তু সলিল-কে গ্রামের এই গরীব কৃষকের গল্পটি নাড়া দিয়ে দিল। বাড়ি ফিরেই এর উপরে ভিত্তি করে লিখতে শুরু করলেন এক গল্প। এক সপ্তাহের কাটাছেঁড়ার পর দাঁড়ালো সেই বিখ্যাত গল্প ‘রিক্সাওয়ালা’। এর পরের ঘটনা আপনারা সবাই জানেন – সলিলের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল এক রিক্সাওয়ালার গল্প। সলিল বাবুর সাথে বেশ অনেক দিনেরই চেনাশুনা ছিল হৃষিকেশ মুখার্জীর যিনি তখন বোম্বেতে কাজ করছিলেন বিমল রায়ের সাথে। ‘রিক্সাওয়ালা’ গল্প লেখা শেষ হবার কিছুদিনের মধ্যেই কি এক কাজে বিমল রায় আর হৃষিকেশ মুখার্জী দুজনেই একসাথে কলকাতা এসেছিলেন। মৃণাল বা ঋত্বিকের মত গলায় গলায় ইয়ার না হলেও হৃষিকেশ কলকাতায় এলেই সলিলের সাথে দেখা করতেন। ঋত্বিকের সাথেও দেখা করার চেষ্টা করতেন – কিন্তু তখনো পর্যন্ত বোম্বেই হোক বা বিদেশের, জামজমক ব্যাপার ঋত্বিক এড়িয়ে চলতেন। ওদিকে আবার হৃষিকেশ নেশা টেশা তেমন করেন না – ফলে সলিলের সাথে দেখা করতেন তাঁর অন্য এক প্রিয় জায়গায়।
অন্য কিছু নেশা না থাকলেও হৃষিকেশ এবং বিমল রায় – দুইজনেরই ছিল মিষ্টির প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ। তাও যে সে মিষ্টী নয় – একবার এই দুজন গ্র্যান্ড হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আজকে যেখানে কিডস স্ট্রিট সেখানে এক দোকানের খোঁজ পেয়ে গেলেন যে গরম কালে দারুন কুলফি ও লস্যি বিক্রী করত। সেই জিনিস খেয়ে হৃষি ও বিমল দুজনেই ফিদা। এবং একদিন দোকানের কাঠের বেঞ্চে বসে দুগ্লাস করে সাঁটিয়ে লক্ষ্য করলেন প্রচুর লোক দোকানে এসে শুধুই ‘বালুসাই’ নামক মিষ্টি কিনে নিয়ে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন সেই দোকানের বিখ্যাত মিষ্টি হল দানাদার – তা তেনারাও পরখ করে খেলেন। খেয়েই ততোধিক ফিদা! তারপর থেকে এদিকে এলেই হৃষিকেশ বা বিমল বাবুর এই দোকান থেকে বালুসাই খাওয়া মাষ্ট ছিল। একটু ফাষ্ট ফরোয়ার্ড গল্প বলে নিই ভুলে যাওয়ার আগে, ১৯৫৮ সালে যখন মধুমতি বিশাল হিট করল, তখন বোম্বেতে সাকসেস পার্টিতে বিশেষ আকর্ষণ ছিল এই বালুসাই! সলিল বাবুকে কলকাতা এসে নিয়ে যেতে হয়েছিল সেই বালুসাই! কথিত আছে স্বয়ং দিলীপকুমার ও নাকি সেই বালুসাই খেয়ে প্রবল ইমপ্রেসড হয়ে রেসিপি জানতে চেয়েছিলেন!
যাই হোক, আবার রিক্সাওয়ালার গল্পে ফিরে আসা যাক – সেবারে কলকাতা এলে হৃষিকেশ বাবুর সাথে সলিল দেখা করলেন কিডস রোডের মিষ্টির দোকানেই। শোনালেন রিক্সাওয়ালা গল্পটি। গল্প শুনেই হৃষিকেশ বাবু পোটেনশিয়াল বুঝতে পারলেন – বললেন, “আজকে বিমলদা একটু কাজে বেরিয়েছে। সলিল তুমি কাল সকালে এই এক প্যাকেট বালুসাই নিয়ে সোজা চলে এসো হোটেলে বিমলদার সাথে দেখা করতে”। তা পরের দিন সলিল বাবু গিয়ে বিমলদাকে গল্প শোনালেন। বিমল বাবু বালুসাই খেতে খেতে সেই গল্প শুনলেন – গল্প শেষ হল, বালুসাইয়ের প্যাকেটও ফাঁকা। বিমল বাবু সলিলকে পরে দিন সকালে আবার আসতে বললেন গল্পটি নিয়ে আলোচনা করবেন বলে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ সেই দিন রাতেই এক জরুরী কাজে বিমল রায় কলকাতা ছাড়লেন। কিন্তু তিনি সলিলের গল্প ভোলেন নি। কয়েকমাস পরে সলিল এক চিঠি পেলেন বিমল রায়ের কাছ থেকে বোম্বে এসে গল্পটি নিয়ে সিনেমা বানাবেন সেই চিন্তাভাবনায় অংশগ্রহণের জন্য।
ততদিনে সলিল চৌধুরীর বাবা মারা গ্যাছেন – মা সহ বাকি চার ভাই বোনকে সামলে কি ভাবে সংসার চালাবেন সেই নিয়ে বিশাল ভাবনায় পড়েছেন। ওদিকে বামপন্থা এবং গণনাট্য নিয়ে হয়েছে মোহভঙ্গ – এমন অবস্থায় ১৯৫২ সালে কলকাতা থেকে বোম্বে পাড়ি দিলেন সলিল চৌধুরী। বলা যেতেই পারে যে আজকের দিনে বসে আমরা যে সর্বভারতীয় এবং জনপ্রিয় সলিল চৌধুরী-কে চিনি, সেই সলিলের জন্ম হল বোম্বে আসার সাথে সাথে।
প্রথম প্রথম বোম্বে এসে একটু মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এখানকার সিনেমা জগত যেন অনেক অন্য – তবুও হৃষি এবং বিমলদার গাইডেন্সে খুব একটা খারাপ কাটছিল না দিন। কাজ পুরোদমে চলছিল – পরের বছরেই, ১৯৫৩ সালে মুক্তি পাবে সলিলের সুরে প্রথম হিন্দী ছবি ‘দো বিঘা জমিন’, যা কিনা ‘রিক্সাওয়ালা’ গল্পেরই রূপান্তর। ১৯৫২ সালে যখন প্রথম প্রথম বোম্বে এসেছিলেন তখন প্রায়ই বিকেলের দিকে সময় পেলে সলিল বাবু জুহু বীচের ফাঁকা দিকটাই গিয়ে বসে থাকতেন। সমুদ্রের ঢেউ আর পড়ন্ত সূর্যের আলো দেখতে দেখতে কত কিছু ভাবতেন – মনে চলে আসত নতুন কিছু সুর, গানের কলি।
একদিন এমনই এক পড়ন্ত বিকেলে সলিল চৌধুরি বসে আছেন জুহু বীচে – বিশেষ ভীড় নেই। একটু দূরে এক ঠ্যালাওয়ালা শসা বিক্রী করছে। খানিক পরে দেখলেন একটু দূরে এসে এক প্যাণ্ট শার্ট পরা মেয়ে বসল – বছর কুড়ি-পঁচিশের মধ্যেই বয়স হবে। তখনকার দিনে বোম্বে হলেও তত প্যান্ট শার্ট পরা মেয়ে দেখা যেত না। তাই একটু চোখ টানল সলিল বাবুর। যাই হোক, নিজের ভাবনায় মন দিলেন সলিল। খানিক পরে সমুদ্রের আওয়াজের সাথে যেন মিশে গিয়ে তাঁর কানে এল গানের সুর। পুরো সঠিক গান শোনা যাচ্ছে না, কেবল চড়ায় গলা উঠলে ওদিক থেকে হাওয়া বইলে হাওয়ার সাথে গানের কলি ভেসে আসছিল। চড়ায় গলার স্টেবিলিটি শুনে সলিল বুঝলেন এই মেয়ে যেই হোক, গান ভালোই জানে। কিন্তু হাঁ করে তাকিয়ে থাকা অশোভন হবে বলে, শুধু কান পেতেই রইলেন। আরো খানিক গান গাইবার পর মেয়েটি উঠে গিয়ে শসা খেতে গেল। সলিল বাবু আর ওদিকে মন দিলেন না।
খানিক পরেই হালকা কথা কাটাকাটির শব্দ কানে এল সলিলের। যদিও তখনো মারাঠি একদমই জানতেন না – কিন্তু এগিয়ে গিয়ে বুঝলেন শসা খেয়ে মেয়েটি দাম দিতে পারছে না। কারণ ভ্যানেটি ব্যাগ খুলে দেখছে যে তাতে মানিব্যাগ নেই! শসাওয়ালাকে মেয়েটি বারবার বলছে যে আমি কাল এসে ঠিক দাম দিয়ে যাব – কিন্তু শসাওয়ালা নাছোড় বান্দা, সে বলছে, “তোমাদের মতন মেয়েদের আমি এখানে রোজ দেখছি, কেউ আর পয়সা দিতে ফিরে আসবে না”। সলিলবাবু মানবিকতার খাতিরে নিজের পকেট থেকে শসার দাম মেটালেন। মেয়েটি অনেক কৃতজ্ঞতা জানালো – বললো যে, “দেখুন না, আমার বোন ঠিক পার্স বের করে নিয়েছে কিছু পকেট মানি সরাবে বলে! তাই বাইরে বেরিয়ে এমন অপ্রস্তুত হতে হল”। মেয়েটি পয়সা ফেরত দেবার কথা বললেও সলিল-বাবু বললেন এই বিশাল বোম্বে শহরে শসার দাম পাবার জন্য দেখা করতে গেলে তা ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাবার মত হবে! পড়ন্ত বিকেলে শুধুই মেয়েটির মুখের আদল টুকু দেখে সেদিনের মতন জুহু বীচ ছাড়লেন সলিল।
এর পরের গল্প তো আপনাদের সবারই জানা – ১৯৫৮ সালে ‘মধুমতি’ সিনেমা তুলে দিল সলিল চৌধুরিকে খ্যাতির শিখরে। তার পর থেকে প্রায় ১৯৭৫-৭৮ সাল পর্যন্ত উনাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। এর মধ্যেই বিমল বাবুর কাছে সুপারিশ করে কলকাতা থেকে ঋত্বিক-কে আনিয়েছিলেন, সে এসেছিল বোম্বে আর ফিরেও গিয়েছিল কলকাতা নিজে সিনেমা বানাবে বলে। কিন্তু ততদিনে সলিল-কে অবাক করে সেই এক ক্যান বিয়ার খেয়ে মাতাল হয়ে যাওয়া ঋত্বিক, পাঁড় মাতালে পরিণত হয়েছে। মৃণাল কোনদিন বোম্বে এসে থাকতে চায় নি। সলিল নিজের কাজে এত ব্যস্ত হয়ে গেলেন যে পুরানো সুতোগুলো আস্তে আস্তে আলগা হয়ে গেল।
কিন্তু সময় তো আর চিরদিন সবার এক থাকে না। ১৯৭৮ সালের পর থেকে সলিলের হাতে কাজ কমতে থাকল। লোকে অভিযোগ করতে লাগল যে আপনার গানে রিপিটেশন চলে এসেছে, নতুন কিছু দেবার নেই আপনার ইত্যাদি। যারা একদা কাছের লোক ছিল, তারা অনেকেই খোঁজ রাখা বন্ধ করল। প্রথম প্রথম আঘাত পেলেও জীবনে অনেক সংঘর্ষ করে বেড়ে ওঠা সলিল মানিয়ে নিলেন নিজেকে আসতে আসতে। পড়াশুনায় মন দিলেন, টুকটাক লেখা লিখি – প্রতিষ্ঠিতরা বেশীর ভাগই ভুলে গেলেও লতা কিন্তু ভোলেন নি তাঁর সলিল-দা কে। নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ রাখতেন বা সময় পেলেই দেখা করতে আসতেন।
তেমনি এক বিকেলে বাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে লতা আর সলিল চা খাচ্ছেন। আজকাল সলিল অনেক নষ্টালজিক গল্প করেন। সেদিন কি মনে হতে বললেন –
- জানো লতা, অনেক দিন বলব বলব করেও বলা হয় নি। তোমাকে দেখে মাঝে মাঝে আমার ‘দে-জা ভ্যু’ হয়?
- দে জা ভ্যু কি জিনিস দাদা? কোন বংগালী মিষ্টি আছে নাকি?
- না গো লতা। এর মানে তোমাকে কোথায় যেন আগে দেখেছি এমন ফিলিং
- তাই নাকি? একটু খুলে বলেন দাদা। বেশ ইন্টারেষ্টিং তো
- হ্যাঁ, তখন আমি বোম্বে সবে এসেছি। একদিন বিকেলে জুহু বীচে এক মেয়ের সাথে দেখা হয়ে যায় – যার গানের গলা খুব সুন্দর। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল বলে মুখটা খুব ভালো করে দেখা হয় নি। কিন্তু পরে মনে হয়েছে তার মুখের আদলটা অনেকটা তোমার মতন। অবশ্য সে প্যান্ট শার্ট পরেছিল।
এই বলে সলিল সেদিনের জুহু বীচের ঘটনাটি বললেন। সব শুনে লতা হেসে বললেন –
- দাদা, ওটা আমিই ছিলাম। আমি কিন্তু পরে স্টুডিওতে আপনাকে প্রথম দেখেই চিনতে পারি। কিন্তু আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি বলে আর নিজে থেকে কিছু বলি নি!
- সে কি! ওটা তুমি ছিলে! কিন্তু সে মেয়ে তো প্যান্ট শার্ট পরা! তোমাকে তো আমি কোনদিন শাড়ি ছাড়া দেখি নি!
- (লাজুক হেসে লতা) দাদা, ওইটা বলতেই লজ্জা করছিল বলেই আর আপনাকে কোন দিন মনে করাই নি। আমার না মাঝে মাঝে খুব প্যান্ট শার্ট পরতে ইচ্ছে হত! তখন আশার প্যান্ট-শার্ট পরে আমি একটু চুপি চুপি ঘুরে আসতাম।
- আচ্ছা বুঝেছি, তাহলে সেদিন তোমার ভ্যানেটি ব্যাগ থেকে পার্সটা আশাই সরিয়েছিল!
দুজনা খুব হাসতে লাগলেন। ভারতের দুই শ্রেষ্ঠ সংগীত প্রতিভার হাসিতে বাতাসে যেন মূর্চ্ছনা উঠলো – বোম্বের কোন এক ফ্ল্যাটের বসার ঘর থেকে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।