বাঙালী লেজেন্ডারি ডাক্তারদের নাম করতে গেলে যাঁদের নাম সর্বপ্রথমেই মনে আসবে সেই দুজন হলেন নীলরতন সরকার এবং বিধান চন্দ্র রায়। বিধান রায়কে নিয়ে অনেক লেখা পত্র ছড়িয়ে থাকলেও, নীলরতন বাবুর জীবন নিয়ে তেমন আলোচনা দেখা যায় না। উনি নিজে স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন – কিন্তু একবার চেনা জানা হয়ে গেলে তাঁর মুখ থেকে শোনা যে কত কিছু ঘটনা যা তিনি তাঁর চমকপ্রদ এবং ঘটনা বহুল জীবনে দেখে এসেছেন। সেই সব ঘটনা তিনি যাঁদের বলতেন, তাঁরা কেউ সেগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখেন নি। ফলতঃ এগুলো প্রায় মুখে মুখে ঘোরা ঘটনা হয়েই পাক খেয়ে যাচ্ছে।
আজকের ঘটনা নীলরতন বাবুর সাথে বিধান রায়ের চেনা পরিচয়, স্নেহের সম্পর্ক সেই সব নিয়ে। বিধান বাবুর কাছের লোকের কাছ থেকে শোনা সব। এর পরে কোনদিন সময় পেলে শুধু নীলরতন বাবুর ডাক্তারি জীবনের গল্প শোনাবো, যা তিনি বিধান রায়কে বিকেলে চা খেতে খেতে গল্প করার সময় বলে গিয়েছিলেন ‘ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজের’ এক ঘরে।
নীলরতন বাবু বয়েসে প্রায় বছর কুড়ি বড় ছিলেন বিধান রায়ের থেকে। ভালোবেসে তিনি বিধান রায়কে ‘বিধে’ বলে ডাকতেন আর একদম ভাইয়ের মত ভালোবেসে তুই বলেই সম্বোধন করতেন। সেই ভালোবাসা ছিল রেসিপ্রোক্যাল – কুড়ি বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও বিধান রায় ডাকতেন ‘নীলুদা’ বলে। প্রথম থেকে আলাপের পরেই নীলরতন বাবু বুঝে গিয়েছিলেন যে বিধান রায় খুবই প্রতিশ্রুতিবান ছাত্র এবং কালে কালে খুব নামকরা ডাক্তার হবে যদি ঠিক ঠাক গাইড করা যায়। তাই তিনি নিজে থেকেই বলেছিলেন, “বিধে, সময় পেলেই বিকেলের দিকে আসিস হাসপাতালে আমার রুমে। রাউন্ড দেবার আগে তোর সাথে চা খেতে খেতে বিশেষ কেস গুলো নিয়ে আলোচনা করব”।
তা এমন সুযোগ কি আর হাতছাড়া করেন বিধান রায়! তাঁরও শেখার আগ্রহ প্রচুর, প্রায় প্রতিদিন সময় পেলেই ছুটতেন ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজে – যাকে আপনারা আজকে নীলরতন মেডিক্যাল কলেজ বলে চেনেন। ১৯৫০ সালে ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল কলেজের নাম বদলে নীলরতন বাবুর নামে রাখা হয় – কারণ এখানকারই কৃতি ছাত্র এবং ডাক্তার ছিলেন নীলরতন বাবু। যদিও পরের দিকে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে নিজের প্র্যাক্টিস থেকেই প্রায় লেজেন্ডারি স্ট্যাটাস অর্জন করতে পেরেছিলেন তিনি। ১৯০৯ সালে বিধান রায় বিলেতে পড়তে যাবার আগে পর্যন্ত নিয়মিত আসতেন এখানে তাঁর প্রিয় নীলু-দার সাথে দেখা করতে – চলত গল্প আর সাথে ট্রেনিং।
তেমনি একদিন বিকেলের দিকে নীলরতন বাবুর রুমে বিধান রায় ঢুকলে তিনি বলে উঠলেন –
- বিধে, আজকে চায়ের সাথে কিছু খেতে ইচ্ছে করতে। কি খাওয়া যায় বলত?
- বলো কি খাবে নীলু-দা। গুটকে কচুরী আনাবো?
- না, আজ আর কচুরী ভালো লাগছে না। রোজই তো প্রায় ওই খাওয়াস!
- তাহলে কি সমোসা খেবে আজ?
- ওই সব জাপানী খাবার আমার একদম পছন্দ নয়। তাছাড়া দুধ চায়ের সাথে জাপানী খাবার যায় না। গ্রীণ টি হলে নাহয় ভাবা যেত!
- নীলু-দা, সমোসা ভারতীয় খাবার। সিঙাড়া বলতে পারো!
- তাহলে সিঙাড়া বলতেই কি হয়েছিল!
- হালকা একটা পার্থক্য তো আছেই।
- কি পার্থক্য?
- লোকে বলে খোসা সুদ্ধ আলু চটকে ভিতরের পুর বানালে সেটা নাকি সিঙাড়া আর খোসা ছাড়া আলু চটকে পুর বানালে সেটা সমোসা!
- তোকে এতদিন এই শেখালাম? ‘লোকে বলে’ আবার কি! শুধু অনুমানে কোনদিন ভালো ডাক্তার হওয়া যায় না! নিজের সিদ্ধান্তকে ব্যাকআপ দিতে নিজে হাতে যাচাই করে দেখতে হবে। হাতে করে কোনদিন সিঙাড়ার ব্যবচ্ছেদ করে দেখেছিস যে ‘লোকে বলে’ যেটা সেটা সত্যি কিনা?
হালকা ঝাড় খেলেন বিধান রায়। সেদিন সমোসা-র অর্ডারই দেওয়া হল। আসতে খানিক সময় লাগবে – এই সময়টা গুরু শিষ্যের ডাক্তারি ডায়াগোনিসিস নিয়ে আলোচনা হয়। নীলরতন বাবু বললেন –
- তা বিধে, নতুন কিছু ইন্টারেষ্টিং কেস দেখলি
- দাদা, হয়ত তেমন অর্থে ইন্টারেষ্টিং নয়, কিন্তু বেশ শেখার আছে। আজকের তোমার পরামর্শের সূত্র ধরেই বুঝতে পারলাম, এখনো কত কিছু শেখার আছে
- কি হয়েছে
- আর বোলো না। গতকাল এখান থেকে চা খেয়ে গিয়ে ওয়ার্ডে গিয়েছি, এক ভদ্রলোককে নিয়ে তার পরিবার হাজির, পেটে প্রচুর যন্ত্রণা। বসতে পারছে না একদম – ছটফট করছে। আমি দেখে টেখে যা বুঝলাম, এর আপেন্ডিক্স গেছে, জরুরী অপারেশন করতে হবে। কিন্তু ওদিকে অপারেশন থিয়েটার খালি নেই
- অন্য কিছু টেষ্ট করালি না? অপারেশন টেবিলে তুলে দিবি একেবারে?
- কি টেষ্ট করাবো? কোন মর্ডান মেশিন তো নেই তুমি জানো! এদিকে ভদ্রলোক বসতে পারছেন না। বেশ অবাক ব্যাপার, হাঁটাচলা করলে নাকি উনার কষ্ট কম হচ্ছে। আমি সেই দেখে উনার পরিবারকে বললাম, এনাকে একটু করিডোরে হাঁটান, এক ঘন্টার মধ্যে অপারেশন থিয়েটর খালি হয়ে যাবে, তখন অপারেশন করে দেবে। এই বলে আমি অন্য রুগী দেখতে চলে গেলাম
- তা এর মধ্যে বিশেষ শেখার কি পেলি?
- পুরোটা শুনবে তো! রাউন্ড মেরে ফিরে সে দেখি সেই ভদ্রলোক বাড়ি যাবার তোড়জোর করছেন। যন্ত্রণা একদম কমে গেছে!
- কি করে কমল!
- সেটাই তো! উনার পরিবার বললেন, করিডোরে হাঁটার সময় বেশ কয়েকটা প্রবল বাতকর্ম করে পেটের গ্যাস বের করেই নাকি যন্ত্রণা কমেছে!
- এ্যাঁ, তুমি কেমন ডাক্তার রে! কি শেখালাম তোকে এতদিন? পেটে টোকা দিয়ে তুই গ্যাসের উপস্থিতি টের পাস নি!
- খুবই লজ্জার কথা জানি, কিন্তু সত্যি পারি নি
- আরো ভালো করে গ্যাস ভরা পেট স্টাডি কর। নানা অবস্থার গ্যাস ভর্তি পেটে টোকা মেরে দেখ কেমন আওয়াজ বেরোয়।
- এত গ্যাস ভর্তি পেট পাবো কোথায়?
- কেন তোর নিজের গ্যাস হয় না? নিজের পেটে টোকা মারবি!
- তোমাদের আশীর্বাদে দাদা, অম্বলের রোগ নেই। যা খাই সবই হজম হয়ে যায়! গ্যাস হব এমন খাবার আমি তো হাতের কাছে পাই না!
- গ্যারান্টিড গ্যাস হবে এমন একটা খাবারের নাম করতে পারি তোকে? খেয়ে দেখবি নাকি?
- বলো দাদা বলো! ট্রাই করতে দোষ কি! যদি কিছু শেখা যায়
- তাহলে শোন, যেদিন বিকেলের দিকে ফাঁকা থাকবি, নৌকা করে গঙ্গা পেরিয়ে শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে বেড়াতে যাস। গার্ডেনে ঢোকার গেটের কাছে ‘চন্দ্রপুলি’ বলে এটা খাবার বিক্রি হয়। সেটা খেয়ে একপেট জল খেয়ে নিবি, পরের দিন সকালে দেখবি গ্যাস কারে কয়!
বিধান রায় এবার ধ্বন্ধে পড়ে গেলেন – নীলু-দা রসিকতা করছে নাকি সত্যি কথা বলছে! জিজ্ঞেস করতে যাবেন কি, এক কর্মচারী দিয়ে গেল দুকাপ চা আর সাথে চারটে সমোসা। নতুন জিনিস চাখবার জন্য নীলরতন বাবু একবারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। খেয়ে দেখে বেশ পছন্দ হল উনার সমোসা – মনটা ফুরফুরে হলে অন্য প্রসঙ্গ পাড়লেন এবার
- জানিস বিধু, অনেক দিন ধরে একটা কথা আমার মাথায় ঘুরছে
- কি কথা দাদা
- আচ্ছা এই ধর কারো মৃত্যু হলে আমরা বলি ‘প্রাণটা বেরিয়ে গেল’। তা এই প্রাণটা বেরিয়ে কোথায় যায়!
- এ্যাই দ্যাখো! মানুষের মৃত্যু, আত্মা এই সব নিয়ে তো মানুষের ইতিহাসে হাজার হাজার বছর নিয়ে লেখা হচ্ছে
- আরে আমি আধ্যাত্মিক জিনিসের বা দর্শন গত ব্যাপার স্যাপার বলছি না, সে তো দেবেন বাবু সভাতে গেলেই কান ঝালাপালা করে দেন। আমি ভাবছি পুরো বিজ্ঞান ভিত্তিক যাচাই এর ব্যাপারটা।
- কেমন? কেমন? (বিধান রায় বিশাল উৎসাহিত হয়ে পড়লেন)
- কোন জিনিস থেকে কিছুটা জিনিস বেরিয়ে গেলে প্রথম জিনিসটার ওজন তো কমে যাবার কথা, নাকি?
- তা তো বটেই – বিজ্ঞান তো তাই বলছে।
- তাই ভাবছিলাম, যদি ধর জাষ্ট মৃত্যুর আগে কাউকে ওজন করলাম, আর তার মৃত্যুর সাথে সাথে আবার ওজন। এবারের সেই দুই ওজনের পার্থক্য থেকেই আমরা বুঝতে পারবো “প্রাণটা বেরিয়ে গেল” কনসেপ্টটা!
- আরো একটু খোলসা করে বলো দেখি!
- যদি মৃত্যুর জাষ্ট পরেই কারো ওজন কমে যায়, তাহলে সেই ওজনটা হবে বেরিয়ে যাওয়া প্রাণের! মানে মৃত্যুর ঠিক আগে আর পরের ওজনের পার্থক্য থেকে আমরা মানুষের ‘প্রাণ’-এর ওজন বের করতে পারবো!
- এতো বিশাল ভালো প্ল্যান নীলু-দা! আমি আছি তোমার সাথে। কিন্তু ‘প্রাণ’ না বলে যদি আমরা ‘আত্মার’ ওজন বলি ওটাকে
- সে নিয়ে না হয় পরে ভাবা যাবে। আগে তা হলে এক্সপেরিমেন্টাল প্ল্যানটা করে ফেলা যাক
প্ল্যান তৈরী হল – তেমন ভাবে দেখতে গেলে বেশ কন্ট্রোভার্সিয়াল প্ল্যান। ভালো দাঁড়িপাল্লা চাই – গ্রামের হিসেব তো করা যাবেই, মিলিগ্রামের হিসেব থাকলে আরো ভালো হয়। আত্মার কত ওজন হতে পারে তার কোন রেফারেন্স ছিল না তাঁদের কাছে, কারণ এমন ভাবনা চিন্তা কেউ আগে করে নি।
বেশ কিছু দিন গেল পরীক্ষার প্ল্যানটা বারে বারে চেক করে একদম নির্ভুল করে। বড়বাজার থেকে অনেক খুঁজে এমন ওজন মাপার যন্ত্র পাওয়া গেল যার উপরে পুরো মানুষটাকে শুইয়ে রাখা যাবে – তবে মিলিগ্রাম মাপা যাবে না সেই কাঁটায়, গ্রামে হিসেব করা যাবে। তাই সই বলে সেই মেশিন কিনে আনা হল। দুজনা ভেবে দেখলেন যে মৃত্যুর কিছু আগে থেকেই ব্যক্তিকে সেই ওজন যন্ত্রে ট্রান্সফার করতে হবে – না হলে ঠিক মারা যাবার আগে বিছানা থেকে তুলে ওজন করা, আবার মারা যাবার পর ফের ওজন করা – এই সবের মধ্যে অনেক এরর আসতে পারে।
শুধু শরীর স্থানান্তরিত করা নয়, শরীরবৃত্তিয় আরো যে সব ব্যাপার থেকে এরর্ (ভ্রান্তি) আসতে পারে সেই গুলি নিয়েও ব্রেন স্ট্রর্মিং করে একে একে এলিমিনেট করলেন – যেমন রুগী পায়খানা বা পেচ্ছাপ করে ফেললে কি হবে! তাঁরা যুক্তি দেখালেন যে যেহেতু বিছানা সমেত রুগীকে ওজন করা হচ্ছে তাই পায়খানা বা পেচ্ছাপ ফ্যাক্টর এখানে কোন সমস্যা করবে না। খুব দ্রুত যদি রুগীর ত্বক বা ফুসফুস শুকিয়ে যায় সেখান থেকে আর্দ্রতা চলে গিয়ে তাহলে ওজনের হেরফের হতে পারে – কিন্তু মৃত্যুর একদম সাথে সাথে ওজন করছেন বলে তত তাড়াতাড়ি আর্দ্রতা কমার চান্স নেই বলে সেগুলো বাতিল হল ইনফ্লুয়েন্সিং ফ্যাক্টর বলে। এই ভাবে নীলরতন বাবু আর বিধান রায় প্রায় বুলেট প্রুফ করে ফেললেন পরীক্ষার প্ল্যানটা। কেবল বাকি রইল একটা জিনিস, বিধান রায় বললেন
- নীলুদা, সবইতো দেখে নিলাম। কিন্তু শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যাপারটা? ধরো জীবিত মানুষ শ্বাস নেবে কিন্তু মারা যাবার পর তো আর নেবে না! এর থেকে যদি ওজনের যদি কিছু হেরফের হয়
- বাঃ ভালো পয়েন্ট ভেবেছিস তো বিধে! তবে এটাও আমরা পরীক্ষা করে নিতে পারি এখনিই। তুই ওজন যন্ত্রের উপরে চট করে শুয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড় বা বন্ধ করে থাকতো, আর আমি লক্ষ্য রাখি যে এতে ওজনের কোন হেরফের হচ্ছে কিনা!
বিধান রায় ওজন যন্ত্রের উপর শুয়ে পড়লেন – বড় বড় শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়াছারি করে বা বন্ধ করে রেখেও ওজনের কাঁটায় কোন হেরফের দেখা গেল না। ব্যাস এই ভাবে পুরো প্ল্যান তৈরী!
এবার খুঁজতে হবে ভলেন্টিয়ার – যদিও নীলরতন বাবুকে বেশীর ভাগ রুগীই ভগবানের মতন দেখত, তারা রাজীও হয়ে গেল, কিন্তু রুগীর পরিবাররা বাদ সাধল। তারা বলল, “আপনাকে আমরা খুবই শ্রদ্ধা করি ডাক্তারবাবুর, কিন্তু এ আপনি কি অস্বিরৈণী কথাবার্তা বলছেন আপনি! মৃত্যুপথ যাত্রী নিয়ে এই ভাবে আমরা পরীক্ষা করতে দেব না”!
কিন্তু ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য এমনই যে শিয়ালদার কাছে এমন অনেক রুগী পাওয়া গেল যাদের কোন পরিবার নেই! চিকিৎসার ক্ষমতাও নেই নিজেদের। নীলরতন বাবু নিজে যত্ন করে তাঁদের চিকিৎসা করাতেন। এমন এক যক্ষ্মা রুগীর কাছে গিয়ে নিজের প্ল্যানটা বললেন নীলরতন বাবু, জানতে চাইলেন সে নিজের ওজন নিতে দিতে রাজী হবে কিনা! সে বলল, “ডাক্তার বাবু আপনি আমার ভগবান। আপনার জন্য এতদিন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মাথায় ছাদ দেখেছি, দুবেলা খাবার পেয়েছি। ওজন যন্ত্রের উপর মরব, কি মেঝেতে মরব – তাতে আমার কোন চিন্তা নেই। আপনাকে চোখের সামনে দেখে মরব, এর থেকে বড় পুণ্য আর কি হতে পারে!”
এই যক্ষ্মা রুগীকে দিয়েই শুরু হল পরীক্ষা – যেদিন সেই রুগীর অবস্থার অবনতি শুরু হল দ্রুত, যেদিন তাকে সেই স্পেশাল ওজন যন্ত্রের উপর বিছানায় ট্রান্সফার করা হল, এবার তার ওজন খুব যত্ন নিয়ে মনিটর করা হল। পরের প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা এই ব্যক্তি রইলেন মৃত্যু সজ্জায়। প্রতি ঘন্টায় সেই ব্যক্তির ওজন প্রায় ৬০ গ্রাম করে কমতে লাগল। মারা যাবার ঠিক আগে এবং ঠিক পরে ওজনের পার্থক্য হল ৩৫ গ্রামের মত। তার ফলে সিদ্ধান্ত হল ‘আত্মা’ বলে যদি কিছু বেরিয়ে যায় শরীর থেকে (মানে প্রাণ বেরিয়ে যাওয়া যাকে বলে) তাহলে তার ওজন হচ্ছে ৩৫ গ্রাম মত। এর পরেও আরো পাঁচটা মৃত্যু পথ যাত্রীর উপর এই পরীক্ষা চালানো হল – সেই গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ গ্রাম মতন ওজন কমল মৃত্যুর ঠিক পরে!
নীলরতন বাবু এবং বিধান রায় এই পরীক্ষার ফলাফল কোন জার্ণালে পাবলিশ করেন নি। তাই তাঁদের এই যুগান্তকারী পরীক্ষার খবর বিশ্বের কেউ জানতেই পারল না! কেউ পারল না বলা ঠিক নয় – কাকতলীয় ভাবে ১৯০০ শতাব্দীর প্রথম দিকে আমেরিকার ম্যাসাচ্যূয়েটস শহরের এক ডাক্তার ডানকান ম্যাকডুগ্যাল এই একই পরীক্ষা শুরু করেন। যে সময় নীলরতন বাবু এবং বিধান রায় এই পরীক্ষা করছেন, সেই সময় আমাদের কোলকাতার ক্যাম্ববেল মেডিক্যাল কলেজে সাহেব লোকজন ছিল প্রচুর। এটা কি একেবারেই কাকতলীয় যে উনারা যখন কোলকাতায় এই পরীক্ষা করতে শুরু করলেন তার ঠিক কিছুদিন পরেই পৃথিবীর অন্য প্রান্তে এক ডাক্তার হুবাহু একই পরীক্ষা শুরু করলেন! ম্যাকডুগ্যাল ১৯০৭ সালে ‘আমেরিকান মেডিসিন’ জার্নালে তাঁর পরীক্ষা পাবলিশ করলেন।
জগদীশচন্দ্র বসুর মত নীলরতন সরকার ও বিধান রায়ের নামও কেউ মনে রাখল না এই বিশেষ পরীক্ষার সাথে সম্পর্কযুক্ত বলে!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।