শিবপুর বোটানিক গার্ডেনের ভিতর দিকে ঢুকে হাঁটতে হাঁটতে সোজা বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বাঁদিকে বেঁকে গিয়ে আরো খানিকটা এগিয়ে গেলে এবার পেয়ে যাবেন পেয়ে যাবেন গঙ্গার সমান্তরালে হাঁটবার পথ। সেদিন জগদীশ চন্দ্র বসু তেমনই ঢুকে হাঁটছেন বোটানিক্যাল গার্ডেনের রাস্তা দিয়ে, সেই প্রথমবারের জন্য আসা তাঁর এখানে। ১৮৯২ সালের কথা - জগদীশ বাবু এসেছেন বোটানিক গার্ডেনের হারবেরিয়ামের কিউরেটর সার্জন ক্যাপ্টেন ডেভিড প্রেইনের ডাকে। তখন কতই বা বয়েস জগদীশ বসু, মাত্র ৩৪ বছর, কিন্তু এর মধ্যেই সারা বাংলা জুড়ে, বাংলাই বা কেন, সারা ভারত জুড়ে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে প্রচন্ড প্রতিভাবান বোটানিষ্ট হিসেবে।
হাঁটতে হাঁটতে তিনি পোঁছে গেলেন সেই জায়গাটায় এখন যেখানে গেলে গঙ্গার উলটোদিকে মেটিয়াবুরুজের ফেরিঘাট দেখা যাবে। আর বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতরে তখন এই পাশের পুরো জায়গাটা জুড়ে চাষ হত গাঁজার। হাঁটতে হাঁটতে জগদীশ বসু ভাবতেও পারেন নি সেদিনের থেকে প্রায় ১২০ বছর পরে এই বোটানিক্যাল গার্ডেন তাঁর নামেই নামাঙ্কিত হবে। আগেকার দিনের শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন এখন পরিচিত “আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস ইন্ডিয়ান বোটানিক গার্ডেন”। ভারতের সবচেয়ে বড় বোটানিক্যাল গার্ডেনের নাম ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত বোটানিষ্টের নামে হবে সে আর আশ্চর্য কি!
তবে হালকা আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে বোটানিক্যাল গার্ডেনে জগদীশ বসু-র প্রথম পদার্পণ কোন স্পেশাল গাছ গাছালি দেখতে নয় – গাঁজার চাষ দেখতে! গাঁজার চাষ এবং গাঁজা গাছের ব্যাপারে আলোচনার জন্যই কিউরেটর ডেভিড প্রেইন ডেকে পাঠিয়েছিলেন জগদীশ বোস-কে। একদম সরাসরি তাঁর অফিসে চলে যেতে বলেছিলেন, কিন্তু জগদীশ বোস ভাবলেন আলোচনায় ঢোকার আগে নিজের মত করে গাঁজা গাছগুলিকে দেখে নেওয়া যাক!
বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতরে এমন দিগন্ত বিস্তৃত, উঁচু এবং সুবাসিত গাছের স্রোতের সামনে দাঁড়িয়ে জগদীশ বাবু হতবাক হয়ে গেলেন। আজ আমরা জানি তাঁর সাহিত্য প্রীতির কথা – রবীন্দ্রনাথের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ গাঢ় সম্পর্কের কথা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এমন গাঁজা গাছ দেখে তাঁর মনে প্রথমেই কাব্যিক ভাব উদয় হল – সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে খাতায় লিখেছিলেন –
“গাঁজা তুমি কোথা হতে আসিয়াছ?
ভারী গাছগুলো অল্প হেসে দুলে বলেছিল
মহাদেবের জটা হতে”।
এবার নিশ্চয়ই ভাবছেন তো যে গাঁজার চাষ দেখতে জগদীশ বোস শিবপুর গেলেন কেন! এটা জানতে হলে একটু ঘেঁটে নিতে হবে এই বোটানিক গার্ডেনের ইতিহাস। ১৭৮৭ সালে যখন প্রায় ২৭০ একর (৮১০ বিঘা মত) জায়গা জুড়ে এই বাগানের প্রতিষ্ঠা হল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মালিকানায়, তখন পাবলিককে বোঝানো হল যে এখানে গবেষণা হবে নতুন ধরণের উদ্ভিদের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নিয়ে – উদাহরণ দেওয়া হল যে গবেষণা হবে সেগুন গাছ নিয়ে। অতদূর বার্মা থেকে না এনে যদি এখানেই কোনভাবে একই কোয়ালিটির সেগুন গাছ বড় করে তোলা যায় তাহলেই তো কেল্লা ফতে! সবাই ভাবলো বাঃ দারুণ প্ল্যান তো! কিন্তু আসল উদ্দেশ্য কি ছিল সেটা আরো অনেক কিছুর মত রাখা হল ক্লাসিফায়েড।
বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গাঁজা চাষ এবং আরো ভালো ভ্যারাইটির গাঁজার প্রজাতি বানানো। এটা আমরা সবাই জানি যে তৎকালীন সময়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে চীন দেশের এক জটিল সম্পর্ক ছিল দুটি বিষয় নিয়ে – এক তো চায়ের বাণিজ্য নিয়ে এবং দ্বিতীয়ত আফিমের। এই দুই বস্তু সারা বিশ্বের বাজারে ততদিনে প্রবল চাহিদার মুখোমুখি হচ্ছে – কিন্তু বাজার কন্ট্রোল করছে চীন! সেই মনোপলি থেকে বের হবার জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতের নামা জায়গায় এবং শ্রীলঙ্কার কিছু জায়গায় শুরু করল চা এবং আফিমের চাষ। চায়ের চাষ তো বেশ ছড়িয়ে পড়ল – স্বাদ গন্ধও দারুণ পাওয়া গেল আসাম এবং দার্জিলিং চায়ের। কিন্তু আফিমের কোয়ালিটি ভালো হল না! মানুষ খাচ্ছে, কিন্তু নেশা হচ্ছে না চাইনীজ আফিমের মত। ওষূধে আফিম যাচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না তেমন। তখন ইংরেজরা ভাবতে বসল যে আফিমের পরিবর্তে অন্য কিছু নেশার গাছ গাছালি পাওয়া যায় কিনা! এর অনেক দিন পরে অবশ্য ইংরাজরা আফিমের চাষ, মানে পোস্ত গাছ বাংলায় কিভাবে চাষ হবে সেই আর্ট-টাও মাষ্টার করে ফেলেছিল। বাংলার ঘরে ঘরে পোস্ত খাবার ধুমও তখন থেকে – তবে সেই গল্প অন্যদিন। আজকের গল্প গাঁজার চাষ নিয়েই।
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর লোকজন যখন কোলকাতার হেড অফিসে বসে মাথার চুল ছিঁড়ছে কি গাছ থেকে নেশা হয়, তখনই নীলকরেরা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে খবর আনলো যে গ্রামের দিকে লোকেরা একধরণের গাছের শুকনো পাতা, ফুল ইত্যাদি খেয়ে মাতোয়ারা হয়ে যাচ্ছে। গাঁজার সেবনের প্রভাব নিয়ে আমরা সবাই জানি, তাই আর সেই বিস্তারে লিখছি না। সেই থেকেই শুরু বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্ল্যান – বাংলার নানা জায়গা থেকে গাঁজা গাছ নিয়ে এসে শিবপুরের বোটানিক্যাল গার্ডেন ভরিয়ে তোলা হল। তাহলে এবার প্রশ্ন করতে পারেন, “ভাই, গাছ কি কিছু লাগায়নি ইংরাজরা? আজকের দিনের সে সব বহু প্রাচীন লম্বা লম্বা গাছ আছে বাগানে সেগুলো কে লাগিয়েছিল”? এর উত্তরে বলি লাগিয়েছিল ওরাই, সেই গাছের কথাই এর পর লোককে চোখের ধুলো দেবার জন্য দেখিয়ে গেছে – কিন্তু সেই লম্বা লম্বা গাছে তলায় যে আসল চাষ হত গাঁজা গাছের সেটা ওরা আর বলে নি! ইংরাজ আর গাঁজা গাছের একটা মিল ছিল – দুয়েই তেমন রোদ সহ্য করতে পারত না!
তো বোটানিক্যাল গার্ডেন প্রতিষ্ঠার প্রথম ১০০ বছর শুধু একরকমেরই গাঁজ চাষ হয়ে গেল এখানে। এর পিছনে এক প্রধান কারণ ছিল কাদের উপর টেষ্ট করব গাঁজার এফেক্ট, সেই সাবজেক্টের অভাব। একদম একটেরে টাইপের জায়গা ছিল বলে শুধু গাঁজা খেতে এখানে কেউ আসতে চাইত না! বিশেষ করে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে কোলকাতার বুকে যখন গাঁজা প্রবল ভাবেই প্রচলিত হয়ে গেল। সেই ১৮১০ থেকে কোলকাতার পক্ষীকূল এবং বাবুদের মধ্যে গাঁজা প্রীতি নিয়ে দিস্তে দিস্তে লেখা আছে। ১৮৮০ সালে এসে বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। গভরমেন্ট কলেজ হাওড়া নাম দিয়ে শিবপুরের বিশপ কলেজের ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হল সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজটি – ১৯২১ সালে যে কলেজের নাম পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়ায় বেঙ্গল ইঞ্জনিয়ারিং কলেজ, বা সংক্ষেপে বি ই কলেজ। বি ই কলেজের ছাত্রদের সাথে বোটানিক্যাল গার্ডেনের সম্পর্কের শুরু সেই গাঁজা দিয়েই – দুই কমপাউন্ড একদম গায়ে গায়ে। বিনা পয়সায় গাঁজা সাপ্লাই পেলে কে আর টেষ্ট সাবজেক্ট হিসেবে নাম না লেখায়! বোটানিক্যাল গার্ডেনে গাঁজার বিবর্তনে বি ই কলেজের ছাত্রেদের অবদান অনেক। গাঁজার ট্রাডিশন বি ই কলেজে এই হালেও চলছে – তবে এখন কেউ আর বিনা পয়সায় গাঁজা খাওয়ায়, ভাবীর দোকান থেকে পয়সা দিয়ে কিনতে হয়!
এই দিক থেকে দেখতে গেলে সার্জন ক্যাপ্টেন ডেভিড প্রেইনের ভাগ্য ভালোই বলতে হবে! তিনি যখন ১৮৮৫ সালের দিকে বোটানিক্যাল গার্ডেনের কিউরেটর হয়ে এলেন তখন হাতের কাছে প্রচুর বি ই কলেজের ছাত্র টেষ্ট সাবজেক্ট হিসাবে। কিন্তু তিনিও অনেক দিন চেষ্টা করে অন্য কলমের গাঁজা বানাতে পারলেন না – কেবল “ক্যানাবিস ইন্ডিকা” এরই চাষ হতে লাগলো বোটানিক্যাল গার্ডেনে। কিন্তু আগেকার কিউরেটরদের থেকে ডেভিড প্রাইন একটু আলাদা ছিলেন – লেগে থাকার এবং অন্য ভাবে ভাবার ক্ষমতা ছিল অনেক তাঁর। তিনি ভাবলেন এই ভাবে হবে না – একা একা সব কাজ করা যায় না। তিনি খুঁজতে লাগলেন স্থানীয় যোগ্য লোকের সাহায্য – যার থাকবে বোটানি নিয়ে জ্ঞান। এমন সময়েই একদিন কোলকাতার প্রসিডেন্সী কলেজে একটা সেমিনার শুনতে গিয়ে জগদীশ বোসের লেকচার শুনে বিশাল ইমপ্রেসড হয়ে গেলেন তিনি! মনে মনে ঠিক করে নিলেন একেই সাথী বানাতে হবে! কিন্তু প্রশ্ন হল, কিভাবে অ্যাপ্রোচ করবেন জগদীশ বোস-কে সেটা বুঝতে পারছিলেন না। যদি গিয়ে বলেন, “ভাই গাঁজার চাষ বাড়াবার চেষ্টা করছি, একটু হেল্প করো”, জগদীশ বোস তাতে ইন্টারেষ্ট পাবেন বলে মনে হয় না! তলে তলে গুপ্তচর লাগালেন জগদীশ বোসের পিছনে কিভাবে টোপ ফেলা যায় যাচাই করতে। তিনি গুপ্তচরের কাছ থেকে শুনলেন জগদীশ বোসের ইন্টারেষ্ট শুধু বোটানিতে এমন নয় – তাঁর প্রায় সমান পারদর্শিতা আছে ফিজিক্স, বায়োলজি, বায়োফিজিক্স এমন কি চিকিৎসাবিজ্ঞানেও! এবং কাকতলীয় ভাবে জগদীশ চন্দ্র তখন নাকি গাঁজা গাছ থেকে কি ঔষুধ বানানো যায় সেই নিয়ে হালকা মেতে আছে! ব্যাস, ডেভিড প্রাইন দেখলেন এই মোকা!
কিন্তু জগদীশ চন্দ্র কেন গাঁজা থেকে ঔষুধ বানানোর জন্য মাথা ঘামাচ্ছিলেন? সেটায় ঢোকার আগে গাঁজা গাছের হালকা পরিচয় দিয়ে নেওয়া যাক আলোচনার সুবিধার জন্য। আমরা যাকে গাঁজা গাছ বলি তাকে পশ্চিমে বলা হয় মারিজুয়ানা বা ক্যানাবিস। এবার যদি আরো একটু টেকনিক্যালি ভিতরে ঢোকেন তাহলে মারিজুয়ানা হল ভাঙ এর সমতূল্য (যা পাতা এবং কান্ড থেকে বানানো), গাঁজা হল স্ত্রী-ফুলের মাথা থেকে বানানো, হাসিশ (চরশ) হল গাঁজা গাছের আঠা। হাসিশ কিন্তু নেশার দ্রব্য হিসাবে মারিজুয়ানার থেকে অনেক বেশী কার্যকরী।
তা এই গাঁজা গাছের ঔষুধ গুণের দিকে জগদীশ বোসের আকর্ষণের শুরু যখন একদিন ১৮২৬ সালের হোয়াইটল এইনস্লি-র লন্ডন থেকে প্রকাশিত ভারতীয় ভেষজ এর উপরে বই “মেটিরিয়া ইন্ডিকা” পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখে পড়ে গিয়েছিল ‘অর্শ’ রোগে গাঁজা কিভাবে কাজ করে সেই নিয়ে আলোচনায়। জগদীশ বোসের সেজ মামা অনেকদিন ধরে ভুগছিলেন ‘ঝুলে পড়া অর্শ’ (পোর্ট্রুডেড পাইলস্) এর রোগে। অনেক ডাক্তার বদ্যি দেখিয়েও কিছু হচ্ছিল না – এদিকে সেজমামা খুব প্রিয় জগদীশের, মাঝে মাঝেই মামা বলেন “কি রে জগা, এত পড়াশুনা করছিস, এটা সেটা ঘাঁটছিস আর আমার অর্শ-টার কোন কিনারা করতে পারছিস না”!
মামার কথা ভেবেই গাঁজার উপর ইন্টারেষ্ট বেড়ে যায় ওঁনার। বাড়ির ছাদে বেশ কিছু টবে গাঁজার গাছ বসিয়ে ফেলেন। গাঁজার গাছ থেকে তখনো ঔষূধ বানাতে না পারলেও, সেই গাঁজ গাছ অন্য ভাবে সাহায্য করেছিল তাঁর রিসার্চে। অনেকেই জানেন না, গাছের যে প্রাণ আছে এই ব্যাপারটা আমরা ছোট বেলায় পড়েছিলেন ওঁনার আবিষ্কার হিসাবে – যে গাছের উপর পরীক্ষা চালিয়েছিলেন তা ছিল টবের গাঁজা গাছ! মিমোসা পুডিকা এবং ডেস্মোডিয়াম গ্রায়ানস্ এই গাছ দুটো ছাড়াও সে গাছটি জগদীশ বসুকে সাহায্য করেছিল তাঁর বায়োফিজিক্স রিসার্চে তা হল ক্যানাবিস ইন্ডিকা। তবে বাইরের লোকজনের কাছে অজানাই রয়ে গেছে সেজ মামার অর্শ রোগের সাথে জগদীশের গাছের প্রাণ বিষয়ক রিসার্চের সম্পর্কের কথা। আজও বিলেতে কোলকাতার নিযুক্ত গুপ্তচরের গোপন ফাইলগুলো (যেগুলো এখন নন-ক্লাসিফাই করে দেওয়া হয়েছে) দেখলে ডেভিড প্রেইন নিযুক্ত জগদীশ বোসের পিছনে লাগানো সেই গুপ্তচরের রিপোর্টে গাঁজা এবং সেজ মামার অর্শ রোগের উল্লেখ দেখা যাবে।
যখনই ডেভিড প্রেইন শুনলেন যে জগদীশ বোসের ইন্টারেষ্ট আছে গাঁজার উপকারীতার বিষয়ে, তখনই তিনি ঠিক করে নিলেন এই অ্যাঙ্গেল থেকেই টুপি পরিয়ে বোসকে আনতে হবে দলে। যেমন ভাবা তেমন কাজ – প্রেইন নিজেও খুঁজে বের করলেন গাঁজা থেকে কি ঔষুধ হতে পারে সেই নিয়ে রিসার্চ পেপার। দেখা গেল ডায়েরিয়া-তেও নাকি গাঁজা সাহায্য করে এমন উল্লিখিত আছে। আরো খুঁজে পাওয়া গেল ১৮৩০ সালের ডব্লু বি ও’শনসির খোদ কোলকাতার বুকে মানুষ এবং কুকুরের উপর গাঁজা দিয়ে চালানো পরীক্ষা গুলি যা পাবলিশ হয়েছিল ট্র্যানজাকশন অফ দ্য মেডিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সোসাইটি অফ বেঙ্গল ১৮৩৮-৪০ সালের সংখ্যায়। ও’শনসি লিখেছিলেন গাঁজা খেয়ে “কুকুরের মুখের চেহারা এক অসহায় মদ্যপের মতন দেখাচ্ছে” আর মানুষের ক্ষেত্রে গাঁজা নাকি কলেরা, বাত থেকে শুরু করে খিঁচুনি বা মৃগীরোগীর উপশম করছে! এগুলো সব ডকুমেন্টেড করে প্রেইন গেলেন জগদীশ চন্দ্রে কাছে – গিয়ে বললেন যে বোটানিক্যাল গার্ডেনের গাঁজা গাছের সাহায্যে তিনি এই রিসার্চ আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে চান, যদি জগদীশ চন্দ্র তাতে সাহায্য করেন তাহলে মানুষের খুব উপকার হবে। নিজের অন্য রিসার্চে তখন জগদীশ বাবু খুব ব্যস্ত – কিন্তু সেজ মামার ঝুলে পড়া অর্শ রোগের কথা মনে এসে উনি রাজী হয়ে গেলেন।
সেই ডাকেই সাড়া দিয়ে ওদিন প্রথম বারের জন্য বোটানিক গার্ডেনে এলেন জগদীশ বোস, বা সেজমামার আদরের জগা। এত গাঁজা গাছ এক সাথে দেখেন নি আগে কোনদিন! গাঁজা ক্ষেতের ভিতর ঢুকে বিস্তারে পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন, গাঁজা গাছে একধরণের রোগ (যাকে আমরা পরে ‘ধসা’ রোগ বলে জানবো) লেগেছে। এটা প্রেইন নিজেও লক্ষ্য করেন নি। জগদীশ বোস সব নোট করে নিতে লাগলেন – তার পর থেকে ঘন ঘন আসতে শুরু করলেন বোটানিক্যাল গার্ডেনে। একসময় বোটানিক গার্ডেনের হারবেরিয়ামের পাশে একটা কোয়ার্টারের ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। কয়েক বছর হল অবলা বোস-কে বিয়ে করেছেন – অবলা বোস খুবই প্রগতিশীল ছিলেন, স্বামী রাতের বেলা বাইরে থাকবে সেই নিয়ে তাঁর কোন কুন্ঠা ছিল না। স্বামীর যোগ্য সহধর্মীনি ছিলেন তিনি – কেবল বলতেন, “গাঁজা খেও না কিন্তু তুমি। যদি গবেষণা করতে গিয়ে চাখার দরকারও হয়, একদমই অল্প খাবে”।
গাঁজা গাছের ধসা রোগের সমস্যার সমাধান করতে পারছেন না কিছুতেই। একদিন বাড়ি ফিরে সেজ মামা-কে বললেন সেই কথা। মামা বললেন, “জগা তুই বরং একবার খড়গপুরের দিকে ঘুরে আয়। আমি একবার ওদিকে গিয়ে বিস্তর গাঁজার চাষ দেখেছিলাম, একদম সুস্থ সবল গাছ”। সেই কথা শুনে কয়েক দিন মেদিনীপুরের ওদিকটা ঘুরে দেখলেন জগদীশ বোস এবং ডেভিড প্রেইন। সেই সব বিস্তারে লিখে আর বোর করব না – সেই প্রথম আর্সেনিকের সাথে গাঁজার সম্পর্ক টের পান তাঁরা, ওদিকের জলে আর্সেনিক থাকার জন্য ধসা রোগের প্রকোপ কম। আজও ধসা রোগের পোকা মারার জন্য সবচেয়ে কড়া যে বিষ দেওয়া হল তাতে খুব অল্প হলেও আর্সেনিক থাকে। তাই বাজারের কেনা সব্জী ভালো করে ধুয়ে খাবেন।
বছর দুয়েকের মধ্যে এসে গেল সেই মহেন্দ্রক্ষণ যার জন্য ডেভিড প্রেইন অপেক্ষা করছিলেন বিগত এক দশক। ক্যানিবাস ইন্ডিকা (ভারতে যে গাঁজা গাছ দেখা যায়) এর সাথে ক্যানাবিস স্যাটিভা (সাউথ ইষ্ট এশিয়ায় যে প্রজাতি দেখা যায়) গাঁজা প্রজাতির কলম ঘটিয়ে জগদীশ বোস জন্মদিলেন ‘ক্যানাবিস রুডেরালিস’ প্রজাতির যা আজেকের মধ্য এবং পশ্চিম ইউরোপে দেখা যায়। এরা ঠান্ডা সহ্য করতে পারে। আজকের দিনের আমষ্টারডাম শহরের ‘কফি হাউস’ গুলিতে যে গাঁজা পাওয়া যায় তার বেশীর ভাগই ক্যানাবিস রুডেরালিস প্রজাতি থেকে বানানো! আমষ্টারডামের ক্যানালের ধারে দোকানে আয়েশ করে গাঁজা খেতে থাকা পাবলিক জানেও না ওর কতটা কৃতজ্ঞ থাকার উচিত জগদীশ চন্দ্র বোস আর বি ই কলেজের কাছে! ক্যানাবিস রুডেরালিস প্রজাতির গাঁজার প্রথম টেষ্ট পেয়েছিল বি ই কলেজের ছাত্ররাই!
বোটানিক্যাল গার্ডেনের ভিতরে গাঁজা গাছের সাথে ব্যস্ত এই ভদ্রলোক-কে চিনতে পারেন?
লেখা অনেক বড় হয়ে গেল – জগদীশ বোস শুধু বেতার যন্ত্রের কৃতিত্ব থেকেই বঞ্চিত হন নি! বঞ্চিত হয়েছিলেন এই বোটানিক্যাল গার্ডেনেও – জগদীশ বোসই প্রথম আইডিয়া দেন ডেভিড প্রেইন-কে যে গাঁজা চাষ, ব্যবহার এবং তার প্রভাব নিয়ে এক বিস্তারিত রিপোর্টে লেখার জন্য। সেই প্রস্তাব ডেভিড প্রেইন নিজের নামে চিলিয়ে বিলেতে দরবারে পেশ করেন। ১৮৯৩ সালের এপ্রিল মাসে হাউস অফ কমনস্-এ আলোচনার পরে গড়ে তোলা হয় 'ইন্ডিয়ান হেম্প ড্রাগস্ কমিশন' - এই কমিশনকে বলা হয় যে তাদের প্রধান কাজ হবে বাংলায় গিয়ে গাঁজা চাষের ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে হবে। গাঁজা খেয়ে পাবলিকের কি অবস্থা হয়েছে বা হচ্ছে এবং সামাজিক ও নৈতিক অবস্থার উপর গাঁজার প্রভাব কেমন - সেই সব খুঁজে পেতে দেখা আর কি। অথচ রিপোর্টের পুরো কাঠামো, এমনকি যে সত্তরটা প্রশ্ন ভিত্তি করে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল – সে সবই জগদীশ বোসের বানানো। সমীক্ষা লব্ধ উত্তর থেকে অনুসিদ্ধান্ত নেওয়া – সে সবই বোস বাবুর। সারা পৃথিবীতে গাঁজা বিষয়ক এমন রিপোর্ট সেই প্রথম।
কিন্তু বেতার আবিষ্কারক মার্কনী সাহেবের মতন এই রিপোর্টেও রয়ে গেল কেবল প্রেইন সাহেবের নাম! জগদীশ বোস রয়ে গেলেন আড়ালেই – বঞ্চিত হয়েই!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।