আমেরিকান পাবলিকের সেই জায়গায় যাবার কোন দরকারই ছিল না! মধ্যপ্রাচ্যের একখানি দেশ ইয়েমেন, তখনো খনিজ তেল ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া যায় নি এখানে। পাবলিক বেশীর ভাগই গরীব – চাষবাসও বিশাল কিছু হবে যে সেই পোড়া জমিতে তেমন ব্যাপার নয়। ইয়েমেনের রাজধানী তখন আদেন – আর সেই আদেন শহরের বন্দরই ছিল পাবলিকের মূল ইনকামের জায়গা। আদেন শহরের বন্দর ব্যবসার কারণে একসময় খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল আর গুরুত্বপূর্ণ ছিল সামরিক স্ট্যাট্রিজিক জায়গা বলে।
তা এমন সেই আদেন শহরে ভেবে দেখতে গেলে দুই আমেরিকান বিল আর ফিলের কোনই আসার কারণ ছিল না। ইয়েমেন দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দারুণ কিছু এমন বলা যাবে না – যদিও এই দেশের একপাশে লোহিত সাগর দেখতে খারাপ এমনটা কেউ বলবে না। সেই লোহিত সাগর পেরিয়ে ওপারে গেলেই মিশর – এদিকে ইয়েমেনকে যেমন কেউ তেমন চেনে না, কিন্তু মিশরের সাথে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস। বিল আর ফিলে আদেন শহরে আসা তাই মিশর হয়ে এমন ভেবে নেওয়া খুব স্বাভাবিক। কিন্তু আসল ব্যাপার তা নয়!
বিল (বিল বোয়ারম্যান) আর ফিলের (ফিল নাইট) ইতিহাস নিয়ে খুব বেশী আগ্রহ ছিল এমন পরিচয় পাওয়া যায় নি – কিন্তু ব্যবসায় তাদের নেশা যে ছিল বিরাট তা পরের ইতিহাসই বলবে। বিলের প্রথম নেশা অবশ্য ছিল খেলাধূলা, আর এদিকে ফিলের ইচ্ছে ছিল স্কুল জীবন থেকেই যে ব্যবসা করবে – এমন ব্যবসা যা ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্ব জুড়ে। আর সারা বিশ্ব জুড়ে কিভাবে ব্যবসা করতে হয় তা প্রথম দেখিয়েছিল কে? ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী! তাই ফিল অনেক দিন থেকেই টাকা জমাচ্ছিল এই ভাবনা নিয়ে যে একদিন না একদিন সে ইষ্ট ইন্ডিয়ার ট্রেডিং রুট পুরো ম্যাপ ধরে ফলো করবে! সেই ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রুট ফলো করতে গিয়েই ফিলের আসার আগ্রহ জন্মালো আদেন শহরে।
এমনিতে আদেন শহর বা এই গোটা অঞ্চল নিয়ে বৃটিশদের খুব একটা বেশী উৎসাহ ছিল না প্রথম দিকে। কিন্তু যখন নেপোলিয়ান ১৭৯৬ সালে মিশর আক্রমণ করতে এসে ইয়েমেন সহ এই অঞ্চলটি ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করল, তখন বৃটিশরা দেখল – উরিত্তারা, এখানে ঘাঁটি না গাড়লে তো ব্যাপার খারাপের দিকে গড়াবে! কে জানে এই এলাকা টপকে ভারতের দিকে গেলেই তো হচ্ছে আর কি! বৃটিশদের সোনার হাঁস আবার কি হাতছাড়া হবে নাকি ফারসী-দের কাছে! অনেক কষ্টে ভারতে ফরাসীদের সাইড করা গেছে! তারপর মার্কেটে সুয়েজ খাল চলে এলে তো বিশাল ইন্টারেষ্ট বেড়ে গেল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর! লোহিত সাগরের ভিতরে দিয়ে টুক করে সুয়েজ ক্যানাল ধরে নিলে বাণিজ্যের রুট কত ছোট হয়ে যায়! আফ্রিকার ল্যাজ দিয়ে আর ঘুরতে হবে না! সেই থেকে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী জাঁকিয়ে বসেছিল আদেন সহ ইয়েমেন পুরো দেশটাতেই।
ফিলের বাপ বিশাল কড়া ব্যাক্তি ছিল – ছেলে স্কুলে পড়াকালীনই সেই বাপ বলে দিল যে ছেলেকে নিজে খেটে পড়ার খরচ জোগাতে হবে। বিল টুকটাক এটা সেটা কাজ এবং সাথে এটা সেটা বিক্রী করতে শুরু করে সেই থেকে। পরে কলেজ যাবার খরচ নিজেই জোগাড় করে বিজনেস নিয়ে ডিগ্রী করতে চলল ফিল অরিগন ইউনিভার্সিটিতে। সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা কালীনই (১৯৫৬-১৯৫৯) ফিলের সাথে আলাপ হয়ে গেল বিলের। বিল প্রায় বয়েসে বছর ছাব্বিশের বড় ফিলের থেকে – অরিগন ইউনিভার্সিটির অ্যাথলিটিক্স টিমের কোচ বছর চুয়াল্লিশের বিল, আর আঠেরো বছরের তরুণ তখন ফিল। এদের দুজনের আলাপ হওয়াটাও বেশ কাকতলীয় – ওই যে আগে বলেছি ফিল টুকটাক ব্যবসা করত, তো হোষ্টেলের এক অ্যাথলিটিক্স টিমের ছেলে এক জুতো বিক্রী করে। সেই জুতোর কোয়ালিটি দেখে কোচ বিল পুরো ফিদা। কোথা থেকে সেই জুতো কিনেছে ছেলে খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এল ফিলের নাম। এইভাবেই ফিল এবং বিলের প্রথম আলাপ।
এর পর প্রায় একবছর কেটে গেছে – আলাপ হয়েছে বেশ গাঢ়। ১৯৫৭ সালে ইউনিভার্সিটিতে গ্রীষ্মের ছুটি পড়লে বিল জানতে চাইল ছুটিতে কি প্ল্যান ফিলের। ফিল জানালো যে সে প্ল্যান করেছে আদেন শহর দেখতে যাবে। আদেন কোথায় বিল জানত না, ফিল যখন ব্যাখা করল যে আদেন মধ্যপ্রাচ্যে এবং তার একদিকে আছে আফ্রিকা, তখন বিল নড়েচড়ে বসল। জানালো যে তার অনেক দিন থেকে আফ্রিকা যাবার ইচ্ছে, কারণ যত টপ লং ডিসট্যান্স রানার আছে, প্রায় সবই সেই আফ্রিকা অঞ্চল থেকে। তাই বিলের একবার ঘুরে দেখার ইচ্ছে আছে কি এমন জীবনযাত্রা এদের বা কিভাবেই এরা প্র্যাকটিস করে যে এদের বীট দেওয়া যায় না!
এইভাবেই ফাইন্যাল হয়ে গেল ফিল আর বিলের আদেন শহরে আসা ১৯৫৭ সালে – এই সেই ট্রিপে যার ফলে টেক্সটাইল এবং স্পোর্টস ইন্ডাষ্ট্রির গ্লোবাল অবস্থা পালটে যাবে – আর তার মূল কারণ এই দুজনের সাথে দেখা হয়ে যাবে ধীরু নামে এক বছর পঁচিশের ভারতীয় ছেলের সাথে। সারাদিন ঘোরা ঘুরি করে ক্লান্ত বিল আর ফিল আদেন শহরের বন্দরের পাশেই সাগরের দিকে মুখ করে কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছেন সবে। কিন্তু স্থির ভাবে কি আর বসার উপায় আছে! দুই মিনিট অন্তর অন্তর “চায়ে, চায়ে” বলে কিসের যেন বিক্রেতা হাজির হচ্ছে। উনার বুঝতে পারলেন না কি জিনিস, কিন্তু দেখলেন আশে পাশের প্রচুর লোক কাপে ঢেলে সেই জিনিস কিনছে – হালকা খয়েরী রঙের কি এক তরল। চায়ে চাই না বোঝাতে হাত নেড়ে নেড়ে যখন প্রায় ব্যাথা হয়ে এসেছে এবং সেই জায়গা ছাড়বেন কিনা ভাবছেন, তখন দেখলেন এক ভারতীয় যুবক হাতে এক টিফিন কোটো নিয়ে পাশের বেঞ্চে বসে কাগজে কিসের সব হিসেব করতে লাগলেন। এনারা অবাক হয়ে দেখলেন যে সেই ছেলেটিকে কেউ বিরক্ত করছে না – সে একমনে নিজের ডিব্বা খুলে হলুদ স্পঞ্জের মত কি এক টা বস্তু বের করে খাচ্ছে।
ফিল আর বিলের সেই জায়গাটা এত ভালো লেগেছিল যে উঠতে ইচ্ছে করছিল না – কিন্তু হকার-দের হাত থেকে বাঁচতে উঠে গিয়ে বসলেন সেই ছেলেটির বেঞ্চে। আলাপ হয়ে গেল ছেলেটির সাথে, জানা গেল তার নাম ধীরু আম্বানী। ফিলের একটু ফটফট করা অভ্যেস আছে, যতই হোক মাত্র উনিশ বছর বয়স – সে জিজ্ঞেস করে বসল
- দাদা, তুমি কি খাচ্ছ এটা, হলুদ রঙের স্পঞ্জের মত, তাও লঙ্কার কামড়ের সাথে?
- একে বলে ধোকলা
- হোয়াট? ভোকালা?
- নো, নো, ইটস কল্ড ধোকলা!
এর পর প্রায় মিনিট তিনেক ধ্বস্তাধ্বস্তি চলল ধোকালার উচ্চারণ নিয়ে। ধীরু খেতে দিলেন এক পিস করে ধোকলা বিল আর ফিলকে। আলাপ আরো গাঢ় হতে লাগল এনাদের। উনারা জানলেন যে ধীরু ভাই সেই ১৯৪৯ সাল থেকে, মানে প্রায় নয় বছর ধরে আদেন শহরে আছে। এবার বিল জিজ্ঞেস করলেন,
- আচ্ছা ধীরু, একটা কথা আমাদের বল, আমাদের এত হকার চায়ে চায়ে বলে বিরক্ত করছিল। কিন্তু তোমাকে তো কেউ বিরক্ত করছে না! ব্যাপারটা কি? আর বাই দি ওয়ে, হোয়াট ইজ চায়ে?
- বিলদা, চায়ে হল গিয়ে তোমরা যাকে টি বল, তাতে দুধ মিশিয়ে বানানো। আর আমাকে এই হকার-রা সবাই চেনে। চায়ের মত ফালতু জিনিসের জন্য যে আমার পকেটের থেকে ফুটো পয়সাও বেরুবে না সেটা ওরা জানে!
- কিন্তু তুমি ভারত ছেড়ে এখানে এলে কেন?
- আরে দাদা ভারতে প্রচুর কম্পিটিশন চাকুরীর। তার তুলনায় এখানে চাকুরী পাওয়া সহজ। বিজনেসের কাছে ইংরাজি জানা লোক চাই, কিন্তু এদের দেশের লোকেদের ও দেখেছেন। একে লোক সংখ্যা খুব কম, তারপরে ইংরাজী বিশেষ জানে না। এই এখানে এসে বেশ করে কম্মে খাচ্ছি।
এবার ফিল জিজ্ঞেস করল –
- ধীরু-দা তোমার তো বয়স বেশ কম। বাকি জীবন কি এখানেই সেটল করবে নাকি?
- পাগল! আমার তো টার্গেট ঠিক করার আছে! এই যে হাতের হিসেবের খাতা দেখছ, রোজ বিকেলে অফিস শেষ করে হিসেব করি আমার নিজের ফিনান্স কি অবস্থায় দাঁড়িয়ে। একটা টার্গেট জমলেই ভারতে ফিরে নিজের বিজনেস করব।
- (বিজনেসের কথা শুনে ফিল বিশাল ইন্টারেষ্টেড হয়ে পড়ল) তাই নাকি দাদা, তা তোমার টার্গেট মিট করতে আর কত দেরী? কিসেরই বা ব্যবসা করবে?
- সব কিছু ঠিক ঠাক চললে পরের বছরই আমি আদেন থেকে পাততাড়ি গুটাচ্ছি। ফিরে গিয়ে টেক্সটাইলের ব্যবসা করব।
- তাই নাকি? আমারও তো অনেক দিনের স্বপ্ন যে টেক্সটাইল নিয়ে ব্যবসা করি? তা ধীরু-দা কিছু কি প্ল্যানে আছে?
- দ্যাখো, একটা কথা সোজাসুজি বলি, বিজনেসের আইডিয়া পাবলিকের সাথে শেয়ার করা আমার স্বভাব নয়! অনেক দেখলাম তো জীবনে – কে শালা কোথা থেকে ঝেঁপে দিচ্ছে বোঝা মুশকিল!
এবার মাঠে নামলেন বিল – তিনি আসলে ফিল-কে হেল্প করতে চান
- দ্যাখো ধীরু, আমরা তো আর তোমার দেশে ব্যবসা করতে যাচ্ছি না! কি বলতে পারে এই ফিল হয়ত এমন একটা কোম্পানী খুলল আমেরিকায়, যাকে তুমি ইন্টারনেশন্যাল পার্টনার করত পারবে পরে!
ধীরুভাই ভেবে দেখলেন কথায় যুক্তি আছে! বিদেশে তাঁর তেমন কিছু চেনাশুনা নেই – কে বলতে পারে কি দাঁড়াবে। তিনি সম্মতি জানাতে যাবেন – ওদিকে ফিল মুখ দেখেই মনে হচ্ছে হ্যাঁ ধরে নিয়েছে
- ধীরু-দা, তাহলে কি প্ল্যান? দেশে ফিরেই ব্যবসা?
- না-রে ভাই, ব্যবসার লাইসেন্স পাওয়া অত সোজা নয়! লাল-ফিতের বাঁধনে আটকা পরে থাকবে অনেকদিন।
- স্পিড আপ করার কোন উপায় নেই?
- উহুঁ, লাল ফিতের বাঁধন খুব জটিল
লাল ফিতে, লাল ফিতে শুনতে শুনতে বিল গেছেন ধাঁধায় পড়ে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন –
- হোয়াট ইজ লাল ফিতে ধীরু?
- বিল-দা ফিতে মানে হচ্ছে রিবন। লাল মানে রেড – রেড রিবন মোদ্দা কথায়।
কথায় কথায় সন্ধ্যে ঘনিয়ে এল – আলাপ জমে গেছে বলে ধীরু ভাই বিল-ফিলকে বললেন –
- সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। আমি বাইরের খাবার খাই না। তা আপনারা কি আমার বাড়িতে আসতে চান ডিনারের জন্য? আমি নিজেই রাঁধি – নিরামিষ খাবার। খুব একটা খারাপ লাগবে না। খেতে খেতে আমি বিজনেস প্ল্যান্টা বলব।
বিল-ফিলের কিছু করার ছিল না সন্ধ্যাবেলা বলে রাজী হয়ে গেলেন। ধীরু-র দুই কামরার ভাড়া বাড়িতে গিয়ে উনারা ঠেপলা, ফাপড়া, উনদিয়ু, খিচড়ি দিয়ে ডিনার সারলেন। অনেক দিন পর এত স্বাদু খাবার খেয়ে ফিল চেটে চেটে নিজের ফর্সা হাত আরো ফার্সা করে ফেললো।
ডিনার শেষে মিষ্টি ডিস হিসাবে শ্রীকান্দ খেতে খেতে ধীরু-ভাই বললেন
- আমি স্টাডি করে দেখেছি, টেক্সটাইল বিজনেসে খুব পোটেনশিয়াল আছে। তবে পোটেনশিয়াল থাকলেই তো হবে না, এমন কিছু নতুন বাজারে ছাড়তে হবে যে কিছু নতুনত্ব থাকে
- তা ভেবেছো কিছু দাদা?
- হ্যাঁ, অনেক ভেবে দেখলাম সিন্থেটিক কাপড় তো অনেকই বাজারে আনছে। আমি ছাড়াবো বাজারে সুতি, মানে কটন।
- কটন?
- হ্যাঁ, তাই তো পরের সপ্তাহ থেকে কিছু দিনের জন্য ছুটি নিচ্ছে। কলকাতা যাব – ওখানের সুতি বিখ্যাত
সেই শুনে ফিল বলল,
- হ্যাঁ, হ্যাঁ – আমিও কলকাতার নাম শুনেছি। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সবচেয়ে বড় ঘাঁটি ছিল ওটা
- হ্যাঁ তো! কিন্তু তুমি কি করে এত সব জানলে
তখন ফিল খুলে বলল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নিয়ে তার ইন্টারেষ্টের কথা। এবং সাথে বেশ এক অদ্ভূত আবদার করে বসল ধীরু ভাইয়ের কাছে –
- ধীরু-দা বলছিলাম কি ভাইয়ের একটা আবদার রাখবে?
- কি বলো না শুনি?
- বলছিলাম কি পরের সপ্তাহের মধ্যে আমাদেরও তো আদেন শহরটা দেখা হয়ে যাবে। তাই যদি আমরা তোমার সাথে কলকাতা শহর আর সুতির কাপড় দেখতে আসি প্রবলেম আছে তোমার?
- না, আমার আর কি প্রবলেম থাকবে। বরং রাস্তায় সমমনস্ক কথা বলার লোক পাওয়া যাবে।
এখান থেকে কলকাতা যাবার প্ল্যান শুনে ওদিকে বিল গেছে ফায়ার হয়ে –
- ওই, আমি কলকাতায় গিয়ে কি করব? ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বা সুতির কাপড়ে আমার খুব বেশী উৎসাহ নেই। আর অ্যাথলেটিক্স জগতে তো কলকাতার পাবলিকের কোন নামই শুনি নি! তাহলে আমি ওখানে গিয়ে কি স্টাডি করব!
ধীরুভাই দেখলেন এ মাল রাজী না হলে ফিল-ও যাবে না। তাই তিনি টোপ দিলেন
- দেখুন বিল-দা, একেবারেই কিছু শেখার নেই কলকাতায় এমন নয়। কেমন খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে থাকলে একদমই অ্যাথলিট হওয়া যায় না সেটা নিজের চোখে দেখে নিতে পারবেন!
গুঁইগাঁই করে বিল রাজী হয়ে গেলেন। সেই ১৯৫৭ সালে আদের থেকে কলকাতা এসে পৌঁছালেন ধীরু-ভাই, সাথে বিল এবং ফিল। কলকাতা থেকে সুতির কাপড় এবং তাঁতি দেখতে যাওয়া একটু যোগাযোগের চাপ বলে ধীরুভাই ঠিক করলেন ধনেখালি যাবেন।
পরের দিন সকালে সেই মত এসে উনারা তিন জনে হাওড়া স্টেশনে এসে হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনের ট্রেন ধরলেন। একটু চাপেও আছেন ধীরুভাই – এত তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়েছেন বলে স্থানীয় তেমন কারো সাথে আগে থেকে যোগাযোগ করা হয় নি। তখনো ধনেখালি হল্টটি স্থাপিত হয় নি, ঠিক করে নিলেন বেলমুড়ি স্টেশনে নেমে গরুর গাড়ি বা তেমন কিছু একটা ভাড়া করে নেবেন। আর স্থানীয় এক ছেলেকে নিয়ে নেবেন।
কিন্তু রাখে হরি মারে কে! ট্রেনেই ধীরু ভাইয়ের সাথে আলাপ হয় গেল বলরামের সাথে। একদম বাচ্ছা ছেলে – বছর ষোল বয়েস। দেশ ভাগের পর কলকাতার দিকে চলে এসেছে। পড়াশুনা খুব বেশী করার সুযোগ হয় নি – কিন্তু ব্যবসায় বিশাল ঝোঁক। ট্রেনে সে সুতির গামছা, মশারির দড়ি ইত্যাদি বিক্রী করছে। ট্রেন তো প্রচুর আস্তে চলে – ধীরুভাইয়ের সাথে জমে গেল বলরামের – বলরামের আবার একটা মুদ্রা দোষ আছে, কথায় কথায় ‘নাকি’ বলা – মানে “তাই নাকি”, “ঠিক তাইতো নাকি” ইত্যাদি। ধীরুভাই জিজ্ঞেস করলেন ভাঙা বাংলায় (আদেনে কাজ করা কালীন হালকা বাংলা শিখে নিয়েছিলেন ধীরুভাই কারণ সেখানে বন্দরে কাজ করা প্রায় অনেকেই পূর্ব পাকিস্তানের দিক থেকে এসেছে)
- তাহলে বলরাম, তুমি আমাদের ধনেখালিতে তাঁতিদের কাছে নিজে যেতে পারবে তো?
- তাই নাকি দাদা? আপনারা তাঁতির ঘরে যেতে চান নাকি?
- না হলে আর কি বলছি সেই থেকে তোমাকে?
- সমস্যা আছে নাকি দাদা! কিচ্ছু সমস্যা নেই! একদম তাঁতির ঘরে নিয়ে গিয়ে কথা বলিয়ে দেব
বিল আর ফিল, এই ‘নাকি’ ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন না ঠিক মত। ধীরুভাইও ‘নাকি’ জিনিসটার অনুবাদ করে জানাতে পারলেন না। ফলে বিল আর ফিলের কাছে ‘নাকি’ রহস্য অমিমাংসিত হয়ে রয়ে গেল।
সেবারে তিন দিন ছিলেন ধীরু ভাই, বিল আর ফিল ধনেখালিতে। সেই তিন দিনই বলরাম নিজের বাড়ি থেকে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করে ধনেখালি এসে ওদের সাথ দিয়েছিল।
উপরের ঘটনা হয়ত অনেকের জানা নেই – কিন্তু এর পরের ইতিহাস আপনারা হয়ত অনেকেই জানেন, বা চাইলেই খুঁজে পেয়ে যাবেন।
১৯৫৮ সালে নিজের পাক্কা হিসেব মতই ধীরুভাই আম্বানী ফিরে আসেন আদেন থেকে। বোম্বেতে সেটেল করে প্রথমে কাপড়, মশালা ইত্যাদির ব্যবসা শুরু করে, পরে প্লাষ্টিক। এই করে ১৯৬৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রিলায়েন্স ইন্ডাষ্ট্রির – বাকিটা তো ইতিহাস।
ফিল নাইট আর বিল বাওয়ারম্যান ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্টা করেন “ব্লু রিবন স্পোর্টস”। একবার ভেবে দেখেছেন এত কিছু থাকতে ‘রিবন’ কথাটা তাঁদের কোম্পানীর নামে ঢুকল কেন? মনে পড়ছে উনাদের কাছে করা ধীরুভাইয়ের সেই লাল-ফিতের চক্করে বিজনেসের লাইসেন্স পড়ে থাকার কথা?
প্রায় সাত বছর “ব্লু রিবন স্পোর্টস” নাম নিয়ে কোম্পানী চলার পর, বিল আর ফিল ঠিক করলেন মার্কেটিং এর জন্য নাম চেঞ্জ করে এমন এক নাম রাখবেন যে তা সবাই সহজে উচ্চারণ করতে পারে। ভাবতে বসলেন তাঁরা – মনে এসে গেল সেই ধনেখালির দিন গুলির কথা যেখান থেকে তাঁদের সত্যিকারের টেক্সটাইল প্রীতির শুরু। মনে এল সেই অমিমাংসিত রহস্যের শব্দবন্ধের কথা ‘নাকি’! ততদিনে ‘নাকি’ টা ঠিক উচ্চারণ করতে পারলেন না – সেই ‘নাকি’ থেকেই এল নাম ‘নাইকি’-র! বাকিটা ইতিহাসটা আপনারা সকলেই জানেন –
আর সেই হাওড়া-বর্ধমান কর্ডলাইনের বলরাম নামে ছেলেটি? হাল ছাড়ে নি সে – নিজের পরিশ্রমে টাকা জমিয়ে বিজনেস শুরু করে সে, তার ভালোবাসার জিনিস – শাড়ির দোকান, ১৯৭০ সালে। আজকের দিনের “বলরাম সাহা অ্যান্ড সনস্” নামক বিখ্যাত কাপড়ের দোকানটি নিশ্চয়ই কাউকে আলাদা করে চিনিয়ে দিতে হবে না।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।