১৯৯৩ সালের কথা - জ্যোতিবাবু যাচ্ছেন কিউবা, প্রথমে যাবেন কিউবার রাজধানী হাভানা, সেখানে ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে দেখা সাক্ষাত করে তারপর কিউবা একটু ঘুরে দেখবেন। সিপিআইএম পার্টি থেকে জ্যোতিবাবুর সঙ্গী হয়েছেন সীতারাম ইয়েচুরী।
যাওয়ার কয়েকদিন আগে জ্যোতিবাবু ফোন লাগালেন ইয়েচুরী-কে।
- সীতা, তা তুমি কি নিয়ে যাবে ভাবছো কাস্ত্রো-র জন্য? এত দূর থেকে যাচ্ছি, খালি হাতে তো আর যাওয়া যায় না!
- জ্যোতিদা আমি তো এখনো তেমন ডিটেলস কিছু ভাবিনি! তা আপনি কি নিয়ে যাচ্ছেন?
জ্যোতিবাবু ফোনের এদিকে তাঁর সেই বিখ্যাত না ফুটে বেরুনো হাসিটা হেসে নিলেন – কারণ তিনি জানেন যে এই ব্যাপারে তিনি এগিয়ে আছেন ইয়েচুরীর থেকে। তাঁর ভাবার তত কিছু নেই – কারণ কুড়ি বছর আগে কাস্ত্রো কলকাতা এলে বোঝাই গিয়েছিল তিনি কি জিনিস ভালোবাসেন। তাই জ্যোতি বসু বললেন -
- আমার দিক থেকে তেমন ভাবার কিছু নেই, ও সব ঠিক আছে।
- একটু খুলেই বলুন না।
- অত কথা এখন ফোনে বলার সময় নেই, এয়ারপোর্টে দেখা হলে বলব সেই গল্প না হয়।
- ঠিক আছে, তাহলে আমি ভেবে দেখি কি নেওয়া যায়
- বেশী দামী জিনিস নিও না যেন! একটা কথা মনে রেখো সীতা, আমরা কমিউনিষ্ট পার্টি – দামী জিনিস আমাদের ইমেজের সাথে যাবে না
- ঠিক আছে দাদা, আমি ভেবে দেখি কি নেওয়া যায়! তবে দাদা একটা কথা বলুন, আপনি কি মিষ্টির দিকে যাচ্ছেন, নাকি ঝাল ঝাল কিছুর সাথে? আমি সেইভাবে চয়েস করার চেষ্টা করব, যাতে রিপিট না হয়।
- ধরে নাও তা হলে আমি মিষ্টির দিকেই কিছু নিয়ে যাচ্ছি। তেমন ভাবেই এবার চয়েস করো তোমারটা।
কথিত আছে যে সেদিন সীতারাম ইয়েচুরির চয়েসে পশ্চিম বাঙলায় সিপিআইএমের প্রধান্য ধীরে ধীরে কমে যাবার বীজ বুনে দিয়েছিল।
এয়ারপোর্টে ইয়েচুরী-কে দেখেই জ্যোতি বাবু জিজ্ঞেস করলেন –
- তাহলে ফাইন্যালি কি আনলে কাস্ত্রোর জন্য?
- দাদা, আমি কেরালার ব্যানানা চীপস এনেছি।
- মানে! কাস্ত্রো কলা ভাজা খাবে?
- দেখুন জ্যোতিদা, আমি ভেবে দেখলুম ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি বলতে তো ওয়েষ্ট বেঙ্গল আর কেরালা! আপনি ওয়েষ্ট বেঙ্গল থেকে নিয়ে যাচ্ছেন মিষ্টি, তাই আমি কেরালার সিম্বলিক ব্যানানা চীপস নিয়ে যাই!
জ্যোতিবাবু একটু ভেবে দেখলেন যে ইয়েচুরীর কথায় যুক্তি আছে। এবার ইয়েচুরী উলটে প্রশ্ন করলেন –
- দাদা, আপনি তা হলে কি আনলেন?
- কি আবার! কলকাতা থেকে কিছু সাদা আর নলেন গুড়ের রসগোল্লা, আর কালনার ওদিকের মাখা সন্দেশ।
- কাস্ত্রো মিষ্টি খান?
ফ্লাইট ছাড়তে তখনও বেশ দেরী। জ্যোতিবাবু তখন খুলে বললেন কিভাবে কাস্ত্রোর ভালোবাসা গড়ে উঠল মিষ্টির প্রতি এবং আরো খোলসা করে বলতে গেলে দুগ্ধ জাত জিনিসের প্রতি।
তখন ১৯৭৩ সাল – কয়েকদিন পরে কাস্ত্রো সেই প্রথম বারের মত কলকাতা দর্শনে আসবেন। কি ভাবে তাঁকে স্বাগত জানানো যায়, বা কি খাওয়ানো যায় – সেই নিয়ে পার্টি অফিসে-এ বিশাল সভা বসল। বেশি দামী কিছু নিয়ে নাড়াঘাঁটা করা যাবে না – কারণ পার্টি ফান্ডামেন্টালি গরীব – আবার পশ্চিমবাংলা কেও শোকেস করতে হবে এখানকার জিনিস দেখিয়ে।
কাস্ত্রো কাছে তারুণ্যের প্রাধান্য ছিল বেশ বেশী – তাই সেই পার্টি অফিসের মিটিং এ সুভাষ চক্রবর্তী-কেও ডাকা হয়েছিল যে তখন সর্বভারতীয় এস এফ আই এর জেনেরাল সেক্রেটারী। কাস্ত্রো-কে স্বাগত জানাতে হবে শুনে সে মাঝ খান থাকে কিছু কিছু করে বলে উঠল –
- ইয়ে, বলছিলাম কি। কাস্ত্রোকে কি উপহার দেওয়া হবে বা কি খাওয়ানো হবে সে সব আপনারা ঠিক করুন। কিন্তু আমার একটা ছোট্ট প্রস্তাব আছে। বাঙালী থাকবে, কিন্তু গান বাজনা হবে না, এটা হয় নাকি?
পাশ থেকে প্রমোদ বাবু বলে উঠলেন –
- কিন্তু টাইম খুব কম সুভাষ। কাস্ত্রোকে বাঙলা গান শোনানোর মত স্লট বের করা যাবে না!
- প্রমোদ-দা, আমি আলাদা করে বাংলা গান শোনাতে বলছি না। প্রস্তাব দিচ্ছি যে উনাকে গান গেয়ে এয়ারপোর্টে স্বাগত জানাবো মালা টালা দিয়ে।
- কিন্তু গান কে গাইবে, তুমি?
- না না আমি গাইব কেন! রুমাদি-কে অনুরোধ করব সে তার দলবল নিয়ে চলে যাবে। একজন না গান গেয়ে, সবাই মিলে গাইবে।
- কি গান হবে?
- এসো হে বৈশাখ টাইপের কিছু একটা, কোরাস তো!
- মাথা খারাপ নাকি? সলিলের কিছু একটা গান গাইতে বলবে – ওরা জীবনের গান গাইতে দেয় না ধরণের। ঠিক আছে, তাহলে এই কথাই থাক, রুমা যাবে ফুলের তোড়া নিয়ে তার গানের দলের সাথে।
এবার আলোচনা শুরু হল কি দেওয়া হবে তাই নিয়ে। সব আঞ্চলিক নেতারা তাদের নিজেদের প্রস্তাব দিতে লাগলো – শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা দাঁড়ালো, লুঙ্গি, গামছা আর পাটের ব্যাগের উপর। বীরভূম থেকে একজন শান্তিনিকেতনি জিনিস পত্রের হয়ে দাবী জানালো – কিন্তু কোর কমিটির সম্পর্ক শান্তিনিকেতনের সাথে ঠিক মাখোমাখো নয় বলে, জানানো হল যে শান্তিনিকেতন এমনিতেই অনেক এক্সপোজার পায়, অনেক সময় ওভার এক্সপোজার। তাই শান্তিনিকেতন বাদ – তার জায়গায় ঢুকলো বাঁকুড়ার পোড়ামাটির ঘোড়া। দায়িত্ব ভাগ হয়ে গেল খুব একটা প্রবলেম না হয়ে।
লুঙ্গি নিয়েও খানিক বিতর্ক হল – অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করলেন কাস্ত্রো লুঙ্গি আদৌ পরবেন কিনা! এক নেতা পরামর্শ দিলেন যে কাস্ত্রো যদি কোনদিন গরিলা যুদ্ধে যান, তাহলে রাতে বনে বাদাড়ে শোবার সময় লুঙ্গি কাজে লাগবে। নাইট ড্রেসও হবে – আবার একটু টেনে নিলে গায়ের ঢাকা!
এরপর বিশাল গোলযোগ তৈরী হল কাস্ত্রোকে কি খাওয়ানো হবে সেই নিয়ে। বাঁকুড়ার এক নেতা মুড়ি খাইয়েই ছাড়বে কাস্ত্রোকে – তাঁকে নিরস্ত করা হল এই বলে যে তুমি তো ঘোড়া দিচ্ছ, আবার মুড়ি! আর তা ছাড়া কাস্ত্রো মুড়ি খেতে শুরু করলে যা টাইম লাগবে, তাতে অন্য সব মিটিং তা হলে বাদ দিতে হবে!
পার্টি অফিসে মিটিং চলতেই থাকল, অনেকে বসে বসে বিরক্ত হয়ে বাইরে বিড়ি খেতে গেল। পুরুলিয়ার লিডার অনেকক্ষণ চুপ চাপ বসেছিলেন – চান্স পেয়ে এবার মুখ খুললেন –
- বলছি কি, কিউবার চুরুট তো বিখ্যাত। তা আমরা কি ওই লাইনে গিয়ে দেখাতে পারি না যে আমরাও কম যাই না!
- বল কি, তোমাদের পুরুলিয়ার দিকে চুরুট আছে নাকি?
- না চুরুট থাকবে কেন! কিন্তু বিড়ি পাতার জঙ্গল থেকে স্পেশাল করে বড় কড়া টাইপের বিড়ি বানিয়ে আনতে পারি
বাকি কেউ রাজী হল না এই প্রস্তাবে। ওদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে – খাবার নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয় নি তখনো। সবাই বেশ বিরক্ত হয়ে বলল – বেশী আলোচনা করে আর লাভ নেই, বাঙালী যেই জন্য ফেমাস, সেই মিষ্টিই তা হলে দেওয়া হোক। তাহলে কি মিষ্টি? ভোট বেশী পড়ল রসগোল্লা এবং সন্দেশের দিকে।
বিনয় কোঙার অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলেন – বর্ধমান নিয়ে বিশেষ কিছু বলার চান্স পান নি। ওনাকে পাশ থেকে কেউ বলল – তাহলে বিনয়দাকে বলা হোক শক্তিগড়ের ল্যাঙচা আনতে।
বাকি লোকজন হইহই করে উঠলে, ল্যাঙচা হলে ছানাবড়া নয় কেন, নয় কেন নিখুঁতি, বা মোয়া বা মেচা ইত্যাদি ইত্যাদি। এবার বিনয়বাবু দেখলেন এই চান্স বর্ধমান পুশ করার -
- তাহলে আমার একটা প্রস্তাব আছে। রসগোল্লা আপনারা কোলকাতায় কে সি বা নবীনের কাছ থেকে নিন। আমি বরঙ কালনা থেকে মাখা সন্দেশ আনি কাস্ত্রোর জন্য।
- কিন্তু মাখা সন্দেশ কি ভালো হবে! (জ্যোতি বাবু পাশ থেকে বলে উঠলেন)।
- বর্ধমান কি কোনদিন পার্টিকে ডীচ্ করেছে? আমার উপর বিশ্বাস রাখুন।
এই ভাবেই ফাইন্যাল হল কাস্ত্রো কোলকাতায় এলে তাঁকে খাওয়ানো হল ধবধবে সাদা স্পঞ্জ রসগোল্লা এবং নলেন গুড়ের খয়েরী রসগোল্লা এবং সাথে মাখা সন্দেশ। নলেন গুড় তেমন পছন্দ হল না কাস্ত্রোর – কিন্তু সাদা রসগোল্লা আর মাখা সন্দেশ খেয়ে তিনি ফিদা। কলকাতায় এসেছিলেন ভিয়েতনাম ফেরত – অনেকের সাথে হ্যানয়-এর গল্প করছিলেন, বলছিলেন সেখানকার পরিস্থিতি। কিন্তু মিষ্টি খেতে শুরু করে তাঁর সেই গল্প বন্ধ – পুরো হাঁ হাঁ করে এগারোটা সাদা রসগোল্লা আর পাঁচশো মাখা সন্দেশ সাবাড় করলেন।
এবার প্রশ্ন, এই মিষ্টি কি ভাবে তৈরী হয়? ঠিক ঠাক কেউই বোঝাতে পারছে না। শুধু ছানা-তে গিয়েই ঠেকে যাচ্ছে। কাস্ত্রো বললেন, তাহলে এই ছানা কি ভাবে তৈরী হয়? আমি ছানা খাবো!
ছানা কোথায় পাওয়া যায়! এতক্ষণ পাত্তা না পাওয়া একজন প্রকৃত গ্রামীণ নেতা জানতেন যে বড়বাজারে ছানা পট্টি আছে। সেখান থেকে ছানা আনানো হল – মিষ্টি ছাড়া ছানা খেয়ে কাস্ত্রো খুব খুশী। জিজ্ঞসা করলেন
- এই ছানা কি থেকে হয়?
- (সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন) দুধ থেকে
- কিসের দুধ?
- গরুর
কিউবাতে গরু আছে যে প্রজাতির তারা গরমে থাকতে পারে, বেশ শক্তপোক্ত – কিন্তু তাদের বেশী দুধ দেবার ক্ষমতা নেই। অনেক দিন ধরেই কাস্ত্রো নিজের জন্য না হলেও কিউবা দেশের জন্য দুধের কথা ভাবছিলেন – যে দেশকে স্বনির্ভর হতে হবে। দুধ খেয়ে বিল্পব হবে। কিন্তু তার মধ্যে নিজের বিশেষ ইন্টারেষ্ট ছিল না দুধেরর প্রতি এতদিন। কিন্তু কলকাতার ছানা এবং মিষ্টি খেয়ে ফিদা হয়ে ফিদেল কাস্ত্রো ঠিক করেই নিলেন যে ফিরে গিয়ে কিউবার ডেয়ারী ইন্ডাষ্ট্রিকে দাঁড় করাবেনই। তাই কাস্ত্রো প্রশ্ন করে করে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলেন -
- গরু ছাড়া অন্য কিছুর দুধ থেকে হবে না?
- আসলে কি জানেন তো ছানা জিনিসটা ডেলিকেট ব্যাপার। মোটা-সরু দুধেরও ব্যাপার আছে। মোষের দুধের ছানাও একটু অন্যরকম। গরুর দুধই বেষ্ট
কিন্তু এদিকে ছানা এত ভালো লেগে গ্যাছে যে, কিউবাতে ফিরে গরু নিয়ে কিছু করা যায় কিনা ভাবতে বসলেন। গরু নিয়ে প্রশ্ন শুরু করলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত-কে
- তাহলে আপনারা গরু রাখেন কোথায় যারা এত দুধ দেয়?
- এই কলকাতা থেকে খানিক দূরে হরিণঘাটা বলে একটা জায়গা আছে যেখানে একটা দুধের ফার্ম, মানে ডেয়ারী আছে।
- তাই নাকি? কত দূর?
- তা ধরুণ এখান থেকে চল্লিশ কিলোমিটারের মতন
- কতক্ষণ যেতে লাগে?
- গাড়ি করে গেলে ধরুণ প্রায় দুই ঘন্টার কাছাকাছি
- তাহলে কিছু মনে না করলে আমি একবার দেখতে চাই আপনাদের ডেয়ারী। আমার খুব পছন্দ হয়েছে আপনাদের এই দুধের বানানো জিনিসপত্র। আমি কিউবাতে এমন কিছু করতে চাই
সেই ১৯৭৩ সালে কিছু সময়ের জন্য কলকাতা এসে কাস্ত্রো ভালোবেসে ফেলেছিলেন রসগোল্লা, সন্দেশ এবং দুধের জিনিসপত্র। ঘুরে গিয়েছিলেন হরিণঘাটা। এর পরে অনেক আর্টিক্যাল লেখা হয়েছে কাস্ত্রো-র দুগ্ধজাত জিনিসের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে। আইস-ক্রীম থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছু – কিন্তু সেই ভালোবাসার বীজ যে বোনা হয়েছিল কাস্ত্রো-র কলকাতা ভিজিটের সময়, সেটা অনেকেই জানেন না।
তাই সেদিন ফোনে যখন ইয়েচুরী জিজ্ঞেস করেছিলেন জ্যোতি বসু কি নিয়ে যাবেন কাস্ত্রো-র জন্য, তার উত্তর জ্যোতি বসুর কাছে খুবই সোজা ছিল – তিনি সাথে নিয়েছিলেন সাদা রসগোল্লা এবং মাখা সন্দেশ।
ফাস্ট ফরোয়ার্ড কুড়ি বছর। জ্যোতি বাবু এবং সীতারাম ইয়েচুরী দুজনে হাভানার হোটেলে আছেন, তখনো কাস্ত্রোর অ্যাপোয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় নি। তিনি নাকি তখন চিলি দেশে গেছেন আঙুরের ক্ষেত দেখতে। ইয়েচুরী আর জ্যোতি বাবু সময় নষ্ট না করে কিউবার অন্যদের সাথে মিট করছেন।
সেদিন রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা - তখন হোটেলে ঘুমোতে যাবেন যাবেন করছেন, এমন সময় অন্য হোটেল থেকে কল এল যে কাস্ত্রো নাকি সেই রাতেই সাক্ষাত করতে চান।
জ্যোতিবাবু আর সীতারাম ইয়েচুরি তড়িঘড়ি যে গিফটগুলো এনেছিলেন সেগুলো নিজেদের হোটেলের রুম থেকে তুলে নিয়ে কাস্ত্রোর সাথে দেখা করবেন বলে এগুলেন। কিন্তু ওই যে বলে না – যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয় (পরে যে প্রবাদবাক্যটি পশ্চিমের লোকেরা চুরি করে ‘মারফি’স ল’ নামে চালাতে শুরু করে – তবে সেই গল্প অন্যদিন)।
লিফটে উঠতে গিয়ে জ্যোতিবাবুর ধুতির পাড় আটকে গেল দরজা বন্ধ হবার সময় তার ফাঁকে! টানাটানিতে সেই পাড় গেল ছিঁড়ে! আর আমরা সবাই জানি ধুতি নিয়ে জ্যোতিবাবু কেমন সেনসিটিভ – কলকাতা বাজারে প্রচলিত ছিল যে ধুতি সর্বাঙ্গীন সুন্দর করে পরতে পারে দুই বাঙালি – একজন উত্তম কুমার, অন্যজন জ্যোতি বসু। তবে এই নিয়ে মতান্তর ছিল না এমন নয় – ইন ফ্যাক্ট সিপিআইএম পলিটব্যুরর মধ্যে যেটুকু মনান্তর ছিল তা এই ধুতি পরা নিয়েই। প্রমোদবাবু এবং অনিল নাকি খুব একটা খুশী হতে পারেন নি তাঁদের ধুতি পরার স্টাইল জনসমাজে তত স্বীকৃত হয় নি বলে।
যাই হোক – সেই ধুতির পাড় ছিঁড়ে যাওয়া মানে জ্যোতিবাবুর কাছে পার্সোন্যালিটিতে হাত। তিনি বললেন –
- সীতা তুমি দাঁড়াও একটু, আমি ধুতিটা পালটে আসি রুম থেকে চট করে
- দাদা, পাড়ই তো ছিঁড়েছে একটু! ধুতি তত ইমপরটেন্ট নাকি কাস্ত্রোর সাথে দেখা করা!
- অবশ্যই ধুতি! সেবারে বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে সাতগেছিয়ার দিকে গিয়ে কাদা দেখে গাড়ি থেকেই নামি নি ধুতি নোংরা হবে বলে, আর তুমি এখন ছেঁড়া ধুতি পরে যেতে বলছ। ভোট আমাকে টলাতে পারে নি আর কাস্ত্রো!
- দাদা, বুঝতে পারছি। কিন্তু এখন রাত প্রায় বারোটা – কে আর দেখবে আমাদের! গাড়ি থেকে নেমেই হোটেলে ঢুকে যাব, প্লীজ চলুন।
বেশ অনিচ্ছা সত্ত্বেও জ্যোতি বাবু গেলেন সেদিন পাড় ছেঁড়া ধুতি পরেই। হোটেলের ঘরে ঢুকে দেখলেন কাস্ত্রো বিশাল মুডে। এমনিতে কাস্ত্রো যে বিশাল কিছু পান করতেন তেমন নয়, ওনার পছন্দ ছিল চুরুট। কিন্তু সেদিন চিলি থেকে ফিরেছেন বলে সাথে বেশ কিছু গিফট পাওয়া রেড ওয়াইন ছিল ১৯৮২ সালের আঙুরের। জ্যোতি বাবুকে আলিঙ্গন করে ইয়েচুরীর পরিচয় জেনে নিলেন – এবং আহ্বান
- তোমাদের সাথে আজই দেখা করি মনে হল। সরি এত রাতে ডাকার জন্য। আসলে আমি জানতাম জ্যোতি আমার জন্য কোলকাতা থেকে আমার ফেবারিট জিনিসটা আনবেই। কিন্তু ওই জিনিস এখন তো আর রাতে খাওয়া যাবে না। এস চিলির রেড ওয়াইন এর বোতল খোলা যাক
এদিকে ইয়েচুরী হয়েছেন কনফিউজড। তখনো নতুন – সিনিয়র জ্যোতিদার সামনে পান করা ঠিক কিনা বুঝতে পারছেন না, আর তার থেকেও বড় কথা কমিউনিষ্ট গরীবি ইমেজের সাথে দামী রেড ওয়াইন যাবে কিনা সেই নিয়েও ধন্দে! জ্যোতিবাবু ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এগিয়ে এলেন –
- ঠিক আছে, তাই হোক। সীতা অল্প খাবে আমাদের সাথে।
ইয়েচুরী বেশ উৎসাহের সাথে রেড ওয়াইনের গ্লাস হাতে তুলে নিলেন। কি মনে হতে তাঁর কলেজ লাইফ এবং ইন্ডিয়া স্টাইলে মদ খাবার কথা মনে এসে গেল! সাথে চাট হলে ভালো জমত – আর তখনি সাথে আনা কেরালার ব্যানানা চিপসের ছবি চোখে ভেসে উঠল। কাস্ত্রো বা জ্যোতিবাবুকে জিজ্ঞেস না করেই ব্যাগ খুলে চিপসের প্যাকেট গুলো টেবিলে রাখলেন –
- রেড ওয়াইনের সাথে আমার আনা এগুলো খেলে ভালো জমবে!
- এগুলো কি? (কাস্ত্রো জানতে চাইলেন)
- এগুলো কেরালা থেকে আনানো স্পেশাল করে ভাজা ব্যানানা চিপস।
- ওই তাই নাকি!
এই বলে কাস্ত্রো রেড ওয়াইনে চুমুক দিতে দিতে সেই কেরালা চিপসে কামড় দিলেন! তখন আলোচনা চলছিল পশ্চিমবঙ্গের এগ্রিকালচার এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাপার স্যাপার নিয়ে। প্রায় তিরিশ বছর আগে যখন কাস্ত্রো দেখা করেছিলেন নেহেরুর সাথে তখনি তিনি জানিয়ে ছিলেন যে শুধু কিউবা নয়, তৃতীয় বিশ্বের বাকি দেশগুলিকেও উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়া তাঁর আকাঙ্খার মধ্যে আসে। তো সেই প্রসঙ্গেই পশ্চিমবাংলার ইন্ডাষ্ট্রি কেমন চলছে তা জানতে চাওয়া। জ্যোতিবাবু ভেবে পাচ্ছেন না ইন্ডাষ্ট্রি নিয়ে কি বলবেন! প্রায় কিছুই তো আর বাকি নেই হাওড়ার ঢালাই কারখানা গুলো ছাড়া! বেঁচে গেলে ইয়েচুরী মাঝে চিপস নিয়ে ঢুকে পরায়!
কথিত আছে যে আলোচনা সেদিন বেশি দূর এগুলো না তার মূলে ছিল কেরালা ব্যানানা চিপস। রেড ওয়ানের সাথে কলা ভাজা খেয়ে কাস্ত্রোর মুড গেল বিগড়ে! ইন্ডাষ্ট্রি নিয়ে আলোচনা স্থগিত হল আবার পরের দিন দেখা হবে বলে। হোটেলে ফেরার পথে জ্যোতিবাবু ইয়েচুরী-কে মুক্তমনে প্রশংসা করলেন
- দারুণ সময়ে কলাভাজা বের করেছিলে সীতা! না হলে পশ্চিম বাংলার শিল্প নিয়ে কিছু রূপকথা বুনতে হত কাস্ত্রোর কাছে! পার্টির সাধারণ সম্পাদক হবার সব গুণ আছে তোমার মধ্যে।
তার পরের দিন কিছুটা হলেও মুড ভালো হল কাস্ত্রো-র ঘুম টুম দিয়ে। তিনি নিজেই এবার পরের দিন জ্যোতি বাবুদের সাথে দেখা করার জন্য উনারা যে হোটেলে ছিলেন সেখানে চলে এলেন। বলাই বাহুল্য এই রকম ব্যবহার কাস্ত্রো-র কাছে পেয়ে জ্যোতি বাবু খুবই আপ্লুত হয়েছিলেন, যেটা পরে তিনি নানা জায়গায় বলেছেন – আপনারা অনেকেই পড়ে থাকবেন।
হোটেলে এসে এককাপ চা খেয়েই কাস্ত্রো বললেন, চলুন আপনাদের কিউবান ডেয়ারী ইন্ডাষ্ট্রী দেখিয়ে আনি। আর এর জন্য সেই কুড়ি বছর আগের আপনাদের কলকাতার ডেয়ারী ভিজিটের কাছে আমি খুবই কৃতজ্ঞ।
হোটেল থেকে বেরিয়ে তিনজনা হাভানা শহরের কাছে সবচেয়ে বড় ডেয়ারী ফার্মে গেলেন। হাজার হাজার গরু, জ্যোতি বাবু অবাক হয়ে গেলেন – তবে গরুর সংখ্যা দেখে নয়, এত পরিষ্কার ফার্ম দেখে। সাদা ধুতির জন্য কাদা জায়গায় যেতে জ্যোতি বাবুর একটু কিন্তু কিন্তু আছে সেটা ততদিনে ইয়েচুরীও জেনে গ্যাছেন। কিন্তু সেই ফার্মে পরিচ্ছন্নতা দেখে মন খুলে ঘুরলেন। জ্যোতি বাবু আর কিছুদিন বাঁচলে দেখে যেতে পারতেন – শুধু পরিচ্ছন্নতা নয়, গরুর সংখ্যার প্রাচুর্যও রাজনৈতিক নেতার মনে প্রফুল্লতা এনে দিতে পারে – দুধ ছাড়াও অন্যভাবে ইনকামের সোর্স হিসেবে। কাস্ত্রো-র ও দূর্ভাগ্য যে গরু থেকে ওই ভাবে ইনকামের পথটা তিনি শিখে যেতে পারেন নি কলকাতা থেকে।
যাই হোক, কাস্ত্রোর ফার্মে ঢোকার মুখেই আছে গরুর এক বিশাল বড় স্ট্যাচু – সেই গরুর নাম ‘উবরে ব্লাঙ্কা’। ১৯৮৫ সালে ব্লাঙ্কা মারা যায় – কিন্তু তার আগে গিনেস বুকে নিজের নাম তুলে গিয়েছিল ১৯৮২ সালের জানুয়ারী মাসের কোন একদিনে ১১৩ লিটার দুধ দিয়ে!
১১৩ লিটার দু একদিনে! জ্যোতিবাবু এবং ইয়েচুরীর মুখ হাঁ হয়ে গেল। কিন্তু তাঁদের আরো অবাক করে বলে উঠলেন কাস্ত্রো,
“এই যে উবরে ব্লাঙ্কা এত দুধ দিল, এটাও কিন্তু কলকাতা ঘুরে না এলে সম্ভব হত না। আমি যখন ১৯৭৩ সালের ভিয়েতনাম হয়ে আপনাদের দিকে দিয়ে ঘুরে এলাম তখন ব্লাঙ্কার বয়স মাত্র এক বছর। গরুকে কি খাওয়ালে ভালো দুধ দেয় সেটা আমাদের দেশের অনেকেরই জানা ছিল না। আপনাদের ওখান থেকে ফিরে এসে খোল-ভূষি খাওয়ানো চালু করি প্রবল ভাবে। আর খাবার শেষে পাতায় পড়ে থাকা জিনিস ফেলে না দিয়ে গরুর ডাবায় দেবার নির্দেশ দিই। ধীরে ধীরে দুধ দেবার পরিমাণ বাড়তে থাকে”।
জ্যোতি বাবু এবং ইয়েচুরী মুখ চাওয়া চাওয়ি করলেন – কে বলে কমিউনিজম প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে, আর বাঙালীর কোন অবদান নেই! পরের পলিটব্যুরোর মিটিং এ এটা নিয়ে দুই দিনের শেসন রাখবেন ঠিক করে নিলেন তাঁরা দুজনেই সেই সুদূর কিউবায় কাস্ত্রোর ডেয়ারী ফার্মে দাঁড়িয়ে -
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।