১৯৩৪ সালের কথা - রবি ঠাকুর আমন্ত্রণ পেলেন কলকাতায় ‘বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স’ এর উদ্বোধন করার। একদম যাবার ইচ্ছে নেই রবি বাবুর, কিন্তু শান্তিনিকেতনের পাবলিক নাছোড়বান্দা – বারে বারে কানের কাছে বলতে লাগলো এই সব অনুষ্ঠানে না গেলে রবীন্দ্র সংগীতের মার্কেটিং কেমন করে হবে! ততদিনে রবি বাবু বুঝে গেছেন যে তাঁর যা কিছু কমার্শিয়াল স্টেক সবই ওই গানের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকবে। গান দাঁড় করাতে না পারলে শান্তিনিকেতনও দাঁড়াবে না মনের মত করে – গানেই পয়সা এই সারমর্ম মরমে গেঁথে গেছে একদম।
তো গেলেন উদ্বোধন করতে। এমনিতে উদ্যোক্তরা বলেছিলেন যে রবি ঠাকুর গিয়ে লম্ফ জ্বালিয়ে উদ্বোধন চলে এলেই হবে – ওতেই ফুটেজ যা দরকার সব কালেক্ট হয়ে যাবে। তার পর বাকিটা উনারা সামলে নেবেন। ততদিনে দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা চলে এসেছেন মনমালিন্যের জন্য। এর জন্য কবি নিজে সরাসরি দায়ী ছিলেন না অবশ্যই – কিন্তু অভিমান হেতু দিনু দেখাও করছিলেন না তখন কবির সাথে। কিন্তু ওদিকে গান আবার মজ্জায় – তাই বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সে চলে এলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, এবং এসে দেখা হয়ে গেল কবির সাথে। দিনু কি বলবে বুঝতে পারছে না – কিন্তু কবি একদম কুল, জিজ্ঞেস করলেন –
- কি রে দিনু, দেখাই পাওয়া যায় না তো তোর! ভ্যাগিস এলি এখানে
- তুমি তো উদ্বোধন করে দিয়েছ অলরেডী, তা এখনো বসে আছ যে এখানে? ব্যস্ততা কি কমে গেছে নাকি আজকাল?
- তা না রে, শান্তিনিকেতনের ওরা বলল এখানে এই সুযোগে কিছু মার্কেটিং করতে আমার লেখা গানগুলোর
- তুমি কি গান গাইবে নাকি?
- গান গাইতে কি অ্যালাও করবে? মনে হয় না – তার চেয়ে বরং আমি একটা লেকচার দিয়ে দিই
- কি নিয়ে লেকচার দেবে? তোমার লেকচার শুনে লোকে ঢুলবে
- আরে বাবা, গান নিয়েই লেকচার দেব এখানে। তুই তো জানিস, কি রাগ নিয়ে আমি খেলা করি নি? ভৈরবী, ইমন, কাফি, খাম্বাজ, বেহাগ, জয়জয়ন্তি সবেতেই গান বেঁধেছি
- সেটা ঠিক, কিন্তু বেশী বোর করবে না একদম। সংক্ষেপে কাজ সারবে
- ঠিক আছে, মনে রাখব তোর পরামর্শ
এই বলে কবি হাত তুলে ডাকলেন ফাংশনের একজন কর্তা-কে। জানালেন তাঁর বক্তব্য রাখার ইচ্ছের কথা। কিন্তু সেই কর্তা বলল,
- এখন তো সব সিডিউল ফিক্সড, কি করে আপনাকে মাঝে ঢোকাই বলুন তো! তাও আবার বক্তৃতা!
- তবুও একটু দেখুন না যদি অ্যাডজাষ্ট করে নেওয়া যায় কিছুটা। আমি বেশী টাইম নেব না
- ঠিক আছে দেখছি। এর পরে শচীন গান গাইবে। তার পরের পার্টিসিপেন্ট-কে এখনো দেখছি না। আপনি এখানেই থাকুন। চান্স পেলেই আমি ডেকে নেব।
সেই মত বসেই রইলেন রবি ঠাকুর – আর এই ভাবেই সম্পূর্ণ আন-প্ল্যানড ভাবে পালটে গেল শচীন দেব বর্মণের জীবন। হ্যাঁ, আমাদের প্রিয় শচীন কর্তা, তখনো যদিও ‘কর্তা’ উপাধি পান নি। ২৮ বছরের মত বয়স তখন শচীন দেব বর্মণের। তখন তিনি গান-ই গান মূলত। সেই সে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় এম এ পড়তে এসেছিলেন ১৯২৪ সালে – কিন্তু সংগীতের ক্ষপ্পরে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর এম এ শেষ করতে পারলেন না। কৃষ্ণ চন্দ্র দে এর কাছে গান শিখলেন টানা পাঁচ বছর – ১৯২৫ থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত। তারপর ১৯৩২ সাল থেকে জুড়ে গেলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের সাথে যদিও ভীষ্মদেব মাত্র তিন বছরের বড় ছিলেন শচীন দেবের সাথে। কিন্তু ভীষ্মদেব ছিলেন অন্য জিনিস – অমন প্রতিভা বাংলা সংগীত জগতে আসে নি বলতে গেলে। এই নিয়ে অন্যদিন লিখব এখন। তো যাই হোক, এই সব গান টান শিখে ততদিনে শচীনদেব কলকাতা রেডিও-তে গান-টাই গাইছেন।
সেদিনের অনুষ্ঠানে শচীন দেব গান গাইতে উঠলেন। রবি বাবুর ততক্ষণে চলে যাবার কথা, আর শচীন দেব সরাসরি গ্রীন রুম থেকে এলেন বলে তিনি আর খেয়াল করেন নি শ্রোতাদের মধ্যে রবি ঠাকুর বসে আছেন। গান শুরু হল – শচীন দেব সেদিন গাইলেন ঠুমরি। সেই কি গাইলেন – পুরো অনুষ্ঠান শেষ হলে শচীন দেব পেয়েছিলেন গোল্ড মেডেল। রবি বাবু খুব মন দিয়ে গান শুনছিলেন – মজে গিয়েছিলেন, একসময় জিজ্ঞেস করলেন
- হ্যাঁরে, দিনু, ছেলেটা কে রে? ভারী সুন্দর গাইছে তো।
- ওটা তো শচীন। ওর বাবাকে চিনবে তুমি। ত্রিপুরায় গিয়ে অনেকবার উনার সাথে সাক্ষাত হয়েছে তোমার
- আচ্ছা, ত্রিপুরার রাজ দরবারে তবলা বাজায় নাকি ছেলেটার বাবা?
- ওফ, তোমার যত বয়স হচ্ছে না, তত ফিলসফিক্যাল হয়ে যাচ্ছো। আগে কি লিখতে, কি বলতে তবু কিছুটা বোঝা যেত, এখন তো তুমি প্রায় দুর্বোধ্য!
- আমার দুর্বোধ্যতার সাথে এই ছেলেটির সম্পর্ক কি? তুইও কলকাতায় সিফট করার পর ভাট বকতে শুরু করেছিস দেখছি!
- শচীন হল গিয়ে তোমার ত্রিপুরার রাজকুমার নবদ্বীপচন্দ্র দেব বর্মণের ছেলে
- বলিস কি! মাণিকের নাতি? (*মহারাজা ঈশ্বরচন্দ্র মানিক্য দেব বর্মণ)
- হ্যাঁ, তাই তো দাঁড়াচ্ছে
- তাহলে একবার গিয়ে দেখ করে আসি। এ ছেলে মনে হচ্ছে নাম করবে যদি শুধু ‘সা সা’ করে জীবন না কাটায়। আমার গান-ও যদি গাইতে চায়, দেখি একবার বলে। আমার দিক থেকেও মার্কেটিং হয়ে যাবে
- তুমি এক নোবেল লরিয়েট কবি যাবে গ্রীন রুমে এক ছোকরার সাথে দেখা করতে! মান সম্মান কিছুই তো রাখবে না দেখছি!
- তোর নামে তো আর বিল আসে না! শান্তিনিকেতনের বিল মেটাতে গিয়ে আমাকে গ্রীন রুম কেন, দরকার হলে সেজে গুজে স্টেজেও নামতে হবে।
- ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি বসো। আমি গ্রীণ রুম থেকে শচীন-কে ডেকে পাঠাচ্ছি
গ্রীন রুমে তখন শচীন দেব বর্মন বসে তারিফ শুনছিলেন অন্যদের মুখে। যেই শুনলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান শুনে খুশী হয়েছেন এবং ডাকছেন, পরিমরি করে ধুতি সামলে ছুটলেন একবারে রবিঠাকুরের সামনে –
- গুরু, আপনি আমার গান শুনেছেন! আমি ভাবতেই পারছি না!
- কিন্তু আমি তো তোমার গুরু নই। এই নামে আমাকে সম্বোধন করো না
- না না, এই গুরু সেই গুরু নয়। এটা কলকাতার একটা সম্বোধন বলতে পারেন
- ও তাহলে ঠিক আছে। তোমার গান আমার খুব ভালো লেগেছে
- আমি একদম আপ্লুত
- তুমি কি আমার গান গাইতে ইচ্ছুক?
- কেন নয়? সেই সৌভাগ্য কি আমার হবে?
- দেখ তুমি একদিন জোড়াসাঁকোয় এসো। খোলা গলায় গান শুনি তোমার।
- এখানে কি বুঝতে পারেন নি আমার রেঞ্জ
- শুধু এই রেঞ্জ দিয়ে তো আর আমার গান গাওয়া যাবে না! “হ্যাঁ-না, তানা – তানা, সা রে গা” করেই প্রায় ঘন্টা দেড়েক কাটালে স্টেজে
- ওই আর কি, যেখানে যেমন
- শোনো শুধু কালোয়াতি গান দিয়ে হবে না। তুমি আমার কালয়াতি গান শোনা নিয়ে বাজারে চালু চুটকিটা শুনেছো তো?
- কোন চুটকি?
- ওই যে আমাকে দিনু বার বার অনুরোধ করছিল এক বিরাট উস্তাদের কালোয়াতি গান শুনতে যাবার জন্য। আমি নাকি জিজ্ঞেস করছিলাম, উস্তাদ থামে তো?
- এটা তো খুবই চালু চুটকি। তবে ছেড়ে দেন না, কত লোকে কত মিথ্যে রটায়
- এটা মিথ্যে নয়, ঘটনা সত্য। আর সেটাই বলছিলেম – গানের ব্যাপারে একটা ফ্রী-তে পরামর্শ দিই শোনো, অবশ্য যদি শুনতে চাও
- প্লীজ বলুন, প্লীজ বলুন – খুব শুনতে চাই।
- গান এমন হবে যেন হৃদয়ে গিয়ে লাগে। তবেই মানুষের মুখে মুখে সেই গান ঘুরতে। শুধু তান মেরে কারুকাজ করে গেলে কিছুই হবে না
রবি ঠাকুরের এই পরামর্শ শচীন দেব বর্মণ সারা জীবন মনে রেখেছিলেন। এবং আপনারা যাঁরা কিশোর কুমারের স্মৃতিচারণ শুনেছেন শচীন কর্তাকে নিয়ে, তাঁরা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন শচীন কর্তার পরামর্শ, “কিশোর, তুই হৃদয় দিয়ে গাইবি, শুধু শুধু কারুকাজ তানা তানা করবি না”। এটা সেই রবি ঠাকুরের দেওয়া পরামর্শ শচীনকর্তাকে।
আবার ফিরে আসা যাক সেদিনের ঘটনায় – রবিঠাকুরের মুখে সোজা সাপটা গান গাইবার কথা শুনে শচীন কর্তা জিজ্ঞেস করলেন
- তাহলে গুরু, রাগ সঙ্গীত ভিত্তিক গান কি বাঁধবোই
- ধুর পাগলা, তা কখন বললাম! এমন রাগ দিয়ে শুরু করবি যেন তা শ্রোতার বুকে গিয়ে লাগে। তার পর না হয় অন্য রাগ নিয়ে খেলা করবি
- তাহলে কোন রাগ নিয়ে খেলব প্রথমে?
- কেন? পিলু নিয়ে নাড়াচাড়া কর। এর মতন শিওর শট জিনিস হয় না। আমি জানিস কতগুলো গান বেঁধেছি এই পিলু-তে? অনেক অনেক – সব ভুলেও গেছি! এ্যাই দিনু, তোর মনে আছে আমি পিলু নিয়ে কি বেঁধেছিলাম
পাশ থেকে দিনু জানালেন – “আমার পরাণ যাহা চায়”, “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে”, “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে আছে”, “তোমায় গান শোনাব”, “চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে”, “দিবস রজনী আমি যেন”, “ওগো নদী আপন বেগে” – আরো আছে, বলব?
রবি ঠাকুর বললেন –
- থাক এতেই হবে। বুঝতেই পারছো শচীন, এগুলো সব হিট গান
- আসলে আমার তো ভৈরবী ভালো লাগে বেশি। কিন্তু আপনি যখন বলছেন তখন ‘পিলু’ দিয়েই স্টার্ট করব না হয়।
- সেটাই করো। পিলু-র নামের মধ্যেই ওই রাগের ফ্রী-ফ্লোয়িং ব্যাপারটা লুকিয়ে আছে
- তাই নাকি? এটা জানতাম না তো? কেমন ভাবে
- এটা অনেকেই জানে না। পিলু এসেছে হিন্দী “পি লুঁ” মানে পান করে ফেলি – এখান থেকে।
- ও তাই!
সেদিন রবি ঠাকুরের কাছ থেকে অনেক কিছু টিপস পেলেন শচীন কর্তা। শচীন কর্তার প্রকৃত গলা অতটা নাকি ছিল না – কিন্তু রবি ঠাকুর পরামর্শ দিয়েছিলেন যে কন্ঠে সিগনেচার আনার জন্য নাকি ব্যাপারটা আরো একটু বাড়াতে। তাতে করে যে কি বাণিজ্য সফল মার্কেট তৈরী হয়েছিল শচীন কর্তার গানের, সেটা তো ইতিহাস বলবে। সেই দিনের উনাদের দুই জনের আলোচনার আরো গল্প পরের দিন করব
আজকে এইটুকু লিখে শেষ করি। ১৯৪৪ সালে যখন শশধর মুখার্জীর অনুরোধে বোম্বে গেলেন শচীন দেব তখনো কিন্তু তিনি রবি ঠাকুরের পরামর্শ ভোলেন নি। কিছু দিন সময় লেগেছিল নিজেকে এসটাবলিস করতে বোম্বের মার্কেটে। ১৯৫০ সাল নাগাদ যখন শচীন কর্তার নাম ছড়াচ্ছে তার পিছনেও ছিল কিন্তু ‘পিলু’ রাগ আর রবি ঠাকুর। ১৯৫০ সালে মুক্তি পায় ছবি আফসার। শচীন দেব বর্মনের সুরে প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সুরাইয়া গান “নয়ন দিওয়ানে এক নেহি মানে” গানটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেম পর্যায়ের গান “সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে”র হিন্দি রূপান্তর ছিল এই গানটি।
পিলু রাগের উপর তৈরি এই গানটি আজকের দিনের অনেকেই হয়ত মনে নেই – কিন্তু এই গানটি সেযুগে কাঁপিয়ে দিয়েছিল মার্কেট আর শচীন দেব বর্মন শচীন কর্তা হবার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল একধাপ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।