আমরা কয়জন জানি যে এই ছবির বীজ যামিনী রায়ের মাথায় বুনে দিয়েছিলেন সত্যেন বোস যেদিন তিনি ‘শ্রোডিঙ্গার ক্যাট’ এর গল্পটা বলেছিলেন উনাকে। সেই যে একটা বন্ধ বক্সে একটা বিড়াল রাখা আছে, সাথে আছে একটা বিষাক্ত গ্যাসের ফ্লাক্স। বেড়ালটা যদি ফ্ল্যাক্সটা উলটে দেয়, তাহলে সে মরে যাবে – না হলে জ্যান্ত থাকবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যদি আপনি বাক্সটা না খোলেন, তাহলে নিশ্চিত ভাবে জানবেন না যে বিড়ালটা জীবিত নাকি মৃত! অর্থাৎ বিড়ালটা একই সাথে মৃত এবং জীবিত। এই ছবিটিও তাই – যামিনী রায় যেদিন প্রথম সত্যেন বোস-কে ছবিটি দেখান, সত্যেন বোস অবাক হয়ে বলেন –
- কিন্তু যামিনী বাবু, চোখের টানটা মুখের বাইরে বেরিয়ে গেছে। মুখের থেকে চোখ বড়, এমন বিড়াল তো আর আসলে হয় না!
- আপনি কি পৃথিবীর সব বিড়াল দেখেছেন?
- না, তা দেখিনি
- তাহলে আপনি কি ভাবে বলতে পারেন নিশ্চিত ভাবে যে চোখ মুখের থেকে বড় হতে পারে না!
- তা পারি না অবশ্য! কি নাম দিয়েছেন ছবিটির?
- নাম এখনো ফাইন্যাল করি নি, কিন্তু ভেবে রেখেছি দেব ‘শ্রোডিঙ্গার ক্যাট’
কোন কারণ বশতঃ যামিনী রায়ের ছবির ক্যাটালগে এই বিড়ালটির ছবি ‘আন-টাইটেলড’ লেখা আছে। কিন্তু আপনি আজ জেনে গেলেন, কি নাম হবার কথা ছিল তার।
কিংবা ধরুণ ওই যে আরেকটি ছবি, “কির্তনীয়া ড্যান্সার” – এটাও দেখবেন একটু অন্যরকম। এই ভাবে কেউ কীর্তন ড্যান্স করে না, অন্তত এই বাঙলায়। আসলে এই আইডিয়াটা যামিনী রায় পান যেদিন সত্যেন বোস উনাকে ‘পার্টিক্যাল স্পিন’ বোঝান। মানে এই যে পৃথিবীর কোন কিছুই স্থির নেই, এমনকি ক্ষুদ্রতম পদার্থকণা গুলিও এক তন্ত্রীতে নাচানাচি করছে, এই কনসেপ্টটাই যামিনী রায়ের কাছে ফ্যাসিনেটিং লেগেছিল। এই ছবিটি আসলে তাই ডিপিক্ট করে ‘বোসন’ পার্টিক্যাল গুলির ইন্টিজার স্পিন।
সত্যেন বোস খুব ভালো এস্রাজ বাজাতেন। ইন ফ্যাক্ট বোস-আইনষ্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স স্বীকৃতি পাবার পর, ইউরোপে গিয়ে যে দুই বছর রিসার্চ করেছিলেন আমন্ত্রণ পেয়ে, তার বেশীর ভাগ সময়টাই কেটেছিল উনার আইনষ্টাইনের সাথে সংগীত চর্চায় – ইনি এস্রাজ, উনি বেহালা। এই সময় সত্যেন বোস যেমন কিছু লেখেন নি পেপার – আইনষ্টাইনও কিছু পাবলিশ করেন নি। দুজনা মিলে লাইফ দেদার এনজয় করছিলেন।
পূর্ব দিকের সংগীত মিলছে পশ্চিমের সাথে। খুব কম জনই এই ব্যাপারটা জানেন যে বোস-আইনষ্টাইন তত্ত্বের অনেক কিছু উদ্ভাবন এবং পরিমার্জন হয়েছিল এই সংগীত চর্চার মধ্যে দিয়েই। পদার্থ কণার যে আচরণ, তার অনেক হিন্টস সত্যেন বাবু পেয়েছিলেন ভারতীয় মার্গ সংগীতের তত্ত্বের থেকে। সত্যেন বোস একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন “ম্যান ইন সায়েন্টিফিক এজ” – সেখানে তিনি দেখিয়েছিলেন ভারতীয় দর্শন দিয়ে কি ভাবে নানা বিজ্ঞানের তত্ত্ব ও ঘটনা ব্যখ্যা করা যায়।
ভারতবর্ষ অনেক বিজ্ঞানীর জন্ম দিয়েছে, কিন্তু সেই হিসেবে খুব বেশী সংখ্যক ‘মহান’ বিজ্ঞানী (যারা আজ সারা পৃথিবীতে স্বীকৃত) ভারত থেকে পরিচিতি লাভ করেন নি। এখানে আমি আধুনিক যুগের কথা বলছি। এমনটা কেন হয় এই সব নিয়ে কাটা ছেঁড়া করে খুঁজলে অনেক প্রবন্ধ বা গুরুগম্ভীর বই/থিসিস পাওয়া যাবে হয়ত। তাতেও মূল সমস্যা কিছু পাল্টায় নি – এই এখনো ভারতবর্ষে প্রথম সারির সারা পৃথিবীতে পরিচিত বিজ্ঞানী প্রায় নেইই বলতে গেলে। যাই হোক, কি ব্যাপারে কিছু তথ্য দিয়ে রাখা যাক – “চেম্বার্স বায়োগ্রাফিকাল ডিক্সনারী” (সেন্টেনারী এডিশন ১৯৯৭) তে সারা পৃথিবীর প্রায় ১৭৫০০ জনের জীবনী আছে। সেখানে ভারত থেকে বিজ্ঞানী হিসাবে এন্ট্রী পেয়েছেন জগদীশ বোস, সি ভি রামন, রামানুজন, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাদ সাহা এবং হোমি ভাবা। কেমব্রীজ থেকে প্রকাশিত ২০০২ সালের “কেমব্রীজ ডিক্সনারী অফ সায়েন্টিষ্ট” তে এই ছয় জনের মধ্যে আবার জগদীশ বাবু এবং হোমি ভাবা ঠাঁই পান নি। ১৯৯৯ সালের “ডিক্সেনারী অফ সায়েন্টিষ্ট কেমব্রীজ ইউনিভার্সিটি” প্রথম ছয় জনের মধ্যে হোমি ভাবা বাদ গেছেন। তার মানে দাঁড়ালো, পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের ডিক্সনারীতে এই তিন প্রকাশনার তুলনা করলে ভারত থেকে চার বিজ্ঞানীর নাম কমন - সি ভি রামন, রামানুজন, সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাদ সাহা!
১৯১৮ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এই মেঘনাদ সাহার সাথে বেশ কিছু কাজ কর্ম করেছিলেন সত্যেন বোস থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স এবং পিওর ম্যাথামেটিক্স নিয়ে। তা ছাড়া একাকীও চিন্তা ভাবনা চালাচ্ছিলেন পুরোদমে – ১৯২৪ সালে যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে কাজ করছিলেন, তখন প্ল্যাঙ্ক এর কোয়ান্টাম রেডিয়েশন সূত্র তিনি ডিরাইভ করে ফেলেন একদম নতুন পদ্ধতিতে অনুরূপ পার্টিক্যালদের স্টেট গণণা করে - ক্লাসিক্যাল ফিজিক্স এর কোনরকম রেফারেন্স ছাড়াই। সে এক মারকাটারী ব্যাপার – এই একটা কাজ থেকেই পরে গড়ে উঠবে ‘কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্সের’ এর ভিত্তি। সত্যেন বাবু সেই পেপার এক জার্ণালে পাঠালে তারা ছাপার যোগ্য মনে করল না – কারণ জিনিসটা তাদের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। এর পর সত্যেন বোস জীবনে সেই প্রথমবার ল্যাদ কাটিয়ে একটা চিঠি লিখলেন সেই কাজের ডিটেলস নিয়ে। আইনস্টাইন তো সেই কাজের ডিটেলস দেখে পুরো হুব্বা! এই ছোকরা করেছে কি! নিজে দায়িত্ব নিয়ে তিনি জার্মানে সেই আর্টিক্যালের অনুবাদ করে ছাপালেন জার্মান ভাষার তৎকালীন বিখ্যাত ফিজিক্স জার্ণালে। তার পরের ব্যাপার ইতিহাস – আইনস্টাইন বুঝেছিলেন এই কাজের বীজ সলিড, কিন্তু কালে কালে সেই কাজ যে এমন মহীরূহ হবে তা স্বয়ং আইনস্টাইনও ভাবেন নি! সেখান থেকে গিয়ে দাঁড়ায় “বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স” এবং ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’ (পদার্থের এক নতুন অবস্থা)। এর পরে পল ডিরাক যে পদার্থ কণা গুলি বোস- স্ট্যাটিসটিক্স মেনে চলে তাদের নাম দেন ‘বোসন’। তো দেখা গেল পৃথিবীর অর্ধেক কণা বোস- স্ট্যাটিসটিক্স মেনে চলে, তাই তাদের বলে বোসন, বাকি অর্ধেককে বলা হয় ‘ফার্মিয়ন’।
যাই হোক, এই সবই আপনারা অনেকেই জানেন। আরো জানতে চাইলে গুগুল করে নিলেই হবে – কিন্তু যে ঘটনা পরম্পরা ততটা পরিচিত নয়, সেগুলি নিয়ে এবার নাড়াঘাঁটা করা যাক। আশা করি এই আলোচনা থেকে বোঝাতে পারব, আমাদের ভারতের প্রাচীন সংস্কৃতি কি ভাবে এই সব মহান মানুষকে প্রভাবিত করেছিল – কি ভাবে মিশে গিয়েছিল আধ্মাত্যবাদ, দর্শন, সংগীত, সাহিত্য এবং বিজ্ঞান।
সত্যেন বোসে একবার লিখেছিলেন “স্ট্যাটিসটিক্স দিয়ে শুধু সাব-অ্যাটমিক পার্টিক্যাল-দের আচরণ ব্যাখ্যা করা যায় এমনটাই নয়, মানুষের ব্যবহারের ব্যাখ্যাও স্ট্যাটিসটিক্স দিয়ে করা যায়”। কি বোঝাতে চেয়েছিলেন কে জানে! সেই ১৯২৪ সালে (তখন সত্যেন বোসের বয়স ৩০ বছর) পেপার লিখে আইনষ্টাইন-কে পাঠিয়ে ব্যাস – খালাস। তিনি লাগলেন রিল্যাক্স করতে – এর পরের ৩০ বছর আর কিছুই পাবলিশ করলেন না। ছাত্র পড়িয়ে, এস্রাজ বাজিয়ে, ছবি-সাহিত্য আলোচনা করে এবং ল্যাদ খেয়ে কাটিয়ে দিলেন – বাঙালী জিনিয়াসের মাপকাঠি। রবি ঠাকুর আর মানিক-বাবু অ্যানোম্যালি। প্রতক্ষ্যদর্শী-দের মতে তিনি লুঙ্গি পরতে বিশাল ভালোবাসতেন – বারান্দায় বসে লুঙ্গি পরে এস্রাজ বাজাচ্ছেন সত্যেন বোস – এ এক বহুল চর্চিত দৃশ্য।
এতটা লিখে ফেললাম, এখনো আলাউদ্দিন খাঁ বা সংগীত এল না – কেসটা কি? আসলে আলাউদ্দিন খাঁ এর ব্যাপারটা এমন নয় যে সত্যেন বোস উনার কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন বা রোজ পায়ের তলায় বসে চিরতা পাতার জল খেতেন! কিন্তু ওই যে ভাবনার মোড় ঘুরিয়ে দেবার ব্যাপারটা, সেটা যদি আলাউদ্দিন-সত্যেন সাক্ষাত না হত, তাহলে হত না! আর আমরা না পেতাম “বোস স্ট্যাটিসটিক্স”, না পেতাম বোসন, না পেতাম কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিক্স! তো সেই হিসাবে সারা পৃথিবীর পদার্থবিদ তথা বিজ্ঞানীদের বাবা আলাউদ্দিন খানের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।
১৯১৭-১৮ সাল, সেবারে বাবা আলাউদ্দিন খান বাজাতে এসেছেন কলকাতায় – সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না সেই সভা। এক কলকাতার জমিদার টাইপের বিখ্যাত লোকের বাড়িতে অনুষ্ঠান। আলাউদ্দিন ততদিনে মাইহার মহারাজের সভাতে কাজ করে সারা ভারতে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। আরো অনেক বিখ্যাত লোকজন সেদিন ছিলেন অনুষ্ঠানে। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় ছিলেন সেই সময়, আলাউদ্দিন আসছেন শুনে নিজেই যাবে বললেন। ততদিনে লালনের গান নিয়ে ইন্টারেষ্ট পেয়ে বসেছে রবীন্দ্রনাথকে – তো সেই নিয়ে কিছু আলোচনার ইচ্ছে ছিল আলাউদ্দিন খানের সাথে। নিজের গ্রাম ব্রাহ্মণবেড়িয়ার দিকে লালনের গান তখন প্রচলিত ছিল না এমন প্রশ্ন ছিল রবি ঠাকুরের মনে আলাউদ্দিন খানের জন্য।
রবি ঠাকুর জগদীশ বসুকে বললেন, “চলো তাহলে আলাউদ্দিনের বাজনা শুনে আসি। অবলা যদি যেতে চায়, সাথে নিয়ে নিও”। সত্যেন বোস তখন মাঝে মাঝে জগদীশ বোসের কাছে যেতেন রিসার্চ বিষয়ক আলোচনার জন্য। সেখান থেকে যখন কথার ফাঁকে শুনলেন উনারা আলাউদ্দিন খানের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন, তখন আর স্থির থাকতে পারলেন না। এদিকে জগদীশ বোস-কে সরাসরি সাথে নেবার অনুরোধ করার সাহস নেই। তাই গিয়ে ধরলেন অবলা বসু-কে – জ্যাঠিমা বলতেন উনাকে সত্যেন বোস। সেই জ্যেঠিমার অনুরোধেই আলাউদ্দিনের অনুষ্ঠানে যাবার চান্স পান সত্যেব বোস।
এই এক রাতের অনুষ্ঠান মোড় ঘুরিয়ে দেয় সত্যেন বোসের। ততদিনে আলাউদ্দিন বেঁধে ফেলেছেন বিখ্যাত সব রাগ – মদন মঞ্জরী (নিজের স্ত্রী-র নামে নামকরণ), প্রভাকলি, শোভাবতী, হেম ভৈরব, মাধবগিরি, হেম বিহাগ ইত্যাদি। আমরা এটা সবাই জানি যে বাবা আলাউদ্দিন প্রায় সব ধরণের বাজনাই বাজাতে পারতেন। এই সরোদ নিয়ে, তো ওই সেতার নিয়ে, খানিক পরে এজ্রাস, এমনকি বেহালা বাজিয়েও সেই সব অনেক রাগ বাজিয়ে শোনালেন সেই রাতে। এক কোণে বসে তন্ময় হয়ে শুনছিলেন সত্যেন বোস – নিজে খেয়াল করেন নি, চোখ নিয়ে ঝরে পড়ছিল জল (তখনো সত্যেন বোস চশমা পরতেন না)। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন কি ভাবে প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্য মিশে যাচ্ছে – তারে তারে কিভাবে ঝঙ্কার দিচ্ছে আলাউদ্দিনের আঙুল। অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলেন – সবাই চলে গেলে একটু আলাউদ্দিন-কে একা পাবার আশায়। ঘর ক্রমশ খালি হয়ে গেলে, একসময় এগিয়ে গেলেন সত্যেন বোস আলাউদ্দিনের দিকে। বাবা আলাউদ্দিন বিখ্যাত ছিলেন তাঁর বদমেজাজের জন্য।
সত্যেন বোস বললেন যে তিনি বাবার কাছে যে কদিন তিনি কলকাতায় আছেন সে কদিন কিছু শিখতে চান – শুনে বাবা বিশাল খাপ্পা –
- তুমি কি এটারে ছেলেখেলা পাইসো! এক মাসের মইধ্যা তুমি বাজনা শিখবো!
সত্যেন বোস বললেন তিনি ফাষ্ট লার্ণার – বাবা বললেন,
- আজকে যে কয়টা রাগ বাজালাম, সেই গুলান সব নতুন। আমি যদি আবার বাজাই, তুমি ধরতে পারবা, সেগুলো কি রাগ?
- চেষ্টা করবো
- তুমি যদি সব কয়টা রাগ বলতে পারো, আমি ভেবে দেখবো তোমার অনুরোধ
সত্যেন বোসের স্মৃতিশক্তি বিশাল – বাবা যে কটা রাগ বাজালেন, সব কটা ঠিক ঠাক সনাক্ত করলেন। বাবা বিশাল ইমপ্রেসড – পরের দিন বিকেলে আসতে বললেন।
পরের দিন বিকেলে ভয়ে ভয়ে বাবার কাছে আবার গেলেন সত্যেন বোস। বাবা বললেন, “তুমি আগে ঠিক করো, কি বাজাতে চাও তুমি”। তখনো সত্যেন বোস ফ্লুট বাজাতেন – আর বাজাতেন এস্রাজ। কেন জানা নেই, সত্যেন বোস বললেই তিনি বাঁশিতেই মন দেবেন। বাবা বললেন, “ঠিক আসে, তুমি আমারে অনুসরণ করো। আমি যেই ভাবে বাজাইতেসি, সেটাই তুমি বাজাও”
বাবা আলাউদ্দিন বাজাচ্ছেন সে এক লেভেলে – সত্যেন বোস পারেন নাকি? বাবার বদরাগ গেল চড়ে – একসময় হাতের বাঁশিটা দিলেন ছুঁড়ে সত্যেন বোসের দিকে, “হেইডা তোমার দ্বারা হইবো না”। সেই বাঁশি গিয়ে লাগে সত্যেন বোসের বাঁ চোখের হালকা উপরে। এর কিছুদিন পর থেকে সত্যেন বোসের চোখের হালকা সমস্যা শুরু হয় – ডাক্তার দেখান, চশমা নিয়ে হয়। যদিও সেই বাঁশির আঘাতের সাথে চশমা নেবার কোন সম্পর্ক ছিল কিনা সেই বিষয়ে সত্যেন বাবু নিজে কোনদিন কিছু বলেন নি। তো যাই হোক, বাঁশিতে ব্যর্থ হবার পর সত্যেন বোস অন-স্পট অনুরোধ করলেন তাঁকে এস্রাজে একবার চান্স দিয়ে। বাবা একটু অনুতপ্ত ছিলেন বাঁশি ছোঁড়ার পর – তাই অ্যালাও করলেন এস্রাজ বাজাতে।
সত্যেন বোসের এস্রাজ শুনে বাবা খুব খুব খুশী। বললেন, “তুমি আমার সাথে মাইহার চলে আইসো। শিখাবো যত্ন করে”। সত্যেন বোস বললেন, একটু ভেবে জানাবেন। এবার এই খবর কি করে যে রবীন্দ্রনাথের কানে চলে যায়। সত্যেন বোসের মতন ছেলে বিজ্ঞান চর্চা ছেড়ে সংগীত চলে যাবে পুরোপুরি, এটা তাঁর কেমন যেন লাগলো। জগদীশের কাছে তিনি শুনেছিলেন যে সত্যে্নের ভিতরে পোটেনশিয়াল কি রকম। আর সত্যেন যত ভালোই এস্রাজ বাজান না কেন, তার থেকেও বেশী ভালো অঙ্ক আর ফিজিক্স করতেন। রবি ঠাকুর তাই সরাসরি আব্বা আলাউদ্দিনের সাথে দেখা করে সব খুলে বললেন,
- দেখুন আপনি হয়ত সত্যেনের থেকে আরো ভালো সংগীতের ছাত্র খুঁজে পাবেন, কিন্তু ওর থেকে ভালো বিজ্ঞানী এই বাংলা হয়ত পাবে না
- কিন্তু রবিবাবু সত্যেন তো নাছোড় বান্দা!
- ঠিক আছে, আপনি ওকে প্লীজ বলুন যে এক্ষুণি যেতে হবে মাইহার তাই নয়। আপনার দরজা ওর কাছে সবসময় খোলা
রবি বাবুর অনুরোধ ফেলতে পারেন নি বাবা আলাউদ্দিন। সত্যেন বোসের সেই যাত্রায় মাইহার যাওয়া ঠ্যাকানো গেল। রবি বাবুর স্নেহ সত্যেন বসুর উপর চিরকাল বর্ষিত হয়েছিল। নিজের একমাত্র বিজ্ঞান বিষয়ক বই “বিশ্ব-পরিচয়” ১৯৩৭ সালে উৎসর্গ করেছিলেন সত্যেন বোস-কেই।
লেখা অনেক বড় হয়ে গেল – একটা ব্যাপার হালকা টাচ করে এই লেখা শেষ করব। এস্রাজ না বাজালে সত্যেন বোস কোয়ান্টাম স্পিন নাম্বার নিয়ে কাজ করতে পারতেন না। ভারতীয় ক্লাসিক্যাল মিউজিকের সাথে ম্যাথামেটিক্সের সম্পর্ক নিয়ে আজকাল অনেক লেখা বেরিয়েছে – এই সত্যেন বোস-ই সেটা প্রথম ডিকোড করেন। আমাদের বাদ্যযন্ত্রের তারের কম্পনের সাথে যে এই মহাবিশ্বের কোন অন্তর্নিহিত সম্পর্ক আছে সেটা এস্রাজ বাজাতে গিয়ে প্রথম লক্ষ্য করেন সত্যেন বোস। ধরুণ আমাদের এই যে ‘সা’ ‘রে’ ‘গা’ ‘মা’ – এই সব কোন র্যান্ডাম জিনিস নয়। এদের প্রত্যেকের একটা আলাদা করে ফ্রীকোয়েন্সী আছে। একটা পীচে নোট গুলি একটা অপরের থেকে যে দিয়ে পৃথক থাকে তাকে বলে ‘ফিফথ’ পশ্চিমের সংগীতে। মানে এই ভাবে ধরুণ ‘সা’ আর ‘পা’ এর যে বিভাজন আছে, তাদের মধ্যে জড়িয়ে আছে এক স্পেশাল সম্পর্ক – হিসেব করে দেখা গেছে যে এই হায়ার নোটের ফ্রীকোয়েন্সী, নীচের নোটের ফ্রিকোয়েন্সীর থেকে ৩/২ গুণ বেশি! তো এই ভাবে যদি আমরা ফ্রীকোয়েন্সী দিয়ে আমাদের সংগীতের নোট সা, রে, গা, মা ইত্যাদিকে সাজাই তাহলে সেটা দাঁড়াবে
১, ৯/৮, ৮১/৬৪, ৩/২, ২৭/১৬, ২
এখান থেকে সত্যেন বোস পান পার্টিক্যালের কোয়ান্টাম স্পিন নাম্বারের ধারণা। বোসন মেনে চলে ইন্টিজার স্পিন মানে ১, ২ ইত্যাদি। আর ফার্মিয়ান-রা মেনে চলে অড হাফ ইন্টিজার স্পীন ৩/২ ইত্যাদি।