সুকিয়ানার ৯ম পর্বে (২৬শে সেপ্টেম্বর) সপ্তমীর দিন ঘাট থেকে কলা বউ স্নান করিয়ে নিয়ে বাড়িতে এসে ঘট প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত গল্প হয়েছিল। আজকে তার পর থেকেই শুরু করা যাক তা হলে। তবে এই লেখা পড়তে গিয়ে কিন্তু একটা কথা মনে রাখার জন্য অনুরোধ করছি – আমাদের বাড়ির পুজো, এক মধ্যবিত্ত বাড়ির দুর্গাপুজো। তাই হয়ত আপনাদের মনের মধ্যে যে সেই বনেদী বাড়ির বড় ধরণের ব্যবস্থা, ঠাকুর দালানের এদিক থেকে ওদিক দেখা যায় না – বিশাল আড়ম্বর, বা সিনেমায় যেমন দেখেছেন – এর অনেকটাই মিলবে না। তবে আমাদের পুজো বড় আন্তরিক, বড় ভালোবাসার জিনিস ছিল চিরকাল আর এখনো আছে – যেখানে আড়ম্বর নয়, বরং অন্তরের টান দিয়ে অনুভূত হয় পুজোর দিনগুলি। তবে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলা সিনেমার সাথে – ওই যে ছেলে বিদেশ থেকে পুজোর সময় গ্রামের বাড়িতে ফিরছে – সেই অ্যাঙ্গেল থেকে দেখলে!
সপ্তমীর সকালে আমরা ছেলে ছোকরারা তো ঘট এনে দিয়ে খালাস – এবার ভার চলে গেল বাড়ির বয়ষ্কদের অধীনে। সারাদিন ধরে পাঁজি মেনে সপ্তমীর পুজো – ঠিক যেমন যেমন নিখুঁত ভাবে করা যায়, বামুনের আশে পাশে থেকে সব কিছুর ব্যবস্থা হতে থাকে। ওদিকে পুরোহিত মশাই ঠাকুরের গলায় পৈতে ইত্যাদি লাগিয়ে সব ব্যবস্থা করছে পুজোয় বসবে বলে। এই সময়ের ঠাকুরের একটা ছবি সাথে দিয়ে দিচ্ছি – গলায় মালা, বা পায়ের গোড়ায় পুষ্প এই সব নেই বলে কেমন খালি খালি লাগে যেন – আর কিছুক্ষণ পর থেকেই সব ভরে যাবে।
আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের পুজো বলে ঠাকুর দালানে পুজোর কাজে সাহায্য করার লোকের অভাব হয় না। পিসিমণি বা বড় দিদিরা ঠাকুর দালানে বসে ফল কাটা কুটি করে – আর ওপাশে কম বয়েসীরা ফুল ইত্যাদি দিয়ে মালা গাঁথে, চন্দন বাঁটে বা বেল গাছের ডাল থেকে সুন্দর করে নরম দেখে তিনটি করে বেলাপাতা গুলি সাজিতে সাজিয়ে রাখে। চন্দন দুই প্রকারেরই থাকে – শ্বেত এবং রক্ত চন্দন। আর বলাই বাহুল্য ঠাকুরের জিনিসে যারা হাত দেবে তাদের অবশ্যই স্নান করে কাচা জামা কাপড় পরে আসতে হবে।
পিসিমণিরা দালানে বসে ফল কাটে – হাসি, ঠাট্টা, গল্প করতে করতে কাজ হয়। ছোট বেলায় এই দালানে খুব একটা বসে থাকার সময় থাকত না এই সময় – কিন্তু বড় হয়ে বিদেশ থেকে ফিরে গেলে এমন সময়টাই খুব সদব্যবহার করা যেত সবার সাথে ক্যাচ-আপ করার জন্য।
কেউ বের করে সাজাচ্ছে মাটির বা পিতলের পিলসুজ এবং বাতি গুলো – কেউ ধুনোতে হাওয়া দিয়ে ধোঁয়া সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এমন সময় বাড়ির ভিতর থেকে ডাক আসে ‘জলখাবার’ খেয়ে যাবার জন্য। আর বর্ধমানের লোক বলে বুঝতেই পারছেন জলখাবার বেলা আমরা কি খেতাম! হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন – মুড়ি! সাথে আলুর দম, বা ঘুগনী – দুটো রসগোল্লা এবং বোঁদে। স্ট্যানার্ড খাবার – মুড়ি খেতে না পেলে বর্ধমানের লোকজন পাগলের মতন আচরণ করে। অষ্টমীর দিন বাড়িতে লুচি খেতে হত – সেই নিয়ে কি ঝামেলা। অনেকে একদিন মুড়ি খেতে পাবে না বলে আগের দিন বা পরের দিন বেশী খেয়ে পুষিয়ে নিত! তবে বাড়ির মেয়েরা অনেকেই উপবাস করত – সপ্তমীর পুজোর পর পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে তারপর খাওয়া।
আচ্ছা, আপনারা বর্ধমানের লোকেদের মুড়ি খাওয়া নিয়ে গল্পটা জানেন? একদিন হয়েছে কি নারদকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবী পরিভ্রমণে বেরিয়েছেন মহাদেব। এক জায়গার উপর দিয়ে যাবার সময় বিশাল ‘সোঁ সোঁ’ শব্দ শোনা গেল। মহাদেব নারদকে বললেন, ‘নারু, মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে – একটু তাড়াতাড়ি যাই চলো”। নারদ রিপ্লাই দিলেন, “স্যার, আপনি চিন্তা করবেন না। এই ‘সোঁ সোঁ’ শব্দটা ঝড়ের নয়। আমরা এখন বর্ধমানের উপর দিয়ে যাচ্ছে – আর নীচে এখানকার লোকেরা জল দিয়ে মুড়ি ভেজাচ্ছে। সেই থেকেই এই শব্দের উৎপত্তি!”
বাড়িতে যখন বাজি বানানো হত, তখন আমরা মুড়ি খেয়ে উঠে যেতাম চিলেকোঠার ছাদে, মানে আমাদের বাজি ফ্যাক্টরিতে। সেখানে বহুযুগ আগে আমাদের সাথী ছিল ন-কাকুর বিয়েতে নাকি কিসে উপহার পাওয়া একটা ফিলিপ্সের টেপ আর সাথে ক্যাসেট। সেই ক্যাসেটে গান চালিয়ে – এমনকি সিনেমার ক্যাসেটও পাওয়া যেত তখন – সেই সব চালিয়ে আমরা বাজি কারখানায় কাজ করতাম। এমন এক সময় ছিল যখন আমি গুরুদক্ষিণা এবং প্রতিকার সিনেমা দুটি প্রায় মুখস্ত বলতে পারতাম! এর পরে যখন বাড়িতে বাজি তৈরী বন্ধ হয়ে গেল, তখনও আমরা চিলেকোঠাতেই আড্ডা দিতাম – ততদিনে অনেকে সিগারেট খাওয়া ধরেছে। বড়দের লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাবার মজাই আলাদা। এর মধ্যে যারা একটু বয়েসে পেকেছে, তাদের মধ্যে অনেকে আবার সিগারেটে সুখটান দিয়ে মুখ উপরের দিকে রিঙ করতে করতে কেত মেরে জিজ্ঞেস করত, “হ্যাঁরে, ছোটকাকার মেজ শালি কবে আসবে জানিস? নবমীর দিন?”
তবে আমি নিজে সপ্তমীর দিন এই সময়টায় বাড়িতে টাইম দিতে পারতাম না। ব্যস্ত থাকতাম এক সম্পূর্ণ জিনিস নিয়ে প্রতিবছর দুর্গা পুজোর সপ্তমীর দিন বিকেলে নিমো গ্রামের বারোয়ারী তলায় ‘সাহিত্য সভা’ হত সেই সময়। এর মূল উদ্যোক্তা ছিল সামাদ সাহেব – সাহেব মারা যাবার পর শচীন জ্যাঠু কয়েক বছর চালায়। তার পর শচীন জ্যেঠুও মারা গেলে প্রায় ৬৫ বছর ধরে চলা সাহিত্য সভা বন্ধ হয়ে যায়। আগেও মনে হয় সাহিত্য সভার গল্প লিখেছি এখানে, তবুও আর একবার হালকা করে রিপিট করে দিই।
আমি এবং আমাদের কাছে সেই বয়সে সাহিত্যের থেকে অবশ্যই হুজুগটাই প্রধান ছিল – কিন্তু আমি যেটা তখনও এবং আজ পর্যন্ত বুঝতে পারি নি যে সাহিত্য সভা নিমোর বুকেতে ঘটানোর মূলে প্রাথমিক ধারণাটি কার মাথা থেকে বেরিয়ে ছিল? আমি কম্মি কালেও আমাদের গ্রামের কাউকে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে শুনি নি – সুভাষ এবং গান্ধীর নাম বছরে দুই-তিন বার। এবং নিমো ভারতীয় সেবক সমাজ দ্বারা আয়োজিত বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতার মত রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎসব ক্লাব প্রাঙ্গণে – এর মধ্যে কোথাও সাহিত্য ছিল না। কিন্তু আমাদের গ্রামের মানুষের আর যাই কিছু না থাক, উৎসাহ এবং অনুসন্ধিৎসু ছিল প্রচুর। ফলতঃ সালাম চাচা থেকে শুরু করে শিবু জ্যাঠা যে প্রবল উৎসাহে কমরেড মহানন্দের শ্রমিক বঞ্চনার ইতিহাস থেকে সি পি আই এম কর্তৃক তাদের উদ্ধার হওয়ার হবার বক্তৃতা শুনতে যেত, সেই সম পরিমাণ উৎসাহে সাহিত্য সভার সামনের সারিতে বসে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের সাহিত্যে সমাজ চেতনার নিয়ে প্রভাব নিয়ে আলোচনা শুনত। মানিক কে ছিল বা কিউবা কি জিনিস সেই সব কোন কালেই নিমোর বুকে আয়োজিত সভায় লোক সমাগমের পথে বাধার সৃষ্টি করে নি।
সামাদ সাহেবের সাথে জুড়ে যাবার আগে সেই সাহিত্য সভার সাথে আমার সরাসরি যোগ বলতে ছিল একবার বাবার চাপে ও ধমকের চোটে ‘প্রশ্ন’ কবিতা আবৃত্তি করা। ইন-ডাইরেক্ট যোগ ছিল কিছু বিশেষ অতিথির জন্য ওয়েট করা – তারা ছিল আমাদের কাকা-জ্যাঠাদের ফ্রেন্ড। তা সেই ফ্যামিলি ফ্রেন্ডরা আমাদের বাড়িতে দুর্গাপুজো দেখে যেত সভা শেষ হলে এবং আমার উপর ভার থাকতে তাদের মনে করিয়ে নিয়ে যাওয়ার।
এই ভাবেই চলছিল – সাহেব থাকার জন্য সেই সাহিত্যসভার বাজেট নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে দেখি নি – লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন ব্যাপার টাইপের। খরচা বলতে ছিল সাহিত্য সভায় আগত অতিথীদের ভূরিভোজ, কিছু পুরস্কার দেবার বই এবং মাইক খরচা। কিন্তু সেই বার সাহেব বলল, সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। অর্থাৎ আজকালকার কোরপোরেটীয় ভাষ্যে – ইনক্লুসিভ হতে হবে। মানে হল গিয়ে সাহিত্য সভা হবে চাঁদা তুলে – সবাই যেন মনে করে সভাতে তারাও যুক্ত। সব ঠিক আছে, আমাদের উপর দায়িত্ব পড়ল পাড়ায় পাড়ায় চাঁদা তোলায়। অনেকে চাঁদা দিল, ইন ফ্যাক্ট বেশীর ভাগই দিল – যত না সাহিত্য ভালোবেসে, তার থেকেও বেশী আমরা সাহেবের চ্যালা বলে! আমাদের অভিজ্ঞতায় নিমো গ্রামে বিতর্ক ছাড়া কিছু সুষ্ঠ ভাবে হওয়া মনে কোথাও একটা গড়বড় আছে! আমরা চাঁদা তুলছি, কেউ প্রশ্ন করছে না – চাঁদা তোলা প্রায় শেষ হয়ে এল, আমাদের টেনশন বাড়ছে! বিতর্ক কোথায়? কেউ তো প্রশ্ন তুলল না!
এই করতে করতে আমরা গিয়ে হাজির হলাম খোকার ভাই বুড়োর বাড়ি। ইস্কুল ঘরের পাশে বাড়ির বারান্দায় বসে তখন বুড়ো-কাকা প্লাষ্টিকের মগে জল নিয়ে তাতে আয়না হেলান দিয়ে জুত করে বসে দাড়ি কামাচ্ছে। চাঁদা চাইলাম – প্রশ্ন এল কিসের? আমরা বললাম সাহিত্যসভার। প্রধান অতিথি কে আসছে ইত্যাদি সব জিজ্ঞেস করল। সব শুনে বলল, “ঠিক আছে পরে আসিস, এখন আর দাড়ি কাটার মাঝখানে উঠতে পারছি না”
আমরা চলে আসছি, বুড়োকা বলল,
- যাবার আগে একটা কথা বলে যা, এই সাহিত্য করে হবে টা কি?
আমরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। এমন প্রশ্ন কেউ করে নি আমাদের – আর এর উত্তর জানার বয়স কি আমাদের হয়েছে তখনও সেটাও বুঝতে পারছি না। আমাদের চুপ থাকতে দেখে বুড়োকা বলল –
- পারলি না তো! তোরা আর কি করে পারবি? সাহেব নিজেও এর উত্তর জানে না, আমি একদিন নিমো স্টেশনে দেখা হতে জিজ্ঞেস করেছিলাম
আমরা চলে আসছি, বুড়োকা গালে রেজার চালাতে চালতে বলল,
- সঠিক উত্তরটা শুনে যা আমার কাছ থেকে। সাহিত্য করে ঘোড়ার বাঁড়া হবে!
আমি এর পরে সারা জীবন বুড়োকার কথাটা মনে রেখেছি সাহিত্য করা ব্যাপারে। আমার কিছু চেনা শুনা, বন্ধু, দাদা ইত্যাদিদের সাহিত্য করে সমাজ বদলে দেব, আগুন ছুটিয়ে দেব, ন্যায় এনে দেব – ইত্যাদি আস্ফালন শুনে মুচকি হাসি। নিমোতে জন্মালে এই ইল্যুউশন থাকত না এদের! তাহলে আমি সাহিত্য নিয়ে ভাবি না? ভাবি বৈকী – বুড়োকা যখন ওই মন্তব্য করেছিল তখনো ইন্টারনেট অনেক দূরে, অনলাইন সাহিত্য ম্যাগাজিন তো দূরের কথা। কেবল ছাপা সাহিত্য দেখেই সেই বলা। আমি খুব ভাবি আজকের ইন্টারনেট বা ফেসবুক সাহিত্য পড়লে বুড়োকা তাকে কোন প্রাণীর ইয়ের সাথে তুলনা করত!
এইভাবেই সপ্তমীর সারা বিকেল এবং সন্ধ্যের কিছুটা সাহিত্য করে কাটিয়ে বাড়ি ফেরা – তখন সময় হয়ে গেছে সন্ধ্যা আরতির। এবার ঘটনা হল সন্ধ্যারতির একদম কাঁটায় কাঁটায় কিছু টাইম ছিল না অন্য সময়ের পুজোর মত। খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল আরতি – কিন্তু আমার হালকা সমস্যা হত সেই আওয়াজে – ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘন্টা, শাঁখ, উলু – সব মিলিয়ে এক জমজমাট ব্যাপার। ঠাকুরের পাশে দাঁড়িয়ে তালপাতার পাখা দিয়ে ঠাকুরকে হাওয়া করা, বা ধুনো দেখানো বা ধূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা – সবটাই পুণ্যের কাজ বলে বিবেচিত হত। আমি নিজেও দীর্ঘকাল কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়ে ঠাকুরকে সার্ভ করেছি। গলায় কাপড় দিয়ে বয়ষ্কারা দাঁড়িয়ে থাকতেন ঠাকুর দালানে – আরতির সময় নাকি বসে থাকতে নেই! কতক্ষণ আরতি হতে সেই নিয়ে বামুন দাদুর কাছে আবদার চলত – অনেকে বলত দাদু, আজকে কিন্তু মিনিমাম এক ঘন্টা আরতি করতে হবে। বামুন দাদুর বয়স হচ্ছিল – শেষের দিকে এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে এক হাতে ক্রমাগত ঘন্টা নাড়িয়ে আরতি করা চাপের হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মিনিট ৪৫ তো করতেনই আরতি।
যদিও সেই জটিল আওয়াজে আমার একটু অসুবিধা হত – কিন্তু তাবলে ঠাকুর দালান ছেড়ে যাবার প্রশ্নই নেই সেই সময়। কারণ সেই আরতির শেষেই ভোগ বিতরণ হবে – আরতি শুরুর ঠিক আগে গাওয়া ঘী দিয়ে একটা একটা করে লুচি ভেজে, প্রবল সেই ফোলা লুচি এবং নাড়ু অপেক্ষা করছে রেকাবিতে। আরতি শেষ হবে – তারপর বামুন দাদু দরজা সব বন্ধ করে দেবে, তখন নাকি মা-দুর্গা খাবে সেই ভোগ। তারপর মায়ের খাওয়া হলে প্রসাদ বিতরণ। ঠাকুর বিশ্বাস করি বা না করি, সেই লুচির অমৃতসমান স্বাদ স্বীকার করার কোনই উপায় ছিল না! আরতির শেষে বাবা-জ্যাঠা-কাকা-রা বসত তাস খেলতে সেই ঠাকুর দালানে – বেশ রাত পর্যন্ত চলত সেই তাস খেলা এবং পাশে আমাদের সবার গল্প গুজব।
এই ভাবেই কোন এক সময় সপ্তমীর দিনটা ফুরিয়ে যেত – পরের দিন অষ্টমী।
দুর্গা পুজোয় অষ্টমীর দিনটাই নাকি প্রধান – এমন একটা হাবভাব ঘুরে বেড়াত বাতাসে। তবে অষ্টমীর দিন ভিতর বাড়ি থেকে শুরু করে ঠাকুর দালানের ব্যস্ততা দেখলে সেই সম্পর্কে কোন দ্বিমত থাকার কথা নয়। মা-কাকিমা- জ্যেঠিমা – পিসি - ঠাকুমা এবং বাড়ির আরো সব বয়ষ্কা মহিলাদের দম ফেলার ফুরসত থাকত না ওদিন।
অন্য দিনের তুলনায় বাড়িতে লোক সমাগমও এদিন বেশী হত – গ্রামের, পাড়ার তো বটেই – নিজেদের চেনা শুনা, বন্ধু বান্ধব, সহকারী চাকুরীজীবি বা ব্যবসায়ী – এই দিনেই প্রায় সবাই একচেটিয়া আসত বাড়িতে দুর্গাঠাকুরের সন্ধিপুজোয় অংশ গ্রহণ করবে বলে। সারাদিন উপবাস করে সন্ধিপুজো শেষে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে তবে খাওয়া দাওয়া করত অনেকে। পঞ্জিকা মতে সন্ধিপুজো ভালো সময়ে পড়লে ঠিক আছে – কিন্তু কিছু কিছু বছর গভীর রাতে বা একদম ভোরে পড়ত। সেই সব বছর খুব চাপের হয়ে যেত সবকিছু।
বাড়ির লোকেরা চাপে থাকলেও ব্রাহ্মণ-দের জন্য এই দিন ছিল আদর্শ – আমাদের নন্দ দাদু খুব খুশী খুশী থাকত ওই দিন। এবং মাঝে মাঝে ঠাকুর দালানের কোণের দিকে খাতা নিয়ে বসা মেজ বা সেজ জ্যেঠুর কাছে উঁকি মেরে দেখে নিত পুজো কেমন পড়ছে। পুজো পড়া মানে মানসিক করা নাকি বলে না – সেই জিনিস। প্রচুর লোক জন ওদিন আমাদের ঠাকুরকে কাপড়, গামাছা, টাকা, মিষ্টি, ফল ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে ‘মানসিক’ করত – আলোচালের ব্যাপার তো সাথে ছিলই। সেই সব কাপড় গামছা ঠাকুরের পায়ের কাছে – এপাশে গণেশ আর ওপাশে কার্তিকের পাশে জমা হয়ে স্তূপাকৃতি হত। স্তূপের উচ্চতা যত বাড়ে নন্দ দাদুর মুখের হাসি তত চওড়া হয়! শ্যাণ্ডিল্য, কাশপ্য আর ভরদ্বাজ গোত্রেরই বেশী পুজো আসত। খাতায় নাম লেখা দেখে – অমুক দাসস্য ইত্যদি ইত্যাদি বলে প্রায় স্কুলের রোল কলের মত করে সবার নামে উৎসর্গ হত পুজো।
এই সন্ধি পুজো (আমরা আবার ‘ক্ষ্যাণের পুজোও’ বলতাম) করতে গেলে টাইম মেনটেন এক বিশাল জিনিস। এদিকে ২৪ মিনিট – আর ওদিকে ২৪, মোট ৪৮ মিনিটের মধ্যেই সব সারতে হবে, পুজো, পুষ্পাঞ্জলি, আরতি – সব কিছু! এই অষ্টমীর দিনেই বিশেষ ‘মানত’ যারা করেছিল, তাদের মানত গুলো মায়ের পায়ে ডেলিভার হত। কে কিসের মানত করেছে সব তো আর ডিটেলে জানা যেত না – গোপন ব্যাপার সব। তবে মাঝে মাঝে আমি ওই খাতার এন্ট্রি করার দ্বায়িত্বে থাকার জন্য জানতে পারতাম কি কি মানত হয়েছে! সে যে কোন জিনিস নিয়ে মানত হতে পারে – পরের বছর জমিতে আলু ভালো ফলন হওয়া থেকে শুরু করে আমার ‘বাবুর’ যেন ভালো পাত্রী পেয়ে গিয়ে বিয়ে হয়, বা মেয়ের বিয়ে যেন ভালো ঘরে হয় , পরীক্ষার রেজাল্ট ভালো হওয়া – কত কি বলব! মানতের পরিমাণ বা জিনিসও ছিল নানাবিধ। অনেক লোক মা-দুর্গাকে সোনার বা রুপোর গহনা, গলার হার, নাকের নথ ইত্যাদি মানত করত। এই ভাবে মানত হয়ে হয়ে আমাদের বাড়ির দুর্গা মায়ের গহনা পত্র নেহাত কম ছিল না!
আমার মা নাকি একবার মানত করেছিল আমার ছোটবেলায় অ্যানুয়াল পরীক্ষায় ছেলে যাতে পাস করে সেই জন্য। আমি বারণ করেছিলাম – প্রথমে শোনে নি, তবে খুব তাড়াতাড়ি শিখে গিয়েছিল নিজেই – প্রতিবছর এই ভাবে গ্যারেন্টিড গহনা যোগানো চাপের!
আচ্ছা আর একটা ব্যাপার বলে নিই এই ফাঁকে – আমাদের বাড়ির দুর্গা নিরামিশাষী। অর্থাৎ বাড়িতে বোধনের সময় থেকে শুরু করে দশমীর ঘট বিসর্জন পর্যন্ত বাড়িতে আমিষ রান্না বা খাওয়া হয় না। আর অষ্টমীর দিন তো বাড়িতে সেই পেটেন্টেড খাবার – লুচি, ছোলার ডাল, বোঁদে, রসগোল্লা ইত্যাদি। ওদিন বাড়িতে জিনিস পোড়াতে নেই – ফলে রুটি পাওয়া যেত না, না পাওয়া যেত ভাত! তবে মা-কাকিমার হাতে গড়া লুচি বাড়িতেই তৈরী ঘিয়ে (এখন অবশ্য সানফ্লাওয়ার অয়েল) ভাজা – সাথে বাড়িতেই তৈরী নারকেল নাড়ু – খুব বেশী অভিযোগের অবকাশ ছিল না খাবার দাবার নিয়ে।
আগেই বলেছি জলখাবার বেলা মুড়ি খাবার কথা – এদিন যারা উপবাস করত তারা তো কিছু খেত না পুষ্পাঞ্জলি না দেওয়া পর্যন্ত। কিন্তু আমার সেই সবের পাট কোনদিনই ছিল না বলে আমাকে খেতে দিত মা আলাদা করে – আলাদা করে দেবার কারণটাও অন্য। বাকিদের মতন আমি মুড়ি ভক্ত নয়, আর তা ছাড়া বছরে একবার পুজোয় বাড়ি এলে স্পেশালিটি কিছু খাবার তো খাওয়ানো চাই নাকি ছেলেকে? আমাকে দেওয়া হত বাড়িতে তৈরী চালভাজা, মুড়কি আর চিনি/গুড়ের নাড়ু। বাকিদের অফার করা হলে চালভাজার বদলে প্রায় সবাই মুড়ি প্রেফার করত।
বাড়ির বয়জ্যেষ্ঠ কেউ ঘড়ি দেখে বলত ঠিক কখন শুরু হবে পুজো – পঞ্জিকা এই সব নিয়ে ফান্ডা থাকার জন্য টাইমের ব্যাপারটা নিজেই কাঁধে তুলে নিয়েছিল মেজজ্যাঠা। সেই যেন স্টপওয়াচে ১০০ মিটার দৌড়ের সময় দেখছে এমন ভাবে ডিক্লেয়ার করত – “এবার শুরু হোক পুজো”। আমরা ছেলে ছোকরারা সেই শুনে বাইরে গিয়ে গোটা কতক কাদা বোমা ফাটিয়ে আসতাম – লোকে জানল যে সন্ধিপুজো শুরু হচ্ছে এবার!
অনেকে আবার ফুলের বড় বড় মালা, বা চাঁদমালা, পদ্ম ফুল এই সব অফার করত মা দুর্গাকে – সেই সব মায়ের গলায় চড়াতে বেশ টাইম লাগত। আর ঠাকুরের পুষ্প হিসাবে ঠাকুরের পায়ের কাছে জমা হতে থাকত বেলপাতা আর আমাদের তোলা সকালের ফুল। ছোটবেলায় মাটির একশো আট প্রদীপ জ্বালা হত – হাতে তুলো দিয়ে সলতে পাকিয়ে, প্রদীপে সর্ষের তেল ঢেলে, বড় সুন্দর এবং পবিত্র লাগত ঠাকুর দালান। ধুনোর গন্ধ এবং ধূপ, চন্দন – সব মিলিয়ে কেমন যেন এক আধ্যাত্মিক পরিবেশ সেইক্ষণে ঠাকুর দালানে – তবে ধোঁয়া টলারেট করার ক্ষমতা অর্জন করতে হত এবং গরম। তবে বেশ কিছু বছর মাটির প্রদীপের বদলে চলে এল বড় বড় পেতলের সেট করা সব প্রদীপ, এখানেও অবশ্য তেল এবং সলতে পারিকে দিতে হত হাতে করেই!
বিবাহের পরে এই অষ্টমীর দিনটা আমাদের তোলা থাকল অমৃতার বাড়ির জন্য। আমার বাড়ির থেকে অমৃতার দেশের বাড়ি এক ঘন্টার পথ – সকাল সকাল পেরিয়ে পড়তাম দুজনে, সাথে মাঝে মাঝে আমার বন্ধু পিন্টুও থাকত সঙ্গে। বাপের বাড়ি যাচ্ছে বলে অমৃতা বেশ সময় নিয়ে সাজত ওইদিন – আমিও জামাই মানুষ বলে একটু ড্রেস করতে হত বৈকী! নীচের ছবিটি অমৃতার ওদের বাড়ির ঠাকুর দালানের সামনে –
প্রত্যেক জায়গার যেমন নিয়ম থাকে – অমৃতাদের পুজোর অষ্টমীর দিন বলি, ধুনো পোড়ানো এই সব হত। আর ওদের কি নিয়ম আছে একশো আটটা বেলপাতা দিয়ে নাকি একটা মালা গাঁথা হয় যেটা সন্ধি পুজোর সময় মায়ের গলায় চড়ানো হবে। অমৃতার নাকি স্পেশালিটি ছিল সেটা বানাতে – ওর ঠাকুমার সাথে। ওদের দেশের বাড়িও আমাদের মতই গ্রামে – তাই সময় ভালোই কেটে যেত। ঠাকুর দালানে খানিক পুজো দেখে আমরা চলে যেতাম পাশের দিঘীর পাড়ে, সেই পুকুরটাও নাকি মা-দুর্গার দেবোত্তর, আর পুকুর পাড়ের আমবাগানও।
ওদের ঠাকুর দালান গ্রামের লোকে ভরে যেত – কয়েক জন চেনা এবং বেশীর ভাগ অচেনার মাঝে দাঁড়িয়ে পুজো দেখা। অষ্টমীর পুজো অমৃতার বাড়িতে দেখে নবমীর দিন নিজের বাড়ি ফেরা –
পরের দিন নবমীর গল্প –