সেবারে ফ্রান্সের ডিজন শহরের এক বিখ্যাত রেষ্টুরান্ট থেকে তাদের ততোধিক বিখ্যাত ডিস ‘কুইজ দি গ্রনুই’ (পাতি বাংলায় ব্যাঙের ঠ্যাঙ) খেয়ে বেরিয়ে সামনের চত্ত্বরে একটা জম্পেশ ঢেঁকুর তুলেছি সবে, একজন সঙ্গী বলল একটু ওয়েট করতে হবে, রেষ্টুরান্টের কার্ড মেশিনে কি হালকা গোলমাল হয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে না থেকে পাশে একটা ব্রোঞ্জের মূর্তি আছে তার সিমেন্টের ভিত্তিটাতে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ চোখ চলে গেল মুর্তিটি কার সেটা লেখা নামের ফলকের দিকে – বেশ অবাক হয়ে দেখলাম মুর্তিটি গুস্তাভো আইফেল – এর!
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন – ইনিই সেই ইঞ্জিনিয়ার, যার নামেই আজকের আইফেল টাওয়ার। মেটিরিয়্যালস সায়েন্স, বিশেষ করে ধাতু নিয়ে পড়াশুনা করেছে তেমন কারো যদি আইফেল টাওয়ার নিয়ে উৎসাহ না থেকে, তাহলে বুঝতে হবে কিছু জালি ব্যাপার আছে।
তো এবার ঘটনা হল, আমি আইফেলের কাজ কর্ম নিয়ে জানলেও তার ছবি শোবার ঘরে মাথার গোড়ায় সাঁটিয়ে তো ঘুমাই না! তাই চিনতে পারি নি – আর তা ছাড়া এত জায়গা থাকতে ডিজনে কেন আইফেলের মূর্তি থাকবে সেটাও বুঝতে পারি নি। পরে আরো বেশী করে গুস্তাভো আইফেলের জীবন নিয়ে পড়াশুনা করতে গিয়ে দেখলাম, তিনি এই ডিজন শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন!
১৮৮৯ সাল এগিয়ে আসছে – তার মানে ফরাসী বিল্পবের একশো বছর। ফরাসী বিপ্লবের প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তবে এই শতবর্ষে ফরাসী সরকার চাইল এমন কিছু করে সারা পৃথিবীকে চমকে দিতে যাতে করে মনে হয় – হ্যাঁ, দেশকে ভালোবাসে বটে এরা! তো সেই চমকের সৃষ্টি করার জন্য ঠিক হল এক বিশাল মেলার আয়োজন করা হবে যার নাম দেওয়া হল ১৮৮৯ সালে সর্বজনীন প্রদর্শনী (এক্সোপোজিশন ইউনিভার্সেল দি ১৮৮৯)। সে এক এলাহী কান্ড – চমকদার সব প্রদর্শনী, খানা-পিনা, থিয়েটার, বহুমূল্য সামগ্রীর স্টল। কিন্তু এ সব একেবারে প্রথমবার দেখছে পৃথিবীর পাবলিক এমনটা বলা যাবে না! তাই তাদের জন্য মূল চমক ছিল মূল মেলা প্রাঙ্গণের প্রবেশ পথের সামনেই সেই বিশাল মনুমেন্ট! এ জিনিস আগে কেউ দেখে নি – নাম ‘দি আয়রণ লেডি’
এই বিশাল আকারের মনুমেন্ট বানানোর প্ল্যান ঠিক পাঁচ বছরে আগে থেকে শুরু করা হয়। ১৮৮৪ সালে ফরাসী সরকার এই মর্মে এক ডিজাইন কম্পিটিশনের আয়োজন করে – ৩০০ মিটার উঁচু মনুমেন্ট বানানোর। প্রায় ১০০ টি ডিজাইন এবং প্ল্যান জমা পরেছিল। সব প্ল্যান খুঁটিয়ে দেখা হল – এবং বেশীর ভাগ প্ল্যানই বাদ চলে গেল অবাস্তব বা বানানো সম্ভব নয় বলে। যেমন একজন প্রস্তাব রেখেছিল ৩০০ ফুটের একটা গাম্বাট গিলোটিন বানাবে সে! শেষ পর্যন্ত সব কিছু বিচার করে ১৮৮৬ সালের জুন মাসে বেছে নেওয়া হল গুস্তাভো আইফেলের ডিজাইন-কে। এমন নয় যে আইফেল তখন একদম অপরিচিত কেউ ছিলেন – বরং ততেদিনে তিনি বেশ কিছু অদ্ভূত এবং আগে না দেখা ব্রীজ ইত্যাদি বানিয়ে ‘লোহার জাদুগর’ নামে পরিচিত হবার দিকে অনেক এগিয়ে গেছেন।
তখনকার সময়ে এমন ৩০০ মিটার উঁচু (মানে ধরুণ ৯০ তলা বাড়ির সমান) স্তম্ভ পৃথিবীতে কেউ আগে দেখে নি। তখনো পর্যন্ত সবথেকে উঁচু স্তম্ভ ছিল ওয়াশিংটন মনুমেন্ট – এর প্রায় অর্ধেক উচ্চতার, ১৫৯ মিটার। ১৮৮৭ থেকে ১৮৮৯ সালের মধ্যে আইফেল বানিয়ে ফেললেন এই জিনিস – এমন স্পীড আর এফিসিয়েন্সি দেখে সায়েন্টিফিক আমেরিকান রিপোর্ট করেছিল যে আইফেল টাওয়ার বানানো হয়েছিল – কোন প্রকারের ভুল, দুর্ঘটনা বা বিলম্ব ছাড়া। যা ওরা লেখেনি তা হল, আইফেল সেই টাওয়ার বানিয়েছিলেন ৬% আন্ডার বাজেটেও!
আজকে সেই পুরানো ডিজনের দিনের ছবি দেখতে গিয়ে ভাবছিলাম আইফেল টাওয়ারের ব্যাপারটা নিয়ে। জানি না আপনারা জানেন কিনা, মূল পরিকল্পনা অনুসারে মাত্র কুড়ি বছর পরে (মানে ১৯০৯ সালে) এই টাওয়ার আর থাকার কথা ছিল না - সরিয়ে বা ভেঙে দেওয়া হত। ভ্যাগিস সেটা করে নি! প্রায় ৯০ বছর হতে চলল আইফেল টাওয়ার আর পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্তম্ভ নেই – এর থেকে অনেক বড় বড় মনুমেন্ট, বাড়ি তৈরী হয়েছে। এবং আমার সৌভাগ্য হয়েছে আজকের দিনের বেশীর ভাগ উঁচু বাড়ি বা মনুমেন্ট গুলিতে ওঠার। কিন্তু এমন কোন স্তম্ভ/বাড়ি/মনুমেন্ট দেখি নি যা এলিগ্যান্সের দিক থেকে আইফেল টাওয়ারকে ছাড়িয়ে যায়।
প্রায় ৬৪০,০০০ কেজি পেটা লোহা দিয়ে ২৭ মাসের মধ্যে আইফেল এই টাওয়ার বানিয়েছিলেন – কেন পেটা লোহা? ইস্পাত বা ঢালাই লোহা নয় কেন? এত বড় কাঠামো যাতে টাইফুন এর সামনেও ভেঙে না যায় তার জন্য কি করেছিলেন আইফেল? মানুষ উঠবে কি করে এই মাথায় – তার জন্য কি করেছিলেন তিনি? একে একে এই সবই দেখে নেব
তবে গুস্তাভো আইফেলের এই টাওয়ার বানানোটা কিন্তু ওই যাকে বলে, এলাম, দেখলাম, জয় করলাম – এমন ছিল না মোটেই। বরং যখন আইফেলের ডিজাইন সিলেক্টেড হয়ে পাবলিক জানতে পারল কি হতে চলেছে, তখন সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল। কে এগিয়ে এল না সেই সমালোচনায়? ফ্রান্সের বিখ্যাত সব শিল্পী, সাহিত্যিক, আর্কিটেক্ট, স্থাপত্যবিদ, তথাকথিত ফরাসী শিল্প এবং সৌন্দর্য্যের পুজারী একযোগে খোলা পত্র লিখলেন ‘লে টেম্প’ খবরের কাগজে সেই শতবার্ষিকী মেলার ডাইরেক্টরকে উদ্দেশ্য করে। অনেক বড় সেই চিঠি – তার সারমর্ম করলে দাঁড়াবে এমন বক্তব্যঃ
মঁসিয়ে আইফেলের প্রস্তাবিত টাওয়ারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
“আমরা সবাই, অর্থাৎ লেখক, শিল্প, স্থাপত্যবিদ, আর্কিটেক্ট এবং প্যারিস শহরের সৌন্দর্য্য ভালোবাসা লোকেরা একযোগে প্রতিবাদ করছি এই সিদ্ধান্তের যা এই শহরের সৌন্দর্য্যের প্রতি এবং তার থেকেও বড় কথা ফরাসীদের সৌন্দর্য বোধের, যা আমাদের অত্যন্ত গর্বের এক বিষয় তার প্রতি এক প্রবল আঘাত হানতে চলেছে। কি ভাবে যে আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় এই শহরের বুকে, একদম মধ্যভাগে বলতে গেলে – এই একদম ফালতু এবং দৈত্যাকার আইফেল টাওয়ার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল – তা আমরা অনেক চিন্তা করেও বুঝতে পারছি না। আমার কি আমাদের প্রিয় প্যারিস শহরের শত শত বছরের এলিগ্যান্ট এবং মনোহর স্থাপত্য দিয়ে গর্ব করা ভুলে গেলাম যে এমন এক অদ্ভুত কারখানার কালো চিমনির মত টাওয়ার শহরের মাঝখানে খাড়া করতে হবে? এই কাঠামো শুধু হাস্যকরই নয়, এক বর্বরোচিত প্রচেষ্টা যা আমাদের ফরাসী সংস্কৃতির প্রতি অবমাননা – এবং এই প্ল্যান কার্যকরী হলে সুন্দরী প্যারিসের বুকে আমরা আগামী কুড়ি বছর ধরে এক কুৎসিত নাট-বল্টু লাগানো ধাতব টাওয়ারের কালো ছায়া দেখতে চলেছি – এ যেন এক সুন্দর ক্যানভাসকে জেনেশুনে কালিমালিপ্ত করা ”
তখনকার দিনের বিখ্যাত ফরাসীরা আলাদা করেও নিজেদের মতামত জানালেন – কেউ লিখলেন
“এটা একটা করুণ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা স্ট্রীট ল্যাম্প”,
“মনে হচ্ছে একটা ধাতব ব্যায়াম যন্ত্র বিশেষ – কনফিউজড, অসম্পূর্ণ এবং বিকৃত”,
“লম্বা ছিপছিপে লোহার পিরামিডের সিঁড়ি”, বা
“অর্ধনির্মিত কারখানার পাইপ”
আইফেল নিজে কি বলেছিলেন? এত সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরবার লোক ছিলেন না – তিনি বলেছিলেন,
“আমি প্রবল ভাবেই আত্মবিশ্বাসী যে এই টাওয়ারের কাজ একবার সম্পূর্ণ হলে তা নিজের সৌন্দর্য্যের গুণে নিজেকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারবে। আর তা ছাড়া এনারা আসলে কি বলতে চান? আমি একজন ইঞ্জিনিয়ার বলে কি সৌন্দর্য্য নিয়ে আমার নিজস্ব কোন ভাবনা থাকতে পারে না? নাকি সৌন্দর্য্য নিয়ে ভাবার সাথে সাথে সেই কাঠামোর স্থায়িত্ব এবং দৃঢ়তা নিয়ে ভাবা খারাপ? এনারা কি জানেন যে এত উঁচু টাওয়ার বানাতে গিয়ে আমাকে সবথেকে কোন বিষয় নিয়ে আগে ভাবতে হয়েছিল? বাতাসের প্রতিরোধ (উইন্ড রেজিস্ট্যান্স) – তো সেটা করতে গিয়ে গণনা করে বের হয়েছিল যে ঠিক যেমন ভাবে আপনারা দেখছেন, ঠিক তেমন ভাবেই চারটে পায়া দরকার – আমি নিশ্চিত যে এর ভরে কোন সৌন্দর্য্য হানি তো হবেই না, বরং আপনারা আগে না দেখা এক নতুন সৌন্দর্য্যের আস্বাদন পাবেন”
বলাই বাহুল্য যে, গুস্তাভো আইফেল একেবারে সঠিক ভবিষ্যত বাণীই করেছিলেন – কালের নিয়মে সেই সব সমালোচকদের কথা আর কেউ মনে রাখেনি। উদ্বোধনের পর থেকে আইফেল টাওয়ার একদম সুপারহিট যাকে বলে
ভালো ইঞ্জিনিয়ার হবার একটা আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে এদিকে ওদিক থেকে জিনিস ঝেড়ে দিয়ে কাজ চালানো – ভারী কথায় যাকে বলে ‘ইন্সপায়ার্ড’ হয়ে কাজ করা। আইফেল ছিলেন যুগান্তকারী ইঞ্জিনিয়ার, তাই ঝেড়ে দেওয়া তিনি জানবেন ভালো সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তাঁর মূল প্রবলেম ছিল – কার থেকে ঝাড়বেন? মানে তাঁর বেশীর ভাগ কাজই যাকে বলে পাইয়োনিয়ারিং – আগে তেমন কাজ কেউ করে নি। ফলে আইফেলকে নিজেই বানাতে হত গোড়া থেকে – আগে অনেক ব্রীজ বানিয়ে ছিলেন এই ভাবে নতুন ডিজাইনের। অবশ্য একবার একটা ব্রীজ বানাবার পরে, সেটা থেকে হাজার হাজার লোক কপি করেছে গত দেড়শো বছর ধরে! তবে একটা জিনিস ক্লীয়ার করে নিই, ঝাড়া মানে কিন্তু তার সামগ্রীক ডিজাইনের কথা বলছি না কিন্তু – বলতে চাইছি সেই সব ইঞ্জিনিয়ারিং প্রিন্সিপ্যাল এর কথাও যার উপর ভিত্তি করে পরবর্তী কালের অনুরূপ স্ট্রাকচার গড়ে ওঠে। তবে এই নিয়ে বেশী ডিটেলসে যাব না – সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর জনতা এই নিয়ে আরো ভালো ফান্ডা দিতে পারবে।
তাহলে এবার টুক করে দেখে নেওয়া যায়, এমন ৩০০ মিটারের টাওয়ার গড়ে তুলতে গিয়ে আইফেলকে ঠিক কি কি প্রযুক্তিগত সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল – এটা মনে রাখবেন যে সব সমস্যাই কিন্তু আগে থেকে অনুমান করে নেওয়া যায় নি – কাজ করতে করতে অনেক কিছু বাস্তবিক সমস্যার সম্মুখিন হতে হয়েছিল যা আইফেলকে তাঁর প্রবল উদ্ভাবনী ক্ষমতা প্রয়োগ করে সমাধান করতে হয়েছিল – এবং এই সবই কম্পিউটার আসার অনেক যুগ আগের কথা। যদি এতেও আইফেলের এলেমটা না বুঝতে পারেন তাহলে আজকের দিনের যে কোন বিখ্যাত বা নাদান ইঞ্জিনিয়ারকে একটা সমস্যা সমাধান করতে বলতে পারেন কম্পিউটার আর নেট কানেকশন ছাড়া। আপনার সামনে যে পরিমাণে ঘামবে এমন প্রস্তাব শুনে, তাতে করে হালকা একটা আঁচ পেয়ে যাবেন আইফেলের এলেম এর।
প্রথম ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জ ছিল যে জিনিসপত্র গুলি দিয়ে আইফেল টাওয়ার বানানো হচ্ছিল তাদের মাপজোপের অ্যাকুরেসি ঠিকঠাক রাখা। আজকে যেখানে আইফেল টাওয়ার দেখছেন সেখানে বসে বসে তো আর হাজার হাজার লোহার পার্টস গুলো বানানো হয় নি! বরং নানা জায়গা থেকে বানিয়ে এনে এখানে আজকের ভাষায় অ্যাসেম্বল করা হয়েছিল। তো বুঝতে পারছেন এখানে জোড়ার সময় একটু এদিক ওদিকে হয়ে গেলে কি সমস্যা! আমাদের বাড়িতে খুব ছোটবেলায় এক কাঠমিস্ত্রী কাজ করতে এসেছিল আনন্দ নামে – সে নাকি বাইরে থেকে কাজ শিখে এসেছে, তাই আমাদের স্থায়ী কাঠমিস্ত্রী রাজারামকে সরিয়ে তাকে ভার দেওয়া হল একটা ঘরের জানালা দরজা আলমারী করার। মাপজোপ যে কি কনফিউজিং হতে পারে সেই আনন্দে দেখে প্রথম টের পেয়েছিলাম – একটা কাঠ কেটে আর অন্যটার সাথে মেলাতে পারে না! ক্লাসিক্যাল আলমারী বানাতে গিয়ে তা ঠেকেছিল মর্ডান আর্টে! আজকেও আমি বাড়ি গেলে সেই আলমারী কিভাবে খুলতে হবে নতুন ভাবে আবিষ্কার করি। আর দ্বিতীয় বার টের পেয়েছিলাম কলেজে ফার্ষ্ট ইয়ারে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ে কারপেন্ট্রী ক্লাসে। তিনমাস ক্লাস করেও যিশু খ্রীষ্টের ক্রশের মত কিছু একটা বানাতে পারি নি! তাই আইফেলকে আর কিছু জন্য না হলেও আমার সেলাম করতে ইচ্ছে হয় মাপের অ্যাকুরেসির জন্য। একটা ছোট্ট ক্যালকুলেশনের ভুল আইফেল টাওয়ারের পায়ের ডিজাইন এদিক ওদিক করে দিতে পারত – মানে যেভাবে বাঁকার কথা সেই ভাবে হয়ত বেঁকল না! বুঝতে পারছেন কেস? আর একটু বেঁকে গেলে বিশাল কেলো – টাওয়ারের স্টেবিলিটি নিয়ে টানাটানি, আবার ভেঙে সব ঠিক করতে হত। আচ্ছা আর একটা কথা – আমাদের হাওড়া ব্রীজের মতই এই আইফেল টাওয়ারে কোন নাট-বল্টু ব্যবহার করা হয় নি, হয়েছিল রিভেট জয়েন্ট। এটা কেমন জিনিস – ধরুণ যে দুটো জিনিসকে জুড়বেন তাদের কাছে এনে বল্টুটা লাগালেন – কিন্তু এবার নাট লাগাবেন না, বরং ওই ওই বোল্টের বেরিয়ে থাকা দুই দিকের অংশটা ঘা মেরে মিশিয়ে দেবেন দু দিক থেকে ডিম্বাকৃতি করে। এটা সাধারণত গরম করে করা হয়, কারণ ঠান্ডা হলে সেই বোল্ট একটু সংকুচিত হয়ে আরো টান টান করে রাখবে কাঠামোকে। যে দুটো টুকরোকে জুড়বেন তাদের মধ্যে মিসঅ্যালাইনমেন্ট মাত্র ১ মিলি মিটারের বেশী হলেই প্রবলেম - প্রায় আড়াই লক্ষ রিভেট জয়েন্ট আছে আইফেল টাওয়ারে – আর সব পার্টস নানা জায়গা থেকে বানিয়ে আনা। একটাতেও মিসঅ্যালাইনমেন্ট হয় নি, ভাবতে পারছেন?
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল এত বড় টাওয়ারকে কিভাবে বাতাসের বেগ এবং ঝড় ঝাপটা থেকে বাঁচানো যাবে? আইফেল এর আগে অনেক বড় বড় ব্রীজ এবং বাড়ি বানিয়ে অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছিলেন যে বাতাসের এফেক্ট কি ভয়ঙ্কর হতে পারে। পরে আইফেল লিখেছিলেন যে,
“সারা জীবন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্রাকচার বানিয়েছি অনেক, মুখোমুখি হয়েছি অনেক সমস্যার – কিন্তু বাতাসের থেকে বড় শত্রু আমার কেউ ছিল না! এর সাথে আমাকে সারাজীবন লড়াই করতে হয়েছে, শুধু স্ট্রাকচার বানাবার সময় নয়, যতদিন স্ট্রাকচার দাঁড়িয়ে ততদিনই তাকে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে বাতাসের সাথে”।
এমনটা বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না যে, আজকের যে আইফেল টাওয়ারের ডিজাইনটি দেখছেন, তা প্রধানত নির্ধারিত হয়েছিল বাতাসের দ্বারা। টাওয়ারের চারটি পা ঠিক কত কৌণিক ভাবে থাকলে স্ট্রাকচার স্টেবল হবে সেটা নিখুঁত ভাবে বের করেছিলেন তিনি। আর বাতাসের রেসিন্টান্স থেকে বাঁচার জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘ল্যাটিস’ স্ট্রাকচার – যেখানে বেশী ভাগটাই থাকবে খোলামেলা – যাতে এর মধ্যে দিয়ে খুব জোরালো বাতাস খুব বেশী বাধা না পেয়ে বয়ে যেতে পারে। সব থেকে জোরে বাতাসেও যাতে টাওয়ারের চূড়া খুব বেশী নড়ে না তেমন ভাবে গণনা করে আইফেল বানিয়েছিলেন টাওয়ার। পরে দেখা গেছে আইফেলের গণনা ছিল প্রবল ভাবেই নিখুঁত – সবচেয়ে জোর ঝড়েও আইফেল টাওয়ারের চূড়া ১০ সেন্টিমিটারের বেশী হেলে না।
এ তো গেল শুধু বাতাসের দিক – কিন্তু ধাতুর সঙ্কোচন আর প্রসারণের ব্যাপারটা? এত বড় একটা কাঠামো গরমে একটু বাড়বে আর ঠান্ডায় একটু সঙ্কুচিত হবে – ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে এটা অ্যাডজাষ্ট না করে নিলে টাওয়ার বেঁকে যেতে বেশীদিন লাগবে না! তাই আইফেলকে আবার গণনা করতে বসতে হল ঠিক কতখানি সঙ্কোচন বা প্রসারণ হবে সেই লোহার স্ট্রাকচারের। প্যারিসের সব রেকর্ড ঘেঁটে দেখা হল সব থেকে বেশী তাপমাত্রা কত হয় প্রবল গরমে – সেই মত হিসেব করে দেখা হল প্রবল গরমেও টাওয়ারের চূড়া সর্বোচ্চ সরতে পারে ৬ ইঞ্চি মতন। তো সেই ভাবে ডিজাইন করা হল সব। এক্ষেত্রেও যে আইফেল ঠিক ছিলেন ১৩০ বছর টিকে থাকাই তার প্রমাণ।
আর একটা প্রধান ডিজাইন চ্যালেঞ্জ ছিল সেই এলিভেটর (আমরা যাকে লিফট বলি আর কি) কেমন ভাবে নীচে থেকে উপরে যাবে তা ঠিক করা। এটা ভাবতে পারেন যে এটা আর বেশী কথা কি, সোজাসুজি একটা এলিভেটরের পথ করে দিলেই তো হল! হয়ত সেটা সোজা হত ইঞ্জিনিয়ারিং এর দিক থেকে। কিন্তু আইফেল এমন লোক ছিলেন না যে চ্যালেঞ্জের ভয়ে পিছিয়ে যাবেন। বিশেষ করে এমন ডিজাইন যা তাঁর চোখে টাওয়ারের সৌন্দর্য্য হানী করবে। পাশ দিয়ে একটা এলিভেটর সোজা উঠে গেলে খুব একটা ভালো দেখতে লাগবে সেটা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। তাই বিকল্প উপায় ভাবা শুরু হল – তিনি ভেবে ঠিক করলেন সব থেকে এলিগেন্ট ব্যাপার হবে যদি এলিভেটর গুলো টাওয়ারের পায়া বেয়ে ওঠে। মানে পায়া যেমন কার্ভেচারে আছে ঠিক তেমন ভাবেই এলিভেটর উঠবে নীচে থেকে উপরে। ১৩০ বছর আগে এই ভাবনা বাস্তবায়িত করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না – কিন্তু আইফেল সেটাও সম্ভব করে দিয়েছিলেন। অন্য ইঞ্জিনিয়াররা পরে বলেছিলেন এই এলিভেটর ডিজাইন করাই ছিল খুব সম্ভবত আইফেল টাওয়ার তৈরীর সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ। তখন কার দিনে ৩০০ মিটার ওঠার মত কোন এলিভেটর ছিল না – আর তার থেকেও বড় কথা প্রচুর পরিমাণ পর্যটক হ্যান্ডেল করার মত কেপেবিলিটি চাই এই এলিভেটর গুলোর – তখনকার হিসেব মত মোটামুটি ঘন্টায় দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার পর্যটককে উপর নীচে করানো – যা এককথায় অভাবনীয় ছিল তখন।
দুই খানি করে আলাদা এলিভেটররের ব্যবস্থা করা হল টাওয়ারের প্রত্যেক পায়াতে। একটা এলিভেটর নীচে থেকে আইফেল টাওয়ারের প্রথম লেভেলে নিয়ে যাবে পাবলিককে, সেখানে আছে রেষ্টুরান্ট, দেখার জন্য ডেক, থিয়েটার ইত্যাদি। কিন্তু সেই একই এলিভেটরের এত পাওয়ার ছিল না যে সেটাই আবার প্রথম লেভেল থেকে দ্বিতীয় লেভেলে যায় যেখানে আছে আরো দেখার ডেক এবং রেষ্টুরান্ট। এই এলিভেটরের প্রবলেমটা অবশ্য ঠিক আইফেল নিজে সমাধান করেন নি – তিনি সাহায্য নিলেন তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাসমেট লিঁও এডু-র। এডু করলেন কি এলিভেটরের প্রচলিত কাউন্টার ব্যালেন্সের আইডিয়া থেকে সরে গিয়ে প্রথম এলিভেটর (যেটা নীচে থেকে প্রথম তলা যায়) আর দ্বিতীয় এলিভেটর (যেটা প্রথম থেকে দ্বিতীয় তলা যায়) সেই দুটিকে লোহার কেবল দিয়ে জুড়ে দিলেন। ফলে যখন প্রথম এলিভেটরকে নীচে থেকে পাওয়ার দিয়ে একতলায় উঠানো হচ্ছে তখন জুড়ে থাকার জন্য দ্বিতীয় এলিভেটর নামছে দ্বিতীয় তলা থেকে একতলায়। এই একতলায় লোকেরা এক এলিভেটর থেকে অন্য এলিভেটরে চলে যাবে – এবার প্রথম এলিভেটর নামবে নীচে, এখানেও জুড়ে থাকার জন্য, এটা এবার টেনে তুলে দেবে দ্বিতীয় এলিভেটরকে প্রথম তলা থেকে দ্বিতীয় তলায়। শুনে খুবই সিম্পল মনে হচ্ছে কি? এক একটা এলিভেটরের ওজন ছিল প্রায় আট থেকে ১০ টন করে, প্রায় ৬৫ জন করে পাবলিক ধরত তার মধ্যে।
আগে যেমন উল্লেখ করেছি, আইফেল টাওয়ার বানাতে গিয়ে গণনা একদম নিখুঁত হতে হত, না হলে পুরো কেলো কেস। কিন্তু প্রবলেম হল, ক্যালকুলেশন তো একটা, দুটো, দশটা বা একশোটা নয় – হাজার হাজার ক্যালকুলেশন। ভেবে দেখুন কম্পিউটার নেই, ডিজিটাল ক্যামেরা নেই, ফটোকপি করার মেশিন নেই – এই সব হাজার হাজার ক্যালকুলেশন ম্যানুয়াল ভাবে ম্যানেজ করতে হত। আর তা ছাড়া ছিল প্রচুর ড্রয়িং – আইফেলের অফিস শুধু মাত্র টাওয়ারের খাঁচার জন্যই ১৭০০ মত ড্রয়িং বানিয়েছিল। এছাড়া ওই ভিউয়িং ডেক বা অন্য জায়গা গুলোর ড্রয়িং এর কথা তো ছেড়েই দিলাম! এর সাথে আরো যোগ হয়েছিল ৩৭০০ মত ডিটেলেড ড্রয়িং – প্রচুর প্রচুর গণনা যাতে খুঁটি নাটি ধরা ছিল প্রায় ১৮,০০০ হাজার বিভিন্ন পার্টের যেগুলো জুড়েই তৈরী হয়েছিল আইফেল টাওয়ার।
লেখা অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে – শেষ করব আইফেল কি ভাবে ঠিক করলেন কি দিয়ে তৈরী করবেন এত বড় টাওয়ার সেটা নিয়ে খানিক আলোচনা করে। বিগত একশো বছরে ধাতুবিদ্যার (বিশেষ করে স্টিল মেকিং) অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। অনেক জিনিস যা আগে কল্পনা করা যেত না কাঠামো হিসাবে বানানোর জন্য, তা সম্ভব হয়েছে অনেকটা এই স্টিল মেকিং এর উন্নতির জন্যই। কিন্তু সেই নিয়ে লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে – আজকে তাই আইফেল টাওয়ারের সাথে জড়িত ব্যাপার নিয়েই আলোচনা করা যাক।
বাইরের উন্মুক্ত পরিবেশে কোন ধাতব কাঠামো বা স্থাপত্য রেখে দিলে (বিশেষ তা যদি আবার লোহা/ইস্পাতের বানানো হয়) তাই ক্রমশঃ ক্ষয়ে যাবে এ আমাদের জানা। ঠিক কেন ক্ষয় এবং কি করলে ক্ষয় রোধ হবে তা প্রায় আধুনিক যুগের জ্ঞান। বাইরের বিখ্যাত কাঠামোর ক্ষয় নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দুটি স্থাপত্য আমাদের মনে চট করে ভেসে ওঠে – এক হল দিল্লীর লৌহ স্তম্ভ যা প্রায় ১৬০০ বছর ধরে খোলা পরে আছে, কিন্তু ক্ষয় হচ্ছে না তেমন। আর অন্যদিকে আছে আইফেল টাওয়ার – এর কিন্তু ক্ষয় হয় বাইরে খোলামেলা পরে থেকে। তাই এই টাওয়ারকে বাইরের আবহাওয়ার থেকে রক্ষা করতে আইফেল বুঝে গিয়েছিলেন যে একে রঙ করতে হবে।
তাহলে কি দিল্লীর লৌহস্তম্ভ যে লোহা দিয়ে বানানো হয়েছিল তা দিয়ে আইফেল টাওয়ার বানালে আর রঙ করতে হত না? প্রথম কথা আইফেল জানতেন না কি ধরণের লোহা দিয়ে দিল্লী লৌহস্তম্ভ বানানো হয়েছে, আর দ্বিতীয়ত দিল্লীর লৌহস্তম্ভের লোহা দিয়ে আইফেল টাওয়ার বানানো যেত না। কেন যেত না বা কেন দিল্লীর লৌহ স্তম্ভ ক্ষয় নি সেই নিয়ে তিন পর্বে বিস্তারে লিখেছি আগে, ইচ্ছে করলে পড়ে নিতে পারেন। তাহলে আই আইফেলের হাতে এমন কোন লোহা ছিল না যা ব্যবহার করলে ক্ষয় নিয়ে চিন্তা করতে হত না? এখানে দুটো ব্যাপার খেয়াল রাখতে হবে, যখন আইফেল টাওয়ার বানানো হয়, তার প্রাথমিক প্ল্যানে ছিল মাত্র ২০ বছরের জন্য সেটা থাকবে, তারপর সেটাকে ভেঙে ফেলা হবে। তাই মনে হয় না আইফেল খুব বেশী ভেবেছিলেন কেমন ভাবে যুগ যুগ ধরে এই স্তম্ভ বিনা ক্ষয়ে খাড়া থাকবে।
তবে চাইলেও আইফেলের হাতে খুব একটা বেশী চয়েস ছিল না। ভালো ইস্পাত (স্টিল) তৈরী তখন সবে মাত্র পরিপক্ক হচ্ছে – প্রচুর দাম। কিন্তু আবহাওয়া নিরোধক ইস্পাত (ওয়েদারিং স্টিল) আসতে তখনো অনেক দেরী। এই স্টিল কিন্তু আপনারা অনেকেই দেখেছেন – হয়ত না জেনেই। দেখেছেন কি অনেক স্থাপত্য যেগুলো ইস্পাত দিয়ে বানানো তারা খোলামেলা বাইরে ছড়িয়ে আছে আর তাদের গায়ে হালকা সবুজ রঙের এক আস্তরণ (প্যাটিনা)। তামার তৈরী মূর্তি বা বাড়ির ছাদের, বা ব্রোঞ্জের মূর্তির, বা কোন তামার অন্য কিছু মোড়কের গায়ে তো এই সবুজ প্যাটিনা আপনারা দেখেছেনই – যা কপার অক্সাইডের, এই অক্সাইডের জন্যই সে সবুজ রঙ।
তো স্টিল মেকিং এর অগ্রগতির সাথে মানুষ করল কি – ক্রমে বুঝতে শিখল লোহার সাথে কি মেশালে কি হয়। সেই মত আবিষ্কার করে ফেলল ওয়েদারিং স্টিল যাতে খুব কম করে মেশানো থাকে তামা (০.২৫ – ০.৫৫%) আর ক্রোমিয়াম (০.৫ – ১.২৫%) – এরা খুব উগ্র ভাবে ভালোবাসে অক্সিজেনকে। তাদের ভালো বাসার ফলে তৈরী হয় কপার অস্কাইড এবং ক্রোমিয়াম অক্সাইড যা একটা পাতলা আস্তরণ তৈরী করে ধাতুর গায়ে। সেই হিসাবে দেখতে গেলে এটাও কিন্তু একধরণের ক্ষয় – কিন্তু এটা এমন ক্ষয়, যা আমাদের কাজে লাগে। এমনি লোহা বাতাসের সাথে বিক্রিয়া করে যে আয়রণ অক্সাইড গড়ে তোলে তাকে আমরা বলি মরচে বা জং। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে এই মরিচা তা হলে কেন বাকি লোহাটাকে প্রোটেক্ট করতে পারে না যেমন পারে কপার অক্সাইড? কারন একটাই – লেগে থাকার ক্ষমতা। এ সেই পড়াশুনার মত ব্যাপার আর কি – শুধু বুদ্ধি থাকলেই তো হবে না, গেলে থাকার ক্ষমতা চাই! আয়রণ অক্সাইডের এই লেগে থাকার ক্ষমতাটাই নেই – লোহার গা থেকে টুক করে খসে পরে। কিন্তু কপার বা ক্রোমিয়াম অক্সাইড এত আঁটোসাঁটো ভাবে লোহার গায়ে লেগে থাকে যে বাকি আর খারাপ কিছুকে তার কাছেই আসতে দেয় না। ফলে মূল লোহা সংরক্ষিত থেকে যায় – আপনারা হয়ত এমন হালকা সবুজ প্যাটিনার অনেক জিনিস পত্র দেখেছেন। এগুলে আবহাওয়ার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য পেন্টিং বা রঙ করার দরকার হয় না। সেই সবুজের আস্তরণই এদের বাঁচিয়ে রাখে।
তা এমন ওয়েদারিং স্টিল হাতে না থাকার ফলে আইফেলকে পেন্টিং করতে হয়ে ছিল তাঁর ব্যবহৃত পেটা লোহার কাঠামোতে। তবে ওয়েদারিং স্টিল থাকলেও অবশ্য মনে হয় না আইফেল তা ব্যবহার করতে পারতেন – মূলত বাজেট ইস্যুর জন্য। অত দাম দিয়ে ওই স্টিল কিনে আইফেল টাওয়ার বানাতে গেলে দেউলিয়া হয়ে যেত সরকার। আইফেল রঙ করার উপকারিতা বুঝতে পেরেছিলেন, আর তাই পরে ১৯০০ সালে তাঁর বই “দি থ্রি হান্ড্রেড মিটার টাওয়ার” এ লিখেছিলেন,
“আমরা মনে হয় কখনই এই টাওয়ারকে রঙ করার গুরুত্ব ঠিক ঠাক বুঝতে পারব না। কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার যে এই ধাতব স্তম্ভের সুরক্ষার জন্য একে রঙ করা খুবই জরুরী। যত ভালো ভাবে যত্ন করে রঙ করা হবে, তত বেশি দিন টেকসই হবে এই টাওয়ার”।
আইফেল টাওয়ারের রঙ কিন্তু প্রথম থেকে একই ছিল এমন নয় – বরং সময়ের সাথে সাথে রঙ পাল্টেছে এর। প্রথমে যে লোহার টুকরো গুলি নিয়ে এসে জুড়ে জুড়ে টাওয়ার বানানো হচ্ছিল তাদের রঙ ছিল ‘ভেনেশিয়ান রেড’ – পরে পুরো আইফেল টাওয়ার খাড়া হয়ে গেলে তাকে রঙ করা হয় লালচে-বাদামী রঙে। এর পর থেকে প্রতি ৭ বছর অন্তর অন্তর পুরানো রঙ পুরো খসিয়ে নতুন করে রঙ করা হয়। এই সাত বছরের রেকমেন্ডেশনটা খোদ আইফেল নিজে করে গিয়েছিলেন – ১৮৮৯ সালের পর থেকে এখনো পর্যন্ত ১৯ বার রঙ করা হয়েছে আইফেল টাওয়ারকে, শেষবার ২০১৯ সালে। ১৯০৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আইফেল টাওয়ারের রঙ ছিল হলদেটে-বাদামী, তারপরে ১৯৫৪ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত ছিল বাদামী-লালচে রঙের, এবং ১৯৬৮ সালের পর থেকে এর রঙ হয় ‘আইফেল টাওয়ার ব্রাউন’। পুরো আইফেল টাওয়ারের সারফেস এরিয়া দেখতে গেলে প্রায় আড়াই লক্ষ বর্গ মিটার, এই পুরো সারফেস রঙ করতে প্রায় আঠারো মাস মতন লাগে গড়ে। জনা পঞ্চাশ ট্রেনড রঙ মিস্ত্রী লাগে কাজে, প্রায় ৬০ টন মত রঙ লাগে, সাথে থাকে ১৫০০ ব্রাশ, ১৫০০ মত ঘষার জিনিস ইত্যাদি। ২০০৯ সালের ক্যাম্পেনে এই আইফেল টাওয়ার রঙ করতে খরচা হয়েছিল প্রায় ৪০ লক্ষ ইউরো (৩৬ কোটি টাকা)।
তাহলে কি দেখলাম, সত্যি বলতে কি খুব বেশী চয়েস তাঁর হাতে ছিল না। ক্যালকুলেশন করে তিনি যা বার করলেন তাতে করে ধাতুর যা শক্তি বা নমনীয়তা লাগবে তা ঢালাই লোহা প্রদান করতে পারবে না। তাহলে হাতে রইল পেটা লোহা আর ইস্পাত। মনে রাখতে হবে যে তখন ইস্পাত সবে মাত্র বাজারে আসছে – একবারে প্রথম যুগের ইস্পাত যদিও, কিন্তু তাদের ধর্ম পেটা লোহার থেকে ভালো। কিন্তু এই ইস্পাত কোথা থেকে পাওয়া যাবে এত অল্প সময়ের মধ্যে! আর তা ছাড়া তখন ইস্পাত এত বেশী দামী ছিল যে মনে হয় না আইফেল টাওয়ারের বাজেটে সেটা কুলাতো! অনেকে বলেন যে বাজেট ছিল ইস্পাত কেনার, কিন্তু আইফেলের কনফিডেন্স ছিল না ইস্পাত কেমন ব্যবহার করবে বা কি ভাবে তার ধর্মের গ্যারান্টি দেওয়া হবে! আমার মনে হয় না এটা সত্যি – বাজেটটাই মূল ব্যাপার ছিল ইস্পাত না ব্যবহার করার। আইফেল টাওয়ার বানাবার কিছু বছর পরে স্টিল বানাবার পদ্ধতির খুব দ্রুত উন্নতি হয় এবং দামও বেশ কমে আসে। তাই কিছু বছর পরে বানালে হয়ত আমরা ইস্পাতের আইফেল টাওয়ার দেখতাম আমরা। তবে বাহ্যিক ভাবে আমরা কিছু টের পেতাম না – কারণ সেই স্টিলও রঙ করা থাকত ‘আইফেল ব্রাউন’ দিয়ে।
যদি আপনার বিষ্মিত হবার ক্ষমতা থেকে – তাহলে নিশ্চিত ভাবেই আপনি প্রথমবার এই আইফেল টাওয়ার দেখলে বিষ্মিত হবেনই। ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে আমার বিষ্ময় লাগে আরো বেশী – কতখানি দখল থাকলে ১৩০ বছর আগে এমন জিনিস বানানো যায় ভেবে অবাক হই! অজান্তেই মাথা ঝুঁকে আসে গুস্তাভো আইফেলের জন্য -
শুধু আইফেল টাওয়ারই নয়, গুস্তাভো আইফেল না থাকলে হয়ত আমরা যে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি দেখছি আমেরিকার নিউ ইয়র্কে, সেটাও পেতাম না। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শেষে হলে ১৮৮০ নাগাদ ফরাসীরা ঠিক করল আমেরিকাকে একটা জমকালো গিফট করবে – ওই স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। কিন্তু অমন বিশাল দৈত্যাকার জিনিস সলিড মেটাল দিয়ে বানালে তা এত ভারী হয়ে যাবে যে আমেরিকা পাঠানো অসম্ভব হয়ে উঠবে। ফলে দারস্থ হতে হল আইফেলের। কি করলেন তিনি? কেমন ভাবে ডিজাইন করলেন তিনি স্ট্যাচু অফ লিবার্টি?
স্ট্যাচু অফ লিবার্টি – এর নিজের গল্পও বড়ই জমকালো। একশো বছর ধরে সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে অনেক ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল মূর্তি এবং তার কাঠামোর। কেমন ভাবে চতুর ভাবে পরিকল্পনা করে সব ক্ষয় মেরামত করে নতুন ভাবে সাজিয়ে তোলা হল এনাকে – সেই সব রোমহর্ষক কাহিনী পরের পর্বে
বা: চলুক চলুক!
(স্বগতঃ পরের পর্ব আসতে আসতে কি শ্রী দিলীপ ঘোষের মুখ্যমন্ত্রীত্ব দেখবে বাংলা? )
অনবদ্য লাগল।
খুব ভাল লাগল।
সব লেখাই চেষ্টা করি পড়ে যেতে। বলবার সময় আর পাই না।