এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  বিবিধ

  • সুকিয়ানা - ১০ম পর্ব (অশুভ শক্তি মোহময় - আমাদের সম্মোহিত করে রাখে)

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | বিবিধ | ০৩ অক্টোবর ২০২০ | ৩৮৬৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (৪ জন)
  • দৃশ্য-১

    “আমাদের অবস্থান কেউ ফাঁস করে দিয়েছে – জার্মানরা জানতে পেরে গিয়েছিল আমাদের দলটা কোথায় ক্যাম্প করে ছিলাম।  জঙ্গলকে তারা থেকে ঘিরে ধরল চারপাশ থেকে।  জঙ্গলের মধ্যেকার কিছু জলাভূমি আমাদের বাঁচিয়েছিল কারণ শত্রুপক্ষের কেউ সেখানে গিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে নি।  একটানা সারাদিন, এমনকি গোটা সপ্তাহ ধরেও এক গলা জলে দাঁড়িয়ে থাকা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।  আমাদের দলে ছিল একজন মেয়ে যে রেডিও অপারেট করত আর মাত্র কয়েকমাস আগে মা হয়েছে।  সেই বাচ্চার তখনো স্তন্যপান করার বয়স, কিন্তু ওদিকে মেয়েটির বুকে দুধ নেই – খেতেই পাচ্ছি না আমরা দিনের পর দিন তো কি করে বুকে দুধ আসবে! আর তাই দুধ না পেয়ে বাচ্চাটা মাঝে মাঝেই কেঁদে উঠছিল।  কিন্তু সেই কান্না আমাদের কাছে অত্যন্ত বিপদজনক হয়ে দেখা দিল – কারণ শত্রুপক্ষ যদি একবার কান্না শুনতে পেয়ে যায় তাহলে কেউই বাঁচব না আর – আমাদের তিরিশ জনের দলের একজনও নয়।  আলোচনা করে নিজেদের মধ্যে এক সিদ্ধান্ত নেওয়া হল – গেলাম সেই মায়ের কাছে – তার দিকে তাকালাম – কিন্তু আমাদের মধ্যে কেউই মুখ ফুটে বলতে পারল না কমান্ডারের সিদ্ধান্তের কথা।  কিন্তু মেয়েটি ততক্ষণে নিজেই বুঝতে পেরে গিয়েছিল – বাচ্চাটি যেখানে বাঁধা ছিল সেটা সে ধীরে ধীরে জলের নীচে ধরল এবং ধরেই রইল জলের নীচে অনেকক্ষণ – বাচ্চার কান্না থেমে গেল একসময়  - কিন্তু একে অপরের চোখের দিকে তাকাবার ক্ষমতা হারালাম আমরা”।  

    সোয়েতলানা আলেক্সিভিচ-এর লেখা এই অংশ, যা মূলত দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এক সোভিয়েত নারীর স্মৃতিচারণ, তা সোভিয়েত ইউনিয়নের সেন্সরশিপের বেড়াজাল টপকে তাঁর তখনকার বইতে স্থান পায় নি। 

    কি বলেছিল মনে হয় সেন্সর বোর্ড লেখার এই অংশটা বাদ দেবার যুক্তি হিসাবে? সোয়েতলানাকে বলা হয়েছিল তোমার লেখা শুনে মনে হচ্ছে আমাদের দেশের নাগরিকদের মধ্যে বাচ্ছাদের প্রতিও কোন করুণা ছিল না! হ্যাঁ, এটা ঠিক যে যুদ্ধ আমাদের কাছ থেকে অনেক কিছু ছিনিয়ে নিয়েছে – কিন্তু তার মধ্যে থেকেও তোমাকে বীরত্বের গল্প খুঁজে আনতে হবে – যুদ্ধের এমন নোংরা দিকটার গল্প নয়! 

    আজ থেকে প্রায় পনেরো বছর আগের কথা।  বার্মিংহাম শহরের বুল-রিং শপিং মলটার নীচের তলার কোণের দিকে একটা বইয়ের দোকান ছিল যেখানে কম দামে নানাবিধ কিন্তু অন্যধরণের বই পাওয়া যেত।  ছাত্রজীবনে তা বেশ আকর্ষণীয়।  তাই প্রত্যেক শনিবার ওদিকে বাজার করতে গেলে সেখানে খানিকক্ষণের জন্য ঢুঁ মারা প্রায় নিয়ম ছিল। একদিন সেখানে এক বইয়ের খোঁজে পেয়ে গেলাম – এমন কোন বিখ্যাত কোন বই নয়। কিন্তু কেন জানি না বড় ভালো লেগে গিয়েছিল সেই বইটি – এবং তারপর থেকে মাঝে মাঝেই মন খারাপ হলে, বা মন খারাপ না হলেও নিজেকে মনে করিয়ে দেবার জন্য বইটি পড়েছি।  সেই বইটি মূলত সংকলিত হয়েছিল তখনকার সময়ে (২০০০-২০০৩) ফরাসী দেশে অ্যাসাইলাম-এ থাকা নানা দেশের লেখকদের কবিতা-গদ্য-স্মৃতিকথা-প্রবন্ধ দিয়ে। বর্ণিত হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এই শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত ঘটে যাওয়া কিছু হাড় হিম করে দেওয়া মানবতার অবমাননার কথা।   

    এই ভাবেই আলাপ হয়ে যায় সোয়েতলানা আলেক্সিভিচ এর সাথে – তখনো আমি তাঁর লেখার সাথে পরিচিত ছিলাম না – পড়েছিলাম তাঁর ২০০২ সালের ডায়েরীর পাতার অংশবিশেষ।  জানা ছিল না তিনি কত বড় লেখক – কিন্তু বড় ভালো লেগে গিয়েছিল তাঁর লেখা।  দীর্ঘসময় ধরে তিনি যুদ্ধ বিষয়ক লেখা লিখি করেছেন – সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে শুরু করে আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ানের কাজকর্ম এবং পরে চেরনোবিল পারমাণবিক বিপর্যয় নিয়েও।  তারপর যা হয়, বেশী ঘাঁটাঘাঁটি করে নিজের দেশ বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লউকানচেঙকো-এর বিরাগভাজন হন – বারংবার আক্রমণের স্বীকার হয়ে অবশেষে তিনি প্যারিসের কাছে অ্যাসাইলামে আসেন। আমি যখন প্রথম তাঁর লেখা পড়ি ২০০৫ সাল নাগাদ, তখনো তিনি সেখানেই ছিলেন।   

    সোয়েতলানা যেমন নানা সত্ত্বার সাথে মিশে গিয়ে মানুষের গল্প – সেই অস্বাভাবিক সময়ের মধ্যে স্বাভাবিকতা আদৌ ছিল কিনা খুঁজতে বেরিয়ে ছিলেন, তেমনি হয়ত এক আগামীর সন্ধ্যেয় উত্তর খুঁজতে বসব আমরা তিনজন – আমার উত্তর পুরুষ, তখনকার আমি আর আজকের আমি।  আমার উত্তরপুরুষ সেই সন্ধ্যেবেলায় জিজ্ঞেস করবে – তোমরা কেমন ছিলে তখন? মানিয়ে নিয়েছিলে কি সেটাই স্বাভাবিক বলে?  

    উত্তরপুরুষ এক বাক্যে আমার উত্তর শুনতে চাইলে চুপ করে থাকব – যদি তার হাতে সময় থাকে তাহলে হয়ত গল্প করব, তাকে বলব - বারবার খাতায় লিখতাম

    “সে বড়ো সুখের সময় নয়, সে বড়ো আনন্দের সময় নয়
    তখনই
    পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল করে, দেয়ালে দেয়াল, কার্নিশে কার্নিশ”

    সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গের পঙতিমালা এমনই ভাবে আমাকে ওই সময়ের সাথে মিলিয়ে দিয়েছিল।  আমি তাকে হয়ত বোঝাবার চেষ্টা করব – সেই দিনের গল্পে আমি মানুষটার কমপক্ষে দুটো সত্ত্বা মজুত আছে – অনেক সময় দুয়ের বেশীর সও্বাও।  এতগুলো সত্ত্বার মধ্যে কোনটা ঠিক – কোনটা তুলে ধরবে নিখাদ সত্যি! তখন কি আর মনে পড়বে কোনক্ষণে কোন সত্ত্বায় জড়িয়ে ছিলাম আমি?  

    যদি জিজ্ঞেস করে, কিন্তু তোমার উত্তর তো পেলাম না! 

    আমার মৃদু ভাষ্য জানান দেবে আমাদের অনেকের কাছেই তার উত্তর থাকবে না –  যেমনটা ছিল না আজ থেকে আশি-নব্বই বছর আগের অনেকের বা তার পরেও অনেক অনেকবার ঘটে যাওয়া খুব ইদানিং অতীতের।  মানুষ জেনেটিক্যালি খুব স্বার্থপর – তাই আমার বলতে কষ্ট তেমন হবে না সেই সময় সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের মত  নিজেদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলাম। 

    হয়ত বলব, আমরা ছিলাম সেই পদার্থবিজ্ঞানের বিড়ালটির মত – ক্রান্তিকাল পার না হয়ে গেলে বুঝতেই পারি নি আমরা বেঁচে আছি নাকি বিষ বাষ্প শুঁকে ফেলেছি ইতিমধ্যে।  আর তখন তো উত্তরপুরুষ পর্যবেক্ষকের উপস্থিতি ছিল না – তাই বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া তার ফলাফলে আমরা ছিলাম উদাসীন।    

    যেটা হয়ত বলব না – তা হল মনের গভীরে দ্বন্দ, ক্রমাগত জমা হতে থাকা অস্বাচ্ছন্দ ঢেকে দেবার চেষ্টা করে চলেছিলাম নিজের অবচেতনে।  আমরা কেউই ঢাকনা খুলে দেখার চেষ্টা করি নি বেড়ালটার অবস্থা।  এবং তারপরে উত্তরপুরুষকে মনে করিয়ে দেব সেই অমোঘ সত্য – 

     “অশুভ শক্তি আর শয়তান, এরা মোহময় – আমাদের সম্মোহিত করে রাখে তারা” 

     সোয়েতলানা তাঁর দেশের যুদ্ধের সময়ের ইতিহাস লিখতে চেয়েছেন – কিন্তু কেমন ইতিহাস? ইতিহাস তো অনেকেই লিখেছেন, বইও অনেক, কিন্তু তাহলে কেন সোয়েতলানার লেখা আমার আলাদা লেগেছিল? খুব ছোট ছোট ব্যাপারে যখন নিজের ভাবনার সাথে, বা নিজে কি ভাবে দেখতে চাইছি তার সাথে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি মিলে যায় তখন তখন একাত্ম মনে হয় বৈকী! খুব সাধারণ কয়েকটা কথা আমার মনে গেঁধে গিয়েছিল – 

    • ইতিহাস কি? আমার কাছে ইতিহাস হচ্ছে মানুষের ভয় পাবার গল্প।  
    • আমি যুদ্ধ নিয়ে লিখছি না, আমি লিখছি যুদ্ধলিপ্ত মানুষদের কথা।
    • নারীদের যুদ্ধের আছে নিজস্ব ভাষ্য।   

    যুদ্ধকালীন মানুষই হোক আর চেরনোবিল এর মানুষই হোক, সোয়েতলানা নিজে মানুষের কাছে গিয়ে তাদের গল্প শুনেছেন।  মানুষের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে চেরনোবিলে আশেপাশে খুব বেশী সময় কাটাবার জন্য তিনি তেজস্ক্রীয় বিষক্রিয়ার সম্মুখিন হন এবং দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা অর্জন করেন।  চেরনোবিলের গল্প আজকে নয় – আজকে বরং দেখা যাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মানুষের ছবি তিনি কেমন এঁকেছিলেন – 

     প্রায় চারশো জনারও বেশী মহিলার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন তিনি – ক্যাসেটের পর ক্যাসেট, খাতায় নোটস্‌ এর ভর্তি।  এর পরেও তিনি আলাদা করে নিজের এক ডায়েরী রেখেছিলেন সাথে যেখানে তিনি নিজের সেই সময়ের অনুভব লিখে রাখতেন।  

    দৃশ্য-২

     “শত্রুপক্ষের সেনারা আমাদের গ্রাম ঘিরে ফেলে জ্বালিয়ে দিল সব কিছুই।  যারা পালাতে পেরেছিল সময় মত তারাই কেবল বেঁচে রইল। আমরা পালিয়ে গিয়েছিলাম একদম খালি হাতে, এমনকি সাথে খাবার নেবারও সময় হয় নি।  রাতের বেলা নাশতিয়া আন্টি তার ছোট মেয়েকে খুব মারল।  নাশতিয়া আন্টির পাঁচজন ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আমাদের সাথে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছিল – কিন্তু তারা প্রত্যেকেই বারে বারে মায়ের কাছে খাবার চাইছিল খুব খিদে পেয়েছে বলে।  আন্টিকে পুরো পাগল এবং উদভ্রান্ত মতন লাগছিল বারে বারে বাচ্ছাদের কান্না শুনে।  আন্টির ছোট মেয়ে জুলিয়া আমার বন্ধু।  একদিন রাতে শুনলাম জুলিয়া তার মাকে বলছে, “আমাকে তুমি প্লীজ জলে ডুবিয়ে মেরো না, আমি আর তোমার কাছে খেতে চাইব না কিচ্ছুটি”।  পরেরদিন সকালে আমরা কেউই আর জুলিয়াকে খুঁজে পেলাম না।  শত্রুপক্ষের সেনারা গ্রাম থেকে চলে গেলে আমরা ফিরলাম গ্রামে – কেবল কালো কালো চুল্লীগুলো জ্বলছে দেখলাম।  আর নিজের বাড়ির বাগানে দেখতে পেলাম আন্টি নাশতিয়া আগুনে ঝলসানো আপেল গাছটার থেকে গলার দড়ি দিয়ে ঝুলছে”।   

    দৃশ্য-৩

     “আমরা পুরো ঘেরাও হয়ে গিয়েছিলাম চারিদিক থেকে – আরো দূরে পালাবার উপায় ছিল না।  তাই আমরা বনে জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলাম প্রায় দুই মাস যাবৎ । গাছের পাতা, মূল, জলাভূমির শ্যাওলা খেয়ে দিন কাটছিল আমাদের।  সেই দলে আমরা মোট ছিলাম পাঁচজন, আমরা চার বান্ধবী আর একটা বাচ্ছা ছেলে।  সেই ছেলেটি সবেমাত্র সেনা বাহিনীতে যোগদান করার জন্য ভর্তি হতে গিয়েছিল। একদিন রাতে আমার বান্ধবী কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “এই বাচ্ছাটা কেবল নামে মাত্র বেঁচে আছে – যেকোন দিন মারা যেতে পারে। তুই বুঝতে পারছিস আমি কি বলতে চাইছি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি বলতে চাইছিস তুই?”। বান্ধবী বলল, “আমরা সবাই মানুষের মাংস খেতে পারি – না হলে মারাই যাব সব আমরা”। সেই কথা শুনে আমি বমি করে ফেললাম যদিও বমি করার মত পেটে কিছুই ছিল না। পরের দিন সৌভাগ্যবশতঃ আমরা মিত্রপক্ষের লোকেদের দেখা পেয়ে গেলাম”।

    দৃশ্য ২ এবং ৩ এর ঘটনা তাঁর বইতে রাখেন নি সোয়েতলানা – কত রাখবেন তিনি! আরো হাজারো ঘটনার মধ্যে তবুও এমন কিছু তিনি দীর্ঘদিন ভুলতে পারেন নি বলে আলাদা করে নিজের ডায়েরীতে লিখে রেখেছিলেন।  তবে যে ঘটনা গুলো লিখেছিলেন, তার সবই যে ছাপার মুখ দেখেছিল তেমন নয়।  সোভিয়েত ইউনিয়নের সেন্সরশিপের বেড়াজাল টপকে তখন প্রকাশিত বইতে এমন অনেক ঘটনা স্থান পায় নি।  এর মধ্যে দৃশ্য ১ তো আগেই উল্লেখ করেছি।  আরো দুটো দৃশ্যের কথা উল্লেখ করা যাক -

     দৃশ্য-৪

    “আমরা এগিয়ে যাচ্ছিলাম – সামনেই একটা জার্মান গ্রাম – আমদের বয়স তখন অনেক কম আর গায়ে প্রচুর শক্তি।  প্রায় চার বছর আমরা নারী স্পর্শ বিহীন – সেই গ্রামে আমরা ওয়াইন পেলাম, খাদ্য পেলাম – আর পেলাম জার্মান মেয়েদের। আমরা মেয়েদের পাকড়াও করে দশজন মিলে প্রত্যেক মেয়েকে ধর্ষণ করলাম।  সেই গ্রামে বেশী সংখ্যায় মেয়ে ছিল না – সবাই সোভিয়েত সেনার ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। খুব কম বয়সী কিছু মেয়ে রয়ে গিয়েছিল – সেই ১২ বছরের মেয়েটার কথা মনে পড়ছে – খুব কাঁদছিল সে, আমরা তাকে মারতে থাকলাম। একজন এগিয়ে গিয়ে তার মুখে কিছু একটা গুঁজে দিল। ব্যাথায় ককিয়ে উঠল সে – কিন্তু আমাদের বেশ মজা লাগলো। আজ এই এতদিন পরে আমি বুঝতে পারি না কিভাবে আমি সেই ব্যাপারটায় অংশগ্রহন করেছিলাম! – কিন্তু করেছিলাম – সেটা অন্য এক আমি ছিলাম মনে হয়”

    এই অংশও বাদ – সোয়েতলানা-কে সেন্সর বোর্ড বলল, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তখন ছিল স্তালিনের আদেশ – আর এছাড়া তুমি সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপবাদ দিচ্ছ, সেই বাহিনী যারা প্রায় অর্ধেক ইউরোপকে জার্মানদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিল। তোমার এই সব লিখতে লজ্জা হওয়া উচিত – কেবল মাত্র আমাদের পরম শত্রুরাই এমন কিছু আমাদের সেনাবাহিনীদের নিয়ে লিখতে পারে! 

    আরো বাদ দেওয়া অংশ

     দৃশ্য-৫ 

    “আমরা প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার হাঁটলাম সেদিন – খুব গরম, তিরিশ ডিগ্রী মতন।  খালি পায়ে সেই গরম বালির উপর দিয়ে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমাদের।  বিকেলের দিকে আমরা একটা নদীর কাছে এসে পৌঁছলাম – এখান থেকে ফেরী নেবার কথা।  আমাদের দলের পুরুষরা ক্লান্ত হয়ে নদীর ধারেই বসে পড়ল – আমরা মেয়েরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে অনেকে এগিয়ে গেল নদীতে স্নান করতে।  অনেক মেয়েদের তখন ঋতুস্রাব চলছিল – কিন্তু তখন সেনাবাহিনীতে মেয়েদের জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা না থাকার জন্য স্যানেটারী ন্যাপকিন পায় নি কেউই।  প্রায় সবারই পা-ময় লেগেছিল রক্ত। আমরা হাতের কাছে চটের টুকরো বা কাগজ যা পেয়েছিলাম তাই দিয়েই মুছে নিচ্ছিলাম ঋতুস্রাবের রক্ত – অনেকে আবার ঘাসে মুছছিল – এমন সময় আবার বোম্বিং শুরু হল – আমাদের উপর জার্মানরা প্রবল ভাবে বোমা বর্ষণ শুরু করল – পুরুষেরা যারা বিশ্রাম করছিল, তারা অনেকেই প্রাণ ভয়ে এদিক ওদিকে ছোটাছুটি লাগালো – কিন্তু বেশীর ভাগ মেয়েই জল থেকে উঠল না।  মৃত্যুর থেকেও তাদের কাছে বেশি ভয়ঙ্কর ছিল লজ্জা! জলের মধ্যে থেকেই অনেকে মারা গেল – নগ্ন দেহে ছুটে পালাবার লজ্জায় তারা নিজেদের মৃত্যু ডেকে আনল – সেই প্রথম চোখের সামনে দেখলাম লজ্জা বিষয়ক মেয়েলী ধারণার কবলে পরে কিভাবে প্রাণ পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারে অনেকে!”

    এর লেখা না ছাপতে দেবার যুক্তি কি ছিল? লেখিকাকে বলা হল – তোমার লেখার এত ‘শরীরবিদ্যা’ কেন? আদিম প্রাকৃতিকতা লেখার মধ্যে ঢুকিয়ে তুমি মহিলাদের সম্মানহানী করছ – ওরা সব বীর মহিলা ছিল – বীরের মত মৃত্যু বরণ করেছে – তুমি তাদের সেই অবস্থান থেকে নামিয়ে একজন সাধারণ নারী বানিয়ে দিয়েছ – যারা রক্তমাংসের গড়া! 

    হ্যাঁ, সোয়েতলানার লেখায় এমন সব রক্ত মাংসের মানুষের দেখা পাওয়া যায় – তাঁর যুদ্ধের লেখায় জুড়ে থাকে মানুষের গল্প, বিশেষ করে নারীদের গল্প। তিনি ঠিকই করেছিলেন যে যুদ্ধের বীরগাথা লিখবেন না – আমাদের কাছে যুদ্ধের গল্প মানে স্বাভাবিক ভাবে সেই কেবল মৃত্যু – বীরের মতন যুদ্ধ করা, বিজয়ী হলে তার বিজয় গাথা – আর হেরে গেলে সেই হারকে মহিমান্বিত করে প্রচলিত লোকগাথা। সেই সবের বাইরে বেরিয়ে তিনি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন মানুষের বেঁচে থাকার দিনপঞ্জী।  এমন নাড়িয়ে দেওয়া লেখা আমার খুব একটা পড়া নেই।  আর সেই জন্যই হয়ত কখন অজান্তেই বড় কাছের হয়ে যায় সোয়েতলানা আলেক্সিভিচ এর লেখা।  

    আমি নিজে বেশীর ভাগ সময়েই মানুষের গল্প লিখতে চেয়েছি – সেই কারণেই আমার লেখায় ‘ফিকশন’ খুব একটা থাকে না।  সোয়েতলানা তাঁর মত করে লিপিবদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিলেন তাঁর ফেলে আসা, বা তাঁর ছোট বেলায় দেখা দেশের কথা – তাঁর বান্ধবী, তাদের মা – বা আরো অনেক অনেক চেনা এবং অচেনাও মহিলা এবং পুরুষদের কথাও।  তিনি যুদ্ধের সময় পেরিয়ে খোঁজার চেষ্টা করেছেন সেই প্রশ্নের উত্তর - তোমরা কেমন ছিলে তখন? মানিয়ে নিয়েছিলে কি সেটাই স্বাভাবিক বলে?  

    অনেকটা পড়া হলে, জানা হলে দেখা যায় ‘স্বাভাবিকতা’ এক অদ্ভুত ধারণা – লেখিকার সামনে বসা সাক্ষাতকারে অকপটে সব বলা যুদ্ধের সময়ের ধর্ষক নিজেই এখন বুঝতে পারছে না কিভাবে সে মনে করে নিয়েছিল তখন যা করছে সব কিছু স্বাভাবিক! আর দেখা যায় রাষ্ট্রের প্রতি ভক্তির ব্যাপারটাও গোলমেলে – রাষ্ট্রের ক্ষমতা কিন্তু ততটা গোলমেলে নয়।  ক্ষমতার কাজ কিন্তু বেশীর ভাগ দেশেই, বেশীর ভাগ সময় জুড়েই প্রায় একই – আনুগত্যে বাধ্য করা। হ্যাঁ, রকমফের আছে বৈকী – পদ্ধতির প্রকারভেদ আছে, আছে প্রকারভেদ নামেও।  অনেকটা আত্মহত্যার মত ব্যাপার, পথ যাই হোক – সফলতা পেলে বরণীয় সেই মৃত্যুই।   

    সময় বয়ে চলে নিজের মত, মানুষ নিজে পালটায় – কেমন পাল্টেছে তা সে নিজেই বুঝতে পারে না অনেকসময় যতক্ষণ না বাইরে থেকে কেউ পদার্থবিদ্যার বেড়ালটা মৃত কিনা দেখার জন্য পর্যবেক্ষক হিসাবে উপস্থিত হচ্ছে।  এবার প্রশ্ন হচ্ছে সেই পর্যবেক্ষক কে হবে? আমি কি নিজেই নিজের শরীরটা নাড়িয়ে মগজকে জানিয়ে দিতে পারব আমি মৃত কিনা? বা আমার কোন এক সত্ত্বার মৃত্যু হয়ে গেছে কিনা আমার অজান্তেই? আমার উত্তরপুরুষের সাথে তো আমার তখনকার সত্ত্বা বাদ দিয়েও গল্প করতে উঠে আসবে আরো অনেক সত্ত্বা – যার প্রত্যেকটাই আমি ছিলাম বাস্তবেই কোন না কোন সময়ে।  

    ক্ষমতা চিরকালই পরিশেষে জয়ী হয় – ক্ষমতার জয়গাথায় বাছাই লোকেদের ঠাঁই হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে যে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষত তৈরী হয় তার প্রশমণের জন্য না কিছু করে ক্ষমতা, না তাতে প্রলেপ লাগানোর ব্যবস্থা করে রাষ্ট্র। নিজেদের মতন করে মানুষ বেঁচে থাকে – নিজের পথ নিজেকে করে নিতে হয়, যেমন করে নিয়েছিল যুদ্ধের পর সেই সোভিয়েত মহিলা বোম্বার।  সেই মহিলা তিন বছর যুদ্ধে ছিলেন, শয়ে শয়ে বোমা বর্ষণ করেছিলেন শহরের উপর, মানুষের উপর। কিন্তু আকাশ থেকে তো আর মানুষের মৃত্যুর স্পর্শ পাওয়া যায় না! সেটাও তিনি পেয়ে গেলেন বার্লিন শহরের কাছে জঙ্গলের পাশ দিয়ে একদিন হাঁটার সময় – সেদিনই প্রথম তিনি চোখের সামনে দেখলেন একজন মৃত ছিন্ন বিচ্ছিন্ন জার্মান সৈনিক-এর দেহ।  অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন শত শত বোমা বর্ষণকারী সেই মহিলা! যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে একদিন কেউ তাঁকে একটা গাঢ় লাল রঙের পোষাক উপহার দেয় – সেই পোষাক গায়ে দিলে তাঁর সারা শরীর জুড়ে দেখা যায় একজিমা! মহিলা তখন নিজের লড়াই লড়ছিলেন – পুরানো ক্ষত।   

    তিনি স্মৃতিচারণ করছেন, “যুদ্ধে এত রক্ত দেখেছি যে আমার মাথা আর লাল রঙ নিতে পারে নি – তাই শরীর খুব তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।  যুদ্ধের ভয়ঙ্কর স্মৃতি মাথার মধ্যে ভর করে -  সম্মুখ হাতাহাতি যুদ্ধে মানুষের হাড় ভাঙার শব্দ – মাথা, চোখ, পেটে ছুরি বেয়নেট ঢুকিয়ে আঘাতের পর আঘাত – যুদ্ধ থেকে ফেরার পর আমি অনেক দিন খুব অসুস্থ ছিলাম – কোন ওষুধেই কাজ হচ্ছিল না – শেষ পর্যন্ত এক বয়ষ্ক প্রোফেসরের সাথে দেখা হয় যিনি সঠিক ভাবে আমার রোগের লক্ষণ বিচার করেন – তিনি বলেন যে, ‘অনেক কম বয়েসে যুদ্ধে যাবার জন্য তোমার শরীরবৃত্তিয় অনেক জিনিস খুব মানসিক চাপের মধ্যে আছে।  কোন ঔষুধ তোমাকে কিছু সাহায্য করতে পারবে না – তোমার পক্ষে সবচেয়ে ভালো হবে বিবাহ করা এবং যত গুলো সম্ভব সন্তান ধারণ। প্রতিটা সন্তানের জন্মের সাথে সাথে তোমার শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একটু একটু করে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরবে’।  আজকে আমি পাঁচ ছেলেমেয়ের মা”।  ভালোবাসার দিয়ে তাহলে এই নারী জয় করতে পেরেছিলেন যুদ্ধের রেখে যাওয়া ক্ষত।  শুধু এই নারীই নয়, আরো অনেকেই ছিলেন এমন –  

    সোয়েতলানার নেওয়া কয়েকশো নারীর মধ্যে কেবল মাত্র একজনই সাক্ষাতকার নেবার সময় তেমন কিছুই বলতে চান নি – কারণ হিসাবে “আমি মনে করতে চাই না সেই সব অভিশপ্ত দিন – আমি চাই না।  তিন বছর যুদ্ধে ছিলাম আমি, আর সেই তিন বছরে আমার ভিতরের নারীটা যেন মৃত ছিল – আমার শরীর কাজ করত না ঠিক ঠাক – ঋতুস্রাব বন্ধ ছিল পুরোপুরি, নারীর শরীরের যৌন চাহিদাও অনুভব করতাম না।  কিন্তু তখনও আমি সুন্দরী ছিলাম – এমন একদিনে বার্লিনের কাছে আমার ভবিষ্যতের স্বামী আমাকে প্রপোজ করল। বলল যুদ্ধ তো শেষ হয়ে গেল – আমরা বেঁচে রইলাম, আমাকে বিয়ে কর।  আমি সেই বিবাহ প্রস্তাব শুনে কেঁদে ফেললাম – চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হল, ‘আমাকে বিয়ে করবে বলছ? দ্যাখো, আমাকে ভালো করে দেখো! কেমন দেখতে লাগছে আমাকে, নারীর মতন লাগছে কি? আগে আমাকে আবার একজন নারীতে পরিণত কর আগে – ভালোবাসা দিয়ে, ফুল দিয়ে – সুন্দর স্বপ্ন দেখিয়ে’ আসলে আমি তাকে এমনটা বলতে চাই নি – সেদিন তাকে প্রায় আঘাত করে ফেলেছিলেম – আমি তার মুখের দিকে তাকালাম – ওর গালের একপাশটা যুদ্ধে পুড়ে গেছে – আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সে আমার সব কথা বুঝতে পারছে।  পুড়ে যাওয়া গালের উপর দিয়ে ঝরে পড়ছে জলের ধারা – আমি নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারলাম না যখন আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল – হ্যাঁ, তোমাকে বিয়ে করব।  এই সব কথা আমি আর মনে করতে চাই না”।   

    কিন্তু এক্ষেত্রেও সেই ভালবাসাই নারীটিকে ফিরিয়ে দিয়ে এক নতুন জীবন।  বেশীর ভাগ নারীর সাক্ষাতকার নিয়ে তাদের জীবনের গল্প আঁকতে চাইলেও সোয়েতলানা যুদ্ধ অংশগ্রহনকারী অনে পুরুষেরও সাক্ষাতকার নিয়েছিলেন – প্রত্যেকের নিজের গল্প আছে – প্রত্যেকের আছে প্রায় অনেকেরই আছে তখনকার কাজের ন্যায্যতার দাবী।  তেমনি একজন বলছেন,  

    “আমরা জার্মানদের বন্দী বানিয়ে গ্রামে নিয়ে ফিরলাম – তাদের আমরা গুলি করে মারি নি, কারণ গুলি খেয়ে মৃত্যু বড় সহজের।  আমরা তাদের বন্দী অবস্থায় মারতাম খুব – লোহার রড দিয়ে – শূয়োরের মত ব্যবহার করা তাদের সাথে।  আমি মাঝে মাঝে তাদের উপর সেই অত্যাচার করা দেখতে যেতাম – চোখের ঠুলি বেড়িয়ে আসছে যন্ত্রণায় – কেমন এক চাপা আনন্দে ভরে উঠত মন।  কি, এসব শুনতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে? মনে হচ্ছে আমরা খুব নিষ্ঠুর জন্তু বিশেষ? কিন্তু এবার তোমাকে যদি বলি নিজের গ্রামের কথা একবার মনে কর – যেখানে জার্মানরা ঢুকে সব কিছু ছারখার করে দিয়েছি – এক ফাঁকা জায়গায় সন্ধ্যে বেলায় জ্বেলেছে বন-ফায়ার। আর এই আগুনে একে একে ছুঁড়ে দিচ্ছে তোমার মাকে – তোমার ছোট বোনকে – তোমার প্রিয় স্কুল শিক্ষককে।  বুঝতে পারছ কেমন লাগতে পারে? লেলিনগ্রাদে হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল – এত বেশী মানুষ মারা গিয়েছিল যে ঘোড়া-রাও ভয় পাওয়া ভুলে গিয়েছিল! তুমি মনে হয় জানো এমনিতে ঘোড়া মৃত মানুষের উপর পা দেয় না।  আমরা নিজেদের সৈন্যদের দেহ সংগ্রহ করতাম – কিন্তু জার্মান সৈন্যদের দেহ সেই ঠান্ডায় জমে যাওয়া অবস্থায় মাঠেই পড়ে থাকত। আমি গাড়ি নিয়ে ঘুরতাম, আমার ছিল গোলাবারুদ বহনের কাজ – আমার গাড়ির চাকার নীচে এসে জার্মান সৈন্যদের মাথার খুলি – হাড়গোড় ভাঙার শব্দ পেতাম – আমার মনে মনে খুব আনন্দ হত”।

    সোয়েতলানা লিখেছেন তিনি অশুভ শক্তি এবং শয়তান দের ভয় করতেন।  সাক্ষাতকার নেবার এবং আরো বেশী গভীরে ঢোকার আগে তিনি আগে বিশ্বাস করেন নি অশুভ শক্তির এত বেশী বিষ্ময়কর প্রকারভেদ থাকতে পারে বলে। কারণ তিনি মনুষ্যত্বে, মানবিকতায় বিশ্বায় রাখতেন।  তিনি ভুল ভাবে ভেবে নিয়েছিলেন যে মানুষকে আরো বেশী দৃঢ় করে বানানো হয়েছে – আদপে সে ততটা দৃঢ় নয়!    

    সোয়েতলানা আলেক্সিভিচ এর লেখা পড়ার পর হতাশা আরো বেড়ে যায় আমাদের দেশের এই সময়ের ততাকথিত ইন্টেলেকচ্যুয়াল (বৌদ্ধিক)-দের কাগুজে আস্ফালন দেখে বা তাদের পুরোপুরী চুপ করে থাকা দেখে।  মানছি আমরা সম্মুখ যুদ্ধে ঢুকি নি এখনো – কিন্তু ভারতে আজকের অবস্থা যুদ্ধকালীন বিপর্যয়ের থেকে খুব একটা কম নয়।  প্রবল হতাশা চলে আসে – আমাদের একটা সোয়েতলানা থাকলে দেখতে পেতাম যে গত কয়েক বছরে ভারত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতন না হলেও খুব একটা কম হাড় হিম করা ঘটনার জন্ম দেয় নি! আর এতো গেল পুরো ভারত দেশের কথা – শুধু যদি আমাদের দেশের  মেয়েদের কথা ধরি, এমন ভাবে চলতে থাকলে খুব তাড়াতাড়ি ঘটনার হীনতায় এবং ভয়ঙ্করতায় আমরা জার্মান-সোভিয়েতকেও ছাড়িয়ে যাব হয়ত!  

    তবে বার্মিংহামের এক বইয়ের দোকান থেকে আগোছলে তুলে নেওয়া এক বই আমাকে প্রথম বুঝতে সাহায্য করে শুধু আমাদের দেশে নয়, সব দেশ এবং সব সময়কালেই এমন হতাশার জন্ম হয়।  এই “ইন্টেলেকচ্যুয়াল রেজিন্টান্স” (বৌদ্ধিক প্রতিরোধ) এর অসারতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠলেই ভিক্টর পেলেভিন নামে এক রাশিয়ান লেখকের কথাগুলি মনে চলে আসে -  

    “বৌদ্ধিক প্রতিরোধ এর কথা মনে শুনলেই আমার মনে পড়ে যায় গ্র্যান ক্যানিরিয়া বেড়াতে গিয়ে গিয়ে শ্যুভেনিয়ার হিসাবে কেনা একটা বড় লাল তোয়ালের কথা যাতে এক বিশাল বড় চে গুভেয়রার ছবি আঁকা আছে।   সেই তোয়ালে গায়ে দিলেই যেন রক্ত গরম হয়ে ওঠে – ১৯৬৮ সালে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়, নিজেকে প্রতিরোধের সাথে একাত্ম মনে হয়।  কিন্তু এই সব সত্ত্বেও সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল এই বিপ্লবাত্মক অনুভূতির পুরোটাই ঝুঁকি বিহীন – অনেকটা দুটো কন্ডোম লাগিয়ে সেক্স করার মত”!  

    আজও যখন এই লেখা পড়ি নিজের মনেই মিলিয়ে নিই চারপাশের বৌদ্ধিক প্রতিরোধ-দের কার্যকলাপ দেখে।  মূল ব্যাপার থেকে অনেক দূরে, নিজের যাতে কিছুমাত্র ক্ষতি না হয় তা পুরোপুরি নিশ্চিত করার পর পদক্ষেপ স্থির করি।  ভিক্টর পেলেভিনের কথা যেন আমার নিজের কথা হয়ে যায় -  

    “আমি বলছি না যে যাঁরা বৌদ্ধিক প্রতিরোধ করেন তাঁরা সবাই অসৎ বা তাঁরা সবাই ভীতু।  সততা এবং সাহসের সাথে আসলে এর তেমন কোন সম্পর্ক নেই – কোন সিনেমা ভালোলেগেছে ‘স্পাইডারম্যান নাকি সুপারম্যান” – এই প্রশ্নের উত্তর কিভাবে এক বৌদ্ধিক সততা এবং সাহসের সাথে দেবে? আসল ব্যাপার হল এই সব ছাড়া অন্য বিষয় নিয়ে বৌদ্ধিকদের বিব্রত হবার উদাহরণ আজকের পৃথিবীতে খুবই কম।  বুদ্ধিবৃত্তি আর বাকি সব কিছু করতে সক্ষম কেবল নিজের পেটের খাবার জোগানো ছাড়া, যতক্ষণ না সেই বুদ্ধিবৃত্তি বিক্রিত হয়ে যাচ্ছে।  আর তাই আধুনিক বৌদ্ধিকদের জন্য পপ-বাস্তবতা-র বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক ততখানিই কঠিন এবং প্রয়োজনীয় যতখনি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী এক ভায়োলিন বাদকের কাছে প্রহরীদের পার্টিতে বাজানো”।

     
    আমি মাত্র কিছুদিন আগে পর্যন্তও জানতাম না সোয়েতলানা আলেক্সিভিচ নামে সোভিয়েত ইউনিয়ানের (এবং আজকের রাশিয়া বা বেলারুশের বাইরে) বাইরে তখনকার প্রায় আপাত অজানা (অন্তত আমার কাছে) যে লেখিকার ডায়েরীর ছিন্ন অংশ গত পনেরো বছরে বারে বারে পড়েছি – আর ভেবেছি এমনও হয় – সেই তিনিই ২০১৫ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পান! তাঁকে নোবেল দেওয়া হয় “বহুবচনীয় লেখার জন্য – যা আমাদের সময়ের দুর্দশার এবং সাহসের কৃতিস্তম্ভ স্বরূপ”।  বাঙলায় যাকে যোগ্য প্রাপক বলে, সাহিত্যে যোগ্য নোবেল প্রাপক তাঁর থেকে আর বেশী কে হতে পারত!   

    ভারতে বৌদ্ধিক প্রতিরোধ নিয়ে আমার খুব একটা মাথাব্যাথা নেই। কিন্তু প্রবলভাবে চাই আমাদের দেশে একজন সোয়েতলানা আলেক্সিভিচ বেড়ে উঠুক যে ক্ষমতার বিজয়গাথা লিখবে না – মানুষের কথা লিখবে তাদের সাথে মিশে গিয়ে।  

    “AUTODAFE – A Manual for Intelluctual Survival”, International Parliament of Writers, published with the help of European Commission and with grants from the French Ministry of Culture and the French Ministry of Foreign Affairs, Aubervilliers, France 2003.


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৩ অক্টোবর ২০২০ | ৩৮৬৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 14.139.***.*** | ০৩ অক্টোবর ২০২০ ১৫:৪২98000
  • দারুণ সুকি। 

  • গবু | 223.223.***.*** | ০৩ অক্টোবর ২০২০ ১৮:৪৭98006
  • ভালো লাগলো সুকি।


    কিরকম যেন মনে হয় ঐরকম সর্বব্যাপী একটা মৃত্যুর উৎসব হলে প্রচুর অকারণ প্রাণ যাবে হয়তো, কিন্তু যারা থাকবে তাদের আবার বাঁচতে ইচ্ছে করবে। হয়তো সেদিন আর খুব দূরে নয়।

  • সুকি | 49.207.***.*** | ০৪ অক্টোবর ২০২০ ০৯:০০98028
  • বি-দা, গবু - এবং আরো যারা পড়লেন তাঁদেরকে ধন্যবাদ। 


    গবু - জানি না কতদূরে আমরা, হতাশা গ্রাস করে। তবে মানুষের বাঁচার ইচ্ছে একদম কাছ থেকে বহুদিন ধরে দেখে আসছি - বেশীর ভাগ মানুষ তো বাঁচতেই চায়! 

  • রঞ্জন | 182.69.***.*** | ০৪ অক্টোবর ২০২০ ০৯:৫৫98035
  • সুকি, 


    সোযেতলানার লেখা বই কোথায় পাওয়া যাবে?


    বিশ্বাস করি, কেউ লিখবে আজকের  গল্প,  মানুষের গল্প,  কেউ  তো লিখবে।

  • বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত | 49.37.***.*** | ০৪ অক্টোবর ২০২০ ১৫:০৯98050
  • স্বেতলানার আমি উনি নোবেল পুরস্কার পাবার জস্ট আগে পড়েছি, এ মানে অবশ্য পাঠ্য। তবে লেখার কারুকার্য কিসু নাই, জার্নালিস্টিক রাইটিং, কিন্তু হৃদয় বিদারক। আমি চেরনোবিল আর আফগানিস্তান টা পড়েছি।


    চমৎকার যথারীতি গুরু দেব সুকি, লব লব লব

  • Ranjan Roy | ০৪ অক্টোবর ২০২০ ২৩:২৯98063
  • ধন্যবাদ সুকি!


    তিনটে, দুটো কিন্ডল, একটা পেপারব্যাক।


    হানু যেমন বলেছে--অবশ্যপাঠ্য। গুরুতে এসে টেকোবুড়োর এগুলিই প্রাপ্তি।

  • বিপ্লব রহমান | ০৭ অক্টোবর ২০২০ ১৭:২৮98164
  • ভালবাসাই সারিয়ে তোলে  যুদ্ধের ক্ষত,  এ-ও এক অনিবার্য সত্য। লেখাটিকে অনেক দিন মনে থাকবে। 

  • r2h | 73.106.***.*** | ০৭ অক্টোবর ২০২০ ২১:৩১98171
  • এই লেখাটা মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে, এইসব পড়ে আবারও মনে হয় এত বিভৎসতার পরেও যুদ্ধ, দাঙ্গা, বীরত্ব নিয়ে মানুষের মোহ কেন কমে না। এসবের ডকুমেন্টেশন তো কম হলো না, যদিও তা যথেষ্ট নয়।

    হুমায়ুন আহমেদের একটা গল্প আছে জলিল সাহেবের পিটিশন - কত মানুষের বিচার পাওয়া হয়নি, আমানবিকতা, বর্বরতার বিচার। আমাদের ইতিহাসে এইসব নির্মমতার উদাহরন অনেক কিন্তু ডকুমেন্টেশন অতি সামান্য, রেকগনিশন আরো কম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভ দেখলে আতংক হয়, কিন্তু ওদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার হল আন্তর্জাতিক আদালতে, যুদ্ধাপরাধের হলো না।

    দ্য গুড লাই বলে একটা সিনেমা কাল দ্বিতীয়বার দেখলাম, ভাবছিলাম বাঙলার মানুষের কত উচ্ছেদ নির্বাসন উদ্বাস্তু হওয়ার ইতিহাস, কত মানুষ তবু হারিয়েই গেল, পৃথিবীর কেউ জানলও না।

    মানুষকে মানুষ হিসেবে না দেখে বীর হিসেবে বা শত্রু হিসেবে দেখা, এর থেকে বেরুনোর জন্যে আরো কত এরকম লেখার দরকার কে জানে।

    "প্রবলভাবে চাই আমাদের দেশে একজন সোয়েতলানা আলেক্সিভিচ বেড়ে উঠুক যে ক্ষমতার বিজয়গাথা লিখবে না – মানুষের কথা লিখবে তাদের সাথে মিশে গিয়ে" - সত্যি।

  • রৌহিন | ১০ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৩২98233
  • এই লেখাটা পড়তে পড়তে যেটা ভাবছিলাম, সেটাই সুকি শেষে এসে লিখেছ দেখলাম - ভারতে যা চলছে তা যদি এখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নৃশংসতার তুল্যমূল্য না হয়ে থাকে তবে সে দিন বেশী দূরেও নেই। এবং সত্যিই আমরা সবাই নিরাপদ দূরত্বে থেকে কর্তব্যকর্ম নিয়ে আলোচনা টনা করতে পছন্দ করি।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন