নবমী চলে আসা মানেই যেন বিসর্জনের সুর বেজে ওঠা—অন্তত এমনটাই আমরা মনে করতাম। নবমীর দিনের পুজোর প্রধান আকর্ষণ ছিল বলি এবং হোম-যজ্ঞ। আগের দিনেই মনে হয় বলেছি আমার বাড়ির মা দুর্গা নিরামিষাশী। অর্থাৎ বাড়িতে ওই দিন পাঁঠাবলি হত না। তার বদলে কী বলি হত? আখ, শসা ও ছাঁচিকুমড়ো।
তবে এর মধ্যেও অনেক ব্যাপার আছে। আখ যেমন তেমন হলে হবে না, আখের শিকড় সুদ্ধ জোগাড় করতে হবে, অনুরূপ ভাবে শসার সাথে তার বোঁটা থাকতে হবে এবং ছাঁচিকুমড়োরও তাই। বোঁটা সুদ্ধ শসা এবং ছাঁচিকুমড়ো না হয় জোগাড় হয়ে যেত সহজেই। আমাদের অনেকের বাড়িতেই এগুলো পাওয়া যেত। কিন্তু শিকড় সুদ্ধ আখ? আমাদের ওদিকে আখ চাষ হত না—ফলে বিশেষ ভাবে বাড়িতে লাগানো হত পুজোর জন্য আখ বা আগে থাকতে অন্য জায়গায় বলে রাখতে হত।
বলি দেবার পর আখ, শসা এবং ছাঁচিকুমড়ো সব পুকুরের জলে বিসর্জন দিতে হত। কিন্তু আমরা ছেলেছোকরার দল তক্কে তক্কে থাকতাম ওই আখের গোছাগুলি জলে পড়ার অপেক্ষায়! জল থেকে তুলে দাঁতে করে আখ ছাড়িয়ে খাও! একবার জলে পড়ে গেলে সেই আখ নাকি খাওয়া যায়। জলে একবার না দিলে পাপ ইত্যাদি হতে পারে সেই নিয়ে আমার কোনোদিন মাথা ব্যথা ছিল না—তবে মাথা ব্যথা ছিল সেই আখের গায়ে লেগে থাকা তেল-সিঁদুর নিয়ে। যাঁরা এই তেল-সিঁদুর নিয়ে ডিল করেছেন তাঁরা জানেন যে, এ জিনিস একবার জামাকাপড়ে লেগে গেলে তাকে তোলা বড়োই কঠিন! আখ খেতে গিয়ে পুজোর নতুন জামা নষ্ট হলেই তো গ্যাছে আর কি! পাঁঠাবলি যেমন একটা প্রতীকী ব্যাপার (ওই যে সব রিপুর বিসর্জন নাকি বলে না), আমি নিশ্চিত তেমনি এই আখ, শসা এবং ছাঁচিকুমড়ো বলি কিছু একটা প্রতীকী ব্যাপার। কিন্তু কীসের প্রতীক সেই নিয়ে খুব একটা ভাবনা চিন্তা করিনি ছোটোবেলায়।
আগেই বলেছি পুরোহিত, ঠাকুর মিস্ত্রি, ঢাকি এদের মতো বলি দেবার কামারও আমাদের পারিবারিক সূত্রে চলে আসছে। কিন্তু কয়েক মাস আগে বাড়ি থেকে একটা খারাপ খবর শুনলাম—আমাদের কামার জি টি রোডের পাশ দিয়ে হাঁটছিল, আর একটা মাতাল বাইক এসে তাকে পিষে দিয়েছে। কামার প্রথম ধাক্কাতেই মরেছে, আর কামারকে ধাক্কা দেবার পর সেই ছেলে সামনের ইলেকট্রিক পোলে গিয়ে ধাক্কা মেরেছে, এবং নিজেও চেপটে গেছে। দুজনাই ঘটনাস্থলে মৃত! আমার জ্ঞানত এই বার বাড়ি গিয়ে নবমীর বলির দিন অন্য কামার (তার ছেলে) দেখব! আমার জন্ম থেকেই একেই দেখে আসছিলাম।
পাঁঠার বদলে শসা বলি হলেও, সেই শসার জন্য তো আর আলাদা করে খাঁড়া কেউ বানাত না! ফলে পাঁঠা কাটার খাঁড়া দিয়েই শসা বলি—মশা মারতে কামান দাগার মতো! কামারের কাজ খুব সিম্পল ছিল—চোখ-টোখ লাল করে একটু হালকা টলতে টলতে নাকি কে জানে, সাইকেল নিয়ে হাজির হত। সে মদ খেয়ে এসেছে কি খায়নি, তা এক বড়ো গবেষণার ব্যাপার। তবে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না। এই কামার এসে সামনের পুকুরে ডুব দিয়ে আমাদের দেওয়া নতুন কাপড়টা পরে আর হাতের খাঁড়াটা ধুয়ে নিয়ে এসে মা-দুর্গার সামনে বামুন ঠাকুরের পাশে রাখত। বামুন দাদু নানাবিধ মন্ত্র বলে সেই খাঁড়াকে পুজো করে দিত এবং তারপর উঠে এসে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা কামারের মাথায় মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে দিত। ব্যস এবার রেডি বলির জন্য।
এইখানে এবার একটু হালকা টেনশনের ব্যাপার আছে—উঠোনের মাঝে মাটির বেদী করে বলি দেওয়া হত। সে ঠিক আছে—কিন্তু নিয়ম নাকি আছে বলি হবার সময় সেই শসা, আখ এদের একা একা ছাড়া যাবে না। অর্থাৎ বাড়ির দুজনকে দু-দিকে ছুঁয়ে থাকতে হবে। এবার ভাবুন একজন চোখ লাল করে, যে মদ খেয়ে এসেছে কি খায়নি সেটা আলোচনার বিষয়, সেই লোক চকচকে খাঁড়া নিয়ে বলি দেবে আর আপনি শসার বোঁটার দিকটা ধরে আছেন! শসার আর দৈর্ঘ্য কত হবে! একটু এদিক ওদিকে হলেই আপনার কবজি বা নিদেনপক্ষে আঙুলগুলি বলি হয়ে যাবে! এই জন্য আমরা শসা আনতে গিয়ে সবচেয়ে লম্বা চওড়া শসা খুঁজতাম, নিজেদের হাত বাঁচাবার জন্য।
চারিদিকে ‘মা’ ‘মা’ আওয়াজ উঠছে এবং তার মাঝেই ঢাকের তালে তালে বলি হয়ে গেল। বেশ রোমাঞ্চকর ব্যাপার—আপনি খুব বেশি ঠাকুরভক্ত হলে আপ্লুত হয়ে যেতেই পারেন সেই সব দেখে। এবার বলি হয়ে গেলে নাকি এবার খেতে হবে সেই খাঁড়া ধোওয়া জল! কেন বলতে পারব না। একজন গিয়ে একটা কাঁসার পাত্র নিয়ে এলে তাতে খাঁড়া ধোওয়া হয় এবং সেই প্রসাদ-জল খাবার জন্য হুড়োহুড়ি!
বলি ইত্যাদি হয়ে গেলে আমাদের ছেলেছোকরাদের ভার থাকত কিছু কিছু জায়গায় মালসায় করে পুজো দিতে যাওয়া। আশে পাশে দু-তিনটে গ্রামের ঠাকুরতলায় আমরা গিয়ে সেই মালসা দিয়ে আসতাম। খুব ছোটোবেলায় সাইকেলে করে যেতাম—অনেক সময় লাগত, পরে বাইক চালু হলে খুব কম সময়ে সেইসব মালসা আমরা যথাস্থানে পৌঁছে দিতে পারতাম।
এইসব মিটে গেলে এবার চলে আসে হোম-যজ্ঞের ব্যাপারটা। আগের দিন যেমন বলেছি অমৃতার বাড়িতে অষ্টমীর দিন ধুনো পোড়ানো বলে মানসিক করার কাজটা হত, সেটা আমাদের বাড়িতে হত নবমীর দিন। যারা কিছু মানত করেছিল, তারা মা দুর্গার সামনে বসে মাথায় এবং দুই হাতে মালসা নিয়ে ধুনো পোড়ায়। আগুন জ্বলে এবং তাতে ধুনো ইত্যাদি দিয়ে মিনিট পনেরোর ব্যাপার। অনেকেই ধুনো পোড়াত। ধুনো ইত্যাদি পোড়ানো হয়ে গেলে এবার হোমের পালা।
নবমীর হোমে আমাদের বাড়িতে যে হরেকরকমের কাঠ লাগত—তার অনেককেই আজকাল চট করে দেখতে পাওয়াই যায় না। অশোক, পলাশ, যজ্ঞডুমুর ইত্যাদি ইত্যাদি। অন্য গাছের ডাল এদিক ওদিকে থেকে কালেক্ট করে ফেললেও, যজ্ঞডুমুর গাছের ডাল কালেক্ট করা বেশ চাপের ছিল। পুজোর প্রথম দিনের গল্পে এই নিয়ে লিখেছি, তাই আর পুনরাবৃত্তি করছি না।
হোমের টিকা নেওয়া ইত্যাদিতে কিছু সমস্যা ছিল না—কিন্তু হোমের আগুনে পোড়ানো কলা ঘি দিয়ে মেখে সে যে প্রসাদ হত তা খাওয়া বেশ চাপের ছিল। ফলত খুব ছোটোবেলার পরে আর সেই জিনিস কোনোদিন খাইনি।
হোম হয়ে গেলে মূল দুর্গা পুজোর আর তেমন কিছু পড়ে রইল না। ওই দিন বিকেলে আমাদের বামুন ঠাকুর একটু রিল্যাক্স করতে বেরুত, মাঝে মাঝে মেমারি বা বর্ধমানে ঠাকুর দেখতে চলে যেত। সন্ধ্যাবেলায় আমরা ছেলেছোকরার দল গুলতানিতে ব্যস্ত থাকতাম। যতদিন বাড়িতে বাজি তৈরি করেছি ততদিন সেই বাজির ফিনিশিং টাচ দিয়ে। আর তারপর বাজি কিনতে শুরু করার পর—সন্ধেবেলা বাড়ির লোকেদের কাছ থেকে সেই মর্মে ভলেন্টারি এবং জোরজবরদস্তির মাঝামাঝি অবস্থানে থেকে চাঁদা তোলা।
চাঁদা তোলা এক সময় শেষ হত—এই দিন আর তেমন কারও তাড়াতাড়ি করার আগ্রহ থাকত না সন্ধ্যারতি। বামুন দাদু বাইরে থেকে ঠাকুর দেখে ফিরে এলে আরতি উঠত—এদিন অনেকক্ষণ ধরে আরতি হত। আমাদের অনেকের চোখের কোল চিকচিক করে উঠত কারণ রাত পোহালেই দশমী!