“দরকার হলে এক দেশ আবার পুনর্জন্ম নিতে পারে, কিন্তু দেশের সংস্কৃতি একবার ধ্বংস হয়ে গেলে তাকে পুনরায় উদ্ধার করা অসম্ভব”!
তখনকার দিনের এক খুব প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ টি ভি সুং পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন এই কথা।
১৯৩৩ সালের প্রথম দিক - শুরু হয়ে গেছে দ্বিতীয় সিনো-জাপানীজ যুদ্ধ। চীনের পূর্বদিক তখন পুরো ত্রাসে কাঁপছে জাপানী আক্রমণের ভয়ে। দেশকে কিভাবে সুরক্ষা প্রদান করা যায় বা জাপানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নিয়ে চিন্তা ভাবনা তো সামরিক বিভাগের লোকজন করছেই – কিছু কিছু চিন্তাশীল ব্যক্তি এও চিন্তা শুরু করে দিলেন যে যদি জাপানীদের হাতে চীনের পরাজয় হয়ই – তাহলে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সম্পদ কিভাবে রক্ষা করা যাবে।! আর তখন চীন দেশে সব থেকে বেশী অমূল্য সম্পদ রাখা ছিল পুরানো দিনের ফরবিডেন সিটি বা আজকের সময়ের ‘প্যালেস মিউজিয়াম’-এ। তো সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ২০,০০০ ক্রেট (বড় বাক্স) ভরা দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী চীনের অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা হবে প্যালেস মিউজিয়াম থেকে।
তখনকার কিছু চাইনীজ আঁতেল বলল, চীন সরকার নিজেদের জনতা-কে রক্ষা করার দিকে মন দিক – প্রাচীন সামগ্রী রক্ষার পিছনে সময় এবং অর্থ ব্যায় করার কোন মানে হয় না! অন্য কেউ কেউ ভাবলো সরকার আসলে ভয় দেখাচ্ছে ফালতু জাপানীদের নাম করে – প্যালেস মিউজিয়াম খালি করার মূল প্ল্যান হল অন্য জায়গায় রাজধানী সরিয়ে বেজিং শহরকে পরিত্যাগ করার। কিন্তু চীনের সরকার এই সব ফালতু সমালোচনায় দমল না – নিজেদের প্ল্যান অনুযায়ী কাজ চালাতে লাগলো।
এই ফাঁকে প্যালেজ মিউজিয়ামের ইতিহাস হালকা করে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। আজকের সময়ের ‘প্যালেস মিউজিয়াম’ হচ্ছে চীনের অন্যতম সেরা স্থাপত্য বিদ্যার নিদর্শন। ১৪০৬ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৪২০ সালে এই প্রাসাদ বানানো শেষ হয় এবং কথিত আছে প্রায় ১০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করেছিল এটা বানানো কালে। গোটা কমপ্লেক্স প্রায় ১৮০ একর জায়গা জুড়ে এবং এখানে আছে ছোট বড় মিলিয়ে ৯৮০ টা বিল্ডিং। এবং সেই থেকে এই প্রাসাদে প্রায় ৫০০ বছর ধরে ২৪ জন সম্রাট রাজত্ব চালিয়েছেন। ১৯১২ সালের আগে এই ফরবিডেন সিটিতে রাজপরিবার এবং তাদের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা ছাড়া সাধারণ লোকের এখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। রাজনৈতিক পালাবদল এবং বিপ্লবের পর পর এটাকে সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৯৮৭ সাল থেকে এটা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট – আজকাল বছরে এখানে গড়ে প্রায় ১.৪ কটি লোক ঘুরতে আসে, ২০১৯ সালে এসেছিল প্রায় ১.৯ কোটি পর্যটক!
এক হংউ সম্রাটের ছেলে জু ডি নিজে সম্রাট হয়ে বসার পর দেশের রাজধানী তৎকালীন নানজিং থেকে সরিয়ে বেজিং এ আনেন এবং এই প্রাসাদ বানাতে শুরু করেন। ১৪২০ থেকে ১৬৪৪ সাল পর্যন্ত এই প্রাসাদে থেকে রাজত্ব করেছিল মিং সাম্রাজ্যের সম্রাটরা। তারপরে ১৬৪৪ সাল থেকে এই হালের ১৯১২ সাল পর্যন্ত চলেছিল কুইং সম্রাটদের রাজত্ব। হিসেব করলে দেখা যাবে ফরবিডেন সিটিতে বসে রাজত্ব চালানো ২৪ জন সম্রাটের মধ্যে ১৪ ছিলেন মিং বংশের এবং ১০ জন ছিলেন কুইং বংশের। তবে আজকে ফরবিডেন সিটির বা সেখানকার সম্রাটদের নিয়ে গল্প নয়, সেটা অন্য দিনের জন্য তোলা থাক। এই পর্বে একটু ছুঁয়ে নিই রাজপ্রাসাদ থেকে ফরবিডেন সিটির জাতীয় মিউজিয়াম হয়ে ওঠার ইতিহাস – কারণ আজকের মূল গল্পের গোড়াপত্তন সেখানেই।
১৯১২ সালে রাজনৈতিক পালাবদলে চীনের সম্রাট ক্ষমতা হারালেন – ভিতরের দিকে ঘরে তাঁকে পাঠিয়ে বাইরের প্রাঙ্গণ খুলে দেওয়া হল সাধারণের জন্য। এবং শেষ সম্রাটকে ১৯২৪ সালের ৫ই নম্ভেম্বর সেই প্রাসাদ থেকে, যেখানে সম্রাটেরা বসবাস করে আসছিলেন বিগত ৫০০ বছর ধরে, পুরোপুরি সেখান থেকেই উচ্ছেদ করে দেওয়া হল – ভাগো হিঁয়াসে বলে। এই ভাবে উচ্ছদের কারণটা কি? ১৯১২ সাল থেকে বেশ তো ছিল ভিতরের দিকে ঘরেতে। কিন্তু মানুষের লোভ যাবে কোথায়? তখন নতুন চায়না রিপাবলিকের সরকার গঠিত হয়েছে – দেশের মর্যাদা এবং সম্পদ রক্ষার্থে যাঁদের তীক্ষ্ম নজর। তাঁরা টের পেলেন যে এই সম্রাট প্রাসাদের ভিতর থেকে নিজের সাগরেদ-দের সাহায্যে বহুমূল্য প্রাচীন দুষ্পাপ্র্য সব সম্পদ বাইরে পাচার করছে! ব্যাস – আর যায় কোথায়!
সম্রাটকে তো ভাগানো হল প্যালেস থেকে – তাহলে এবার হবে কি সেই জায়গাটার? চীনের তৎকালীন সরকারের মাথায় এল প্যারিসের ল্যুভ বা ইউরোপের আরো নানা প্রাসাদের কথা যেখানে আগেকার দিনের সম্রাটদের থাকার জায়গাগুলিকে মিউজিয়ামে পরিণত করা হয়েছিল। যা ভাবা তাই কাজ, ফরবিডেন সিটিকে বানানো হল মিউজিয়াম যা পরিচিত হল প্যালেস মিউজিয়ামে। ১৯২৫ সালে সর্বপ্রথম নথি বদ্ধ করা হল সেই প্যালেস মিউজিয়ামে কি কি আছে – সেই সময়ের হিসেব মত বেজিং প্যালেস মিউজিয়ামে ছিল প্রায় ১২ লক্ষ দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী - বই থেকে শুরু করে ক্যালিগ্রাফী, পোর্সেলিন, পেন্টিং ইত্যাদি। সব কিছু নথিবদ্ধ করার পর, ১৯২৫ সালের ১০ই অক্টোবর রিপাবলিক অফ চায়নার চতুর্দশ বার্ষীকিতে সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হল প্যালেস মিউজিয়াম।
সময় এগিয়ে যায় নিজের মত। ১৯৩৩ সালের প্রথম দিক - শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় সিনো-জাপানীজ যুদ্ধ। ক্রমে জাপান দখল করে নিল মাঞ্চুরিয়া এবং চীনের উত্তরদিকেও অগ্রসর হতে লাগলো। এই সব দেখে তখনকার প্যালেস মিউজিয়ামের ডাইরেক্টরেরা খুবই চিন্তিত হয়ে উঠলেন এবং যে করেই হোক জাপানী আক্রমণের হাত থেকে, যুদ্ধের বিভিষীকা থেকে শত শত বছরের চীন দেশের প্রাচীন এবং দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী বাঁচাতে তৎপর হয়ে উঠলেন।
তো আগেই যেমন লিখেছি, সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে ২০,০০০ ক্রেট (বড় বাক্স) ভরা দুষ্প্রাপ্য চীনের অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত করা হবে প্যালেস মিউজিয়াম থেকে। এমন নয় যে এই ২০,০০০ ক্রেট নিয়ে গিয়ে আর জায়গায় রেখে দেওয়া হয়েছিল যুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত! বরং উল্টোটাই – ক্রমাগত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেই ঐতিহাসিক সম্পদ। ১৯৩৭ সাল নাগাদ যুদ্ধের প্রকোপ আরো বেড়ে গেলে তখনকার ডাইরেক্টররা নির্দেশ দেন দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের নানা জায়গায় সেই সম্পদ লুকিয়ে রাখতে। এ তো গেল জাপানের ভয়ে জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা, ১৯৪৫ সালে জাপানের পরাজয়ের পরেও কিন্তু টেনশন কমল না – চীনের অভ্যন্তরীন ব্যাপার খুবই জটিল হয়ে উঠেছিল এমনকি গৃহযুদ্ধও। তাই সে সবের থেকেও মিউজিয়ামের সম্পদ বাঁচাতে তখনকার প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাই-শেক নির্দেশ দিলেন প্রায় ৩০০০ ক্রেট জিনিস তাইওয়ানে পাঠাতে – এবং ক্রমে ১৯৬৫ সালে তাইওয়ানেই তিনিই গড়ে তোলেন ন্যাশানাল প্যালেস মিউজিয়াম যা এখনও দর্শকদের বিষ্মিত করে চলেছে। তাওয়ানের ন্যাশানাল প্যালেস মিউজিয়াম নিয়ে পরে লিখছি, তবে সুবিধার্থে সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক যে পুরানো দিনের বেজিং শহরের ‘প্যালেস মিউজিয়ামের’ প্রাচীন সম্পদ আজকের দিনে তিন শহরে ছড়িয়ে আছে মূলত – কিছু আছে বেজিং প্যালেসেই, কিন্তু আছে নানজিং শহরে, আর বাকি তাইপে শহরের প্যালেস মিউজিয়ামে।
বেজিং এর প্যালেস মিউজিয়ামের এখনকার হিসেবটা একটু দেখে নেওয়া যাক – এখন সেখানে সংগ্রহের পরিমাণ ১৮ লক্ষ! এর মধ্যে আছে প্রায় ৫৪ হাজার পেন্টিং, ৭৫ হাজার ক্যালিগ্রাফি, ১ লক্ষ ৬০ হাজার তামার সামগ্রী, প্রায় ৬ লক্ষ প্রাচীন পুঁথি ও দস্তাবেজ, ৪ লক্ষ পোর্সেলিনের সামগ্রী, ১১ হাজার স্কাল্পচার (এর মধ্যে কিছু কিছু তো খ্রীষ্ট পূর্ব ৪০০ বছর আগেকার)। এই মুহুর্তে তাইওয়ানের তাইপে শহরের ন্যাশানাল মিউজিয়ামে আছে প্রায় ৭ লক্ষ শিল্পকর্ম, বই, পুঁথি, ঐতিহাসিক দস্তাবেজ ইত্যাদি। আমি ভাগ্যবান যে এই দুই মিউজিয়ামই দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেই হিসাবে পৃথিবীর প্রথম দশটা মিউজিয়ামের (পর্যটকের দিক থেকে দেখতে গেলে) প্রায় সবকটাই দেখা হয়ে গেছে – প্যারিসের ল্যুভে থেকে শুরু করে নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অফ আর্ট আর আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাশানাল হিষ্ট্রি, ভ্যাটিকান মিউজিয়াম, লন্ডনের চারটে (বৃটিশ মিউজিয়াম, ন্যাশানাল গ্যালারী, ন্যাচারাল হিষ্ট্রী মিউজিয়াম, টাতে মিউজিয়াম) ইত্যাদি। কেবল সেন্ট পিটসবার্গের স্টেট হার্মিটেজ মিউজিয়ামটা দেখা হয় নি এখনো – হয়ে যাবে সামনে কোনদিন।
কিন্তু প্রাচীন কোন জিনিস যা শত শত বছর ধরে এক জায়গায় আছে তাকে দুম করে রাতারাতি অন্য জায়গায় সরিয়ে ফেলব বললে বাকি সবাই চুপচাপ বসে থাকবে এমন তো আর হয় না! আর সেটাই হয়েছিল প্রথম যখন বেজিং এর প্যালেস মিউজিয়াম থেকে ২০০০০ হাজার ক্রেট প্রত্ন সামগ্রী সরানোর কথা উঠল। আজকালকার চীনে ভিতরের মহল থেকে এমন খবর সাধারণত লিক হয় না, কিন্তু কি ভাবে যেন ১৯৩৩ সালে হয়ে গিয়েছিল। ব্যাস আর যায় কোথায়! পাবলিক হই হই করে উঠলো – কেউ বলল পিকেটিং হবে সরাতে না দেবার জন্য, কেউ প্ল্যান করল রাস্তায় ছিনতাই করে নেবার জন্য।
আবার ওদিকে সরকারের কাছে ইন্টেলিজেন্স ছিল কিভাবে জাপান আক্রমণ করতে পারে, কোন দিক থেকে ইত্যাদি – যা সাধারণ মানুষ জানত না। চাইনীজ ইন্টিলিজন্স কিভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল এই সামগ্রীগুলি বাঁচাতে সেটা নিয়ে খানিক পরে আসছি। তো সরকার নিজেদের সিদ্ধান্তে পিছু না হটে প্যালেস মিউজিয়াম থেকে জিনিস সরিয়ে নিয়ে যাবার তোড়জোড় শুরু করল।
প্যাকিং এর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল – প্যালেস মিউজিয়ামের স্টাফেরা ইয়ানশি প্যালেসে সব সামগ্রী জমা করে এবং নানাবিধ জিনিস দিয়ে (ব্যবহার করা হয়েছিল তুলো, খড়, কাপড় ইত্যাদি) মুড়িয়ে কাঠের ক্রেটে রাখল। খুব নিঁখুত ভাবে ডকুমেন্টেড কর হল সব প্যাকিং – ডুপ্লিকেট কপি বানানো হল লিষ্টের – এক কপি সেই কাঠের ক্রেটের ভিতর রেখে আর এক কপি ইন্সপেকশন এর লগ লিষ্টি করার কাজে ব্যবহৃত হল। কি কি জিনিস প্যাকিং করা হল তার বিশদে আর যাব না – মোটামুটি ভাবে যা কিছু কাঠের ক্রেটে ভরে স্থানান্তর করা যায়, সব প্যাক করে নেওয়া হল – এমকি সেই বিখ্যাত ‘ড্রাগন সিংহাসন’-ও।
সব কিছু প্যাকিং হয়ে যাবার পরে এবার অপেক্ষা – ঠিক কবে স্থানান্তর প্রক্রিয়া চালু করা হবে সেই নিয়ে নির্দেশ আসার জন্য মিউজিয়ামের স্টাফেরা অপেক্ষা করতে লাগলো। অবশেষে ৪ ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৩ সালে নির্দেশ এল পরিবহন চালু করার। সকাল বেলা গোটা বারো চোদ্দ মোটর গাড়ী এবং ৩০০ মত রিক্স ঢুকলো ফরবিডেন সিটিতে। ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল চরম – সবাইকে ব্যাজ দেওয়া, গাড়িতে স্পেশাল নাম্বারিং করা – এই করতে করতে রাত হয়ে গেল। রাত আটটার সময় তিয়েনমেন স্কোয়ারের সামনের রাস্তা, যেটা সেখান থেকে জেনগ্যায়াংমেন ট্রেন স্টেশনের দিকে গেছে সেখানে কার্ফু-র মত জারি করে দেওয়া হল। একমাত্র পারমিশন নিয়ে এবং স্পেশাল ব্যাজের লোকেরাই এই এলাকায় ঢুকতে পারত সেই রাতের বেলা। রাত নটার সময় সারি দিয়ে গাড়ি গুলি প্যালেস মিউজিয়াম থেকে রওয়ানা দিল স্টেশনের উদ্দেশ্যে, সেই গাড়ির সাথে যোগ দিল আশে পাশের একজিবিশন হল থেকে বোঝাই গাড়িগুলিও। ট্রেন স্টেশনে গিয়ে সব কাঠের ক্রেট বোঝাই হল ২১টা ট্রেনের বগিতে।
গাড়ির সাথে কড়া মিলিটারি পাহারা ছিল যেমন, তেমনি ট্রেনের ছাদে মেশিন গান নিয়ে সৈন্য বসিয়ে ট্রেন পাড়ি দিল দক্ষিণ দিকে। ছিনতাইয়ের এর থেকে বড় সুযোগ আর আগে আসে নি মানুষের ইতিহাসে – হাজার জাহার বছরের অমূল্য সম্পদ এক সাথে ট্রেনের বগিতে! ভাবা যায়! বেজিং থেকে ট্রেন/গাড়ি রওয়ানা দিল নানজিং এর উদ্দেশ্যে। সুরক্ষার জন্য এই ট্রেনটি কিন্তু নানজিং যাবার সরাসরি রাস্তায় গেল না – বরং এদিক ওদিকে দিয়ে ঘুরিয়ে ট্রেনটি যেতে লাগলো যাতে করে আগে থেকে পরিকল্পিত কেউ আক্রমণ করতে না পারে। শোনা যায় একজায়গায় নাকি প্রায় ১০০০ মতন লুটেরা অপেক্ষা করছিল – কিন্তু তারা রণে ভঙ্গ দেয় এটা জানতে পেরে যে ট্রেন/ট্রাক আসছে মেশিন গান সহ সৈন্যদের সুরক্ষার সাথে সাথে। ভাগ্য সাথ দিল – হাজার হাজার ক্রেট সামগ্রী পৌঁছে গেল সাংহাই শহর থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরের নানজিং শহরে অক্ষত অবস্থায় – দিনটা ১০ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৩৩।
নানজিং শহরে পোঁছাবার পরে এই সব সামগ্রী স্থানান্তরিত করা হল সাংহাই শহরে সেখানে ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের মধ্যে এক ক্যাথলিক চার্চে লুকিয়ে রাখার জন্য। পরে অবশ্য চীনা সরকার নানজিং শহরে একটা আধুনিক মিউজিয়াম গড়ে তোলেন – এখনো গেলে সেটা দেখতে পাবেন। আর বেজিং প্যালেস মিউজিয়ামের অনেক সামগ্রী এখানে এখনো রাখা আছে যেমনটা আগে লিখেছি।
জাপানীদের সাথে যাঁরা পরিচিত তাঁরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন যে জাপানীরা হাল ছেড়ে দেবার জাত নয় – সেই একই ফিলোসফি তারা পালন করে চলে অন্যদেশ আক্রমণ করলেও। তাই চীন দেশের রেহাই অত সহজে এল না – এসপার-ওসপার করার জন্য একদম পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল ১৯৩৭ সাল নাগাদ। আবার মালপত্র সরাতে উদ্দোগী হল চীনা সরকার জাপানী বোমার ভয় থেকে – এবার আরো দক্ষিণ পশ্চিমে সরে যাওয়া হল গুইজু এবং সিচূয়ান প্রদেশের দিকে। আলোচনা করে ঠিক করা হল যে এবার আর সবকিছু একসাথে নয়, বরং তিন ভাগে ভাগ করে পাঠানো হবে দেশের আরো ভিতরের দিকে – হুনান প্রদেশের চাংশার মধ্যভাগে; আরেক ভাগ জাংটজে নদীর দিয়ে হানকু আর আরেক ভাগ উত্তর পশ্চিমের সিয়ান-এ। চাংশায় যেটা পাঠানো হয়েছিল সেটা সর্বপ্রথম সুরক্ষিত জায়গায় রাখার পরিকল্পনা হল – প্রথমে এদের তোলা হল হুনান ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরীতে অস্থায়ী ভাবে। হুনান চিকেন খেয়েছেন তো কলকাতার চাইনীজ রেষ্টুরান্টে? এটা সেই হুনান – পার্থক্য কেবল একটাই হুনানে অমন চাইনীজ খাবার কেউ খায় না!
কিন্তু একটা স্থায়ী জায়গা খুঁজতে হবে তো – তাই পাত্তা করতে বেরোলেন তখনকার প্যালেস মিউজিয়ামের ডাইরেক্টর মা হেং। অনেক খুঁজে তিনি ইউলু পাহাড়ের গায়ে একটা জায়গা পছন্দ করলেন – তাঁর ইচ্ছে ছিল যে এই পাহাড়ের গা খুঁড়েই এখানে একটা ভল্ট টাইপের বানাবেন যেখানে সব সামগ্রী স্থায়ী ভাবে রাখতে পারবেন। কিন্তু তাঁর ইচ্ছেয় বাধ সাধল জাপানের আকাশ পথের বিমান আক্রমণ – পাহাড়ের গায়ে খোঁড়া খুঁড়ি মাথায় উঠল, চাংশা শহর প্রায় ধ্বংস হয়ে গেল সাথে হুনান লাইব্রেরী। তবে বিমান আক্রমণের আগেই সব সম্পদ সরিয়ে ফেলা গিয়েছিল লাইব্রেরী থেকে, তাই সম্পদ গুলি অক্ষত থেকে গিয়েছিল।
ওদিকে দ্বিতীয় শিপমেন্ট গিয়েছিল হানকু এর দিকে – এই ব্যাচে ছিল সব থেকে বেশী ক্রেট, প্রায় ৯৩০০টি। এত সব সম্পদ নিয়ে দুই খানি জাহাজ নদী দিয়ে রওয়ানা দিল নানজিং থেকে – কিন্তু এই যাত্রার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সাংহাই আর নানজিং দুই শহরেরই পতন হল জাপানীদের হাতে। সেই খবর শুনে চীন সরকার জাহাজ দুটিকে দিক ঘুরিয়ে হানকু না গিয়ে আরো দক্ষিণ পশ্চিমের চংকিং শহরে যেতে বলল – কিন্তু ওদিকে জাপানীরাও এগিয়ে আসছে। কিছুদিন এই খানে থাকার পরেই জাপানীরা প্রায় একেবারে ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলার জন্য আবার মালপত্র সরাবার ব্যবস্থা করতে হল। খুব অল্প সময়ের মধ্যে কাঠের নৌকা কেবল যোগাড় করা গেল – সেই নৌকা করে লেশান শহরের উদ্দেশ্যে অনেক খেপ দিতে হল নৌকা গুলিকে। লেশান শহরেও জাপানীরা বোমা ফেলা শুরু করল – তখন নৌকাগুলি তাদের ১০ম খেপ দিয়েছে – খুব অল্পের জন্য বেঁচে গেল – বোমার আঘাতে শহর পুরো জর্জরিত – আরে খানিক আগে নৌকা গুলি এলে, সেই সব সম্পদও চিরকালের জন্য ছাড়খাড় হয়ে যেত বোমার আঘাতে! একেই মনে হয় বলে রাখে হরি মারে কে!
এই দুই রাস্তায় ক্রেট গুলি পাঠাবার কথা শুনেই যদি আপনার অবাক লাগে, তাহলে শেষ বা তিন নম্বর ব্যাচ যেটা শিয়ান শহরের দিকে পাঠানো হয়েছিল তার কথা জানলে কি বলবেন! এই ব্যাচে নানজিং থেকে পাঠানো হয়েছিল প্রায় ৭০০০ ক্রেট ট্রেনে করে, এর মাত্র পাঁচ দিন পরেই নানজিং শহর জাপানীদের আক্রমণে ধ্যুলিস্যাৎ হয়ে যায়। এখানেই আর পাঁচ দিন দেরী করলে কালের গর্ভে হারিতে যেত ওই ৭০০০ ক্রেট ঐতিহাসিক সম্পদ। জেংজু শহরের বোমার আঘাত থেকে কান ঘেঁষে বেঁচে সেই ট্রেন পৌঁছালো শিয়ান এবং সেখান থেকে একটু ভিতরের দিকে বাওজি নামক জায়গায় – মানে যতদূর ট্রেন ট্র্যাক বেছানো ছিল আর কি। সেখানে ট্রেন থেকে ক্রেট গুলো নামিয়ে ট্রাকে তুলে পাঠানো হল হানজোং শহরের কুন পার্বত্য এলাকায়। পাহাড়ের উঁচু নীচুতে যেখানে ঠিক ঠাক রাস্তা নেই – আবার কাদায় পিচ্ছিল – সেখানে গাড়ি চালানো বিশাল চাপের ছিল। কিন্তু এখানেও চাপের থেকে মুক্তি নেই – জাপান বাওজি শহরেও বোমা ফেলতে এল – চীন সরকার ক্রেট গুলো সরিয়ে নিয়ে গেলেন সিনচ্যুয়ান নামক জায়গায় – ঘুরে ফিরে প্রায় দ্বিতীয় ব্যাচের কাছাকাছি চলে এল ক্রেট গুলো। এখানে বোমার হাত থেকে কিছু দিনের জন্য চিন্তা মুক্ত হলেও যেভাবে ক্রেট গুলো গুদাম বা অনুরূপ জায়গায় রাখা হয়েছিল তাতে তারা আগুনের হাত থেকে সুরক্ষিত ছিল না একদম। কাছাকাছি একটা আফিমের গুদামে আগুন লাগলে খুব বাঁচা বেঁচে যায় এই ক্রেট গুলো।
এই ভাবে কার্যত ক্যাট অ্যান্ড মাউস গেল চলতে থাকল চীন এবং জাপানের মধ্যে। ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সালে জাপানের পতনের আগে পর্যন্ত কার্যত ওই বেজিং এর প্যালেস মিউজিয়াম ছিল রাস্তায়! আজ এখানে তো কাল সেখানে - একের পর এক জায়গা জাপানের হাতে পরাজিত হচ্ছে, আর তার আগেই সেই জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেশের ঐতিহ্য। এই সময়ের মধ্যে ক্রেট গুলো রাখা থাকত মন্দিরে, গুহায়, টানেলে, কারো বাড়িতে এবং আরো সব জায়গায় যেখানে চট করে জাপানীরা পৌঁছাতে পারবে না।
সাংহাই-এ মিলিয়ে নেওয়া হচ্ছে জিনিসপত্র
১৯৪৫ সালে জাপানের পতনের পর সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এবং জিনিস পত্র একত্রিত করা হতে লাগলো নানজিং-এ এই উদ্দেশ্যে যে ক্রমে এদের পাঠানো হবে পুনরায় বেজিং-এ যেখান থেকে এসেছিল এরা। কিন্তু জাপানের পতন হলেও চীনের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে উঠল – সিভিল ওয়ার এর ভয়ে তখন আর পাঠানো গেল না বেজিং এ। সবচেয়ে বড় কথা কি জানেন? এই বারো বছর (১৯৩৩-৪৫) রাস্তায় রাস্তায়, এখান থেকে সেখানে ২০০০০ ক্রেট বহুমূল্য সামগ্রী ঘোরা ফেরা করলেও, একটা জিনিসও চুরি যায় নি যুদ্ধের পরে যখন লিষ্ট মেলানো হয়! ডেডিকেশানটা বুঝতে পারছেন? আর আমরা একটা নোবেল পদক ঠিক করে রাখতে পারলাম নি – কিন্তু বাতেলায় অস্থির বাঙালী বা ভারতীয়!
শুধু ডেডিকেটেড পাবলিক দেখলেই তো হবে না – চীনা সরকারের অবদানও কম নয়। এই জিনিসপত্র এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবার জন্য যে ট্রেন, ট্রাক বা জলপথ ব্যবহার করা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য ছাড়া এটা একদমই সম্ভব ছিল না। আর আগেই তো মিলিটারী দিয়ে পাহারার কথা উল্লেখ করেছি। এগুলো সাধারণ জ্ঞানের ব্যাপার – একটু লক্ষ্য করলেই সরকারের অবদান বোঝা যায়। কিন্তু যেটা চট করে বোঝা যায় না বা জানা যায় না সেটা হল চীনা সরকার কিভাবে তাদের গুপ্তচর বা ইন্টিলিজেন্স ব্যবহার করত জাপানী আক্রমণ অনুমান করার জন্য – এবং সেই ভাবে প্ল্যান করত মিউজিয়ামের সামগ্রী সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। এর অনেক উদাহরণ দেওয়া যায় – যেমন ধরুণ ১৯৪৪ সালের হুনান প্রদেশের চাংশা ইউনিভার্সিটিতে আক্রমণের ঘটনাটা। এই ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরীতে লুকানো ছিল অনেক সামগ্রী। এমন সময় চাইনীজ সরকার খবর পাঠালো যে জাপানীরা নাকি এখানে অবিলম্বে আক্রমণ করতে পারে – তাড়াতাড়ি মাল সরাও ওখান থেকে। তো সেই মত জিনিস সরিয়ে নেওয়া হল – কিন্তু অনেক লোক তখনো রয়ে গিয়েছিল এমন সময় জাপানী আক্রমণ এল। জিনিস বেঁচে গেল – কিন্তু অনেক মানুষ পারল না নিজেদের বাঁচাতে।
তো বেজিং এবং নানজিং মিউজিয়ামের গল্প তো হল – তা তাইওয়ানের ন্যাশানাল প্যালেস মিউজিয়ামে এল কিভাবে সেই সব অমূল্য সামগ্রী? বেজিং থেকে নানজিং এ জিনিস সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জাপানীজরা দায়ী হলেও, বেজিং এর জিনিস তাইওয়ানে আসার জন্য কিন্তু চাইনীজরা নিজেরাই দায়ী। ১৯৪৫ সালের জাপানের পরাজয়ের পরেও কিন্তু চীনের ভিতর টেনশন কমল না মূলত আভ্যন্তরীন কোন্দল এমনকি গৃহযুদ্ধের জন্যও। তাই সে সবের থেকেও মিউজিয়ামের সম্পদ বাঁচাতে তখনকার প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাই-শেক দেখলেন ভালো সুরক্ষা হবে যদি চীনের মূল ভূখন্ড থেকে তাইওয়ান দ্বীপে কিছু জিনিস অন্তত সরিয়ে রাখা যায়! যেমন ভাবে তেমন কাজ, চিয়াং নিজে ১৯৪৫ সালে তাইওয়ান গেলেন আর সাথে করে নিয়ে গেলেন ৩০০০ ক্রেট সামগ্রী – তখনকার হিসাবে যা বেজিং এর প্যালেস মিউজিয়ামের মোট সামগ্রীর প্রায় ২০ শতাংশ।
তখনো পর্যন্ত কিন্তু চিয়াং এমন ইচ্ছে ছিল না যে তাইওয়ানেতেই এই সামগ্রীগুলো চিরস্থায়ী ভাবে রেখে দেবেন – ভেবেছিলেন চীনের ভিতরের বিদ্রোহ ইত্যাদি ঠান্ডা করে, পুরো চীন কন্ট্রোলে আনার পরে আবার এখান থেকে বেজিং এর সামগ্রী ফিরিয়ে নিয়ে চলে যাবেন। কিন্তু সময় চলে যায় – ফিরিয়ে আর নিয়ে যাওয়া হয় না। শেষ-মেশ ১৯৬০ দশকের প্রথম দিকে চিয়াং ঠিক করলেন অনেক হয়েছে, তার থেকে বরং তাইওয়ানেতেই এগুলো রেখে দেওয়া যাক একটা মিউজিয়াম করে যেখানে সাধারণ লোক দেখতে আসতে পারবে। সেই মত ১৯৬৫ সালে উদ্বোধন হয় আজকের দিনের ন্যাশানাল প্যালেস মিউজিয়ামের, তাইওয়ানের রাজধানী তাইপে শহরের উত্তর দিকের শহর তলিতে যার অবস্থান।
আজকের দিনের তাইওয়ানের সবথেকে বড় টুরিষ্ট আকর্ষণ হচ্ছে তাইপের এই ন্যাশানাল প্যালেস মিউজিয়াম। এটা একেবারে পাহাড়ের কোলে অবস্থিত – এখানে পাহাড় প্রদান করে সুরক্ষা। এমন ভাবে বানানো হয়েছে যে ভূমিকম্প, ঝড়, বাতাসের আদ্রতা, শত্রুর বিমান আক্রমণ কিছুই একে টলাতে পারবে না। তাইওয়ানের এই মিউজিয়ামে ঘুরতে গেছি – সে বড়ই সুন্দর। তবে অনেক জিনিস, ইনফ্যাক্ট বেশীর ভাগ জিনিসই প্রদর্শনীতে রাখা হয় না – ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খুব কম সংখ্যক সংগ্রহ দেখানো হয়। আর বেশীর ভাগ অদেখা বহুমূল্য সামগ্রী রাখা থাকে পাহাড়ের ভিতর প্রায় ১৮০ মিটার একটা ট্যানেলে। কেউ বোমা ফেললেও কিছু হবে না এদের ক্ষতি!
প্রায় সাত লক্ষ সামগ্রী আছে তাইপের ন্যাশানাল প্যালেস মিউজিয়ামে, কিন্তু কোন এক সময়ে প্রদর্শিত হয় মাত্র ছয় হাজার মত সামগ্রী! মানে বুঝতেই পারছেন যখনই যান, আপনার দেখা জিনিসের থেকে না দেখা জিনিস থাকবে অনেক বেশী! এখনকার হিসেব মত এই মিউজিয়ামে আছে প্রায় ৪,৪০০ প্রাচীন ব্রোঞ্জের সামগ্রী, ২৪ হাজার মত পোর্সেলি্ন, ১৩ হাজার পেন্টিং, ১৪ হাজার ক্যালিগ্রাফী এবং ৪৬০০ মত জেড কার্ভিং – এছাড়াও অগুনতি পুঁথি, নথি, ডায়েরী ইত্যাদি। তবে আজকের দিনে কিন্তু চীন এবং তাইওয়ানের মধ্যে বিশাল টেনশন আছে। স্বাভাবিক ভাবেই মাঝে মাঝে চীন তাইওয়ানের ন্যাশানাল প্যালেস মিউজিয়ামের জিনিসপত্র আদপে তাদের বলে দাবী করে – কিন্তু তাইওয়ান ফেরত দিতে নারাজ। কে ঠিক কে ভুল তা এখানের আলোচ্য বিষয় নয় – মূল যেটা ব্যাপার, বেজিং এর প্যালসে মিউজিয়ামেই থাক বা তাইপের ন্যাশানাল প্যালেস মিউজিয়ামে – দুই জায়গাতেই এই লক্ষ লক্ষ অমূল্য সম্পদ বড়ই যত্নে রাখা আছে। আমাদের কাছে এটাই অনেক স্বস্তির বিষয়।
সেই সময় চীনের লোকসংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি হলেও, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৬,০০০। এরা মানে দেশের ক্রীম - যাকে বলে ভবিষ্যত। তাই এদের সুরক্ষার জন্যও চীনা সরকার খুবই ব্যস্ত হয়ে উঠল। এই গল্প বাইরের দেশের কাছে প্রায় অজানা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নির্দেশ দেওয়া হল আরো পশ্চিমে সরে যেতে। ৭৭টা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ হলে গেল খালি - যেন এক গ্রেট মাইগ্রেশন।
কিন্তু ছাত্ররা শুধু নিজেরা যেতে রাজী হল না - সাথে করে নিয়ে চলল হাজার হাজার বাক্স-প্যাটঁরা যাতে ভর্তি দুষ্প্রাপ্য পুঁথি, বই ইত্যাদি। জাপানী বোম্বার-এর ভয় আছে, মাথার উপরে যে কোন সময় বর্ষিত হতে পারে বোমা। এত ভারী বাক্স নিয়ে চলা, তাও বনে জঙ্গলে, জলপথে - খুব ধীরে হয়ে যাচ্ছে তাদের অগ্রসর - কিন্তু তবুও কেউ সেই সব বই ছেড়ে যেতে রাজী নয়।
কেমন সব গুরুত্বপূর্ণ বই বাঁচিয়েছিল এই সব ছাত্ররা? তাহলে একটু হালকা কুইজ করে নেওয়া যাক – জানেন কি এই ইন্টারনেট যুগে ইংরাজী অনলাইন উইকিপিডিয়া আসার আগে (২০০৭ সালের আগে পর্যন্ত) পর্যন্ত পৃথিবীর সবথেকে বৃহৎ এনসাইক্লোপিডিয়া কোনটা ছিল? গুগুল করলেই জানতে পেরে যাবেন, তবু বলে দিই তা ছিল ‘সিকু কুয়ানসু’ যাকে ট্রান্সেলেট করলে দাঁড়ায় ‘কমপ্লিট লাইব্রেরী অফ ফোর ব্রাঞ্চেস অফ লিটারেচার’। এ জিনিস রচিত হয়েছিল কুইয়ানলং সম্রাটদের আদেশে কারণ তাঁদের ইচ্ছে ছিল টেক্কা দেবার মিং সাম্রাজ্যের সময়ে লিখিত আগের সেই চাইনীজ এনসাইক্লোপিডিয়াকে। ১৪০৭ সালে শেষ হওয়া সেই এনসাইক্লোপিডিয়ায় ছিল ৩৭০ মিলিয়ন শব্দ! তো এ জিনিসকে টেক্কা দিতে গিয়ে কুইং সম্রাটেরা মার্কেটে নামালেন ৮০০ মিলিয়ন শব্দের সেই জম্পেশ এনসাইক্লোপিডিয়া সিকু কুয়ানসু, ১৭৮২ সালে যা লেখা শেষ হয় – ৩৫,৩৮১ ভ্যুলম এর অতিমানবীয় সেই জিনিস। এর পরের ২২৫ বছর ধরে পৃথিবীর সবথেকে বৃহৎ এনসাইক্লোপিডিয়া ছিল এটাই, একেবারে এই ২০০৭ সালে ইংরাজী উইকি এসে এক বিলিয়ন শব্দে সেই চাইনীজ জিনিসকে টেক্কা দেয়।
তা এখানে এই এনসাইক্লোপিডিয়ার কথা লিখছি কেন? কারণ কয়েকজন চাইনীজদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ভালোবাসার জন্য এই এনসাইক্লোপিডিয়াকেও বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল জাপানী বোমার আঘাতে ধ্বংসের হাত থেকে। মোট সাত সেট হাতে কপি করা সিকু কুয়ানসু বানানো হয়েছিল – চার সেট গিয়েছিল চারটে ইম্পিরিয়াল প্যালেসে, আর তিনটে ছিল পাবলিক ব্যবহারের জন্য। এই তিনটের একটা সেট গিয়েছিল হাংজু শহরের ওয়েনলান গি লাইব্রেরীতে।
কালের প্রকোপে এই এনসাইক্লোপিডিয়ার বেশীর ভাগটাই হারিয়ে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে, লুট হয়ে গিয়েছিল। অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে ১৮৫৪ সালে হাংজু শহরের লাইব্রেরীতে এই বইয়ের সেট গুলির বিশাল ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। এর আট বছর পরে ডিং নামে এক বুক কালেক্টর বাজারে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পান একজন এই বইয়ের পাতার বানানো ঠোঙা করে বাদাম ভাজা খাচ্ছে! ডিং ছিল বিশাল বই পাগল – আর তেমন ছিল তার ভাই – দুজনে মিলে নিজেদের পয়সায় এবং সময় ব্যায় করে হারিয়ে যাওয়া সিকু কুয়ানসুর খোঁজ শুরু করেন। দিন এগুতে থাকে – অনেক কিছু ধীরে ধীরে সংগ্রহ করেন তাঁরা – কিন্তু ৩৩ হাজার ভ্যলুম বই কি জিনিস বুঝতে পারছেন! সেই প্রোজেক্ট ক্রমশ হস্তান্তরিত হয় জিজিয়াং লাইব্রেরীর তত্ত্বাবধানে – যারা ১৯২০ সালে অবশেষে পুরো রিষ্টোরেশন করতে সক্ষম হন।
তো ১৯৩৩ সালে আশে পাশে যখন নির্দেশ এল যে জিজিয়াং ইউনিভার্সিটি ছেড়ে সব ছাত্রদের চলে যেতে হবে জাপানীদের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য, তখন হেড লাইব্রেরিয়ান চেন সুংসি ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলরকে অনুরোধ করলেন যে এই সিকু কুয়ানসু যেন তাঁরা সাথে করে নিয়ে যান। অমূল্য সম্পদের কথা ভেবে চ্যান্সেলর রাজী হন – তাঁদের বাক্স প্যাঁটরার সাথে যুক্ত হল আরো ২৩০টি বাক্স! কিন্তু এই ২৩০ বাক্স বইবার খরচ দেবে কে? চেন সুংসি প্রমিশ করেছিলেন চ্যান্সেলরকে যে লাইব্রেরী খরচ দেবে পরিবহনের – কিন্তু কোন এক কারণে এডুকেশন মিনিষ্ট্রি রাজী হল না। ফলে চেন নিজে ধারদেনা শুরু করলেন – এমনকি নিজের শেষ সম্বল বাড়ি বিক্রী করে জোগাড় করলেন টাকা – শুধু বই ভালোবেসে।
এই ভাবে জার্নি শুরু হল পথে ঘাটে পৃথিবীর বৃহত্তম এনসাইক্লোপিডিয়ার – সাথের ছাত্রা নিজেদের প্রাণের থেকেও ভালোবেসে বই গুলিকে যত্ন করতে লাগলো। ঠিক সময়ে রোদে দেওয়া, ভিজে গেলে শুকানো – সেই সব লিখতে গেলে মহাভারত হয় উঠবে। শেষে ১৯৪০ সালে প্রায় ১৪০০ মাইল পথ পরিভ্রমন করে শেষ মেশ একটা যুদ্ধকালীন অস্থায়ী ইউনিভার্সিটিতে আস্তানা গাড়তে পারেন এনারা সবাই –জেজিয়াং ইউনিভার্সিটির প্রায় ৮০০ জন স্টাফ। কিন্তু এখানেও বই গুলো সুরক্ষিত নয় কারণ জাপানীরা আক্রমণ করতে পারে। তাই গুইজাও প্রদেশের এই জায়গাতে খুঁজে বের করা হল পাহাড়ের গায়ে কিছু গুহা – বইগুলি সেই গুহায় স্থানান্তরিত করা হল – দুজন করে পালা করে থাকত সেই গুহাতে বইগুলি পাহাড়া দেবার জন্য। ১৯৪৫ সালে জাপানের পতন এবং যুদ্ধ শেষ হবার আগে পর্যন্ত সিকু কুয়ানসু ছিল সেই গুহায় এবং খুবই আশ্চর্য ভাবে প্রায় অক্ষত অবস্থায়। পরের দিকে ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত এক ডকুমেন্টে দেখা যায় যে জাপানের কিয়োটো শহর থেকে ইন্টিলিজেন্স অফিসার পাঠানো হয়েছিল সিকু কুয়ানসু খুঁজে বের করার জন্য সাংহাই শহরে। কিন্তু ততদিনে সাংহাই ছেড়ে সেই বই পাড়ি দিয়েছে আরো সুরক্ষিত জায়গায়।
কোন এক বিশেষ ব্যক্তির জন্য বাঁচে নি পৃথিবীর এই অমূল্য সম্পদ – বেঁচে গিয়েছিল দেশের সংস্কৃতিকে ভালোবেসে অনেক মানুষের আত্মত্যাগের জন্য। বেজিং শহরের প্যালেস মিউজিয়ামের বা তাইপের ন্যাশানাল প্যালেস মিউজিয়ামের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সেই সব অদেখা, অচেনা, ইতিহাসে অনুউল্লিখিত মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা ঝুঁকে আসে -
অনবদ্য। আমাদের এই শিক্ষা যদি থাকতো!!!!
আপনি লিখুন
সুকান্ত, আপনার ফোন নাম্বার টা পাওয়া যাবে? aryadeb২০১৭অ্যটgmail.com টে
খুব তথ্যসমৃদ্ধ লেখা। এঁদের ডেডিকেশন আর টেনাসিটি জেনে ইম্প্রেসড হলাম, লেখকের একটা বড় ধন্যবাদ প্রাপ্য।
দারুন লাগলো পড়ে সুকি। কি লেভেলের ডেডিকেশন থাকা দরকার দেশের লোকের মধ্যে সেই রকম যুদ্ধের মধ্যে দাঁড়িয়ে ওদের প্রাচীন ইতিহাসের দলিল সব রক্ষা করার জন্যে , জাস্ট ভাবা যায়না।
আমাদের সাথে পুরো পোলার অপোজিট। আমরা আসল ইতিহাস কিস্যু বাঁচাতে পারিনা। কিন্তু মহাভারতে ইন্টারনেট বা রামের উড়োজাহাজ এর মতো সিউডো ইতিহাসের গল্প ফাঁদতে পারি হোয়াটস্যাপে বিরাট স্কেলে।
সবাইকে ধন্যবাদ।
অপরাজিতা, কেকে, অমিতাভদা - হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন আপনারা। যেমন লিখেছি মিউজিয়ামে যাবার আগে আমিও এত সব জানতাম না। কিন্তু ডিটেলসে পড়ার পর চমকে গেলাম - কি ডেডিকেশন! ভাবা যায় না।
এডি, ধন্যবাদ। আপানার সাথে আমার আলাপ আছে কিনা মনে করতে পারছি না - ফোনে পাওয়া আমাকে একটু চাপ। আমি আপনাকে মেল করছি - কি দরকার সেইমত কথা বলে নেওয়া যাবে।
লেখাটা সযত্নে পড়লুম।
সম্প্রতি অন্য একটি লেখার জন্য ভারতীয়দের ইতিহাসচর্চা আর প্রশ্নশীলতার পরম্পরা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে নানা ধরনের নৈরাশ্যের সম্মুখিন হতে হলো। মার্কিনদেশের একটি বাংলা পত্রিকার জন্য চিনাদের ধর্মচর্চা নিয়ে একটা বড়ো নিবন্ধ লিখেছিলুম একসময়। মধ্যসাম্রাজ্য সম্পর্কে আমার ধারণাটিই পাল্টে গিয়েছিলো একেবারে। এই গ্রহের ভবিষ্যতের অধিকার কীভাবে ওঁদের হাতে চলে গেলো, তার কার্যকারণ আর পরিপ্রেক্ষিতটি স্বচ্ছ হয়ে উঠেছিলো আমার।
অনবদ্য লেখা, আরো অনবদ্য তৎকালীন চিনাদের অধ্যবসায়, সততা, নিজেদের সংস্কৃতি র প্রতি ভালোবাসা। লজ্জা লাগে দেখে।