সেদিন দেখলাম অফিসে আমার ল্যাবে কাজ করা ছেলেটি মন খারাপ খারাপ টাইপের মুখ করে ডেস্কে বসে রয়েছে। জিজ্ঞেস করলাম কেস কি। যা শুনলাম তাতে চক্ষু ছানাবড়া – কাগজ পড়া তেমন হয় না বলে টের পাইনি যে বিশাল ট্রেন্ডিং খবর চলছে। এক প্রেমিক নাকি তার প্রেমিকাকে নৃশংস ভাবে খুন করছে। যা বর্ণনা করল তাতে আমি বলতে বাধ্য হলাম – ঘটনা শুনে মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু চেনাশুনা না হলে তার এতটা মুষড়ে পড়াও তো ঠিক ব্যাখা করতে পারছি না।
সে তখন তার মূল দুঃখের কারণ খুলে বলল – “দ্যাখো, এই ছেলে কেমন দুষ্টু – কিন্তু তাতেও ওর মেয়ে বন্ধু পেতে আসুবিধা হয় নি। একজনকে খুন করেছে, তারপরেও নাকি তার বাড়িতে অন্য মেয়েদের আনাগোণা ছিল। আর এদিকে আমার অবস্থা দ্যাখো! তুমি তো আমাকে কতদিন চেনো – এই ছেলেটার থেকে আমি ভালো এটা তো মানবে! তাহলে বিয়ে করার জন্য মেয়ে পাচ্ছি না কেন? মনটা তাই খুব খারাপ”
কি আর বলি – ভাবলাম ছেলের কথায় যুক্তি আছে। মৃত্যু নিজে ধ্রুব, কিন্তু তার খবর অপেক্ষিক।
সেই ছেলেটির বিবাহ যোগ্য কন্যে খোঁজার ব্যাকগ্রাউন্ডও আছে।
বেশ কিছুদিন আগে আমাকে টিমের একজন বলল, “সুকান্ত, তুমি আমার ভিজিটিং কার্ড প্রিন্টের রিকোয়েষ্টটা অ্যাপ্রুভ করে দিও”
বললাম, সে না হয় দেব। কিন্তু তুমি এর ভিজিটিং কার্ড বিলোচ্ছে কাকে?
সে তখন জানালো বেশীর ভাগ ভিজিটিং কার্ড তার শেষ হয়ে যাচ্ছে অন্য ছেলেটির বিয়ের সমন্ধ করতে গিয়ে। মাঝে মাঝেই নাকি এরা দুজন আশেপাশে মেয়ে দেখতে যায়। মানে ফর্মালি দেখা – মেয়ের বাড়ি গিয়ে। যে ছেলেটির বিয়ের চেষ্টা চালানো হচ্ছে তার দেশের বাড়ি অনেক দূরে। তাই লোকাল গার্জেন হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছে ভিজিটিং কার্ড বিলোনো ছেলেটি। ফর্মালি দেখতে গেলে নাকি একঘর লোক থাকে বৃহত্তর ফ্যামিলি – তাদের সবাইকে নিজের ভিজিটিং কার্ড বিলি করে বলছে – পাত্র খুব ভালো, নামী কোম্পানীতে কাজ করে। আমার ভাইয়ের মত। এই আমার বিজনেস কার্ড, যে কোন রকম ডিটেলস জানতে আমাকে কনট্যাক্ট করবেন।
আমি তখন বললাম, প্রতিবার মেয়ে দেখতে গিয়ে ২০টা করে বিজনেস কার্ড বিলোবার তো কোন দরকার নেই! ফ্যামিলির হেড-কে দিয়ে আসবে একটা কার্ড। রিসোর্স অপ্টিমাইজ করতে শিখতে হবে
পাত্রী দেখতে গিয়ে পাশে কতজন বসে থাকবে সেটাও আপেক্ষিক। কতজনকে বিজনেস কার্ড দেওয়া উচিত সেটাও।
এর পর থেকে আমি প্রতি সোমবার সকালে গিয়ে সেই ছেলেটির কাছে গিয়ে আপডেট নিতাম যে তার পাত্রী বা বান্ধবীর অনুসন্ধান কেমন চলছে। পি এইচ ডি করার সময় প্রতি সোমবার ল্যাবে গিয়ে সকালের কিছুটা সময় যেমন বরাদ্দ থাকত উইক এন্ডের ইংলীশ প্রিমিয়ার লীগের ফুটবল আলোচনায় – তেমনি আমি ছেলেটির কাছে তার বিবাহের আপডেট নিতে লাগলাম।
ছেলেটি আমাকে জানালো, সে চারটি মেয়ের শর্ট লিষ্টে উঠতে পেরেছে।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে না পারলে সে ক্লীয়ার করে দিল – আগে থেকে বান্ধবী থাকলে অন্য ব্যাপার, কিন্তু এই বয়সে বান্ধবী তথা পোটেনশিয়াল পাত্রী খোঁজার পুরো ব্যাপারটাই প্রফোশ্যনাল। আগে যেমন ছেলেরা শুধু নিজেদের সুবিধা দেখবে এখন সে সব যুগ চলে গেছে। মেয়েরাও রীতিমত লিষ্ট বানিয়ে প্রত্যেক ছেলের প্রোস্ অ্যান্ড কনস্ দেখছে – সেই মত র্যাঙ্কিং।
ভাবলাম এটা বেশ ভালো ব্যাপার। ছেলেটির সাথে আরো আলোচনা করে জানলাম চারটি মেয়েরই টপ ফাইভ চয়েসের মধ্যে ঢুকতে পেরেছে সে। মন তার খুশী খুশী।
এর পরের সপ্তাহে সোমবারে গিয়ে দেখলাম তার মন খারাপ। কারণ হিসেবে জানালো, শুক্রবারে রাতের দিকে সে একটি মেয়ের ম্যাসেজ পেল যে সে নাম্বার তিনে উঠে এসেছে। শনিবার সকালে মনের আনন্দে ছিল – এমনকি দুপুরে বিরিয়ানিও খেয়ে নিয়েছিল আনন্দে। কিন্তু শনিবার বিকেলে আবার ম্যাসেজ পায় চার নম্বরে নেমে গেছে বলে। বুঝতে পারছে না র্যাঙ্কিং কিভাবে একবার উঠেও নেমে যেতে পারে!
তাকে বোঝালাম যে র্যাঙ্কিং চিরদিনই আপেক্ষিক। পাত্রের র্যাঙ্কিং তো আরো – ভালোবাসা, সৌন্দর্য, টাকাপয়সা – দুপুরের বিরিয়ানির স্বাদ সবই আপেক্ষিক।
আপসেট আরো বেশী এই জন্য যে এই মেয়েটির সাথে রাতের পর রাত কথা বলে কাটিয়েছে। তবে নির্দিষ্ট টাইম স্লটে – সেই স্লট শেষ হলেই মেয়ে বলেছে এবার ফোন রাখছি কারণ লিষ্টের তিন বা দুই নম্বরকে টাইম দেওয়া আছে। আমার ল্যাবের ছেলেটি কিচ্ছু মনে করে নি – খুবই স্পোর্টিং-লি নিয়েছে।
একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করে ছেলেটি যে, “সুকান্ত তুমি তো অনেকদিন ইউরোপে ছিলে, তা সুইজারল্যান্ড দেশ হিসেবে কেমন”? আমি বললাম,
- দারুণ দেশ তো! হনিমুনে যাবার জন্য দারুণ! তাহলে কি ধরে নেব কেস এগিয়ে গেছে অনেক দূর?
- আরে বাবা তা নয়! যে মেয়েটির সাথে কথা বলছি সে তো সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। তার প্রথম চান্সেই এই দেশ থেকে কেটে পড়ার ইচ্ছে। অনসাইট খুঁজছে – পেলেই চলে যাবে, আর তা হলে আমাকে সাথে যেতে হবে বলছে
- কিন্তু আমাদের কোম্পানীর ওখানে তেমন কোন স্কোপ নেই সেটা আগে থেকেই বলে রাখছি
- সেই জন্যই তো আমি জানতে চাইছি! আমি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ওখানে গিয়ে কি করব!
- কিছু না পেলে কল-মিস্ত্রী হয়ে যাবে! যাকে গালভরা নাম প্লাম্বার বলে ডাকে
- ইনকাম আছে তাতে?
- সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারের থেকে বেশী ইনকাম।
- তাহলে ভাবি সিরিয়াসলি এই নিয়ে
আমি তাকে ভাবার উৎসাহ দিলাম – এমনকি ভাবা প্র্যাকটিস করতেও বললাম, আমাদের মহান বাঙালী যেটা বলে গিয়েছিলেন।
এর পাশাপাশি ছেলেটিকে পরামর্শ দিলাম যে আমাদের অফিসের মধ্যেই অপশন এক্সপ্লোর করতে – ডুয়েল কেরিয়ার বেশ একটা আকর্ষণীয় অপশন। সে বলল, পাশের একটা ল্যাবের মেয়েকে পছন্দ হয়েছে। নড়চড়ে বসলাম আমি –
- দারুণ খবর তো! ওই ল্যাবের ম্যানেজার আমার চেনা, কিছু দরকার হলে বল বোলো
- ম্যানেজারের সাথে আমার তো দরকার নেই, মেয়েটাকে কিছু বলতে পারবে কি?
- সে পারি, কিন্তু আমার মনে হয় পাশাপাশি ল্যাবে কাজ করছো যখন, নিজেদের মধ্যেই আলোচনা করা ভালো
কিছুদিন পরেই শুনলাম সেই মেয়েটি এই ছেলেটির মনে ভাব টের পেয়ে এ কিছু বলার আগেই কফি খেতে ডেকে নিয়ে গিয়ে জানায়, “তুমি খুবই ভালো ছেলে, আমি তোমাকে বন্ধুর মত দেখি। এর বাইরে রোমান্টিক কিছু ভাবা তোমাকে নিয়ে সম্ভব নয়। আর তা ছাড়া আমার পরিবার খুবই গোঁড়া – আমাদের কমিউনিটির বাইরে বিয়ে দেবে না”।
ছেলেটি ভাবে মেয়েটির কথায় যুক্তি আছে – তাই আর কিছু মাইন্ড করে নি। কিন্তু তার না মাইন্ড করা অবস্থা বেশী দিন চলল না। একদিন উইক এন্ডে সে মেয়ে বাড়ি থেকে পালালো অন্য ল্যাবের এক ছেলের সাথে – তার কমিউনিটির বাইরের। মেয়ের বাপ নাকি পুলিশে খবর দিয়েছে – ওদিকে ছেলেটি তার ল্যাবের ছেলেদের হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠাচ্ছে কোন এক রিমোট মন্দিরে বিয়ে হচ্ছে। একদম অফ দি গ্রীড যাকে বলে।
আমিও সেই ছবি দেখলাম – ল্যাবের ছেলেটিকে বললাম,
- তোমাকে আমি দুঃখ দিতে চাই না, কিন্তু তোমার ম্যানেজার হিসেবে আমার একটা কর্তব্য থেকেই যায় গ্রাউন্ড রিয়েলিটি চেক করানোর। এই যে তুমি মেয়েটির গায়ের গয়না, শাড়ি এবং ছেলেটিরও সাজ সজ্জা দেখছো এগুলো শনিবারে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে রবিবারে যোগাড় করা যায় না! সব জামা কাপড় পুরো ফিটিংস – ব্লাউজের হাতা ঢিলে নয়, তার মানে আগে থেকে মাপ দিয়ে বানানো। এবার তোমার যা বোঝার বুঝে নাও
- কিন্তু ছেলেটিকেও তো আমি চিনি! আগের দিনে ল্যাবে আমাকে হাইড্রোজেন সিলিন্ডার এনে দিল! আর মেয়েটি যে আমাকে আগে বলল নিজের কমিউনিটির বাইরে বিয়ে করবে না! সেটার কি হল!
তাকে জানাতে বাধ্য হলাম যে কমিউনিটি ফিলিং এমনকি সিলিন্ডারের গ্যাসের ঘনত্বও আপেক্ষিক! সবচেয়ে বড় আপেক্ষিক মানুষের মন – “দেবা ন জনান্তি, কুতো মনুষ্য”। সে আবার সংস্কৃত জানে না, ওদের ক্লাস সেভেন-এইটে টর্চার ছিল না। তাই ব্যাখ্যা করতে হলে, ‘কুতো’ মানে কুত্তা নয় – কবি এখানে মানুষকে কুত্তার সাথে তুলনা করে নি। সে তুমি হাইড্রোজেন সিলিন্ডার এনে দেওয়া ছেলেটিকে যাই ভাবো না কেন! হালকা গ্যাসের ব্যাপারে কবি নীরব!
আবার কিছুদিন কেটে যায়। অন্য একটি মেয়ের লিষ্টি টপে উঠে আসে সে ছেলে। সপ্তাহের শেষে জানিয়ে যায় উইকএন্ডে কিছু একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে।
কিন্তু হল না সেবারেও! একদম শেষ প্রশ্ন হিসেবে মেয়েটি জানতে চায় – তোমার দেবতা কে? মানে বাড়িতে কি তোমাদের শিব নাকি বিষ্ণু?
ছেলেটি বলে, মনে হচ্ছে বিষ্ণুই হবে
মেয়ে আকাশ থেকে পরে – “মনে হচ্ছে মানে? তুমি জানো জান? আমাদের বাড়ি শিব – তাই তোমার সাথে কোন ভাবেই আর এগুতে পারবো না”
ছেলেটি বলার চেষ্টা করে তার অসুবিধা নেই শিবের ভক্ত হয়ে যেতে। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে
ধর্মও আপেক্ষিক – ভক্তিও।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।