অমৃতার সাথে নানা বিষয় নিয়ে হাবিজাবি কথা হত যেগুলোর শেষকথা বলে কিছু নেই – কথা বাড়ালেই বাড়বে ইলাষ্টিক ব্যান্ডের মত। তেমনি একটা টপিক ছিল, ‘এজিং গ্রেসফুলি’। এজিং গ্রেসফুলি-র বাঙলা ঠিক কি হবে আমার জানা নেই – বার্ধক্যে সৌন্দর্য?
মানুষের বয়স বাড়ে, তো আমার মতে সেই ক্রমশ বেড়ে যাওয়া বয়স মেনে নিতে সমস্যা কোথায়! কিছু কিছু সেলিব্রিটি-দের বয়স হয়ে গেলেও কম বয়সী সেজে ঘুরে বেড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টার সাইকোলজি আমি বুঝতে চাইতাম না। অমৃতার উলটো প্রশ্ন ছিল, “নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে কেউ যদি রাখতে চায় তাতে প্রবলেম কোথায়”? তর্ক করার চেষ্টা করি যে আমার কোনই প্রবলেম নেই, বিশেষ করে যেখানে আমার পয়সায় সে এ কাজ করছে না। আমার তর্ক অন্য জায়গায় – বয়স হয়ে এলে কেন আমরা স্বাভাবিকতাকে সুন্দর বলে মনে করব না? ‘গ্রেসফুলি এজ্’ হওয়া তো আমার কাছে আরো আকর্ষনীয় মনে হয়।
অবধারিত প্রশ্ন, ‘গ্রেসফুল’ হবার মাপকাঠি কি? কে ঠিক করবে? গ্রেসের সাথে সৌন্দর্যের কি সম্পর্ক? ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সব ব্যাপারে সবজায়গায় মতামত প্রকাশ করা চাপের আছে – মতের মিল না হলেই বিতর্ক। আর অর্থহীন বিতর্ক এবং সেই থেকে ব্যক্তিগত তিক্ততায় আমার প্রচুর ভয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে ঘরের ব্যাপার বলে অমৃতাকে আমার মতামত জানাতাম – বলতাম, দেখো এই গ্রেসফুল ব্যাপারটা অনেকটা ভালো পিৎজা-র মত। নেচি বানিয়ে ফ্রীজে রেখে – থিন ক্রাষ্ট বেলে - ট্যামেটো সস – মোৎজারেলা – পিপার এর টুকরো – চিকেনের পিস – এই সব ছড়ালেই পিৎজা হয়ে যায় না! যার হয় তার হয়, তারা জানে কাঠের আগুনের কিভাবে ব্যবহার করতে হয়। ‘এজিং গ্রেসফুলি’-র উদাহরণ ভাবতাম আমরা দুজনা। ওয়াহিদা রহমান, শর্মিলা ঠাকুর, জয়া বচ্চনের সাথে সাথে নীচের ছবির ভদ্রমহিলার নামও চলে আসত। অমৃতার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল উনার সাথে আলাপ করার – ফ্যান ছিল যাকে বলে একেবারে। কোন এক চিত্র প্রদর্শনী-তে গিয়ে দেখা হয়ে যায়। ভুলে গেছি কার প্রদর্শনী ছিল – এই ছবিটা খুঁজে পেলাম সেদিন।
এই বয়স বাড়ার ব্যাপারটা বেশ জটিল – বয়স বাড়লেই একসময় মৃত্যু আসবে। অনেকে মৃত্যুকে চরম ভয় পায় – তাই তাদের কাছে বার্ধক্য তথা মৃত্যুকে যতটা দূরে পারা যায় সরিয়ে রাখা। আবার অনেকে বয়সের সাথে সাথে নিজের শরীরের পরিবর্তনের ভয় পায়। একধরণের সৌন্দর্যের সংজ্ঞা আমাদের মনের মধ্যে কাজ করে আর সেই সংজ্ঞার প্রায় সবটাই যৌবনকালের শারীরিক গঠনের দ্বারা প্রভাবিত। ফলতঃ কিছু মানুষ যৌবনকাল ধরে রেখে ‘সুন্দর’ থাকতে চায় অনন্তকাল বা যতদিন পর্যন্ত টানা যায় আর কি।
অ্যান্টি-এজিং (বার্ধক্য বিরোধী) নিয়ে নানা রিসার্চ ইত্যাদি চলে আসছে বিগত কয়েক দশক ধরে। কয়েক দশক ই বা বলি কেন, হিটলারের ডাক্তারেরা যে এটা নিয়ে মাথা ঘামায় নি সেটা মনে করাই ভুল। আর তা ছাড়া ক্যাপ্টেন আমেরিকা ইত্যাদির গল্প তো আছে। বেশী দিন যৌবন ধরে রাখার মধ্যে খারাপ কিছু নেই – ওই যাকে আমরা ‘হেলথি লাইফস্টাইল’ বলি তা মূলে তো ভালো ভাবে সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকাটাই আছে। সেক্ষেত্রে আমরা যেটা খুব সহজেই নিয়ন্ত্রন করতে পারি তা হল আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন এবং আমাদের খাওয়া দাওয়া। খাওয়া-দাওয়া কন্ট্রোল, ব্যায়াম ইত্যাদি করা – খুব রোদে ঘোরা ফেরা না করা – এই সব কিছু আমাদের সাহায্য করবে বার্ধক্য ঠেকিয়ে রাখতে।
এ পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু এর বাইরে যে জিনিসগুলো আরোপিত হয়েছে আমাদের বার্ধক্য রোধ করার জন্য সেগুলোর রাজনীতি এবং অর্থনীতি খুব জটিল। সেই নিয়ে প্রবন্ধ ফাঁদাই যেতে পারে, তবে মূল সারাংশটা আজ বলে দিই। বিজ্ঞানের চোখে এবং প্রমাণাদির উপর ভিত্তি করে আমরা ঠিক এই মুহুর্তে কোথায় দাঁড়িয়ে? পুষ্টিকর খাবার এবং সাধারণ স্বাস্থ্য ছাড়া এমন কি কোন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে আমরা কিছু আবিষ্কার করতে পেরেছি যাতে করে বার্ধক্য আটাকানো যায়? সঠিক উত্তর হল – না। কোন ম্যাজিক বার্ধক্য বিরোধী বুলেট আবিষ্কার হয় নি, না হয়েছে কোন বার্ধক্য বিরোধী খাবার বড়ি, না কোন ইঞ্জেকশন, না কোন ম্যাজিক ক্রীম বা স্প্রে – তা এ সব বিশাল দামী বা সস্তা যাই হোক না কেন! কিন্তু তার মানে কি এই বিষয়ে কোন গবেষণা চলছে না? চলছে বৈকী! বিশাল সব গবেষণা চলছে, এমনকি বিগত দুই দশকে এই নিয়ে নাড়াঘাঁটা আরো বেড়েছে!
বার্ধক্য বিরোধী রিসার্চ খুব বেড়েছে বায়োলজিক্যাল গবেষণায় - যে সব জিনিসগুলো সাহায্য নেওয়া হচ্ছে তার রেঞ্জ বিশাল – ন্যানো-মেডিসিন, টিস্যু-ইঞ্জিনিয়ারিং, স্টেম-সেল রিসার্চ চলছে জোর কদমে, যারা নাকি শুধু বার্ধক্য ঠেকাবে না, আমাদের বয়স কমিয়েও দিতে পারবে ভবিষ্যতে! এগুলোর বেশীর একটু দূরে এখন, কিন্তু বুড়ো হওয়া ঠেকাতে আমরা বেশ কিছু জিনিস সহজে হাতের কাছে পেয়ে খুব ব্যবহার করি। এই সহজে লভ্য দুই ধরণের জিনিস হচ্ছে – নানা ধরণের খাবার/সাপ্লিমেন্ট/মেডিসিন আর কসমেটিক্স (মুখে/গায়ে মাখার ক্রিম ইত্যাদি)।
কসমেটিক্স বা প্রসাধন ইন্ডাষ্ট্রির ভাঁওতাবাজী নিয়ে আমার আগ্রহ অনেকদিনের। সেই কোন ছোটবেলায় ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী’ বিজ্ঞাপন যে আদপে মিথ্যা তা জানার মাধ্যমে যে আগ্রহের শুরু। তবে অমৃতার সাথে সৌন্দর্যের বিষয়ে আলোচনার আগে আমার মূল জানার আগ্রহ ছিল বহুজাগতিক প্রসাধন কোম্পানীগুলি কিভাবে মানুষের ‘সুন্দর’ হবার আকাঙ্খাকে প্রায় শোষণ করে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা ফেঁদেছে সারা পৃথিবী জুড়ে। কিন্তু মানুষ নিজেকে ‘সুন্দর’ দেখতে চায় কেন বা তার জন্য এত সময় এবং অর্থ খরচে পিছপা হ্য় না কেন, সেই মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে দেখি নি। অমৃতার সাথে আলোচনার পর থেকে আমি নিজের মনের প্রশ্নগুলি ভাগ করে নিয়ে একের সাথে অপরের সম্পর্ক বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম –
১) মানুষ নিজেকে সুন্দর দেখতে চায় কেন?
২) সৌন্দর্যের কি আদৌ কোন সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা আছে? থাকলে, সেই সংজ্ঞা কি পাল্টেছে মানুষের ইতিহাসের সাথে সাথে?
৩) ছেলেদের চোখে মেয়েদের সৌন্দর্যের মাপকাঠির উল্লেখ তো আমরা এদিক ওদিকে পেয়েই যাই। কিন্তু এই আধুনিক সময়ে মেয়েরা নিজেরা সৌন্দর্য নিয়ে কি ভাবে?
৪) সৌন্দর্যের সাথে বার্ধক্য কতটা জড়িয়ে? বয়স্ক এবং সুন্দরী দুটোই যদি একসাথে গ্রহীত হয়, তাহলে বার্ধক্যে এত ভয় কেন যে নানা কসমেটিক্স, মেডিসিন, সার্জারী ইত্যাদি করতে হবে?
৫) বার্ধক্য থামানোর প্রচেষ্টাতে কতটা সময় এবং অর্থ ব্যায়ে একজন সাধারণ মেয়ে রাজী?
উপরের ১ এবং ২ নম্বর প্রশ্নও নতুন কিছু না – এই নিয়ে পরে একদিন প্রবন্ধ ফাঁদবো। অনেক লেখা পত্র আছে এই নিয়ে, আছে নানা জনের মতবাদ – মিশে আছে ইতিহাস, সংস্কৃতি, দেশের রাজনীতি। তাই আমি লক্ষ্য দিতে চাইছিলাম ৩ থেকে ৫ প্রশ্নে - চাইছিলাম খুঁজে পেতে কোন গবেষণা যেখানে সমীক্ষা চালানো হয়েছে সাধারণ নাগরিক মহিলাদের মধ্যে – মানে গবেষকের তত্ত্ব কথা নয়, বাস্তব কোথায় দাঁড়িয়ে সেই সম্পর্কিত এক ধারণা। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেলাম এমন এক গবেষণা যা খুব সম্প্রতি ২০১৩ করা হয়েছিল। সেই গবেষণায় খুব সুস্পষ্ট ভাবে দেখা গিয়েছিল সৌন্দর্যের ধারণার সাথে বার্ধক্য ব্যাপারটা বেশ অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে, আর বার্ধক্য রোধে মহিলারা এখনো স্বাভাবিকের (সুষম আহার এবং ব্যায়াম) বাইরেও মোটা দাগের খরচে রাজী! আজকে এই দিকগুলো নিয়েই একটু আলোচনা করা যাক। অ্যান্টি-এজিং কসমেটিক্স-এর ভাঁওতাবাজি এবং বার্ধক্য রোধে বাকি জিনিস নিয়ে আলোচনা অন্য কোন পর্বে।
আর এই সব ব্যাপারে সমীক্ষা চালাতে কোন দেশের সবচেয়ে এগিয়ে আসার সম্ভাবনা বেশী? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন – ফ্রেঞ্চরাই এই সব ব্যাপারে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেয়। আগেই লিখেছি যে এখানে শরীরের রাজনীতি নিয়ে কোন আলোচনা আমি করব না – তবুও সংক্ষেপে জানিয়ে দিই যে, এই নিয়েও অনেক সমাজতাত্ত্বিক আলোচনা হয়েছে। “১০০ ০০০ ইয়ারস অফ বিউটি” বইটায় খুব গভীরে নাড়াচাড়া করা হয়েছে এই নিয়ে – দেখানো হয়েছে যে সেই প্রাচীন সভ্যতা কাল থেকেই সৌন্দর্যের সাথে মিশে গিয়েছিল নিজেকে পৃথক করে প্রমাণ করার তাগিদ এবং তার সাথে জড়িয়ে থাকা সামাজিক প্রভাব। প্রাচীন কালের সেই সৌন্দর্য চর্চার সাথে আরো জড়িয়ে ছিল মানুষ কোন বিশেষ সংস্কৃতির সাথে যুক্ত তা নির্দিষ্ট করা, সে যে নিজে সেই সংস্কৃতির অঙ্গ তা বোঝানোর প্রচেষ্টা। এবং সব চেয়ে বড় কথা এটা দেখা গেছে যে বিগত মাত্র এক শতাব্দীতে সৌন্দর্য এবং বার্ধক্য বিষয়ে নারীদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গীতে এসেছে প্রায় যুগান্তকারী পরিবর্তন। মানুষ জীবনের গড় আয়ু বেড়েছে যার জন্য নারীরা আরো বেশীদিন (প্রজননের বছরগুলি পেরিয়েও) তাদের যৌন স্বাতন্ত্র বজায় রাখতে পারছে, এবং তার সাথে সাথে নারীরা নিজেরদের অধিকার নিয়ে আরো বেশী সচেতন হয়েছে – ফলে কর্মক্ষেত্রে এবং সমাজের সব ক্ষেত্রেই নারীদের অধিকারে এসেছে ব্যাপক রদবদল। নিজেদের যোগ্যতাতেই নারীরা আজ প্রায় সব ক্ষেত্রেই পুরুষদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলছে।
তো যাই হোক, ‘ইপসস্’ নামে প্যারিসের এক গ্লোবাল মার্কেট রিসার্চ কোম্পানী সমীক্ষা চালাতে উদ্যোগ নিল ২০১৩ সালে। সেই সমীক্ষার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কোয়েষ্ট অবসার্ভেটরী’ যার মূল লক্ষ্য আগেই উল্লেখ করেছিঃ আজকের দিনের নারীদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী এই বিষয়গুলির উপর কেমন - সৌন্দর্য, বার্ধক্য, বার্ধক্য রোধী স্কিনকেয়ার এবং সৌন্দর্য ধরে রাখার জন্য ছোট খাট প্লাষ্টিক সার্জারী (মিনিমাল ইনভেসিভ কসমেটিক সার্জারী)। এই অনলাইন সমীক্ষার জন্য নিয়োগ করা হল সমাজের নানা স্তর থেকে ১০০০ জন নারীকে যাদের বয়স ২৫ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। সমীক্ষার উত্তর দিতে লেগেছিল গড়ে ২৪ মিনিট এবং অংশগ্রহনকারীরা উত্তর দিয়েছিল এক প্রশ্নমালার যা তৈরী করেছিল একদল বিশেষজ্ঞ – ডার্মাটোলজিষ্ট, এসথেটিক মেডিসিন এবং স্যোসাল অ্যানথ্রোপলজি এলাকা থেকে বেছে নেওয়া।
প্রশ্নগুলি করা হয়েছিল এই বিষয়গুলি মাথায় রেখে – ১) অংশগ্রহনকারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা; ২) সেই সময়ে তারা কি কি বিউটি প্রোডাক্ট ব্যবহার করছে; ৩) সৌন্দর্য এবং বার্ধক্য বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গী (‘ভিতরের বয়স’ এবং ‘বাইরের বয়স’ নিয়ে উপলব্ধি); ৪) ত্বকের বার্ধক্য নিয়ে দুশ্চিন্তা এবং তা রোধে নেওয়া ব্যবস্থা (জীবনধারণ এবং ত্বকের যত্ন); ৫) কসমেটিক সার্জারী বিষয়ক ধারণা এবং সেই বিষয়ক সিদ্ধান্তের নির্ণায়ক।
১০০০ জনের সমীক্ষা খুব একটা কম স্যাম্পেল সাইজ নয়! তো দেখা গেল সৌন্দর্যের প্রধান মাপকাঠি হিসাবে বেশির ভাগ জনেই চিহ্নিত করেছেন এই তিনটি বিষয়ঃ
১) স্বাভাবিক চেহারা (ন্যাচারাল লুক)
২) আত্মবিশ্বাস
৩) আকর্ষণীয় ত্বক
স্বাভাবিক চেহারার মাধ্যমে সৌন্দর্য নির্ধারণ করতে গিয়ে দেখা গেল তার মধ্যে আবার পাবলিক মুখের সৌন্দর্যের উপর বেশ জোর দিচ্ছে! আর প্রায় সবাই এতেও একমত যে কম বয়সী মেয়েদের মুখ বেশী আকর্ষণীয় এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে মুখের আকর্ষণ কমে আসে।
ত্বকের ব্যাপারটা নিয়ে আমি নিজে বেশী অবাক হলাম না – কারণ সেটা অমৃতার কাছে শুনে শুনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। দাবী হচ্ছে ত্বকের রঙ এবং টেক্সচারের মাধ্যমে নাকি ধারণা করা যায় একজনের বয়স, স্বাস্থ্য এবং তার শারীরিক সৌন্দর্য কেমন হবে! এই দাবী নিয়ে আমি অমৃতার মাধ্যমে পরীক্ষাও চালিয়েছি। অমৃতার অচেনা হবে এমন কিছু সেলিব্রেটির ছবি আমি দেখাতাম ওকে [মুভি বা স্টিল] – এবং এদের মধ্যে অনেকের বয়স আগে থেকে জানা না থাকলে আমার মত ছেলেদের বলা বেশ চাপের। কারণ এদের বেশির ভাগই কসমেটিক্স সার্জারী ইত্যাদি করেছিল। কিন্তু দেখেছি বেশীর ভাগ সময়েই অমৃতা মোটামুটি ৫ বছর এদিকে ওদিকে তাদের বয়স বলতে পারত! এবং এটাও বলত অনেক মেয়েই নাকি সেটা বলে দেবে! যারা ফেসিয়াল সার্জারি করিয়েছে তাদেরটা বোঝা যায় গলার কাছের তাদের ত্বকের তুলনা করে ইত্যাদি। ভাবতাম কত কিছু শেখার আছে জীবনে!
যাই হোক, ‘কোয়েষ্ট অবসার্ভেটরী’ সমীক্ষায় অংশগ্রহনকারীদের মত অনুযায়ী একজন নারী তার সৌন্দর্যের শিখরে ওঠে ৩৬ বছরের কাছাকাছি বয়সে। যদিও এরা বলেছিল যে বয়স বাড়ার সাথে সাথে মুখের আকর্ষণ তুলনামূলক কমে আসে, কিন্তু এদের মধ্যে ৯২% মতামত রেখেছিল যে সৌন্দর্য বজায় রেখেও কিন্তু বার্ধক্যে পোঁছানো সম্ভব, অন্তত গড়ে ৭৩ বছর পর্যন্ত!
যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বয়স তো আর ঠিক থেমে থাকবে না, তা আপনারা মনোগ্রাহী ত্বক এবং সৌন্দর্যের সাথে বার্ধক্যে প্রবেশ করার জন্য ঠিক কি কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন – তার উত্তরে এসেছিল নীচের প্রথম দশটি পদক্ষেপঃ
১) মুখে এবং শরীরে ময়েশ্চারাইজিং ক্রীম/লোশন লাগানো (৬৮%)
২) সেলুন/বিউটি পার্লারে গিয়ে চুলের যত্ন (৬০%)
৩) পর্যাপ্ত জলপান (৫৮%)
৪) সূর্যরশ্মি থেকে ত্বক বাঁচিয়ে চলা (৫৮%)
৫) স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া (৫৪%)
৬) পর্যাপ্ত নিদ্রা (৫০%)
৭) ত্বকের পরিচর্যা (৪৯%)
৮) নিয়মিত খেলাধূলা এবং ব্যায়াম (৪৭%)
৯) মুখ এবং শরীরে কসমেটিক্সের প্রযোগ (৪৭%)
১০) বিশ্রাম এবং রিল্যাক্স করা (৪৬%)
সেই সমীক্ষা থেকে আরো একটা ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার পরিলক্ষিত হয়েছিল – শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ নারী নিজেদের কম বয়সী মনে করেন, এবং বিশ্বাস করেন যে তাঁদের আসল বয়েসের তুলনায় দেখতে কম বয়সী লাগে! কিন্তু সমীক্ষার উত্তরগুলি আর একটু ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, ওই যে বলা হয়েছিল ৩৬ বছর বয়স যখন এক নারী তার সৌন্দর্যের শিখরে পোঁছন – সেই বয়স পর্যন্ত এই কম বয়সী অনুভব ঠিক আছে। কিন্তু তার পরে একটা ব্যবধান তৈরী হয় – তাঁদের মুখ দেখে যত বয়সী মনে হয় (বাহ্যিক বয়স – এক্সটারন্যাল এজ), আর তাঁরা নিজেরা যতটা কম বয়সী ভাবেন নিজেদের (আভ্যন্তরীন বয়স – ইন্টারন্যাল এজ))। মন বলছে আমি কম বয়সী, কিন্তু মুখ তা সায় দিচ্ছে না! এই যে চাপা টেনশনের কেস এবং অর্ন্তদ্বন্দ – তা বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে।
আগেই লিখেছি যে পাবলিক মুখের সৌন্দর্যের উপর বেশ জোর দিচ্ছে বার্ধক্য বিরোধী কাজকর্মে। এখানেই টেনশনের প্রকার ভেদ আছে। দেখা গেল কম বয়সী মেয়েরা চিন্তিত তাদের মুখে ক্লান্তির ছাপ পড়ছে কিনা বা চোখের চারদিকে কালো দাগ আসছে কিনা। অন্যদিকে ৪৫ বছরের পর থেকে মেয়েদের চিন্তা ভাবনা নিমজ্জিত হচ্ছে মুখের চামড়ায় শিথিলতা, কুঁচকানো ভাব বা সরু দাগের আবির্ভাব নিয়ে! আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে আরো একটা বিশাল চিন্তা মাথায় চেপে বসে – তা হল ঘাড়ের শিথিলতা।
তো এটা প্রায় একদম জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল যে মুখের চামড়ার যত্ন এবং তাকে মেনটেন করা এক টপ প্রায়োরিটি, তা সে বয়স আপনার যাই হোক না কেন। এনারা বিশ্বাস করেন যে মধ্য তিরিশে পোঁছবার পর থেকেই অ্যান্টি-এজিং স্কিন কেয়ার ব্যবহার চালু করে দেওয়া উচিত। যদিও এঁরা ‘বিশ্বাসের’ কথা বললেন, কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করা হল, আপনি কি নিজে ব্যাবহার করে অ্যান্টি-এজিং প্রোডাক্ট? তো দেখা গেল ৩৫-৪৪ বছর বয়সের গ্রুপের মধ্যে মাত্র ২১% এবং ৪৫ বছরের উপরে বয়সের ৪০% ভাগ নারীরা অ্যান্টি-এজিং স্কিন কেয়ার ব্যবহার করছেন। একটু হলেও তা হলে আশা আছে!
এই সমীক্ষায় অংশগ্রহনকারীরা মধ্যে বিশ্বাস করেন যে সৌন্দর্য বিষয়ক পরামর্শকারী ডাক্তার/বিউটিশিয়ানরা খুব গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেন অ্যান্টি-এজিং বিষয়ক পরামর্শ দিতে। আর এই ডাক্তার/বিউটিশিয়ানরা কাছে পরামর্শ নিতে গেলে এদের মধ্যে ৪৩% অ্যান্টি-এজিং স্কিন-কেয়ার প্রোডাক্ট ব্যবহারের পরামর্শ দেন। বোঝা গেল অ্যান্টি-এজিং স্কিন-কেয়ার প্রোডাক্ট জাত সমস্যা অনেক গভীরে!
এবার আসা যাক ছোটখাট কসমেটিক সার্জারীর/প্রসিডিওরের ব্যাপারটায়। সমীক্ষায় অংশগ্রহন কারীদের মধ্যে প্রায় ৮০% জানিয়েছিলেন তাঁরা এই বিষয়ে অবহিত এবং কিছু ফান্ডা আছে কি করলে কি হতে পারে, বা কি করা হয়। কিন্তু মাত্র ৯% জানিয়েছিলেন তাঁরা এমন কোন প্রসিডিওর ইতিমধ্যে করে ফেলেছেন আর ৩৯% ভাবছেন ভবিষ্যতে কোন না কোন এক সময় করাতে পারেন।
তো এই হল ব্যাপার – সৌন্দর্য এবং বার্ধক্যের সম্পর্ক নিয়ে থিওরী অনেক আছে, ম্যাগাজিন ইত্যাদিতেও পরামর্শ, সার্ভে বলে অনেক কিছু চালানো হয়। কিন্তু ‘কোয়েষ্ট অবসার্ভেটরী’ ফ্রান্সে প্রথম এত গভীরে গিয়ে অন্যালেসিস করল – দেখালো যে আজকের যুগে নারীরা নিজেরা কিভাবে বার্ধক্য ব্যাপারটা দেখছেন এবং তা রোধের প্রচেষ্টায় তাঁরা কি কি করতে রাজি। এই সমীক্ষার ফলাফল ভারতীয় নারীদের উপর সরাসরি প্রযোজ্য ধরে নিয়ে আলোচনা চালালে হয়ত হবে না। ফ্রান্সের সমাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যাপার গুলি আমাদের থেকে অনেক আলাদা – তাই ভারতীয় প্রেক্ষিতে এমন একটা সমীক্ষা চালালে মন্দ হয় না! সেই সমীক্ষা থেকে হয়ত দেখা যাবে ভারতীয় নারীরা এই অ্যান্টি-এজিং কসমেটিক্স কোম্পানীগুলির ভাঁওতাবাজিতে কতটা প্রভাবিত। জানি না এই ধরণের কোম্পানীগুলির ভাঁওতাবাজী থামানোর কোন উপায় আছে কিনা, কিন্তু একটা সচেতনা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানোই যায়।
তবে একটা অনুসিদ্ধান্ত কিন্তু নেওয়াই যায় – যা মনে হয় কোন দেশ বা সামাজিক গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়। ত্বকের যত্ন না নিলে কেস কেলো। সব বয়সের নারীরাই (এবং পুরুষেরাও) নিজেদের সুন্দর দেখতে ভালোবাসেন। ‘গ্রেসফুলি এজিং’ ব্যাপারটায় প্রায় অনেকেই সচেতন। প্রায় সবাই কোন না কোন পদক্ষেপ নেয় – কেউ কেউ আবার বেশী সময় অর্থ ব্যায় করেন এর মধ্যে। আর আমরা যতই বলি সৌন্দর্য নির্ভর করে কে দেখছে তার উপর, কিন্তু তার পরেও কিছু কথা থেকে যায় যা বাস্তব – মুখের সৌন্দর্য কিন্তু এখনও আমাদের মানসিক ভাবে প্রভাবিত করে সামগ্রিক সৌন্দর্যের বিচারে। আর জগতে মহাকর্ষের মত এই সব কিছুকে এক সাথে বেঁধে রেখেছে ত্বকের বাহ্যিক প্রকাশ। তাই সবশেষে পরামর্শ সেটাই –
ত্বকের যত্ন নিন
A. Ehlinger-Martin et. Al, “Women’s attitudes to beauty, aging, and the place of cosmetic procedures: insights from the QUEST Observatory”, Journal of Cosmetic Dermatoloty, v.15, pp 89-94, 2015.