আমাদের গ্রামের জন ডেভিস এই অঞ্চলের সর্বাধিক বিক্রিত সাপ্তাহিক পত্রিকা উওকিং নিউজ অ্যান্ড মেলের মুদ্রক ও প্রকাশক; ন্যাপহিলের প্রফুল্ল সরকার অথবা রুপারট মার্ডক! যা কিছু ছাপার প্রয়োজনে জনতা তাঁর দ্বারস্থ হয়। একই মেশিনে কনজারভেটিভকে শাপ শাপান্ত করে শানিত লেবার পার্টির ইস্তেহার, সেই দুই পার্টিকে কঠোর আক্রমণ করে লিব ডেমের বার্তা মুদ্রিত হয়ে থাকে। জনের কাছে শুনেছি নির্বাচনের আশে পাশে বিভিন্ন দলের প্রার্থী সময়ে অসময়ে তাঁর অফিসে হাজির হন, ভোটের হাওয়া বুঝতে। আমার মেয়ের বিয়ে হয়েছে কলকাতায়, বর্ধমান রোডের বিজয় মঞ্জিলে,কার্ড দেশে ছাপানো হয়েছিল। কিন্তু আমরা ছত্রিশ জন বিদেশি অভ্যাগতদের জ্ঞাতার্থে বিয়ের নিয়ম কানুন ইংরেজিতে অনুবাদ করে কিছু হ্যান্ডআউট বিলি করি – সেগুলো ছাপা হয় জনের ন্যাপহিল প্রিন্ট কোম্পানিতে। সেই সূত্রে আলাপ। এককালে তিনি ছিলেন ডাক সাইটে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার, লন্ডন নিউ ইয়র্ক আসা যাওয়া করতেন যেমন আমরা এপাড়া ওপাড়া করি। অনিয়ম এবং অ্যালকোহলের কঠোর প্রভাব পড়ে শরীরে, উচ্চ রক্ত চাপে ভোগেন (২১৬ পৌঁছেছিল)। সেই সময়ে স্থানীয় থাই বুদ্ধ মন্দিরের এক সাধু তাঁর কাছে এসেছিলেন ছাপার কাজে। জনের সমস্যা শুনে বলেন যদি সময় করতে পারেন, আসুন আমাদের মন্দিরে। আপনাকে বৌদ্ধ ধর্ম নিতে হবে না, এক ঘণ্টা ধ্যান করুন খানিক ধম্মের কথা শুনুন। জন তাই করে মনে শান্তি পেয়েছেন ও শরীরের রক্ত চাপকে শাসনে রেখেছেন।
আমি সে সময়ে ইউরোপ দক্ষিণ এশিয়া আফ্রিকাময় উদ্ভ্রান্তের মত ব্যবসা খুঁজি। বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি? সে আমার নয়। জন হেসে বলেছিলেন, এই পাগলা গারদ থেকে একদিন আপনিও মুক্তি পাবেন, সেদিন জানবেন আপনাকে ছাড়াও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক চলতে পারে, ভালো ব্যবসাও করতে পারে। তখন আসবেন আমার সঙ্গে, দু দণ্ড বিশ্রাম নেবেন মন্দিরে! ভালো চা বিস্কিট খাওয়ায়, ফ্রি!
একদিন মনে হলো - আজি এ দিবসে হয়েছে সময়! এবার যাবো; কিন্তু মন্দির কোথায়, কতদূরে ?
জন বললেন, আপনি তো ন্যাপহিল ফুটবল মাঠ চেনেন, ঐ পথে পয়লা রাউন্ড অ্যাবাউট থেকে সোজা গেলে যে গিরজের চুড়ো দেখবেন, সেটি থাই মন্দির।
পাঁচশ বছরে আগে পোপ বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি দিলেন না বলে ক্ষিপ্ত হয়ে ইংল্যান্ডের রাজা হেনরি বললেন আপনি থাকুন রোমের পুরুত হয়ে; আমি একটা আলাদা গিরজে খুলে স্থানীয় পুরুতের অনুমতি নিয়ে নেবো। সেই সৃষ্টি হল চার্চ অফ ইংল্যান্ড। সেথায় ভজনাকারীর সংখ্যা দীর্ঘকাল যাবত নিম্নগামী- মেরে কেটে দেশের এক অষ্টমাংশ নাগরিক সপ্তাহে একদিন সেখানে মাথা ঠোকেন কিনা সন্দেহ। দেবালয়ে প্রদীপ জ্বালানোর খরচা জোটে না। ফলে অনেক গিরজে নিলামে উঠেছে – গুজরাতিরা কিনে সংস্কার করে ভদ্র চেহারা দিয়ে কনভার্ট করেছেন স্বামী নারায়ণ মন্দিরে, শিখরা বানিয়েছেন গুরুদ্বারা। কিছু নাইটক্লাব এবং পাবেও পরিবর্তিত হয়েছে।
ন্যাপহিলেও তা হয়েছে জানতাম না।
বুদ্ধদেবের জীবন ও বাণী, শুধু সিংহল নয় পূর্ব দিগন্তে তার বিস্তারের কাহিনী বাল্যকাল থেকে জানা কিন্তু সেই পরিব্রাজকদের ম্যাপের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। আমাদের সময়ের কলকাতায় কেবল পশ্চিম পানে চেয়ে থেকেছি, পুব দিকে নয়। ছোটবেলায় দেশাত্মবোধক গান শুনেছি ‘সন্তান যার তিব্বত চিন জাপানে গঠিল উপনিবেশ /তার কেন এই মলিন বসন, তার কেন এই রুক্ষ কেশ’। জাপানে ভারতীয় উপনিবেশ গড়ার ব্যাপারটা ফেক নিউজ বলেই উড়িয়ে দিয়েছি। বহু বছর বাদে আংকর ভাটের মন্দিরে ভারতীয় মন্দিরের নিখুঁত কপি দেখলাম- দেওয়ালে রামায়ণ মহাভারতের গল্প, মন্দিরের মাঝে মেরু পর্বতের রেপ্লিকা। সে এক আশ্চর্য আবিষ্কার।
থাই মন্দিরে সপ্তাহে দু দিনের অধিবেশন, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার সন্ধ্যে সাতটা থেকে নটা। পঞ্চাশ মিনিট ধ্যানাভ্যাস, বিরতি তারপর ধর্ম আলোচনা। তার ভিত্তি বুদ্ধের জীবন ও বাণী। কিন্তু প্রশ্নোত্তরের আসরে যে কেউ তাঁর আপন ধর্ম বা জীবন নিয়ে কথা বলতে পারেন – কোন কিছুরই কোন সঠিক উত্তর হয় না। আমরা সব প্রশ্নই কি জানি? বিভিন্ন দেশ ও ধর্মের মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। থাইল্যান্ড ভ্রমণ করুন অথবা পাতাইয়াতে, টু বি এইচ কের ফ্ল্যাট সুলভে পাবেন এমন কোন পোস্টার দেখি নি। জন শারীরিক সুফল পেয়েছে কিন্তু তাই বলে এটিকে আরোগ্য নিকেতন মনে করারও কোন কারণ দেখি না।
বুদ্ধ আখ্যানের পরিচিতি করানো হয় কম্পিউটার স্ক্রিনে। সেখানে অনেক থাই শব্দ চেনা মনে হল – কানে শুনে নয়, ইংরেজি অক্ষরে লেখা দেখে। অন্তত চল্লিশ শতাংশ থাই শব্দ তদ্ভব, সংস্কৃত থেকে পালিতে স্নান করে এসেছে। আগাম বলে দেওয়া প্রয়োজন সংস্কৃতের দূর সম্পর্কের নাতনি হলেও থাই ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা নয়, তার উচ্চারণ, শব্দবন্ধ, সন্ধি সমাস সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কিন্তু আমরা মিল খুঁজে পাই শব্দে - ব্যাংককে আপনার প্লেন নামে সুবর্ণভূমি বিমান বন্দরে। মৃত্যু- মরণ, মাহা – মহা, মানুত -মানুষ, রাজার উপাধি - ভূমিবল অতুল্য তেজ।
তেমনি জানতাম না থাই আর বাংলা নববর্ষ প্রায় একই বন্ধনে বাঁধা, থাইল্যান্ডে এই পরবের নাম সংক্রান, খমের শব্দ ( আমাদের সংক্রান্তি )। টেকনিক্যালি সংক্রান্তি প্রতিমাসে ঘটে কিন্তু যে দিনে সূর্যদেব মীন রাশি থেকে মেষ রাশিতে প্রবেশ করেন সেটি বিশেষ দিন, নববর্ষ। সূর্য সিদ্ধান্ত অনুসারে এটি ১৪ বা ১৫ এপ্রিলে ঘটতে পারে। তাই হয়তো আমাদের নববর্ষের দিন বদলায়। আমি সঠিক জানি না। তবে থাই সরকার এটিকে ১৩ই এপ্রিলে বেঁধে দিয়েছেন (যদিও খাতাপত্র লেখা ও সকল সরকারি কাজের জন্য পয়লা জানুয়ারি থেকে নতুন বছর শুরু)। অতএব থাই নববর্ষ এপ্রিল মাসের তেরো তারিখ, সংক্রান্তি যেদিনেই পড়ুক না কেন। পরবের ছুটি চলে দিন সাতেক (চিনের মতন), পরিবার পরিজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ,উপহার বিনিময়ের সুবিধার্থে।
এই একই দিনে নতুন বছর পালিত হয় কামবোদিয়া ও লাওসে।
থাইল্যান্ডে দোল নেই। কিন্তু নববর্ষের দিনে আছে জল ছোঁড়াছুঁড়ির খেলা। এপ্রিল মাসে বেজায় গরম। লাওস কামবোদিয়া থাইল্যান্ডের পথে ঘাটে সেদিন জল আক্রমণের ধুম পড়ে যায়; মারো পিচকারি! সেটা ছবিতে মাত্র দেখেছি। আমাদের এই মন্দিরে তার একটা ছোটো এডিশন আছে – এক ভিক্ষু ঝ্যাঁটা দিয়ে সবার মাথায় জল ছড়িয়ে দেন। দুঃখের বিষয় যে থাইল্যান্ড বা লাওসের স্টাইলে আমরা তাঁকে জল কামান দিয়ে আক্রমণ করতে বা তাঁকে পাল্টা ঝাপটা মারতে পারি না! নববর্ষের পরবের অন্য রিচুয়ালগুলি মোটামুটি অনুসরণ করা হয়ে থাকে ন্যাপহিলের অনুষ্ঠানে - যেমন প্রার্থনার পরে ভিক্ষুদের খাদ্য দ্রব্য দান। সকলে আনেন কিছু না কিছু, সার দিয়ে বসে থাকেন দানের জন্য, ভিক্ষু সেটি গ্রহণ করলে পরেই স্থান ত্যাগ করতে পারেন। অল্প বয়েসি ছেলে মেয়েরা বয়স্ক নারী ও পুরুষের পা ধুইয়ে দেন, পিতা মাতার গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক সেটি। পুণ্য অর্জনের আরেকটি পন্থা - বুদ্ধ মন্দির বা স্তূপ নির্মাণে শ্রমদান। মাঠের মধ্যে বালি দিয়ে তৈরি স্তূপ মন্দির আছে, দূরে এক কোনায় রাখা বালির পাহাড়; সেখান থেকে পাত্র ভরে কিছুটা বালি এই নির্মীয়মাণ মন্দিরে পৌঁছে দেওয়াটা একটা সিম্বলিক সহায়তা। সাথে হয় কম করে পঞ্চাশ প্রকারের খাদ্য দিয়ে লাঞ্চ! নববর্ষের এই দিনে নতুন জামা পরা আবশ্যিক, নিজের বা পরিবারের জন্য অর্থ ব্যয় কম, দান বেশি এবং মদ্যপান বারণ!
কলকাতা থেকে ব্যাংকক পুব দিকে আড়াই ঘণ্টার উড়ান – সে দেশের প্রথা প্রচলনের সঙ্গে পরিচয় হলো আট হাজার কিলোমিটার দূরে পশ্চিমের এক দ্বীপে।
১৩ই এপ্রিল ২০২৪
মোক্ষ গাল রাম ক্ষম ১, সাল ২৫৬৭
(বুদ্ধের পরিনির্বাণ থেকে)