পাখিদা-কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুই নম্বর রামমোহন কলোনির একমাত্র
ছাতিম গাছ জানায় পাশের জামগাছটিকে। বাতাসে নড়ে ওঠে গাছেদের কানের পাতা।
ডালে আলোড়ন, ফিসফিস। পাড়ার গলি-রাস্তার মাঝ বরাবর শুয়ে থাকা কালিচরণের
অভ্যেস। সাইকেল, বাইকের হর্নে তার কিছুমাত্র আসে যায় না। তাকে সম্ভ্রমে
পাশ কাটিয়ে বাকিদের যেতে হয়। লম্বাটে সরুপানা মুখটায় চোখদুটো আধবোজা।
‘মাধবীবিতান’ বাড়ির ঘোষালদাদু রেডিয়োয় খেয়াল শোনার সময় যে ভাবে কেদারায়
শুয়ে চোখ বুজে আরামে তন্দ্রা আনে। কালিচরণের লটপটে কান সজাগ। খবরটা শুনেই
গা ঝাড়া দিয়ে ‘মনমঞ্জরী’ বাড়ির প্রশস্ত পাঁচিলে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ভুক
করে একটা শব্দে পঞ্চাননকে ডাকে, এ পঞ্চা! বাড়ির আদুরে, সুখের সাদা রোম
গায়ে নিয়ে পঞ্চা রান্নাঘরের জানালার কাচে নাক থেবড়ে রাখে। পাখিদাকে খুঁজে
পাওয়া যাচ্ছে না, তার চোখ ফেটে জল আসতে চায়। পাখিদা ছাড়া এই বেড়াল-জন্ম
মিথ্যে। একমুঠো বয়সে ড্রেনে উলটে পড়ে ছিল। পাখিদা তাকে সেখান থেকে তুলে
ধুইয়ে, মুছিয়ে গরম সেঁক দিয়ে, ড্রপারে দুধ খাইয়ে ‘মনমঞ্জরী’-তে রেখে যায়।
কালিচরণ গোটা পাড়া ছুটে বাকি কুকুরদের খবরটা দেয়। দশ-বারোটা কুকুরের
জটলা জমে রাস্তার ওপর। ‘আলোক-প্রভা’ বাড়ির প্রভা দিদিমণির স্কুলে যাওয়ার
স্কুটি কুকুরের পালে আটকে গেলে ভয় আর বিরক্তিতে গজরায়, রাবিশ, গোটা
কলোনিটা নেড়িকুত্তায় দখল নিয়ে নিয়েছে। দলবদ্ধ ভাবে এরা কামড়ে-নখরে
মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে একদিন, ভাবনার ভেতর আঁতকে ওঠে, মানুষ নেই, গোটা
পাড়ার বাড়িগুলো গিজগিজ করছে ঘেয়ো কুকুর!
পাখিদার খোঁজে কলোনির দিগ্বিদিগে ছিটকে যায় কুকুরের দল। পাখিদা ছাড়া
তাদের রাতের আহার বন্ধ। পাখিদার মুখে হুইসল, পোঁটলায় খাবার নিয়ে পাড়ার
গলির মোড়ে মৃদু পথবাতির তলায় ফুরর বাঁশি বাজায়। বাঁশির ডাক শুনে ছুটে আসে
কলোনির যতো কুকুর। তারা পায়ে এসে লুটিয়ে পড়ে, দুই পা তুলে পাখির গায়ের
ওপর উঠে পড়তে চায়। পাখি জোরে হুইসল বাজায়, ডিনার রেডি, কোনো ঝামেলা না!
রাস্তার ওপর ঢালে ভাত, রান্না করা ব্রয়লার মুরগির ছাঁট। যতেক ক্ষুধার্ত
কুকুরের হাপুস হুপুস খাওয়ার শব্দ রাতের কলোনি জুড়ে। রসভরা জিভে রাস্তা
চেটে পরিষ্কার হয়ে যায়, এক কণা ভাতও পড়ে থাকে না।
দুই নম্বর রামমোহন কলোনির প্রান্তে একটুকরো বস্তিপাড়ায় পাখি দোলই এসে
উঠেছিল কবে কেউ জানে না। পলিথিন মাথার একটা ঝোপড়া, তারও মালিক আছে, ভাড়া
গুণতে হয়। বস্তির লোকের খবর বস্তির লোকেরাই রাখে। বাড়ির কাজের সান্টু
মাসি রাখে। ‘চন্দ্রতপা’ আর ‘মেখলা’ এই দুই বাড়ির কাজে সে যায়। রান্নার
দীপালিদি রাখে। ‘ছায়াবীথি’ আর ‘ভালো-বাসা’ বাড়িতে রান্নার কাজ করে সে।
কলোনির সাইকেল পাম্প দেওয়া লোটনদা রাখে, বাইকের চেন টাইট করা কালিমাখা
জামার স্বপনদা রাখে, ‘অন্তরীণ’ ফ্ল্যাটের বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া
টোটোয়ালা মকাইদা রাখে। পাখি দোলইয়ের দুটো বাচ্চা প্রাইমারি স্কুলে
ওয়ান-টুয়ে পড়ে। পাখির বউ, 'অন্বেষা' নামে ফ্ল্যাটে ধোয়া-মোছার কাজ করে
সংসার টানে। পাখির ঘর-সংসারের কাজে মন নেই। বউ দিনরাত অশান্তি করে। পাখি
তখন কটা পোকা বেগুন পাকা উচ্ছে ঢেঁড়স নিয়ে রাস্তার ধারে বসে পড়ে। দরদাম
জানে না, হাফ দামে লোককে জিনিস দিয়ে দেয়, কেউ পয়সা দিতে না পারলে ফ্রিতে
দিয়ে আসে। লোকের বাড়ির জলের ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের কাজে হঠাৎ ঘুরে আসছি বলে
কোথায় গিয়ে আর ফেরে না। লোকে তাই ডাকে না তাকে আর। বাগানের কাজ তার
পছন্দের। ঘাস নিড়ান, গাছের তলায় মাটি দেওয়া, ফুলগাছ লাগানো, তাতে ফুল
এসেছে কীনা লোকের বাড়ি গিয়ে বারেবারে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে, লোকে তাই
মালির কাজেও ডাকে না আর। তার লাগানো গাছে ফুল এলে পাঁচিলের ধারের বড় গাছে
উঠে জুলজুলে চোখে চেয়ে থাকে। টোটোয়ালা মকাইদা জ্বরে পড়লে তার টোটোটা নিয়ে
বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসে, নিয়ে আসে। হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে চালায়।
বাচ্চারা তার সঙ্গে হৈহৈ করে যায়। দীপালিদির বাজারের ব্যাগ বয়ে দিয়ে আসে,
সান্টু মাসির হাঁটু ব্যথার তেল, লোটনের পাংচারের টিউব গামলার জলে ডুবিয়ে
অবাক চোখে জলের বুড়বুড়ি কাটা দেখে! পাখি চরম অকাজের একটা লোক বউয়ের বুঝতে
বাকি থাকে না। হাল ছেড়ে দেয়। পাখি এদিকসেদিক টো টো ঘুরে বেড়ায়। পিছু ঘোরে
পাড়ার কুকুররেরা, ঘরের খাটে তার গায়ে লুটিয়ে থাকে বেড়ালের দল। ‘সাজন’
ছবির সঞ্জয় দত্ত-র কাঁধ-ছোঁয়া চুল নিয়ে গলি রাস্তায় হাঁটে শিস দিয়ে। তার
কাঁধের দাঁড় আঁকড়ে বসে থাকে একটা শালিক। ঝড়ে আধমরা হয়ে গাছের তলায়
পড়েছিল, ঠোঁট ফাঁক করে মুখে দিয়েছে বিন্দু জল।
সার্থকনামা। তাকে খুঁজে না পাওয়া গেলে লোকে গাছের ডালে তাকিয়ে যায়।
দিনভর কাটায় গাছে গাছে। পাতার আড়ালে ডালে ঠেস রেখে ঘুমোয়। ফলবতী গাছে
ইচ্ছে হলে হাত বাড়িয়ে একটা ছিঁড়ে এনে কচরমচর চিবোয়। কারও দেওয়া স্ক্রিন
ফাটা থার্ড-হ্যান্ড মোবাইলে হিন্দি গান চালিয়ে শোনে চোখ বুজে। দীর্ঘ
গাছের মাথায় উঠলে শহরটা দেখা যায়। ছবির মতো বাড়িঘর। পাখি একটা বাড়ির
স্বপ্ন দেখে। গেটের পিলারে হরেক নামের বাড়ি। কুকুর, বেড়ালের খাবার জোগাড়ে
বাড়ি ঘুরে গালি খেয়েও পাঁচ টাকা-দশ টাকা সংগ্রহ করে। বাড়ির নাম পড়তে পড়তে
যায়। 'নষ্টনীড়'-এর সামনে থমকে দাঁড়ায়। নীড় মানে বাসা, বাসা মানে ঘর,
যে-ঘর নষ্ট হয়ে গেছে। লোকে বাড়ির নাম এমন কেন দেয়? পাড়ায় মাছ নিয়ে বসে
সাজ্জাদ। বলে, অত ভেবে তুই কী করবি পাখি, টাকায়ালা লোকের চমকাই আলাদা,
মানে-ফানে জেনে কী হয়, যার বাড়ি নেই তার বাড়ির নাম! তুই বাড়ি বানালে নাম
দিবি পাখির বাসা! সাজ্জাদ খিখি হাসতে থাকে।
কুকুরেরা ছড়িয়ে পড়েছে এপাড়া, সে-পাড়া। কালিচরণ রাত অব্দি ছুটে বেড়ায়,
অন্য কুকুরদের কাছে খোঁজখবর করে, কেউ বলতে পারে না পাখি কোথায়। বেড়ালরা
হরেক নামের বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়। অন্দরের কথায় পাখিদার খোঁজ পাওয়া যায়
যদি। যতেক শালিক, চড়ুই, আকাশে ঘুরপাক খাওয়া কাকের দল উড়ে যায় তার খোঁজে।
একটা কাকের প্রতিও তার মায়া। ইলেকট্রিকের শক খেয়ে মরা কাকের দেহ দু-হাতের
আগলে ভরে হাঁটতে থাকে। পিছু হাঁটে পাঁচ-ছটি কুকু্র, গোটা চারেক বেড়াল,
কাকেরা চক্কর দেয় মাথার ওপর, কাঁধে এসে বসে শালিকটা। বস্তির বাচ্চারা
হোহো করতে করতে যায়, পাখি ধমক দেয়। শবদেহ চলেছে শ্মশানের পথে অথবা জানাজা
যায় কবরস্থানের দিকে। কাকের দাহ হয় নাকি গোর তারা জানে না। সে এক দেখার
মতো হয়। রাস্তার ধারে লোক দাঁড়িয়ে যায়, দোকান থেকে উঁকি মারে, রগুড়ে গলায়
কে বলে, ওরে কাক মরেছে, কেউ হরিবোল দে! ঝোপে-ঝাড়ে ভরা বিরহান জায়গায় মাটি
খুঁড়ে কাকটাকে রাখে যত্ন করে, মাটি দেয়। শিশু আর পাখিকে মাটির কোল দিতে
হয়। আগুনে তাদের বড় কষ্ট। প্রাণ নেই বলে শরীরের কষ্ট থাকে না এমনটা নয়।
লাল গোলঞ্চের ডাল ভেঙে পুঁতে দেয় কবরের মাটিতে, একদিন ফুল ধরবে।
জলজ্যান্ত একটা লোক উপে গেল অথচ দুই নম্বর রামমোহন কলোনিতে কোনো সাড়
নেই। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ কদিন হাই তুলে ঘোরাঘুরি করে অন্য
কেসে মন দিয়েছে। হরেক নামের বাড়িগুলিতে সন্ধ্যায় জ্বলে ওঠে আলো, রাত
অব্দি টিভি সিরিয়ালের গলা। ‘মাধবীবিতান’-এর ঘোষাল দাদু কেবল চোখ বুজে
খেয়াল শুনতে গিয়ে ভাবে পাখি তার রেডিয়োটা সারিয়ে এনেছিল একদিন। প্রভা
দিদিমণি স্কুলে যাবার পথে দেখে কয়েকটা নেড়ি শুয়ে আছে। খেতে না পেয়ে হাড়
জিরজিরে। মায়া হয়। আজ কি স্কুল থেকে ফিরে একবার এদের ডেকে একটু খাবার
দেবে সে, হুইসল নেই, ঠোট সরু করে শিস দিয়ে? মাছয়ালা সাজ্জাদ বিক্রিবাটা
শেষে আঁশজললাগা পলিথিন গোটাতে গিয়ে ভাবে, পাখি কি অন্য বাসার খোঁজে গেল,
যার নিজের মতো একটা নাম হয়? দিপালীদি ‘ছায়াবীথি’ বাড়ির রান্নাঘরে কড়াইতে
মাছের ঝোল ফোটা দেখতে দেখতে ভাবে পাখি কোথায় গেল? কাজের সান্টু মাসি
এক-দুবার আঁচলে চোখ মুছল, আহা রে রোগাভোগা ছেলেটা। পাংচার-টিউব গামলার
জলে ডুবিয়ে লোটন আনমনা হয় একবার। স্বপনদার বাইকের গ্যারাজে কিছুদিন জটলা
হলো বস্তির লোকেদের। পাখির মতো কাউকে দেখা গেছে রথতলার গঞ্জে। রথতলায়
দেখা গেলে কলোনিতে আসবে না কেন এপ্রশ্নের উত্তর কারো কাছে নেই। টোটোয়ালা
মকাইদাকে স্কুলের বাচ্চারা জিজ্ঞেস করে, পাখিদা কি ভ্যানিস হয়ে গেছে?
মকাই মাথা নাড়ে। চুপ করে টোটো চালাতে চালাতে ভাবে গোটা একটা মানুষ গায়েব
হয়ে যায় কেমন করে? বিশাল পিথিবি, গিজগিজ করা লোক, কেউ একজন তার হাত ধরে
ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারে না? মানুষের এই গহিন জঙ্গলের ভেতর পাখি পথ
হারিয়ে বসে আছে কোথাও? বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে সাইকেল নিয়ে পাড়া
রেকি করে। পাখির খোঁজে কেউ গোয়েন্দা হতে চায়। পাখির বউ রাতে দুইপাশে
ঘুমন্ত বাচ্চাদের নিয়ে একটু শ্বাস ফেলে অনেক রাতে।
লোকে পাখির কথা ভুলে যায়। অথবা মানুষের মনের যে অনেকগুলো তোরঙ্গ, তার
একটাতে মরচে ধরা তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থাকে। পাখি কিছুদিন কলোনির বাতাসে
ভাসমান ঘোরে। একঝলক শীতল হাওয়া হয়ে গলিপথ ঘুরে হুশ উড়ে যায় বাড়িগুলির
হরেক নাম ছুঁয়ে, ফ্ল্যাটের গা দিয়ে, লোটনের সাইকেল দোকানের বাইরে শিকে
ঝোলানো টায়ারে হাত রেখে, মাঝরাতে বাইরে একা পড়ে থাকা মকাইয়ের টোটোর সিটে
এলিয়ে, একটু ধোঁয়ার ফুস করে মিলিয়ে যাওয়া। কেবল তাকে ভোলে না কালিচরণ।
রোজ রাতে গলির মোড়ে মনখারাপি আলোর নিচে শুয়ে থাকে চোখ বুজে। মানুষের
এঁটোকাঁটায় কলোনির এতগুলো কুকুরের পেট ভরে না। লোকের ফেলে দেওয়া খুঁটে
খাওয়ার জীবন ভালো লাগে না। ধুঁকেধুঁকে অসুখে মরে কেউ, দেহ রাস্তায় পড়ে
পচে ফুলে ওঠে, লোকে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে তফাতে হেঁটে যায়। অপমানিত
দেহগুলি যত্নে মাটি দিয়ে আসার কেউ থাকে না। কুকুরেরা খাবারের খোঁজে ভিন
পাড়ায় যায়। খাবারের ভাগ নিয়ে ঝগড়ায় বিক্ষত হয় বেপাড়ার কুকুরের হাতে।
কলোনি নিশ্চুপ হয়ে এলে রাতগভীরে কালিচরণ হুইসলের ডাক শোনে ক্ষীণ। তার কান
খাড়া হয়ে উঠেছে একেকবার। মুখ তুলে তাকিয়েছে। ভোরের স্বপ্নে কালিচরণ দেখে
পাখিকে। রোগা কালো ঢ্যাঙা চেহারার একটা ছায়া হেঁটে যায় হুইসল বাজিয়ে।
কাঁধে বসে একটা শালিক। পেছনে অভুক্ত প্রাণীর দল মন্ত্রমুগ্ধ চলেছে, তাদের
একটি করে মিলিয়ে যাচ্ছে ভোরের আবছা বাতাসে।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠে কালিচরণ হাঁটে সেই ছায়ার দিকে।