ঝাঁসি থেকে শুরু
কর্ণাটকের উদুপী থেকে ০৮.০১.২০ রাতে স্লীপার ক্লাসে উঠেছিলাম শুধু একটা ফুলহাতা জামা পরে। উপকুলবর্তী শহর বলে ওখানে জানুয়ারিতেও শীতের লেশমাত্র নেই। পরদিন বিকেলে নাসিকে পেলাম শীতের আমেজ। রাত বাড়তে চলন্ত ট্রেনে মধ্যপ্রদেশের শীতের দাপটে পরতে হোলো উলের টুপি, জ্যাকেট, উইন্ডচিটার। দুরাত ট্রেনে কাটিয়ে ১৯০০ কিমি পাড়ি দিয়ে ১০ তারিখ সকাল সাতটায় ঝাঁসিতে নেমে টের পেলাম - বেশ ঠান্ডা। বুন্দেলখন্ডের প্রবেশপথ এই পাহাড়ি শহরের আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন। তাপমাত্রা গ্ৰীষ্মে উঠে যায় ৪৮, শীতে নেমে যায় ২ ডিগ্ৰী সেন্টিগ্ৰেডে।
ঝাঁসি আগে এসেছি। তাই শেয়ার অটোয় গেলাম ৫ কিমি দুরে ওরছা রোডের বাসস্ট্যান্ডে। মহারাষ্ট্রে দূরপাল্লার বা স্থানীয় সরকারি বাসের সার্ভিস ভালো। মধ্যপ্রদেশে সরকারি বাসের সার্ভিস অপ্রতুল। ওখানে রমরমিয়ে চলে প্রাইভেট বাস। তবে তার সার্ভিসও ভালো। নিয়মিত ব্যবধানে পাওয়া যায়। বাসের অবস্থা খারাপ নয়। চলে নির্ধারিত সময় মেনে। স্ট্যান্ড থেকে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যত্রতত্র দাঁড়িয়ে যাত্রী ডাকাডাকির চল নেই।
গড়গড়িয়ে করেরা
ঝাঁসি থেকে করেরার দূরত্ব ৪৭কিমি। শীতের সকালে প্রায় খালি বাস ছ লেন হাইওয়ে ধরে চলছে মসৃণ গতিতে। কানপুর ঝাঁসি শিবপুরীর সংযোগকারী ২৭ নম্বর জাতীয় সড়ক শিলচর পোরবন্দর ৩৫০৭ কিমি দীর্ঘ ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরের অন্তর্ভুক্ত ভারতের দ্বিতীয় দীর্ঘতম জাতীয় সড়ক। সোয়া ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম করেরা। নামেই নতুন বাসস্ট্যান্ড। থানা পেরিয়ে PWD রেস্টহাউসের কাছে পুরোনো শিবপুরী রোডের দুপাশে দাঁড়ায় বাসগুলো। মূলতঃ করেরা থেকে ঝাঁসি ও শিবপুরীর লোকাল বাস। ঝাঁসি শিবপুরী সরাসরি বাস বা দূরপাল্লার বাস ৫কিমি দীর্ঘ করেরা বাইপাস দিয়ে চলে যায়। করেরা শহরের মধ্যে সব্জি মন্ডীর কাছে একটা পুরোনো বাসস্ট্যান্ডও আছে। সেখান থেকে ছোটবাস যায় আশপাশের গাঁ-গঞ্জে।
PWD রেস্টহাউসে চারটে দ্বিশয্যার ঘর। খালি থাকলে SDM এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে থাকা যায়। ভাড়া চারশো টাকা। চৌকিদার জানালো সরকারি লোকজন আসার কথা আছে তাই ঘর পাওয়া যাবে না। পিঠে ৭০লিটারের Ajungilak স্যাক। নরওয়ের এই স্যাকটা ১৯৮৭ সালে কিনেছিলাম কাঠমান্ডুতে পর্বতারোহণের যন্ত্রপাতি বিক্রির বাজার থেকে। বহু সফরের সঙ্গী। উজ্জ্বল নীল রঙ বিবর্ণ হয়ে গেছে। তবু কোথাও ছেঁড়েনি, সেলাই খোলেনি। ওটা সেবারের দুমাসব্যাপী একাকী সফরের সঙ্গী। ওজন হয়েছে ১১ কিলো। বুকের ল্যাপটপ স্যাকটা জল, কিছু খাবার, টুকিটাকি নিয়ে ৫ কিলো।
চললুম বাগানবাড়ির হনুমানজীর ভরসায়
রেস্টহাউসে জায়গা না পেয়ে কলা, মটরশুঁটি কিনে প্ল্যান-বি অনুযায়ী চললুম বাগিচাওয়ালে হনুমান মন্দিরে। বাসস্ট্যান্ড থেকে ডানহাতি রাস্তা ধরে বুকে পিঠে দুটো স্যাক নিয়ে দুলকি চালে যাচ্ছি এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতে। উল্টোদিকে একটা দোকানে চোখ পড়তে একটি যুবক "এহই, Hello" বলে উদ্ধত ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলো। দোকানে আরও কয়েকটি ছেলে দাঁড়িয়ে। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে। মাথায় টুপির ওপর দিয়ে বৌয়ের একটা বাতিল গেরুয়া উড়নি মুখে, ঘাড়ে জড়িয়েছি যাতে সানবার্ন না হয়। টুপির হুডের তলা দিয়ে কেবল আমার চশমা পড়া চোখ জোড়া দেখা যাচ্ছে। হয়তো একটু অদ্ভুত লাগছিল। ডাকার কারণ সেটা কি না জানি না। আমি দাঁড়াই। ওদের দিকে তাকিয়ে নিজের বুকে তর্জনী ঠেকিয়ে ইশারায় জানতে চাই - ঐ ডাক কী আমার উদ্দেশে?
ছেলেটি মাথা নেড়ে সায় দেয়। আমি পাঞ্জা নাড়িয়ে ইশারায় জানতে চাই, কী ব্যাপার? ছেলেটি হাত নাড়িয়ে আমায় কাছে ডাকে। আশ্চর্য! বুকে পিঠে স্যাক নিয়ে, উঁচু ডিভাইডার টপকে রাস্তা পেরিয়ে মহারাজের কাছে গিয়ে জানতে হবে - বলুন জাঁহাপনা - কী ব্যাপার! ছেলেটির বেয়াদবি দেখে পিত্তি জ্বলে যায়। জ্ঞানত কোনো বেচাল করিনি। দরকার হলে সে কাছে এসে বলবে কী ব্যাপার। আমি ওর পিতৃদেবের খানসামা নই যে হাত ইশারায় ডাকলেই যেতে হবে। পাত্তা না দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে চলতে শুরু করি। আর ডাকে না। আমিও পিছন ফিরে দেখিনি। মধ্যপ্রদেশে অনেকবার এসেছি। এমন অভদ্রতা আগে দেখিনি।
ফুটাতালাওয়ের পাশ দিয়ে এলাম চাঁদ দরওয়াজা তেমাথায়। ওখান থেকে বাঁদিকে পৌনে এক কিমি গিয়ে মন্দির। বত্রিশ ঘন্টা ট্রেন, সোয়া ঘন্টা বাস জার্নি করে পৌনে এক ঘন্টা হেঁটে এসে পৌঁছলাম সোয়া দু কিমি দুরে মন্দিরে। অটোকে চল্লিশ টাকা দিলেই ছেড়ে দিতো। তবু এসব আমি করি অন্য কারণে। কেবল পয়সা বাঁচাতে নয়।
মন্দিরটা জনপদের উত্তর পশ্চিমে একান্তে। বাড়িঘর নেই। চারপাশে চাষের জমি। মন্দিরের আধা কিমি পিছনে করেরার জীবনরেখা মহুয়ার নদী। সিন্ধের এই শাখানদীর অতীতে নাম ছিল মধুমতী। নদীর ওপারে জনবিরল পাথুরে প্রান্তর। এখানে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা না হলে তিন কিমি প্ল্যান-সি অনুযায়ী অটোতে যাবো ITBP ট্রেনিং এরিয়ায় গুরুদ্বারাতে। লাস্ট অপশন প্ল্যান-ডি, বাইপাসে সেখানকার দুটি মাত্র হোটেল, সাই দরবার বা মানস সরোবরের কোনো একটায়। তাতে বাজেট হড়কে যাবে।
মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন স্বাস্থ্যবান এক শ্মশ্রুগুম্ফময় ষাটোর্ধ্ব গেরুয়াধারী। পূজারী রাজেন্দ্রগিরি মহারাজ। নমস্কার করে সংক্ষেপে আমার মনোবাসনা জানাই। উনি নীরবে সব শুনে বলেন, আইয়ে মেরে সাথ। মূল হনুমান মন্দিরের পশ্চিমে উঁচু চাতালের উপর একটি শিব মন্দির। তার পিছনে বড় ভাঁড়ার ঘর। সেখানে দুটো চৌকি পাতা। মানে চাইলে কেউ সেখানেও থাকতে পারে। উত্তরে দুটি ঘর। সেখানে থাকেন উনি ও প্রধান মহন্ত স্বামী রুদ্রচেতন মহারাজ। দক্ষিণে একটা মাঝারি ঘরে একটা চৌকি পাতা। দুজন শুতে পারে। ওপরে মলিন তোষক। আছে টিউবলাইট, প্লাগ, কুলার, ফ্যান। শেষোক্ত দুটি তখন অপ্রয়োজনীয়। পাশে একটা লম্বাটে বড় হলঘর। একপ্রান্তে বাথরুম ও দুটি শৌচাগার। কলের জল কনকনে ঠান্ডা। দেওয়ালে পেরেকে ঝুলছে ইমার্সন হীটার।
মহারাজ বলেন, দুর থেকে আগত ভক্তরা চাইলে এখানে রাতে থাকতে পারে। এখন কেউ নেই। এই হলে নয়, আপনার পোষালে ঐ ঘরে থাকতে পারেন। বলি, আমার কোনো অসুবিধা নেই, কত দিতে হবে? উনি বলেন, আপনি একা মানুষ, এতদুর থেকে এসেছেন, কিছু লাগবে না। যদি ভোজনপ্রসাদ নিতে চান, আগে বলে দেবেন। আমাদের যা রান্না হয়, আপনিও খেতে পারেন। বলি, ধন্যবাদ। থাকতে দিলেন এই যথেষ্ট। ভোজনের ব্যবস্থা আমি করে নেব। মহারাজ কম কথার মানুষ। স্মিত হেসে, বেশ, যেমন আপনার ইচ্ছা, বলে চলে গেলেন।
প্রথমেই তোষকের ওপর বড় প্লাস্টিক বিছিয়ে চারপাশে মুড়ে দিলাম। অপরিচ্ছন্নতা নিয়ে অস্বস্তির গল্প শেষ। এহেন অস্বস্তি নিয়ে কম খরচে একাকী ভ্রমণ সম্ভব নয়। দুদিন ট্রেনে চান হয়নি। গরম জল করে চান করলাম। ওজন কম রাখতে মাত্র দু সেট পাতলুন ও ফুলহাতা জামা এনেছি। গত দুদিন ধরে পরে থাকা জামাকাপড় কেচে মেলে দিলাম। সঙ্গের মুড়ি, বাদামভাজা, সদ্য কেনা মটরশুঁটি ও চিকি (বাদাম পাটালি) দিয়ে হয়ে গেল জলখাবার। বারোটা বাজে। এবার মনটা চা চা করছে। সকাল থেকে চা খাওয়া হয়নি।
অমায়িক ফৌজীভাই
ছোট স্যাকটা নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে পৌঁছে গেলাম চাঁদ দরওয়াজা। তেমাথায় বেঞ্চে বসেছিলেন এক বয়স্ক কিন্তু মজবুত চেহারার স্থানীয় মানুষ। আলাপ করি। হাফিজ আহমেদ। এলাকায় ফৌজিভাই নামে পরিচিত কারণ তিনি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জওয়ান। এখন শখ লোকজনের সাথে খোশগল্প ও পরোপকার। আলাপী মানুষটিকে প্রথম দর্শনেই ভালো লাগলো। জানতে চাইলেন, কোথা থেকে আসছি। কলকাতা, বাঙ্গালী শুনে অবাক হয়ে বলেন, কলকাতা থেকে এখানে বেড়াতে আসতে আমি অন্তত কাউকে দেখিনি। ট্যূরিস্টরা ঝাঁসি থেকে হয় গোয়ালিয়র নয়তো শিবপুরী অথবা ওরছা হয়ে চলে যায় খাজুরাহো। আপনি এখানে কি মনে করে?
বলি করেরা কেল্লা দেখতে। জানি গোয়ালিয়র কেল্লার তুলনায় আকারে বা ঐশ্বর্যে এটা তেমন কিছু নয় তবু এই সব অখ্যাত, প্রাচীন, ভগ্নপ্রায়, পর্যটকবিরল, নির্জন কেল্লা সময় নিয়ে দেখতে আমার বেশ লাগে। খানিক চুপ করে রইলেন ফৌজিভাই। তারপর বললেন, আপনি কতদুর থেকে দেখতে এসেছেন অথচ স্থানীয় সরকার কেল্লার রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে উদাসীন। এভাবেই আমাদের প্রাচীন সম্পদগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাবে। ওনার স্বরে আক্ষেপ।
বলি, হাফিজভাই, এখানে কোথাও চায়ের দোকান আছে? উনি বলেন, আছে তবে একটু দুরে, কোর্টের কাছে। তবে আপনি তো যাবেন কেল্লা, ওটা উল্টো দিকে হয়ে যাবে। আপনি এতদুর থেকে এসেছেন যদি আপত্তি না থাকে, কাছেই আমার গরীবখানা, বাড়ি থেকে চা আনিয়ে দিতে পারি। বলি, তাহলে তো বেশ হয়, ততক্ষণ আপনার কাছে এখানকার কিছু বৃত্তান্ত শুনতে পারি। আপনি অনেক খবর রাখেন মনে হয়। দৃশ্যত খুশি হলেন ফৌজিভাই। পাশেই কয়েকটি বাচ্চা ছেলে খেলছিল। একজনকে বললেন, এই ছোটু, যা তো, আন্টিকে গিয়ে বল, কলকাতা থেকে এক মেহমান এসেছেন, ভালো করে দু কাপ চা বানিয়ে দিতে বললো আঙ্কল। ছেলেটি খরগোশের মতো দৌড়ে চলে গেল।
হাফিজভাই জানতে চান, উঠেছেন কোথায়? বলি বাগিচাওয়ালে হনুমান মন্দিরে। উনি বলেন, বাঃ, বেশ। মন্দিরটি অনেক প্রাচীন। স্থাপনা করেছিলেন ভানগীর বাবা। মন্দিরের বাইরে বড় চত্বরটির নাম বাবাধাম। তার পাশে যে বড় বাগান তার নাম বাবাবাগিচা। তাই এই মন্দির বাগিচাওয়ালে মন্দির নামে পরিচিত। তবে অতীতে এই মন্দির ভানগীর বাবা মন্দির নামে প্রসিদ্ধ ছিল। তিনি ও তাঁর এক শিষ্য ধ্যানের মধ্যেই ওখানে যুগলে ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেন। ওখানে ওনাদের দুজনের সমাধিও আছে। এখনকার মুখ্য মহন্ত রুদ্রচেতন মহারাজ শাস্ত্রজ্ঞানী মানুষ। অনেক পন্ডিতজন আসেন ওনার সাথে শাস্ত্র আলোচনা করতে। অতীতে ত্যাগী মহারাজের সময়ে মন্দির থেকে শ দুয়েক মিটার দুরে যে প্রবেশ তোরণ আছে তার পরে মহিলাদের যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এখন আর সে নিয়ম নেই। মন্দিরের পূব দিকে করেরার গ্ৰামবাসীর ও বাইরের অনেক ভক্তের দানে তৈরি হচ্ছে বড়সড় রামজানকী মন্দির। সম্পূর্ণ হলে ও জায়গাটি আরো দর্শনীয় হয়ে যাবে।
বলি, কিছু মনে করবেন না হাফিজভাই, মুসলিম হয়েও আপনি তো এই মন্দির সম্পর্কে অনেক খবর রাখেন! উনি বলেন এখানে হিন্দু মুসলিম ভেদভাব নেই। বহুদিন ধরে আমরা মিলেমিশে আছি। এই দেখুন না খবর পেলাম ঐ মন্দিরে বার বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। গতকাল পর্ষদের ইলেকট্রিসিয়ানকে ধরে খুঁজে বার করলাম এক জায়গায় লুজ কনেকশন ছিল। দাঁড়িয়ে থেকে তা ঠিক করালাম। তারপর উনি কপালে হাত ঠেকিয়ে বলেন, ছোটবেলা থেকে এই মন্দিরের কথা অনেক শুনেছি। স্থানীয়রা এই হনুমানজীকে খুব জাগ্ৰত বলে মানে।
বলি, তাই নাকি, কিরকম? উনি বলেন, ধরুন দুজনের মধ্যে কোনো বিবাদ হয়েছে। একজন বলছে, আমার মনে হয় তুমিই আমার অমুক জিনিস চুরি করেছ। সে বলছে, না আমি করিনি। কোনো প্রত্যক্ষ্যদর্শী নেই যে সাক্ষ্য দেবে। তখন সে তাকে বলবে, চলো তাহলে বাগিচাওয়ালে হনুমানজীর কাছে। মন্দিরে শপথ নিয়ে বলবে, তুমি নাও নি। সে যদি তা বলে তাহলে বাদী বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবে, তাহলে হয়তো আমি ভুল ভেবেছিলাম।
জানা গেল অতীতে কেউ মিথ্যে শপথ নিয়ে হলফ করে বলায় তার অচিরেই বড় ক্ষতি হয়েছে। হয় গরু, বলদ বা সন্তান মারা গেছে নয়তো তারই কোনো দূর্ঘটনা হয়েছে। তখন সে মন্দিরে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছে মিথ্যে কথা বলার জন্য। এরকম কয়েকটি ঘটনার পর এটা চাউর হয়ে যায় যে ঐ হনুমানজী খুব জাগ্ৰত। তাই ছোটখাটো পারিবারিক বিবাদে এখনও অনেকে থানায় বা পঞ্চায়েতে না গিয়ে ঐ মন্দিরে যায়। রাজেন্দ্রগিরি মহারাজই এসবের মধ্যস্থতা করেন।
কথার মধ্যেই ছেলেটি দুটো পরিস্কার কাঁচের গেলাসে করে চা নিয়ে এলো। এমন প্রত্যন্ত এলাকায় কাপ, প্লেটে করে ট্রেতে চা দেওয়ার কেতা নেই। তাছাড়া বাড়ি থেকে খানিকটা দুরে চা আনতে গেলাসেই বরং সুবিধে। পরিমাণে পর্যাপ্ত স্বাদু চা। বেশ লাগলো। হাফিজভাই বললেন, কেল্লা দেখে ফেরার সময় অবশ্যই দেখে আসবেন গুপ্তেশ্বর শিব মন্দির। জনশ্রুতি প্রায় পৌনে দুশো বছর আগে যখন করেরা ব্রিটিশদের অধীনে ছিল তখন একদিন কিছু ব্রিটিশ সৈন্য জুতো পরেই ঐ মন্দিরে ঢুকতে যাচ্ছিল। পূজারীজী বারণ করা স্বত্ত্বেও তারা শোনেনি। হঠাৎই উপর থেকে একটা বড় পাথর হুড়মুড়িয়ে গড়িয়ে আসে। সৈন্যরা কোনোরকমে পালিয়ে প্রাণে বাঁচে। তারপরে কিছু ছোট বড় ভূমিকম্প হয়েছে কিন্তু আজও পাথরটা সিঁড়ির ওপর ঐখানে পাহাড়ের খাঁজে অদ্ভুতভাবে আটকে আছে। ঐ পাথরের নীচের দিকে ঠুকলে ওপর দিকে কাঁসরের মতো ধাতব আওয়াজ হয়। এও এক আজুবা। এক সময় কেল্লা থেকে গুপ্তেশ্বর শিব মন্দির অবধি সুরঙ্গপথ ছিল। এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। চায়ের জন্য তো বটেই তাছাড়া অনেক কিছু জানতে পেয়ে হাফিজভাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে চললুম কেল্লা দেখতে।
জনপদ, কেল্লা, গুপ্তেশ্বর মন্দির
করেরা মধ্যপ্রদেশের শিবপুরী জেলার শিবপুরীর পর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনপদ। স্বাধীনতার আগে ছশো বছরে করেরার বহুবার হাতবদল হয়েছে। প্রথমে তা ছিল পরমার রাজপুত বংশে। পরে তা ক্রমান্বয়ে যায় বুন্দেলা রাজত্বে, পেশোয়া প্রথম বাজীরাওয়ের সময় মারাঠা শাসনে, দাতিয়ার রাজা ইন্দ্রজিৎ সিংয়ের কব্জায়, ঝাঁসির শাসক গঙ্গাধর রাওয়ের অধীনে। মাঝে ১৮৩৮ থেকে ১৮৫৬ অবধি এই কেল্লা ছিল ব্রিটিশের অধীনে। সিপাহী বিদ্রোহের সময় ১৮ই জুন ১৮৫৮ তে লক্ষীবাইয়ের মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সৈন্য কামান দেগে বিদ্ধস্ত করে এটি ব্যবহারের অযোগ্য করে দেয়। অবশেষে পয়লা এপ্রিল ১৮৬১তে ব্রিটিশরাজ বুরহানপুরের বদলে নৈকট্য হেতু করেরা জনপদ দিয়ে দেয় গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া রাজবংশকে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার আগে অবধি করেরা ছিল সিন্ধিয়া রাজের অধীনে। এখন বাইপাস পেরিয়ে মহুয়ার নদীর পশ্চিম পারে হয়েছে ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত পুলিশের বিশাল ট্রেনিং কমপ্লেক্স, ফায়ারিং রেঞ্জ, সঞ্জয় উদ্যান। হয়েছে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়। সামরিক বাহিনীর কম্পাউন্ডের মধ্যেই হয়েছে নতুন রাম জানকী মন্দির ও গুরুদ্বারা।
ভাবি দেখি তো এমন জায়গাতেও গুগল ম্যাপ ঠিকমতো দিশা দেখাতে পারে কিনা। জালের মতো ছড়ানো সরু সরু রাস্তায় দিশাহারা হয়ে জিম্যাপ প্রাচীন বসতির মধ্যে দিয়ে কেল্লার পশ্চিমে গঞ্জ দরওয়াজার রাস্তা দেখাতে ব্যর্থ হোলো। অনেক ঘুরিয়ে নিয়ে গেল কৃষনগঞ্জের গুর্জর বসতির মধ্যে দিয়ে কেল্লার দক্ষিণ দিকের প্রধান প্রবেশপথ গুর্জর দরওয়াজায়। বাঁদিকেই ছোট্ট টিলার ওপর ফৌজিভাই বর্ণিত সেই গুপ্তেশ্বর মহাদেব মন্দির। ফেরার পথে দেখবো।
ঐতিহাসিকদের মতে অষ্টম শতকের বিখ্যাত কবি ভবভূতির 'মালতীমাধব' নাট্যে যে পদ্মাবতী নগরীর উল্লেখ আছে সেটাই বর্তমানে গোয়ালিয়রের উত্তরে ডাবরা শহরের সন্নিকটে পায়ায়া। ১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দে পদ্মাবতীর পরমার বংশীয় রাজা কর্ণ পরমার এই জনপদের পত্তন করেন। তাই তখন এর নাম ছিল কর্ণহার। ক্রমে লোকমুখে করহার, করহরা থেকে হয়ে যায় করেরা। নগরীর পত্তনের পর এই কেল্লার নির্মাণ শুরু করেন রাজা পূণ্যপাল পরমার তবে তা বর্তমান রূপ পায় ১৬১৮ সালে বুন্দেলা রাজা ওরছার বীর সিং দেবের রাজত্বকালে (১৬০৫-১৬২৭)। বীর সিং দেব বুন্দেলখন্ডে অনেক প্রাসাদ, কেল্লা নির্মাণ করেন যেমন ওরছার জাহাঙ্গীর মহল, দাতিয়া প্যালেস ও টিকমগড়ের কাছে বলদেবগড় কেল্লা।
করেরা কেল্লাটি বিশেষ বড় নয়। দৈর্ঘ্যে পূর্ব পশ্চিমে ৫৫৫ মিটার ও প্রস্থে উত্তর দক্ষিণে ২০৫ মিটার। কেল্লার পরিসীমা ১৫০০ মিটার। মূল কেল্লা থেকে প্রায় চল্লিশ ফুট নীচে উত্তর দিকে একটূ দুরে রয়েছে কয়েকটি বুরুজসহ আর একটি সমান্তরাল প্রাচীর। উত্তর দিকে টিলার পাদদেশ থেকে কেল্লার সর্বোচ্চ অংশের উচ্চতা প্রায় ২০০ ফুট। কেল্লার পশ্চিমে গঞ্জ দরওয়াজা ও দক্ষিণে গুর্জর দরওয়াজা দুটি রক্ষণাবেক্ষণের ফলে ভালো অবস্থায় আছে তবে পূব দিকে ঝাঁসি দরওয়াজা আজ ভগ্নপ্রায়। উত্তর দিকে কোনো প্রবেশ তোরণ নেই।
কেল্লার মূখ্য আকর্ষণ ত্রৈয়ম্বকেশ্বর মহাদেব মন্দির। শিবরাত্রিতে প্রচুর ভক্ত আসেন। গত ১৫ বছর ধরে সেখানে একাকী রয়েছেন এক বাবা। একদা মূর্তি চুরির চেষ্টা হয়েছিল। তাই লেগেছে সিসিটিভি, লোহার গেট। আলোর ব্যবস্থাও হয়েছে। একসময় এখানে ছিল পুলিশ ক্যাম্প। এখন রাতেও কোনো সিকিউরিটি গার্ড থাকে না। সন্ধ্যার পর বাবা লোহার গেট বন্ধ করে ঈশ্বর ভরসায় থাকেন। কেল্লাটি ASI নয়, রাজ্য পূরাতত্ব বিভাগের অধীনে। তাই অর্থের অভাবে ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ হয়না। কোনো টিকিটও নেই।
প্রধান প্রবেশপথ গুর্জর দরওয়াজা দিয়ে ওঠার পথে পড়ে অতীতের কাছারি। তারপর শিবমন্দির ও সংলগ্ন হনুমান মন্দির। পশ্চিমে একটু দুরে গণেশ মন্দির। পশ্চিম প্রান্তের গঞ্জ দরওয়াজা থেকে শিবমন্দির হয়ে পূব দিকে মসজিদ অবধি সিমেন্ট বাঁধানো পায়ে চলা রাস্তা আছে। কেল্লার বাকি অংশে ঘুরতে হলে ভাঙাচোরা প্রাচীর ও ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে মেঠো পথে চলতে হবে। মসজিদটি মোগল আমলে তৈরি। ওখানে রয়েছে অষ্টাদশ শতকের কিলাদার সৈয়দ সালার খানের সমাধি। স্থানীয়দের কাছে তা কিলাবাবার দরগাহ নামে পরিচিত। তাঁরই বংশধর সৈয়দ আলী ১৯৮২ সাল অবধি ছিলেন করেরা নগরপালিকার প্রধান। মসজিদের পাশে দুটি গভীর তালাও। মাঝে পার্টিশন। স্থানীয়রা বলে শাস-বহু তালাও। কেল্লায় মোট সাতটি তালাও আছে যার একটিতে সারা বছর জল থাকে।
এছাড়া কেল্লার মধ্যে আছে রাজামহল, রাণী মহল, সৈন্যাবাস তবে এখানে রাজপরিবারের কেউ বিশেষ থাকেন নি। এটি মূলতঃ ছিল বলদেবগড়ের মতো এক সামরিক কেল্লা। বর্তমান চাঁদ দরওয়াজা তেমাথায় একদা ছিল কেল্লার পাদদেশের প্রাচীরে তোরণ। এখন প্রাচীর, তোরণ উধাও। কেবল নামটা রয়ে গেছে। কিছু প্রাকৃতিক কারণে ভেঙেচুরে গেছে বাকি লোকজন ভেঙে বসত বানিয়েছে। ফুটাতালাওটিও বীর সিং দেবের আমলে বাঁধ দিয়ে তৈরি হয়েছিল বর্ষার জল ধরে জনপদের জলসমস্যা মেটাতে। অনেকদিন আগে একবার ঘোর বর্ষায় তালাওয়ের বাঁধ ভেঙে যায়। সেই থেকে নাম ফুটা তালাও। এ তালাওয়ে করেরা জনপদের পঙ্কিল জল এসে না পড়লেও এ তালাওয়ের জল এখন ব্যবহার বা মাছ চাষের অযোগ্য।
কেল্লা থেকে নেমে পড়ন্ত বিকেলে গেলাম শান্ত, জনহীন গুপ্তেশ্বর মহাদেব মন্দিরে। পৌনে দুশো বছর ধরে অদ্ভুতভাবে আটকে থাকা সেই পাথরটাও দেখলাম। তার তলা দিয়েই দুরুদুরু বক্ষে গুহার মধ্যে ঢুকে দেখলাম গুপ্তেশ্বর শিবলিঙ্গ। ভাবগম্ভীর পরিবেশ। সাধনমার্গের উপযুক্ত স্থান। নীচে মন্দিরের বাঁদিকে আশ্রমিক আবাসে থাকেন জুনা আখাড়া দশনামী সম্প্রদায়ের কিছু সন্ন্যাসী। তাঁদের একজন বাইরে বসেছিলেন। তাঁকে ফৌজিভাই বর্ণিত ঐ গড়ানে পাথরের বৃত্তান্ত জানতে চাইলাম। তিনিও এমন কথাই শুনেছেন বললেন।
সেলিম মহম্মদ
একটা নাগাদ দিনের প্রথম চা খেয়েছিলাম হাফিজভাইয়ের সৌজন্যে। তিনটে নাগাদ কেল্লার কোনে বসে মুড়ি, মটর, কলা সহযোগে করেছি মৃদু উদর আপ্যায়ন। এমন বেড়ানোয় খাওয়া, বিশেষ করে মধ্যাহ্ন ভোজন, আমার কাছে বাহুল্য। অনেক সময়ই তখন এমন সব জায়গায় থাকি যেখানে আশপাশে কিছুই পাওয়া যায় না। দুপুরে ভরপেট খেলে আলস্য লাগে। তাই সামান্য কিছু খাবার ও জল সঙ্গে নিয়ে চলি, পাখির মতো টুকটাক মুখ চালাই। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত লাগলে কোথাও প্লাসটিক বিছিয়ে স্যাকে মাথা রেখে খানিক চোখ বুঁজলেই শরীর-ব্যাটারী আবার রিচার্জ হয়ে যায়।
নীচে নেমে জৈন মন্দির হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই কোর্ট চকে। সাড়ে পাঁচটা বাজে। কোর্ট বন্ধ হয়ে গেছে। চত্বর ফাঁকা হয়ে আসছে। একপাশে সেলিম মহম্মদের ফাস্টফুডের ঠেলা। পরদেশী বুঝে সেলিমভাই একটা টুল এগিয়ে বসতে বললেন। ডবল ডিমের ওমলেটের সাথে দুটি স্লাইস ব্রেড দিয়ে কুড়ি টাকায় এক প্লেট ব্রেড ওমলেট খাই। অপূর্ব স্বাদ! দ্বিতীয় প্লেট অর্ডার করি। চলছিল টুকটাক আলাপচারিতা।
সেলিম ভাইয়ের বয়স প্রায় পঞ্চাশ। এম এ পাশ করে ১৯৯৪ সাল অবধি হন্যে হয়ে চেষ্টা করেও কোনো সরকারি, বেসরকারি চাকরি পাননি। পেটের দায়ে তখন এই ফাস্টফুডের ঠেলা লাগান কোর্ট চত্বরে। প্রথমদিকে খারাপ লাগতো। পড়াশোনা শিখে লাভ কি হোলো? ক্রমশ সয়ে গেছে। এখন কোনো আক্ষেপ নেই। সুদর্শন সেলিমভাই স্মিতহাস্যে বলেন, বাবুজী এখন মনে হয় আল্লাতালার মর্জি না বুঝতে পেরে কখনো আমাদের হতাশ লাগে বটে তবে ইনসানিয়ৎ কে সাথ নেকি কি রাহ পে চলনেওয়ালে কো আল্লাহ মেহেরবান হমেশা সলামৎ রখতে হ্যায়। এই দেখুন না বিকেল চারটে থেকে রাত দশটা অবধি ঠেলা লাগাই। আমার চাহিদা কম। জিনিস ভালো দিই। দাম রেখেছি ন্যায্য। তাই এই ছ ঘন্টায় যা রোজগার হয়, তাতেই সংসার চলে যায়। ঐ দেখুন পাশেই আমার বাড়ি। দিনের বাকি সময় পরিবারের সাথে সময় কাটাই। দৌড়ঝাঁপ করে অফিস যাওয়া নেই, বদলি হয়ে পরিবার ছেড়ে দুরে থাকা নেই, বসের ডাঁট খেয়ে মন খারাপের প্রশ্ন নেই। কারুর গোলামী না করে আল্লামিঁয়ার দোয়া তে নিজের হাতে করে খাচ্ছি, শরীরে অসুখ নেই, মনে অশান্তি নেই, রাতে শান্তির নিদ্রা যাচ্ছি, জীবনে আর কি চাই, বলুন?
তাঁর জীবনবোধের নির্যাস তাওয়ায় খুন্তি নাড়তে নাড়তে সহজ ভাবে বলে গেলেন মানুষটি। কথাবার্তার মধ্যে একটি বছর দশেকের মেয়ে গেলাসে করে চা এনে বলে, আব্বাজান, আপ কি চায়ে। ভারি শান্ত, মিষ্টি দেখতে মেয়েটিকে। চোখদুটি খুব মায়াবী। সেলিমভাই বললেন, বাবুজী, এ আমার বিটিয়ারাণী। সে চলে যেতে জানান, অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিয়েছেন। ওনাদের সন্তান হয়নি। ভাবি, কিছু মানুষ কতো অল্পে সন্তুষ্ট। কিছু মানুষ আজীবন দৌড়ে মরে। সেলিমভাইয়ের দু প্লেট সুস্বাদু গরমাগরম ব্রেড ওমলেটেই হয়ে গেল আমার ডিনার। উল্টো দিকের দোকানে বসে পাঁচ টাকা কাপের সুন্দর চা দু কাপ খেয়ে শরীর চনমনে হয়ে গেল। সারাদিনের হাঁটাহাঁটির ক্লান্তি নিমেষে উধাও।
ফৌজীভাইয়ের প্রস্তাব
অন্ধকার হয়ে গেছে। রওনা দিলাম মন্দিরের দিকে। গলির দোকানে দাঁড়িয়ে বিস্কুট কিনছি। আধো অন্ধকারে শুনি, মুখার্জীসাব, কিলা কেমন দেখলেন? ফৌজিভাই! বলি, অন্ধকারেও ঠিক চিনতে পেরেছেন তো? হাফিজভাই বলেন, আপনাকে দুর থেকে আসতে দেখেই চিনেছি। অতটা হেঁটে মন্দিরে যেতে না চাইলে আমার গরীবখানাতেও রাতটা থাকতে পারেন। আমরা কেবল মিঞা বিবি থাকি। একটা ঘর খালিই পড়ে আছে। অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে।
বলি, অনেক ধন্যবাদ হাফিজভাই, আমি একবার হাইওয়ের ধারে এক বিরান দরগাহর নির্মিয়মান স্টোররুমের মেঝেতেও রাত কাটিয়েছি। সে তুলনায় আপনার প্রস্তাব তো খুব ভালো। তবে আমার সব জিনিসপত্র রয়েছে ওখানে, তাই মন্দিরেই চলে যাই। আবার কখনও এলে, এক রাত থাকবো আপনার কাছে। আপনি তো করেরার খাজানা। ফৌজিভাই অমায়িক হেসে বলেন, বেশক আইয়েগা। এগিয়ে যাই মন্দিরের পথে।
সুন্দর সন্ধ্যা আরতি
মন্দিরে পৌঁছে দেখি সন্ধ্যা আরতির সময় হয়েছে। তবে বেশী লোকজন নেই। সাকুল্যে জনা সাতেক। গিয়ে একপাশে দাঁড়াই। গর্ভগৃহে হনুমানজী। চারদিকে ঢাকা পরিক্রমা অলিন্দের পশ্চিমে ভানগীর বাবার মূর্তি। পূবে ভগবান পরশুরামের। সন্ধ্যা সাতটা থেকে আধঘন্টার আরতি করলেন পূজারীজী। পুরো সময়টা চারটি বছর আঠারোর স্থানীয় ছেলে ভারী কাঁসর, ঢোলক ও ছাদ থেকে ঝোলানো বড় ঘন্টা বাজিয়ে গেল। সেই সম্মিলিত ছন্দময় শব্দের মূর্ছনায় বিশেষভাবে কিছু উপলব্ধি না করেও কেমন যেন আবিষ্ট লাগে। আরতি শেষে তারা একযোগে প্রায় দশ মিনিট ধরে চোখবুঁজে শিব, হনুমান ও শ্রীরাম স্তোত্রপাঠ করলো। চারজনেরই তা কণ্ঠস্থ। স্তোত্রপাঠ শেষে তারা মিনিট পাঁচেক চোখ বুঁজে পদ্মাসনে ধ্যান করলো।
এরাও তো এই প্রজন্মেরই ছেলে। পরণে জীনস, জ্যাকেট। পকেটে সুইচ অফ করা মোবাইল। অথচ কী নিষ্ঠাময় অর্চনা! মুখমন্ডলে কী সদাচরণের উজ্বলতা! ভারতের এক প্রত্যন্ত স্থানে আধুনিকতার সাথে সনাতন সংস্কৃতির এহেন মেলবন্ধন দেখে বেশ লাগে। ধ্যান শেষে তাদের একজনকে জিজ্ঞাসা করি, তোমরা কী এখানে রোজ আরতির সময় আসো? সে বললো করেরায় থাকলে আমরা চারজনই রোজ সন্ধ্যায় আসি।
এবার শোয়া যাক
দু রাত ট্রেনে ভালো ঘুম হয় নি। ক্লান্ত ছিলাম। তাই রাত আটটা নাগাদ শুয়ে পড়লাম। বাড়িতে দু দুটো স্লিপিং ব্যাগ থাকতেও স্যাকে জায়গা বাঁচাতে আমি এনেছি একটা ফ্লিসের পাতলা কম্বল ও একটা সিন্থেটিক চাদর। ভেবেছিলাম দুটো পাতলুন, ডবল জামার ওপর জ্যাকেট, উইন্ডচিটার ও পায়ে মোজা পরে ঐ চাদর কম্বল দিয়ে হয়তো চলে যাবে। কিন্তু একটু বাদেই বুঝলাম হিসেবে খুব ভুল হয়ে গেছে। কনকনে ঠান্ডা ক্রমশ বাড়ছে। ছাদে গ্ৰীষ্মকালে গরম হাওয়া পাস করার জন্য বড় বড় ওপেনিং ও দরজার পাশে জালি গাঁথুনির ফোকর দিয়ে কুলকুলিয়ে ঠান্ডা ঢুকছে। মাটিতে পেতে শোওয়ার জন্য পাতলা ফোম ম্যাট ছিল। সব গায়ে জড়িয়েও কাঁপছি।
সুন্দরকাণ্ড পর্ব
ওদিকে ভাঁড়ার ঘরে রাত নটা নাগাদ জনা দশেক ভক্ত খোল, কত্তাল, হারমোনিয়াম নিয়ে শুরু করলো সুন্দরকান্ড পাঠ। নানান জমক, গমক সহকারে সে কী উদাত্ত পাঠ ও গায়কী! একে ঠান্ডা তায় ঐ উত্তাল ভজন, ঘুমের দফা রফা। কানে তুলো ঠেসে বিছানায় এপাশ করতে করতে ভজন বন্ধ হলে ভাবি এই হয়তো শেষ হোলো। তা নয়। তারা থেমেছে একটু দম নিতে বা জল খেতে। মিনিট পাঁচেক বাদেই আবার নতুন উদ্যমে শুরু হয়। এভাবে ভোর চারটে অবধি ভজন করে অবশেষে থামলো তারা। সারারাত বিছানায় ওপাশ ওপাশ করে, মাঝরাতে বাইরে বেরিয়ে জালি গাঁথুনির ফোকরে খবরের কাগজ গুঁজে ঠান্ডা হাওয়া আটকে ভোরের দিকে নিদারুণ ক্লান্তিতে প্রবল ঠান্ডার মধ্যেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। ঘুম ভাঙলো সাতটায়। দরকচা ঘুমে চোখ করমচার মতো লাল। মনে হোলো ক্লান্তিতে শরীর বইছে না। আবার শুয়ে পড়লাম। উঠলাম নটায়। এবার একটু আরাম বোধ হয়।
এবার যাওয়া যাকঅমন ঠান্ডায় রোজ চান না করলেও চলে। সকালে চা জোটেনি। তাই এখানে আর সময় নষ্ট না করে জিনিসপত্র গুছিয়ে পরবর্তী গন্তব্যে যাওয়াই মনস্থ করি। খোঁজাখুঁজি করে দেখি রাজেন্দ্রগিরি মহারাজ ভাঁড়ার ঘরের পিছনের প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে মিস্ত্রিদের কাজ দেখছেন। ওখানে আরো গোটা চারেক ঘর হচ্ছে ভক্তদের থাকার জন্য। কাছে গিয়ে দুশোটা টাকা ওনার হাতে দিয়ে বলি, বাবা, এটা রাখুন। উনি বলেছিলেন কিছু লাগবে না। তবু আমার বিবেচনাবোধে উনি খুশী হন। এসব নির্মাণ ভক্তদের দানেই হচ্ছে। তবু কম খরচে ঘুরতে চাই বলে বেবাক সুবিধা নেওয়া ঠিক নয়। ওনাকে নমস্কার করে রওনা হই পরবর্তী গন্তব্যের পথে।
কিছু ছবি: হনুমান মন্দিরের বিশাল চত্বর হনুমান মন্দির হনুমান মন্দিরের পশ্চিমে শিব মন্দির এক রাতের আস্তানা - চৌকির ওপর বিছানো নীল প্লাস্টিকটিও ১৯৮৭ সালের - মানে ৩৩ বছরের ভ্রমণসঙ্গী নির্মিয়মান রাম জানকী মন্দির করেরা কেল্লার ল্যান্ডমার্কগুলি ম্যাপে দেখে নেওয়া যাক:1- গুর্জর দরওয়াজা 2- ত্রৈয়ম্বকেশ্বর মহাদেব মন্দির 3- গঞ্জ দরওয়াজা 4- কিলাবাবার দরগাহ 5- শাস বহু তাল 6- নীচ থেকে প্রথম সুরক্ষা প্রাচীর। 7- গুপ্তেশ্বর মন্দির
গুর্জর দরওয়াজা ত্রৈয়ম্বকেশ্বর মহাদেব মন্দির - দক্ষিণে প্রবেশ পথে ত্রৈয়ম্বকেশ্বর মহাদেব মন্দির - উত্তর সীমা থেকে গঞ্জ দরওয়াজা - কেল্লার ভেতর থেকে গঞ্জ দরওয়াজা - কেল্লার বাইরে থেকে কিলাবাবার দরগাহ শাস বহু তাল - মাঝে পাঁচিল উত্তর দিকে নীচ থেকে প্রথম সুরক্ষা প্রাচীরউত্তর প্রাচীর থেকে করেরা শহরে প্রাচীন জৈন মন্দির (লাল তীর) গুপ্তেশ্বর মন্দির থেকে কেল্লা পৌনে দুশো বছর ধরে আটকে থাকা পাথর গুহার মধ্যে গুপ্তেশ্বর মন্দির ফুটা তালাও - পিছনে কেল্লার অংশ দৃশ্যমান
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।