উঠোনের অন্ধকারে কুয়াশা মাখা একটা মৃদূ আলো আলগোছে পড়ে আছে। সেই আলোয় ঠাকুমার আঁকাবাঁকা ছায়াটা পেয়ারা গাছের তলায় যেতেই কেমন মিলিয়ে যায়। লাল বারান্দায় নস্যি রঙের চাদর জড়ানো আমি ঠাকুমার ছায়াটুকু হারিয়ে কিছুটা কু্ঁকড়ে যাই।
অন্ধকারের সাথে তাল মিলিয়ে খুব আস্তে ডেকে উঠি, ও ঠাকুমা।
এই তো দিদি, কতগুলো কচুর পাতা হাতে নিয়ে ঠাকুমা উঠোনের মৃদূ আলোর মধ্যে একদম ছবির মতো ভেসে ওঠে। সাথে সাথেই এক দৌড়ে বারান্দা থেকে নেমে পৌঁছে যাই ঠাকুমার কাছে। কচুর পাতাগুলো ঢেঁকির উপর রেখে চাদরে আমার মাথা ঢাকে ঠাকুমা, দিদি এই ঠান্ডায় এত ভোরে কেনো ওঠো? নীহার মাথায় পড়লেই তো তোমার কাশি হয়।
সেসব কথায় আমার খেয়াল নেই, চাদরে পেঁচানো আমি অনেক কষ্টে হাত বের করে কচুর পাতাগুলোর দিকে ইশারা করি, তুমি বাগানে গিয়েছিলে ঠাকুমা?
আমার কথার উত্তর দেবার সুযোগই পায় না ঠাকুমা। মনিপিসি উঠোনে এসে দাঁড়াতেই খেয়াল করি অন্ধকার কমে সাদা কুয়াশা উঠোনের বুকে জমাট বেঁধে আছে।
মনি, যাবি থানার ঘাটে?
মনিপিসির হাতে আজ ফুলের সাজি। আমি মনিপিসির হাত ধরে বাইরবাড়ির দিকে যেতে যেতেই একবার ঘাড় ঘুরাই, ও ঠাকুমা আজ ডলি ফুপুদের বাড়ি থেকে গন্ধরাজ ফুল নিয়ে আসবো পূজার জন্য।
ব্যস্, এটুকু বলেই মনিপিসির হাত ছেড়ে প্রায় দৌড়ে গোলেনূর দাদীর বাড়ির পেছনের দিকে চলে যাই।
সে বাড়ির পেছনের গায়ে গা লাগানো অসংখ্য গাছ। এক গাছের ডাল আরেক গাছ ছুঁয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে, কোনটা কাঁচামিঠা আম গাছ আর কোনটা বাতাবীলেবু গাছ তা পৃথক করা যায় না। আর সবগুলো গাছের গোড়াও ঠিক সমানভাবে ছড়ানো।
ও মনিপিসি, এখানে এত গাছ কী গোলেনূর দাদী লাগিয়েছে? সব গাছ কী একইদিন লাগিয়েছে? গোলেনূর দাদী এত গাছ কোথায় পেলো?
আমার প্রশ্নগুলো মনিপিসির কাছে পৌঁছায় কীনা বুঝি না, শুধু দেখতে পাই মনিপিসির হাঁটা একটু শ্লথ হয়ে গেছে। আর ঠিক বাতাবীলেবু গাছটার কাছে দাঁড়িয়ে বলে, খুড়িমা এই গাছটা লাগিয়েছিলো, কী লাল আর মিষ্টি এই গাছের বাতাবীলেবু! হ্যাঁ, ওই গাছের বাতাবীলেবু খুব মিষ্টি তা তো আমি জানিই, গোলেনূর দাদী ভাদ্রমাসের বারপূজায় কত্তগুলো বাতাবীলেবু দেয়!
সাদা ঘন কুয়াশা ততক্ষণে গোলেনূর দাদীর গাছগুলোর ফোঁকর থেকে সরে যেতে শুরু করেছে। ও মনিপিসি, তাড়াতাড়ি চলো। ডলি ফুপুর দাদী উঠে পড়লে আর গন্ধরাজ ফুল নিতে পারবো না।
আমি খেজুর চাচার তাঁতঘর পাড় হয়ে থানার ঘাটের দিকে হাঁটা শুরু করি। তাঁতঘরে একজন দু'জন তাঁতী এরইমধ্যে চলে এসেছে। মাকুরের খটাস খটাস শব্দ সকালের বাতাসে কেমন উদ্দেশ্যহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি মনিপিসির জন্য আর দেরী করি না। দ্রুত হাঁটতে থাকি থানার ঘাটের দিকে, মনিপিসিটা কিচ্ছু বোঝে না। ডলি ফুপুদের বাড়ি থেকে গন্ধরাজ ফুল নিতে হবে তো আমার।
কিন্তু থানা ঘাটের মোড় আসতেই মনিপিসি গলা চড়ায়, মনি ওদিকে না, আগে কলমি ফুল নিয়ে আসি চল্। আমি চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাই। উত্তরে শুধু মনিপিসিকে অনুসরণ করার ইঙ্গিত পাই। আমি পায়ে পায়ে থানা ঘাটের ঠিক পাড়ে এসে দাঁড়াই। ওটা নদী নাকী পুকুর আমি ঠিক বুঝতে পারি না।
দাদুর কাছে শুনেছি আগে এই ঘাটে বড় বড় পাট বোঝাই নৌকা এসে দাঁড়াতো। কিন্তু আমি তো কোনো নৌকাই এই ঘাটে দেখিনা। ঘাটের পাড় দিয়ে এখন কলমি আর হেলেঞ্চার বন। আর এখন তো বেগুনী কলমি ফুল লতার ডগায় ডগায় জুড়ে আছে।
মনিপিসি তড়তড় করে নেমে যায় ঘাটের ঢালু বেয়ে। আমি কী ওভাবে নামতে পারি নাকী? ঢালুর মাটিতে পা গুঁজে গুঁজে আমি নামি, এরপর বেগুনী ফুলগুলো হাতের নাগালে আসতেই আলতো ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে যাই। ও মনিপিসি, ঠাকুমার বাগানে এই ফুল নেই কেন? কলমি ফুলে সাজি ভরে মনিপিসি বলে, এই ফুল কী বাগানে হয়?
এত সুন্দর ফুল কেন ঠাকুমার বাগানে হবে না তা ভাবতে ভাবতেই বাড়ির পথ ধরতে হয়।
একটু এগিয়ে মোড়ে এসে ডলি ফুপুদের বাড়ির দিকে পা বাড়াই। মোড় থেকে দু'বাড়ি পরেই সেই বাড়ি। বাড়ির সামনে অসংখ্য ফুলের গাছ। ডালিয়া, গাঁদা আর চন্দ্রমল্লিকা একসাথে ফুটে আছে।
কিন্তু আমার তো ওই গন্ধরাজ ফুলই লাগবে।
মনিপিসিকে দেখেই ডলি ফুপু বাড়ির সামনে চলে এসেছে। আমি গন্ধরাজ ফুলের আবদার করতে যাব ঠিক তখনি ধবধবে সাদা শাড়ি পড়া ডলি ফুপুর দাদী এসে দাঁড়ায়, এত সকালে এ পাড়ায় কেন? গমগমে কন্ঠস্বরে আমার কেমন ভয় ভয় করে। আমি মনিপিসিকে ঢাল বানিয়ে আড়াল হই।
মনিপিসি দাদীর সাথে কী কথা বলে তা আমার কানে আসে না, আমি শুধু ঠাকুমার পূজার জন্য আজ গন্ধরাজ ফুল পাবো কী করে তাই ভাবতে থাকি। এই মনি ফুল নিবি, গমগমে আওয়াজটা এবার আমার খুব সামনে। ঠাকুমার পূজার জন্য..... আমি কথা শেষ করতে পারি না। ডলি, দেখ ও কোন ফুল চায়... আবার সেই গমগমে কন্ঠ।
কী ঘটছে বোঝার আগেই ডলি ফুপু হাত ধরে আমাকে নিয়ে যায়।
আমি সাহস করে গন্ধরাজ ফুলের গাছ দেখাতেই ডলি ফুপু সাদা নরম ফুল এনে আমার হাত ভরে দেয়।
ওতো ফুল আমার হাতে ধরে নাকী? দু'তিনটা মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু আমার সেদিকে খেয়াল নেই। আমি ডলি ফুপুর নখের মেহেদী রঙ মন দিয়ে দেখি, আমাকে কবে মেহেদী লাগিয়ে দেবে ডলি ফুপু? আমার মাথায় আলতো হাত বুলায় ডলি ফুপু, শবেবরাতের আগে আসিস লাগিয়ে দেবো।
ফুলের সাজি ভরা কলমি ফুল আর গন্ধরাজ ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরতেই বুঝি সকালের ঘি ভাত হয়ে গেছে। পূজার ঘন্টার আওয়াজে আমি দৌড়ে বড়ঘরে যাই, ও ঠাকুমা এই দেখো গন্ধরাজ ফুল।
ঠাকুমার ইশারায় লাল মেঝেতে ফুলগুলো রাখি।
কিন্তু সবগুলো গন্ধরাজ ফুল ঠাকুমা পূজার জন্য নেয় না।। কিছু ফুল আলাদা করে রাখে।
আজ যেন সবকিছুতেই একটু তাড়া ঠাকুমার। পূজা শেষ করেই কাঠের দোতলায় চলে যায়। ওপর থেকে একজোড়া নারকেল নামিয়ে আনে। আর সাথে কুশরের গুড়ের পাটালি।
ও ঠাকুমা, এই পাটালি দিয়ে কী হবে? ঠাকুমা কুশরের পাটালি বারান্দায় নামিয়েই ঘরে চলে আসে। এরপর সরিয়ে রাখা গন্ধরাজ ফুলগুলো হাতে নেয়, আজ বড়ার পায়েস হবে দিদি।
ঠাকুমার হাতের গন্ধরাজ ফুলগুলো এরই মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে দাদুর রেডিও'র টেবিলে। কাঁসার জলভরা ঘটে ফুলগুলো রেখে দেয় ঠাকুমা।
এরপর ঠাকুমা এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না।
সকালের খাবার শেষ হতে না হতেই দুপুরের জন্য উনুনে আঁচ পড়ে। অগ্রাহয়ণের রবিবার। তাই রান্নাঘরের পাক আজ নিরামিষ। ঘন ছোলার ডাল, ডুমো আলু ভাজি, ফুলকপির রসা আর শুকনো বরইয়ের টক।
দুপুরের পাত আজ তাড়াতাড়িই উঠে যায়।
ও মনিপিসি, তুমি ভাত খেলে না। পেয়ারা গাছের তলায় লাল তুলসীমঞ্চের চারপাশ গোবরজলে লেপে নিচ্ছে মনিপিসি, আজ আমার উপোস।
মা ভাত খেয়েই জোড়া নারকেল কোরাতে বসে গেছে। কুলার ভেতর কুরানি ফেলে মা একমনে নারকেল কোরাচ্ছে।
ঠাকুমা গা ধুয়ে একটা ধোয়া শাড়ি পড়ে আবার রান্নাঘরে চলে এসেছে। কয়েকদিন আগে গাছ থেকে নামানো চন্দন কবরী কলার কাদ থেকে বেশ কয়েকটা কলা ছিড়ে নেয় ঠাকুমা। কাঁসার জামবাটিতে কলাগুলো চটকিয়ে নেয়, তাতে মেশায় অল্প নারকেল কোরা। এরপর অল্প চালের গুড়ো আর অনেকটা কুশরের গুড় দিয়ে ভাল করে মেখে নেয় ঠাকুমা।
মনিপসির ততক্ষণে স্নান শেষ। লাল বারান্দায় বসে আতপ চাল বাটছে পাটায়।
মা কুলো ভরা কোরানো নারকেল নিয়ে ঠাকুমাকে দেয়। উনুনের কড়াইয়ে তখন ছোট ছোট বলের মতো কলার বড়া তেলের ভেতরে ভাসতে শুরু করেছে। নারকেল আর কলার মিশ্রিত এক মিষ্টি সুবাস রান্নাঘরের ভেতরে ঘুরপাক দিয়েই হুড়হুড় করে উঠোনের দিকে ছুটছে।
আমি সেদিকে তাকাই।
মনিপিসি লেপা উঠোনে বাটা চালের পিটুলি দিয়ে আলপনা দিতে শুরু করেছে।
ও ঠাকুমা, আজকে কোন পূজা হবে?
কড়াইয়ের বড়াগুলো তেল ছেঁকে তুলতে তুলতে ঠাকুমা বলে, আজ ব্রত হবে দিদি।
উনুন থেকে তেলের কড়াই নামে। পেতলের খাবড়ি ওঠে এবার। কাঁসার ঘটি থেকে সবটা দুধ ঢেলে দেয় ঠাকুমা তাতে। উনুনে নতুন খড়ি ঠেলে আঁচ বাড়ায়। অনবরত সেই দুধ ডাবর হাতা দিয়ে নাড়তে থাকে ঠাকুমা।
বেলা পড়তে শুরু করেছে।
পেয়ারা গাছের তলা থেকে নরম রোদ ততক্ষণে হারিয়ে গিয়েছে। সেখানে পাপড়ি মেলা ফুলের নকশা নিয়ে পিটুলির আলপনায় সিঁদুর পড়াচ্ছে মনিপিসি। এরপর গুনে গুনে সাতটা কচুর পাতা রাখে। তাতে সাতটা বাতাসা। আর একপাশে কাটে ছোট্ট একটি পুকুর।
তারপাশে কলার পাতায় সাজানো সাতটি কলমি ফুল, সাতটি তুলসীপাতা, ধান আর দূর্বা।
রান্নাঘর থেকে তখন ঘন হয়ে আসা দূধের ঘ্রাণ বাতাসে এসে মিশতেই টুপ করে বেলা ডুবে যায়। ও ঠাকুমা, আর কত দেরী? মনিপিসি ব্রতে বসবে তো।
ঘন দূধে কুশরের গুড় পড়ে। একটু নেড়ে তাতে কলার বড়া আর অনেকটা কোরানো নারকেল। আর তা ফুটে উঠলেই বড় কাঁসার রেকাবীতে পড়ে সেই বড়ার পায়েস।
ঠাকুমা সেই রেকাবী তুলসী মঞ্চের সামনে রাখতেই মনিপিসি উঠোনের কাটা পুকুরে জল ঢালতে ঢালতে বলে ওঠে,
সরল ভক্তিতে প্রিয় হও মা সদয়
পূজার খেলা খেলি মা তুষিতে তোমাকে
ভুলিয়া ধুলোর খেলা তুলিয়াছি ফুল
আজ যে তুমি মা মোর ভক্তির পুতুল।
সন্ধ্যার অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠিনের মানুষগুলোকে আবছা করে দেয়।
হুট করে উঠোনের বাতি জ্বলে ওঠে। আর সেই বাতির অল্প আলোয় একটু একটু নীহার বরই গাছের ফোকর দিয়ে চুইয়ে পড়তে থাকে কলার বড়ার সেই রেকাবীতে।
সাতটি ধূপকাঠির কুন্ডলী পাকানো ধোঁয়ার সুবাস আর রেকাবীর পায়েসের নারকেলের ঘ্রাণ মিলেমিশে উঠোন দখল করে নিচ্ছে খুব আলগোছে।
মনিপিসি তখনো একমনে পড়ে যাচ্ছে ব্রতকথা,
' ওই দিকে সওদাগর চোদ্দডিঙি ধনহিরে রাজকুমার রাজপুত্র নিয়ে দেশে ফিরলো.........'
আর ঠিক তখনি দাদুর রেডিওতে খুব আস্তে য়াস্তে বাজতে শুরু হয়,
শুনি ম'লে পাবো বেহেস্তখানা
তা শুনে তো মন মানে না
বাকির লোভে নগদ পাওনা
কে ছাড়ে এই ভুবনে.......
কুশরের গুড় কি আখের গুড় ?
হুড়মুড়িয়ে সবকটা পর্ব পড়ে এলুম।
ফেলে আসা দিনের গল্প, রেসিপির গল্প সব কেমন মিলে মিশে একাকার। গল্প বলার মন্দমধুর গৎটিও বড় চমৎকার, কিন্তু কখনই একঘেয়ে লাগে না।
চলুক।
সুন্দর
স্মৃতি, আবার মুগ্ধ হলাম ।
অপূর্ব ।একরাশ মুগ্ধতা .
মন ভরে যায় পড়ে, অপুর্ব।
Apurbo