- কোথায় যাচ্ছেন?
- যেখানে এই ফ্লাইট যাবে, তেল আভিভ।
- আর কোথাও?
- জেরুসালেমে মিটিং আছে।
- কতদিনের জন্য যাচ্ছেন?
- পাঁচ দিন।
- একা?
- না, ব্রিটিশ ট্রেড মিশনের সঙ্গে।
- আপনার পাসপোর্ট ভারতীয়।
- হ্যাঁ, কাজ করি সিটি ব্যাঙ্কে। তাঁরা আমাকে এই ডেলিগেশনের সঙ্গে ইসরায়েল যাওয়ার জন্য মনোনীত করেছেন।
- আগে কখনও গেছেন?
- না, এই প্রথম
- ধন্যবাদ আপনার সফর শুভ হোক। তবে একটু বসে থাকুন এখানে।
এই বলে ইসরায়েলি মহিলা প্রস্থান করলেন। খালি ঘরে একা বসে আছি হঠাৎ পাশের দরোজাটা খুলে গেলো,একজন বলশালী পুরুষের প্রবেশ। হাসিমুখ।
- কোথায় যাচ্ছেন?
- তেল আভিভ।
- আর কোথাও?
- জেরুসালেমে সরকারের সঙ্গে মিটিং আছে।
- কতদিনের জন্য?
- পাঁচ দিন
- একা?
- না, ব্রিটিশ ট্রেড মিশনের অংশ হিসেবে।
- আপনার পাসপোর্ট ভারতীয়।
- হ্যাঁ, সিটি ব্যাঙ্কে কাজ করি। তাঁরা আমাকে ব্যাঙ্কের হয়ে ইসরায়েল যাওয়ার জন্য মনোনীত করেছেন।
- আগে কখনও গেছেন?
- না, এই প্রথম।
- আপনার যাত্রা শুভ হোক। দু মিনিট বসুন এখানে।
এবারে আরেকজন এলেন। আরেক প্রস্থ চাপান উতোর। একই প্রশ্নবাণ।
এই নাটিকাটি অভিনীত হচ্ছিল ১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে, হিথরো বিমান বন্দরের তিন নম্বর টার্মিনালে। ভাববেন না যেটা পড়লেন তা ছাপার বা আমার মাথার ভুল।আমার মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ সুস্থ আছে। তিন বার সাদা পোষাকে তিন জন ইসরায়েলি পুরুষ এবং মহিলা আমাকে ওই গতে বাঁধা প্রশ্ন করলেন। কোন রকমফের নেই, একেবারে যাকে বলে সেট কোশ্চেন।তৃতীয় জনের উত্তর দিতে গিয়ে কটু কথা বলার বাসনা হয়েছিল কিন্তু জিহ্বাকে রাশ দিতে হল।এইখানে এই বন্ধ ঘরের ভেতরে আমি ব্রিটেনের মহারানির এক অতি ক্ষুদ্র প্রতিভূ, তাঁরই কাজে ইসরায়েল যাচ্ছি। এখানে বরানগরের স্টাইলে মাস্তানি দেখাতে গেলে ব্রিটিশ সরকার আমাকে রেয়াত করবেন না বরং এ দেশে বসবাসের অনুমোদন বাতিল হয়ে যেতে পারে।
ঘটনার ধারা বিচিত্র। চেক ইন হয়ে গেছে কিন্তু ফ্লাইটে ওঠবার আগে আমাদের দলের সকলকে পাঠানো হলো একটি প্রতীক্ষা কক্ষে। সেখানে একের পর একজনের ডাক পড়ে- সে চলে যায় আরেকটি ঘরে। ত্রিফলা ইন্টারভিউয়ের পরে সে অন্য দরোজা দিয়ে বেরিয়ে ফ্লাইট গেটের দিকে যায়, প্রতীক্ষা কক্ষে ফেরে না। ফলে তার পক্ষে প্রশ্ন গুলো চাউর করে দেবার সুযোগ নেই। আমি ভারতীয় বা গায়ের রঙ কালো বলে আমার সঙ্গেই এ হেন বিমাতৃসুলভ আচরণ করা হল এমন ভাববার কোন কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের দলে জনা চল্লিশ পুরুষ ও মহিলা, একমাত্র আমি কৃষ্ণবর্ণ।
প্লেনে উঠে দলের সরদার ও সাথীদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম তাঁদের সকলকে ওই একই প্রশ্নমালার সম্মুখীন হতে হয়েছে। স্লাউ শহরের একটি খাদ্য দ্রব্য প্রস্তুত কারি সংস্থার প্রতিনিধি বললেন তৃতীয় জনকে তিনি প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে নিজেই প্রশ্ন এবং উত্তর দুটোই সরবরাহ করা শুরু করেন! তিনি হেসে দ্রুত স্থান পরিত্যাগ করেন। আমার মনে একটা খটকা লেগে রইল ব্যাপারটা কি? হিং টিং ছট?
উত্তরটা পেলাম দু দিন বাদে।
দাভিদের দৌলতে টুরিস্টের জেরুসালেম দেখা শেষ। এবার গেছি কাজে। এলিজার কাপলান স্ট্রিটে ইসরায়েলি মিনিস্ট্রি অফ ফাইনান্সের সদর দফতর, পার্লামেন্টের (Knesset) প্রায় উলটো দিকে, সেখানে জেরির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার স্থির করে দিয়েছে বাঙ্ক লেউমির ইলান। ট্যাক্সি আমাকে সে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। রিসেপশন হল মাঝারি সাইজের, সেখানে কোন জন মনিষ্যি নেই। সবে তৃতীয় বার গডফাদার দেখেছি - নিউ জার্সি টার্ন পাইকের খালি রাস্তায় সনি করলিওনের ওপরে বন্দুকবাজির দৃশ্য চোখের ওপরে ভেসে এলো। এটা সরকারি অফিস, দুপুরবেলা সব সুনসান কেন? আজ তো সাবাথ নয়? আমার মতো একটা সন্দেহজনক চেহারার মানুষ এখানে কি ধান্দায় ঢুকেছে জানবার ইচ্ছে নেই কারো? হঠাৎ কি মোসাদের কোন গুণমণি ছোটো পিস্তল আমার মাথায় ঠেকিয়ে বলবে ‘এখানে কি উদ্দেশ্যে?’ তারপরে হাপিশ করে দেবে, বউ ছেলে মেয়ে কেউ জানবে না আমার বডি কোথায়।
সি সি টি ভিতে কেউ কি আমায় দেখছে? অদৃশ্য ক্যামেরার দিকে চেয়ে হাসবার চেষ্টা করলাম – আমি এসেছি, বঁধু হে !
লিফট থেকে এক ভদ্রমহিলা নামলেন। আমার ব্যাপারে তাঁর কোন কৌতূহল নেই দেখেও তাঁরই শরনাপন্ন হলাম।
আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেনট আছে জেরি আপফেলবাউমের সঙ্গে, তাকে কোথায় পাবো?
ও জেরি, যিনি ট্রেড ফাইনান্স দেখেন? পাঁচ তলায় চলে যান।
এত বলি তিনি সদর দরোজা দিয়ে প্রস্থান করলেন।
লিফটে পাঁচ তলায় উঠেছি। এবার কোন দিকে? ভাগ্যক্রমে ফাইল বগলদাবা করে চলন্ত এক ভদ্রলোকের দেখা পেলাম। তিনি নিয়ে গেলেন জেরি আপফেলবাউমের ঘরে।
‘আরে আসুন, আসুন। ভাবছি হারিয়ে গেলেন কিনা ইলানকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম’ বলে যে মানুষটি আমার দিকে এগিয়ে এলেন তাঁর মুখে হাসি, পরনে খাকি শর্ট। একটু বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে সেদিকে হয়তো চেয়েছিলাম। জেরি আমার ধন্দ মিটিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এ দেশে বেজায় গরম, তাই শর্ট পরার ওপরে কোন সরকারি নিষেধাজ্ঞা নেই ! আপনারও স্যুট পরে দর্শন দেওয়াটা আবশ্যিক নয় (নট অ্যান এসেনশিয়াল অ্যাপারেল ফর ডুইং বিজনেস!)’ আমাদের আলোচ্য বিষয় ছিল ব্রিটিশ সরকারের এক্সপোর্ট ক্রেডিটের সাহারা নিয়ে ইসরায়েলে রপ্তানি বাড়ানো। সেটা চুকলে ভালো মতো আড্ডা, গোলডারস গ্রিন কানেকশান বেরিয়ে পড়লো। রিজওয়েতে তাঁর খুড়ি থাকেন নব্বুই বছর বয়েস, জেরি যোগ করে দিলেন। জানতে চাইলেন হাই স্ট্রিটে মদ্যপানের সুবিধা দেওয়া হয়েছে কিনা।
উত্তর পশ্চিম লন্ডনে বহুকাল যাবত এটি যে কোন আড্ডায় চর্চার বিষয় ছিল। গোলডারস গ্রিন স্টেশনে নেমে ডাইনে যে হাই স্ট্রিট পড়ে, কোন অজ্ঞাত কারণে সেখানে কোন পানশালা ছিলো না। আমরা বলতাম ইংল্যান্ডে হয়তো এটি একমাত্র বার বিবর্জিত হাই স্ট্রিট! জানাতে হল স্টেশন থেকে নর্থ সার্কুলার রোডের মোড় অবধি জনস্থান একেবারে শুষ্ক,এখনও (দশ বছর বাদে অবশ্য এই ট্র্যাডিশন বিচূর্ণ হয়)।
‘ইসরায়েল কেমন দেখছেন?’
বললাম ‘ভালো। তবে অনেক বেশি সুরক্ষা ব্যবস্থা, পথে ঘাটে প্রহরী দেখব ভেবেছিলাম। এই যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, একতলার রিসেপশনে তো কেউই ছিলেন না।এটা শঙ্কার কথা নয়? বিশেষ করে আমার মতো চেহারার লোক বেমক্কা ঘোরাঘুরি করছে যখন’।
জেরি অট্টহাস্য করলেন।
‘আমাদের সিস্টেম অন্য রকম! এ দেশে ঢোকার আগেই আপনাকে চেক করা হয়ে গেছে ! হিথরো দিয়ে এসেছেন তো?’
স্বীকার করলাম।
‘ফ্লাইটে ওঠার আগে কয়েকজন একই সিরিজের প্রশ্ন করেছে - কোথায় যাচ্ছেন কেন যাচ্ছেন, ইত্যাদি, ঠিক তো? তাদের মধ্যে আবার সুন্দরি মেয়েও থাকে,আপনাকে দিকভ্রষ্ট করবার জন্য।আপনি সব জিজ্ঞাসা সামলেছেন সুবোধ বালকের মতো, তবেই না আপনি এই হেথায় এলেন? আপনার পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে গেছে হিথরোতে !”
“কিন্তু তিন বার কেন?’’
জেরির হাসির ডেসিবেল প্রায় মহাশূন্যে উঠে গেছে।
“শুনুন, এটা অনুসন্ধানের ইসরায়েলি কায়দা ! প্রথম জন আপনার সঙ্গে কথা বলে দ্বিতীয় জনকে পাঠাবার আগে রিপোর্ট দিয়েছে, আপনি কি বললেন। সেই লিস্টি মিলিয়ে দ্বিতীয় জন আপনাকে চেক করে। থিওরি হচ্ছে আপনি সত্যি বললে প্রতিবার তাই বলবেন, কোন ক্রিয়া পদ বিশেষ্য বিশেষণ একটু ওদিক হতে পারে,আপনার কণ্ঠস্বরে উষ্মা দেখা দিতে পারে। কিন্তু পর পর তিন বার ধারাবাহিক ভাবে মিথ্যে বলাটা শক্ত কাজ। নিরাপত্তার লোকেদের মনে সন্দেহ হলে আপনাকে পাঁচবারও প্রশ্ন করতে পারে। হিথরোতে আপনি ক্লিন চিট পেয়েছেন। যখন বেন গুরিওন হাওয়াই আড্ডায় নামলেন, আপনি একেবারে কোশার মানুষ! এখন আপনি আমাদের অফিস কেন, এই উলটোদিকের পার্লামেন্টে গিয়ে একবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে আসুন না!”
জেরির কথার সত্যি মিথ্যে যাচাই করার সুযোগ হয় নি, পরে অবশ্য জেনেছি তাদের গোয়েন্দাগিরি হিথরোতে শেষ হয় নি।
১৯৯১ সালে দেশটার সীমান্ত ঠিক কোন খানে সেটা বোঝা যেতো না। (১৯৯৫ সালের পরে অগুনতি চেক পোস্ট দেখা দিল)। অথচ জেরুসালেমের চতুর্দিকে গড়ে উঠছে নতুন নতুন সেটলমেনট। ল্যান্ড রেজিস্ট্রি অফিস নিশ্চয় আছে। সেখানে এই সব জমির দলিল দস্তাবেজ কি ভাবে দেখা হয়? এক ইসরায়েলি প্যালেস্টিনিয়ান ট্যাক্সি ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম।
তার ব্যাখ্যানের ভিত্তিতে একটি ছোটো সংলাপ
- এই ফোটো দেখে নিন। এই জমিতে বাড়ী তুলবো লেখাপড়া করে দিন।
- আপনার দলিল কোথায়?
- কাগজের আবার কি দরকার? আমাদের পূর্ব পুরুষের জোত জমি ছিল।
- তাদের নাম? জমির পরিমাণ? জানেন? আরেকটা সমস্যা হলো বর্তমান অধিবাসীর কাছে জমির দলিল আছে যে তুর্কি সুলতানের সুবেদারের ছাপ মারা। অন্তত দু শো বছরের বেশি বাস এই জমিতে, অলিভের চাষ করেন।
- সেটা জবর দখল। আমার বাপ পিতেমোর জায়গায় তারা অন্যায় ভাবে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।
কলেজে পড়ার সময়ে ট্রিনি লোপেজের গান শুনেছিলাম -
This land is your land
This land is my land
From California to the New York Island
From the Redwood forest
To the Gulf Stream waters
This land was made for you and me *
কয়েকশো বছর আগে কাগজ বা ঐতিহাসিক দাবি নয়, ইউরোপ থেকে এসে অর্থ ও বন্দুকের জোরে একটি সভ্যতার, মানবিকতার উচ্ছেদ করে আরেক দল মানুষ বলেছিল – এ জমি আমার। কাগজ পত্র আবার কি?
দিস ল্যানড ইজ মাই ল্যানড।