

- আমাদের এবার ফিরতে হয়।
- কেন, তাড়া কিসের? পার্কিং টিকেট তো সারা দিনের!
- না সেজন্য নয়। রাজদূতের বাড়িতে আপনার সান্ধ্য আমন্ত্রণ আছে যে!
- দাভিদ, সেটা সাতটায়। এখান থেকে হোটেলে ফিরতে কতক্ষণ লাগবে বলে মনে হয়?
- ঘণ্টা দেড়েক ধরে নিন।
- আমার আরেকটা কাজ বাকি আছে। সেটা সম্পূর্ণ করি আগে! সবে বেলা দুটো!
- এখন কোথায় যাবেন?
- চার্চ অফ দি হোলি সেপালকার *
দাভিদকে চিন্তিত দেখাল।
- দেখুন সেখানে যাওয়ার পথটা মুসলিম কোয়ার্টারের ভেতর দিয়ে। আপনার আমার একটু অস্বস্তি হতে পারে।
- দাভিদ, আমি কোন গ্রেগরি পেক নই জানি, কিন্তু আমার মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখুন দিকি! এ চেহারা দেখে কি কেউ আমার ধর্মের নাম পড়ে নিতে পারে?
- কিছু মনে করবেন না চার্চ অফ দি হোলি সেপালকার যাওয়াটা আমার পক্ষে নিরাপদ নয় বলে মনে করি। আপনি একা যদি যেতে চান আমি আটকাতে পারি না, কিন্তু আপনার সুরক্ষার দায়িত্ব আমার হাতে! যদি কোন অঘটন ঘটে আমাকে বিওরনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
এই সংলাপ চলছিল ডোম অফ দি রকের প্রশস্ত প্রাঙ্গণে। দাভিদ আমার সারথি। জেরুসালেম যেতে চাই শুনে তেল আভিভে আমার বাণিজ্যিক বন্ধু বিওরন বলেছে, লোক দিচ্ছি। এমন একজনকে পাঠাবো যে শুধু ভালো গাড়ি চালায় তাই নয়, ইতিহাস তার নখদর্পণে! ঠিক তোমার মতন ট্রিভিয়া ভিত্তিক বাজে গল্প করতে ভালবাসে! কথাটার সত্যতা বুঝতে বেশিক্ষণ লাগে নি। সক্কালবেলা হিলটন বিচ হোটেল থেকে এখানে আসা অবধি অনেক আলোচনা হয়েছে। দাভিদ দুর্দান্ত গাইড। জেরুসালেম পৌঁছেই নিয়ে গেল হিব্রু ইউনিভারসিটি, তার অবস্থান অনেকটা উঁচুতে –‘এখান থেকে শহরের একটা বার্ড’স আই ভিউ পাবেন ‘! জেরুসালেমের পুরনো শহর ছড়িয়ে আছে চোখের সামনে। ক্রমশ আমার স্বল্প জানা দুই বাইবেলের ছবি গুলি মূর্ত হয়ে ওঠে ; গেথসেমানের অলিভ বাগান যেখানে একদিন রোমান সৈন্য গ্রেপ্তার করে প্রভু যিশুকে, অনেকটা নেমে এসে দাঁড়াই সলোমনের মন্দিরের পশ্চিম দেওয়ালের সামনে – ক্রন্দন প্রাচীর, ওয়েলিং ওয়াল, ক্লাগেমাউয়ার, সেটি ইহুদিদের কাছে পবিত্রতম তীর্থস্থান। দাভিদ মাথায় পরিয়ে দেয় ইয়ারমুলকা, নীরব প্রার্থনা শেষ হলে হেঁটে যাই ডান দিকে। সেখানে একটি পেল্লায় ভারা বাঁধা আছে, সিঁড়ি উঠে গেছে পশ্চিম দেওয়ালের মাথায় পাকা সিঁড়ি নয়। কিন্তু শক্ত, লোহার রেলিং দেওয়া। ওপরে উঠে হাজির হলাম আল আকসা মসজিদের প্রাঙ্গণে আর একটু এগিয়েই সোনালি চুড়োর ডোম অফ দি রক, জেরুসালেমের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ল্যান্ড মার্ক। এখানে সেই প্রস্তরখণ্ড আছে যার ওপরে আব্রাহাম ঈশ্বরের প্রীত্যর্থে তাঁর পুত্রকে বলি দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন আর কিংবদন্তি অনুযায়ী এখান থেকে শুরু হয় পয়গম্বরের শেষ যাত্রা, ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্রতম তীর্থস্থল।
- দাভিদ, জেনে এসেছি তিন আব্রাহামিক ধর্মের অনন্য সঙ্গম এই জেরুসালেম – দুই বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে। আপনার কল্যাণে দেখলাম জুডাইজমের পবিত্রতম, ইসলামের দ্বিতীয় পবিত্রতম পুণ্যস্থান। বাকি থাকে যিশুর মর্ত্যলোক থেকে বিদায়ের ভূমি – গলগথা। এতদূর যখন এসেছি, সেটি দেখেই যাবো। আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করুন। দু ঘণ্টার ভেতরে যদি না ফিরি, পুলিস, অ্যাম্বুলেন্স ও বিওরনকে খবর দেবেন! ভাববেন না, আমি ঠিক ফিরে আসব!
মোবাইল টেলিফোন আমাদের হাতে পৌছুতে বছর চারেক দেরি! নিতান্ত অনিচ্ছা সহকারে দাভিদ বললে, ‘হেঁটে সেখানে যেতে আসতে বড়ো জোর চল্লিশ মিনিট লাগে যদিও যেতে হবে বাজারের ভিড় ঠেলে। যতটা সময় আপনি চার্চে কাটাবেন তা যোগ করলে দু ঘণ্টার বেশি লাগবে না। তার বেশি দেরি হলে আমি চিন্তায় পড়বো ’।
আরও তিন দশক পিছিয়ে গিয়ে
মুজতবা আলী সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঝরিয়া শহরে আমাদের বাড়ির চিলে কোঠার ঘরে - মাসিক বসুমতীতে ধারাবাহিক পড়ছি ‘জলে ডাঙ্গায়’ যার শেষ টুকু খুব মন খারাপ করানো। ১৯২৮ সালে তাঁর জার্মানি যাত্রায় জাহাজের সঙ্গী দুই তরুণ পল ও পার্সির সঙ্গে খোস মজলিস চলেছে দিনের পর দিন, সেখানে কত কিছু জানছি। হঠাৎ সেই আড্ডা ভেঙ্গে গেলো যখন পোর্ট সায়ীদে এক ‘লজঝর কোট পাতলুন পরা মানুষ হাতে এক তাড়া রঙ্গিন কাগজে ভর্তি প্যামফিলিট’ নিয়ে হাজির হলেন। আলী সাহেব যাবেন জেনোয়া কিন্তু এই মানুষটি তাঁকে অন্য কোথাও পাঠাতে বদ্ধ পরিকর। তাকে মুজতবা আলী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কি দেশ বিক্রি করেন?’
‘আরে ইয়োরোপ যাবেন না হয় দু সপ্তাহ বাদে, আপাতত যান প্যালেস্টাইন। দেখে আসুন গলগথা, গেথসামানে, পশ্চিম প্রাচীর আর সেই আল আকসা যেখান থেকে আল্লাতালা মুহাম্মদ সায়েবকে স্বর্গ দর্শনে নিয়ে যান। আসলে জেরুসালেম হল ধর্মের ত্রিবেণী। ইহুদি খ্রিস্টান এবং মুসলমান ধর্ম এখানে এসে মিলেছে। এক ঢিলে তিন পাখি ’।
পবিত্র ভূমি, হোলি ল্যান্ড!

মুজতবা আলী প্যালেস্টাইন পর্ব লেখেন নি (১৯৪৭ অবধি ইসরায়েল নামের কোন দেশ ম্যাপে পাওয়া যায় না)। জলে ডাঙ্গার শেষ লাইনে বললেন ‘প্যালেস্টাইন সম্বন্ধে না লেখা ভ্রমণ কাহিনি উৎসর্গ করলুম মিত্রদ্বয় পল এবং পার্সিকে’।
জলে ডাঙ্গায় পড়ার পরে আরও তিন দশক কেটে গিয়েছে। সকল ধর্মকে সমান সম্মান দিতে শিখেছি তাই কোন পীঠ স্থানে গিয়ে পুণ্য অর্জন নয়, একই ঈশ্বরের বাণী বয়ে আনা ধর্মের সেই ত্রিবেণী, জেরুসালেমে পৌঁছুনোর বাসনা রয়ে গেছে মনে ঝরিয়ায় বসে কোনদিন ভাবি নি এ জীবনে তা সম্ভব হবে।
ফাস্ট ফরওয়ার্ড ১৯৯১
প্রভুর স্মৃতি সমাধি দেখে ফিরছি, দূর থেকে লক্ষ করলাম দাভিদ চত্বরের বাইরে একটা বেঞ্চে বসে ঘন ঘন মুসলিম কোয়ার্টারের দিকে তাকাচ্ছে আর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। আমাকে দেখিয়ে লাফিয়ে উঠলো, “মাজেল টভ” এক্ষেত্রে যার অর্থ, ‘বাঁচা গেলো’ বা ‘সর্বরক্ষে’। স্থান বা ঘটনা অনুসারে এই হিব্রু শব্দটির অনেক প্রকারের ব্যবহার আছে, সেটা নিয়ে পরে কখনো।
১৯৬৭ সালে ছ দিনের যুদ্ধে বিজয়ী ইসরায়েল নামের দেশের এলাকা ক্রমশ বিস্তারিত হচ্ছে রাষ্ট্র সঙ্ঘের আদেশ বা কোন আইন না মেনে, কেবলই গায়ের জোরে। অধিকৃত অঞ্চলে গড়ে উঠছে ইসরায়েলি কলোনি বা সেটলমেনট। সে সময়কার আমেরিকান রাষ্ট্রপতি বুশ সেটি সমর্থন করেন নি। সিটি ব্যাঙ্কের কোন রাজনৈতিক অবস্থান ছিল না, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের তা থাকার কথাও নয়। কিন্তু আমাদের ব্যাঙ্ক কখনও কোন সেটলমেনটের প্রসারে অর্থ সরবরাহ করে নি, সরাসরি তো নয়ই কোন ইসরায়েলি ব্যাঙ্কের মাধ্যমেও নয়।
গাজা আমি যাই নি। জেরুসালেম থেকে বাস ধরে নিকটবর্তী অধিকৃত শহর বেথলেহেম গেছি আমার চেহারা ইহুদি সুলভ নয় কিন্তু কেউ কোথাও আমার পরিচয় পত্র দেখতে চান নি। তেল আভিভ হতে ট্রেনে চড়ে আকো, বাস ধরে হাইফা, সেখান থেকে নাজারেথ গিয়েছি। তেল আভিভ ফিরেছি অন্য রুটে (বাইবেলের আরমাগেডন যেখানে)। খুব সহজেই ঘুরেছি বাসে যেমন মানুষ বোলপুর থেকে ইলাম বাজার যায় - বেজায় ভিড়, বসার জায়গা মেলে না। অনুমান করতে অসুবিধে হয় নি বাসে ইসরায়েলি ও প্যালেস্টিনিয়ান পাশাপাশি সফর করছেন, আইনি কাগজ দেখাতে হচ্ছে না। মনে রাখা প্রয়োজন দেশে দু ধরনের প্যালেসটিনিয়ানের বাস এক, যারা ইসরায়েল দেশে বাস করেন, সেখানকার পাসপোর্টধারী, অন্যেরা জন্মগত প্যালেসটিনিয়ান, বাস করেন অধিকৃত অঞ্চলে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার অত্যন্ত সীমিত, দেশ ছেড়ে বিদেশে যাওয়া শক্ত ব্যাপার তাঁদের মধ্যে কারো জর্ডানিয়ান পাসপোর্ট আছে প্যালেস্টাইন দেশের ছাপ মারা শেষ পাসপোর্ট ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে বাতিল। অনেকেরই এই দেশ থেকে বেরুনো অসম্ভব - যেমনটি এককালে দেখেছি কমিউনিস্ট পূর্ব ইউরোপে। অধিকারের অন্তর ছিল, অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল, ছিল পারস্পরিক সন্দেহ, ভীতি। আমি কোন ভূরাজনৈতিক নই কিন্তু সেদিন মনে হয়েছে এমনটা তো ইউরোপের অনেক জায়গায় চোখে পড়ে। লন্ডন ব্রাসেলস প্যারিস বার্লিনের অনেক পাড়ায় সাবধানতা বাঞ্ছনীয়, হয়ত বা সেখানে না গেলেই হয় কিন্তু সকল পক্ষের রাজনৈতিক অধিকার কাগজে কলমে সমান। ইসরায়েলে তা নয়। এক পক্ষের পূর্ণ অধিকার, অপর পক্ষ ধনীর দুয়ারে দাঁড়ানো কাঙ্গাল এবং কাঙ্গালিনী। ইয়াসের আরাফত তাদের আপন রাষ্ট্র গঠন ও অনুমোদনের লড়াই চালাচ্ছেন – তিনি আওয়াজ তোলার আগে অবধি প্যালেস্টাইন নামটা শোনা যেতো না অবধি। কোন এক বিছানায় তিনি পর পর দু রাত্তির শোবার ভরসা পান না, মোসাদ আছে পিছে। ওসলো চুক্তি সই হতে দু বছর দেরি। তারপর একদিন দুই রাষ্ট্রের অবস্থিতি মেনে নিয়ে আরাফাত ও ইয়াতঝিক রাবিন হাত মেলাবেন বিল ক্লিনটনের সস্নেহ উপস্থিতিতে। মনে আছে সেই মাসেই (সেপ্টেম্বর ১৯৯৩) বন্ধু পল স্টারলিং জানাল তাদের ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ সুইজারল্যান্ড একটি নতুন দেশ দপ্তর (country desk) খুলেছে – প্যালেস্টাইন! কিছুকাল বাদে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক ব্রাঞ্চ খোলে রামাল্লায়।
তাহলে এবার দুটো দেশ পাশাপাশি সম্পূর্ণ স্বাধীন? যেমন ইউগোস্লাভিয়া ভেঙ্গে ছটি দেশ দাঁড়াল ছটি পতাকার নিচে?
পরের বার ইসরায়েল গিয়ে দেখলাম পতাকা দুটো, সরকারি ভাবে দেশ দুটো কিনা বোঝা যাচ্ছে না। গড়ে উঠেছে কংক্রিটের দেওয়াল, কাঁটা তারের বেড়া। জেরুসালেম থেকে বেথলেহেম আর পাবলিক বাসে চড়ে যাওয়া যায় না। নানান তার ঘেরা সুড়ঙ্গ পার হতে হয়। বেথলেহেমের ক্রিস্টিয়ান মানুষ জেরুসালেমে চার্চ অফ দি হোলি সেপালকারে বন্দনা করতে পারেন না। যে আল আকসার চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিলাম একদিন সে এখন নো ম্যানস ল্যান্ড।
হীরেন সিংহরায় | 81.145.***.*** | ২২ অক্টোবর ২০২৩ ০০:৪২524964
&/ | 151.14.***.*** | ২২ অক্টোবর ২০২৩ ০০:৫০524965
&/ | 151.14.***.*** | ২২ অক্টোবর ২০২৩ ০০:৫৬524966
&/ | 151.14.***.*** | ২২ অক্টোবর ২০২৩ ০১:০১524967
হীরেন সিংহরায় | 2a00:23c7:672e:2001:b023:5682:413b:***:*** | ২২ অক্টোবর ২০২৩ ০২:৪৭524969
&/ | 151.14.***.*** | ২২ অক্টোবর ২০২৩ ০৩:৩২524970
হীরেন সিংহরায় | 2a00:23c7:672e:2001:9ca5:50bf:da26:***:*** | ২২ অক্টোবর ২০২৩ ১০:৫৩524986
&/ | 151.14.***.*** | ২৩ অক্টোবর ২০২৩ ০২:৪৫525030
Sanghamitra Ghosh | 2402:3a80:198b:e6ec:818e:c759:cc29:***:*** | ০৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:০২525717