প্রাক কথন: এটি এক ইহুদির সঙ্গে বাইবেল নিয়ে আমার একান্ত তাত্ত্বিক আলোচনার বিবরণ মাত্র। কারো ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত লাগলে আমি অগ্রিম মার্জনা চেয়ে রাখি।
- পুরো বাইবেল পড়েছে এমন কাউকে চিনি না। তবে দুই বাইবেলের স্টোরি লাইন আপনার জানা আছে এটা অনুমান করতে পারি কি?
এতক্ষণ দাভিদের রেল কাহিনি শুনেছি ‘সে কি’, ‘কেন?’, ‘তাই বুঝি’ এমনি কিছু বিস্ময় সূচক মনোসিলেবিক মন্তব্য সহ। এবার মঞ্চে নামার ডাক। জেরুসালেম পৌঁছুতে অন্তত ঘণ্টা খানেক বাকি, জানলার বাইরের দৃশ্য কিছু মনোরম নয়। অতি রুক্ষ ধুলোয় ঢাকা পাথুরে টিলা।
- আমার দেশে বাইবেল শিক্ষার ক্লাস করা আবশ্যিক ছিলো না। কিন্তু আদমের আপেল খাওয়া থেকে যিশুর পুনরুত্থানের কাহিনি অন্য সবার মতন আমিও কোন না কোন ভাবে জেনেছি। ইংল্যান্ডে আমার ছেলে মেয়ের স্কুলে আর ই বা রিলিজিয়াস এডুকেশনের ক্লাস হয়। তাদের বইয়ের পাতা উলটে দেখেছি, বিশেষ করে যিশুর জীবনের শেষ সাত দিন। বাইবেল আমার কাছে একটা দীর্ঘ সময়ের ঐতিহাসিক ভৌগোলিক এবং সাংস্কৃতিক দলিল।
ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে বরানগরের স্কুল থেকে বীণা সিনেমায় টেন কমান্ডমেনটস সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ইংরেজি প্রায় কিছুই বুঝিনি; দুর্দান্ত সব সিনারি মনে থেকে গেছে। বাইবেলের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। সে কথা দাভিদকে বলার মানে হয় না। এই গ্রন্থের যে নতুন পুরনো দুটো আলাদা খণ্ড আছে জানি কিন্তু কিছু মানুষ কেবল প্রথমটা পড়েন, দ্বিতীয়টা পড়া মানা আর কিছু মানুষ দুটোই পড়েন সেটা জানতে বহু বছর লেগে গেছে। জ্ঞানোদয় হলো এক ইনটার ব্যাঙ্ক কুইজ কনটেস্টে। আমার দলে গুরকান এন্সারি, তুর্কি এবং জশুয়া কোহেন। একটা প্রশ্ন এলো – যিশুর ভাইয়ের নাম কি? জশের সাহায্য খুঁজলাম। সে বললে বস, আমি তো কেবল আমাদের বাইবেলটা পড়েছি! অন্যটা নয়!
দাভিদ কি দুটোই পড়েছেন? বাইবেলের দ্বিতীয় পর্ব পাঠ তো তাঁর সিলেবাসে নেই। অচিরে ভ্রান্তি দূর হলো। দু চারটে প্রশ্ন করে আমার অতি ক্ষীণ জ্ঞানের একটু জরিপ করে নিলেন। উৎরেছি কি না ভাবছি এমন সময়ে দাভিদ প্রথম তির ছুঁড়লেন।
- যিশুর জন্মের সালটা কি?
- তাঁর জন্ম থেকেই তো খ্রিস্টাব্দ বা আনো দমিনি হিসেব করা হয়ে থাকে অতএব সেই নতুন ক্যালেন্ডারের প্রথম বছরে!
- সেটা কোনো গসপেলে পাবেন না। বরং সেই লেখকরা বলেছেন যিশুর জন্ম রাজা হেরডের শাসন কালে অর্থাৎ আপনার হিসেবে খ্রিস্টপূর্ব তিন চার বা পাঁচ সালে। এটা যদি ধরেন তাহলে এই খ্রিস্টাব্দের হিসেব একেবারে ওলট পালট হয়ে যায়। মজার কথা আপনার বয়েসটাই তিন বা পাঁচ বছর কমে যেতে পারে!
হজবরল? বয়েস কমছে না বাড়ছে!
- মেরী ও জোসেফ নাজারেথের বাসিন্দা। তাঁরা বেথলেহেম এলেন কেন?
- সিজারের আদেশে জন এবং কর গণনা হচ্ছিল। সকল নাগরিককে বলা হয় হয় তাদের পৈত্রিক শহর বা গ্রামে গিয়ে হাজিরা দিতে। জোসেফের আদি বাড়ি বেথলেহেম তাই নাজারেথ থেকে তাঁদের বেথলেহেম আসতে হয়।
- রোমান রাজত্বে অন্যত্র কাউকে কোথাও এ ধরনের আদেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। আপনি ভারতের মানুষ লন্ডনে বাস করেন, ট্যাক্স দেন, সে দেশের জনগণের তালিকার অন্তর্ভুক্ত- এই আইন তখনো ছিল।
পরের প্রশ্ন
- যিশুর প্রথম মিরাকল কি?
- জল থেকে মদ বানানো।
- এই কর্মটি তিনি কোথায় সম্পন্ন করলেন?
- জায়গাটার নাম ঠিক মনে পড়ছে না হয়তো কানান। এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছিলেন। এক সময়ে মাতা মেরী যিশুকে ডেকে বললেন অতিথি আপ্যায়নে মহা সমস্যা; মদ ফুরিয়ে গেছে। কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় না? তখন যিশু জলের ছটি বিশাল জালাকে মদে পরিবর্তিত করেন।
- ঠিক। সেই গ্রামের নাম খফ্র কানা, নাজারেথের কাছেই, যেতে পারেন। এবার বলুন তো আপনি গেছেন বন্ধুর বিয়েতে, সেখানে ওয়াইন সরবরাহ করার দায়িত্ব কি আপনার? আপনি অতিথি মাত্র। যার বিয়ে হচ্ছে তিনি আপনার আত্মীয় নন যে সে দায় আপনাকে বইতে হবে। যিশু কি কোনো সাপ্লাই চেনের মালিক?
- তাহলে?
- চমকাবেন না। যিশুর নিজের বিয়ে হচ্ছিল খফ্র কানানে, মেরী মাতার সামনে।
ব্লাসফেমির বাংলা কি? ধর্মের নিন্দা বা সমালোচনা করা? পাঠক, আপনার মতন আমিও চূড়ান্ত অবাক হয়েছিলাম। মনে রাখুন এই বার্তা বিনিময়ের সময়কাল ১৯৯১ সালের অক্টোবর। ড্যান ব্রাউন তাঁর দা ভিঞ্চি কোড বইটি লেখা শুরু করেন নি।
- যিশুর বিবাহ? কার সঙ্গে?
- খফ্র কানা হতে বিশ মাইল দূরের এক গ্রামের একটি কন্যার সঙ্গে।
- কোন গ্রাম? সেই কন্যার নাম কি?
- সঠিক হিব্রুতে গ্রামের নাম মিগদাল তবে লোকমুখে আজও মাগদালা নামে পরিচিত।
- আর সেই কন্যা?
- মারিয়া মাগদালেনা। খুব অবাক হচ্ছেন? চিন্তায় পড়ে গেলেন? ভাবছেন আজে বাজে, ভিত্তিহীন গপ্প বলছি? তাহলে বাকিটুকু শুনুন।
‘আপনি বললেন যিশুর জীবনের শেষ সাত দিনের কাহিনি আপনার ছেলে মেয়ের স্কুলের বইতে পড়েছেন। তাঁর জেরুসালেম প্রবেশের ঠিক আগের দিনটায় তিনি কোথায় রাত্রিবাস করেন? আপনি নিশ্চয় জানেন, বেথানি গ্রামে, তাই তো? সেখানে রাতের রান্নাটা করলো কে? গসপেল অনুযায়ী মারিয়া বা মেরী মাগদালেনা! তিনি হঠাৎ সে রাতে কেমন করে বেথানিতে আবির্ভূত হলেন? যিশু তো তাঁর শেষ যাত্রায় বেরিয়েছেন বারো জন শিষ্য নিয়ে। মাতা মেরী তাঁর পুত্রের গতি বিধির খবর রাখছিলেন (নাজারেথ থেকে জেরুসালেম দিন তিনেকের হাঁটা পথ) কিন্তু নাজারেথের অন্য কোন পাড়া পড়শি আসেন নি, এলেন মাগদালেনা? যিনি লাস্ট সাপারে অনুপস্থিত কিন্তু বেথানিতে রান্না করলেন?
আচ্ছা তুরিনের সেই চাদরের কথা আপনারা জানেন যা দিয়ে এক মহিলা যিশুর রক্তাক্ত ঘর্মাক্ত মুখ মুছিয়ে দিয়েছিলেন, চাদরে পরিষ্কার ফুটে উঠেছিল সেই মুখের ছবি। মুখ মোছালেন কে? কোনো গসপেলে ভেরোনিকার নাম আছে কিন্তু তাকে আগে বা পরে আর কোথাও দেখা যায় নি। কোথায় অদৃশ্য হলেন? এই ভেরোনিকা আসলে মেরী মাগদালেনা যিনি পরের দিন যিশুর শূন্য সমাধি আবিষ্কার করবেন।
প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ নয়, লোকমুখে প্রচলিত কাহিনির ভিত্তিতে প্রথম গসপেল লেখা হয়েছিল যিশুর মৃত্যুর কম করে ষাট বছর বাদে। তারও আড়াইশ বছর পরে নিসিয়াতে ক্রিস্টিয়ান বাইবেলের খসড়া এক সম্পাদক মণ্ডলীতে সর্বসম্মতি ক্রমে অনুমোদিত হয়। সে কথা না হয় থাক, কিন্তু এখানে সেখানে মেরী মাগদালেনার উপস্থিতি সকলেই স্বীকার করেছেন। একবারে মেল ডমিনেটেড শিষ্য গোষ্ঠীর আশে পাশে সতত সঞ্চরময়ী কে সেই মহিলা? সহচরী না সহধর্মিণী?’
মাথা ঝিমঝিম করছিল। এগুলো কি তাঁর বানানো গুল? কোন আব্রাহামিক ধর্মের মানুষ নই, অনেক দূর দেশের এক বোকাসোকা মানুষ বলে নির্ভয়ে কিছু গাল গল্প ছাড়লেন? কনস্পিরেসি থিওরি? বাইবেলকে ইতিহাস হিসেবে আগেও সম্মান করেছি কিন্তু দাভিদের পাঠশালায় সেই ইতিহাস চর্চার একটা অন্য দিগন্ত খুলে গেলো। প্রাপ্ত প্রজ্ঞাই (রিসিভড উইসডম) শেষ কথা নয়।
‘আপনাকে আজ গেথসেমানের অলিভ পাহাড়েও নিয়ে যাবো। সেখানে যে মেরী মাগদালেনা হাজির ছিলেন না সেটা অবধারিত সত্য!’
তিনি যখন গাড়ি থামালেন আমরা হিব্রু ইউনিভারসিটির বিশাল চত্বরে পৌঁছে গেছি, অনেকটা দূরে দেখা যায় গেথসেমানে। ডানদিকে ডোম অফ দি রকের সোনালি গম্বুজ।
জেরুসালেম!
পুঃ
এক
ঠিক বত্রিশ বছর আগে দাভিদ আমার চির কৌতূহলী মনের ভেতরে অনেক প্রশ্ন জাগিয়েছিলেন। বাকি জীবনে জবাব খুঁজেছি। দু দশক বাদে দা ভিঞ্চি কোড পড়ে বিশেষ অবাক হই নি, বরং মনের জানলা খুলে গেছে। তারপর তো গুচ্ছের বই পড়লাম, প্রভাঁসের বুশ দু রোঁন, কামারগে তিন মেরীর চার্চ দেখেছি (সেখানেও মেরী মাগদালেনা!) আরেক প্রসঙ্গের নাম - মোসেস কি মিশরীয় ছিলেন? সেটা ইসরায়েল পর্বে অবশ্য আসে না তিনি সেখানে প্রবেশাধিকার পান নি।
ওহ কিসসা ফির কভি!